আজ বৃহস্পতিবার, ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

প্রতিপক্ষ ও ‘সাহিত্য’

।। ফরহাদ মজহার।।

ছাপাখানা এবং প্রতিপক্ষ

‘প্রতিপক্ষ’ প্রথাগত অর্থেই সাহিত্যের পত্রিকা হিসাবে গত শতকে ৮৯/৯০ সালে বেরুতো। বাংলাদেশের উর্দু সাহিত্যিক, আব্বাস উদ্দীন, ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সেই সময়ে বেশ কয়েকটি সাড়া জাগানো সংখ্যা ‘প্রতিপক্ষ’ বের করেছিল। পত্রিকা প্রকাশ ছিল পত্রিকার বাইরের দিক, প্রাণের দিকটা ছিল আড্ডায়। কোন একটি পত্রিকা কেন্দ্র করে ‘সাহিত্য’ করাকরির অন্তরের দিকটা আড্ডাবাজিতে, সম্পর্ক রচনার এই সহজিয়া রীতি মোটেও নতুন কোন আবিষ্কার নয়। কিন্তু ‘সাহিত্য’ মানে ‘সহিত’ হওয়া, অপরের ‘সহিত’ সম্বন্ধ রচনা ও সম্বন্ধ  চর্চা – এই পুরানা কথাটা আমাদের খুব মনে ধরেছিল। এ নিয়ে তত্ত্ব করা যায় বিস্তর। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন যখন কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘ইস্ক্রা’ বের করেছিলেন, তখন তিনি সাফ বুঝেছিলেন পত্রিকা প্রকাশ করাটা প্রকাশনার গৌণ দিক। পত্রিকা রীতিমতো একটা রাজনৈতিক  পার্টি গঠনের ভূমিকা রাখতে পারে। পত্রিকার কাজ আদতে লেখকদের লেখা প্রকাশ করা না। বরং পত্রিকা জ্ঞানে-অজ্ঞানে আরও অনেক কিছু করে এক কথায় যাকে বলা যায় মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ তৈরী। পত্রিকা একটা সামষ্টিক উদ্দেশ্য তৈয়ারির প্রক্রিয়া এবং সেই উদ্দেশ্য  বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা নির্ণয়, পরস্পরের মধ্য দিয়ে সকলে মিলে রূপান্তরিত হওয়া, নতুন করে নিজেদের বর্তমান ও ঐতিহাসিক কাজ পরিচ্ছন্ন করে তোলা, ইত্যাদি। সরাসরি রাজনৈতিক সাহিত্য আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না।  বরং ‘সাহিত্য’ কথাটার মানে নতুন করে আবিষ্কার করবার আনন্দ নিয়ে আমরা মাত্র চারটি সংখ্যা বের করতে পেরেছিলাম। আর পারি নি।

ততোদিনে ছাপাখানা কিভাবে একটি জনগোষ্ঠিকে ‘জাতি’ হিশাবে কল্পনা করবার বাস্তব ও বৈষয়িক শর্ত তৈরি করে তার রহস্য কিছুটা আমরা বুঝতে শিখেছি। বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ‘Imagined Community’ নামের কেতাবটি বেরোয় ১৯৮৩ সালে। ছাপাখানার ছাপা পত্রিকা পুঁজিতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থায় উৎপাদন, বিতরণ ও ভোগের মধ্য দিয়ে কিভাবে  আমাদের চেতনা ও কল্পনার জগত বদলে দেয় এবং আমরা কিভাবে নিজেদের একটি ‘জাতি’র অন্তর্গত ‘কল্পনা’ করতে শিখি ও অভ্যস্ত হয়ে পড়ি সেটা  আরও গভীরে গিয়ে বোঝার জন্য আমরা তখন আগ্রহী হয়ে পড়ি।  নিজেদের একটি জাতির অন্তর্গত ভাবতে আমরা কিভাবে শিখলাম? কল্পনার এই জাতিগোষ্ঠির নির্মাণ সম্ভব হয়েছে ‘প্রিন্ট ক্যাপিটালিজম’ বা ‘ছাপাখানার পুঁজিতন্ত্র’ দিয়ে। সেটা কেমন? এন্ডারসন দাবি করছেন, বইয়ের ব্যবসায়ীরা পুরানা বা মৃত ভাষায় বই ছাপলেন না, ব্যবসার তাগিদে অধিক মানুষের কাছে পৌঁছবার জন্য জনগোষ্ঠি বোঝে এমন ভাষায় পত্র পত্রিকা বইপত্র ছাপতে শুরু করলেন। পাশ্চাত্যে ল্যাটিন ভাষায় নয়, লৌকিক ভাষায় — ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি ইত্যাদি  — বই বেরুতে শুরু করল। আমাদের এখানে ইংরেজ ও পণ্ডিত মিলে একটা বাংলা ভাষা তৈরি করল বটে, তবে ইংরেজের জাহাজ  ‘সুতানটি’ নামের যে গ্রামে ভিড়েছিল এবং পরবর্তীতে যেখানে কলকাতা শহর গড়ে উঠল, তার আশপাশের গ্রামের ভাষা প্রিন্ট-টেকনলিজি ও ঔপনিবেশিকতার ঔরসে গড়ে ওঠা বাজার ব্যবস্থার  কল্যাণে ‘বাংলা ভাষা’ হিশাবে তৈরি হয়ে একটা রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সুতানুটি, পুরনো ইংরেজি বানানে (Suttanuttee), পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রাম। যার কথা কেউ এখন আর মনে রাখে না। ঈসায়ী সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সুতানুটি ও তার আশপাশের আরও দুটি গ্রাম  কলিকাতা ও গোবিন্দপুর নিয়ে আধুনিক কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসক জব চার্নক এই গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কাছে চার্নক  “কলকাতার জন্মদাতা হিশাবে পরিচিত। ইংরেজের জাহাজ যদি বাংলার অন্য কোন গ্রামে ভিড়ত, যেমন ধরা যাক  নোয়াখালি বা চট্টগ্রাম, তাহলে এই দুই জেলার ভাষা আশ্রয় করেই তথাকথিত ‘প্রমিত ভাষা’ গড়ে উঠত।

উনবিংশ শতাব্দির ছাপাখানা, সাহিত্য পত্রিকা, গল্প-উপন্যাস-কবিতা আমাদের নিজেদের ‘বাঙালি’ কল্পনা করতে শিখিয়েছে। পত্রিকা এই কাণ্ড করতে পারে। শুধু সম্বন্ধ তৈরি নয়, বরং নিজেদের নতুন ভাবে কল্পনা করতে ও ভাবতেও শেখায় সাহিত্য। যদি তাই হয় তবে সেটাই চিরায়ত, শাশ্বত ও একমাত্র ‘কল্পনা’ বা চরম সত্য হয়ে বিরাজ করবে তারও কোন কারণ নাই। সাহিত্য বানাতে যেমন জানে, বদলাতেও পারে, পুরানা কল্পনা বাদ দিয়ে নতুন ভাবে নিজেদের কল্পনা করবার সাহসও সাহিত্য দান করতে পারে।

তবে আমাদের মন ও কল্পনার রূপান্তর  শুধু সাহিত্যের গুণে হয়, এই ভাবনাটা প্রাচীন। সেটা সব সময় ইতিবাচক হয়, সেটাও ঠিক না। তবে বাস্তব বা বৈষয়িক জীবনে জার্মানির জোহান্স গুটেনবার্গের আবিষ্কৃত ছাপাখানার টেকনলজির আবিষ্কারের পর মানুষের ইতিহাস আর আগের মতো থাকে নি। গুটেনবার্গের টেকনলজি বা ছাপাখানার কৃৎকৌশল  কিভাবে আমাদের ইন্দ্রিয় চর্চা এবং দৈহিক-মানসিক ভূবন বদলায়  সেই দিক নিয়ে আজ অবধি আমরা বিশেষ মনোযোগী হতে পারি নি। অর্থাৎ টেকনলজির সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে আমরা বাংলাভাষায় খুব একটা ভেবেছি বলে চোখে পড়ে নি। ‘প্রতিপক্ষ’ শুরুতে ব্যাপারগুলো নিয়ে ভেবেছে, যে কারনে গ্রামোফোন কোম্পানি কিভাবে কাজী নজরুল ইসলাম কিম্বা আব্বাস উদ্দীনকে বানিয়েছে সেই দিকটা আমাদের আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল আমরা একটি আব্বাসউদ্দীন সংখ্যা বের করি।


সম্বন্ধ রচনা কথাটা আমরা শুরুতে খুব স্থূল অর্থে বুঝেছি। কিন্তু তাতে আমাদের অসুবিধা হয় নি। কিন্তু টেকনলজি কিম্বা যে কোন মাধ্যমে সাহিত্য করা বা সম্বন্ধ রচনার কারিগরি দিকটাকে আমরা ভুলি নি। ‘সাহিত্য’ টেকনলজির নিরপেক্ষ প্রডাক্ট বলে আমাদের কখনই মনে হয় নি, কিন্তু তার মানে বাস্তবে কি হতে পারে সে ব্যাপারে শুরুর দিকে আমরা বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি নি। তাতে অসুবিধা হয় নি। সম্বন্ধ রচনাকে স্থূল ভাবে বুঝলেও তার উপযোগিতা এখনও অনস্বীকার্য। যেমন, ‘প্রতিপক্ষ’ নামে প্রতি বৃহস্পতিবার যে আড্ডা হোত সেটা ছিল সেই সময় সাহিত্য চর্চার দিক থেকে আমাদের জন্য এক নম্বরের কাজের জায়গা। এক নম্বর কাজ তো অবশ্যই, কারন ঢাকা শহরে এই জায়গাটুকু তৈরি করা আমাদের জন্য খুবই জরুরি ছিল। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা, সাহিত্য নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তাভাবনা করা, পরস্পরের কাছ থেকে শেখা, ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ রচনাই যদি পরমার্থ হয় তাহলে ‘সাহিত্য’ করাকরিকে শুধু আড্ডা ভাবা স্থূল। কিম্বা সাহিত্যকে স্রেফ ছাপাখানার পত্রিকার মধ্যে বোকা বোকা কালো কালির দাগ হিশাবে ভাবাটাও সংকীর্ণ ব্যাপার। তাহলে সাহিত্য কী, কিভাবে সেটা ঘটে – এই জিজ্ঞাসাগুলো সবসময়ই আমাদের ভাবনার কেন্দ্রে হাজির ছিল।

ইন্টারনেট এবং সাহিত্য

নতুন ভাবে যখন আমরা ‘প্রতিপক্ষ’-কে গুটেনবার্গ টেকলজিতে তৈরি বস্তু হিশাবে না বানিয়ে সদ্য আবির্ভূত নতুন মাধ্যম ইন্টারনেটে ওয়েব পাতা হিসাবে বের করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি তখন একদিকে আমাদের ব্যর্থ চেষ্টা, পুরানা ইতিহাস ও তার চাপা গৌরব, আর অন্যদিকে সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের কিছু নতুন ধারণা মাথায় নিয়েই আমরা শুরু করি। যারা ‘সাহিত্য’ ধারণা নিয়ে দেশেবিদেশের তর্ক কমবেশী অনুসরণ করেছেন, তাঁরা জানেন ‘লিটারেচার’ কথাটা আমরা ব্যবহার করি বটে, কিন্তু তার কোন সারবত্তা নাই। কেন নাই? কারণ লিটারেচার কি তাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাবার কোন যুৎসই মানদণ্ড নাই। কি মিল আছে কবিতার সঙ্গে গদ্যের? কিম্বা রম্য রচনার সঙ্গে উপন্যাসের; তারা ছাপাখানায় ছাপা হয় এটা একটা মিল বটে। এর বাইরে ‘লিটারেচার’ কথাটাকে কোন স্থির-নির্দিষ্ট ধারণার ওপর সিধা করে দাঁড় করানো যারপরনাই মুশকিল হয়ে পড়ে।

নতুন করে ওয়েবে প্রকাশের প্রস্তুতির সময়, আমরা নীচের কথাগুলো লিখি: 

“স্বল্পকাল ছিল প্রতিপক্ষ, কিন্তু তখনই সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়েছিল।

তার কারনও ছিল। সম্ভবত সেটা ছিল বিষয় নির্বাচনে। তখন ১৯৮৯ সালে অগাস্ট-সেপ্টেম্বর সংখ্যাটা হয়েছিল বাংলাদেশের উর্দু সাহিত্য নিয়ে। আমরা লিখেছিলাম:

বাংলাদেশে যাঁরা উর্দুতে লিখছেন, বলাবাহুল্য, তাঁদের দুএকজন ছাড়া অধিকাংশেরই মুখের ভাষা উর্দু। কিন্তু খানিক জোর দিয়ে যে কথাটা বলা দরকার ; তা হোল, এঁরা সবাই বাংলাদেশী নাগরিক, বাংলাদেশ তাঁদের দেশ।ফলে তাঁদের উর্দু সাহিত্য চর্চা মানে বাংলাদেশের উর্দু সাহিত্য চর্চা।

বাংলাদেশের নাগরিককথাটার ওপর জোর দিতে হচ্ছে ঐতিহাসিক কারণে। বাংলাভাষা আর বাংলাদেশ আমাদের লড়ে জয় করতে হয়েছে। একটি জাতিকে প্রাণ আর রক্তের হিস্যা বুঝিয়ে দিয়ে দুনিয়ার  মানচিত্রে জায়গা করে নিতে হয়েছে।

আর এই লড়াইয়ের সময় আমাদের মুখোমুখি পড়েছে উর্দু। চাপিয়ে দেয়া উর্দুকে হঠিয়ে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার জন্যই শুরু হয়েছিল আমাদের লড়াই। ফলে উর্দুতে কথা বলেন, উর্দুতে সাহিত্য চর্চা করেন অথচ এদেশের কেউ নাগরিক সেটা চট করে আমাদের বিশ্বাস হয় না। একটা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে বিশ্বাস করাতে হয়”।

স্বল্পকাল স্থায়ী প্রতিপক্ষছাপ রেখে গিয়েছিল গভীর ভাবে। যখন আমরা আবার সাহিত্যের কাগজটি বের করেছি ওয়েবে তখন আমরা মনেপ্রাণে চেয়েছি তরুণদের মধ্যে যারা নতুন ভাবে সাহিত্যের জগতে আসছেন সেই তরুণরাই এর দায়িত্ব নেবেন। সেই সময় আমরা আরো লিখেছিলাম:

“সাহিত্য কথাটা প্রাচীন অর্থেই আমরা আপাতত ধরে নিচ্ছি। ‘সহিত’ থেকে ‘সাহিত্য’, সবার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ও বিরাজ করবার বাসনা। এই বাসনা আছে বলেই মানুষ নাকি কথা বলে। ওর মধ্য দিয়ে সমাজ নামক যে-পদার্থটা দানা বাঁধে তা একই সঙ্গে এক ও অনেক। চিহ্ন বা আরও সুনির্দিষ্ট অর্থে অক্ষর নিয়ে কায়কারবারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই উৎপাদন হয় বলে প্রচার আছে।

শুরু করবার জন্য এই অনুমানটুকুই যথেষ্ট। আমরা সবাইকে নিয়ে একটা জায়গা তৈরি করতে চাই যেখানে সাহিত্যের চর্চা জোরদার করা যায়। বিভিন্ন ধারা, কখনও সমান্তরাল আবার কখনও পরস্পর বিরোধী হতে পারে আসুক না এক জায়গায়। একটা চর্চার জায়গা দরকার। সাদা কথায় সিম্পলি অনুশীলন অর্থে। এটাই করতে চাইছি।

প্রতিপক্ষের একটা মিলিট্যান্ট ভাব ছিল। কাউকে পরোয়া না করার মতো বেশ রাগি মেজাজ। এখন সেটা আমরা চাইছি না। আমরা কিছুটা সংশোধনবাদীহয়ে যেতে চাইছি। নিন্দিত হবার ভয় পাচ্ছি না। কারন যারা সবে মাত্র লেখালিখি শুরু করেছে তারা যেন লিখতে পারে সেই রকম একটা জায়গা তৈরি করা দরকার। আর যারা ইতোমধ্যে বিখ্যাত, ভারিক্কি বা বুড়া হয়ে গিয়েছে, তাদের কাজ নতুনদের উৎসাহিত করা। আর তাদের ভালো লেখা ভালো একটি সাহিত্য পত্রিকায় ছাপতে দেওয়া।

তবে একই জিনিস তৈয়ার করবার কারখানা আমরা চাইছি না। এই আশাটুকু রাখতে চাইছি যে যাই করি তা যেন নতুন অর্থ উৎপাদনের সম্ভাবনা তৈরি করে।

শিশুর মতো আবার লেখালিখির হাতেখড়ি হওয়া দরকার এই রকম একটা তাগিদ বোধ করছি আমরা। ভুল করছি কিনা জানি না”।

কথাগুলো অনেকের মধ্যে সাড়া ফেলে। ‘সহিত’ থেকে ‘সাহিত্য’ হয় এই কথা আমাদের পরিচিত, কিন্তু অনেকের কাছেই সেটা নতুন হয়ে হাজির হোল। অনেকে ‘সহিত’ থেকে ‘সাহিত্য’ কথাটা নিয়ে ঠাট্টা তামাশাও করেছিলেন। তরুণদের মধ্যে যারা নিজেদের প্রথাবিরোধী ভাবে, তাদের আগের পয়দা হওয়া জেনেরেশানকে যারা মিউজিয়মে পুরে দিয়ে আনন্দ পায়, তাদের দাবি, ফরহাদ মজহার সাহিত্য সম্পর্কে এইসব উলটাপালটা কথা বলে তরুণদের ‘আইকন’ হয়ে উঠতে চান। এটা হতে দেওয়া যাবে না। আমরা তরুণরা কোন ‘আইকন’ মানি না।

নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে সবকিছু পাশ্চাত্য থেকে ধার করতে হবে, এমনকি সাহিত্যের ধারণাও,  তার কোন যুক্তি নাই। ফলে সাহিত্যের অর্থ অপরের সহিত সম্বন্ধ রচনা ও সম্বন্ধ চর্চা কথাটা আমাদের ভাল লাগলো। মনে হোল এই প্রাচীন পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা অনেকদূর যেতে পারব। সাহিত্য নিয়ে আমরা নতুন ভাবে ভাবতে পারছি। এই সম্ভাবনা আমাদের দারুন অনুপ্রাণিত করলো।

এই সকল ভাবনা চিন্তার পরিণতি হিশাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি আমরা করে ফেলতে পেরেছিলাম সেটা হোল দুই হাজার চৌদ্দ সালে ২৮ ও ২৯ অগাস্টে টাঙ্গাইলে নয়াকৃষি আন্দোলনের বিদ্যাঘরে  ‘রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডা’ বা  রিদয়পুর সাহিত্য সম্মেলন। ঢাকার বাইরে আমরা অনেকে মিলে একসঙ্গে বসে ‘সহিত থেকে সাহিত্য’ কথাটাকে কিভাবে বুঝি বা বুঝব তার একটা বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছি সকলে সেই সম্মেলনে।

‘রিদয়পুর সাহিত্য সম্মেলন’ ছিল আরেকটি কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারন এটি ঘটেছিল শাহবাগের আন্দোলনের পরপরই। সেই সময় বাংলাদেশে রাজনৈতিক মতবিরোধ যে বিভাজন ও বিভক্তি তৈরি করেছিল বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা সেই মেরুকরণ থেকে মুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তারপরও কথা থাকে। সাহিত্যচর্চার অর্থ যদি সম্বন্ধ স্থাপন হয়, তাহলে বিদ্যমান সম্বন্ধ যতোই বিভেদাত্মক হোক সম্বন্ধ বিচারের মধ্য দিয়েও আমরা ‘অপর’ বা ভিন্ন চিন্তার মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হবার – অর্থাৎ পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়ার সাধনা করতে পারি। ‘রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডা’ বা সম্মেলন ছিল তারই একটি সফল প্রয়াস।

পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে নির্বিচারে গ্রহণ করবার ফলে এবং ঔপনিবেশিক ইতিহাস, সাম্রাজ্যবাদ, বিশ্বব্যাপী পুঁজির স্ফীতি ও পুঁঞ্জিভবন এবং নয় এগারোর পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ফলে ধর্ম সম্পর্কে এবং ধর্মের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী নানান ভাবে জটিল হয়ে রয়েছে। এর মীমাংসা হয় নি। মীমাংসার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কবিতর্কের কোন সপ্রাণ ঐতিহ্য আমরা গড়ে তুলতে পারি নি। এই ক্ষেত্রে ভয়ানক আপদ হয়ে রয়েছে পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে নির্বিচারে ‘প্রগতিশীল’ গণ্য করা এবং পাশ্চাত্যকেই একমাত্র আদর্শ ধরে নেওয়া। এর বিপরীতে অবশ্য নির্বিচার পাশ্চাত্য বিরোধিতাও রয়েছে,  যার জীবনাদর্শ হয় কূয়ার ব্যঙের। এক চিলতে আকাশকে সুডুর পাশ্চাত্য বলে ভ্রমে থাকা। তবে আদত মুশকিল  ঘটে নিজেদের পাশ্চাত্যের আদলে গড়ে তুলবার তীব্র বাসনায়। এর ফলে ধর্ম, নিজেদের জীবন যাপন এবং অতীতের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার চর্চা প্রকট ভাবে চর্চিত হয়। বলা বাহুল্য নিজেদের অতীত বা ঐতিহ্য নিয়ে রোমান্টিক উৎকল্পনার যেমন কোন ভিত্তি নাই, তেমনি অতীত অস্বীকার করা, কিম্বা বিশ্বের দরবারে  আমাদের ইতিহাস বা ঐতিহ্যের কিছুই দেবার নাই এই বদ্ধমূল গবেটগিরিরও কোন অর্থ নাই

বাংলাদেশে আমাদের সমস্যা আরও প্রকট। একাত্তরে নিজেদের ‘বাঙালি’ দাবি করা এবং সেই দাবি কায়েম করবার জন্য আমাদের একটি সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেখানে লড়াই হয়েছে একটি সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। যার আর্থ-সামাজিক ভিত্তি সামন্ততন্ত্রে এবং আধ-খিঁচড়া ভাবে গড়ে ওঠা সেই সকল শ্রেণীর মধ্যে যারা এখনও সামন্ত ধ্যানধারণার গর্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারে নি। আমরা আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতির জন্য লড়েছি। মতাদর্শিক ভাবে লড়তে হয়েছে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিশাবে পাকিস্তান এবং পাকিস্তানবাদের বিরুদ্ধে। এর ফলে ইসলাম এবং বাঙালি জাতিবাদের মধ্যে একটা ঐতিহাসিক বিচ্ছেদ ঘটে যায়। সেই বিচ্ছেদ লাশ ও রক্তপাতের বোঝা হয়ে হিমালয় প্রমাণ ভারী হয়ে আছে। যুদ্ধের ভয়াবহ প্রকোপ তীব্র ভাবেই বাংলাদেশে রয়ে গিয়েছে। এর পরিণতিতে বাঙালি জাতিবাদ হাজির হয় ইসলামের বিপরীতে  ইসলাম নির্মূল রাজনীতির অভিপ্রায়ে। অন্যদিকে বাঙালি জাতিবাদের পালটা প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠছে ইসলামি জাতিবাদ। এই বিভাজন ও বিভক্তির মধ্যে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে পর্যালোচনামূলক অবস্থান গ্রহণ করে টিকে থাকা কঠিন। কারন ততোদিনে হয় তুমি আমাদের লোক অথবা তুমি ওদের পক্ষে, অতএব আমাদের দুষমণ – এই জর্জ বুশীয় শমন জারি  করা হয়ে গিয়েছে।

 নিজেদের পরিচয়কে জাতিবাদের যুগে চিরায়ত, শ্বাশ্বত বা আবহমান গণ্য করা হয়। ফলে একদিকে বাঙালি জাতিবাদ আর বিপরীতে ইসলাম – এই দুই বিভক্তির মধ্যে আমরা বাস করছি। এই প্রকট বিভেদাত্মক পরিস্থিতিতেও রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডার  বাংলাদেশ ঘটেছে।

রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডা

‘রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডায়’ দুই দিন ব্যাপী ছাপার অক্ষর, চলচ্চিত্র এবং অপরাপর শিল্প মাধ্যমে বা মাধ্যমের  মধ্যস্থতায় অপরের ‘সহিত’ সম্পর্ক রচনা বা অপরের ‘সহিত’ বাস করা নিয়ে নানান কথা হয়। ‘প্রতিপক্ষ’ সাহিত্য বোঝাতে বাংলায় ‘সহিত’ থেকে ‘সাহিত্য’ এই ব্যুৎপত্তির তাৎপর্য কংক্রিট কাজের মধ্য দিয়ে বোঝার আন্তরিক প্রচেষ্টা এই আড্ডাকে বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার ইতিহাসে একটা মাইলফলকে পরিণত করে।

২৮ তারিখ সন্ধ্যায় রিদয়পুরের বিদ্যাঘরে দৈনন্দিন বিধি অনুযায়ী দৈন্য গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরমধ্যে পরিচয় পর্ব শেষ হয়।  ঢাকাসহ কয়েকটি জেলা থেকে কোন না কোন মাধ্যমে সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত প্রায় ৫০ জন ‘সাহিত্যিক’ অংশগ্রহণ করেছিলেন।

দৈন্য গান শেষে রাত আটটায় শুরু হয় প্রথম পর্ব: নূরুল আলম আতিকের উপস্থাপনা  ‘সিনেমায় নিজস্ব ভাষার খোঁজে’। তার পরদিন ভোরে যথারীতি গোষ্ঠগান, বিদ্যাঘরের দৈনন্দিনের কর্মপর্বের মধ্য দিয়ে ২৯ তারিখ সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব,।গত রাতের উপস্থাপনা কেন্দ্র করে প্রশ্ন ও কথাবার্তা। এ পর্বেও নূরুল আলম আতিক চলচ্চিত্র বিষয়ে তার ভাবনার কথা আরও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন।

বাংলাদেশেরর চলচ্চিত্রে মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন নূরুল আলম আতিক। রিদয়পুর আড্ডায় তাঁর উপস্থাপনা

সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে তৃতীয়পর্বে  ‘ভাষার দর্শন ও সাহিত্যতত্ত্ব’ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন  মোহাম্মাদ আজম। ভাষার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের ওপর দাঁড়িয়ে মিখাইল বাখতিন উপন্যাস বিচারের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিগত দিক গুলো প্রস্তাব করেছে মোহাম্মদ আজম সেই দিকগুলো তুলে ধরেন। সসিউরের ভাষাতত্ত্ব ও ফ্রয়েডিয় মনোকিলনের সমালোচনার মধ্য দিয়ে বাখতিন কিভাবে ভাষার স্বভাব বিচারের প্রস্তাব করেছেন এবং তার ওপর দাঁড়িয়ে উপন্যাস বিচারের পদ্ধতি খাড়া করেছেন তা নিয়ে মোহাম্মদ আজম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন।

১২টা ৩০ মিনিটে চতুর্থপর্বে ‘কথাসাহিত্যের আপন ও অপর’ নিয়ে আলাপ করেন মাহবুব মোর্শেদ। মাহবুব মোর্শেদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তোলেন। মধ্যশ্রেণীর বাইরের বিষয় নিয়ে লেখা কথাসাহিত্যই ভাল বা মহান – এই ধারণা কেন এতো স্বতঃসিদ্ধ গণ্য করা হয়?  উচ্চশ্রেণী নিয়ে খুব বেশি লেখা হয় না, অথচ নিম্নবিত্ত শ্রেণী নিয়ে লেখার অভাব নাই। কীভাবে এমন হলো? লেখকরা কেন নিম্ন শ্রেণী ও বর্গের জীবনকে সহজগম্য ভাবেন? এই প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লেখালিখির মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর পরস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে্ ভাবনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন তিনি। একই সঙ্গে সেই কঠিন প্রশ্নটিও তোলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা লেখকদের  নিম্নবর্গ বা শ্রেণি নিয়ে এত মাথাব্যথার ‘অধিকার’ কতটুকু?

বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে একালের কাব্যচিন্তা নিয়ে আমি কিছু কথা বলি। কিভাবে কাব্য একালে গদ্য ও উপন্যাস চর্চা থেকে পৃথক এবং একই সঙ্গে অন্য শক্তিশালী মাধ্যম– যেমন,  চিত্রকলা, সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে ‘সাহিত্য’ চর্চা থেকে আলাদা বিষয় নতুন করে হাজির করবার চেষ্টা করি। কবিদের একটা ‘দায়’ রয়েছে কবিতার মহিমা অন্য সকল মাধ্যম থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। সেটা তখনই সম্ভব যখন ভাষার সঙ্গে সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট ধরণ সম্পর্কে কবি ও কবিতা উভয়েই হুঁশিয়ার থাকে এবং ভাষার কারবারের মধ্য দিয়ে নতুন চিন্তার সম্ভাবনা কবি তৈয়ার করতে পারেন। ভাষার চিহ্নব্যবস্থা একইসঙ্গে কবিতার উপাদান বা কাঁচামাল যেমন, তেমনি প্রকাশের মাধ্যমও বটে। এই সম্বন্ধ আরও ভালভাবে পর্যালোচনা জরুরী। কবির কাছে বিদ্যমান ভাষা একই সঙ্গে প্রতিবন্ধকতা এবং সম্ভাবনা। নতুন ভাষা আবিষ্কার কবির কাজ। কবিতাকে উপমাবহুল, দুর্বোধ্য ও অর্থহীন হতে হবে এমন কোন কথা নাই। আধুনিক কবিতার কারবার প্রধানত চিহ্ন প্রকরণের (semiotic) সঙ্গে,  অর্থতত্ত্বের (semantic) সঙ্গে অতোটা নয়। তাই কাব্য কিভাবে ‘রস’ তৈরি করে প্রকরণ ও বিষয় উভয়ভাবেই — এই বঙ্গীয় চিন্তার গুরুত্ব আধুনিক কবিরা বুঝতে অক্ষম। সাধারণ মানুষের হৃদয়বৃত্তির প্রতি কবিতার মনোযোগ আধুনিক কালে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ অপরের সঙ্গে আন্তরিক সম্বন্ধ রচনার গুরুত্ব আধুনিক সাহিত্য খুইয়ে বসে আছে। এটা ভাল নাকি মন্দ সেটা তর্কে বিষয় নয়। এই ক্ষয় বুর্জোয়া ব্যাক্তিতন্ত্রের অনিবার্য পরিণতি তাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এই বাস্তবতা আমাদের আমলে নিতে হবে।

এই পর্বে আলাপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল  ‘সাহিত্য’ পত্রিকা হিসেবে প্রতিপক্ষের সম্পাদকীয় নীতিনির্ধারণ। সকলেই এই পর্বে তাঁদের অনুভূতি ও উপলব্ধির কথা বলেন এবং প্রতিপক্ষকে নানান পরামর্শ দিয়ে সমৃদ্ধ করেন। কমপক্ষে প্রতি বছর একটি বাৎসরিক সাহিত্য আড্ডা এবং সুযোগ ও সাধ্য অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে আরও আড্ডা ও আলোচনার সংকল্প নিয়ে দারুন এই আড্ডাটি  শেষ হয়।

টাঙ্গাইলে রিদয়পুর  বিদ্যাঘরে  ‘রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডা’র আলোচনায় প্রতিপক্ষের আয়োজনে একটি সাহিত্য সম্মেলন করা যায় কিনা সে কথা ওঠে। রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডার ধারাবাহিকতায় প্রতিপক্ষের আয়োজনে ‘ঢাকা সাহিত্য সম্মেলন’ আয়োজনের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটা কোন জাতীয় সম্মেলন নয়। রিদয়পুর আড্ডারই ধারাবাহিকতা। যারা রিদয়পুরে যান নি বা ঢাকার বাইরে যাওয়া যাদের জন্য কঠিন, তাদের নিয়ে রিদয়পুরের মতোই আরও বড় পরিসরে একত্র হওয়া। ইতোমধ্যে আরো দুই একটি সংগঠন বা উদ্যোগ সাহিত্য সম্মেলন করেছেন বা করছেন। খুবই ভাল কাজ। তাঁদের আমরা সমর্থন করি। যে যেভাবেই করুক সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ বাড়ুক। সাহিত্যকে কেন্দ্র করে সবার সঙ্গে মেলামেশা বাড়ুক, এটাই আমরা সবসময় চাই।

‘উদযাপন পর্ব’

রিদয়পুরের সাহিত্য সম্মেলন অনুপ্রাণিত করে সবাইকেই।  তাই পরবর্তী সম্মেলনকে একটি জাতীয় সম্মেলন হিসাবে রূপ দেবার ইচ্ছা অনেকের মধ্যেই জেগেছিল। সেটা ছিল খুবই খুশির কথা। এ ধরণের উদ্যাগ  কেউ নিলে এবং আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলে ‘প্রতিপক্ষ’ অবশ্যই তার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। জাতীয় সম্মেলন ‘প্রতিপক্ষ’কেই করতে হবে এমন কোন কথা নাই। কিন্তু আগে দরকার মেলামেশা, পরস্পরকে জানা এবং ‘সাহিত্য’ নামক ধারণাকে কেন্দ্র করে সমাজের বিভিন্ন ধারা উপধারাকে শনাক্ত করা। ‘জাতীয়’ কথাটা অনেক বড়সড় ব্যাপার। তবে মেলামেশা ও পরস্পরকে জানাশোনার প্রক্রিয়া জারি রাখা গেলে বাংলাদেশের সাহিত্য আন্দোলন একটা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় রূপ আপনাতেই নেবে। তাই রিদয়পুরের পর একই ধরণের প্রক্রিয়া আমরা জারি রাখতে চেয়েছি। কারন সাহিত্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু ধারণা নিয়েই রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডাটি হয়েছিল। সেই ধারণারই  ধারাবাহিকতায় ‘ঢাকা সাহিত্য সম্মেলন’-এর কথা আমরা ভেবেছি।   

ঢাকা সাহিত্য সম্মেলনের সফল করবার প্রক্রিয়া হিসাবে আমাদের মনে হয়েছে আরো কিছু আড্ডা, আরো কিছু মানুষের সঙ্গে একত্রিত হওয়া দরকার। যেন সকলে বুঝতে পারেন আমরা আসলে কী করতে চাইছি। সাহিত্য সম্পর্কে গৎবাঁধা চিন্তা মাথায় নিয়ে কিছু করে কোন লাভ নাই। প্রতিপক্ষের আয়োজনে ঢাকা সাহিত্য সম্মেলন করবার ইচ্ছা ও পরিকল্পনা সামনে রেখে তাই কয়েকটি আলোচনা বা আড্ডার আয়োজন করা হয়েছে। এই আড্ডাগুলোর আমরা নাম দিয়েছিলাম ‘উদযাপন পর্ব’। তারই প্রথমটি ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ এবং নতুন সিনেমার সম্ভাবনা’। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সাম্প্রতিক একটি ছবি কেন্দ্র করে কথাবার্তা। তবে আলোচনার ভরকেন্দ্র ছিল পরিচালকের কাছ থেকে সরাসরি শোনা এবং বাংলাদেশের সামনের সারির ছবি বানানেওয়ালাদের ও ছবির সমঝদারদের সঙ্গে বাংলাদেশে নতুন সিনেমার সম্ভাবনা নিয়ে কিছু ভাবনাচিন্তা করা। আলোচনা করেছিলেন নূরুল আলম আতিক, গোলাম রাব্বানী বিপ্লব, মোহাম্মদ আজম,  সুমন রহমান, পিপলু আর খান, রেদওয়ান রনি, তৈমুর রেজা এবং আমি।প্রশ্নোত্তর পর্বে ছবিটির পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নানান প্রশ্নের প্রাণবন্ত উত্তর দিয়েছিলেন।

এরপর আমরা ১১ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে আরেকটি আড্ডা বা আলোচনার আয়োজন করি ফটোগ্রাফি নিয়ে: ‘স্মৃতির শহর ঢাকা: ছবি ও অক্ষরে’। এবার আড্ডার ভরকেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের তরুণ ফটোগ্রাফার মুনেম ওয়াসিফ। ঢাকা সম্মেলনের দিকে যাবার লক্ষ্যে এটা ছিল প্রতিপক্ষের দ্বিতীয় উদযাপন পর্ব।  ফটোগ্রাফি বা স্থিরছবির মধ্য দিয়ে সাহিত্যের চর্চা কিভাবে ঘটে সে সম্পর্কে একটা ধারণা আমরা দিতে চেয়েছি।

এই আড্ডাগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা বোঝাতে চেয়েছি ‘সাহিত্য’ সম্পর্কে প্রাচীন ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। শুধু গুটেনবার্গ টেকনলজি সাহিত্য চর্চার জায়গা হতে পারে না। সাহিত্য যে কোন মাধ্যমেই চর্চা হতে পারে এবং বিভিন্ন মাধ্যম সেই সকল চর্চাকে  ভিন্নতা, স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য দান করে। এই সাহিত্য আড্ডা উপলক্ষ্যে আমি একটি ছোট লেখা লিখি। আমরা কি ভাবছি সে সম্পর্কে কিছু ধারণা এখানে ধরা আছে। ভবিষ্যতের জন্য পেশ করে রেখে দিচ্ছি।

“যেভাবে আমরা এখন ‘সাহিত্য’ কথাটা আক্ষরিক বুঝি, সেই দিক থেকেও আলোচনা হবে। আলোচনা হবে সিনেমার দিক থেকেও – প্রথম পর্বে ‘পিঁপড়াবিদ্যা ও নতুন সিনেমার সম্ভাবনা’ অনুষ্ঠানটিতে যেমন আমরা করেছি। তবে এবার ক্যামেরা আমাদের বিশেষ আগ্রহের বিষয়। ফটো তোলার মধ্য দিয়ে ‘সাহিত্য’ অর্থাৎ সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা ও বিরাজ করবার বাসনা কিভাবে চর্চা করছেন আমাদের ফটোগ্রাফাররা সেই দিকটিতে সবার নজর আকর্ষণ আমাদের ইচ্ছা। বলাবাহুল্য এটা সাহিত্যের একমাত্র বা শেষ সংজ্ঞা নয়। বিশেষ একটি টেকনলজির সঙ্গে সাহিত্য কথাটা ঐতিহাসিক কারনে যুক্ত হয়ে পড়ায় সাহিত্যকে টেকনলজির বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করা জরুরী হয়ে পড়েছে।  নইলে মুদ্রণযন্ত্রের আতিশয্য সাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরকে সংকীর্ণ করে রাখবে। অন্যদিকে ফটোগ্রাফার, চিত্রশিল্পী, সিনেমা নির্মাতা, নাটক ইত্যাদি মাধ্যমে যারা কাজ করছেন তাদের ঐক্যের জায়গাগুলো অস্পষ্ট হয়ে পড়বে। কলম ( নাকি কী বোর্ড!), ক্যামেরা, তুলি কিম্বা মঞ্চ যে বিভাজনগুলো করে সেটা সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য বা চরিত্রের জন্য যতোটা তার চেয়ে অনেক বেশী মাধ্যম বা হাতিয়ারের ফারাকের জন্য খোপে খোপে আলাদা হয়ে যায়।  এই দিকটা এতোই স্পষ্ট যা আমার দেখেও দেখি না। প্রতিপক্ষ সেই দিকে নজর ফেরাতে চাইছে সবার।

স্মৃতি এক দারুন জিনিস। আলোচনা সুনির্দিষ্ট করতে গিয়ে স্মৃতির কথা এসেছে। ফটোগ্রাফি কিভাবে স্মৃতিচারণ করে? ধরুন ঢাকাকে নিয়ে? আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে পুরান ঢাকাকে নিয়ে? আর যদি এই স্মৃতিচারণের অনুপ্রেরণা আসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর শহিদুল জহিরের সাহিত্য থেকে? তাহলে সাহিত্য কিভাবে ফটোগ্রাফিকে অনুপ্রাণিত করে সেই দিকটার প্রতিও আমাদের আগ্রহ জাগতে পারে। সিনেমা গল্প বা উপন্যাসকে সিনেমা বানায়, এটা আমরা জানি। ফটোগ্রাফিও সেই কাজ করে বা করতে পারে, খবর হিসাবেও সেটা আমাদের কাছে পৌঁছায় নি। তাই না? সে কারনে প্রতিপক্ষের উৎসাহ।

অন্যদিকে সিনেমাও বা কিভাবে ঢাকাকে মনে রেখেছে বা মনে রাখবার চেষ্টা করেছে। ধরুন খান জয়নুলের ‘তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ ছবিতে। এই যে বিভিন্ন মাধ্যম বা টেকনলজি তাদের নিজ নিজ কৃৎকলা ও আঙ্গিকের জায়গা থেকে ঢাকা শহরকে ভাবছে, মনে রাখার চেষ্টা করছে – সেই দিকে সবাইকে যথাসাধ্য উৎসাহিত করবার এই চেষ্টা । মূল কথা হচ্ছে সাহিত্য কোন বিশেষ টেকনলজি – বিশেষত ছাপাখানার – একচেটিয়া না। প্রতিটি টেকনলজি বা মাধ্যম যা চর্চা করে তা সাহিত্য ছাড়া ভিন্ন কিছু না। যদি ‘সহিত’ থেকে সাহিত্য কথাটার তাৎপর্য আমরা কদর করি, তাহলে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না। তবে কলোনিয়াল অভ্যাসে ইংরেজি ‘লিটারেচার’ শব্দটির অনুবাদ হিসাবে আমরা ‘সাহিত্য’ বুঝি তাহলে আমাদের কথা বুঝতে একটু থমকাতে হবে। ইংরেজ তো গিয়েছে অনেক কাল হোল। এবার নিজেদের মত করে চিন্তা করবার জায়গাগুলো তো পরিচ্ছন্ন করা দরকার।  এটাই আমরা বলতে চাইছি।

 কিভাবে সাহিত্য চর্চা করছেন আমাদের ফটগ্রাফাররা? এই প্রশ্ন তুলে  ছাপলেই সেটা ‘সাহিত্য’ হয় এই ধারণা ভাঙবার পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে চাইছে প্রতিপক্ষ। ‘সাহিত্য’ সংক্রান্ত ধারণাকে আরও বৃহৎ কাণ্ড জ্ঞান করে আরও বিস্তৃত পরিসরে ভাববার জন্য এই ভাঙাভাঙির আয়োজন। ‘সাহিত্য’ সম্পর্কে আমাদের চিন্তা বড় দীর্ঘকাল বৃদ্ধ পাথরের মতো স্টোন হয়ে গিয়েছে, একে ভাঙা দরকার।

এই প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের সঙ্গে টেকনলজির সম্পর্ককেও আমরা বিচারের মুখে সামনে আনতে চাইছি। টেকনলজির প্রবল ও প্রকট প্রতাপের মধ্য দিয়ে কিভাবে আমাদের  নানান সম্পর্কের রূপান্তর ঘটছে সেটা খুবই গুরুতর বিষয়। সাহিত্যের দিক থেকে একে বোঝার উপায় কি? মুদ্রনযন্ত্র কি পুরানকে অসম্ভব করে তোলে নি? কিম্বা মুদ্রিত বাক্যের শুরু ও শেষ আছে বলে লিনিয়ার চিন্তা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে কি? এটা স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক?  এই পরিপ্রেক্ষিতে ফটোগ্রাফি ও সিনেমা কোথায় কিভাবে আমাদের রূপান্তর ঘটায়, ঘটাচ্ছে বা ঘটাতে সক্ষম সেটা ভাবা দরকার।

ঢাকার স্মৃতি নিয়ে ভাবতে গিয়ে কবিতার কথা মনে পড়ল। শামসুর রাহমান। ‘স্মৃতির শহর’। শহরের কাব্যানুবাদ কিম্বা শহর কবিতায় স্মৃতি, উপমা, উৎপ্রেক্ষা কিম্বা আরো নানান ইশারা হিশাবে কিভাবে হাজির থাকে কাব্যবিচারের দিক থেকে সেটা খুবই আকর্ষণীয় বিষয় হতে পারে। বলা বাহুল্য এটা শুধু প্রতীকে উৎপ্রেক্ষায়, আঙ্গিকে বা গঠনে শহরের উপস্থিতি বিচার না, কিম্বা শহরের স্মৃতিও শুধু নয় — তবে এইসবও, নিশ্চয়ই। শামসুর রাহমানের কবিতায় শহর কিভাবে এসেছে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে কিভাবে এসেছে সেটা বুঝবার আগেই তিনি ‘নাগরিক কবি’ খেতাব পেয়েছিলেন। যদিও নাগরিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধারণা, সেটা বাংলাদেশের শহুরে সাহিত্যে আদৌ আছে কিনা সেটা গুরুতর তর্কের বিষয়। কিন্তু পুরানো ঢাকা তার উপস্থিতি ও চলমান রূপান্তরসহ সাহিত্যে নানা ভাবে এসেছে।  চেনা ছবিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, মাহুতটুলির অলিতে গলিতে বেড়ে ওঠা শামসুর রাহমানের কবিতা কিভাবে স্মৃতি ও রূপান্তর ধরে রেখেছে, কিম্বা আদৌ রেখেছে কিনা তা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি।

শহর যখন সরাসরি শামসুর রহমানের কবিতার বিষয় তখন তাকে এভাবে পড়ি:

এ শহর ট্যুরিস্টের কাছে পাতে শীর্ণ হাত যখন তখন
এ শহর তালিমারা জামা পরে নগ্ন হাটে, খোঁড়ায় ভীষণ।
এ শহর রেস খেলে, তাড়ি গেলে হাঁড়ি হাঁড়ি, ছায়ার গহ্বরে
পা মেরে রগড় করে আত্মার উকুন বাছে, ঝাড়ে ছারপোকা।
কখনো-বা গাঁট কাটে, পুলিশ দেখলে
মারে কাট। টক টকে  চাঁদের মতোন চোখে তাকায় চৌদিকে,

এ শহর বেজায় প্রলাপ বকে, আওড়ায় শ্লোক।
গলা ছেড়ে গান গায়, ক্ষিপ্র কারখানায় ঝরায় মাথার ঘাম পায়ে।
ভাবে দোলনার কথা কখনো-সখনো
দ্যাখে সরু বারান্দায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির রূপ।

    … …

এ শহর ক্ষুধাকেই নিঃসঙ্গ বাস্তব জেনে ধূলায় গড়ায়;
এ শহর পল্টনের মাঠে ছোটে, পোস্টারের উল্কি-ছাওয়া মনে
এল গ্রেকো ছবি হয়ে ছোঁয় যেন উদার নীলিমা,
এ শহর প্রত্যহ লড়াই লরে বহুরূপী নেকড়ের সাথে।

( “এ শহর” ।। ‘নিজ বাসভূমে’।। শামসুর রাহমান)

তবে ‘প্রতিপক্ষ’ যখন এই অনুষ্ঠানটির বিষয় হিসাবে যুগপৎ স্মৃতি ও শহর নিয়ে ভাবছিলো তখন স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমিকে যে গল্প শামসুর রাহমান শোনাতে চেয়েছিলেন সেই শহরের গল্প মনে পড়ল। ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গমি আবার পুরানা রাজরাজড়ার কাহিনী শুনতে চায় না। তো শামসুর রাহমান গাছতলা থেকে প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি, আমার গল্প শুনবে তোমরা?

    ব্যঙ্গমা প্রশ্ন করছে: ‘কী তোমার পরিচয়?’

    ‘ছড়া কাটি কবিতা বানাই’  হেসে হেসে বললেন কবি

    ‘সেই শহরের গল্প শোনাতে পারবে তুমি?’

    ‘চেষ্টা করে দেখতে পারি’।

    ‘তোমার গল্প শুনতে রাজি আছি আমরা’।

     ‘তবে বলি, শোনো,…।।

শামসুর রাহমান তাঁর অভিজ্ঞতার ঢাকার গল্প বলছেন:

    “আরমানিটোলার মাঠ পেরিয়ে বাবুবাজারের পুল পেরিয়ে ইসলামপুরের রকমারি দোকান ঘেঁষে কখনো পাটুয়া্টুলির  পথ মাড়িয়ে, কখনো বা শাখারি বাজারের ভেতর দিয়ে পোগোজ ইশকুলে আসা-যাওয়া করতাম রোজ। শাঁখারী বাজারে ঢুকলেই একটা গন্ধ এসে জড়িয়ে ধরত আমাকে। শাঁখের গুঁড়োর । দেখতাম, শাঁখের ওপর করাত চালাচ্ছে দুবেলা। সমস্ত গলিটা রূপকথার ভ্রমর হয়ে উঠত করাতের গুঞ্জনে। দিনের পর দিন ওই সরু গলির ভেতর তৈরি হতো শাঁখের রকমারি সুন্দর সুন্দর সব জিনিস। ভাবতাম, ছোট একটি গলিতে এত লোক থাকে কী করে? এত সুন্দর কাজই বা শেখাল কে ওদের? সরু নরুনের মতো যন্তর দিয়ে শাঁখের গায়ে নকশা ফুটিয়ে তোলা তো মজাত খেলা। বছরের পর বছর ধরে এই ভারি মজার খেলাটা খেলে আসছে শাঁখারিরা। আজ যে শাঁখারি শাঁখের কারুকাজময় চুড়ি বানাচ্ছে, সে ওর বাবার কাছে শিখেছিল এই বিদ্যে। তার বাবা আবার শিখেছিল ওর বাবার কাছে। এমনি ধারা হাতে হাতে চলে এসেছে এই চমৎকার শাঁখের কাজ। আজ ঢাকা শহরের অনেক কিছু বদলে গেছে, কিন্তু শাঁখারিবাজার সেই আগে যেমন ছিল, এখনো রয়ে গেছে ঠিক তেমনই। সেই সারি সারি পুরোনো বাড়ি, ছোট ছোট নিচু নিচু ঘর। সেই অন্ধকার। সেই শাঁখ, সেই করাত। সেই শাঁখের গুঁড়ো, সেই গন্ধ”।

    (‘স্মৃতির শহর’, শামসুর রাহমান)

তাই কি? না, পুরানা ঢাকা আগে যেমন ছিল এখন কি তেমন রয়েছে? সব কিছু কি দ্রুত বদলাচ্ছে না?  ক্রমশ অপসৃয়মান শামসুর রাহমানের পুরান ঢাকা কি এখনও বর্তমান? যে ঢাকা শহর নিয়ে আমাদের সাহিত্য তা এখন একই সঙ্গে স্মৃতি।

স্মৃতি কিভাবে ধরে রাখা হবে, সেটা শুধু ইতিহাসের বিষয় নয়, সাহিত্যেরও বিষয়। ওর মধ্য দিয়ে যা নাই তা আমাদের মধ্যে হাজির হয় আবার, আর ওর মধ্য দিয়ে যিনি এই উপস্থিতির চর্চা করেন তিনিও। তিনি কখনও কবি, কখনও গল্পকার বা ঔপন্যাসিক; কখনও ফটোগ্রাফার, কখনও সিনেমা নির্মাতা, কখনও চিত্রশিল্পী বা ছবি আঁকিয়ে। বিভিন্ন টেকনলজি বা মাধ্যমের মধ্য দিয়ে সাহিত্যচর্চা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়।

শহর নিয়ে। আমাদের নিজেদের নিয়েও”।

লিখেছিলাম ১১ জানুয়ারি ২০১৫। ‘প্রতিপক্ষ’ কেন্দ্র করে কিভাবে সাহিত্য নিয়ে ভেবেছি এবং আমার বন্ধুদের নিয়ে কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি সে সম্পর্কে ধারণা দেবার জন্য এই পেছনের কথাগুলো জানিয়ে রাখলাম।

‘লিটারেচার’ বা ‘সাহিত্য’

লিটারেচার কথাটার অসারত্ব নতুন কিছু না। যারা টেরি ইগলটন (Terry Eagleton)  বা স্টেনলি ফিশের (Stanely Fish) মতো লেখকদের পড়েছেন তারা এ ব্যাপারে অবহিত আছেন বলেই আমার বিশ্বাস। ইগলটন লিটারেচারের  সার্বজনীন সারবত্তা (essence) অস্বীকার করলেও ক্যাটাগরিটির ব্যবহারকে অন্যায্য বলেন নি। অর্থাৎ ‘লিটারেচার নামক সার্বজনীন কোন সোনার অশ্বডিম্ব নাই। তবে লেখালিখিতে আমরা কিছু একটা বোঝাবার জন্য ‘লিটারেচার’ কথাটা ব্যবহার করি। সেই ব্যবহারের মানে কখন কোথায় কিভাবে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তার দ্বারাই বুঝতে হবে। এর বাইরে ‘লিটারেচার’ বড়জোর একটি বর্ণানাত্মক নির্দেশক। ছাপাখনায় ছাপা কিছু চিহ্ন এবং তার কায়কারবারের বর্ণনা। সুনির্দিষ্ট কোন আইডিয়া বা ধারণা না। লিটারেচার সংক্রান্ত তর্কগুলো  ছাপাখানায় ছাপা লেখালিখি কেন্দ্র করে। আমরা ‘সাহিত্য’ নামে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি তার সঙ্গে কিছুটা প্রাসঙ্গিক, কিন্তু ‘সাহিত্য’ সম্পর্কে আমাদের নতুন চিন্তাভাবনার জন্য কেন্দ্রীয় বিষয় না। তবে ‘লিটারেচার’ বা ‘সাহিত্য’ নিয়ে নতুন ভাবে ভাবনাচিন্তা করা যে ন্যায্য এটা অনেকের লেখালিখি থেকে অনেক আগেই টের পাওয়া গিয়েছিল।

রিদয়পুরের সাহিত্য আড্ডার আয়োজনের আগে থেকেই প্রতিপক্ষ ‘সাহিত্য’ ধারণাটিকে বিচারের অধীন আনবার জন্য কিছু কথা পেশ করেই শুরু করেছিল। প্রতিপক্ষের ওয়েবপাতাটি যেদিন প্রকাশিত হয়েছে সেদিন থেকেই আমরা নতুন কথাই বলেছি। তবে বলেছিলাম অতিশয় বিনয়ের সঙ্গে। নিজেদের ‘প্রাচীন’ বলে মেনে নিয়ে। যে অনুমানগুলো নিয়ে আমরা শুরু করেছি এবং তার যথার্থতা একমাত্র তাকে কাজে রূপ দেবার মধ্যেই বিচর্য। অনুমানগুলোকে আরওএকটু গুছিয়ে হাজির করা যাক:

১. সাহিত্য কথাটির একটা প্রাচীন মানে আছে আমাদের ভাষায়।  এর অন্তর্নিহিত ভাব নিয়ে আমরা প্রায় কিছুই ভাবি নি, বিশ্লেষণ করি নি, কিম্বা সেই ভাবকে আমরা এতোকাল গুরুত্ব দিতে রাজি ছিলাম না। পাশ্চাত্যের লিটারেচার ধারণাকে মোকাবিলার জন্য এখন দিতে চাইছি। এখন দেব।  আমরা সেই ভাবের সূত্র ধরে রাখতে চাই, কিম্বা সূত্র মনে রেখে বর্তমানে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা করতে চাই। যেহেতু সহিত থেকে সাহিত্য, অতএব সেই চর্চার সবার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ও বিরাজ করবার বাসনা। অর্থাৎ আমরা যে যার যার পছন্দের বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করলেও  সবার সঙ্গে যুক্ত হবার এবং সকলের মধ্যে বিরাজ করবার বাসনার মধ্যেই সাহিত্যের ঘটনা ঘটে। আমরা সাহিত্যকে নতুন করে আবষ্কার করি।

২. এই বাসনা আছে বলেই,  মানুষ কথা বলে আমরা শুনেছি। শ্রুতি আমাদের ঐতিহ্যে প্রামাণ্য বলে স্বীকৃত। অতএব পরম পুরুষদের বরাতে বলা শ্রুতিবাক্যও  প্রামান্য। কথাটা ধরে আমরা আরও একটু গভীরে নামতে পারি।

আমরা জানি গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটটল দাবি করেছিলেন মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী। এই দাবির পেছনে তার যুক্তি ছিল মানুষ স্রেফ জীব না। সে কথা বলে এবং কথা বলতে পারে বলে জীবগগতে প্রতিযোগিতা ও প্রতিযোগিতা থেকে উদ্ভূত দ্বন্দ্ব মানুষ কোন রক্তপাত ছাড়া সমাধান করতে পারে। নিদেন পক্ষে সমাধানের জন্য পরস্পরের মধ্যে কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারে।

পলিস এর বাংলা অনুবাদ করা হয় নগর রাষ্ট্রএরিস্টটটল পলিস বলতে আমরা এখন যেভাবে রাজনৈতিক কিম্বা ক্ষমতা করায়ত্ব করা বুঝি সেটা বোঝান নি। তিনি জীবাবস্থার অতিরিক্ত একটা বৃত্তির দিকে বরং ইঙ্গিত করেছিলেন, যার কারণে তিনি ধরে নিয়েছিলেন মানুষের জীবসত্তাই তার সত্তার সর্বস্ব নয়, তার পরমার্থিক একটা সত্তা আছে, যার কারণে মানুষ সমাজে বা সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে চায় এবং বাস করতে ভালবাসে। এই অর্থে মানুষ রাজনৈতিক অর্থাৎ কিভাবে সমাজে একসঙ্গে মানুষ বসবাস করবে সেই সিদ্ধান্ত সবাই মিলে নির্ণয়ের পরিসর হচ্ছে পলিস   এখানে সমাজ মুখ্য , সামাজিকতা আসল জিনিস। তাহলে ‘পলিস’ কে আমরা সামাজিকও বলতে পারি, কিম্বা সামাজিক-রাজনৈতিকও বলা যায়। মোট কথা মানুষ কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে সামষ্টিক বা সামাজিক হয় সেই বৃত্তির চর্চা।  তাহলে যার যার পছন্দের বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করা, অর্থাৎ  সবার সঙ্গে যুক্ত হবার এবং সকলের মধ্যে বিরাজ করবার বাসনার সঙ্গে মানুষের কথাসম্পন্ন বা ভাষাসম্পন্ন হওয়ার একটা যোগ আছে।

৩. তাহলে নিজেকে যে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে সমাজ নামক পদার্থটা দানা বাঁধেসমাজ একই সঙ্গে এক ও অনেক। আমি যেমন সমাজ, তেমনি আমি ছাড়া অন্যরাও সমাজেরই অন্তর্গত। সে সমাজের পরিসর আমরা সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক বৃত্তে বন্দী করব নাকি সকলকে অন্তর্ভূক্ত করারা চেষ্টা চালাব সেটা ভিন্ন তর্ক। আমরা একই সমাজে থাকি, আছি বা বাস করি। আর বাস করবার ক্ষেত্রে আমাদের ভাষার ভূমিকা নির্ধারক। সে কারণে সাহিত্যের ভূমিকা অনন্য। সেটাই আমামদের নতুন করে ভাবতে হবে।

সাহিত্য সমাজ ভাঙতে পারে,  চাইলে সমাজকে একত্রে বাঁধতেও পারে। আমাদের অনুমান তাহলে অমূলক নয় যে চিহ্ন বা আরও সুনির্দিষ্ট বা সংকীর্ণ অর্থে অক্ষর নিয়ে কায়কারবারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই উৎপাদন হয়সাহিত্য যদি সবার সঙ্গে যুক্ত হবার, যুক্ত থাকার এবং সামষ্টিক ভাবে  বিরাজ করবার বাসনা হয় তাহলে সেই বাসনা কোন না কোন চিহ্নব্যবস্থা বা মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যুগপৎ ব্যক্তি এবং সঙ্গে সমাজ হয়ে ওঠে সমাজের মধ্যে ব্যক্তি এবং ব্যাক্তির মধ্যে সমাজ একের মধ্যে অনেক এবং অনেকের মধ্যে এক-এর মহিমা বিস্ফোরিত করাই সাহিত্যের কাজ।

সাহিত্য ব্যাপারটা শুধু লিখিত ভাষার ব্যাপার না। সেটা আরও বড় জিনিস। সাহিত্য চর্চা শুধু গুটেনবার্গের টেকজনলজি দিয়ে হতে হবে তারও কোন কথা নাই – যে কোন মাধ্যম বা টেকনলজির মধ্য দিয়ে সাহিত্য চর্চা সম্ভব। অর্থাৎ মুদ্রিত অক্ষরের সঙ্গে সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য ও চিরায়ত সম্পর্কের একটা অবসান চাইছিলাম আমরা। যেন সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অন্যান্য মাধ্যমের ভুমিকা আমাদের দৃষ্টিগোচর হতে পারে।

কেন এখন এই ডিজিটাল যুগে এই ‘প্রাচীন’ অর্থটা ধরে রাখতে চাইছি সেটা আমরা আরও লেখালিখি ও কাজের মধ্যে আগামিতে আরও ব্যাখ্যা করব বলে পণ করেছিলাম। ‘সাহিত্য’ কথাটাকে  তার মাধ্যম বা বিশেষ টেকনলজির সঙ্গে সম্পৃক্তি থেকে  আমরা  মুক্তি দিতে চাইছি সেটা অনেকের কাছেই এখন সম্ভবত স্পষ্ট করতে পেরেছি।  কিছু লেখালিখিও হয়েছে। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেককেই ব্যাখ্যা করে বলেছি। আমরা ‘সাহিত্য’ বলতে শুধু বইপত্র বুঝি না, সিনেমাকেও বুঝি। টেলিভিশানও। সঙ্গীতও শিল্পকলার সব মাধ্যমও সাহিত্যের অন্তর্গত। এমনকি কারুশিল্পী যখন তার হাতের কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন সেটাও সাহিত্য। আমাদের কাজ ‘সাহিত্য’কে ছাপাখানা থেকে মুক্ত করে দেওয়া। সবার জন্য একটা প্লাটফর্ম তৈরি করা। বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত ভাবে আমাদের আরো লিখে যেতে হবে। তবে কথার চেয়ে কাজ করে দেখানোই আসল কথা।

মুখের ভাষা বা মুদ্রিত অক্ষরই একমাত্র চিহ্নব্যাবস্থা নয়। সিনেমারও একটা ভাষা আছে। যেমন আছে ফটোগ্রাফি বা স্থির চিত্রের, রঙের ও তুলির, স্পেইস বা জায়গা ব্যবহারেরও ভাষা আছে, যাকে আমরা স্থাপত্য বলি; ভাষা আছে নাচের মুদ্রা আর জীবন্ত শরীরের বিশেষ স্থাপত্য নির্মাণে, সঙ্গীতের পর্দা ও তাদের আন্তঃসম্পর্কের  ভাষাও ভাষা– এমনকি ভাষা আছে পোশাক আশাক, ফ্যাশান, কিম্বা ঘর সাজানোর মধ্যেও। নাটক, যাত্রা, পালা – নানান ভাষা আর নানা ভাবে মানুষের সাহিত্য চর্চার ধরণ। প্রাচীন ‘সাহিত্য’ কথাটির পরিব্যাপ্তি এতো তুমুল ও গভীর সেটা আমরা টের পেয়ে আমোদিত অনেক দিন থেকেই। সবার সঙ্গে যুক্ত ও বিরাজ করবার বাসনার চর্চা যে কোনচিহ্নব্যাবস্থা, মাধ্যম, উপায়  বা টেকনলজির মধ্য দিয়ে যে কেউই চর্চা করতে পারেন। করেনও বটে। আমরা তাই সকলের, সকল মাধ্যমের ‘সহিত’ সাহিত্য করতে চাই।

আমরা কৃতজ্ঞ সিনেমার ভাষাও সাহিত্য চর্চার একটা ধরণ,  রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডায় যাবার আগে নূরুল আলম আতিককে এটা বোঝাতে আমাদের একদমই বেগ পেতে হয় নি। রিদয়পুরে কেউই প্রশ্ন তোলে নি, সাহিত্যের আড্ডায় আবার সিনেমার লোক কেন? তাঁদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু সিনেমার নিজের একটা ভাষা আছে, সেটা মুদ্রণ যন্ত্রের ভাষা কিম্বা গুটেন বার্গ টেকনলজি নয়। পার্থক্য এখান থেকে শুরু হয়।  কিভাবে সে ভাষা নিয়ে আমরা কথা বলব বা আলোচনা করব সেই দিক তাহলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নূরুল আলম আতিক তাই রিদয়পুরে সিনেমার ভাষা নিয়ে কথা বলেছেন। ‘সাহিত্য’ কথাটাকে একটি বিশেষ ভাষা, মাধ্যম বা প্রযুক্তি থেকে বিযুক্ত করে বিভিন্ন মাধ্যমে যাঁরা কাজ করছেন সকলকে নিয়েই সাহিত্যচর্চা কেন জরুরী তার একটা ছোটখাট রিহার্সাল হয়ে গিয়েছিল রিদয়পুরে। সাহিত্যের ধারণাটিকে পরিচ্ছন্ন করা ছাড়াও আরও নানান দিক থেকে বাড়তি লাভ তো ছিলই।

এটা পরিষ্কার যে সাহিত্য বলতে সকলে যা বোঝে সেই গড়পড়তা গড়ে হরিবোল জায়গা থেকে আমরা সাহিত্য বুঝতে চাইনি । এটা না বোঝার কিছু নগদ লাভ আছে। অন্যান্য ভাষা, চিহ্নব্যবস্থা বা মাধ্যমে যারা কাজ করছেন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির তীব্র আকুতি জন্মেছে আমাদের মধ্যে।  আমাদের অনুমান এই সম্পর্ক বাড়াতে পারলে সব মাধ্যমে সাহিত্যচর্চার প্রণোদনা বাড়বে, নতুন কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করা যাবে, নানান মাধ্যমে নতুন কিছু তৈরি হবে। এটা হবে কিনা হলফ করে বলবার কোন উপায় নাই। কিন্তু কাজটা আমাদের জরুরী মনে হয়েছে। এই আকুতি থেকেই আমরা নতুন সিনেমার সম্ভাবনার কথাও ভাবতে পারছি। এটা শুধু সিনেমার আকুতি নয়, সাহিত্যের আকুতি।

তখন এটাও মনে হয়েছে প্রতিপক্ষ যে ধারণা নিয়ে কাজ চায় সেটা সকলকে বোঝানো দরকার। কিন্তু সেটা এক লাফে হবে না। এ একটা কাজ বটে। আমরা অক্ষর বা মুদ্রণ যন্ত্রের মধ্যে তৈয়ার হওয়া সাহিত্যকে সাহিত্য মানি, কিন্তু সেটাই শুধু সাহিত্য নয়, রিদয়পুরের সাহিত্য আড্ডায় সেটাই আমরা বোঝাতে চেয়েছি। ফলে সেখানে বাখতিনের উপন্যাস তত্ত্বের পাশা পাশি সিনেমার ভাষা নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু সাহিত্য সম্পর্কে অন্যদের প্রথাগত ধারণা ও মতকে উপেক্ষা করাও আমরা ঠিক মনে করি নি। কারণ আমরা যা ভাবছি সেটা তো সবাইকে যথেষ্ট বলি নি। বলবার সুযোগ ও সময় দুটোই দরকার। কোন বড় বা জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন করবার আগে সাহিত্যের ধারণা নিয়ে যথেষ্ট লেখালিখি, কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা জরুরী

আশির শেষ ও নব্বইয়ের শুরুতে প্রতিপক্ষ যখন বেরুচ্ছিল, এবং আমরা বৃহস্পতিবারের আড্ডা চালিয়ে যাচ্ছিলাম   ‘সহিত থেকে সাহিত্য’ কথাটা তখনও বলতাম, কিন্তু তাকে প্রাচীন ধারণা গণ্য করেই কথা হোত, সে অনুমানে সংশয় ও সন্দেহ ছিল না, তা নয়। কিন্তু তাকে বিচারের অধীনে আনা হয় নি। ‘সাহিত্য’ কথাটা লিটারেচার-এর চেয়ে ভালো লাগত। বাংলা বলে নয়, টের পেতাম এর কিছু তাৎপর্য আছে যাকে  লিটারেচারের অনুবাদ হিসাবে গ্রহণ করলে হারিয়ে যায়। হারানোর হাহাকার তখন অতো তীব্র বোধ করতাম না, কারন তাকে বোঝার জন্য যথেষ্ট ভাবাভাবি করতে পারিনি আমরা। এটাও তখন বুঝিনি যে এই ধারণা টেকনলজি বা কৃৎকৌশলের ধারণার সঙ্গে যুক্ত, যাকে সাধারণত আমরা বাংলায় ‘মাধ্যম’ বলে থাকি। ‘প্রতিপক্ষ’ নিজেকে লিটারারি ম্যাগাজিন বা পত্রিকা হিসাবে হাজির করেছিল ফলে ‘সাহিত্য’ কথাটার দ্যোতনা বা তাৎপর্য  বিচার তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হয় নি। ‘সহিত থেকে সাহিত্য’ কথাটা প্রাচীন ধারণা হিসাবে বহাল থেকে গিয়েছিল। লিটারেচার কথাটারই অনুবাদ হিসাবে এর আধিপত্য রয়ে গেল। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ যখন নিজেকে কেবলই মুদ্রিত অক্ষরের পত্রিকা ভাবত তখন সাহিত্য বলতে আমরা লিটারেচারই বুঝেছি। ইংরেজির অনুবাদে।

লিটারেচারের ধারণা দানা বেঁধেছে আধুনিকতার মধ্যে। কিন্তুই যে আধুনিকতা আমরা কলোনির দুর্দশা ভোগ করা দেশে চর্চা করি সেটা পাশ্চাত্য এনলাইটমেন্ট নয়, বরং ঔপনিবেশিক সম্পর্কের অধীনতা মেনে ‘আধুনিকতা’ নামক একটা ফিনিশড প্রডাক্ট কঞ্জিউওমার হিসাবে ভোগ। আমরা কোকাকোলা খাই, কিন্তু কোকাকোলা কোঠায়, কিভাবে কেমন করে উৎপাদন করা হয় সে সম্পর্কে আমদের কোন হুঁশজ্ঞান নাই। আমরা শুধু খাই বা পান করি। আর পাশ্চাত্য তা বেচাবিক্রি করে। সংক্ষপে কোকাকোলা উপমা দিয়ে বোঝাতে চাইছি। ঠিক তেমনি পাশ্চাত্য লিটারেচার করে আমরা তাকে অনুবাদ করে সাহিত্য করি। কিন্তু আমাদের ভাষায়, উপলব্ধিতে কিম্বা সাহিত্যের ইতিহাসে ধারণাটির যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য আছে আমরা তা খোঁজ করে দেখি নি। তাকে পরখ বা পর্যালোচনা করা তো দূরের কথা। লিটারেচারের ধারণাকে নির্বিচারে গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাকে অনুবাদ সাহিত্য বলে চালিয়ে দিয়েছি। সহিত থেকে সাহিত্য কথাটার মর্ম বোঝার চেষ্টা করি নি। লিটারেচার  অর্থেই আমরা সাহিত্য কথাটা এখনও ব্যবহার করি।  প্রতিপক্ষ যখন শুধুই সাহিত্য ম্যাগাজিন ছিল তখনও ইংরেজি লিটারেচার কথাটার অনুবাদ আমরা ‘সাহিত্য’ করব কিনা তর্ক উঠেছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষের বৃহস্পতিবারের আড্ডা বন্ধ হয়ে যাবার ফলে তর্কটা আগায় নি; পত্রিকাটিও নানা কারনে বের করতে পারি নি।

লিটারেচার একটি আধুনিক ধারণা, ফলে এর বিচারও অনেকাংশে আধুনিকতা-বিচারের অন্তর্গত। কিন্তু সেই দিকে এখন এখানে যাচ্ছি না। এটা তো বোঝাই যায়  ‘লিটারেচার’ কোন হাওয়াই ধারণা না। তার দেশকালপাত্র আছে। আধু্নিকতার  মধ্যেই তার আবির্ভাব ও বিকাশ। আধুনিকতার একটা ভাবগত আছে, কিন্তু সেই ব্যাখ্যা নিয়ে এখানে কালক্ষেপ করবো না, সেটা এখানে জোর দেব টেকনলজি বা কৃৎকৌশলের ওপর। যাকে আমরা সাধারণত ‘মাধ্যম’ বলে এড়িয়ে যাই, কিম্বা অপরিচ্ছন্ন করে ফেলি। যেমন, শিল্পমাধ্যম। অনুমান হচ্ছে মাধ্যম একান্তই একটি উপায় – শিল্পের চর্চা, মর্ম নির্ণয়ে বা অর্থোৎপাদনে এর কোন ভূমিকা নাই। মার্শাল মাকলুহানের ‘মিডিয়া ইজ দ্য মাসাজ’ – বা মাধ্যমই  মর্ম নির্ণয় করে, কথাটা বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে শোনা গিয়েছিল, কিন্তু  এর প্রতি খুব একটা মনোযোগ কারো দেখি নি। কিন্তু মাকলুহানও এখন আমার আলোচনার বিষয় নয়।

বলা হয় ট্রাজেডি ও মহাকাব্যের যুগ লিটারেচা্রের যুগ নয় – বিশেষত উপন্যাসের যুগ তো নয়ই। উপন্যাস তখনই সম্ভব যখন ভাষা বলতে আমরা যেভাবে মুখের ভাষা বুঝি সেভাবে  আর স্মৃতি, শ্রুতি ও কন্ঠের আদানপ্রদান ও এই তিনের সীমার মধ্যে আবদ্ধ নাই। মূদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, উপন্যাস মানুষ শোনে না, পড়ে। আর পড়া মানে কান বা কণ্ঠ না,  চোখের ভূমিকা  প্রধান হয়ে ওঠা। যদি এতোটুকু বুঝতে পারি তাহলে কৃৎকৌশল কিভাবে সাহিত্য চর্চার মধ্যেও বিপ্লব ঘটিয়েছে ( নাকি অন্য কিছু) তার খানিক হদিস আমরা করতে পারব। যদি তাই হয় তাহলে সাহিত্যের বিচার সাহিত্যের নিজের ক্ষেত্র ছাড়া একই সঙ্গে  কৃৎকৌশল ও নৃতাত্ত্বিক বিচারেরও অন্তর্গত।

বিস্তৃত অর্থে লিটারেচার  হচ্ছে যে কোন লিখিত কাজ। যদি ব্যূৎপত্তি বিচার করি ,তাহলে সেটা এসেছে ল্যাটিন থেকে (literature/litteratura – ইত্যাদি। এর অর্থ যাকে অক্ষর দিয়ে তৈয়ার করা হয়। গীত বা মৌখিক সাহিত্যকে মাঝে মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে, কিন্তু সেটাও  তার মূদ্রিত রূপকে। তার মৌখিক রূপ সাহিত্য বিচারের বাইরে রয়ে গিয়েছে।

লিটারারি ব্যাপার বা বিষয় বলতে কী বুঝব তা নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে; যেমন, কোন একটি মূদ্রিত লেখার সাহিত্যিক মূল্য কি? লিটারেচারের যেটা লিটারারি ব্যাপার বা তার ‘সাহিত্য মূল্য’ সেই মূল্যের বিচার করার সময় ধরা পড়ে লিটারেচার একান্তই মূদ্রণ যন্ত্র ও মূদ্রিত অক্ষরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ লিটারেচার নিয়ে কোন কিছু বিচারের আগেই মুখস্থ সাহিত্য, বা মুখে তৈয়ারি সাহিত্য আগেভাগেই বাদ দিয়ে রাখা হয়। যেমন কবিতার আলোচনায় আমরা লালন, জালাল উদ্দীন খাঁ, কুবীর গোঁসাইদের নিয়ে আলোচনা করি কি? করি না। তাদের আমরা পছন্দ করলেও সাহিত্যের প্রচলিত সংজ্ঞায় তাঁরা পড়ে না। কারণ তাঁরা তাদের কাজ মুদ্রিত অক্ষরে প্রকাশ করেন নি। গলা দিয়ে গেয়েছিলেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের মনে হয়েছে নতুন ভাবে যখন প্রতিপক্ষ আবার নিজেকে জাহির করতে চাইছে, তখন আমরা যেন ‘সাহিত্য’ কথাটিকে তার প্রাচীন অর্থেই বুঝি। লিটারেচার অর্থে না। এর  প্রথম সুবিধা হচ্ছে পাশ্চাত্যের ইতিহাস , বিশেষত টেকনলজির ইতিহাসের সঙ্গে লিটারেচারের যে ধারণা গড়ে উঠেছে সেই ধারণা থেকে নিজেদের বিযুক্ত করা। লিটারেচার যদি শুধু মুদ্রিত অক্ষরের কায়কারবার হয় তবে তাকে অনুবাদ হিসাবে ‘সাহিত্য’ কথাটা আমরা পরিত্যাগ করছি। এটা প্রথমেই সবাইকে জানিয়ে দেওয়া। এরপর প্রশ্ন আসে, তো সাহিত্য মানে কি? সেই কারনেই আমরা বলেছি, ‘আপাতত’ আমরা সহিত থেকে সাহিত্য – এই প্রাচীন ধারণাটি মাথায় রেখেই শুরু করি। শুরু করবার জন্য এই অনুমানটুকুই যথেষ্ট। সাহিত্যের মানে খুঁজতে খোঁজা মানে নতুন অর্থোৎপাদনের অন্বেষণ। সেটা না হয় অন্বেষণ হয়েই থাকুক। এখন এটাই আমরা মানি যে লেখালিখি, সিনেমা, যাত্রা, নাটক, ছবি আঁকা, ফটো তোলা সবই সাহিত্য চর্চার প্রকার ভেদ, কিন্তু তাদের ভেদবিচার তাদের মাধ্যম বা তাদের নিজ নিজ ভাষার  বিচার ছাড়া সম্ভব না। সাহিত্য যদি কোন বিশেষ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত না থাকে তাহলে সবই তাদের নিজ নিজ মাধ্যমের জায়গা থেকে সবার সঙ্গে যুক্ত হবার বা  বিরাজ করবার বাসনা চর্চা করে। এই বাসনা আছে বলেই মানুষ কথা বলে, গান গায়, ছবি আঁকে, ছবি তোলে, নাটক করে, ইত্যাদি। ওর মধ্য দিয়ে সমাজ নামক যে-পদার্থটা দানা বাঁধে তা একই সঙ্গে এক ও অনেক। এই এক ও অনেককে বিমূর্ত ভাবে ভাবলে চলছে না। তাকে সুনির্দিষ্ট মাধ্যম বা ভাষার মধ্য দিয়ে বোঝা দরকার।

এই অনুশীলন বলাবাহুল্য ‘লিটারেচার’ চর্চা না। সাহিত্যের চর্চা।  সকলের সঙ্গে‘সহিত’ হবার,  সম্পর্কিত থাকবার বাসনা বা ইচ্ছা ব্যাপারটা বিভিন্ন মাধ্যম তার নিজ নিজ ভাষায় চর্চা করে। আমাদের খুবই সরল ও সিধা দাবি হচ্ছে, সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়েই ‘ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই উৎপাদন হয় বলে প্রচার আছে’। যদি তাই হয় তাহলে বিভিন্ন মাধ্যমের সাহিত্য চর্চা কী ধরনের ব্যাক্তি ও সমাজ উৎপাদন করছে সেই মোক্ষম বিষয়ের দিকে আমরা কার্যকর ভাবে মুখ ফেরাতে পারি।

অনেকে বলতে পারেন, সাহিত্য সবসময় নিজ নিজ ভাষার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ  উৎপাদন করে; ঠিক, কিন্তু কী ধরণের ব্যক্তি বা সমাজ তৈয়ার করে তার বিচার তো দরকার। তার ক্ষেত্র আলাদা। এমন সমাজও সাহিত্য তৈয়ার করতে পারে যা নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য না। ঠিক। সবই হতে পারে। সাহিত্যের সঙ্গে নীতিনৈতিকতা, রুচি, নান্দনিকতা, সত্য-মিথ্যা ইত্যাদির তর্ক আছে। নীতি, আদর্শ, কে কী ধরণের ব্যাক্তিত্ব চাই বা কি ধরণের সমাজ আমরা বাসনা করি সেই সকল ভিন্ন তর্ক। এই ক্ষেত্রে বইপুস্তকের তৈয়ারি নিয়ে যে বিচার, সিনেমা-টেলিভিশান বানানোর বিচারও আলাদা কিছু না। কিম্বা চিত্রকলা বা যাত্রার। এই সকল তর্ক আছে। থাকুক। আমরা আপাতত শুধু এতোটুকুই চাইছি যে বইপুস্তকের সাহিত্যই সাহিত্য – আর ভিন্ন মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা — যেমন, সিনেমা বানানো ভিন্ন একটা ব্যাপার — এই অনুমানের অবসান ঘটুক। সাহিত্যের আলোচনাকে বিশেষ একটি মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত করে বিচারের অভ্যাস যতো তাড়াতাড়ি আমরা ত্যাগ করব, গুটেনবার্গের টেকনলজির বাইরে অন্যান্য মাধ্যমের শক্তি ও সীমা সম্পর্কে আমাদের ধারণাও আরও পরিচ্ছন্ন হবে।

শেষে একটি সতর্ক বাণী। বিশেষ একটি মাধ্যমের সঙ্গে সাহিত্যের বিযুক্তি চাওয়ার অর্থ মোটেও সাহিত্যের সঙ্গে তার ভাষার বিযুক্তি দাবি করা নয়। সাহিত্য মাত্রই তার ভাষার, মাধ্যম বা চিহ্ন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। সাহিত্যকে বিশেষ মাধ্যম – বিশেষত মূদ্রণ যন্ত্র থেকে বিযুক্ত করলে আমরা সাহিত্য নিয়ে আরও দরকারী বিচারে প্রবেশ করতে পারব। অন্তত বুঝব বিভিন্ন মাধ্যমের চরিত্র বা ভাষাও সেই মাধ্যমের সাহিত্য চর্চাকে সুনির্দিষ্ট রূপ দেয়। এই দিকগুলো নিয়ে আমাদের সমাজে বিশেষ ভাবনা চিন্তা হয় নি এবং হয় না বললেই চলে।

বিভিন্ন মাধ্যমের নিজ নিজ ভাষার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। । যেমন, রিদয়পুরে  সিনেমার ভাষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সিনেমার ভাষা কি? সিনামার ভাষা বোঝার জন্য আমাদের আগ্রহ আছে কি? আমরা সিনেমা দেখতে গিয়ে কি সিনেমা ‘দেখি’? নাকি গল্প খুঁজি। সিনেমাতে গিয়ে আমরা গল্প দেখি, বা উপন্যাস পাঠ করি। কাহিনী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু সিনেমা দেখি কি? খুব কমই দেখি। দেখতে হলে সিনেমার ভাষা কিছুটা রপ্র থাকা দরকার। আমরা অনেক কিছুই অনুমানে পার করে দিতে চাই। সেটা সম্ভব কি?

তাহলে বিভিন্ন মাধ্যমের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলার দিকেই আমাদের বিশেষ আগ্রহ। এটা সাহিত্যিক আগ্রহ। নিছক সিনেমা প্রীতি নয়। তাই সিনেমা যারা বানাচ্ছেন তাদের কাছে আমরা যাচ্ছি। ক্রমে ক্রমে অন্যদের কাছেও। সাহিত্যের দরকারেই বিভিন্ন মাধ্যমের ভাষা নিয়ে আমাদের অনেক অনেক ভাবা দরকার।  

শেষে যে কথাটা বলা দরকার সেটা হোল যাদের ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ‘প্রতিপক্ষ’ প্রকাশ, রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডার আয়োজন, উদযাপন পর্বের অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পন্ন অসম্ভব হোত তাদের মধ্যে মোহাম্মদ রোমেলের ভূমিকা ছিল অসামান্য। রোমেল কাজ করেন নীরবে, সেটা তার স্বভাবের দিক, কিন্তু আমার দিক থেকে মোহাম্মদ রোমেল বিভিন্ন সময়ে হতাশা এবং ভেঙ্গে পড়ার মুহূর্তে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরামর্শ দাতা। এছাড়া ছিলেন গৌতম দাস, মুসতাইন জহির, মাহমুব মোর্শেদ, সুজন, শাহাদাত তৈয়ব, ফ্লোরা সরকার, রওশন আরা মুক্তা এবং চিন্তা পাঠচক্রের আরও অনেকে। উদযাপন পর্বে তৈমুর রেজা ও সুমন রহমান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এদের সবার কাছে প্রতিপক্ষ কৃতজ্ঞ। প্রতিপক্ষ যখন পত্রিকা হিশাবে প্রথম প্রকাশিত হয় তখন আইয়ুব হোসেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁকে স্মরণ করি। রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডা সংগঠিত করবার ক্ষেত্রে আলমগীর নিষাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাকেও স্মরণ করি। নানা সময়ে নানান ভাবে অনেকে আমামদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আলাদা করে মস্তো তালিকা দিচ্ছি না। কিন্তু সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

আর যারা শুরু থেকে বিরোধিতা করেছেন, কিম্বা মাঝপথে, কিম্বা এখনও — তাদেরকেও। বিদ্বেষ, বিভক্তি ও বিভাজনের বিষবাষ্পে টইটুম্বুর বাংলাদেশে ফণা ও ছোবলে জর্জরিত না হওয়াটাই চরম অস্বাভাবিক ঘটনা। তাদের কাছেও আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ।


এই লেখাটি প্রতিপক্ষ সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যে সফর আজ অবধি সবাই মিলে আমরা করে এসেছি তার একটা হদিস দেবার জন্য লিখে রাখলাম। মূলত নিজের জন্য এবং যারা প্রতিপক্ষের ব্যাপারে এখনো বিপুল ভাবে আগ্রহী তাদের সবার জন্যও বটে। পেছনের ইতিহাস জানা থাকলে সামনে এগিয়ে যাওয়া সহজ হয়।    লেখাটি শেষ করবার আগে একটা কথা মনে হচ্ছে, সেটা বলে শেষ করি। ছাপাখানা কিম্বা টেকনলজি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ বদলায় অজান্তে, পেছন থেকে; কিন্তু সাহিত্য সম্বন্ধ স্থাপন করে সজ্ঞানে, প্রযুক্তি ও পুঁজির বিপরীতে দাঁড়িয়ে, সামনা সামনি। বুঝতে পারছি আগামি দিনগুলোতে এই উপলব্ধিটুকু আমাকে আরও গুছিয়ে বিশদ ভাবে  ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বলতে হবে।

কিন্তু আজ এতোটুকুই …।

লেখক পরিচিতি:

ফরহাদ মজহার

কবি, চিন্তক, বুদ্ধিজীবী ও কৃষক। জন্ম: ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলায়। পড়াশুনা করেছে ওষুধ শাস্ত্র ও অর্থনীতি বিষয়ে যথাক্রমে ঢাকা ও নিউইর্কে। পেশা সূত্রে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশের ‘নয়াকৃষি আন্দোলন’-এর প্রধান সহযোদ্ধা। লালন ধারা-সহ বৃহৎ বঙ্গের ভাবান্দোলন পরম্পরার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সমাজ ও রাজনীতি চিন্তা এবং দার্শনিক বিষয়ে বহু গদ্য রচনা করেছেন। এছাড়াও লিখেছেন নাটক। অনুবাদও করেছেন।
তাঁর বইগুলি-

কাব্যগ্রন্থ:
খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ (১৯৭২)
ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি (১৯৭৭)
আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে (১৯৮৩)
সভাকুসুম দুই ফর্মা (১৯৮৫)
বৃক্ষ: মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিষয়ক কবিতা (১৯৮৫)
অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন (১৯৮৫)
খসড়া গদ্য (১৯৮৭)
মেঘমেশিনের সঙ্গীত (১৯৮৮)
অসময়ের নোটবই (১৯৯৪)
দরদী বকুল (১৯৯৪)
গুবরে পোকার শ্বশুর (২০০০)
কবিতার বোনের সঙ্গে আবার (২০০৩)
ক্যামেরাগিরি (২০১০)
এবাদতনামা (২০১১)
এ সময়ের কবিতা (২০১১)
যে তুমি রঙ দেখোনি (২০১১)
কবিতাসংগ্রহ (২০১১)
তুমি ছাড়া আর কোন্ শালারে আমি কেয়ার করি? (২০১৬)
সদরুদ্দীন (২০১৮)

গদ্যগ্রন্থ:
প্রস্তাব (১৯৭৬)
সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান প্রসঙ্গে (১৯৮৫)
রাজকুমারী হাসিনা (১৯৯৫)
সাঁইজীর দৈন্য গান (২০০০)
জগদীশ (২০০২)
সামনা সামনি: ফরহাদ মজহারের সঙ্গে কথাবার্তা (২০০৪)
বাণিজ্য ও বাংলাদেশের জনগণ (২০০৪)
মোকাবিলা (২০০৬)
গণপ্রতিরক্ষা (২০০৬)
ক্ষমতার বিকার ও গণশক্তির উদ্বোধন (২০০৭)
পুরুষতন্ত্র ও নারী (২০০৮)
ভাবান্দোলন (২০০৮)
সাম্রাজ্যবাদ (২০০৮)
রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ (২০০৮)
সংবিধান ও গণতন্ত্র (২০০৮)
নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০০৮)
জ্যাক দেরিদা-র চিহ্ন বিচার (২০১০)
তিমির জন্য লজিকবিদ্যা (উপন্যাস, ২০১১)
প্রাণ ও প্রকৃতি (২০১১)
মার্কস পাঠের ভূমিকা (২০১১)
ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ (২০১২)
যুদ্ধ আরো কঠিন আরো গভীর (২০১৪)
ব্যক্তি বন্ধুত্ব ও সাহিত্য (২০১৬)
মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত (২০১৮
নাটক: প্রজাপতির লীলালাস্য (১৯৭২)

অনুবাদ:
অর্থশাস্ত্র পর্যালোচনার একটি ভূমিকা (মূল: কার্ল মার্কস) (২০১০)
খুন হবার দুই রকম পদ্ধতি (মূল: রোকে ডাল্টন) (২০১১)







Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top