বংশাই নদীর চক্র বাংলাদশের চাকদহ

গদ্য সাহিত্য

।। জেসমিন নাহার ।।

পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার  চাকদহ জনপদের গল্প জানা গেলেও টাঙ্গাইল জেলার সখীপুরের চাকদহের কেচ্ছা এখনও জানতে পারি নি। এখানে ভগীরথের মতো কারো রথের চাকা দেবে গিয়েছিল কিনা সেটা কেউ জানে না। তাই এই চাকদহ গ্রামের নামকরণ এখনও আবিষ্কার করতে পারি নি। গ্রামের মানুষদের জিজ্ঞাসা করেছি। তারাও জানেন না। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের জিজ্ঞাসা করলে বলেন, চারিদিকে চাক, মধ্যেখানে দহ, চাকদহ। খারাপ না। বংশাই নদীর একটা চক্রই বলা যায় এই চাকদহ গ্রামকে।

বংশাই নদীর চক্র বাংলাদশের চাকদহ

অপূর্ব সুন্দর এক ভাসান গ্রাম চাকদহ। চারমাস পানির উপরে ভেসে থাকে। ছবির মতো। ওর মধ্যে এক মাস কাদায় লেপ্টে থাকে। চাকদহ টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলার অন্তর্গত। এর কর্মমুখরতা সর্বসাকুল্যে ছয়মাস। বর্ষায় মনে হবে ভুলে কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে এসে পড়েছি।

চাকদহের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বংশাই নদী। নদীতে পানি বাড়ার সাথে সাথে এ গ্রামে পানি চলে আসে। বর্ষায় প্রায় ডুবে যাওয়া গ্রামের চারপাশের  প্রাকৃতিক শোভা এ গ্রামকে অপূর্ব সৌন্দর্য দান করেছে।

চাকদহ গ্রামটার নামকরণ নিয়ে আমার কৌতুহল অনেক। তাই এ গ্রামে চাকরি পাবার পরে কখনো চাক আর কখনো দহ নিয়ে চিন্তা মাথায় এসেছে। মাঝে মাঝে আমি নিজেও বইখাতা ঘেটে, গুগল করে নামকরণের ইতিহাস জানবার চেষ্টা করেছি। চাক এবং দহের সঙ্গা তো জানিই আমি। কিন্তু চাকদহ গ্রামের নামকরণ কোন্‌ ব্যক্তি করেছিলেন তা জানবার আগ্রহ প্রচুর৷ আমি যে চাকদহের গল্প বলছি সেটা নদীয়া জেলার প্রাচীন চাকদহ না।

ইক্ষ্বাকু রাজবংশের কিংবদন্তী রাজা ভগীরথ, তিনি গঙ্গা দেবীকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এনেছেন। তাঁর তপস্যায় গঙ্গা স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে আসতে রাজি হলেন। কিন্তু গঙ্গা ভগীরথকে বললেন,  তিনি স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করার সময় তার প্রপাতের প্রচণ্ড বেগ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই ভগীরথের উচিত শিবের কাছে প্রার্থনা করা, একমাত্র  শিবই সেই প্রবল স্রোত  নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।  ভগীরথ শিবের তপস্যা আরম্ভ করেন এং তাঁকে গঙ্গাধারণের প্রার্থনা করেন। শিব আশুতো, অল্পেই খুশি হয়ে যান, তিনি ভগীরথের  প্রার্থনা শোনেন। স্বর্গ থেকে পতিত গঙ্গা দেবীকে তার জটায় ধারণ করেন। গঙ্গা স্বর্গ থেকে আনবার সময় ভীষণ বৃষ্টি হয়েছিল, আর সেই বৃষ্টিতে ভগীরথের রথের চাকা  বসে যায়। তিনি সেই চাকা টেনে তোলেন, তার ফলে এক  প্রকাণ্ড  দহের সৃষ্টি হয়। সেই থেকে নাম হয় ‘চক্রদহ’ । কালে কালে চক্রদহ হয়ে ওঠে চাকদহ।

নদীয়ার  চাকদহ জনপদের গল্প জানা গেলেও সখীপুরের চাকদহের কেচ্ছা এখনও জানতে পারি নি। এখানে কারো রথের চাকা দেবে গিয়েছিল কিনা সেটা কেউ জানবেন না। তাই চাকদহ গ্রামের নামকরণ এখনও আবিষ্কার করতে পারি নি। গ্রামের মানুষদের জিজ্ঞাসা করেছি। তারাও জানেন না। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের জিজ্ঞাসা করলে বলেন, চারিদিকে চাক, মধ্যেখানে দহ, চাকদহ। খারাপ না। বংশাই নদীর একটা চক্রই বলা যায় এই চাকদহ গ্রামকে।

তবে প্রবীণদের কাছে জানতে পেরেছি যে, এই গ্রামে প্রতিবছরই পানি আসে। একজন বললেন তার পঁচাত্তর বছর বয়েসের জীবনে একবারই দেখেছেন ১৯৯৬ সালে পানি আসেনি চাকদহ গ্রামে। চারিদিকে তখন চাষীদের আমন ধান বোনা ছিলো। পানি না আসবার কারণে গরুকে সেই ধানের চারা কেটে খাওয়ানো হয়েছিল। তার উপরে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিলো  ১৯৯৬ সালের ১৩ ই মে। ধানগাছ সব মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো। চাকদহবাসীদের দেখে মনে হয় গ্রামে পানি এলেও ভালো। না এলেও ভাল। পানির প্রতি তাদের উপভোগ অভিযোগ কিছুই নাই। তারা হয়তো ভাবে এটা দূর্ভোগ তাদের জন্য।  তবে আমি যা বুঝেছি তা হলো পানি তাদের আশীর্বাদ। পানি এলে পলিমাটি আসে। ফসল ভালো হয়। পানি বিরক্তির কারণও বটে, স্বাভাবিক ভাবে চলা যায় না। বাড়িতে বন্দী জীবন পার করতে হয়। কিন্তু পানি খাদ্যের যোগান দেয়, তেমনি বহু জলজ প্রাণীর জীবনও রক্ষা করে।

গ্রামে ধীরে ধীরে পানি আসে । পানির সঙ্গে মানুষ ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যায়। পানি আসে ফসল উঠে গেলে। তখন পানি আসবে গ্রাম যেন তার অপেক্ষা করে। পানি আসবার সুন্দর দৃশ্যও থাকে। কিন্তু পানি এবার সুন্দর ভাবে আসেনি। ধান শুকানোর আগেই চলে এসেছে। এবং তা হৃদয়ে দুঃখ জাগালেও পানি আসার দৃশ্য আমার আজীবন মনে থাকবে। পানি তার নিজস্ব গতিতে, নিজস্ব শব্দে আসছিল আর মানুষ ধান কাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। মাঠের যে দিকে চোখ যায় সেদিকে শুধু ধান আর ধান। পানি আসবার শব্দ একদিকে, অন্যদিকে ধান কাটা মেশিনের শব্দ। যারা ধান শুকাচ্ছিলো,  খামারের ধানের কাছাকাছি  পানি আসা মাত্র তারা ধান গোটো করে একটু সরে গিয়ে আবারো ধান শুকাচ্ছিলো। মা বাবারা ধান গোটানোয় আর শুকানোয় ব্যস্ত৷ আর শিশুরা মাছ ধরা এবং পানিতে খেলা নিয়ে ব্যস্ত। আস্তে আস্তে পানি হাঁটু থেকে কোমর, কোমর থেকে বুক এবং বুক পানি থেকে অথৈ পানিতে চলে যায়। বর্ষার বৃষ্টিও শুরু হয়। ধান গ্রামবাসীকে কখনো রোদ আর কখনো বৃষ্টিতে বাড়ির উঠানে শুকাতে হয়েছিলো। এই যে পানি, এই পানির সাথে গ্রামের মানুষ নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এই পানি কাদা তাদের সংগ্রামী করেছে। এই সংগ্রাম কারো  মনকে কঠিন করে তুলেছে,  কাউকে সুযোগসন্ধানী আর কাউকে করেছে সহজ সরল সুন্দর। হুড়োহুড়ি, মারামারি আর ঝগড়াঝাটির মধ্যে গ্রামে সকলেই একতাবদ্ধ।

এই গ্রামে একটা  দাখিল মাদরাসা, একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং নুরানীয়া হাফিজিয়া মাদরাসা আছে। তিনটি মসজিদ, একটা মন্দির রয়েছে। রয়েছে একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অর্ধেক মুসলমান এবং অর্ধেক হিন্দুর বসবাস এই গ্রামে। এখনো পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক কোনো ভেদাভেদ চোখে পড়েনি। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সব মানুষ এখানে সুখে শান্তিতে বসবাস করে।

এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কৃষির উপরে নির্ভরশীল। কিছু জেলে এবং কুমোর রয়েছে৷ বেশির ভাগ বাড়ির এক দুজন মানুষ লেখাপড়া শিখে শহরে। অনেকে গ্রামের মাদরাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করে। তবে সে সংখ্যা নিতান্তই কম। এছাড়াও কিছু মানুষ দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে বর্ষাকালে গ্রামের চিত্র ভিন্ন। বানের পানি এসে গেলে চাকদহ গ্রামের মানুষের সবজি এবং আমিষ নির্ভর জীবন থাকে বাজারকেন্দ্রিক। চাকদহে বাজার বসে শুধু শনিবার। অন্যান্য দিনে বাজার করতে হলে যেতে হয় দূরের গ্রামে। আবার অনেকে বাড়িতে তরিতরকারি করেন। যেমন দেশি লাউ, কুমড়া, ধুন্দুল আর পুঁইশাক। তবে মাছ পাওয়া যায় প্রচুর পরিমানে। বোয়াল, কৈ, শৈল, ট্যাংরা, ফলি, টাটকিনি, নুরা ফ্যাকা( স্থানীয় ভাষায়) যা বড়ো হলে হয়ে যায় রুই এবং কাতলা। কেউ কেউ আক্ষেপ করে বলে সরপুটি মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক বছর। কিভাবে হলো, কেন হলো কে জানে! এই গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারেরই একজন করে দেশের বাইরে থাকে। তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা এ গ্রামের মানুষের আর্থিক অবস্থাকে মজবুত করেছে।

বানের পানি ভর্তি বর্ষামাসের দিনগুলোতে চাকদহের মানুষের প্রধান বাহন নৌকা। গ্রামে পানি ঢুকবার সাথে সাথে পানি কাদার নিচে থেকে  নৌকা তোলা হয়, মেরামত করে আলকাতরা আর নানান রঙের রঙ মাখিয়ে আবার ব্যভার শুরু হয়। পানির কারণে কাজের ধরনেরও পার্থক্য আসে। জেলেদের রমরমা অবস্থা বিরাজমান থাকে। বর্ষামাস আসে তাদের আশীর্বাদ হয়ে। তারা মনের সুখে সারারাত মাছ ধরে। ভোরে সে মাছ হাটে নিয়ে যায়। বিক্রয় করে।  টাকা অর্জন করে। কৃষক শ্রেণির লোকজনকে অলস সময় পার করতে হয়। আর কিছু লোকজন নৌকায় মানুষ পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করে। কেউ কেউ জাল পেতে মাছ ধরে এলাকার বাড়িতে পানি বন্দী মানুষের কাছে বিক্রয় করে।

চাকদহে ছোট ছোট শিশুরা নৌকা বাইতে পারে। আমি তাদের কাছে মাঝে মাঝে নৌকা বাওয়া শিখি। বিকালে তারা ঘুরতে বের হয়। এক বান্ধবী আরেক বান্ধবীর বাড়িতে যায় ঘুরতে যাবার জন্য। নৌকায় বান্ধবীরা সবাই একজোট হয়ে বসে নানান গল্প করে। কবে তারা পানিতে পড়ে গিয়েছিলো। কে তাদের বাঁচিয়েছিলো। কাকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়ে তোলা হয়েছে। কার হায়াত ছিলো তাই আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছে। ছোট ছেলে শিশুরা খুব ভোরে যায় শাপলার নাইল তুলতে। ছোট মাছ দিয়ে শাপলার নাইল ভাজি নাকি অনেক মজা! তাদের কাছে গল্প শুনে আমি একদিন রান্না করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেটা ঘন্ট হয়ে গেলো। কিন্তু খেতে সত্যিই মজাদার হয়েছিলো।

এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কৃষির উপরে নির্ভরশীল। কিছু জেলে এবং কুমোর রয়েছে৷ বেশির ভাগ বাড়ির এক দুজন মানুষ লেখাপড়া শিখে শহরে। অনেকে গ্রামের মাদরাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করে। তবে সে সংখ্যা নিতান্তই কম। এছাড়াও কিছু মানুষ দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে বর্ষাকালে গ্রামের চিত্র ভিন্ন। বানের পানি এসে গেলে চাকদহ গ্রামের মানুষের সবজি এবং আমিষ নির্ভর জীবন থাকে বাজারকেন্দ্রিক। চাকদহে বাজার বসে শুধু শনিবার। অন্যান্য দিনে বাজার করতে হলে যেতে হয় দূরের গ্রামে। আবার অনেকে বাড়িতে তরিতরকারি করেন। যেমন দেশি লাউ, কুমড়া, ধুন্দুল আর পুঁইশাক। তবে মাছ পাওয়া যায় প্রচুর পরিমানে। বোয়াল, কৈ, শৈল, ট্যাংরা, ফলি, টাটকিনি, নুরা ফ্যাকা( স্থানীয় ভাষায়) যা বড়ো হলে হয়ে যায় রুই এবং কাতলা। কেউ কেউ আক্ষেপ করে বলে সরপুটি মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক বছর। কিভাবে হলো, কেন হলো কে জানে!

কোনো কোনো বাড়ির নারী পুরুষ মিলে কচুরিপানা দিয়ে — যাকে তারা টাগৈ বলে — খুব সুন্দর করে বেড় দিয়ে তাদের বাড়ির আঙিনায় রাখে। যেন ভরা পানিতে আশেপাশের টাগৈ শেষ হলে তাদের বাড়ির আঙিনায় ধরে রাখা টাগৈ গরুকে খাওয়াতে পারে। এবার অধিকাংশ পরিবারই রাখছে কারণ খড় নাড়া বিচুড়ি খুব কম পরিবার তুলতে পেরেছে ঘরে। 

কচুরিপানাকে আমি ভয় পেতাম,  কচুরিপানার ফুল আমাকে সবসময় আনন্দ দিলেও কচুরিপানার সাথে আমার বিরুদ্ধতা ছিল অন্তত এই গ্রামে আসা পর্যন্ত। আমার মায়ের কাছে গল্প শুনেছি একবার আমাদের ষোল টা গরু মারা গিয়েছিলো। যুদ্ধের পরপরই জমিতে ধান বিচুলি কম হয়েছিলো। দাদা প্রায় ছয়মাস একনাগাড়ে গরুকে কচুরিপানা খাইয়েছিলেন। সে কারণে গরুর কলিজায় নাকি পোকা হয়েছিল। এবং গরুগুলো মারা গিয়েছিলো। জানিনা কচুরিপানার সাথে গরু মরার কোনো যোগসূত্র ছিলো কিনা। কিন্তু কচুরিপানাকে তখন থেকেই আমি বিষ জাতীয় কোন পানা বলে মনে করতাম। কিন্তু এখানে যখন দেখি সকলে পরম মমতায় কচুরিপানা তুলে ঘরে নিয়ে গরুকে খেতে দেয় এবং আমার চোখের সামনেই খড় বিচুলির মতো গরু তা খায় তখন ভাবনাটা ভুল মনে হয়। মনে হয় হয়তো তখন আমাদের বাড়ির গরু গুলোর অন্য কোন রোগ হয়েছিলো।

এই গ্রামে একটা  দাখিল মাদরাসা, একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং নুরানীয়া হাফিজিয়া মাদরাসা আছে। তিনটি মসজিদ, একটা মন্দির রয়েছে। রয়েছে একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অর্ধেক মুসলমান এবং অর্ধেক হিন্দুর বসবাস এই গ্রামে। এখনো পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক কোনো ভেদাভেদ চোখে পড়েনি। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সব মানুষ এখানে সুখে শান্তিতে বসবাস করে।

ছবির মতো এই গ্রাম আম-জাম,কাঁঠাল-লিচু,নারিকেল-তাল, হিজল, নিম এবং নানা জাতের গাছপালায় সুসজ্জিত। ঝোপঝাড় লতাপাতার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা মন কেড়ে নেবার প্রধান উপকরণ। পাখপাখালির কলকূজনে মুখরিত গ্রামখানা৷ ডাহুক, কাকাতুয়া, টুনটুনি, ঘুঘু, চড়ুই, পেঁচা দ্বারা ভরপুর গ্রাম। এখানে কালো এবং সোনা রঙের গুইসাপ হেলেদুলে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। গুইসাপ দেখামাত্র আমি আবৃত্তি করি,

সুবর্ণগোধিকা দেখি, চিন্তে বীর হৈয়া দুখি,
অযাত্রিক পাপ দরশনে।

কালকেতু চিন্তিত হয়ে গিয়েছিল কারণ তার ঘরে ছিলো অন্নের চিন্তা। আর আমি খুশিতে আটখানা হয়ে হেলেদুলে তাদের দেখি। তারা চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকায়। আবার কখনও ভুল করে আমারই ঘরে ঢুকে পড়ে।

প্রচুর ঘুঘু দেখতে পাওয়া যায়। এরকম নাদুস নুদুস ঘুঘু আমাদের বাড়ির আঙিনায় ভুলেও খেলা করে না। গুইসাপও আসে না৷ কারণ যশোরে আমাদের এলাকায় কথা প্রচলিত গুই সাপ কামড় দিলে নাকি পুকুরের পানিতে সাত টা ডুব মারতে না পারলে সে মারা যায়। তো গুইসাপকে শত্রু ভাবা হয়। আমাদের এলাকায় সব স্বর্ণ রঙের গুই সাপ। তাদের যাবার পথে বাঁধা দিলে মুখ হা করে সে কী! রাগ প্রকাশ করে। হয়তো বলতে চায় আমি কি তোদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াই? তোরা কেন বাধা হলি আমার যাত্রাপথের! আর ঘুঘু ধরে ফাঁদ পেতে বেচবার জন্য। আমি তাই কখনোই পছন্দ করি না। শুধু টিয়া আর ঘুঘু পাখি ফাঁদ পেতে ধরে বিক্রয় করে দেখে একজনের বউ অন্যের সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছিল।  তাতে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। মার সামনে বলে ফেলেছিলাম ঠিক হয়েছে , ও ঘুঘু পাখি ধরে বেঁচে। ওর বউ থাকে! মা আমাকে ধমক দিয়েছিলেন।

দেখলাম, চাকদহ গ্রামে কেউ পাখি ধরে না। পাখি ধরে না বলাও যায় না৷ ডাহুক পাখিকে তারা অনেকেই ধরে ঝোলাভাতি মানে চড়ুইভাতি বা ফিস্টিভাত করে খায়। তবে অধিকাংশই পশুপাখির সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে বসবাস করে। মানুষের সাথে মানুষের যে সম্পর্কই থাক। পশুপাখির প্রতি হিংস্র না তারা। এই পানির সময়ে ধূর্ত শেয়ালও মানবিক। পাশাপাশি শেয়াল আর মুরগি পাশাপাশি থাকলেও শুধু বেঁচে থাকবার তাগিদে শেয়াল মুরগিকে ধরে ছিড়েখুঁড়ে খায়না। এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়ে যায় চোখের নিমিষে। যেখানে পেটে ক্ষুধা, সম্মুখে খাদ্য, চারদিকে বানের পানি আবাস কেড়ে নিয়েছে। বেঁচে থাকাটাই সেখানে মুখ্য।  খাদ্য সম্মুখে রেখে বাস করা শিখতে হবে! ।

আমার পছন্দের শহর যশোর এবং ঢাকা। আমি আছি টাঙ্গাইলের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম চাকদহে। মন হাঁসফাঁস করে চলে যাবার জন্য। কিন্তু এই গ্রামের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করে। ছবির মতো গ্রামখানি প্রকৃতির মায়ায় জড়ানো। চাকদহের মানুষ কেউ সহজ- সরল আবার কেউ জটিল। সরল- গরলের মধ্যেখানে আমি গ্রামের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমার দিন রাত গুলো পার করে যাচ্ছি।

জেসমিন নাহার

ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। বাড়ি যশোহর জেলার শার্শায়। গোড়পাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম। চিশিতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। মা রওশানারা বেগম। গল্প লেখক। উপন্যাসও লিখছেন।

Share