।। তানভীর মুহাম্মদ ।।
“আমি কিভাবে যেন কোথায় গিয়ে নদীর ধারের সেই অসীম শূন্যতাবোধের মাঝে একাকার হয়ে গেলাম। আমার বারবার নতুন করে মনে হইতেছে লাফিয়ে পড়া এই ছেলেটা আমিই। আমার মাথাই ফেটে গিয়ে রাস্তায় মাখামাখি হয়ে গেছে। তাতে কার কেমন বেদনাবোধ হইতেছে তা নিয়ে আর কোনও ভাবনা নাই আমার, মুক্ত আমি; আমি স্বাধীন। এই কঠিন জগতের শক্তকঠিন মন আমার হয়ত কোনোদিনই ছিল না; আমি কোনোদিন বোধ করি নাই অপর একজনকে হারায়ে দিয়ে নিজেকেই জিতে নিতে হবে।”
হৃদয়, বৃষ্টিরও আগে
দেরিটা তাহলে শেষমেশ শওকতের জন্যই হইল। গত সন্ধ্যায় আমি যখন তাকে আবহাওয়া অধিদফতরের বরাত দিয়ে সকাল সকাল কাজটা সেরে ফেলতে বললাম, কারণ দুপুর থেকে আকাশ মেঘলা থাকবে, কারণ বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে তাতে সে যথেষ্ট গা করছে বলে এখন আর মনে হইতেছে না। তখন কিন্তু অতি উৎসাহে একদম ভরকেন্দ্র হারায়ে ফেলার দশা। অদ্ভুত লোক। বলে কিনা আমি যদি ঘুম থেকে উঠতে দেরি করি তাহলে সে নিজ দায়িত্বে আমার দরজায় এসে জোর করে ঘুম থেকে টেনে তুলবে তারপর মালামাল ভ্যানে তোলা শুরু করে দিবে। তার ক্যান মনে হইল আমি বাসা পাল্টানোর দিনেও এমন বেদিশা ঘুমে হারায়ে থাকবো সেই সম্পর্কে আমার কোনো আন্দাজ নাই। হইতে পারে আমি যেদিন তাকে বললাম মামা আপনে যে রাতদিন এতোগুলা মাল টানেন তাইলে ঘুমান কখন তাতেই সে ধারণা করে নিছে আমার জীবনে ঘুমের গুরুত্ব কতোখানি অথবা এমনও হইতে পারে যে আমার চেহারায় সত্যরূপে জেগে থাকার কোন নিদর্শনই সে দেখতে পায় না। আমি আমার কম্পিউটার, বৈষয়িক জিনিসপত্র এবং আর্টওয়ার্কের যাবতীয় বিষয়-আশয় গোছগাছ করে বক্স খাটটা পর্যন্ত টুকটাক করে খুলে ফেললাম। ঘড়িতে বেলা হয়ে আসতে আসতে কখন বারোটা বেজে গেল অপেক্ষার তীব্রতায় তাও বুঝতে পারলাম না। আবারও ফোন করলাম, করতে থাকলাম। একসময় সে রিসিভ করে বললো, মামা দরজা খোলেন না ক্যান। কলিংবেলও তো খুইলা ফেলছেন এখন দরজার দিকে একটু খেয়াল করবেন না? আমি কোনও কথা তেমন আর খুঁজে না পেয়ে খুললাম দরজা। ঘাড় কাত করে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়ে থাকলাম। সে বলল আপনি বুঝবেন না কী হইছে, আপনি ঘরে ছিলেন যা দেখার দেখছি তো আমি। আর বাইরের ওই মানুষজন। আমি তখনও তার অজুহাতে তেমন কোনো আগ্রহ পাইলাম না। এমনিই বললাম কী হইছে বাইরে? বলে মজগ বাইর হইয়া ছ্যাঁত কইরা রাস্তায়…আমি খালি দেখলাম দেওয়ালের মধ্যে ছিট্টা গেল। এরপর কি গলা দিয়া আর সাউন্ড বাইর হয় কন? আপনারে দেইখা এখন একটু বাইর হইতাছে। প্রেম নাকি কী এগুলা, একটা শান্তশিষ্ট পোলা ছাদ থেকা লাফ দিয়া পড়ল নীচে। আমি চোখের পলক ফেলতে ফেলতে ধীরেসুস্থে বারান্দায় গিয়ে হাজির হই। দেখি আমার সদ্য ছেড়ে দেওয়া এই বাসার সোজাসুজি রাস্তাটা যেই বাড়ির ধার দিয়ে বড় রাস্তার দিকে বাঁক নিছে তার সামনে অনেক কৌতূহলী মানুষের ভিড়। এই রাস্তা ধরেই আমাকে এখন মালামাল ভ্যানে তুলে নিয়ে ছুটতে হবে নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে।
আকাশ এখনও রোদে ঝলমল করতেছে। বারান্দা থেকে ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, দ্যাটস ভেরি গুড ফর মি। আমি বৃষ্টিতে ভিজি কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু আমার একটা খাট, যার বয়স প্রায় শতবর্ষ হইতে চলল তার অযথা ক্ষয় ঘটবে হঠাৎ এক হালকা বৃষ্টির কবলে পড়ে তা হয় না। অথচ এই একশ বছরে কতো না ঝড় বয়ে গেল পৃথিবীর উপর দিয়ে; শওকতের বর্ণনার সেই শান্তশিষ্ট ছেলেটার উপর দিয়েও। মানুষ হিসেবে এই পরম্পরা ধরে রাখার দায় আমি নিতে চাই না। তাও… অন্তত কতো দীর্ঘ সময় তো চড়ে আসছে এই খাট। সেজন্যই একে আমার এত পছন্দ। পুরাতন বলতে আর আছে একটা কাঠের আলনা, যার ভিতর দিয়ে কায়দা করে কাপড় বের করতে আমার এখনও ভালোলাগে। আম্মারও ভালোলাগতো। একেও আমি হেঁচকা বৃষ্টির কবলে ফেলতে চাই না। কিন্তু আজকের দিনটা অপেক্ষা করা যাবে পরিস্থিতি দেখে তেমনটা মনে হইতেছে না। এই বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া বিকালের আগেই চলে আসবে। তারা আমার আর তানিশার যৌনতার স্থানগুলোতে হয়তো ভাত রাঁধবে তারপর সবাই মিলে খাবে। খুনসুটির সময় তানিশা আমার খাটে শুইতে চাইতো না। বলতো তোমাকে আমার ইনট্যাক্ট লাগবে, তুমি নিজের সঙ্গে তোমার নানা-নানু আব্বু-আম্মু বন্ধুবান্ধব এবং পুরাতন প্রেমিকাদের স্মৃতি গুলায়ে ফেলছো। এতে আমি ডিস্টার্বড হই; আমি চাই তোমার ইতিহাস তোমার থেকেই শুরু হবে ব্যস, আর কেউ থাকবে না। আমি জানি তুমিও তাই চাও কিন্তু এই খাট বিদায় না দিলে সেটা কোনওদিন হইতেছে না জেনে রাইখো। তখন নিরুপায় হয়ে অন্য কোথাও…। আমি বেজার মুখে হাঁটা দিলে পিছু পিছু এসে ঝুলে পড়ে বলতো “তোমাল গলাতা আমি খেয়ে ফেলবোওওওও”। আবার সবশেষে খাটে ফিরে আমরা বড়দের মতোন ভবিষ্যৎ বিষয়ে গম্ভীর আলাপ জুড়ে দিতাম হু-হা করতাম। সেখানে আগত ফ্যামিলির বড়রা চুপিসারে সঙ্গম সেড়ে নিবে। হতেই পারে; মানুষের বিচিত্র দশা। তাতে স্থানের গুরুত্ব সামান্যই। কিন্তু যেই ফলস ছাদে উঠে আমরা দুইজন একবারে ছোটবেলার মতন, বসা যায় না দাঁড়ানো তো দূর এমন এক গোপন বাসা নির্মাণ করছিলাম তাতে যেন ওরা সর্বোচ্চ মালামালই রাখে সেই আশাটুকু এখনও করি। ওদের বাচ্চারা যেন অন্য কোনো বাচ্চার সঙ্গে সেখানে গিয়ে মিছেমিছি সংসার না পেতে বসে। স্থান মাঝেমধ্যে অনেক গুরুতর বিষয়, ওদের মাথায় বিকল্প হিসেবে এই জায়গাটুকুর চিন্তা আবির্ভূত না হলেই আমাদের যুগল স্মৃতিটা অন্তত ওখানে স্বয়ম্ভর বিরাজ করতে পারে। আমার এতসব ভাবনা-চিন্তার ফাঁকে শওকত কখন যেন নীচে চলে গেছে। সম্ভবত কৌতূহলী জনতার ভিড় থেকে তার মাল টানার সাথীকে টেনে বের করে আনতে।
সরি মামা। একটা দুর্ঘটনা ঘটছে তো এইখানে তাই সময়মতো আসতে পারি নাই। আমি দেখলাম সাদাপাকা দাড়িওয়ালা একজন লোক আমার কাছে পরিষ্কার হইল অজুহাতের মাধ্যমে, খুব সাধাসিধাভাবে হাঁটেন উনি দাঁড়ানও খুব বিশুদ্ধ। ঢুকে খেয়াল না করাতে তার পেছনে খোলা মেইন দরজা ধাম করে লেগে শব্দ করলো দেয়ালের সাথে। শওকত মনে হয় একটু বিরক্ত হই্লো, হোইত ছ্যারার ঘরে ছ্যারা মামায় খুব ফিরি মানুষ, তুই এরুম চাবায়া চাবায়া কথা কইতে লাগছোস ক্যান রে? ধর দেহি আগে কাটুনডি তোল। তারপর একটু বয়স্ক মামা কোমরে বাঁধা গামছা খুলে নিয়ে হাতে পাঁক দেওয়া শুরু করলেন, গামছার সেই কুণ্ডলী মাথায় সেট করতে করতে বললেন মরণ দেহা অত কি সোজা কাম নাকি? আমি বললাম লাশ কোথায় এখন? উনি এখন আস্তে আস্তে একটু সহজ হয়ে বোধহয় নিজস্ব টোন ও শব্দে প্রকাশ হইতে শুরু করলেন। তাগড়া জোয়ান শওকত তাতে একটু হালকা বোধ করল। তিনি বললেন লাশ নেয় নাই এহান তে, পড়ার পরে নড়তাছিল শ্বাসও নিতাছিল তারপর নাকি ঢাকা মেডিক্যাল নিয়া গেছে। আর কোনও খবর এহনও আসে নাই। অলরেডি লাশ যদি হইয়া থাকে হেই লাশ মেডিক্যালেই থাকার কথা। আমি আবারও বারান্দায় এসে দাঁড়াইলাম। পেছন থেকে শওকত উঁকি দিয়ে বললো, রক্তে ভাইসা গেছেগা, হের চারিপাশে ইট দিয়া ঘেরাও দিয়া থুইছে। আমি নিরেট সহানুভূতি জানাইতেই পেছনে তাকাইলাম। দেখি যে শওকত এই কথাটুকু বলার জন্যই উঁকি দিছিল এখন আবার নাই, কাজে ব্যস্ত। ঘটনাস্থলের কোনও শব্দ এখান থেকে পাওয়া যাইতেছে না। অবশ্য ওখানকার সব মানুষ শোকের আবহে কথাও বলতেছে খুবই ফিসফাস। আমি শুধু ঘরের ভেতরের শব্দগুলা পাইতেছি “ওই ছ্যারা পাঙ্খাডা তোল ডানপাশ দিয়া। আর মামায় যে খাটটারে এমন দেয়ালের লগে মিশাইয়া রাখছে এইডার জানে কি আর পানি আছে নাকি। সব পানি তো দেওয়ালে খাইয়া ফালাইছে। ক এইডা কোনও বুদ্ধির কাম?”…তখন ওইপাশ থেকে বয়স্ক মামা বলেন একা মানুষ না? তুই কাম কর ছ্যারা, ঘন কথা কইস না।
তানিশা আজকে বাসায় থাকলেও পারতো। আমাদের গত তিনমাস দেখা হয় না, তাতে করে এমন সূত্র তৈরি হবার কথা নয় যে ও আমাকে বাসা গোছগাছেও হেল্প করবে না। অন্তত জিনিসপত্রে তার উপস্থিতিটুকুন তো থাকতো, যেভাবে সে নিজেও ছিল আমার সাথে এই বাসায়, দীর্ঘ সময়। আমি কোন অর্থে একা মানুষ তার দিক বিবেচনা করে নিশ্চয়ই মামা মন্তব্যটি করেন নাই। উনি যেটা ধরতে চাইলেন তা হইল একটা বাসা নারী এবং পুরুষ উভয়ে না থাকলে পরিপূর্ণ হয় কিনা। আমি বুঝলাম তার স্পষ্ট উত্তর “না”। তাই তিনি আমাকে একা মানুষ হিসাবে দেখে একটু বেশিই হেল্পফুল হইতে চাইতেছেন। এতে অবশ্য আমার খুব সমস্যা নাই কারণ আমি কারও কাছেই পরিপূর্ণ স্পষ্ট হয়ে থাকতে চাই না। যদি উনাকে বলি আপনি এই মুহূর্তে যেই কার্টুনটা মাথায় তুলতেছেন তার মধ্যকার পুরাটাই আমার বান্ধবীর, তাকে আমি মন থেকে ভালোবাসি এবং সেজন্যই আমাদেরকে সবসময় একসাথে দেখা যাইতেছে না। এই যেমন মাস তিনেক যাবত প্রতিদিন গেট দিয়ে আমি একাই বের হইতেছি কাজে যাইতেছি আবার একা একা ফিরে আসতেছি আবার বের হইতেছি, এতেই আপনি আমাকে একা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু তার আগে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তানিশা কতো জোরে জোরেই না কথা বলতো আমার সাথে। চারদিক থেকে সবাই হা করে তাকায়ে থাকতো। সেই ঘটনাগুলো তো আপনার স্মৃতিতে থাকার কথা। যাই হোক, মামার কাছে এত কৈফিয়ত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ল না কারণ তিনি এইসব নিয়ে ভাববার অবকাশে নাই। একটার পর একটা মালামাল মাথায় তুলতেছেন আর শওকতের সাথে খুঁটিনাটি আলাপ করতেছেন। পূর্ণ অবকাশে তো ছিলাম আমি। যেদিন থেকে বুঝতে পারি আমার ফটোজার্নালিস্ট বান্ধবীটি আমার অগোচরে তার এডিটরের সঙ্গে ইটিশপিটিশ করতেছেন সেদিন থেকেই তো আমার অবকাশ যাপন শুরু। কতকিছু ভাবলাম বুঝলাম, তারপর বললামও কতো কথা তারপর আর কী করার থাকে। সে জিনিসপত্র ব্যাগে ভরতে ভরতে বলতেছিলো হ্যাঁ তোমার সাথে আমি ফলস ছাদে গিয়া একটা বাচ্চা নেই তারপর দুই দুইটা বাচ্চা নিয়া জীবন দুর্বিষহ কইরা রাখি…যত্তোসব! কালকে আফসার কী করছে জানো? আমাকে কোলে করে সুইমিং পুলে নিয়ে গেল, ও জানে আমি পানি ভয় করি তাও আমাকে পানিতে নামায় দিয়ে বলল যেন রেলিং ধরে ঝুলে থাকি আর সাঁতরানোর চেষ্টা করি। বলেই এক ঝাঁপ দিয়ে ভাসতে ভাসতে একদম পুলের গভীরে চলে গেল। আমার কাছে তখন আর কোনো ভরসা নাই, রেলিং শক্তভাবে ধরে জোরে জোরে চিল্লাইতে থাকলাম। বললাম, আমি মরলে আমার জীবনের সব দায় কিন্তু তোমার আফসার! তাও ও বাঁচাইতে আসেনা; আমাকে দূর থেকে আদর দিতেছে, বলে তুমি মরলে আমার জন্যই মরবে এরচেয়ে বড় সুখ তুমি কী চাও বলো? বোঝো অবস্থা। তুমি বুঝবা না হাউ হার্ড ফিলিং ইট ওয়াজ ওওওউফ! তুমি তো একটা আস্ত কোমল। তোমাকে দিয়া আমার আর কিচ্ছু হবে না। আমার একমুহুর্ত ইচ্ছা করলো ওরে আমি শক্ত দড়ি দিয়ে বারান্দার রেলিংয়ের সাথে বেঁধে রাখি এবং সারাদিন সারারাত উপোস রেখে শুধুমাত্র আমার নিঃসৃত লালা খাইতে দেই—তারপর বুঝুক হাউ হার্ড ফিলিং ইট ইজ। মরতে হলে শুধু আমার লালা খেয়েই মরতে হবে ওর আর আমার জন্য এরচেয়ে বড় সুখ আর কী চাই হাহা। কিন্তু পরমহুর্তেই আমার সেটা আর ইচ্ছা করলো না। হাঁটতে হাঁটতে লিভিং রুমে গিয়ে ডেডলাইনে থাকা একটা স্কেচে কাজ করতে থাকলাম। মনে মনে অবশ্য দেখতে থাকলাম ও কিভাবে বের হয়। সেই যে তানিশা নিশ্চুপ বের হয়ে গেল আমি তার বিপরীতে বারান্দায় গিয়ে দেখতে থাকলাম নতুন সম্ভাবনার দিকে আমার প্রিয়মানুষের যাত্রা। এখন সেই পথ ধরে দৃষ্টি ফেলে রোমন্থন করতে গিয়েই বুঝলাম যেই পথ ধরে তানিশা হেঁটে গেল তার ফেলে যাওয়া পদচ্ছাপের উপরেই এখন ছেলেটার মাথা থেকে ছিটকে পড়া অনেকগুলা রক্ত ছড়িয়ে লেপ্টে আস্তর পড়ে আছে। যেন রক্তেভাসা ওই জায়গাটুকুতে পেছনের ইতিহাস আর নাই। সব বিনাশ হয়ে গেল।
আমার যাবতীয় মালামাল একটা ভ্যানে তুলে একবারে সেখান থেকে বিদায় নেওয়া সম্ভব হইলো না। বেশকিছু জিনিসপত্র আছে খুবই নাজুক, সেগুলোর ক্ষেত্রে একটার উপরে আরেকটা রাখা বারণ। ফলে স্পেস কিছুটা বেশি ব্যবহার করতে হইতেছে। তাতে অবশ্য শওকতের কোনও আপত্তি নাই, এতে সুবিধাই হইছে আমার। আমি ভিড়ের মধ্য দিয়ে ভ্যান আগায়ে দেওয়ার জন্য রাস্তায় তদারকি করতে গেলাম। দেখলাম চারদিক শুনশান। কেউ একটা টু শব্দও করতেছে না। মহিলা যারা আছে সবাই মুখের উপর শাড়ি টেনে নিয়ে তারপর অন্যদের সাথে বাক্যালাপ করতেছে। এই বিষয়ে কার কী অভিমত সেটা ভিড়ের মধ্যিখানে এসেও বোঝার কোনো উপায় নাই। আর পুরুষরা কেউ কারও সাথে কথা বলতেছে না। তারা একবার আড়চোখে রক্ত দেখে তারপর দীর্ঘ সময় আকাশের দিকে তাকায়ে থেকে আবার চোখ নামানোর আগে ক্ষণকালের জন্য উপরের ছাদটি দেখে নিতেছে। বেশ কিছুক্ষণ এরই মধ্যে হয়ে গেছে ছেলেটা লাফ দিয়ে নীচে পড়ল কিন্তু এই এত্তোগুলা জমাট বেঁধে থাকা রক্ত তার উপর ফোঁটা ফোঁটা ছিটে থাকা অনেকদূর পর্যন্ত তার চিহ্ন এখানের মানুষদেরকে এই বেদনা থেকে কিছুতেই মুক্তি দিতেছে না। একটু পরপর নতুন কেউ আসলেই বেদনার্তদের মধ্য থেকে কেউ একজন পুরো ঘটনাটা তাকে শোনায় তারপর আগত সেই ব্যক্তি অনেকক্ষণ সেখানে নিশ্চুপ দাঁড়ায়ে থাকে। আমি যখন তাদেরকে বললাম আপনারা প্লিজ একটু সড়ে দাঁড়াবেন, তখন তারা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাইল। এমন দুর্ঘটনার দিনে কারও বৈষয়িক কাজ থাকতে পারে তারা সেটা ভেবেই পাইতেছে না। আমি যতোটুকু সম্ভব শোকের অনুভূতি চেহারায় ছড়ায়ে রেখে তাদের থেকে জায়গা নিলাম এবং বহুকষ্টে সেই রক্তের পাশ কাটায়ে ভ্যান বের করে নিতে সক্ষম হইলাম। পেছন ফিরে দেখলাম ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ঠিক যেই দোকানের সামনে পিচের উপরে পড়ে ছেলেটা ছিটকে গেল, সেই দোকানের ক্যাশকাউন্টারে বসে দোকানদার ‘জাহানারার জামাই’ মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবতেছে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্যটা এখানকার যাদের যাদের হজম করতে হইতেছে জাহানারার জামাই তাদের মধ্যেই একজন…তাকে আমি চিনি। সর্বক্ষণ চিল্লাচিল্লি হাসাহাসি করতে থাকা উত্তেজিত এই লোক, দোকানের মধ্যে তার এইরকম নির্বাক ব্যথাতুর বসে থাকার চেহারাটা আমাকে বিরাজমান বেদনার স্রোতে সর্বপ্রথম এক করে নিল। বুকের মধ্যে যেন কিরকম অনুভূত হইতে শুরু করল আমার।
আচ্ছা, আমি তাহলে। যাই। রক্তের দিকে তাকায়ে থেকে আনমনা ভঙ্গিতে আমার পুরাতন বাড়িওয়ালাকে বিদায় জানাইলাম। মালামাল নিতে নিতে বেলা প্রায় পড়ে আসতেছে। সওদাগর বাড়িতে ভাড়া থাকার সময় এখনকার মতোই সন্ধ্যা হওয়া সকাল হওয়া আমার বিশেষ প্রিয় ছিল। এই বাড়ির নেইমপ্লেটটাও হয়ত আমার এই উদযাপনের সঙ্গে অদ্ভুত মানানসই হয়ে উঠছিল অজান্তেই; আরও কতকিছুর সাথে যে জড়ায়ে আছে ফেলে আসা দিনগুলি। আর বিদায় নেবার কালে কেবলই রক্তের দিকে তাকায়ে বিদায় নিতে হইতেছে আমার। চারপাশের একটা মানুষের মন ভালো নাই। তবুও, জাহানারার জামাই শওকত খাম্বার সাথে বসে থাকা সিগারেটের দোকানদার এবং আরও যারা যারা হঠাৎ এই ছিটকে পড়ার মুহূর্তটা স্বচক্ষে দেখে ফেলছে, একটা মানবদেহ উড়ে এসে ছিটে পড়ার বাতাসটাও যাদের গা বেয়ে অতিবাহিত হইছে— তাদের ভেতরের আর্তি অন্যদের থেকে কতো যে আলাদা। আমি কিভাবে যেন কোথায় গিয়ে নদীর ধারের সেই অসীম শূন্যতাবোধের মাঝে একাকার হয়ে গেলাম। আমার বারবার নতুন করে মনে হইতেছে লাফিয়ে পড়া এই ছেলেটা আমিই। আমার মাথাই ফেটে গিয়ে রাস্তায় মাখামাখি হয়ে গেছে। তাতে কার কেমন বেদনাবোধ হইতেছে তা নিয়ে আর কোনও ভাবনা নাই আমার, মুক্ত আমি; আমি স্বাধীন। এই কঠিন জগতের শক্তকঠিন মন আমার হয়ত কোনোদিনই ছিল না; আমি কোনোদিন বোধ করি নাই অপর একজনকে হারায়ে দিয়ে নিজেকেই জিতে নিতে হবে। কিন্তু এই খবরদারি না আসাটাই যখন জগতের অন্যদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায় তখন একমুহূর্তের এই ফেটে পড়া কতো যে শান্তির কতো যে মুক্তির সেটা আমি, শওকত, জাহানারার জামাই শামীম এবং সিগারেটের দোকানী শিহাব- আমরাই অনুভব করতে পারতেছি। পারতপক্ষে এই কেউই কারওদিকে তেমন তাকাইতেছি না আর। যেন আমাদের মৃত্যু হয়ে গেছে, আমরা এবার নিজেদেরকে নিয়ে নিজেরা যার যার মতো চলে যেতে পারি।
নতুন বাসায় ওঠার পর আরেকটা ঠিকানার সমাগত স্থিতি আমাকে হাতছানি দিতে শুরু করল। মনে হইল প্রতিযোগে না থাকার ফলে যদি আমাকে কেউ জগত থেকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতেই চায় তাহলে সেখানে জেতার প্রতিযোগিতা আমার কার সাথে। আমি তো এমনিতেই আরও মুক্তস্বাধীন। তানিশাকে এখন আর মিস করতেছি না আমি, আমি এমনকি ভাবতেও চাই না আর তার কথা। ও এডিটর এবং আরও যার সাথে যা ইচ্ছা তাই করুক তাতে করে ওকে শাস্তি দেওয়ার তাড়নায় আমি আমার কোমল-পেলব মনকে পাথরে রূপান্তর করে ফেলবো তা হয় না। আমার যতো ইচ্ছা কোমল হবো, জগতের সব কঠিনেরে আমি কোমলতা দিয়ে ঘিরে ফেলতে চাই। আমি চাই আমি শুধু একমাত্র আমারেই ভালোবাসি। আবার বাইরে বের হয়ে আসলাম তখন। বাইরে বৃষ্টির গন্ধ, ভেজা বাতাস বইতেছে। আনমনে বললাম আমি বড় দমবন্ধ অবস্থায় ছিলাম, ওই বাসাটায় আমার যতোটুকু শিকড় গেড়ে গেছিল তাতে এতদিন মুখ বুজে পড়ে থাকাটা ঠিক হয় নাই। নিজেকে ভালোবেসে আমি নিজেকেই এতো সাফোকেশানে কেন রাখি?
ক্লান্তিতে একদম মাতালের মতো লাগতেছে, হাঁটাচলা সুস্থিরভাবে করা সম্ভব হইতেছে না; বাদলা হাওয়ার উল্টাদিকে আমার ফেলে আসা পুরাতন বাসার ঠিকানায় আমি আবার ছুটতে লাগলাম। রাত নেমে গেছে ইতোমধ্যেই। দোকানীরা সব বন্ধ করে টরে চলে যাইতেছে একেকজন। তখন অনেক জোরে বাতাস। আমি টলতে টলতে বড় রাস্তায় এসে উঠলাম। এতদিন, এতোগুলা মাস আমি ওই বাসাটায় থাকলাম, ওইখানের প্রত্যেকটা ইট বালু সিমেন্ট আমার নাম জপতেছে, ওইখানে আর কেউ থাকতে পারবে না। তানিশাও থাকতে পারবে না। আমি আর ছাদ থেকে লাফ দেওয়া আমার ভাইটা আমরা দুইজনে মিলে থাকব শুধু। সামনে দিয়ে অনেক গাড়ি কই যেন ছুটে যাইতেছে। আমার ইশারায় কেউ থামতেছে না। ওরা থামবেও না। আমাকে ওরা যাইতে দিবে না আমার ভাইয়ের রক্তের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। তার আগেই আমাকে পৌঁছাইতে হবে ওর রক্তের কাছে, আমার বেঁচে থাকার একমাত্র পাথেয়; একমাত্র সঙ্গী। আমার একমাত্র স্বতঃস্ফুর্ত ভালোবাসা। আমার খুব গর্ব হইতেছে আমি তার কাছে ফিরে যাইতে পারতেছি। কতো মানুষ কতো ধরণের ছাপ রেখে যায়, কিন্তু কী দারুণভাবে ছাপ রেখে গেল আমার ভাইটা। আজকাল সভ্য শহরের রাস্তায় প্রকাশ্যে কোনো রক্ত এতো দীর্ঘ সময় ছড়ায়ে থাকতে পারে না। শহরে আইন আছে শৃঙ্খলা আছে, রক্ত মুছে ফেলার লোকের অভাব নাই। রক্ত মানুষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, তাই। সভ্য মানুষ অপরকে মেরে সেই দাগও আর রাখতে চায় না এখন। কিন্তু ওর রক্ত কতো দীর্ঘ সময় নিদারুণ দাপটে বিরাজ করল কালো পিচের উপর। কেউ মুছে ফেলার ইচ্ছাটুকুও করল না। খোদা, তোমার বৃষ্টি যেন তাকে ধুয়ে না দেয়। আমার সেখানেই যে ফিরতে হবে। প্লিজ!
তানভীর মুহাম্মদ
লেখক, কথাসাহিত্যিক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার। ১৯৯৫ সালের ২৬ই ফেব্রুয়ারী ঢাকার মনোওয়ারা হাসপাতালে জন্ম। বেড়ে ওঠা তুরাগ নদীর নিকটবর্তী রানাভোলা অতঃপর বাসাবো কদমতলা এলাকায়। সেখান থেকেই কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে হাঁটাহাঁটির শুরু, এবং অবধারিতভাবে দেখার উৎপত্তি। দর্শনের সেই সূত্র ধরে সবুজবাগ, শাহজাহানপুর, দৈনিক বাংলা, পল্টন, মতিঝিল এবং শাহবাগ এবং আরও কিছু…। যুক্ততামাত্রই এঁটে যাওয়া এড়িয়ে আরেকটু দূরের আকাঙ্ক্ষা, উপলব্ধি, জ্ঞান ও নানাবিধ কারণ—ফলত বিযুক্তির অভিজ্ঞান হয়েই অপরের সঙ্গে ভালোবাসা নিয়ে মিশবার আত্মতাড়না। এসব তাকে শিল্পীসত্ত্বার স্থিতি ও ঠিকানা প্রদান করে; সেই ঠিকানা থেকেই তিনি যাবতীয় লেখালেখি ও চলচ্চিত্র উপস্থাপন করতে আগ্রহী এবং নিজেকে প্রস্তাব করতে উদগ্রীব। প্রকাশিত ট্রাভেল-ডকু: ‘সেই কথা আজ বলতে হলো’। প্রকাশিতব্য ডকুমেন্টারি ফিল্ম: ‘বাতাসের ফেনা’।