আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

হরপার্বতীর প্রেম

পর্যালোচনা

আর্য সারথী 

  

মহিষাসুরমর্দিনির মিথ বা সেই সংক্রান্ত ভাব বঙ্গের নিজস্ব নয়। এই মিথ বৈদিক। বঙ্গদেশ সাংখ্যের পুরুষ ও প্রকৃতির অভিন্নতার তত্ত্ব ধারণ করে। সাংখ্য কিম্বা তার উত্তরমুখে শ্রীচৈতন্যের অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্বে জীবের অন্দরে পরম আর বহিরঙ্গে প্রকৃতির রূপমাধুরীর ডিসকোর্স এখানকার ভাব-বস্তুর যুগল লীলায় সক্রিয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেম এই ডিসকোর্সের। রাধাকৃষ্ণের মিথের চেয়েও পুরানো হরগৌরী কিম্বা হরপার্বতীর মিথ। যা অবৈদিক বঙ্গের নিজস্ব। আর তাই আজ মহাষ্টমীতে এই লেখাটি প্রকাশ করছে প্রতিপক্ষ।

– সম্পাদকীয় বিভাগ, প্রতিপক্ষ



এক পিরিত ভবানীর সনে
করেছিল পঞ্চাননে।
নাম রহিল ত্রিভুবনে
কিঞ্চিৎ ধ্যানে মহাদেব সিদ্ধি।”  

-ফকির লালন শাহ

হরপার্বতীর প্রেম— কথাটা শুনতে বেশ একটু ‘হারানো দিনের’ বাঙলা সিনেমার আমেজ তৈরি হয়। কটাক্ষ করছি না যেহেতু ওগুলো আমারও বেশ পছন্দের কিন্তু উপমার অভাবে তুলনা দিচ্ছি। হরপার্বতীর  প্রেমে যেমন মন দেওয়া নেওয়া আছে তেমনি আছে লড়াই। এই লড়াই তথাকথিত ‘রোম্যান্টিক’ সিনেমার মতো জগতের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, এই লড়াই সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াই। সহজ কথায়, তাঁদের লড়াই সমাজ ও জগতের বিরুদ্ধে নিজেদের  প্রেম  প্রতিষ্ঠার লড়াই নয় বরং সমাজ ও জগতের সুরক্ষার মাধ্যমে নিজেদের  প্রেম প্রকাশের লড়াই। এই লড়াই দেব-দানবের বাইনারীকে খারিজ করে দিয়ে মহাদেব বা প্রকৃত মানুষ হবার লড়াই। আমরা আমাদের অবচেতনে একেই আদর্শ মনেকরি। তাই আজও আমাদের প্রেম সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা ও প্রস্তাবনাকে হরপার্বতীর মাঝে খুঁজে বেড়াই। আমরা চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে ময়লা কাপড়, কাঁধে বইখাতা ভর্তি ঝোলা এবং মনেমুখে আমদানীকৃত তত্ত্বের বাঙলায় যাকে দর্শনচর্চা বলি তার চেয়ে ভাল ধরনের অভিজ্ঞতা হরপার্বতীর দ্বারা লাভ করা সম্ভব।

হরপার্বতীর মিলন সংক্রান্ত গল্পে সাংখ্যের পুরুষ-প্রকৃতির তত্ত্ব হাজির আছে। আমরা যদি হর ও পার্বতীকে বিচ্ছিন্ন আকারে বুঝতে যাই তাহলে আমরা জ্ঞানলাভ করতে পারব না বা সত্যকে অনুধাবন করতে পারব না। খেয়াল রাখতে হবে এই সত্য কিন্তু ট্রুথ নয়। (জড়)বস্তু ও  চেতনার মাঝে যদি আমরা বিভাজন রেখা টানি তাহলে জ্ঞানতত্ত্বের দুটো ভুতুড়ে পক্ষ তৈরি হবে। একদল কেবল বস্তু খুঁজে বেড়াবে আর আরেকদল কেবল ভাব খুঁজে বেড়াবে। অথচ জগতে রয়েছে ভাব ও বস্তুর লীলা। আলাদা করে কখনই ভাব ও বস্তু বোঝা যায় না। কেননা,  জগতে আমাদের চাওয়ার মত করে এদের বিচ্ছিন্নতা  থাকে না।  বস্তু ও ভাবের যুক্ততা দ্বন্দ্ব আকারে জগতে বিরাজমান। ভাব ও বস্তু এক হয়েও আলাদা আবার আলাদা হয়েও এক। তাই ব্যাপারকে অনুধাবন করে আমাদের স্থায়ীভাবে ত্রিতাপ দূরীকরণের কাজ করতে হবে বা পারময়ার্থিক কাজ করতে হবে। এখানে বুঝে নেওয়া দরকার পারমার্থিক কাজ বলতে চোখ-মুখ বন্ধ করে বসে থাকা নয়,পারমার্থিক কাজ মানে নিজের মাঝে পরমকে হাজির করা। নিজের মাঝে পরমকে হাজির করার মাধ্যমে নিজের কুপ্রবৃত্তি দূরীভূত হবে এবং চারপাশের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে। আমরা ভালভাবে যদি খেয়াল করি তাহলে দেখব এই ব্যাপারটা হরপার্বতীর মিলনের সঙ্গে কতটা সমার্থক। হরপার্বতীর মিলন সংক্রান্ত গল্পে সাংখ্যের পুরুষ-প্রকৃতির তত্ত্ব হাজির আছে । তবে এই সাংখ্যের সম্পর্ক বিচার করতে গিয়ে যদি সাংখ্যশাস্ত্রের তত্ত্বগুলো এক এক করে মেলাতে চাই তাহলে হতাশ হতেই হবে। কারণ সাংখ্যতত্ত্ব বইপত্রের চেয়ে অনেক বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির আছে। তাছাড়া শুধু সাংখ্যতত্ত্বই আছে এমন নয়, আরও অনেক কিছুই আছে।  হরপার্বতী বোঝেন ভাবভক্তির চর্চা ও জগতের সুরক্ষা। তাই তাঁরা জগতের মা-বাবা। হরপার্বতীর মাঝে আছে চিত্তবৃত্তি নিরোধ সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা কিন্তু  সেই জিজ্ঞাসায় ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তাঁরা নিজেরাই জগতের সাথে প্রতিনিয়ত সম্বন্ধ বজায় রেখেছেন।

মহাদেব বা শিব আজন্ম সাধনা করেছেন  কেবল ভগবতীর প্রেমলাভ করার জন্য আর ভগবতী   সাধনা করেছেন  মহাদেবের প্রেমলাভ করতে। হরের বাসনা পার্বতীর  দাস হতে এবং পার্বতীর চাওয়া কেবল হরের দাসী হতে। দাস আর দাসী হওয়াতেই যে সাধনার পরিপূর্ণতা তা কেবল ওই দুজনেই বোঝেন। বাকিরা কতকিছু যে চায় তার ইয়ত্তা নেই। মদনভস্মের পর দাস-দাসী হওয়ার পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। শুরু হয় মহাদেব ও ভগবতীর অপার্থিব সঙ্গম। সেই সঙ্গমের ফলে জগৎব্যাপী অদ্বৈতের নীললোহিত জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে। বিন্দু আর বিসর্গ মিলে গিয়ে হংসমিথুন হয়ে লীলা করে আর সেই লীলায় ‘সোহং’ ধ্বনিত হয় বারবার। রসিকজন কেবল বুঝতে পারে, হংসমিথুন লীলা করে যে মহানন্দের শব্দ ‘সোহং’ নির্গত করেন তা আসলে ওঙ্কার ধ্বনি মাত্র। তাঁদের লিঙ্গযোনির মন্থনেই সেই অনাদির আদি নাদ ওঙ্কারের উদ্ভব। কেননা, ‘হংসঃ’ আসলে ‘সোহং’ আর ‘সোহং’ হলো ‘ওঁ’। মিলনান্দে যে শব্দ ‘ওঁ’ ধ্বনিত হয় তাই জগতে অদ্বৈতের বর্ণ নীললোহিত রূপে দেখা দেয়। ‘ওঁ’ সকল বর্ণের অতীত হলেও এই জগতে নীললোহিত হয়েই হাজির হয়। শক্তিস্ফূরণের লোহিত এবং প্রজ্ঞা প্রকাশের নীল মিলিত হয়ে নীললোহিত রূপে প্রকাশিত হয় ও জগতে মহামিলনের বার্তা দেয়। তন্ত্রে কিন্তু প্রবেশ করে গেলাম কথায় কথায়। অথচ বুঝতেই পারলাম না। কিন্তু চতুর লোকে এসব বুঝবে, তাই এতে খুব তীর মারার গৌরব নেই৷ বিচক্ষণ হলে বলবে, আমরা সহজিয়া মতের সফরও কিঞ্চিৎ করে ফেলেছি৷ শিব-পার্বতীর প্রেমের গল্প করতে গিয়ে সাংখ্য, তন্ত্র ও সহজ মতে ঘোরাফেরা হয়ে গেছে।

সাংখ্য বলি, সহজিয়া বলি  আর তন্ত্র বলি অর্থাৎ এই অঞ্চলের প্রধান দর্শনগুলোর মধ্যে যার নামই বলি না কেন হরপার্বতীর প্রেমের কাছে এসে সব কেমন মিলেমিশে শরবৎ হয়ে যায়। সিনেমার সংলাপের মতো করে বললে : ভালবাসার শক্তি৷ তা সে যাই হোক, ব্যাপারটা অনেক আকর্ষণীয় এবং অবশ্যই নমস্য। ভালবাসার জোর কতখানি যে একেবারে একদেহে লীল হয়ে যায়।  অর্ধেক গৌরীদেহ, কস্তুরিচন্দন বিলেপিত। অপর অর্ধেক হরদেহে শ্মশানভস্মের বিলেপন। নীললোহিত, হংসমিথুনের আলাপ দ্বারা একে বুঝে নিলেই হবে।  বঙ্গে অঞ্চলের অর্ধনারীশ্বরের তর্কটা একদেহে লীন হওয়ার মামলা। শিব ও পার্বতীর ভালবাসা এতখানি যে এঁরা একদেহ একপ্রাণ হতে পারে। আর হবে নাই বা কেন জগতের সার্বিক কল্যাণ করতে দুজনে কাজ করে যাচ্ছে। এমন যাদের মানসিকতা তাঁদের হয়ত মিলতে বাধা নেই। আর আদতে দুই রূপে দুজনেই এক, অভিন্ন।

কলকাতার আহিরিটোলায় গঙ্গার ঘাটে অর্ধনারীশ্বর ও তার পূজারী। ছবি: অতনু ও রূপসা

           

Share

2 thoughts on “হরপার্বতীর প্রেম”

  1. খুব সুন্দর লিখেছেন। মহাদেব তথা শিব অত্যন্ত জনপ্রিয় দেবতা। তাঁর এই জনপ্রিয়তা জাতি ও সম্প্রদায়ের বাইরে যেয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। বৈদিক পূর্ববর্তী যুগের অনার্য দেবতা রুদ্র যে পরবর্তী কালের অত্যন্ত জনপ্রিয় দেবতা শিব রুপে ফিরে এসেছেন এ ব্যাপারে বস্তুবাদী ঐতিহাসিক দের সুচিন্তিত গবেষণা আছে।স্বর্গলোকের দুঃখহর দেবতা রুদ্র সেই সব পূজা উপাচার গ্রহণ করতেন যে গুলো অন্য দেবতারা ঘৃণা করতেন। আসলে মানবজাতি এক সর্বনিয়ামক মহামানবের প্রতিক্ষায় আছে আমরা মুসলমানরা যেমন হযরত ঈমাম মাহদী ( আল্লাহ পাক তাঁর প্রকাশ তরান্বিত করুন) এর প্রতিক্ষাতে আছি। পুরুষ ও প্রকৃতি এক হয়ে গেলে যুক্তিশাস্ত্রের ভিত্তিমূল ভেঙ্গে পড়ে। পুরুষ তার প্রয়োজনে প্রকৃতির স্রষ্টা বা প্রকৃতির স্তব গানের জন্য পুরুষের সৃষ্টি হয়েছে এমন কিছু হতে পারে।

  2. জগতের মাঙগলার্থে হর পার্বতী দুই জনেই কাজ করে চলেছে এটা তুমি কিভাবে জেনেছ??? শিব পার্বতী মূলক মেগা সিরিয়াল গুলো দেখে | বাস্তবের মার্টিতে এর কি উদাহরণ ? কি ভাবে কি পাচ্ছ জবাব দেও ? 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top