ফাতেমা তুজ জোহরা
দাদীজান যেদিন মারা গেল, অনেক বৃষ্টি, আনুবিবি বৃষ্টির মধ্যে পুকুরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো দাফন হবার পরে, যতক্ষণ ডুবে থাকা যায় ডুবে রইলো, আবার শ্বাস নিতে উঠলো, মাথার ওপরে বৃষ্টির ফোঁটা সূচের মত বিঁধে, সেই ব্যথাও তার ভাল লাগে। আনুবিবির মনে হল পৃথিবীর সব ব্যথা তাকে আপন করে নিক, তার আর সুখ দরকার নাই।
দূর থেকে ভেসে আসছে কোলাহল। কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যারাতি ক্রমশ রহস্যময় হয়ে উঠছে। আনুবিবির হাতে মেহেদি, সে ঘরে স্থির হয়ে বসে আছে, অন্য মেয়েরা কোলাহল শুনে দৌড়ে গেল উঠোনে। বরযাত্রী এসেছে।
আজ আনুবিবির বিয়ে, বরযাত্রী এসেছে; হাতের মেহেদি এখনো শুকোলো না।
শুকাবেই বা কিভাবে, এত কাহিনী, এত ব্যস্ততায় কনের হাত সাদা রয়ে গেল কেউ খেয়ালই করল না। পরে ওই পাড়ার অশীতিপর বৃদ্ধা এসে বলল, ওলো পোড়ামুখীর দল, মাইয়ার হাতে রং কই? আসলেই তো, রং কই।
ওইদিকে খবর চলে এসেছে বরযাত্রী রওনা দিয়েছে।
মেহেন্দি গাছের পাতা তোলা নেই, যা ছিল কিশোরী মেয়েরা বেটে দিয়ে দিয়েছে।
ওই পাড়ার ফুলসনের মা বলল, মর পোড়ামুখীর দল। বিয়া কি তোগোর হচ্ছে রে? ধামড়ি মাগী গুলার রসের অভাব নাই, ছি!
কিশোরী দলের প্রধান ময়না, সে কোমরে আঁচল বেঁধে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, মাইয়ারে মোরা কইছিলাম, মাগী। না জাইন্না ভ্যাক ভ্যাক করবি না।
তাহলে কনে ই দেয় নি মেহেদি। কেন দেয় নি। ওইসব উত্তর খোঁজা বৃথা। এখন পাতা তুলো।
পাতা তুলে, বেছে, মেহেদি দিয়ে যেই বসলো, বরযাত্রীর কোলাহল শোনা গেল।
আনুবিবি চুপ হয়ে শুনতে লাগল। কাল রাতে সে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। সে সাদা শাড়ি পরে দৌড়াচ্ছে, একটু দূরে একটা কফিন, কার কফিন সে জানে না। কাছে যেতে দৌড়ে যাচ্ছে, অথচ কফিনের কাছে আর পৌঁছাচ্ছে না।
ঘামে নেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। বিয়ের আগের রাতে কি দেখল, তার মানে কি? এখানে সুখ নাই? সাদা শাড়ি কেন? সে কি বিধবা হবে? এই কারণেই মন খারাপ ছিল, বিয়ের আয়োজনের ব্যস্ততার আড়ালে লুকিয়ে ছিল, যদিও বাবার উপরে কিছু বলার সাহস তার নেই, তবুও এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিল সব নীরবে। অথচ এই কোলাহলে ব্যস্ত মানুষ গুলো নীরবতার ভাষা বুঝবে?
*****
আনুবিবির হাতের মেহেদি ধুয়ে ফেলা হল। মেহেদিতে ঝাপসা রং ধরেছে, অথচ কথিত আছে, মেহেদির রং যত গাঢ় হবে, স্বামীর সোহাগ তত বেশি হবে।
আনুবিবি ঝাপসা মেহেদির রঙা হাতের দিকে তাকাল। মনটা আবার শিহরিয়ে উঠলো। একটু পরে ভাবল, মেহেদি রাখার তো সময়ই হল না। তাই এমন ঝাপসা। স্বামীকে ভালবাসার সময় হবে তো? কাঁচা মেহেদির রং কি সেই সময় স্বল্পতাই বুঝিয়ে দিল?
বাসর ঘরে বসে থাকতে থাকতে আনুবিবির ঝিমুনি এলো। সে চারপাশ টা ঘোমটার আড়াল থেকে দেখতে লাগল।
নতুন টিনের বেড়া, দক্ষিনমুখী জানালা, সেখান থেকে কোন বুনো ফুলের সুবাস আসছে। এই ফুলের নাম কি ভাবতে চেষ্টা করল সে। কিছুতেই মনে আসল না।
কুয়াশা কেটে চাঁদ উঠেছে, হিমেল হাওয়ায় আনুবিবির শীত করতে লাগল, সে শালটা জড়িয়ে নিল ভাল করে। বাইরে মানুষজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, তবে কিছুই বুঝতে পারছে না। দখিনা জানালার সামনে বিরান খেত। সেখানে রহস্যময় চাঁদের আলো।
আনুবিবির কাছে সব ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল।
দরজা লাগানোর শব্দে আনুবিবির ঘুম ভাঙলো। তাকিয়ে দেখল, তার স্বামী এগিয়ে আসছে। আনুবিবি ধড়মড় করে উঠে বসলো, গায়ের কাপড়, আঁচল, শাল ঠিক করলো। স্বামী হ্যারিকেনের সলতেটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে তার দিকে তাকালো।
তোমার নাম কি তোমার মুখেই শুনি, গলা ত শুনি নাই’।
আনুবিবি ভয়ে কাঁপছে, শাল গা থেকে ছলকে পড়ে গেল, উঠাতে উঠাতে বলল, মোসাম্মত আনু বেগম।
-ভাল নাম।
তার স্বামীর মুখে পান সে বুঝতে পারলো, কচ কচ করে পান চিবুচ্ছে। হঠাৎ করে মানুষটাকে তার ভাল লেগে গেল।- তা বাসায় কি ডাকে?
– আনুবিবি।
– আইচ্ছা। ত আমিও আনুবিবি ডাকমু, কি কও।
আনুবিবি মাথা নাড়লো।
দেখি ঘোমটা সরাও ত। এত কষ্ট করে বিয়া করলাম, তাও ময় মুরুব্বির যন্ত্রণায় মুখটা দেখি না।
আনুবিবি জড়োসড়ো হয়ে ঘোমটা সরালো। তার স্বামী তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।
তারপর বলল, চলে আর কি, গায়ের রং ফরসা হইলেই কি আর সুন্দর হয়!
আনুবিবির বুকে আঘাত লাগলো। সে ফরসা, কাঁচা সোনা গায়ের রঙের জন্য কম প্রশংসা শুনে নি সে। সে যে অসুন্দর তাও কেউ বলে নি। যদিও তার বয়স টা ১৫। অন্য সবার থেকে একটু দেরিতেই তার বিয়ে হয়েছে। তাও, অসুন্দর তো না।
মুহূর্তে মনটা দমে গেল। সে মাথা নিচু করে বসে রইলো।
-কি গো বউ, মন খারাপ হইল নাকি?
সে উত্তর দিল না, অনুভব করলো শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, শালটা আরেকটু গায়ে জড়িয়ে নিতে চাইল সে।আর জড়ানো হল না।
শালে টান পড়লো…আঁচলে টান পড়লো।
বাইরে জেগে রইলো মায়াময় রাত।
*****
আনুবিবির ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে, বাইরে প্রবল কুয়াশা, খোলা জানালা থেকে হিমেল হাওয়া আসছে। দু একটা কাকের উত্তেজিত গলা ও শোনা যাচ্ছে। তাছাড়া সব নীরব।
আনুবিবি আস্তে আস্তে পরনের কাপড় ঠিক করতে লাগল। আলগোছে তাকালো তার স্বামীর দিকে। লোকটা বাচ্চাদের মত ঘুমুচ্ছে। অথচ তাও এই লোকটাকে তার এত ভয় লাগে কেন!
কাল রাতের কথা ভাবতেই গা শিউরে উঠলো, তাও আনুবিবি এই অদ্ভুত লোকটার প্রতি প্রবল মায়া অনুভব করলো, কেন করলো জানে না।
সে তার স্বামীকে ভাল ভাবে দেখতে লাগলো। দুধে আলতা গায়ের রং, জোড়া ভ্রু, খাড়া নাক, আর মোটা ঠোঁট । পান খাওয়ার কারণে ঠোঁট দুটো লাল।
সুদর্শন বটে। নামটাও সুন্দর। মইন মিয়া। আনুবিবি নিজের অজান্তেই হাসলো। হেসেই লজ্জা পেয়ে গেল।
মইন মিয়ার থেকে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে শাড়ির আঁচল গায়ে তুলে বিছানা থেকে উঠলো। মইন মিয়া শব্দে জেগে উঠলো। তার দিকে কতক্ষণ অপরিচিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো।
– কিগো, এই সকালে কই যাও। কেউ উঠে নাই।
– হাতে মুখে একটু পানি দিতাম।
– আরে পানি দেওয়া যাইব একটু পর, গরম পানি। মইন মিয়া খিক খিক করে হাসলো। হাসিটায় দুষ্টু ইংগিত। আনুবিবি শাড়ির আঁচল মুখে চেপে বসে পড়লো। সে ভুলেই গিয়েছিল এটা শ্বশুর বাড়ি, আর যে রাতটা কাটলো এটা বাসর রাত। চাইলেই ঠিক বের হওয়াটা আজ শোভন না।
মইন মিয়া বউকে বলল, পান বানাইতে পারো নি?
আনুবিবি মাথা নাড়লো।
– কেমন পারো? কাউরে বানাইয়া খাওয়াইছ?
– দাদিজানরে বানাইয়া দিতাম।
– ভাল। ওই নামাজের চকির উপরে পানের থাল আছে। নিয়া আইসা বানাইয়া দাও।
আনুবিবি সন্ত্রস্ত হয়ে পানের থালা নিয়ে এসে খাটের এক কোণে বসলো।
মইন মিয়া হাই তুলে আবার চোখ বুজলো। বুঝা গেল ঘুম আর ক্লান্তি কাটে নি। আনুবিবির পান বানানো যখন হল মইন মিয়া আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। আনুবিবি বুঝতে পারলো না সে কি করবে। ডেকে তুললে যদি রাগ হয়, এমন খেয়ালী মানুষ, এই সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে পান খেতে চেয়ে আবার কেউ এমন ঘুমিয়ে পড়ে। আনুবিবি নিজের অজান্তেই হাসলো। বানানো পান টা থালার ওপরে রেখে দিয়ে আবার আগের জায়গায় রেখে আসলো সে।
মইন মিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে তার ভাল লাগে, কেন এই অদ্ভুত লোকটা তাকে এত টানে সে বুঝতে পারে না। অথচ বিয়ের প্রথম দিন ই স্বামীর প্রতি এত নির্লজ্জ ভালবাসা অনুভব হওয়াতে নিজের প্রতি ই একটু যেন রাগ করলো সে।
বিয়ের আগের রাতে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়লো। দূরবর্তী কফিন, সাদা শাড়িতে আনুবিবি, মন টা দমে গেল তার। হাতের দিকে তাকালো, মেহেদির ফ্যাকাসে রং আরো ফিকে হয়ে যাচ্ছে…।
****
স্বামী সংসারে আনুবিবির দিন জলতরঙ্গের মত কেটে যায়। আনুবিবির শ্বশুর বাড়িতে এক বুড়ো শ্বশুর ছাড়া কেউ থাকে না আপাতত আনুবিবিরা ছাড়া।
মইন মিয়ার দুই বোন, তাদের বিয়ে হয়েছে দুরের গ্রামে। দুইজনই ঝগড়াটে, এসেই কিছু না কিছু ছুতো ধরে ঠিক ঝগড়া লাগিয়ে দেয়।
মইন মিয়ার ছোট বোনের নাম মোমেনা। মোমেনার দুই ছেলে, দুইটাই বদের হাড্ডি, মোমেনার স্বামী বকুল মিয়া সাধাসিধা মানুষ। ঘরে থাকলে তার প্রধান কাজ মোমেনা বিবির বকা শোনা আর নীরবে হুকা টানা। মাঝে মাঝে ছেলেদের হুংকার দিয়ে বলা, কিরে বদমাইশের দল, মরার শখ উঠল! ছেলেরা তাদের এই নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ বাবার হুংকারে ভয় পায় না। জ্ঞান হবার পর থেকেই এর বেশি তারা শুনে নাই। নিশ্চিন্তে ‘বদমায়েশি’ চালিয়ে যাওয়া যাক।
এই মোমেনা বিবি তার সার্কাস পার্টির মত বৈচিত্রময় পরিবার নিয়ে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। আনুবিবির শান্ত জীবনে ঢেউ আসে তখন। সারাক্ষণ মোমেনা বিবি তার দোষ খুজতে ব্যস্ত।
সেদিন পুকুর ঘাটে গোসল করতে গেল, গায়ে পানি দিয়ে যেই শাড়ির আঁচলটা তুলে গা ঘষতে যাবে আনুবিবি, মোমেনা বলল, বাড়ির বউ পানি ঘরে নিয়া গুসল দিতারো না?
আনুবিবি অবাক হয়ে গেল, তার মা খালাদের কখনো পুকুর ছাড়া গোসল করতে দেখে নাই সে। পুকুরপাড়ের ছায়াঘেরা পরিবেশে গাছপালার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ঘটি দিয়ে গায়ে পানি দেয়া, অথবা মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা জলে নাক ডুবিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকা, তা কি ঘরে পানি তুলে পাওয়া সম্ভব?
মোমেনা নির্বিকার ভাবে বলল, পরদা পুশিদার বালাই নাই তোমার বউ। মাগীপনা চলাফেরা।
আনুবিবি স্তব্ধ হয়ে গেল। সে নিচু স্বরে বলল, এয়ানে কেউ ত দেখে না আমারে।
মোমেনা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, আহারে পোলাপাইনের ভাব নিবা না। কে দেখে না দেখে তুমি কেমনে জানবা। চউখ কি সব দিকে থাকে? খড়ের গাদায় পালাইয়া থাইকা তোমার বড় বড় বুনি দেখল, তুমি বালডাও জানলা না।
আনুবিবি লজ্জায় চুপ হয়ে রইলো। ভেজা শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে শুকনো কাপড়গুলো তুলে ঘরের মধ্যে চলে গেল তারপর।
মোমেনা রাগ হয়ে বলল, বাড়ির বউয়ের এমন ছেনালিপনা আর উদাসীন ভাব সে কোনদিন দেখে নাই।
*****
মোমেনার যন্ত্রণায় আনুবিবির জীবন অতীষ্ঠ।
আনুবিবি বরাবর ই শান্ত মেয়ে, সরদার বাড়ির মেয়ে হলেও সে চুপচাপ।
মোমেনার তিরস্কার সে চুপচাপ সহ্য করে। আর তার নীরবতায় মোমেনা আরো খেপে যায়। মেয়ে মানুষ এক কথা বললে দুই কথার উত্তর দিবে সেটাই ত স্বাভাবিক। ব্যাটাছেলেরা বেকুব, তারা ঝগড়া করতে পারে না, মেয়ে হয়ে চুপ থাকাটা তার কেমন যেন সহ্য হয় না। ঝগড়া করা মোমেনার নেশা, সে আনুবিবিকে খোঁচাতেই থাকে।
এই ত সেদিন রান্নাঘরে আনুবিবি ইলিশ মাছ ভাজছিল।
মোমেনা এসে বলল, মাছে হলুদ কি বেশি হইল নাকি?
আনুবিবি বলল, না।
-তাইলে এমন দেখায় ক্যা।
আনুবিবি উত্তর দিল, খাইয়া দেইখেন।
কথায় সামান্য ঝাঁজ ছিল, মোমেনা একটু ইতস্তত হয়ে বলল, ওলো, কি ঝাঁজ দেখো, জিগাইলাম হলুদ বেশি হইল কিনা, কি ত্যাড়া ভাব নবাবজাদীর। আনুবিবি চুপ করে মাছ উলটে দিতে লাগল। মোমেনা গজ গজ করতে করতে চলে গেল।
খাওয়ার সময় মোমেনা আবার হলুদের কথা তুলল। এক গ্রাস ভাত মুখে নিয়ে বলল, হলুদ বেশি।
মইন মিয়া তার পাশেই খাচ্ছিল, আর মোমেনার দুই ছেলে, বকুল মিয়া নীরবে খেয়ে যাচ্ছিল। দাওয়ায় পাটি পেতে খায় তারা। আনুবিবি সবার পাতে ডাল তুলে দিচ্ছিল। আর মোমেনা খেতেও বসে নি, সে ছেলেদের জন্য ভাত মেখে মুখে তুলেই অভিযোগ করল।
বকুল মিয়া নীরবতা ভাঙলো, না বেশি ত লাগে না।
নির্বিষ বোকাসোকা স্বামীর থেকে এই বিরোধিতা কাম্য না, মোমেনার রাগ আরো বেড়ে গেল।
-তুমি চুপ থাহো, খাওয়া ছাড়া কি বুঝো! ঘাস আইন্না রাইন্দা দিলেও পুইশাক বুইঝা খাইবা।
বকুল মিয়া ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল।
মইন মিয়া বলল, কি শুরু করলি? হলুদ বেশি লাগলেও খাইয়া থো, খালি সব কিছু লইয়া প্যান প্যান তোর।
ভাইয়ের বৌকে পরাস্ত করার সব উপায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে সে বলল, আমি রান্নার সময় কইছিলাম, তোমার বউ ত্যাজ দেখাইছে। হে নিজের মত রানব। কারো কতা শুনে সে?
আনুবিবি ডালের বাটি রেখে উঠে গেল। ঘরে গিয়ে দুয়ার দিল।
মোমেনা তার চলে যাওয়া দেখল, তারপর বলল, দেখো কি ত্যাজ!
মইন মিয়ারও ব্যাপারটা ভাল লাগল না, মেয়ে মানুষকে শাশুড়ি ননদ দু কথা শোনাবে এইটাই স্বাভাবিক, এত তেজ দেখিয়ে স্বামীকে খাওয়ানো রেখে চলে যাওয়া মোটেও ঠিক না।
মইন মিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, মাইয়া মাইন্সের এত ত্যাজ ভাল না।
মোমেনার বাচ্চা ছেলেটা তার অনুকরণ করে বলল, মাইয়া মাইন্সের এত ত্যাজ ভাল না।
মইন মিয়া হাত ধুয়ে উঠে পড়ল, তার মেজাজ গরম হয়েছে, আনুবিবি যা করেছে তাতে তার অপমান বোধ হয়েছে, এর হেস্তনেস্ত করা উচিত।
মোমেনা তাকে উঠতে দেখে বিচলিত হয়ে বলল, কি ভাই খাইবা না?
মইন মিয়া উত্তর দিল না। মোমেনার খারাপ লাগল, যদিও তার ভাইয়ের বউকে সে সহ্য করতে পারে না, তাও ভাই তার মোটে একখানা। মাঠে ঘাটে ঘুরে এসে খেতে বসল, তাও পারল না ওই রাক্ষসীর তেজ দেখে।
মোমেনা তার নিজের দোষ দেখতে পেল না, আমাদের আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষেরই চোখ নাই, দেখতে পায় না।
মোমেনা চিকন সুরে বলল, এই হইল আইজকালের মাগির খাইসলত। স্বামীর লগে ত্যাজ, কি সাহস বাবা!
মইন মিয়া বোনের কথায় আরো রেগে উঠলো। সে দরজা ধাক্কালো ঘরে গিয়ে। আনুবিবি সাথে সাথেই খুলে দিল। মইন মিয়া চুলের মুঠি ধরে আনুবিবিকে বিছানায় ফেলে দিল। তারপর মুখে পিঠে গালে ঘুষি, কিল, লাথি।
আনুবিবি নীরবে সব মার সহ্য করলো, মোমেনা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ভাইকে বলতে লাগলো, মাইরা কি হইব। আদব হইল পরিবারের শিক্ষা, যার নয়ে হয় না, তার নব্বইতেই হয় না।
মাইরো না।
যদিও আনুবিবির মার খাওয়ায় মোমেনাকে অত বিচলিত মনে হল না। সে বেশ খুশি ই মনে হল।
*****
মার খেয়ে আনুবিবি পড়ে রইল মরার মত। মইন মিয়া ঘেমে গিয়েছিল, ফরসা চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। সে কোথায় যেন চলে গেল। আর মোমেনা দোর দিল স্বামী-সন্তান নিয়ে।
আনুবিবির মনে হল সে মরে যাচ্ছে, পুরো শরীরে ব্যথা, ঠোঁটের কাছে নোনতা লাগছে। হাত দিয়ে দেখার শক্তি নেই, বুঝতে পারল ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে, মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। আনুবিবি দেখল তার দাদিজান এসেছে। তার পাশে বসেছে। দাদিজানের গা থেকে জর্দার কড়া গন্ধ। আনুবিবির মাথা আরো ঝিম ঝিম করতে শুরু করলো।
দাদিজানের ভাঙা গলা শুনতে পেল, কিরে বুবুজান, রাগ দেখালি কেন? আনুবিবির ঠোঁট নড়ল। সে তারপর শুনলো দাদিজান মৃদুস্বরে গান গাচ্ছে,
ও মাইয়া দুধের সর
কেম্নে করবি পরের ঘর
পরের পুতে মারিবে, ধরিবে
বাঁশতলায় বইসা কান্দিবে
চিনা জোঁকে ধরিবে।
দাদীজানের গলা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যায়, আবার স্পষ্ট হয়।
দাদীজান গান থামিয়ে এইবার হৃষ্ট চিত্তে বলেন, তোর দাদা একবার আমারে বেতকাটা দিয়া পিটাইল রে। ওরে কি ব্যথা, পরে ত রাইতে ত্যাল মালিশও কইরা দিল। পুরুষ মানুষ বুঝা বড় দায় বুঝলি….
এই গল্প আনুবিবি ছোটবেলায় শুনেছে, দাদিজান কত কিছুই না বলত।
আনুবিবির মুখ থেকে এইবার মৃদু স্বরে কথা বের হল।
সে বলল, দাদিজান চুপ করো।
দাদিজান রেগে গিয়ে বলল, কেন চুপ করমু কেন? তোর যন্ত্রণা দেখলে আমার যন্ত্রণা হয় না? মাগী মাইর খাইয়া পইড়া থাকস, সংসার বুঝস না।
দাদিজানকে কিছু বলা বৃথা, আনুবিবি জানে, সে কষ্টে থাকলেই দাদিজান চলে আসে। আর বকা দেয়, গান শুনায়, আদর করে। দাদীজানকে সে ছাড়া কেউ দেখে না কখনো।
দাদীজান যেদিন মারা গেল, অনেক বৃষ্টি, আনুবিবি বৃষ্টির মধ্যে পুকুরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো দাফন হবার পরে, যতক্ষণ ডুবে থাকা যায় ডুবে রইলো, আবার শ্বাস নিতে উঠলো, মাথার ওপরে বৃষ্টির ফোঁটা সূচের মত বিঁধে, সেই ব্যথাও তার ভাল লাগে। আনুবিবির মনে হল পৃথিবীর সব ব্যথা তাকে আপন করে নিক, তার আর সুখ দরকার নাই।
উঠলো যখন সন্ধ্যা, ভেজা শরীরে দাদিজানের কবরের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ল সে। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো।
তাকে উদ্ধার করা হল পরের দিন, গ্রামে ঢি ঢি পড়ে গেল মেয়েকে জ্বীনে ধরেছে, সারারাত ঘরের বাইরে ছিল, বদ জ্বীনে আছর করে দাদির কবরের কাছে ফেলে গেছে। সেই জ্বীন তাড়ানোর জন্য ও না কত কাহিনী।
আনুবিবির মাথা চেপে আসতে থাকে। দাদীজান এখন চুপ। আনুবিবি আস্তে করে ডাকল, দাদী।
– হ আছি।
– কিছু কও।
– তোর ঠোঁট দিয়া ত রক্ত পড়ে রে বুবুজান, আমার যন্ত্রণা লাগতাছে।
আনুবিবি চুপ করে রইলো। দাদিজান আবার গান ধরলো,
সোনার মাইয়া, সোনার অঙ্গ
খাইল কালিয়া কুত্তা রে।
দাদিজানের গলা ক্রমশ দূরে চলে যেতে যাচ্ছে। আনুবিবি ঘুমিয়ে যাচ্ছে।
*****
আনুবিবির জ্ঞান ফিরলো রাতে, চোখ মেলে দেখলো মইন মিয়া বিছানায় পাশে বসে আছে। মোমেনা একটু দূরে। বকুল মিয়া খুব চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
আনুবিবি ভীত চোখে মইন মিয়ার দিকে আবার তাকালো, মইন মিয়া তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মোমেনা নীরবতা ভাঙলো।
-কিগো নবাবের ঝি, রান্দাবাড়া কে করব, ভাতার আইসা যে না খাইয়া বইসা আছে।
আনুবিবির বুকে আঘাত লাগলো, পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কা ? সে উঠতে চেষ্টা করল, পড়েও গেল, মইন মিয়া তাকে ধরতে চেষ্টা করল না, সে উঠে ঘরের বাইরে চলে গেল।
মোমেনাও চলে গেল গট গট করে। দাঁড়িয়ে রইল এক বকুল মিয়া অসহায় মুখে, সে আনুবিবিকে ধরতে পারবে না, সাহায্যও করতে পারবে না, এই পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতা করা দয়া দেখানোর চেয়ে বেশি সহজ।
আনুবিবি তবুও ডাকল বকুল মিয়াকে –
– মিয়া ভাই, আমারে ধরবা একটু?
– না বইন, শুইয়া থাকো তুমি। তারা তো দেখল ই তোমার কি দশা।
আমি বুঝায়ে কমু নে।
আনুবিবি চুপ হয়ে রইলো। সে জানে বকুল মিয়া ভয় পাচ্ছে। পাবেই না কেন, তার স্বামীর মেজাজ সে জানে। অন্য কেউ বউকে ধরলে তাকে আস্ত রাখবে না সে।
বকুল মিয়া চলে গেল। আনুবিবি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল আকাশে মস্ত চাঁদ, চাঁদের গায়ে কালি,
চাঁদকে কে মেরে গেল এইভাবে। চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আনুবিবি উঠলো আর কিছুক্ষণ পর, পুরো শরীর ব্যথা হয়ে আছে, নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত পড়া শুরু হল। নাক শাড়ির আঁচলে চেপে ধরে রান্নাঘরের দিকে গেল সে।
শিং মাছ জিয়োনো ছিল ঘরে, নাকে শাড়ি বেঁধে মাছ কাটলো সে। লাউ তুলে রাখা হয়েছিল সকালে, লাউটা কেটে নিল। কড়াই ধুয়ে চুলায় দেবার পর মোমেনা আসলো।
-কিগো নবাবের ঝি, এহন আসার সুময় হইল। বাড়ির বেডারা সব বাইরে খাইতে গেছে।
আনুবিবির নাকে মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দেয়া ছিল।
সে শাড়ি সরিয়ে মোমেনার দিকে তাকালো। স্পষ্ট স্বরে বলল, ভাই এর খাওনের এত চিন্তা তো নিজে আইসা চুলা ঠেললেই হইত।
মোমেনা অবাক হয়ে গেল, এত বড় সাহস, এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। কিন্ত সে হল কীটপতঙ্গ শ্রেণী, খোঁচাতে পারে সারাক্ষণ, বিরোধের মুখে সে স্থবির হয়, এখন মইন মিয়াও ঘরে নেই, বুড়ো বাপের কাছে কিছু বলা না বলা সমান, সে কারো সাতে পাঁচে থাকে না। আলাদা ঘরে থাকে। তাকে খাবার দিয়ে আসা হয়।
মোমেনা বলল, আসুক আইজকা তোর ভাতার। তোর কথার ত্যাল আমি বের করতেছি।
আনুবিবি বলল, এখন করতে পারবা না? মুখ এত চলে, এত ত্যাজ আপনার, এখনি করেন।
মোমেনা রাগে জ্বলতে জ্বলতে ঘরে চলে গেল। আনুবিবির নাক থেকে আবার রক্ত পড়া শুরু হয়েছিল। সে শাড়ির আঁচল মুখে চেপে আবার রান্নায় নজর দিল
*****
মইন একটু পরই ফিরে আসল, সে বাইরে খেতে যায় নি, বকুল মিয়াকে নিয়ে কবিরাজ আনতে গেছিল।
এসে দেখল আনুবিবি দিব্যি রক্তভেজা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নাক মুখে কাপড় চেপে রান্না করছে। মইন মিয়া কি বলবে ভেবে পেল না। বাড়ির বউ এই অবস্থায় রান্না বাটনা করছে এটাও বাইরের একজন লোকের কাছে লজ্জার। তার বোনটা আর মানুষ হল না।
কবিরাজকে পাচদুয়ারে বসিয়ে রেখে এসেছিল সে। বাসার অবস্থা দেখে ভিতরে আনবে ভেবেছিল। এখন কি আনুবিবিকে গিয়ে বলা যায় শুয়ে পড়ো, কবিরাজ এসেছে।
বরং মেয়ে মানুষ হল কই মাছের পরান, এদের সহজে কিছু হয় না। মইন সামান্য খুশি হয়ে কবিরাজকে বিদায় দিতে আগালো।
মোমেনা মইনকে দেখে আর এগিয়ে আসল না, কবিরাজ এনেছে তার ভাই এই ঘটনায় সে আঘাত পেয়েছে। ইশ কত দরদ ওই পোড়ামুখির জন্য। ভাইকে কিছু বলার সাহস আর হল না। সে গিয়ে ধরল বকুল মিয়াকে। বকুল মিয়াও গিয়েছিল।
-কিলো মরদ, সম্বুন্ধির বেটির জন্য কবিরাজও আনা হইছে?
বকুল মিয়া স্পষ্ট স্বরে জবাব দিল, মইরা গেলে পুলিশে নিত তোমার ভাইরে।
মোমেনা ভেবে পেল না আজ তার কি হয়েছে। সবাই তার উপরে এমন ক্যাট ক্যাট শুরু করেছে। নির্বিষ ঢোঁড়া সাপও ফণা তুলছে আজ।
এই কথার উপরে কথা চলে না, তবুও জেতা মোমেনার স্বভাব, তাই সে বলল, বাল ফালাইয়া দিত। ওইসব আমারে শিখাইবা না।
বকুল মিয়া আবার বলল, তুমি কবে কি শিখছো যে এহন শিখামু?
মোমেনা রাগ করে চলে গেল ঘরের বাইরে। উঠানে ছেলে দুইটা খেলছিল, তাদের চড় বসিয়ে দিল গিয়ে।
*****
গভীর রাত। আনুবিবি আলাদা বিছানা করে মেঝেতে শুয়েছ। মইন মিয়া খাটের ওপরে শুয়ে আছে অন্য দিকে ফিরে।
একটা তক্ষক মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে। মোমেনার ছোট ছেলেটার চিকন কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। আবার মারছে হয়ত। জানালা থেকে পূর্ণচন্দ্র উঁকি দিচ্ছে, মাঝে মাঝে এলোমেলো বাতাস।
অদ্ভুত আবহাওয়া। মইন মিয়ার ইচ্ছা হল আনুবিবির কাছে যায়। তার একটু রাগ হল, এত মার খেয়েও তেজ গেল না, আবার আলাদা বিছানা করলো। স্বামীর সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় বাবামা কি না শিখিয়েই বিয়ে দিল? যদিও আনুবিবিকে সে শান্ত, ধৈর্যশীল মেয়ে বলেই জানে, এতদিনে তাদের মধ্যে বড় কোন ঝামেলা হয় নি, কিন্ত মধ্যে এত আগুন পুষে রেখেছিল কে জানত? আনুবিবির শরীরের প্রতিটা অঙ্গের খবর সে জানে অথচ মন টা কেমন আজও বুঝল না, সে ভাবত সে সবই জানে, আজ বুঝলো আনু তার কতটা অচেনা।
নিজের বউকে অচেনা ভাবতে ভাল লাগে না, অথচ না ভেবেও উপায় কি। রাগ যে দেখাবে সেই উপায়ও নেই, আনুবিবি মুখে কুলুপ এঁটেছে।সে পাশ ফিরে আনুবিবির দিকে তাকালো। আনুবিবি জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। ঘুমিয়েছে না জেগে আছে বুঝা যাচ্ছে না। মাথার চুল সরে গিয়ে ঘাড়ের অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে, সেখানে আঘাতের দাগ। মইন মিয়ার অপরাধবোধ হল। দেখালোই না একটু তেজ, তাই বলে এইভাবে মারা ঠিক হল না। বরং বকে দিলেই হত। মইন মিয়া এলোমেলো ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে উঠল। সে আর থাকতে পারল না।
অশান্ত গলাতেই ডাকল, বউ।
আনুবিবি ফিরে তাকালো সাথে সাথেই। চোখের নিচে কালি তার। মুখ লাল হয়ে আছে, মাঝে মাঝে আঘাতের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে। চোখ ভাবলেশহীন মইন মিয়া আনুবিবির ওই বিধ্বস্ত আর অচেনা মৃতপ্রায় চেহারা দেখে আর কিছু বলতে সাহস পেল না কিছুক্ষণ। তারপর কাছে গিয়ে ধরে বলল, বিছানায় আসো।
আনুবিবি আসলো।
মইন মিয়া অবাক হয়ে গেল। সে ভাবতে পারে নাই এভাবে চলে আসবে। সে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল রাগ ভাঙানোর জন্য। এই মেয়ে কি তাকে কোন ভাবে স্বস্তি দিবে না আর? রাগ ভাঙানোর সময় ক্ষমা চেয়ে নেয়া যেত, ভাল ভাল কথা বলা যেত। এখন কি বলবে?
তবুও বলল, বউ মাফ করে দাও।
আনুবিবি উত্তর দিল না। সে বিছানায় বসে রইলো স্থানু হয়ে।
মইন মিয়া বুঝলো এখন কথা বলা বৃথা, সে আনুবিবিকে আস্তে আস্তে কাছে টেনে নিল। আনুবিবি আঘাতের জায়গায় স্পর্শ পেয়ে একবার গুঙিয়ে উঠলো। তারপর নীরব হয়ে রইলো।
পূর্ণচন্দ্র তখন জানালার একদম সামনে। একটা কাক উড়ে গেল বিকট শব্দে কাকা করে।
তারপর সব নীরব…
*****
বসন্তের সকাল। কোকিল ডাকছে কুহু স্বরে। গাছে গাছে কচি সবুজ পাতার আনাগোনা। বিগত শীতের হিমেল হাওয়া মাঝে মাঝে স্পর্শ করে যা।। এমন ই এক সকালে আনুবিবি ঘুম থেকে উঠে পুকুরে গিয়ে নেয়ে নিল। পুকুরের পানি হালকা ঠাণ্ডা, তাও আনুবিবির মনে হল বরফে গা ডুবিয়েছে সে।
পুকুর পাড়ের রাধাচূড়া গাছে ফুল ধরেছে। কিছু ফুল পড়ে ভেসে আছে পানিতে। আনুবিবি ফুলগুলো এলোমেলো করে দিল। তারপর ডুব দিল পানিতে।
হঠাৎ মনে হল তার গলা কেউ চেপে ধরেছে। মাথা চেপে আসছে। আনুবিবি হাঁসফাঁস করে পানি থেকে মাথা উঠালো। কোনমতে ঘাটলা ধরে উঠে দাড়ালো, এরমধ্যেই বমি। আনুবিবির মনে হল পুরো শরীর কেউ ঝাঁকাচ্ছে আর সব বের হয়ে আসছে। পুকুর পাড় থেকে দৌড়ে ঘরে আসল সে। মইন মিয়া দাওয়ায় বসেছিল। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
আনুবিবি ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে আরো একবার বমি করলো, তারপর পড়ে রইলো মরার মত।
উপায়ান্তর না পেয়ে মইন মিয়া পাশের বাড়ির মাজেদা খানমকে ডেকে আনলো। মাজেদা খানম বেঁটে মহিলা, সারাক্ষণ পান খায়। সে যখন আসল তার গা থেকে কড়া জর্দার গন্ধে আনুবিবি আরো একবার বমি করলো।
যদিও মাজেদা খানম তার আরো কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার মাথা ধরলো, তারপর রান্নাঘর থেকে বালতি এনে দিল বমি করার জন্য, মেঝে ভেসে যাচ্ছে। একটু শান্ত হয়ে আনুবিবি ঘুমিয়ে পড়লো, আর মাজেদা খানম আনুবিবির হাত মুখ পরিষ্কার করল। মেঝে পরিষ্কার করলো। তারপর দাওয়ায় বসে থাকা মইন মিয়াকে গিয়ে বলল, বাচ্চা হইবে।
মইন মিয়া এইটাই সন্দেহ করছিল। তার খুশি লাগলো।
মাজেদা খানম বলল, বউ রে এখন মাইরো না মিয়া। একেকবার যা শুনি। একটু ধাক্কা লাগলো মইনের। সে কিছু বলল না। মাজেদা খানম আর কি কি বলতে লাগল সে শুনতে পেল না। তার ইচ্ছা হল আনুবিবির কাছে যায়। অথচ লজ্জা লাগছে।
বসন্তের কোকিল এই দুপুরে ডেকে উঠলো। মইন মিয়ার ইচ্ছা হল আনুবিবিকে আদর করে। এত দূর্বলতা কোন দিন অনুভব করে নি সে।
*****
খবর পেয়ে আনুবিবির বোন আমেনা তার বড় ছেলেকে নিয়ে আসল।
আমেনা লম্বা চওড়া মহিলা, শ্যামলা গায়ের রং, প্রথম দেখায় তাকে খুব সুন্দরী মনে হবে না। তবে এই অবয়বে আকর্ষণ আছে। কি আকর্ষণ তা বোঝা যায় না।
আমেনা সারাক্ষণ পান খায়। একটা পান মুখে দিয়ে সে শায়িত আনুবিবির কাছে বসলো। তারপর কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, চেহারা ত বানাইসো মাশাল্লাহ।
আনুবিবি উত্তর দিল না।
-খাইতে কি দেয় না জামাই?
আমেনা উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলো।
-দেবে না কেন? আনুবিবি ঝাঁজ মাখা গলায় বললো।
ঝাঁজালো উত্তর শুনে আমেনা চুপ করে পান চিবুতে চিবুতে আনুবিবিকে দেখতে লাগল।
– বাড়ি ল। বাপজান যাইতে কইছে।
– না যামু না।
– এইডা কি কস। তোরে দেখব কেডা এহানে। ননদ দুইডা ত ইবলিশ, শাউড়ি নাই।
– কয়েক মাস পর যামু, এহনি যামু না।
– ঘাউড়ামি করিস না। মেজাজ গরম।
– তোমার আবার কি হইল?
-তোরে আর কি কমু, মরা মানুষ তুই।
আনুবিবি চুপ হল আবার। সময়মত ধরতে হবে।
আমেনার ছেলেটা ঢুকলো ঘরে। শান্ত শিষ্ট ছেলে। বয়স ৫-৬ এর বেশি না। চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো, মায়াবী চেহারা। আনুবিবি আদুরে স্বরে বললো, আসো বাপজান, কত বড় হইয়া গেলা। ছেলেটা বাধ্য ছেলের মত এসে আনুবিবির পাশে বসলো।
আনুবিবি ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার বইন কই?
ছেলে নিচু স্বরে উত্তর দিল, বাড়ি।
আমেনা উত্তর দিল, আর কইস না অনেক দুষ্ট হইছে।
-আনলি না কেন?
-মায়ের কাছে থুইয়া আইলাম। দুইডা টানতে ভাল্লাগে না। মন মেজাজ খারাপ আরো।
আনুবিবি জিজ্ঞাসা করলো, কি হইছে?
মোমেনা চুপ করে রইলো।
আমেনার মেয়ের নাম নিশি, যদিও এই নাম নিয়ে তার নানাবাড়িতে আপত্তি আছে তবে আমেনা উপন্যাস পড়া মেয়ে, ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছে সে। উপন্যাসে নিশুতি রাতের বর্ণনা পড়ে তার মেয়ের নাম নিশি রাখতে মনে চাইল। মেয়ের নানি মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, কি শিশি বোতল নাম থুইসে। আমেনা গাড়ল মহিলা, তার এতে সমস্যা নেই।
আনুবিবির দিকে তাকিয়ে আমেনা আবার বলল, বাড়ি চল। আনুবিবি নীরব হয়ে অন্যদিকে ফিরে রইলো। স্বামীকে রেখে যেতে একদমই ভাল লাগছে না। মানুষটা একা একা কই খাবে, কি করবে।
আমেনা মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল, তোর নিজেরো ত শরীর আছে নাকি। আর বেডা মাইন্সেরে এত ভাল পাইয়া লাভ নাই, কোন কাম হয় না।
আনুবিবি ফিরে তাকালো, আমেনার কথায় কিসের ইঙ্গিত।
সে বলল, কি হইছে কও ত। আইয়া হইতে কি কি কও বুঝি না।
আমেনা চুপ হয়ে রইলো। তারপর ছেলেকে বলল, বাইরে যা। ছেলে চলে গেল। আমেনা বলতে শুরু করলো, বাইরে তখন বিকাল, কোকিলের কুহু ডাক, তার মধ্যে গাড়ল আমেনার মুখে বিরহের কথা।
ঘটনা খুব বেশি ভাল না। আমেনার বিয়ে হয়েছে এক মৌলবির সন্তানের সাথে। তার নাম বজলু মিয়া। লোকটা স্কুলে মাস্টারি করে।বিয়ের দিন থেকেই লোকটা তার সাথে ভাল ভাবে কথা বলে না। তা আনুবিবি জানে। তার দুলাভাই বরাবরই দূরেই থেকেছে। কারণটাও জানত। বজলু মিয়ার প্রেম ছিল আলেয়া বানুর সাথে। আলেয়া বানু বজলু মিয়ার খালাত বোন।
বজলু মিয়া আলেয়া বানুকে বিয়ে করার জন্য বাসায় না খেয়ে থেকেছে, এমন কি পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে বাবাকে বলেছে, এই পুকুর থিকা আর উঠমু না, যদি আলেয়ার লগে বিয়া না দাও।
মৌলবি সাহেবও শক্ত মানুষ, তিনি চুপ করে সব দেখেছেন। বজলু মিয়া দুইদিন অগভীর পুকুরের পানিতে বসবাস করে বিরক্ত হয়ে উঠে এসেছে। তারপর বাবার ঠিক করা মেয়ে আমেনাকে বিয়ে করেছে। কিন্ত মনে রয়ে গেছে আলেয়ার আলো। বাসর রাতে বজলু মিয়া আমেনার দিকে তাকালো ই না। বজলু মিয়া এসেই আরেকদিকে মুখ করে শুয়ে রইলো। আর আমেনা ঘোমটা দিয়ে বসে রইলো অনেকক্ষণ। বাসর রাতে যদি স্বামী ঘোমটা না সরাতে বলে, কিভাবে সরাবে সে।
কত আশা, কত স্বপ্ন, কত লজ্জা বুনেছিল এই রাত নিয়ে। অথচ এ কি হচ্ছে। স্বামী আরেকদিকে মুখ করে আছে, ছি ছি। সে নারীজাতির ই কলংক। ভাবতে ভাবতে আমেনার চোখে জল এলো। সে ঘোমটার মধ্যেই ফুপিয়ে কাদতে শুরু করলো।
কান্নার শব্দ শুনে বজলু মিয়া ফিরে তাকালো। তারপর বলল, কান্দো কেন?
আমেনা অপ্রস্তুত হল, সে ভেবেছিল বজলু মিয়া ঘুমিয়ে গেছে। ঘোমটা নড়ে উঠলো, আমেনা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে শান্ত হতে চেষ্টা করল
বজলু মিয়া এইবার শোয়া থেকে উঠলো, আমেনার দিকে মুখ করে বসলো।
তারপর উদাসীন গলায় বলল, ঘোমটা সরাও দেখি।
আমেনা ইতস্তত করলো, তার ঘোমটা আবার নড়ে উঠলো।
বজলু মিয়া আবার বলল, ঢং করবা না, কথা কই নাই দেখে কানতেসিলা, এখন জইমা আছ কেন?
আমেনা বিবি ভয় পেয়ে ঘোমটা সরালো।
বজলু মিয়া তার দিকে তাকালো। হতাশ গলায় বলল,
– সাজাইছে কেডা?
– খালাম্মা।
– এত রং মাইখা থুইছে কেন?
এই উত্তর আমেনার কাছে নাই, খালাম্মার ওপর তার রাগ হল।
-দেখি আঁচলটা ফালাও।
কেমন নির্লজ্জ কথাবার্তা, এইভাবে ঠাস করে কেউ আচল ফেলতে বলে। আমেনার মনে হল এই লোকটা তাকে আজীবনই এমন যন্ত্রণা দিয়ে যাবে, তার কপালে সুখ নাই। আমেনা আচল ফেলল, বজলু মিয়া তাকালো। তাতেও তার বিকার হল না, আবার ওই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো বজলু মিয়া। বলল, ঘুমাও, কাইল কথা হইবে।
এত অপমান আমেনা পুরো জীবনে বোধ করে নাই, সে রাগে আঁচল জড়িয়ে ফেলল আবার, সারারাত বসে রইলো জানালার দিকে মুখ করে।
বজলু মিয়ার প্রেমিকাকে লেখা চিঠিও আবিষ্কার করলো আমেনা বিয়ের কয়েকদিন পরে। জামাকাপড় ধোয়ার জন্য বেছে নিচ্ছিল সে। এর মধ্যেই শার্টের পকেট থেকে চিঠি বের হল বেশ কয়েকট।। আমেনা প্রথমে ভেবেছিল কোন জরুরী কাগজ হবে, তুলে রেখে দিতে যেতেই কি যেন মনে হল, সে খুলল। চিঠি পড়ে আমেনার গা কাঁপতে লাগল।
প্রিয়তমা আলো,
তোমার রূপের আলোয় সে আমি যে অন্ধ হইয়া গেলাম। তোমাকে ভালবাসিয়া জয় করিতে চাহিয়াছি সাত সমুদ্দুর, অথচ তুমি কখনো বুঝিলেই না।
কতবার করিয়া কহিলাম, চলো পালাইয়া যাই। কোন এক নিবিড় গ্রামে কুটির করিয়া থাকিব দুইজনে। শুনিলে না।
শুনিবেই বা কেন, তোমরা নারী জাতি, পরম আদর আর যত্নের ধন, তাহার ওপরে তুমি এক অভিজাত রাজহংসী, প্রাসাদের প্রতিশ্রুতি না পাইলে কি আসিবে?
আমি দিন রাত খাটিয়া প্রাসাদ গড়িয়া দিতাম, এইটুকু ধৈর্য তোমার খাটি সোনার মত অঙ্গে আসিলো না কেন।
আমার আগুন তবে কি সোনাকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হইল? আগুনে পুড়িয়া সোনা খাঁটি হয়, একটু পুড়িতে চাহিলে না কেন?
পিতাদেব বিবাহ ঠিক করিয়াছেন। আমি সেই কন্যাকে ঘরে আনিয়া কষ্ট দিতে চাই না। ভালবাসা না পাইবার যন্ত্রণা তুমি আমাকে বুঝাইয়াছ, আমি আর কাউকে সে যন্ত্রণা দিতে চাই না। তোমার প্রতি ভাবাবেগে আমার অন্তর পুড়িয়া যায়।
ইতি
তোমার আজীবন দাস
যে নামে ডাকো।
আমেনার গায়ে আর শক্তি রইলো না, সে কোন ভাবে খাটের পায়া ধরে বসে পড়লো। চিঠিটা আবার পড়লো। তার মাথা কাজ করছে না, আচ্ছা এই ‘ভাবাবেগ’ অর্থ কি? বাকিটা সে মোটামুটি বুঝতে পেরেছে।
জামাকাপড় ধোয়া শিকেয় উঠলো, সে ঘরে দোর দিল। শাশুড়ি এসে কয়েকবার দরজা ধাক্কিয়ে ফিরে গেল। আমেনা বিছানায় মরার মত শুয়ে রইলো। মাঝে মাঝে মাথায় ঘুরতে লাগল, ‘ভাবাবেগ’ অর্থ কী।
বেলা পড়ে আসতে থাকে, দু একটা কাক বিচ্ছিন্ন ভাবে ডেকে যায়।
*****
আনুবিবি এসব কাহিনী জানে। তাহলে নতুন করে কি হল।
শুনেছিল আলেয়ার বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সাথে সে ঢাকায় থাকে। আমেনা ভেবেছিল আপদ গিয়েছে।।কিন্ত কপালে যদি দুঃখ থাকে, তবে ঢাকা থেকে এসেও যন্ত্রণা দেয়া অস্বাভাবিক কিছু না। আলেয়া স্বামীর সাথে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি এসেছে।
আমেনার শ্বশুরবাড়ি আর আলেয়ার বাপের বাড়ি এক ই গ্রামে হওয়ায় এখন কপালে শনি চড়েছে।
বজলু মিয়ার পুরাতন প্রেম জেগে উঠেছে। যতটা তাকে নিজের করে নিয়েছিল আমেনা, বাচ্চা কাচ্চা জন্ম দিয়ে যতটা মায়ার বাঁধনে জড়িয়েছিল, সব ওই মায়াবিনী এক নিমিষে শেষ করে দিয়েছে। বজলু সংসারী পুরুষ থেকে আবার সেই উদাসীন পাগল প্রেমিক। খালার বাড়িতে সারাদিন গিয়ে বসে থাকে, বাহানা বানায়।
আমেনা শুনে বলল, মরণ, এত পাপ আল্লায় সইবে না। মাইয়ার কাছে আরেক বেডা গিয়া গফ করে, আর কেমন বাড়ির মানুষজন, কেউ কিছু কয় ও না। বজলু মিয়া নীরবে অভিযোগ মেনে নেয়, তবে যাওয়া থামায় না।
আমেনা রাগ করে বাপের বাড়ি চলে এসেছে তাই। আনুবিবি শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, আওয়া ঠিক হয় নাই।
আমেনা মুখ ঝামটা মেরে বলল, চুপ কর হারামজাদী। আমি এসব সইতে পারি না। বিয়ার পর থিকা দেখতাছি এই কাহিনী। আর সহ্য হয় না।
আনুবিবি মইন মিয়ার কথা ভাবলো। তারও কি এমন কেউ আছে। নাই হয়ত। রাগ করুক, মারুক, মইন মিয়ার জীবনে একমাত্র নারী সেই। ভেবে আনুবিবির ভাল লাগলো।
আমেনা ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো।
-আমার পোড়া কপাল নিয়া ভাবিস না। পেডে তোর বাচ্চা, বাড়ি ল। মায় যাইতে কইছে।
আনুবিবির মন কিছুতেই সরলো না। তবে সে জানে আমেনা নাছোড়বান্দা। নিয়েই ছাড়বে।
তারপর বলল, আইছো যখন কয়দিন থাহো, যাই পরে।
আমেনা প্রস্তাব মেনে নিল।
রাতে খাবার সময় মইন মিয়া ভাত মাখতে মাখতে বলল, বিদ্যাশ যাইতে পারি।
আমেনা তরকারী বেড়ে দিচ্ছিল। সে বলল, কেম্নে যাইবা
-আমার এক বড় ভাই আছে, সে থাহে লন্ডন। সে কইসে নিয়া যাইতে পারবে।
আমেনা ছেলের পাতে ডাল তুলে দিতে দিতে বলল, টাহা লাগব না?
-জমি বেইচা যামু।
আমেনার কথাটা ভাল লাগলো না, সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো, মাঝে মাঝে বোন জামাই আর ছেলের পাতে ভাত তরকারি তুলে দিতে লাগলো।
আনুবিবির মাথা ঘুরাচ্ছে, সে ঘরে শুয়ে আছে, আমেনা ঘরের দিকে তাকালো, যেই মেয়ে স্বামী রেখে এক দণ্ড যাইতে চায় না সে কিভাবে বিদেশে স্বামীকে ছেড়ে দেবে।
আমেনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, বউ তোমার পোয়াতি৷ বাচ্চাডা জন্মাইয়া ত বাপরেও দেখব না।
-কেন এক্কারেই যামু গা নাকি? আমু ত সময় সময়ে। আর আনুরেও নিয়া যামু সব ঠিক ঠাক থাকলে। আল্লাহ ভরসা।
আমেনার এইবার বুকেও লাগলো, বোনকে নিয়ে যাবে, কই নিয়ে যাবে। মর্মাহত আমেনা আর কথা বাড়ালো না।
*****
বজলু মিয়া পাচদুয়ারে বসে আছে। তার সাথে আলেয়া বানুর ছোট ভাই আলম। আলেয়া বানুর ছোট ভাই তাকে চোখ ছোট করে দেখছে। দেখাই স্বাভাবিক, বজলু মিয়া সব অপমান মেনে নিয়েছে।
কারো লগে দেহা করবেন? আলম তাচ্ছিল্য ভরে জিজ্ঞাসা করল।
-না। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল বজলু মিয়া।
আলম তাতে দমলো না, দৃষ্টিতে দ্বিগুণ ঘৃণা নিয়ে তাকে দেখতে লাগলো। আলম শহরে থাকে। ইন্টারে পড়ে। তার বিবেকের দংশন খুব বেশি ই। সবাই তাকে সমীহ ও করে।
-আপনে আর এই বাড়িতে আইবেন না।
বজলু মিয়া এটা আশা করে নাই। সে তীব্র চোখে তাকালো।
-কেন আমু না?
-আপনারে দেখলে আমার ভাল লাগে না।
-সেদিনের পোলার খুব ত্যাজ দেখতেসি। থাপড়ায়ে দাত ফালায় দিমু হারামির বাচ্চা।
বজলু মিয়ার রাগ উঠে গেল। আলম ও এত উগ্র উত্তর প্রত্যাশা করে নাই। এই লোকের দেখি লজ্জা শরম ও নাই।
সে উঠে চলে গেল বাড়ির মধ্যে। বজলু মিয়া চোখ লাল করে বসে রইলো, একটু পর আলেয়া বানু আসলো। বজলু মিয়া আলেয়া বানুর দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকালো।
আলেয়া বানু বলল, ঘরে চলো, কথা আছে। এইখানে মানুষ দেখব।
বজলু মিয়া নীরবে নির্দেশ পালন করলো।
ঘরে এসে চকির ওপরে বসলো সে। আলেয়া বানুদের ঘর সব সময় সাজানো গোছানো একটু বেশিই। বেড়ায় একজন নায়কের ছবি সাটা। এই নায়ক কে বজলু মিয়া চিনতে পারলো না। সে ছবির দিকে তাকিয়ে রইলো।আলেয়া বানু তার সামনে পানি আর মুড়িগুড় রেখে বলল, খাও। সকালে ত কিছু খাও নাই।
বজলু মিয়ার এই কথা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সে আলেয়া বানুর পায়ের কাছে বসে পড়লো চকি থেকে উঠে।
তারপর বলল, আমারে বিয়া করো। বউ তালাক দিয়া দিমু।
আলেয়া বানু এই হঠাৎ কাণ্ডে অবাক হল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি আর এই বাড়িতে আইবা না। মানুষ জন আমারে কথা শুনায়।।
বজলু মিয়া বলল, আমি আসুম না, তুমি চলো আমার বাড়ি বউ হইয়া।
-তুমি কি পাগল হইছো? আমার স্বামী আছে না? আমার স্বামীর সাথে কি আমার তালাক হইছে?
বজলু মিয়া মাটির ওপর বসে পড়লো হতাশ হয়ে। তারপর শুরু করলো কান্না হাউমাউ করে। আলেয়া বিব্রত হল।
সে বজলু মিয়াকে বলল, চুপ করো, আমার ১৪ গুস্টি খাইবা তুমি।
বজলু মিয়া থামতে পারলো না। সে আরো জোরে চিৎকার করতে লাগলো। শব্দ শুনে আলেয়া বানুর মা, দাদি, আর আলম দৌড়ে এলো ঘরে।
তারা হতভম্ব। আলেয়া বানুর মা নসিমন বিবি, ছোটখাট মহিলা, যিনি সম্পর্কে বজলু মিয়ার খালা
উনি তীব্র স্বরে আলেয়াকে বললেন, এই আপদ ঘরে উঠাইছো কেন তুই? এখন মাইন্সে কি কইব আমাগো, তুই কাল ই ঢাকা যাবি খানকি মাগি।
আলেয়া চুপ করে রইলো, আলম বিস্ফোরিত চোখে মেঝেতে বসে বাচ্চার মত কান্না করা বজলু মিয়াকে দেখতে লাগল। আর আলেয়া বানুর দাদি শুরু করলেন শাপ শাপান্ত।
-হায় রে পোড়া কপাল, এই দিন দেখার আগে আমি মইররা গেলাম না কেন, মরণ তোগো সবডির কপালে, মরণ, তোরা একটাও বাঁচবি না, গাংগের পানিতে ভাইস্যা যাবি তোরা, ভাইস্যা যাবি।
বজলু মিয়ার কান্না, আর আলেয়া বানুর দাদির চেঁচামেচি শুনে অনেক মানুষ জড় হলে ভেতর বাড়িতে। দুইজন বজলু মিয়াকে ধরে উঠিয়ে নিয়ে গেল, বজলু মিয়া তাদের বাধা দিল না, তবে সে কাঁদছিল, অনেক কাঁদছিল।
যাওয়ার সময় পাশ থেকে একটা তীব্র নারীকন্ঠ শুনতে পেল।
-ঘরে বউ পোলা রাইক্ষা কি অসভ্যগিরি রে বাপ। ছি ছি, ঝাড়ু তোর কপালে, ঝাড়ু।
বজলু মিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলল লজ্জায়।
*****
আমেনা সকালে ঘুম থেকে উঠলো আগে। আনুবিবিকে এখনো মইন মিয়ার বিদেশে যাবার খবরটা দেয়া হয় নাই, কেন যেন সাহস হচ্ছে না। বোনকে সে খুব ই ভালবাসে, এই অসুস্থ শরীরে তাকে আরো কষ্ট দিতে ইচ্ছা হল না। আমেনা চুপ হয়ে বসে রইলো ঘরের দাওয়ায়, কেউ উঠে নি। বাইরে বসন্ত বাতাস, দুই একটা চড়ুই কিচির মিচির করছে, ভালই লাগছে।
একটা পুরুষ কন্ঠ পাচদুয়ার থেকে শোনা গেল। ভারী গলা, একটু তাড়িত মনে হল।
-বাড়িতে কেউ আছে?
এই সকালে কে আসল। আমেনা মাথায় কাপড় দিল, মইন মিয়ার কাছে আসল মনে হয়। সে এগিয়ে গেল উঠান পেরিয়ে, যথাসম্ভব মুখ গলা ঢেকে আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করল, কারে খুঁজতে আইছেন?
আঁচলের আড়াল থেকে লোকটার দিকে তাকালো সে। মধ্যবয়স্ক, মোটা গোঁফ, গালভর্তি দাড়ি, পরনে পরিস্কার জামা লুংগি।
সে বলল, আমেনা বেগম।
আমেনা অবাক হল, এই বাড়িতে তাঁকে খুজতে কেন আসবে?
– আমেনা বেগম দিয়া কি কাম?
– তারেই কমু, ডাইকা দেন। লোকটার গলায় অস্বস্তি।
– আমিই আমেনা, কন।
লোকটা একটু তার দিকে তাকালো, তারপর থেমে বলল, স্বামীর বাড়ি রামনগর না?
– হ।
– স্বামীর কাছে যান।
– কেন?
– উনি হাওলাদার বাড়ি গিয়া বাড়ির মাইয়ার লাইগা কান্দাকাটি কইরা কাহিনী করছে। সবাই ছি ছি দিতাছে। আমেনার গা কাঁপতে লাগলো। সে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলো না।
– জামাই গাঙে ঝাপ দিয়া মরার আগে হের কাছে যান। অবস্থা বেশি ভাল না।
লোকটা উত্তরের অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ, আমেনা আর কিছু বলল না। তারপর বলল, এইদিক দিয়া যাইতেছেলাম, আপনে কই তা খবর নিয়া কইয়া গেলাম।
আমেনা মাথা নাড়লো, লোকটা কি করবে বা কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল, যাই তাইলে। ভাল থাইকেন বইন।
আমেনা আবারো মাথা নাড়লো, আগন্তুক চলে গেল বাড়ির বাইরে থেকেই। বসতেও বলা হল না। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ, তারপর ঘোমটা ফেলে আস্তে আস্তে দাওয়ায় এসে বসলো, পাথরের মত চোখ করে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
*****
বজলু মিয়া ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। তার পাশে একটু দূরে চেয়ারে তার মৌলবি বাবা। সন্ধ্যা নেমেছে। মৌলবি সাহেব নামাজ পড়ে এসে বসেছেন। বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। কান ধরে আসে। বজলু মিয়া আকাশের দিকে তাকালো, আকাশ ভরা তারা। তার ভাল্লাগলো। বজলুর ছোট বোন মিনা এসে কুপি দিয়ে গেল।
মৌলবি সাহেব কুপির সোনালী আলোয় তার পাগল প্রায় ছেলেকে দেখতে লাগলেন। তারপর বললেন, তুমি এমন করবা জানলে আমি যেম্নেই হউক আলেয়ার সাথে তোমার বিয়া দিতাম। বজলু মিয়া আকাশের দিকেই তাকিয়ে রইলো। মৌলবি সাহেব একটু চুপ করে রইলেন।
তারপর বললেন, পুরা গ্রামের কাছে আমার মাথা হেঁট করছো তুমি। তুমি কি বুঝতে পারতেছ?
বজলু মিয়া এইবার তারা থেকে চোখ সরালো।
তারপর স্পষ্ট গলায় বলল, আপনি আগে বুঝেন নাই কেন?
মৌলবি সাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বজলু কোন দিন তার মুখের ওপরে কথা বলে নাই। আজ এই অসম্মানের দায়ভার কি তার নিজের ওপরেও আসে না? মৌলবি সাহেব বিষন্ন হলেন।
তারপর বললেন, আমি বুঝি নাই সেই কারণে তুমি ত পরিবারকে শাস্তি দিতে পারো না। পারো কি? তোমার স্ত্রী, সন্তান আছে।
বজলু চুপ করে রইলো।
-তোমার সন্তানরা একদিন বড় হবে, তারা এসব জানবে, যে কাহিনী করতেছো, তোমার নাতি নাতনিরাও এসবের আঁচ পাবে একদিন। কি হবে তখন?
মৌলবি সাহেব অতি বিচক্ষণ মানুষ আপনারা এতক্ষণে হয়ত বুঝে নিয়েছেন পাঠক, উনি আসলেই বিচক্ষণ ছিলেন। তবে ছেলের কাছে বারবার হেরেই যাচ্ছিলেন তিনি। বজলু মিয়া মাথা নিচু করে রইলো।
-স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনো, আমি যতদূর জানি সে মনের ব্যথায় বিবাগী হয়েছে। সে ই তোমার পবিত্র সঙ্গী, অন্য সব কিছুই তোমাকে শয়তানের দিকে নিয়ে যাবে। তাকে তুমি মন থেকে গ্রহণ করো। বজলু মিয়া মাথা নাড়লো। মৌলবি সাহেব একটু স্বস্তি পেলেন।
তারপর বললেন, একটু পর এশার আজান পড়বে। ওজু করে আসো, একসাথে নামাজ পড়তে যাব।
বজলু মিয়া উঠল, বাবার সরল আদেশ বজ্রের থেকেও কঠিন, না মানার ক্ষমতা তার হয়ে উঠে নি কখনো।
বাবার সাথে তার বিদ্রোহেরই সম্পর্ক, অথচ সেই বিদ্রোহ কখনো সামনা সামনি খুব বেশি হয় নি।
বজলু মিয়া ওজু করে আসল, মৌলবি সাহেব তার কাঁধে হাত রাখলেন। মসজিদ থেকে এশার আজান ভেসে এলো।
নামাজে বাবার পাশেই দাড়িয়েছিল বজলু মিয়া। বাবার দিকে তাকালো সে। লোকটা চোখ বন্ধ করে নামাজ পড়েন,কত নিমগ্ন, কত নিবিড় সে ধ্যান।
মোনাজাতের সময় দেখলো বাবা কাঁদছেন।
বজলু মিয়া মোনাজাত ভুলে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো।
*****
আমেনা কাঁদছে। আনুবিবি পাশে চুপ করে বসে আছে। আমেনার ছেলেটা অবাক হয়ে মাকে দেখছে। একটু পর সে উঠোনে একটা বিড়ালের বাচ্চা দেখতে পেল। সেটা ধরতে ছুটলো সে।
আনুবিবি নীরবতা ভাঙলো। বলল, বাড়ি যাও।
আমেনার কান্নার বেগ আরো বাড়লো। তার কি বাড়ি আছে? তার ত বাড়ি নাই।
আনুবিবি বুঝতে পারল কান্নার মানে। তবুও বলল, মাইয়া পোলার দিকে চাইয়া যাও গা।
আমেনা কাঁদতেই থাকলো। প্রবল দুঃখ তাকে গ্রাস করেছে। ৯-১০ টা বছর ধরেও স্বামীকে সে আপন করতে পারলো না, ওই মায়াবিনী দূর থেকে কি ছল করল।
আনুবিবির মাথা ধরতে শুরু করলো আবার, সে ঘরে গিয়ে শুয়ে রইলো। কি যেন এক বিপদের আশংকায় তার মন টা বিষিয়ে উঠল। বাহির ঘরে বসে থাকা আমেনার কান্না ও তার অসহ্য লাগতে লাগলো। মনে হল কি যেন আসছে, কি যেন আসছে। কি আসছে। চোখ বন্ধ করে আবার সেই দূরবর্তী কফিন দেখতে পেল সে।
মাথায় প্রবল যন্ত্রণা হচ্ছিল। জানালার কাছে এসে একটা কোকিল ডাকতে শুরু করল। কোকিলের সুরেলা গলাও তাকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করল কেন যেন। আনুবিবি ছটফট করতে করতেই ঘুমিয়ে গেল।
*****
তারপর কেটে গেল অনেক গুলো দিন…অনেক গুলো বছর। আনুবিবির স্বামী পাড়ি জমালো পরবাসে। আনুবিবি একা তার বাচ্চাকে নিয়ে পড়ে রইল দূর গ্রামে। আমেনা ফিরে গেল স্বামীর ঘরে। আলেয়াও সেদিনের পর ই স্বামীর কাছে চলে গিয়েছিল। বজলু মিয়া ও আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিল। আমেনা আর বজলুর ঘর সন্তানাদিতে আলোকিত হয়ে উঠল। দিন কেটে যায়…বহমান নদী খরস্রোতা হয়, ঝড়ে জলে উচ্ছাসিত হয়ে ওঠে, প্রবল শীতে জলকষ্টে মরে থাকে। তবু জীবন কেটে যায়।
আনুবিবি বাস করে একচালা ঘরে, স্বামী যেটা রেখে গিয়েছিল সেখানেই।
তবে টাকা পাঠাচ্ছে স্বামী বেশ ভালই। ভাবছে পাশের নুরু মিয়ার ৫ বিঘার জমিটা কিনে নেবে। তারপর বাগানবাড়ি বানাবে। এই আনুবিবি আর সেই চুপচাপ আনুবিবি নেই, একাকীত্বের জীবন তাকে অনেক পোড়ালো। এখন সে সাহসী, বকাবাজ। অনেকেই তাকে ভয় পায়। একটা এঞ্জিওতে চাকরি ও নিয়েছে সে। সেখানেও বেশ ভাল জনপ্রিয়তা তার। আনুবিবির রূপ যৌবন ও বয়সের সাথে খুলছে।
নেকড়ে শেয়ালেরা হাত বাড়াতে চায়। আনুবিবি চায় সম্মান নিয়ে বাঁচতে। সে সব আকর্ষণীয় পরিধেয় বর্জন করলো। সাদা এক পেড়ে শাড়ি, মাথায় এক হাড়া কাপড় দিয়ে চলে সে। চলাফেরায় কোন অশ্লীলতা নাই, কোন আবেদন নাই।
স্বামীহীন, সঙ্গীহীন জীবনের বেদনা তার শরীরে ফুটে উঠতে পারে না। তার ছেলেটার নাম আমির। আমিরও বেশ বড় হয়েছে। স্কুলে আট ক্লাসে উঠেও গেছে। এর মধ্যে বাবাকে দেখে নি সে। তাতে অবশ্য তার বিকার নেই, মায়ের বর্ণাঢ্য জীবন সে উপভোগ করে। আনু খালাম্মার ছেলে বলে তার আলাদা সম্মানও আছে।
যেটা বলা হয় নাই, আনুবিবি যেখানেই যেত, সে মানা করত তাকে যেন ‘আপা’ না বলা হয়। সে চাইত সবার মুরুব্বিস্থানীয়া হয়ে থাকতে যাতে তার ওপরে কারো নজর না পড়ে।
তাকে সবাই প্রাণের ‘আনু খালাম্মা’ বলেই জানত।
আনু খালাম্মার জীবন তর তর করে এগিয়ে যেতে লাগলো।
আনুবিবি জমি বাড়ালো, বাগান বাড়ি করলো, তারপর সেই বাড়িতে বসলো উৎসব। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসলে আনুবিবির বাড়িতেই থাকে, এলাকার ইলেকশনের প্রচারণা, নির্বাচনের জন্য আসা মানুষজনের ও আনুবিবির বাড়িতে জায়গা হয়। আনুবিবির ঘনিষ্ঠ পাড়াত ভাই মেম্বার ইলেকশনে দাড়ালো। তার যাবতীয় চেলা চামুন্ডারা আনুবিবির বাড়িতে দিনের পর দিন অন্ন ধ্বংস করতে লাগলো। তাতে আনুবিবির কোন সমস্যা নেই, টাকায় টাকা বাড়ে।
দুনিয়ার যাবতীয় ধান্ধা সেই কিশোরী ছোট মেয়েটা বুঝে ফেলেছে, স্বামীর মার খেয়ে পড়ে থেকে দাদীকে স্বপ্ন দেখে বিলাপ করার দিন ও শেষ হয়েছে। এখন আনুবিবি অরাজনৈতিক রাজনীতিবিদ। এলাকার যাবতীয় বিরোধের মধ্যস্থতাকারী।
আনুবিবি থেকে ‘আনু খালাম্মা’।
জল কত দ্রুত গড়ায়….
আনুবিবির বাড়িতে জায়গীর থাকে তিন জন। তিনজন ই অতি দরিদ্র ঘরের সন্তান। তারা আনুবিবির সামনে কেঁচো হয়ে থাকে। যদিও আনুবিবি তাদের কখনোই কিছু বলে নি। এইবার দুইজন ইন্টার দিবে আর একজন বি এ তে ভর্তি হয়েছে। কারো কাছ থেকেই বিনিময় নেয় না আনুবিবি। মাঝে মাঝে আনুবিবি ভাত খাবার সময় তাদের ডাকে। তারা জবুথবু হয়ে আসে ভাত খেতে। কাজের মেয়ে রহিমা সব তদারকি করে।
আনুবিবি বলে, ত কেমন পড়াশোনা চলে বাবারা?
তিনজন ই একসাথে মাথা নেড়ে রোবটের মত বলে, ভাল।
-পড়ো, বাপ মা ত অনেক কষ্ট করে তোমাগো। ‘অবিসার’ (অফিসার) হইয়া তাদের যাতনা দূর করবা। ঠিক কিনা?
তিনজন আবার একসাথে মাথা নাড়ে।
আনুবিবি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এই গাধার দল কথা না বুঝেই শুধু মাথা নাড়তে থাকবে। আনুগত্যের কুফল। সে আর কথা বলে না। নীরবে ভাত খেয়ে যায়। মাঝে মাঝে তিন গাধার দিকে তাকায়। তারা দ্রুত খেয়ে যাচ্ছে।আনুবিবি আবার বলে, এত তাড়া কিসের খাওয়ার সময়? ধীরে সুস্থে খাও। তাদের খাওয়ার গতি একদম নেমে যায়। আনুবিবি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই গাধাদের অন্নধ্বংস করতে দেয়া ই ভুল হল।
আনুবিবির খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে হাত ধুয়ে উঠে যায়। তারপর আনুবিবি যায় তার ছেলের ঘরে। ছেলেটা টেবিলে বসে আছে। হাতে কি একটা বই। ক্লাসের পড়ার বই না যতদূর মনে হচ্ছে।
আনুবিবি তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ তার মনে হল মইন মিয়া বই হাতে বসে আছে। তার বুকে ধাক্কা লাগলো। সবাই বলে ছেলেটা তার মত হয়েছে দেখতে, অথচ সে মাঝে মাঝে মইন মিয়াকেই দেখতে পায় ছেলের মধ্যে। আনুবিবির চোখে জল এলো।
সে কোমল স্বরে ডাকলো, আমির।
আমির ফিরে তাকালো, আনুবিবি দেখলো এই ফিরে তাকানোর ভঙ্গি ত মইন মিয়ার মতই। ঘাড় বাঁকা করে তাকানো। সে ছেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, কি করিস বাছা?
– একটা গল্পের বই পড়তাছি।
– কি নাম?
– বিষবৃক্ষ।
– ওমা কি কঠিন নাম। আনুবিবি হাসলো। ছেলেও হাসলো।
তারপর আনুবিবি বলল, বাপরে দেখতে ইচ্ছা হয় না?
আমির একটু গম্ভীর হল, তারপর বলল, হয় ত।
-তোর বাবা আসবে সামনের মাসে। চিঠি দিয়েছে। আমিরকে অতটা আগ্রহী মনে হল না, সে বই নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
আনুবিবির মনে ধাক্কা লাগলো, ছেলেটা এত দূরে কবে সরে গেল, বাবার আগমনী সংবাদ বা সেজন্য মায়ের খুশি কিছুতেই তার কোন অংশগ্রহণ নেই কেন। আনুবিবি আর দাড়ালো না।
-ঠিক আছে, পড়। বলে চলে এলো। বাইরের ঘরে কয়েকজন মহিলা এসে বসেছিল, তাদের নিয়ে বসলো।
*****
আনুবিবির ঘনিষ্ঠ পাড়াত ভাই হল শানু, যাবতীয় কাজকর্ম, যেকোন লেনাদেনার ব্যাপার স্যাপার, নৈমিত্তিক সমস্যাদি সব শানুর সাথে পরামর্শ করেই করে সে।
শানুর বয়স ৪০ এর কাছাকাছি। বউ আছে একটা শান্ত শিষ্ট। তার কাজ রান্নাবান্না করা আর কাথা সেলাই।ছেলেপুলে হয় নি, শানু এক সময় চেষ্ট করেছিল। এখন চেষ্টা ও ছেড়ে দিয়েছে।
আনুবিবির কাছে প্রায়ই আসে শানু, সুখ দুঃখের গল্প করে, নিজের বোনের বাড়ির মতই এসে হইচই লাগিয়ে দেয়।
এই ত গতবছর মেম্বার ইলেকশন হল। শানুর লোকজন সব এসে জুটলো আনুবিবির ঘরে, তাদের রান্না খাওয়া থাকা সবি আনুবিবির তদারকি করতে হয়।
আনুবিবির অবশ্য তাতে সমস্যা নেই আগেই বলা হয়েছে। স্বামীহীন জীবনে একা নারীর জন্য পুরুষ মানুষ ছাড়া চলা এই গ্রামদেশে অসম্ভব। শানু তার অনেক উপকার করেছে। তাকে ঘরশুদ্ধ দিয়ে দিতেও আনুবিবির অসুবিধা নেই। যদিও লোকে দু কথা শুনিয়েছিল, অবশ্য আনুবিবি পাত্তা দেয় নি। সময়ে সব সয়ে গেছে, তাছাড়া টাকা আর ক্ষমতা থাকলে মানুষের মুখ বন্ধ হতে সময় লাগে না তা আনুবিবি এতদিনে ভালই বুঝেছে।
যত যাই হউক, যেকোন দরকারে ত এলাকার মানুষ তাকেই স্মরণ করে, করতে বাধ্য।
দেখা গেল ঘরে চাল নেই, রান্না হবে না, তো আনুবিবির কাছেই যাওয়া যায়। পেট পুরে ভাত ও জুটবে, রাতের জন্য চাল ও জুটবে
ঝগড়াঝাটি হলেও আনুবিবই ভরসা, তার কথা সবাই মানে এখন। এমন সাক্ষাতলক্ষীকে নিয়ে ত আর কথা মানায় না।
তবে শানু খেয়ালী মানুষ, সে রাজনীতি করে ঠিকি, তবে তার মন টা উদাস, বাচ্চাদের মতই।
রাত জেগে যাত্রাপালা, মাঝে মাঝে ফকির আনিয়ে গান বাদ্য করা,এসব ই তার মধ্যে আছে।
বয়স টা একটু বেশি, তবে তরুণদের সাথেই মিশতে ভাল লাগে তার। ইদানিং তার নতুন একজন বন্ধু জুটেছে। বয়স ২৩-২৪ এর মত। অনেক দূরে বাড়ি, কুমিল্লায়। এখানে সমাজকল্যাণে চাকরি নিয়ে এসেছে।
নাম তার শাহজাহান। শাহজাহান একটু চুপচাপ, বুদ্ধিমান ছেলে। তার প্রধান কাজ হচ্ছে শানুর বকবক উদাসীন হয়ে শোনা, এতে অবশ্য সে বিরক্ত হয় না, শানু তাকে ভালবাসে।
তার একা থাকতে খেতে কষ্ট হয় বলে সে শানুর বাড়িতেই উঠেছে। তাদের পরিচয়টা অবশ্য নাটকীয় ই ছিল। সে বিশাল কাহিনী। পরে কখনো বলা যাবে।
শানু বউ প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল, পরে অবশ্য স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই সব সয়ে নিল। তার পুরো জীবন ই চলে গেল শানুর পাগলমি সহ্য করতে করতে। এটা হয়ত তার প্রিয় বিরক্তি ও।
আনুবিবি খুব ব্যস্ত সময় পার করছে। ধান উঠেছে, হেমন্ত কাল।। ২০ জন শ্রমিক কাজ করছে। তাদের তদারকি করতে হচ্ছে। ধান শুকাতে দেয়া, সিদ্ধ করা, ভানার কাজ আনুবিবি নিজেই কয়েকজন মহিলা নিয়ে করছে।
হেমন্তের নরম রোদ্দুর, সাথে নতুন ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ, আকাশ টা নিবিড় ভাবে নীল। সারা উঠোন জুড়ে চড়ুই, দোয়েল, টুনটুনি নেচে বেড়াচ্ছে, ধান খাচ্ছে। মানুষজনের কোলাহল, পাখির কলকাকলি আর মাঝে মাঝে আনুবিবির দরাজ গলা পুরো পরিবেশকে ছেয়ে রেখেছে।
এর মধ্যে আনুবিবি আমিরকে খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিল।
শরীর ভয়াবহ ভাবে ঘামছে। এই মৌসুমে আনুবিবি কয়েকবার গোসল করে দিনে। আজো তার ব্যতিক্রম হল না। উঠোনের তদারকি ময়নার মাকে দিয়ে সে ছুটলো কলঘরে।
ভেজা শরীরে গেরুয়া রং এর শাড়ি পরে বের হয়ে এলো। এইসময় আনুবিবি ব্লাউজ ও পড়ে না। কোন ভাবে শাড়িটা দিয়ে শরীরটা কোন ভাবে ঢেকে এসে ধান গুলো আবার পা দিয়ে নেড়ে দিতে লাগলো ঘুরে ঘুরে।
রোদ পড়ছে, শরীর শুকাচ্ছে, নিচে শস্যদানা। ভালই লাগছে তার। এর মধ্যে ডাক এলো। কারা যেন দেখা করতে এসেছে।
আনুবিবির বিরক্ত লাগলো। এটা তার নিজস্ব সময়। তাও কি আর করা। মাথায় কাপড় দিয়ে শরীরটা ভাল ভাবে ঢেকে ছুটলো সে। গিয়ে দেখলো তার পাড়াত ভাই মেম্বার শানু আর সাথে একজন যুবা পুরুষ বসে আছে। পাচদুয়ারের সামনে যে মেহমানঘর আনুবিবি বানিয়েছে সেখানে।
আনুবিবি ঘাম মুছে গিয়ে বসলো। তারপর বলল, কি ভাই? অসময়ে আইলা কেন?
– বইন খুব ব্যস্ত আছিলা নাকি।
– হ। ধানের কাম করতেছি।
– ওহ। এই হইল শাহজাহান। আমার বন্ধু।সমাজকল্যানে চাকরি করে। যুবাকে দেখিয়ে বলল শানু।
আনুবিবি এইবার তাকালো তার দিকে। কমবয়সী ছেলে। শানুর পাগলামি আর গেল না।
– আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুম সালাম। উত্তর আসলো।
আনুবিবি তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ ফিরিয়ে নিল। তাছাড়া মনে হল এই পুরুষ তাকে খুব গভীর ভাবে দেখছে। তার অস্বস্তি লাগলো।
আনুবিবি শানুকে জিজ্ঞাসা করল, তা কিছু কইবা নাকি?
-হ বইন, কইতেই ত আইলাম। সালিশ আছে আইজ একটা, তুমি কইরা দিবা নাকি।
-কি সালিশ?
-আরে ব্যাপারির পোলা, মোল্লার মাইয়া নিয়া ভাগছে।
মোল্লার মাইয়া দুইদিন পর আইসা কইতেছে এই পোলার লগে থাকব না, পোলা নাকি হেরে বিয়া না কইরাই হুডেলে নিয়া রাখছে।
– কি মসিবত আইজকালের পোলামাইয়ার।
– হ। চেয়ারম্যান সাব ঢাকা গেছে। তাছাড়া বেশি মাতামাতি হউক বাপ মা চাইতেছে না। তোমার ঘরেই বসুক সবাই আইজকা। আমিও থাকমু।
আনুবিবি একটু ভাবলো, সন্ধ্যার পর আসতে কইও।
-আইচ্ছা, ত আমার দোস্তের লগে ত কথা কইলা না।
শানু হাসলো।
আনুবিবি অপ্রস্তুত হয়ে শাহজাহানের দিকে তাকালো।
শাহজাহান রহস্যময় স্বরে বলল, সময় ত ফুরাইয়া যায় নাই, আবার দেখা হইবে।
আনুবিবির গা শিরশির করে উঠলো। এইভাবে কথা তো তার সাথে কেউ বলে না।
– হ্যা দেখা হইবে। আনুবিবি হাসলো।
– ত আপনারে কি ডাকমু? আনু আপা? শাহজাহান বললো।
– না, আমি আনু খালাম্মা। সবাই ত জানে।
– কিন্ত আপনার ভাই ত আমার দোস্ত।
– আমার ভাই আর আপনার হিসাব ত আলাদা।
আর বয়সে আপনি আমার ভাই এর থেকে ছোট হইবেন বইলা ই মনে হইতেছে।
শানু এইবার হাহা করে হাসলো।
আনুবিবি ও হাসলো।
-হ বইনা, পোলা ত আমার ছোট, তায় অনেক পাকনা, তাই দোস্ত বানাইয়া নিলাম। ছোড পোলাপান দোস্ত থাকলে নিজেরে বুড়া লাগে না, হাহাহা।
আনুবিবি এইবার শাহজাহানের দিকে তাকালো, বয়স কতই বা হবে, ২৩-২৪।
তার আর শানুর হিসাবে নিতান্তই বাচ্চা। আর শানুও মাঝে মাঝে যে কিসব করে বেড়ায়, এইসব বাচ্চা ছেলেদের মুরুব্বিদের কাতারে বসানোর কি দরকার? কথাবার্তার ধাঁচ কেমন, আদব লেহাজ নাই। আনুবিবি বিরক্ত হল।
আনু বিরক্ত স্বরে বলল, আর কত জুয়ান থাকবা? মেম্বার হইছ, কয়দিন পর চেয়ারম্যানেও খাড়াবা। আর এহনো তোমার ঢং যায় না।
শানু আবার হাহা করে আসলো, আনুবিবি বকা দিলে তার ভাল লাগে।
তারপর বলল, আচ্ছা যাই বইনা। কাম করো তুমি, সন্ধায় সব ইন্তেজাম রাইখো।
-যাও। আনুবিবি দ্রুতই উঠলো।
*****
সারাদিন এক অদ্ভুত বিরক্তি তার শরীরে বয়ে বেড়াতে লাগল। শাহজাহান মন থেকে আনুবিবিকে সরাতে পারছে না।
গেরুয়া শাড়ি পরা কাঁচাসোনা গায়ের রং, মাথার কাপড়ের আড়াল থেকে কয়েক গোছা কোকড়া চুল, সাক্ষাত দেবী। আর তেজ ও কি ভয়াবহ।
যদিও শাহজাহানের নারীজাতির প্রতি টান টা একটু বেশিই, তাও আনুবিবি যেন সব টানকে ছাড়িয়ে গেল। চোখের সামনে আনুবিবি আসতে লাগলো বারবার।
একটু বিরক্ত হল সে। শানু ওইদিকে ইলেকশনের কাহিনী কি বকবক করেই যাচ্ছে, তার মাথায় ঢুকছে না।
মাঝে মাঝে দু একটা শব্দ খেয়াল করতে পারছে,
হারামজাদার গুস্টি, পাগল, আমি বড় পাগল, মতি মিয়া, মোল্লা ভাই….
আচ্ছা কি বলছে শানু, শাহজাহান শোনার আগ্রহ বোধ করলো না। তার আগ্রহ শুধু গেরুয়াবসনার দিকে এখন।
যেভাবেই হউক আনুবিবির কাছে যাবার ব্যবস্থা করতেই হবে, এখানে শুধু শানু ই তাকে সাহায্য করতে পারে। সে শানুর দিকে তাকালো। ভাব করলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। শানুকে অসন্তুষ্ট করা যাবে না। তারা বসেছিল এক চায়ের দোকানে। দোকানদার চা বানিয়ে শাহজাহানের হাতে দিল। শাহজাহান বেখেয়ালেই চায়ে দ্রুত চুমুক দিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলল। একটু আর্তনাদ করে উঠলো সে।
শানুর বকবক থামলো, আরে কি হইল ভাই। একটু খেয়াল করবা না?
শাহজাহান মনে মনে হাসলো একটু, খেয়াল যে কই গেছে তা যদি জানতা।
শানু চা নিল, আরামসে চুমুক দিয়ে আবার গল্প শুরু করলো।
সন্ধ্যায় সালিশ বসলো।
মেয়ের বাবা হোসেন মোল্লা, বাচাল মানুষ, সারাক্ষণ পান চিবায়,আর মেয়ের মা সুন্দরী বেগম। সে মাথায় কাপড় দিয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে একপাশে বসে আছে। আরো কয়েকজন এলাকার মানুষ আছে।
ছেলের বাবা গম্ভীর, তার চেহারায় আভিজাত্য ধরা পড়ে। ছেলের মা আসে নি। এসেছে ছেলের দুই চাচা, তারাও ভাই এর মত গম্ভীর হয়েই আছে। বাসার সামনের ঘরে গোল হয়ে সভা বসলো। আনুবিবি মধ্যে বসলো,পাশে শানু। শাহজাহান ও এসেছে। ছেলে মেয়ে দুইজনকে আনুবিবির আরেক পাশে বসানো হয়েছে। তারা মাথা নিচু করে আছে। আনুবিবি কথা পাড়লো প্রথমে।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কি হইছে ভাল মত ক।
মেয়ে নীরব রইলো। হাত মুঠো করে শক্ত করতেও দেখা গেল তাকে। আনুবিবি এই পরিস্থিতির সাথে পরিচিত।
সে জিজ্ঞাসা করলো, অন্য কেউ বলবেন?
মেয়ের বাবা হোসেন মোল্লা রাগত স্বরে বলল, আমিই কই।
শানু বললো, কয়েন।
মেয়ের বাবা এক নাগাড়ে বলতে লাগলেন, মাইয়া আমার ভোলাভালা, শয়তানের পাল্লায় পইড়া ঘর ছাড়ছে।
আর হেই শয়তান কি করল, আমার মাইয়ারে দুইদিন হুডেলে রাইখা…
ছেলে এইবার মুখ তুলে তাকালো। তীব্র দৃষ্টি হানলো মোল্লার দিকে। মোল্লা চুপ করলো।
আনুবিবি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করল, কিরে মতিন, এইডা কেন করলি?
মতিন বলল, উনার মাইয়ার চরিত্রে দোষ আছে, ভাল মাইয়া না।
আনুবিবি স্তম্ভিত হল।
-বুঝলাম মাইয়ার চরিত্র ভাল না, তাই বইলা তুই এই আকাম কেন করলি? বাপের মুখে চুনকালি দিলি।
ছেলে আবার চুপ রইলো।
আনুবিবি এইবার সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কাহিনী কম বেশি সবাই-ই জানেন, আমার নতুন করে শোনা বা শোনানোর কিছু নাই।
এখন আপনাদের কি বিবেচনা।
মোল্লা বলল, আমার মাইয়ারে বিয়া করতে কন। এই মাইয়া আমি কই বিয়া দিমু। আসরের অনেকেই তাতে সায় দিল। ছেলের বাবা এইবার মুখ খুলল।
– এই মাইয়া আমরা ঘরে নিবার চাই না।
– চান না মানে? মোল্লা হিসিয়ে উঠলো। আপনার পোলা আমার মাইয়ার ইজ্জত নষ্ট করছে। এখন ঘরে নিতে হইব।
ছেলের এক চাচা বলে উঠলেন, মাইয়ার ইজ্জত ত আগে থিকাই নষ্ট। ভাল মাইয়া হইলে কি আরেক পুরুষের হাত ধইরা দেশান্তরী হয়?
মোল্লা তেড়ে উঠতে যাচ্ছিল প্রায়। আনুবিবি হাত উঠালো, মোল্লাকে থামতে ইশারা করলো। মোল্লা থামলো, তবে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছেলের চাচার দিকে।
আনুবিবি এইবার শানুর দিকে তাকালো, তোমার কি বিবেচনা?
শানু কতক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মাইয়া তোমার বিয়া করতে হইব৷ আমাগো ঘরের মাইয়ার বেইজ্জতি করলে দশ গ্রাম আমাগো নিয়া কথা শোনাইব। এইসব হইব না বিয়া আইজকাই হইব। আমি নিজে দাড়াইয়া বিয়া দিমু।
শানুর কন্ঠ কঠিন।
মোল্লা খুশি হয়ে বলল, আলহামদুলিল্লাহ।
ছেলের বাবা বলল, টাকা পয়সা যত লাগে আমি দিতে রাজি আছি, মাইয়ার বিয়া অন্য কোথাও যাতে হয় সেই চেষ্টা আমি করমু, বিয়ার খরচ ও দিমু। মাইয়া আমরা ঘরে তুলমু না মেম্বার সাব।
আনুবিবি তারপর শান্ত স্বরে বলল, আপনাগো মাইয়া পোলা নিয়া আপনারা যা খুশি করতেন, আমাগো সালিশ ডাকলেন কেন যদি দশ জনের কথাই না শুনেন।
ছেলের চাচা বললেন, আমরা ত অনেজ্জ কিছু করতাছি না। আমরা টাকা পয়সা দিতে চাই। মাইয়া অন্য কোথাও রাইখা বিয়া দিয়া দিক।
আনুবিবি এইবার আসরের দিকে তাকিয়ে বলল, ইজ্জতের বকশিশ টাকা দিয়া হয় না।
আপনাগো পোলা কামডা ঠিক করে নাই। টাকার গরম দেখাইয়েন না।
আসরের মনু মিয়া সায় দিয়া বলল, হ। বিয়া দেয়াই ভাল। অন্য কয়েকজন মাথা নাড়লো।
শানু এইবার বলল, আমাগো ১০ জনের কাছে যখন আইছেন আমাগো কতাই শেষ কথা, আপনারা ঘরে নেন বা না নেন, বিয়া আমরা আইজ পড়াইয়া দিমু, বাকিটা আপনাগো বিবেচনা। ছেলের পরিবার আর কিছু বলল না।
শানু এইবার আসরের দিকে তাকিয়ে বলল, তাইলে বিয়ার আয়োজন হউক, মৌলভি সাহেবরে ডাকো।
আসর আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করলো।
শানু এইবার মতিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ওরে কেউ নজরে রাখো, এই বেডা সুবিধার না, পলাইয়া যাইতে পারে।
মতিনের আশেপাশে তিনজন শানুর চেলা দাড়ালো।
মতিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
*****
শাহজাহান শুধু আনুবিবিকেই দেখছে।
এত শান্ত, এত বুদ্ধিমান, এত তেজ। শাহজাহান মুগ্ধ, আনুবিবি অবশ্য তার দিকে তাকাচ্ছে না, আনুবিবি কি বুঝতে পারছে তার আকুলতা? নাহলে এত সচেতন ভাবে অবহেলা করা যায় না। শাহজাহানের আকুলতা আরো বেড়ে গেল।
সে আনুবিবিকে দেখা যায় এমন দূরত্ব রইলো যথাসম্ভব।
মোল্লার মেয়ের বিয়ের আয়োজন হচ্ছে আনুবিবির বাড়িতেই। পুরো এলাকার মানুষজন এসেছে। অনেক কোলাহল, অবশ্য শাহজাহানের কোন শব্দ ই মাথায় ঢুকছে না। সে শুধু আনুবিবিকেই ভাবছে।
ছেলের বাবার দিকে চোখ পড়ল তার, মানুষটা কাঠের মত হয়ে একপাশে বসে আছে চেয়ার নিয়ে। কোলাহলের প্রতি উদাসীন, পাশে তার দুই ভাই আর আরেকজন লোক দাঁড়ানো। তারা নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করে কথা বলছে।
শাহজাহান এগিয়ে গেল সেদিকে, ছেলের বাবার থেকেও বড় ব্যাপার ওই পাশ দিয়ে আনুবিবিকে ভাল ভাবে দেখা যাচ্ছে, সে কয়েকজন মহিলার সাথে রান্নাঘরের দিকে বসেছে, চাল বেছে দিচ্ছে, অনেক রান্না করতে হবে আজ, ঘরের কাজ আনুবিবি কখনো কাজের মানুষদের ওপরে ছেড়ে দেয় না, শাহজাহান আরো মুগ্ধ হল, কুপির সোনালী আলো পড়েছে আনুবিবির হলুদ মুখের এক পাশে, এত ভাল লাগছে।
শাহজাহান সেদিকে এক নজর তাকিয়ে ছেলের চাচার দিকে তাকালো, তারপর বলল, কি খবর মুরুব্বি?
ছেলের চাচা শাহজাহানের দিকে তাকালো, একে তারা শানুর সাথে দেখেছে, প্রভাব আছে হয়ত, যদিও বাচ্চা ছেলে।
তারা সমীহ করে বলল, কি আর খবর। দেখলেন ই ত। মাইয়া গছাইয়া দিতেছে আমাগো ওপর। নষ্টা মাইয়া।
শাহজাহান একটু হাসলো, তারপর বললো, আপনাগো পোলা কি ভাল নাকি?
ছেলের চাচা ইতস্তত হয়ে বলল, পুরুষ মানুষের আবার ভাল মন্দ কি। বাচ্চা পোলা ভুল কইরা ফালাইছে বয়সের দোষে। শাহজাহান আবার হাসলো, তারপর আবার এক নজর তাকালো, আনুবিবির দিকে। বয়সের দোষ আসলেই খারাপ।
-কি আর করবেন, মাইনা নেন মুরুব্বি, ঘরের বউ হইলে দোষ কাইটা যাইব।
ছেলের চাচার কথাটা পছন্দ হল না৷ সে চুপ করে রইলো। শাহজাহান এখানে আরো দাঁড়িয়ে থাকতে চায়, কথা বন্ধ করা যাবে না।
সে আগ বাড়িয়ে বলল, ত চাচা কি করেন?
-কি আর করমু, জমি আছে, বর্গা দেই, জুয়ান বয়সে হালচাষ ও করতাম।
শাহজাহান এরপর কি বলবে ভেবে পেল না। সে আবার আনুবিবির দিকে তাকালো কৌশলে। এইবার তার বুক ধ্বক করে উঠলো, আনুবিবি তাকিয়েছে, তার দিকেই, তার শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।সে তাড়াতাড়ি চোখ সরালো।
– হ চাচা, হালচাষ ভাল কাম। কোন ভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল সে।
এই ধরণের অদ্ভুত উত্তর পেয়ে তারা সরু চোখে শাহজাহানকে দেখতে লাগল। ছেলের বাবা বকবক শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছিল, সে উঠে চলে গেল।
শাহজাহান কি করবে ভেবে পেল না, সে বলল, আচ্চা চাচা, থাকেন যাই। পরে কথা হইব।
সেও পালালো।
*****
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে রাত হয়ে গেল। এলাকার প্রায় সবাই চলে গেছে। শানু রয়ে গেল, শাহজাহান রয়ে গেল আর শানুর দুইজন লোক। ময়নার মাও আজ বাড়ি গেল না, অনেক থালা বাসন পড়ে আছে, অনেক কিছু অগোছালো হয়ে আছে, রহিমার সাথে সেও দেখাশোনা করবে। আনুবিবির মাথা ধরেছে। সে শানু আর শাহজাহানের জন্য বিছানা সাজাতে বলে ভিতর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
আমির ঘুমোচ্ছে।
কুপি টিম টিম করে জ্বলছে। জানালা থেকে হেমন্তের হালকা বাতাস আসছে। পূর্ণ চাদ উঠেছে। জানালার পাশের রেইন্ট্রি গাছের চিরলবিরল পাতা দুলছে বাতাসে।
আনুবিবির ভাল লাগলো। শুয়ে শুয়ে সারাদিন যা হল তা ভাবতে লাগল সে। হঠাৎ শাহজাহানের কথা মনে হল তার।
এই ছেলেটা এভাবে দেখে কেন তাকে, তার দিকে এত সাহস করে কেউ তাকায় না এখন, এই ছেলেটার এত সাহস কেন? সে কি চায়? আনুবিবির প্রতাপ কি সে দেখে না? এত দম্ভ তার কেন হল? আনুবিবির বিরক্ত লাগলো, আবার ভাল ও লাগলো।
স্বামী চলে যাবার পর তার জীবনে প্রেম ভালবাসা বলে কিছু নেই বললেই চলে, থাকতেও বা কতদূর হয়েছে।ওভাবে তাকিয়েছে কখনো? তার ছিল শরীরের দরকার, সে শরীর নিয়েছে, ভালবেসে ত তাকায় নি, দুটো ভাল কথা ও বলে নি কখনো। তাও আনুবিবি তার স্বামীকে ভালবেসে, তার এত শান শওকত ত লোকটার জন্য তাও অস্বীকার করা যায় না। ভালবাসা না দিলেও কোন না কোন দিক থেকে ত ঠিকই পূর্ণ করে দিল। পরের মাসে আসার কথা তার, আজ কত তারিখ আনুবিবি ভাবতে চেষ্টা করলো। ২২ তারিখ।
নাহ, বেশিদিন নেই। সব ভালমত গুছিয়ে ঘরটা ভাল ভাবে সাজাতে হবে, লোকটা এসে দেখুক সে অন্ন ধ্বংস করেনি বসে বসে, রাজত্বও বাড়িয়েছে। আনুবিবির মন অদ্ভুত প্রসন্নতায় ভরে উঠলো। তারপর হঠাৎ করে মন চলে গেল শাহজাহানের কাছে।
হ্যা, শাহজাহান সুন্দর যুবাপুরষ, বুদ্ধিও আছে, দীর্ঘকায় শরীর, রাজপুত্রের মত গায়ের রং। যেমন নাম, তেমন দেখতে।আনুবিবি মনে মনে হাসলো।তারপর একটু যেন অপ্রস্তুত হল, আচ্ছা সে শাহজাহানকে কেন ভাবছে এত। আনুবিবি লজ্জিত হল। ছিঃ তার স্বামী সন্তান আছে, আরেক পুরুষের কথা এইভাবে ভাবা ও পাপ। আর আজ যেভাবে বলে দিয়েছে শাহজাহান তাকে খালাম্মা ই ডাকবে, তাহলে সে হল শাহজাহানের মাতৃস্থানীয়া। চল্লিশ বছর বয়সে মন টা কেন যে উতলা হয়ে ওঠে তার।
অথচ শরীর ত চল্লিশের নিয়ম মানে নি, এখনো চামড়া শক্ত, টান টান, গায়ের রং আরামে থেকে খুলেছে, আর আনুবিবি ত নিজের যত্নও নেয়, অনেক বছর ধরে কোন পুরুষ ছানাছানিও করে নি, তাহলে তার যৌবনে দাগ লাগবেই বা কেন। এই ধরণের কথা ভেবেও আনুবিবি লজ্জিত হল।
সে ধার্মিক মহিলা, সবার সাথে থেকে অতটা পর্দা রক্ষা হয়ে ওঠে না তাই বলে তাকে কেউ ছিনালও বলবে না।এই মর্যাদা নিয়ে তার গর্ব আছে, এই গর্ব তার রক্ষা করতে হবে। সে তার স্বামীর কথা ভাবলো, বাসর রাতের কথা ভাবলো, সুখ অনুভব হল তার।
কবে যে আসবে। আনুবিবি উতলা হয়ে উঠল।
*****
শাহজাহান খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলো। বাইরে পাখি কিচির মিচির করছে, আলো এখনো ফুটে নি। হিমেল হাওয়া দিচ্ছে। সে শানুর দিকে তাকালো। সে বাচ্চাদের মত ঘুমাচ্ছে। শানুকে পাশ কাটিয়ে সে বিছানা থেকে নামলো। কলঘরে গেল। প্রাতরাশ সেরে উঠোনে এসে দাড়ালো। বিশাল বাগানবাড়ি আনুবিবির।
বাড়ির সামনে হরেক রকম ফুলগাছ, ফুল ফুটে আছে রং বেরং এর, আর ফুলগাছে বেস্টিত বিশাল উঠান। বাড়ির পিছনে নানারকম ফলের গাছ, আর দুইপাশে রেন্ট্রি, মেহগনির সারি। রাজত্ব ই বলা চলে, শুনেছে সব আনুবিবির নিজের হাতে করা, এত অসাধারণ নারী সে আগে দেখে নি।
শাহজাহান ডুবতে শুরু করল খুব বেশি। কেমন প্রেমে মাতাল এক হাওয়া আশেপাশে। প্রতিটা গাছে নিশ্চয়ই আনুবিবির ছোঁয়া আছে, তার ইচ্ছে হল সবগুলো ছুঁয়ে দেখে।
উঠোনের এক পাশে গোলাপের গাছ, সে গাছটির দিকে এগিয়ে গেল। রক্তগোলাপ ফুটে আছে, উপরে শিশির বিন্দু। ভোরের ক্রমবর্ধমান আলোয় গোলাপটা আরো রূপসী হয়ে উঠতে লাগলো। শাহজাহানের মনে হল এই গোলাপটা যেন আনুবিবি। সে আস্তে আস্তে ছুয়ে দেখতে লাগলো, প্রেম এত অদ্ভুত কেন? এই যে পাপড়িটা, এটা আনুবিবির সুডৌল স্তন, এই যে একটু ওপরের আরেকটা পাপড়ি, এটা আনুবিবির ঠোট, আর গোলাপের মধ্যের কুড়িগুলো, এইগুলো যেন আনুর চোখ,
আনুবিবি নিষ্পাপ চোখ মেলে তাকে দেখছে, আর সে আনুবিবিকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। গোলাপের কুঁড়ি গুলো নড়ে ওঠে, তার মনে হল আনু যেন লজ্জা পেয়ে চোখ বন্ধ করছে।
শাহজাহান চোখ বন্ধ করলো, আমি তোমার জন্য ভিখারী, আমি তোমার জন্য ভিখারী। মনে মনে বলল সে।
শব্দে শাহজাহানের ধ্যান ভাঙলো। অপ্রস্তুত হয়ে পিছনে ফিরলো সে। আনুবিবি কোমরে একটা সাজি নিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। চোখ কুঁচকানো। আহা, এই বাংলার নারী রূপেও তুমি কত না সুমধুর। শাহজাহান মনে মনে বলল।
আনুবিবির কোমরের সাজিতে ধানভর্তি, সে ধান গুলো উঠোনে বিছানোর জন্য ফেলে দিল। তারপর পা দিয়ে বিছাতে লাগলো।
শাহজাহান আবার অপ্রস্তুত হল, তার মনে হল আনুবিবি সব যেন জানে। নাহলে এত কঠিন নির্লিপ্ততা তার কিভাবে আসে। যেন কিছুই জানে না, কিছুই হয় নি এমন ভাবে ধান বিছাচ্ছে সে।
শাহজাহান অপমানিত বোধ করলো, কার জন্য তার সব কিছু উতলা হয়ে আছে? সে কি তার বিন্দুমাত্র মূল্যায়নও করবে? কিসের আশায় সে এত পাগল?
সে দ্রুত উঠোন ছেড়ে ঘরে চলে গেল।
*****
আনুবিবি ধান বিছিয়ে যাচ্ছে। মন টা তার আনমনা। ময়নার মা সাজি ভরে ধান নিয়ে এসে ফেলছে উঠানে। সে পা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা, এইটা কি হল। শাহজাহানের চোখের অমন উদ্ভ্রান্ত, উন্মাদ দৃষ্টি কেন। এই দৃষ্টি কি তার জন্য? আনুবিবি অসহায় বোধ করলো।
জল দুইদিক থেকেই ঢেউ তুলছে তাহলে। আনুবিবি ঘাম মুছলো। না, এ অন্যায়। প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। তার স্বামী আছে, সন্তান আছে, তার সমাজে একটা মর্যাদা আছে, সব ধুলিস্মাৎ হয়ে যাবে। আনুবিবি কিছুতেই মন টা স্থির করতে পারলো না। স্বাধীন জীবন তাকে কি পরীক্ষায় ফেলে দিল? স্বামীর মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে রান্নাবান্না করতেও ত এত যন্ত্রণা লাগে নি, তাহলে এখন কি তাকে রক্তাক্ত করছে?
এ কিসের টান, কি সর্বনাশা বান?
না, এই বান তাকে রুখতে হবে, শাহজাহানের এই বাড়িতে আসা বন্ধ করতে হবে, সে জানে শাহজাহান আসবেই। শানুকে কিভাবে বলবে সে? শানুর অতি স্নেহের পাত্র শাহজাহান, তাকে নিয়ে এই কথা কিভাবে পাড়বে তার কাছে? আনুবিবিরও ত লজ্জা করবে এই বয়সে এসে এই অভিযোগ দিতে, শানু তাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, সেখানে এই আঘাত কিভাবে দেবে সে? আনুবিবির মাথা ধরতে শুরু করলো, পায়ের নিচের ধানগুলো রোদে তেতে উঠেছে, তার মনে হল পায়ের নিচে যেন আগুন জ্বলছে।
সে ছিটকে সরে এলো, ময়নার মা ধান সিদ্ধ করছিল উঠোনের একপাশে চুলোতে, সে ফিরে তাকালো।
– কি হইল খালাম্মা?
– না কিছু না, মাথা ধরছে, তুই রহিমারে নিয়া ধান গুলা দ্যাখ, আমি এট্টু শুই গিয়া।
– আচ্ছা খালাম্মা।
ময়নার মা আবার ধান নাড়ায় মন দিল। আনুবিবি হাত মুখে পানি দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। ঘরের মধ্যে শীতলতা, উঠোনটা তার আগুন মনে হচ্ছিল।
নরম বিছানায় শুতে যাবে এর মধ্যে দেখে বিছানার ওপর একটা চিঠি পড়ে আছে, আনুবিবির মাথায় বাজ পড়লো, এই মুসিবত তার পিছু ছাড়ছে না কেন? সে কাঁপা হাতে চিঠি খুললো, পরিষ্কার গোটা গোটা অক্ষর তার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যেতে লাগলো।
আনু,
আমার বিশ্বাস চিঠিটা দেখেই তুমি বুঝে নিয়েছ কার চিঠি, তোমাকে আমি যতদূর পড়েছি, যতদূর জেনেছি, তুমি হয়ত জেনেও ফেলেছো আমাকে।
আমি তোমাকে ‘খালাম্মা’ ডাকতে পারব না, কিসের খালাম্মা তুমি!
আমাকে তুমি তোমার পায়ে জায়গা দাও, আমি নাহলে মরে যাব, আমি বিষ খাব দেখে নিও, তুমি আমাকে পাগল করেছো, তুমি ই আমাকে সুস্থ করতে পারবে।
আমি আর কিছু জানি না,
হয়ত ভাবছো এত কম সময়ে কিভাবে ভালবাসা হল?
কিভাবে হল তা যদি জানতাম তাহলে রুখতে চাইতাম, কিন্ত জানি না।
আমি সারাক্ষণ তোমার ধ্যান করি, সারাক্ষণ তোমাকেই চাই, তোমাকে না পাওয়া পর্যন্ত আমার শরীর মন শান্ত হবে না, আমি তোমাকে চাই আনু, আমি তোমাকে চাই।
নাম টা লিখলাম না,
বুঝে নিও।
চিঠি পড়ে আনুর গা কাঁপতে লাগলো, সে এইদিক ওইদিক দেখে চিঠিটা কুচি কুচি করে ফেলল, তারপর ফেলে দিল জানালার বাইরে।
কোন মতে বিছানায় এসে বসলো সে, তার মাথা ধরেছে, তার শরীর কাঁপছে, আনুবিবির মনে হল সে মরে যাবে। এক জীবনে স্বামীর যন্ত্রণা পেয়েছে, এখন আবার প্রেম এসে এই বয়সে কেন যন্ত্রণা দিচ্ছে।
এই ছিল কপালে!
*****
আনুবিবি সারাদিন ঘর থেকে বের হল না।
রহিমা আর ময়নার মা ঘরদোর সামলালো। শানু যাবার সময় ডেকেছিল, তাকে বলতে বলা হল, খালাম্মার শরীর খারাপ, পরে দেখা করতে যাইবে বাসা। শানু খেয়েদেয়ে শাহজাহানকে নিয়ে নিশ্চিন্তে বের হয়ে গেল। ঘূণাক্ষরেও টের পেল না সে কি ঝড় বয়ে নিয়ে এসেছে।
আমির স্কুল থেকে ফিরলো, মাকে খোঁজার তার অত তাড়া নাই। সে দুপুরের খাবার খেয়ে খেলতে বের হয়ে গেল বন্ধুদের সাথে। ময়নার মা ধান গুলো গুছিয়ে বাড়ি চলে গেল বিকালে। রহিমা নিজের ঘরে গিয়ে ঝিমুতে লাগলো।
আনুবিবি উঠলো সন্ধায়, এমন অকর্মা দিন তার বিগত অনেক বছরে যায় নি। নামাজ, গোসল, খাওয়া কিছুই হয় নি, শরীর আরো অবসন্ন হয়ে পড়েছে। সারাদিন সে শুয়ে শুয়ে কি ভেবেছে তা সে জানে না। তন্দ্রা আসছিল আবার চলে যাচ্ছিল। কি এক ঘোরলাগা সময়।
তন্দ্রার মধ্যেই দেখলো, শাহজাহান এসেছে। তার পাশে বসেছে।
আনুবিবি লজ্জা পেয়ে উঠতে যাচ্ছিল, শাহজাহান ধরে বসলো, তারপর কাছে টেনে নিল, বলল, তোমার পালানোর জায়গা নাই আনু।
ভয় পেয়ে তন্দ্রা কেটে গেল। আনুবিবি উঠলো, বিছানার পাশে রাখা পানির জগ থেকে পানি ঢেলে খেলো। তার কোন পাপের শাস্তি এসব। স্বামীর কথা ভাবলো সে আবার। মন আর রঙিন হয় না কেন তাকে ভাবলে!
রঙ সব ফিকে করে দিল শাহজাহান। কেন করলো?
আনুবিবি উতলা হয়ে উঠলো, কবে আসবে মইন মিয়া? এই অসম্মান, এই সর্বনাশ থেকে একমাত্র মইন মিয়ার ভালবাসাই বাঁচাতে পারে। মইন মিয়া আসুক, তাকে আপন করে বুকে জড়িয়ে নেবে আনুবিবি। ভাববে না কোন আগন্তুকের কথা, তার পবিত্র সঙ্গী, তার কালেমা পড়া স্বামী, তার বাচ্চার বাবা মইন মিয়া।
অন্য কারো সেখানে জায়গা নেই, আনুবিবি বারবার এই কথাটাই মনে ধারণ করতে চেষ্টা করলো।কিন্ত হায়, কোথায় সেই শক্তি? কোথায় সে প্রতিজ্ঞা? সব কর্পূরের মত নিমিষেই উবে যাচ্ছে। আনুবিবি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এইভাবেই কেটে গেল দিন।
আনুবিবি ঘর থেকে নেমে বাইরে তাকালো, সন্ধ্যা মিলিয়ে আধার নেমেছে, আজ আর চাঁদ নেই, আকাশ ভরা তারা, তার উঠোনের ফুলগাছ গুলোর ফাকে জোনাকি নেচে বেড়াচ্ছে। সামনে রিক্ত খেত, সদ্য ধান তোলার হাহাকার। আনুবিবির মন টাও হাহাকার করে উঠলো।
‘আনু’
আনুবিবি ফিরে তাকালো, একটা ছায়ামূর্তি তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ ছায়ামূর্তি।
আনুবিবি স্থবির হয়ে গেল, সে উত্তর দিল না।
ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসলো, তাকে জড়িয়ে ধরলো। চুমু খেতে শুরু করলো তার ঠোঁটে গালে, পাগলের মত আনুবিবিকে শুষে নিতে লাগলো সে।
আনুবিবির মনে হল সে যেন স্বপ্ন দেখছে। সে নিজের অজান্তেই তাকে জড়িয়ে ধরলো, এতদিনের দীর্ঘ ক্ষুধার্ত শরীর জেগে উঠলো, আনুবিবি সব ভুলে গেল, সমাজ, সংসার বাস্তবতা।
হঠাৎ আনুবিবির শরীরে কে যেন চাবুক মারলো, সে ভয় পাওয়া পাখির মত এক নিমিষে আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ছুটে দাঁড়ালো দূরে, আগন্তুক তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে।
তারপর ঘোর লাগানো কন্ঠে বলল, যা থেকে পালাতে পারবা না, তা থেকে পালাতে চেও না।
আনুবিবির শরীর কাঁপছিল, সে দৌড়ে চলে গেল ঘরে। কি হল এটা, সে কি গলায় দড়ি দেবে এখন?
কি সর্বনাশ হয়ে গেল। শাহজাহান তার আকুলতাকে স্পর্শ করে ফেলেছে। জেনে গেছে আনুবিবি ও কাঙাল। এই অপমান সে কোথায় রাখবে? কোথায় রাখবে? ঘরে দোর দিল সে। শাড়ি, চুল সব খুলে ফেলল, কুপি নিভিয়ে দিল। শরীরে আর একটা সুতার স্পর্শ ও রাখবে না সে। কোন কিছুর স্পর্শ তার আর সহ্য হচ্ছে না।
*****
শাহজাহান উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেল আরো। আনুবিবির শরীরের ওম, ঘ্রাণ, তার ব্যাকুলতা, আলিঙ্গনে জড়িয়ে ভীরু পাখির মত আর্তি, এসব তার অনুভবে বারবার সাপের মত ছোবল দিতে লাগল।
এই কামনার দংশনে শাহজাহান আরো উন্মাদ হয়ে গেল। কি করবে সে? ইচ্ছা হল আনুবিবির বাড়ির পাশেই থেকে যায় সে, ভিখারীর মত শুয়ে থাকবে।
আনুবিবির যখন দয়া হবে সে আসবে, স্পর্শ দিবে। সে ধন্য হবে।
তার ভাবনা বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আনুবিবি ওইভাবে চলে গেল কেন? সে কি আঘাত করলো আনুবিবিকে? না, সে ত আঘাত দিতে চায় না। শুধু ভালবাসতে চায়।
শাহজাহানের কষ্ট লাগলো। সে ফেরার পথ ধরলো।
বারবার ফিরে তাকালো আনুবিবির বাড়ির দিকে, অজস্র জোনাকি পোকা নাচছে আশেপাশে, মনে হয়।আগুনের ফুলকিগুলো সব আনুবিবিকে জুড়ে আছে, আনুবিবি অগ্নিকুণ্ড, সে আত্মহত্যা করতে চায় অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে।
একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো পাশ থেকে। শাহজাহান চমকে উঠলো। কুকুরটার চোখ জ্বলছে। পাগলা কুকুর না ত, শাহজাহান সাবধান হল। কুকুরটা আরো কয়েকবার ঘেউ ঘেউ করে দাত মুখ খিঁচিয়ে চলে গেলো। শাহজাহান স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। আচ্ছা, এই কুকুরটা তাকে কামড়ে দিলে কি আনুবিবি দেখতে আসত? তার চোখে কি মায়া থাকত? না থাকত ঘৃণা?পুরো দুনিয়া এখন আনুবিবি হয়ে গেছে তার জন্য, যা দেখে, যা ভাবে সবকিছুই আনুবিবিতে গিয়ে মেশে। কেন এমন হল, শাহজাহান অসহায় বোধ করল। এর পরিণতি কি?
*****
মইন মিয়ার চিঠি এসেছে। সকালে রহিমা চিঠিটা দিয়ে গেল। আনুবিবি কাল সারাদিনের কাহিনীতে বিধ্বস্ত ছিল। আজ সকালেই চিঠির খবরটা সে ঠিক নিতে পারলো না। তার অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো। নিজেকে অপরাধী মনে হল তার, অপবিত্র, কুলটা, নষ্টা সে। যে স্বামী তাকে এত দিয়েছে তার জন্য বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করল না সে? এতদিনের বিরহ ঘুচত ত কিছুদিন পরেই, তার আগে আগেই পা ফসকালো। ছিঃ
অবশ্য এসব অনুভূতির কোন ভিত্তি নেই আর। কোথাও এই কথা গুলোর দাম নাই, কেউ এসব শুনে তাকে ক্ষমা করে দেবে না, সে নিজেকেও নিজে ক্ষমা করতে পারবে না। আনুবিবির চোখে জল আসছিল, সে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলো, বারবার চোখের জল মুছতে লাগলো সে।
প্রিয় আনুবিবি,
আশা করি আমিরকে নিয়া কুশল আছো। আমিও ভাল আছি।
কিছু টাকা পাঠাইলাম, এখন ত ধান উঠার সময়। এই মাস হয়ে যাবে আশা করি। আমি অবগত হইয়াছি গনু মিয়ার কিছু জমি সে বিক্রি করিতে চায়, জমিটা বাজারের লগেই।
গনু মিয়ার ভাইস্তা আমার সাথেই কাজ করে এখানে।
সেই অবগত করিলো। আমি উক্ত জমি কিনিবার আশা পোষণ করিতেছি। তুমি শানুকে লইয়া দামদর করিয়া আমাকে জানাও, আমি টাকা পাঠাইয়া দিব।
সামনের মাসে আসিতে চাহিয়াছিলাম, কিন্ত কাজের কারণে পিছাইতে হইয়াছে।
আমি যত শীঘ্র সম্ভব আসার চেষ্টা করিব।
ভালবাসা নিও। আমিরকে আমার আদরচুম্বন দিও।
ইতি
মোঃ মইন উদ্দীন
চিঠি পড়ে আনুবিবি স্থবির হয়ে বসে রইলো। এ কি হল, মইন মিয়া আসবে না? তার এই খরার নদী এখন আরো রাক্ষসী হয়ে উঠবে যে। খরার নদী জল চায়, জলোচ্ছ্বাস আসছে, বাঁধ ছিল মইন মিয়া, মইন মিয়া সরে গেল আবার। ‘খুব শীঘ্রই আসিতেছি’ কথাটা সে বছরের পর বছর ধরে শুনছে। এই কথার কোন বিশ্বাস নাই। আনুবিবির শরীরে শক্তি রইলো না, তাকে রক্ষা করার আর কেউ রইলো না, শাহজাহান তাকে নিয়েই গেল তাহলে।
-খালাম্মা’ রহিমার কন্ঠে আনুবিবির ধ্যান ভাঙলো।
-বল।
-শানু ভাই আইছে।
আনুবিবির বুক ধ্বক করে উঠলো, জিজ্ঞাসা করবে না ভেবেও বলে বসলো, একলা আইছে?
-না, শাহজাহান ভাই ও আছে লগে।
আনুবিবি নিজেকে সামলে নিল, সে বলল, তুই যা বইতে ক।
আইতেছি আমি।
সে ফোলা চোখে মুখে জল দিল, ভাল একটা শাড়ি পরলো, চুল আচড়ালো ভাল করে, মাথায় কাপড় দিল, কাউকেই তার দুরবস্থা বুঝতে দেয়া যাবে না। শাহজাহানের কাছেও স্বাভাবিক থাকবে সে। যা হয়েছে অন্ধকারে হয়েছে, সে কোন চিঠিও পায় নি, সে কিছু জানে না।
আয়নায় আনুবিবি নিজেকে দেখলো, তারপর নিজেই নিজেকে বললো, কম পোড়ো নাই তুমি৷ সোনা হইছো তুমি পুড়ে পুড়ে।
বাইরের ঘরে গিয়ে দেখলো শানু আর শাহজাহান গল্প করছে। তাদের চা মুড়ি দেয়া হয়েছে। তারা বসে আছে পাটিতে আসন পেতে।
আনুবিবি শাহজাহানের দিকে তাকালো না, সরাসরি শানুকে বলল, কি ভাই? সকাল সকাল আইলা যে।
– হ বইনে, কাল ত দেহা হইলো না, ভাবলাম দেহা কউরা যাই। তুমি যাইবা কইয়া ও আর গেলা না।
– ভাই শরীরটা জুত লাগে নাই। তা আইছো যহন বও, আমি একটু ধানের কাম ডা দেইক্ষা আহি।
আরো মুড়ি নিবা?
– দেও। একটু মরিচ পেঁয়াজ মাখাইয়া দিতে কও, আর চা দিতে কও আরো দুই কাপ।
– আইচ্ছা বহ।
আনুবিবি শাহজাহানের দিকে একবারো তাকালো না, তাড়াতাড়ি ভিতর ঘরে গিয়ে রহিমাকে চা মুড়ি দিতে বলে সে ছুটলো উঠানে।
শাহজাহানের এই অবহেলা গায়ে লাগলো, কাল রাতের কাহিনী কিছুই কি মনে নেই আনুবিবির? কদম পটের বিবি সেজে আসলো, সতী নারী, মাথায় কাপড় দেয়া আর তাকে চিনলো ই না। নারীজাতির প্রতি ঘৃণা চলে আসল তার। এরা সব পারে। রাতে উর্বশী হয়ে এরা সকালে সতী সাজতে পারে। কালনাগিনী!
তার আর কিছুই ভাল লাগছিল না, আনুবিবির বাড়িতে বসে থাকতেও তার রুচিতে বাধছিল, মনে হল এখানে সে অনাকাঙ্ক্ষিত এক কাঙাল, সে আমন্ত্রিত না, অনাহূত।
তার শরীর জ্বলে উঠলো, সে শানুকে বলল, ভাই আমি যামু।
শানু মুড়ি চিবুচ্ছিল নিশ্চিন্তে আর চায়ে সুড়ুৎ সুড়ুৎ চুমুক দিচ্ছিল।
অস্পষ্ট স্বরে বলল, কেন দোস্ত?
– শরীরডা ভাল্লাগে না। ঘরে গিয়া এট্টু শুইয়া থাকমু।
– ত এহানে শুইয়া থাহো, এই বাসায়ই। মোর বুইনের বাসা। চিন্তা নাই ত।
শাহজাহানের প্রস্তাব টা মন্দ লাগলো না, এই সুযোগে আরেকটা চিঠি দেয়া যাবে।
সে অবশ্য মুখে বলল, না কি না কি মনে করে।
-কি মনে করবে? রহিমারে ডাইকা দেই, ও আইসা তোমারে নিয়া যাউক। ও রহিমা!
শাহজাহানের রাগ চলে যায় নি, তবে চিঠি ছাড়া রাগ প্রকাশের উপায়ও নেই। সে আর মানা করলো না। আজ সে কাগজ কলম নিয়েই এসেছে। কাল আমিরের খাতা কলম চুরি করে লিখেছিল। সে রহিমার সাথে ভিতর ঘরে চলে গেল। রহিমা বিছানা ঝেড়ে দিল। সে বিছানায় বসলো।
রহিমা যাচ্ছিল। সে ডাকলো, ও রহিমা।
-জ্বী
– তোমাগো সায়েব আইবে কবে?
– পরের মাসে আওয়ার কতা।
শাহজাহান একটু দমে গেল। মন খারাপ হয়ে গেল তার।
সে রহিমাকে বলল, আচ্ছা যাও।
রহিমা চলে যাবার পর সে উপরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইলো। অবসন্ন লাগছে তার। আনুবিবির শরীরে অন্য কারো হাত সে ভাবতেই পারে না যত রাগ ই হউক৷ এখন আনুবিবি শুধুই তার। আসলেই কি তার? সে কাগজ কলম বের করলো।
আনুবিবি বাইর ঘরে এসে দেখলো শানু একা বসে আছে, তার একটু মন খারাপ হল, বেশি কঠিন হল না ত সে, চলেই গেল।অবশ্য চলে গেছে ভালই হয়েছে- এটা আনুবিবি ভেবে শান্তি পাবার চেষ্টা করলেও খুব শান্তি মিললো না।
সে স্বাভাবিক ভাবে পাটিতে বসতে বসতে বলল, তোমার সংগী কই?
-আছে, শরীর ভাল লাগে না তার তাই শুইতে কইলাম গিয়া ঘরে।
আনুবিবির আবার ধাক্কা লাগলো, শানু ও না, চলে যেতে চাইছিল তাই বলে ঘরে কোলে করে উঠিয়ে রাখতে হবে। সে একটু বিরক্ত হল।
অবশ্য বিরক্তি প্রকাশ করলো না। মাথায় কাপড়টা ভাল ভাবে দিয়ে বলল, তোমার ভাই চিডি দিল আইজ।
শানু মুড়ি চিবুতে চিবুতেই জিজ্ঞাসা করল, কি লিখছে? কবে আইবে?
– আইব না খুব তাত্তারি।
– ও বাবা, কইল না পরের মাসে আইব।
– তা ত কয়েকবার ই কইছে। আনুবিবি মুখ ভার করলো।
– হুম। শানুর কন্ঠে হতাশা।
– তোমার ভাই গনি মিয়ার জমি কেনতে চায়, তোমারে দাম দেখতে কইছে।
– গনি জমি বেচব নাকি?
– হ, বাজারের কাছে নাকি।
– আইচ্ছা দেখমু নে। আমির কই?
– স্কুলে গেছে বুজি।
– পোলাডারে দেইক্ষা হুইন্না রাইখো, কাইল দেখলাম গফুরের লগে ঘুরতাছে।
আনুবিবি চিন্তিত হল, গফুর বাকের মুনশির ছেলে, অত্যন্ত বদ। তাড়ি খেয়ে পড়ে থাকে। এর সাথে আমিরের কী?
– কি করতাছিল?
– কি জানি, গফ সফ। আমারে দেইখা দৌড় দিল।
আনুবিবির কপালে ভাঁজ পড়লো, ছেলেটার খেয়াল খবর আসলেই রাখা হচ্ছে না। নিজেকে একটু অপরাধী ও মন হল তার।
– চিন্তা কইরো না, গফরা রে আমি দেইখা দিমু নে।
– আইচ্ছা, আনুবিবি খুশি হল একটু।
শানু বলল, এইবার তাইলে উডি, উত্তরপাড়া যামু, আইজ সময় পাইলে গনির লগেও কতা কয়া আমু হানে।
-আইচ্ছা।
শানু উঠলো, রহিমাকে ডেকে বলল, শাহজাহানকে ডেকে দিতে। আনুবিবি ভাইকে বিদায় জানিয়ে দ্রুত রান্নাঘরে চলে গেল শাহজাহান আসার আগেই।
আনুবিবি তার ঘরে গিয়ে আবার চিঠি পেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তার জানাই ছিল চিঠি আবার আসবে আজ। ঘরের দোর আটকে চিঠি নিয়ে আরাম করে বসলো সে, হয়ত সে নিয়তি মেনে নিচ্ছে নিজের অজান্তেই।
আনু,
আমার সাথে কথা বললা না কেন তুমি? কথা ত দূর, একটু তাকাইতা।
আমাকে অবহেলা করে কি শান্তি পাও তুমি? তোমার আর অজানা নেই আমি কতটা পাগল।
কাল তোমার স্পর্শ পেয়ে আমি আরো উতলা হয়ে গেছি। এই স্পর্শ আমি বারবার চাই, মরার আগ পর্যন্ত চাই, বেঁচে থাকার জ্বালানি এখন তুমি।
আমাকে মেরে ফেলো না, একটু ভালবাসো, একটু করুণা করো। অনেক কিছুই বলতে চাই, কিন্ত লিখতে বসলে আর পারি না, মনের ব্যথা কি কলম পর্যন্ত আসতে পারে? আমার বুকে হাত দিয়ে দেখো, আমার চোখের দিকে তাকাও, দেখবে কতটা পাগল আমি।
আমাকে কাছে নাও তুমি, আমার প্রিয়া।
আমাকে ভালবাসো, অবহেলা করো না।
ইতি
তোমার মনের জাহানের একমাত্র শাহ
আনুবিবি চিঠি পড়লো, তারপর শুয়ে পড়লো বিছানায় কাটা কলাগাছের মত। এই ঝড় আটকানোর আর উপায় নেই, সে অসহায়। শাহজাহান তাকে দুনিয়াছাড়া কলংকিনী করেই ছাড়বে। আনুবিবির শুকিয়ে থাকা হৃদয়, শরীর সব জেগে উঠতে লাগলো। এই ঝড়ের তান্ডবে সে নিজেকে আস্তে আস্তে বিলিয়ে দিল।
সে এক অসহায় নারী, আর শাহজাহান যেন এক ক্ষুধার্ত বাঘ। এই ক্ষুধার্ত বাঘকে শান্ত করলেই যেন তার ক্ষুধা মিটবে।আনুবিবির শরীর অদ্ভুত সুখে ছেয়ে গেল। এমন অনুভূতি ত তার স্বামী তাকে দিতে পারে নি। এতবার সঙ্গমের পরও ত তার এত ভাল লাগে নি।
নিয়তি তার সাথে কি খেলা খেলছে?
*****
শানু সন্ধায় আবার বাসায় এলো।
অস্থির স্বরে ডাকলো, আনু আপা, ও আনু আপা।
আনুবিবি ছেলের ঘরে ছিল। ছেলের একটু জ্বর জ্বর লাগছে তাই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। শানুর গলা শুনে একটু অবাক হল, রহিমাকে ডেকে আমিরের দিকে নজর রাখতে বলে সে মাথায় কাপড় দিয়ে বের হল।
– কি গো ভাই।
– বইন পানি দাও। শানুকে খুব অস্থির মনে হচ্ছে।
কি হল, আনুবিবি পানি আনতে আনতে ভাবলো, শাহজাহান তাকে কিছু বলল নাকি।
শানুকে এত অস্থির আগে লাগে নি। আনুবিবির বুকে মোচড় দিল। সত্যি যদি এমন হয় তার মান সম্মান থাকবে না।
পানি এনে শানুর হাতে দিল সে। শানু দাওয়ায় পাতা পিড়িতে বসলো পা ছড়িয়ে। গা ঘামছে। পানি খেল শানু, আর আনুবিবি পাশে দাড়িয়ে তাকে নীরবে দেখতে লাগলো।
শানু একটু শান্ত হল। সে আনুবিবির দিকে তাকিয়ে বলল,
দুলাভাই কবে আইবে কইছে?
আনু এই প্রশ্ন আসা করে নি। সে মৃদু স্বরে বলল, কইল আওয়ার চেষ্টা করব যত তাত্তারি পারে।
– অহ। শানু চুপ করে উঠোনের সামনের দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো আবার।
– কি হইছে ভাই? আনুবিবি আতংকিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো।
শানু তার দিকে তাকালো, শানুর চোখে জল।
তাকে কাঁদতে দেখে নি কখনো আনুবিবি, কি হল।
আনুবিবি ভয় পেয়ে গেল, কি হইছে ভাই? সে জোর গলায় বলল আবার।
-দুলাভাই আরেকটা বিয়া করছে বিদেশে।
আনুবিবি চুপ হয়ে রইলো অনেকক্ষণ। শানু ও কোন কথা বলল না।
তারপর আনুবিবি জিজ্ঞাসা করল, কই দিয়া শুনলা?
-গণি মিয়া কইলো, উনার ভাইস্তা ত দুলাভাইর লগে কাম করে।
আনুবিবির শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সে কোনমতে বলল,
কবে করসে বিয়া?
– এক মাস হইছে।
– অহ। উনারা আগে কয় নাই কা আমাগো?
– গণির ভাইস্তা গণিরে চিডি দিসে কয়েকদিন আগে। কথা গোপন রাখতে কইছে। গণি ত আবার পেট পাতলা, কথাবার্তা সুবিধার মনে হয় নাই তাই চাইপা ধরসিলাম, কইয়া দিছে।
– আমারে যে উনি আইজ জমি কেনতে কইলে..
– হ কইসে, ভাবছে গোপন থাকব না, জমি দিয়া খুশি করতে চাইছে।
আনুবিবি দুঃখের হাসি হাসলো, জমি দিয়া কি করবে সে?
শানু বলল, কি করবা এখন?
আনুবিবির চোখ দিয়ে এতক্ষণে পানি পড়লো। আসলেই, কি করবে সে?
শানু আনুবিবির চোখের জল দেখে আর কথা বাড়ালো না, সে নীরব রইলো।
আনুবিবি দাওয়ায় মাটির মেঝেতেই বসে পড়ল। আজ আর কাপড় ময়লা হবার ভয় নাই তার, জীবন ই ধূলায় পড়লো তার, কি আর বাকি আছে। এক বাইরের ছেলে ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করছে, আর স্বামী বিয়ে করছে অন্য নারীকে। কি আর বাকি আছে তার।
শানু আনুবিবির দিকে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ, আনুবিবি নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে, তার দৃষ্টি শূন্য।
*****
পরের সারাদিন আনুবিবি আর কোন কাজ করলো না। রহিমা আর ময়নার মা বাসার সব কাজ করলো। আমির জ্বরে পড়ে রইলো, আনুবিবি তার পাশে বসে রইলো, ছেলে জ্বরে প্রলাপ বকছে, তার মাথায় পানি ঢালছে রহিমা।
আনুবিবির চোখ মুখ কাঁদতে কাঁদতে ফুলে গেছে। সে কোন কথা বলছে না।
রহিমার মাথায় পানি ঢালা শেষ হলে সে বলল, গরম দুধ নিয়া আয় এইবার। দেখি খায় কিনা।
রহিমা দুধ আনতে গেল।
ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো, শব্দ পেয়ে ফিরে তাকালো আনুবিবি, দরজায় তার জায়গীর রাখা তিন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এরা একসাথেই চলে নাকি সারাক্ষণ। অবশ্য এদের খুব একটা দেখা যায় না, তিনজন এক ই ঘরে থাকে, সহজে বের হয় না, আনুবিবি তাদের অস্তিত্ব ই ভুলে যায় মাঝে মাঝে।
আনুবিবি ওদের জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবা?
-না খালাম্মা, বাবুজানকে দেখতে আসছি।
ওদের কন্ঠ অসহায়।
আনুবিবির ভাল লাগলো, তার ছেলেটা নিঃসঙ্গ। এই ছেলেগুলো ভয়েও তার কাছে আসে না, অথচ অসুখ শুনে চলে আসল। ভাবলো ছেলেটা সুস্থ হলে ওদের সাথে মিশতে বলবে, তাছাড়া ছেলেগুলো বোকাসোকা হলেও ভাল।
আনুবিবি উঠলো, তাহলে তোমরা বসো ওর কাছে, রহিমা দুধ নিয়া আসলে খায় কিনা দেখো।
তারা আবার একসাথে মাথা নাড়লো।
আনুবিবি মনে মনে হাসলো, সে বের হয়ে আসল। তার বের হবার তেমন দরকার ছিল না, সে শুধু ছেলেগুলোকে স্বস্তিতে বসতে দিতে চাচ্ছিল। সামনে আনুবিবির কঠিন দিন, ছেলেটার সঙ্গ দরকার হবে, ওরা সহজ হউক। আনুবিবি উঠোনে এসে দাড়ালো, সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে।
অনেকক্ষণ পর একটু ভাল লাগলো তার। আজ চাঁদ আছে।
মইন মিয়া বিয়ে করেছে তাতে তার এখন খুব একটা খারাপ লাগছে না, প্রথমে কষ্ট পেয়েছিল খুব, এখন মনে হল এটাইত স্বাভাবিক, সেও কি শাহজাহানকে দেখে উতলা হয় নি? মানুষের সঙ্গী দরকার, আর কত একা থাকবে বিদেশ বিভুঁইতে? বরং একটা মিথ্যে কাগজি সম্পর্কের দায়ভার বয়ে বেড়িয়ে কষ্ট না পাওয়া ই ভাল। যে সম্পর্কে কোন মনের টান নাই, শরীরের মেলামেশা নাই, সেই সম্পর্ক কি মাসে মাসে কাড়ি কাড়ি টাকা পাঠালেই টিকে থাকবে?
আনুবিবি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার মনে হল, সে আজ মুক্ত। একটা বাদুড় উড়ে গেল মাথার ওপর থেকে। সে বাদুড়টার দিকে প্রসন্ন চোখে তাকালো।
এখন কি শাহজাহানের কাছে যেতে বাধা আছে তার? না হয়ত, বাকিটা সমাজ। সমাজ সে সামলিয়ে নিতে পারবে তাও মনে হচ্ছে এখন। আনুবিবি হাসলো হা হা করে, সে হাসি ভয়াবহ, আকাশ বাতাস ছড়িয়ে পড়ল সে হাসি। রহিমা ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো ভয় পেয়ে। ঘরের খুঁটি ধরে তাকিয়ে রইলো আনুবিবির দিকে। আনুবিবি এইভাবে হাসছে কেন? এভাবে ত দেখে নি কখনো তাকে। শুনেছে ভাইসাহেব বিয়ে করেছে বিদেশে, আনুবিবি কি দুঃখে পাগল হয়ে গেল। আহারে, রহিমা জলভরা চোখে আনুবিবিকে দেখতে লাগলো।
*****
কয়েকটা দিন স্থবির হয়েই কেটে গেল।
আমির জ্বর থেকে উঠলো, তবে দূর্বল। বাবার বিয়ের সংবাদে তাকে অত বিচলিত মনে হল । সে বিছানায় শুয়ে বসে থাকে, আর ছেলে তিনটার সাথে সারাক্ষণ গল্প গুজব করে। সারাক্ষণ আমিরের ঘর থেকে চিৎকার চেচামেচি, হুটোপুটির শব্দ শোনা যায়। আনুবিবি অবাক হয়ে ভাবে, এই শান্ত ছেলেগুলো এত তাণ্ডব করতে পারে তা ত জানা ছিল না। সে অবশ্য খুশিই হয়। ছেলে ভাল আছে দেখলে তার ভাল লাগে।
তবু মাঝে মাঝে দরাজ গলায় হুংকার ছাড়ে, কি রে আমির, কি হইতাছে?
হুটোপুটি থেমে যায়, শব্দ ও থেমে যায়।
আমির ব্যস্ত গলায় বলে, কিছু না মা।
তারপর খিক খিক হাসি।
আনুবিবি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ছেলেটা ভালই দুষ্টু হল। সে জামাকাপড় ধুতে কলঘরে চলে যায়। জামাকাপড়ে সাবান মাখাতে মাখাতে সে ভাবে শাহজাহান কয়েকদিন থেকে আসছে না, শানু ও না।
রাতে শানু আসলো।
উঠানে দাঁড়িয়ে ‘বইনা’ বলে ডাক দিল। আনুবিবি রান্না করছিল। তার মনে হল শাহজাহানও এসেছে। সে প্রায় দৌড়েই গেল। গিয়ে দেখল শানু একা দাঁড়িয়ে আছে। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাথায় কাপড়টা ভাল ভাবে তুলে সে দাঁড়ালো, তারপর শান্ত স্বরে বলল, ভাই আসো।
শানু আসলো, ভিতর ঘরে এসে বসলো।
– কেমন আছ বইনা?
– এই ত ভাল, এই কয়দিন যে আইলা না।
– গ্রামের বাইরে গেছিলাম।
– আইচ্ছা। মুরগী জবাই দিলাম একটা, খাইয়া যাইও। শানু আপত্তি করলো না।
আনুবিবি একটু চুপ থেকে আবার জিজ্ঞাসা করলো, তোমার ভাই এর আর কোন খবর পাইলা?
-হ, সব জানলাম, বিয়া করছে বিদেশী মাইয়া।
আনুবিবি চুপ করে রইলো,
– দুলাভাই কামডা করলো কি? ঘরে এত বড় পোলা, বউ রাইখা, নিয়া যাইত তোমাগো।
– কইসিল কয়েকবার নিয়া যাইব। তা আর হইল না।
– হইল না হইত একদিন। পোলা বড় হইয়া বাপরে কি ভাবব।
– কি আর ভাবব।
শানু উত্তর দিল না।
একটু পর জিজ্ঞাসা করল, গণির জমি কিনবা? কথা কমু?
-তোমার ভাই এর টেলিফোন নাম্বার আছে আমার কাছে, তার লগে একটু কথা কওয়াইয়া দাও আমারে।
শানু বলল, কাইল বাজারের দিকে যাইয়া দেখি।
রহিমা রান্নাঘর থেকে ডাক দিল।
আনুবিবি বলল, রান্না দেইখা আসি, বও।
শানু মাথা নাড়লো।
রান্নাঘরে যেতে রহিমা জিজ্ঞাসা করল, আলু দিবেন না মাংসে?
– হ্যা দিমু। আনুবিবি রহিমার নামিয়ে রাখা আলু ছিলতে শুরু করলো বটি নিয়ে।
– হুনলাম ভাইসাহেব বিদেশী মাইয়া বিয়া করছে।
রহিমা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো।
আনুবিবি আলু ছিলতে ছিলতেই বলল, কই দিয়া হুনলি?
-ময়নার মা কইতেসিল আইজ বিয়ালে।
বাহ, ময়নার মাও তার থেকে বেশি জানে দেখা যাচ্ছে। আনুবিবি নীরবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
-আমিও হুনলাম। সে উত্তর দিল।
রহিমা আবার জিজ্ঞাসা করলো, ভাইসায়েব কি আপনারে তালাক দিব?
আনুবিবির আলু কাটা বন্ধ হয়ে গেল। তালাকের কথা সে আসলেই ভেবে দেখে নি এখনো।
সে রহিমার দিকে তাকিয়ে বলল, এত কথা কস কেন তুই? ডাল নামাইয়া ভিজা।
রহিমা ধমক খেয়ে দ্রুত কাজে গেল।
আনুবিবি ভাবছে শাহজাহানের কথা। কি হল তার? আসছে না কেন। শানুকে জিজ্ঞাসা করতেও সংকোচ হচ্ছে। কার কাছে জিজ্ঞাসা করবে সে তার কথা? এত নিষিদ্ধ গোপনীয়তায় নিজের হাহাকার সামান্য উগড়ে দেবার মত ও জায়গা নেই তার। আনুবিবি ভাবলো, সে অসহায়, খুব অসহায়। বটিতে লেগে বেখেয়ালে তার হাত কেটে গেল, রক্ত পড়তে শুরু করলো অনেক।
রহিমা ‘ করছেন কি’ বলে অস্থির হয়ে গেল।
আনুবিবি হাত চেপে বলল, তুই আলু কাট, আমি আইতেছি।
রহিমা বটি নিয়ে নেল। আনুবিবির চলে যাওয়া দেখলো। মানুষটা আসলেই খুব কষ্টে আছে।
*****
আনুবিবির দিন এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল। সে শাহজাহানের আশা ও ছেড়ে দিয়েছে।। মইন মিয়ার সাথে টেলিফোনে কথাও হয় নি। শানু বাজারে খবর নিয়ে দেখলো যে একটা টেলিফোন ছিল তা নষ্ট। মইন মিয়াকে একটা চিঠি লিখবে ভাবলো সে। কিন্ত কি লিখবে, কোন ভাষা নাই তার। মইনের সাথে রাগ করে বা অভিযোগ দিয়ে কোন কথা বলে নি সে কখনো। কোন প্রশ্নের মুখে ফেলার দরকারও হয় নি কখনো তাকে, আজ সব পুরোনো অভ্যাস ছুড়ে ফেলে দিতে হচ্ছে, পরম আনুগত্যের জায়গায় ও প্রশ্ন করতে হচ্ছে।
অথচ প্রশ্ন করেও বা কি হবে। বরং মেনে নিয়েই একটা চিঠি লেখা যাক, তালাকপ্রাপ্তা হলে ছেলেকে নিয়ে কই যাবে সে, এখন সংসার ত বাঁচাতেই হবে। অন্য কোথাও বিয়ের চিন্তা আনুবিবি করে নি, শাহজাহানের সাথেও না কখনো, এমন উড়নচণ্ডি খেয়ালি ছেলেকে ভরসা করার মানে হয় না
আনুবিবি লিখল,
প্রিয় স্বামী,
আশা করি ভাল আছেন। আমিও আমির কে নিয়ে আল্লাহর রহমতে ভাল আছি। গণি মিয়ার সাথে জমি কেনা নিয়ে কথা চলছে। খুব শীঘ্রই আপনাকে বিস্তারিত জানাইব।
আমির আপনাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছে খুব, যদি অতি শীঘ্রই আসার ব্যবস্থা করতে পারেন, ভাল হয়।
ইতি।
আনুবিবি
আনুবিবি আমিরের কথাটা মিথ্যে লিখল, মইন মিয়ার জীবনে তার গুরুত্ব কতটুকু এখন সে জানে না, তবে আমিরের গুরত্ব আছে অবশ্যই। যেন মইনকে সেটাই মনে করিয়ে দিতে চাইল সে। আমিরই তার ভরসা এখন এই অকূল সমুদ্রে। চিঠিটা খামে ভরে পোস্ট করতে পাঠিয়ে দিল সে। তারপর বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগলো।
শাহজাহান একদিন এলো। উস্কো খুস্কো চুল, দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত, শানুর সাথেই এলো। আনুবিবি তাকিয়ে দেখলো, অনেকটা শুকিয়েও গেছে।
রহিমা তাদের উঠানে পাটি পেতে দিল, সেখানেই বসলো তারা। আনুবিবি কি বলবে ভেবে পেল না, সে ঠিক শাহজাহানকে প্রত্যাশা করে নি।
সে শানুর দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই গণি মিয়ার লগে কথা কদ্দুর?
– ৫০ হাজারের নিচে দিব না কইছে।
– ওমা এত দাম।
– হ বাজারের জমি, আরো দাম হইব।
আমি কই কিন্না লও। কয়েক বছর পর বেচলে তিন চার গুণ পাবা। শানুর কথায় ভরসা আছে আনুবিবির।
সে বলল, দেখি।
তারপর শাহজাহানের দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল, আপনার কি হইসিল?
শাহজাহান তার দিকেই তাকিয়েছিল, আনুবিবি যেচে পড়ে কথা বলবে ভাবে নি, সে অবাক হল, তার মুখ থেকে কথা বের হল না।
শানু উত্তর দিল, বাড়ি গেছিল, বাড়ি ত কুমিল্লা, মেলা দূর, অসুস্থ হইয়া পড়সিল গিয়া।
-ওহ।
আনুবিবি আবার শাহজাহানের দিকে তাকালো, সে দৃষ্টি খুবই স্বাভাবিক। শাহজাহানের দিকে তাকিয়ে তার ভয় হল, মনে হল শাহজাহান এখানেই কিছু একটা করে ফেলবে, বলে ফেলবে,
সে তাড়াতাড়ি শানুকে বলল, তোমাগো চা দিতে কই। আর কিছু খাইবা?
-নাহ, বাতাসে বইসা ভালই লাগতেসে। চা-ই দাও।
– আইচ্ছা।
আনুবিবি প্রায় দৌড়েই ঘরে চলে গেল।
*****
রাতে আনুবিবি তার ঘরে ঢুকে দেখলো শাহজাহান বসে আছে।
তার মুখ থেকে কথা সরলো না অনেকক্ষণ, সম্বিত ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে দোর দিল সে।
তারপর চাপা স্বরে গর্জন করে বলল, এইহানে কেন আইছো?
-কেন আইছি জানো না? শাহজাহান বিছানা থেকে ইঠে আনুবিবির দিকে এগিয়ে এলো।
আনুবিবি ভয় পেয়ে সরতে লাগলো, আর জিজ্ঞাসা করল, কেউ দেখে নাই?
– না, ভয় নাই, শাহজাহান হাসলো।
– আমি যার কাছে ধরা পড়ি, ইচ্ছা করেই পড়ি, আমি না চাইলে কেউ আমারে ধরতে পারবে না
শাহজাহানের দৃষ্টি রহস্যময়।
আনুবিবি এইবার স্থির হয়ে দাড়ালো। তারপর বলল, এইসব পাগলামি কইরো না, যাও এখন। আমি বাইরে গিয়া দেখতাছি কেউ আছে কিনা।
শাহজাহান পাগল হয়ে গেল এত স্থির বুদ্ধির কথা শুনে, এসব সে শুনতে আসে নি। সে আনুবিবির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, মুখ চেপে ধরলো।
তারপর কানে কানে বলল, আর পালাইও না।
আনুবিবি ভয় পেয়ে গেছিল, সে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো। শাহজাহান আনুবিবির বুকে হাত দিল, আনুবিবি শিহরিয়ে উঠলো। সেই রাতে তাদের অঘোষিত বাসর হল। গভীর অমাবস্যার রাত।
প্রথম বাসরের মতই দ্বিতীয় বাসরেও আনুবিবি তাড়াতাড়ি উঠলো।
তার শরীর এক অনন্য সুখে ছেয়ে আছে। বিগত অনেকদিনের দুঃখ যেন মুছে গেল নিমিষেই। সে মৃদু হাসি মুখে নিয়ে ঘুমন্ত শাহজাহানের দিকে তাকালো।
‘পাগল একটা’ অবশ্য পাগলামি না করলে ত মিলনও হত না।
আনুবিবি এইবার মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসলো। তার শরীর বারবার কেপে উঠতে লাগলো। এত হাসি কেন পাচ্ছে। শাহজাহান চাপা হাসির শব্দ শুনে জেগে উঠলো, চোখ মেলে আনুবিবির দিকে অবাক চোখে তাকালো। তারপর আনুবিবিকে কাছে টেনে নিল। বুকের ওপর শোয়ালো।
– খুব আনন্দ না?
– হুঁ। আনুবিবি আবার হাসলো।
শাহজাহান আনুবিবির মুখ তুলে চুমু খেল। তারপর বলল,
– কত কষ্ট পাইছি জানো?
– না জানি না, আনুবিবি শাহজাহানের বুকে মুখ লুকালো।
– তা জানবা কেন? নারীজাতি কালনাগিনী।
– ও তাই? আনুবিবি মুখ তুলল আবার। তার মুখ ভার।
– হু।
শাহজাহান এইবার উঠলো। আনুবিবিকে নিচে শুইয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
তারপর বলল, তুমি অনেক সুন্দর।
– ইশ।
– আসলেই। আমি প্রথম দিনেই পাগল হইছি।
– তুমি এম্নেই পাগল। আনুবিবি কিশোরী মেয়েদের মত হাসলো।
– হুম তোমার জন্য।
আনুবিবি শাহজাহানকে বুকের কাছে টেনে নিল। তারপর স্তন উন্মুক্ত করে দিল।
রহস্যময় স্বরে বলল, নাও।
শাহজাহান আনুবিবির বুকে মুখ গুঁজলো।
*****
এইভাবেই দিন গুলো কেটে যাচ্ছিল। আনুবিবির গোপন প্রেমের রাসলীলাও ভাল চলছি। মইন মিয়াও জমি কিনতে টাকা পাঠালো। সে জমি কিনলো, আগের মতই বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতে লাগলো, প্রেমও চলছে ভালই। কেউ টের পায় নাই। তবে রহিমা একদিন তাদের দুইজনকে দেখে ফেলল,
শাহজাহান ঘরে ঢুকলো, আনুবিবি দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল, তারপর তারা একজন আরেকজনকে আদর দিয়ে দিয়ে পাগল করে ফেলছিল ঘরের মাঝে দাড়িয়েই।
রহিমা ‘খালাম্মা, ময়নার মা কইসিল… ‘ বলে ঢুকতেই তাদের এই অবস্থায় দেখে ফেলল।
আনুবিবি আর শাহজাহান ছিটকে দুইপাশে সরে গেল। রহিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। আনুবিবি ছুটলো পিছনে। শাহজাহান স্থানু হয়ে দাড়িয়ে রইলো।
রহিমা ছুটে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল, আনুবিবি ধরে ফেলল তাকে।
-কি হইছে তোর? পাগলামি করিস না।
রহিমা দাঁড়ালো, তার মুখে লজ্জা। সে মাথা নিচু করে রইলো।
-শোন, তোর যত টাকা লাগে আমি দিব। তোর জামদানি কেনার শখ আমারে কইছিলি না?
রহিমা চুপ করে রইলো।
-আমি জামদানি আনানোর ব্যবস্থা করমু। তুই কিছু দেখিস নাই, ঠিকাছে?
রহিমা একটু চুপ করে থেকে মাথা নাড়লো।
আনুবিবি এইবার চাপা স্বরে বলল, কেউ যেন না জানে, ময়নার মা ও না। আমি কিন্ত মাইরা ফেলমু তোরে কইলাম।
রহিমা ভয় পেয়ে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করলো।
আনুবিবি শান্ত স্বরে বলল, যা এখন।
– আমির রে রাইতে দুধ দিছিস?
– হুঁ।
– যা বলছি মনে থাকবে?
– হ।
রহিমা চলে গেল। আনুবিবি ফিরে দেখলো শাহজাহান মুখ ভার করে বসে আছে। সে শাহজাহানকে জড়িয়ে ধরলো গিয়ে।
*****
আমেনাকে কি মনে আছে আপনাদের?
আমেনা একদিন আনুবিবির বাড়িতে এলো। সাথে তার মেয়ে, নিশি। নিশি বেশ বড় হয়েছে। ১৭ বছরের সুন্দরী কিশোরী সে। আনুবিবি আমেনাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
আমেনাও কাঁদল অনেক। অনেকদিন পর দেখা হল, নিশি তার খালাকে বড় হবার পর আর দেখে নি, সে অবাক হয়ে দুইবোনের কান্নাকাটি দেখতে লাগলো।
আবেগের উচ্ছ্বাস শান্ত হলে আনুবিবি বোনকে বলল, বইনা, মুরগি জবাই দেই গিয়া। বসো, তোমরা।
আমেনা বোনকে ধরে বসলো, খাওন পরে।
-কি খবর ক।
আনুবিবি চুপ করে রইলো।
আমেনা বলল, বেডাইনে কি করছে তা ত জানি। ছি ছি বুড়া বয়সে আইসা…
আনুবিবির গায়ে লাগলো কথাটা, কেন লাগলো তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
– কি আর করমু, কপাল। আনুবিবি দুঃখিত গলায় বলল।
– হ কি আর করবি৷ আমেনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল
– পোলা কই তোর?
– খেলতে গেছে মনে হয় বাইরে। বজলু ভাই কেমন আছে?
আমেনা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, আর জিগাইস না।
-ওমা কেন?
পাগল ছাগলের কতা আর কি কমু। ঘরে এক ফহির উডাইসে আইন্না। হে দুইবেলা খায়, সারাদিন চিল্লায় কি কি সব কইয়া।
আনুবিবি হাসলো, আমেনার মত এত সুন্দর সংসার ত তার কখনো হল না। তার চোখে হঠাৎ ই জল আসলো।
সে নিশির দিকে তাকালো, কিগো মাইয়া এত বড় হইছো?
নিশি লজ্জা পেয়ে মায়ের দিকে তাকালো।
নিশির মা তার দিকে তাকিয়ে সন্তষ্ট গলায় বললেন, হা, মেট্টিক পরীক্ষা দিল এইবার। বিয়া দিতে চাই।
আনুবিবি নিশির দিকে দেখলো, আনুবিবির দাদিজানের চেহারা পেয়েছে মেয়েটা, সেই দেবী প্রতিমার মত মুখ, কোঁকড়া চুল।
-মাইয়া ত সুন্দর হইছে, বিয়া দিতে কষ্ট হইব না।
– আর কষ্ট। জানস ই ত অতি বড় সুন্দরী পায় না বর, অতি বড় ঘরণী পায় না ঘর।
আনুবিবি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কথাটা সত্যি, তারই ত সেটা হল।
দেখতে রূপে, গুণে সে আমেনার থেকে কম ছিল না, তাও কপালে কি আর সংসার স্বামী সুখ রইলো, টাকাপয়সা দিয়ে মেয়ে মানুষের কি সুখ হয়? আমেনা আনুবিবির দুঃখ বুঝতে পারলো।
সে বলল, পাকঘরে চল, কি রান্না করতে হইব আমারে দেহাইয়া দে। আমি রানমু আইজ।
নিশির দিকে তাকিয়ে বলল, গোসল কইরা নে গিয়া।
আনুবিবি রহিমাকে ডেকে নিশিকে নিয়ে যেতে বলল।
নিশির খালার বাড়িতে এসে ভালই লাগছে। রহিমা সারাক্ষণ তার সাথে বক বক করে, ভালই লাগে তার। রহিমা তাকে ‘আফা’ বলে ডাকে।
গোসল করার সময় সে রহিমাকে বলল, পিঠটা একটু মাইজা দাও।
রহিমা পিঠ মাজতে গিয়া বলল, আফার পিঠ এত সোন্দর।
নিশি লজ্জা পেল।
রহিমা একটু আনমনা হয়ে বলল, আমার মায়ের পিঠও এমন সোন্দর আছিল। তয় অনেক খাউজানি হইত, আমারে খালি খাউয়াজাইয়া দেতে কইতে।
নিশি চুপ করে শুনতে লাগলো, রহিমা ভাল পিঠ মাজে, তার আরাম লাগছে।
রহিমা একটু খুশি হয়ে বলল, আফা ঘাড়ডা বানাইয়া দেই।
-দেও।
নিশি আরামে চোখ মুদলো, ঘাড়মর্দন শেষ হলে রহিমা তার গায়ে পানি ঢাললো।
একটু চুপ থেকে বলল, খালাম্মারে কয়দিন পর দেখলেন?
-মেলা দিন। নিশি উত্তর দিল।
অনেক ছোট থাকতে দেখছি।
রহিমা অদ্ভুত ভাবে চুপ হয়ে গেল। নিশি বলল, পিঠ আবার মাজো।
রহিমা দ্রুত পিঠ মেজে দিতে লাগলো।
নিশি বলল, উহ আস্তে।
বিকাল বেলা নিশি দেখলো তার খালার বাসায় দুইটা লোক এসেছে।
একজন একটু বয়স্ক, আরেকজন ছোকড়া জোয়ান। সে দাওয়ায় বসে রুমাল সেলাই করছিল, এটা তার শখের রুমাল, ইদানিং যেখানে যায় সেখানেই সুই সুতা নিয়ে বসে পড়ে রুমাল নিয়ে।
বয়স্ক লোকটা উঠানে দাঁড়িয়ে তাকে বলল, ও মাগো, বাড়িতে কেউ থাকলে ডাইকা দাও।
নিশি রুমাল রেখে কড়া গলায় বলল, আপনারে ডাইকা দিমু কেন? কে আপনি?
বয়স্ক লোকটা হাসলো, পাশের জোয়ান ছেলেটাও হাসছে দেখা যাচ্ছে। সে একটু লজ্জা পেল। দৌড়ে ঘরে চলে গেল। খালার ঘরে মা আর খালা বসেছিল। তাদের গিয়ে বলল, কে যেন আইছে।
আনুবিবি ব্যস্ত হয়ে উঠলো, কে আইছে?
-দুইজন লোক।
আনুবিবি বুঝতে পারলো, সে আমেনাকে বলল, আমার যে মেম্বার ভাই এর কতা কইছিলাম ও আইছে। চলো, কথা কইবা।
নিশির একটু লজ্জা করছিল। সে ঘরেই রইলো। মা আর খালা চলে গেল বাইরে।
আনুবিবি আর শাহজাহানের আজ অভিসার হল ঘরের পিছনের বাগানের আড়াল জায়গায়। আনুবিবি একটা কুপি নিয়ে এসেছিল। সেটা সে আড়াল করে রাখলো যেন বাইরে থেকে কিছু দেখা না যায়।
শাহজাহান তার একটু দূরে দাড়িয়েছিল। তারপর বিরক্ত স্বরে বলল, তোমার বইন কবে যাইবে?
আনুবিবি রাগ করলো, আইজই আইলো, আর তুমি যাওয়ার দিন গুনো।
– কেন গুনমু না? আমি তোমারে ছাড়া থাকতে পারমু না।
– আমারে ছাড়া থাকতে হইব কেন? আনুবিবি এগিয়ে গেল শাহজাহানের দিকে। ‘আইছি ত কাছে’
শাহজাহান তাকে ধরে বলল, এইভাবে না।
আনুবিবি তার গলা ধরে আদুরে গলায় বলল, কয়েকটা দিনই ত। অপেক্ষা করো।
– না পারমু না, বলে শাহজাহান তার গলায় দাত বসিয়ে দিল।
– উহ, রাক্ষস। আনুবিবি চাপা আর্তনাদ করে উঠলো।
শাহজাহান তাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরলো।
আদরের উচ্ছ্বাস শেষ হলে আনুবিবি বলল, যাই।
শাহজাহান বলল, কই যাও?
-ওমা ঘরে যাই।
বইন বইসা আছে।
-না আইজ সারারাইত এহানে থাকবা।
ইশ, শাহজাহানের বুকে আলতো কিল দিল আনুবিবি।
শাহজাহান মন খারাপ করে বলল, আমার কোন দাম নাই।
আনুবিবি হাসলো, তারপর বলল, হু একদম নাই।
তারপর শাহজাহানের গালে চুমু দিয়ে কুপিটা নিয়ে চলে গেল দ্রুত।
নিশি একটু অবাক।
শানু চাচার সাথে যে শাহজাহান নামের ছেলেটা আসে সে তার দিকে কিভাবে যেন তাকায়। কেমন একটা লোভী দৃষ্টি, নিশির শরীর শির শির করে ওঠে, তার উঠতি বয়স, এই অনুভূতি তার কাছে নতুন। তবুও সে ভয় পায়, অনেক ভয় পায়, তারা আসলে লুকিয়ে থাকে।
শানু একদিন কথার মধ্যে ডাকলো, কি গো নিশি মা কই।
নিশি ঘর থেকে শুনলো, বাইরের ঘরে তারা সবাই জটলা করে বসেছে, তার মাও আছে, তবু তার যেতে ইচ্ছা হল না।
আমেনা ডাকলো, কি রে, নিশি, কই? আয় এইদিকে।
নিশি অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেল। পাটিতে মায়ের পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসলো।
শানু তার দিকে তাকাইয়া হৃষ্ট গলায় বলল, মাইয়া ত মাশাল্লাহ বড় হইছে। বিয়া দিবা না?
আমেনা বলল, পোলা খুইজা দাও। পাইলে ত দিয়াই দেই।
শানু হাহা করে হেসে বলল, আমাগো শাহজাহানরে পছন্দ হয় তোমার?
আমেনা একটু অবাক হল, এইভাবে ঠাস করে বলাটা ঠিক নিতে পারলো না, আর মনে মনে শাহজাহানকে নিশির জন্য সে অল্প স্বল্প পছন্দও করেছে। তবে পছন্দের কথা আলোয় চলে আসলে যে অস্বস্তি হয় সেটা হল।
আমেনা বলল, যা কপালে আছে তা হইবে।
সে শাহজাহানের দিকে তাকালো, শাহজাহান মাথা নিচু করে আছে, আর শানু স্বভাব সুলভ দুষ্ট হাসি দিয়ে যাচ্ছে হাহা করে। নিশি লজ্জায় একদম নুয়ে গেল। তবে কেউ খেয়াল করলো না আনুবিবির চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে, সে অনেকটা কাঁপছিলও।
তবু সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হ, খারাপ হয় না কিন্ত।
শানু বলল, আমিও তাই কই।
নিশি উঠে দৌড়ে চলে গেল, শানু আবার হাহা করে হাসলো।
*****
রাতের অভিসারে আনুবিবি আজ রাগলো।
সে ফোঁস ফোঁস করে বলল, নিশিরে বিয়া করতে মনে চায় নাকি?
শাহজাহান কইল, হ চায় ত, খালা ভাগ্নি দুইজনরেই একলগে.. শাহজাহান খিক খিক করে হাসলো।
আনুবিবির গা রি রি করে উঠলো ঘৃণায়। সে শাহজাহানকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। শাহজাহান এই ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিল না, সে পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে বসে পড়লো মাটিতে, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-এত রাগ কেন সুন্দরী?
আনুবিবি রাগে কাঁপছিল, সে বলল, যতদিন নিশি আছে অতদিন এই বাড়িতে আইবা না।
– তোমারে না দেইখা থাকমু কেম্নে? মইরা ই ত যামু।
– আমারে দেখবা, না নিশিরে দেখার ইচ্ছা?
শাহজাহান আবার হাসলো, সে এবার বলল,
আনু, তুমি খুব পাগল, আমি ত তোমারেই ভাল পাই, আর নিশিরে আমি কি বিয়া করমু, কথা ত শানু উঠাইলো।
আনুবিবিও মাটিতে বসে পড়লো অসহায়ের মত, তারপর বলল, আমারে কষ্ট দিও না।
শাহজাহান আনুবিবিকে বুকে টেনে নিল, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, আমারে বিশ্বাস করো না তুমি?
– করি।
– তাইলে আদর কইরা দাও।
আনুবিবি শাহজাহানকে পাগলের মত চুমু খেতে লাগলো।
শাহজাহান আনুবিবির চুল ধরে তাকে সরিয়ে দিল। আনুবিবি অবাক হয়ে দেখলো।
তারপর শাহজাহান তাকে বলল, আমি অন্য কাউরে বিয়া করলে কষ্ট পাইবা অনেক?
আনুবিবি এই সময়ে এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না, তাহলে কি তার আশংকা ই সত্যি।
আনুবিবি বললো, কারে বিয়া করতে চাও?
শাহজাহান সোজা ভাষায় উত্তর দিল, নিশিরে।
*****
নিশির আশেপাশের আবহাওয়া অন্য রকম লাগছে। সবাই তার সাথে এমন করছে কেন? খালা তাকে দেখলেই শক্ত হয়ে যাচ্ছে, কথা বলছে না, রহিমাও এড়িয়ে চলছে, আর আমেনা তাকে বলছে, বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে। আশ্চর্য, সে এখন কি বিয়ে করবে, সে কলেজে পড়তে চায়।
নিশি রাগ করে বলল, আমি বিয়া করমু না।
আমেনা খিচিয়ে উঠলো, কেন করবি না হারামজাদী?
নিশি এইবার ভাল যুক্তি পেল, সে বলল, আব্বারে না জানাইয়া, বাড়ির কাউরে না জানাইয়া তুমি আমারে বিয়া দিতে চাইতেছো কেন?
আমেনা বলল, তোর বাবা আধাপাগল, তার উপরে আমার ভরসা নাই। আর আমি তোরে তাড়াতাড়ি পার করতে চাই, সে চায় না। বয়স হইয়া গেলে বিয়া দিতে কষ্ট।
আমেনা কৈফিয়ত দেবার সুরেই কথা গুলো বলল, নিশির কথাগুলো ভাল লাগলো না, মা তাকে এই বাড়িতে নিয়েই এলো বিয়ে দেবার জন্য? জানলে সে কখনো আসত না, আর তার শাহজাহানকে ভাল ও লাগে না। কেমন লোভী দৃষ্টি। সে রাগ করে চলে গেল, গিয়ে বসে রইলো বাড়ির পিছনের আমগাছের নিচে। কতক্ষণ কেটে গেল জানে না, আশেপাশে পাখি কিচিরমিচির করছে, দু একটা দোয়েল এসে মাঝে মাঝে পাশে বসছে, নিশি হাত বাড়ালেই উড়ে যাচ্ছে।
আমের গাছে মুকুল ধরেছে, মুকুলের মন মাতানো ঘ্রাণ, গ্রীষ্মের আগমনী হাওয়া, নিশির মনে হল এভাবেই কেটে যাক দিন।
‘নিশি’ নাম শুনে নিশি ফিরে তাকালো, শাহজাহান দাড়িয়ে আছে, সে ভয় পেয়ে উঠে দাড়ালো,
শাহজাহান তার দিকে তাকিয়ে হাসলো, বলল, কিসের ভয় তোমার? নিশি কথা বলল না, তার চোখ মুখ নীল হয়ে গেল। শাহজাহান একটু অপ্রস্তুত হল।
সে বলল, আমাকে এত ভয় পাওয়ার কিছু নাই ত।
নিশি মাথা নাড়লো।
শাহজাহান দেখলো মেয়েটা নীল রং এর একটা ফ্রক পড়েছে, নিচে পাজামা, ফ্রকের বুকের ওপরে ঝালর দেয়া, বাচ্চা একটা মেয়ে, অথচ কত আবেদনই না এই কচি পাতায় লুকিয়ে আছে৷ শাহজাহান এগিয়ে গিয়ে নিশির হাত ধরলো, নিশি ভয়ে জমে রইলো। একটু কাছে টানলো তাকে শাহজাহান, নিশি কথা বললো না। নিশির মুখটা তুলে চুমু দিতে গেল শাহজাহান।
তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে তারা দুইজন দুইদিকে ছিটকে গেল।
পিছনে আনুবিবি দাঁড়িয়ে আছে।
নিশি দৌড়ে পালিয়ে গেল। শাহজাহান আনুবিবির দিকে তাকিয়ে স্থির রইলো। আনুবিবি গিয়ে চড় বসিয়ে দিল শাহজাহানের গালে।
তারপর বলল, লম্পট এই বাড়িতে আর আসবি না।
আমেনা নিশির মুখ থেকে এই কাহিনী শুনে জমে রইলো।
সে কোন কথাই বললো না। আনুবিবি ঘরে আসলো, সে কাঁপছিল। কোন ভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে সে বসে পড়লো, আমেনা পাশে চুপ করে বসে রইলো।
একটু পর আনুবিবি বলল, ওরে শাহজাহানের সাথে বিয়া দিয়া দাও।
আমেনা বলল, না।
– কেন?
– এই ছেলের চরিত্র ভাল না। মাইয়া আমার পানিতে পড়ে নাই।
আনুবিবি একটু চুপ থেকে বলল, ওরে শাহজাহানের ভাল লাগছে বলেই হয়ত এমন করছে, বিয়া দিয়া দাও।
আমার কাছেই থাকব ওরা।
– তোর কাছে থাকব কেন?
– শাহজাহানের এখানে ভাল কোন থাকার জায়গা নাই, সে শানুর লগে থাকে।
বাড়ি কুমিল্লা, অতদূর যাইব মাইয়া।
আমেনা তবুও গোঁ ধরে রইলো, তার আর ভাল লাগছে না কিছু। বিয়ের কথা তুলে সেই ছেলেটাকে সাহস দিয়েছে সে মানে। তাই বলে মেয়েকে একা পেয়ে ব্যাপারটা সে মানতে পারছে না।
আমেনা বলল, আমি বাড়ি যামু, কাইল ই যামু, তোর এইসব নাটক আমার ভাল্লাগে না।
আনুবিবি চুপ করে রইলো।
যত যাই হউক সে শাহজাহানকে ভালবাসে, তাদের বিয়ে করাও সম্ভব না, নিশির সাথে একটা সম্বন্ধ হলে যাই হউক আজীবনের জন্য একটা আত্মীয়তা হবে, কাছেও পাওয়া যাবে কালেভদ্রে।
যদিও শাহজাহানের নিশির প্রতি অনুরক্তি তার ভাল লাগছে না, কিন্ত শাহজাহানকে পুরোপুরি ছেড়ে দিতেও তার ভাল লাগছে না। তার জীবনের একমাত্র প্রেমিক, একমাত্র ভাল লাগার সাথী শাহজাহান। স্বামী তার শরীর ছাড়া কখনো কিছু চিনে নি, চেনার চেষ্টা ও করে নি। এই প্রেম সে আর কোথায় পাবে, সে ত বড় একা। এইগুলোই ভাবছিল আনুবিবি। সে ভাবলো, বিয়ে এবার করিয়েই ছাড়বে। সে আমেনাকে ধরে পড়লো,
– বুবু, এই কাহিনী বাইরে যাবে, নিশির মান ইজ্জতের কথা ভাবো।
– কি ভাবমু? মাইয়া আমি গ্রামে নিয়া বিয়া দিয়া দিমু৷ কেউ জানব না।
– তোমার কি মনে হয় শাহজাহান ছাইড়া দিবে? সে এই মাইয়ার পিছা করবে না? আনুবিবি কপট ভয় দেখালো।
আমেনা এইবার একটু বিচলিত হল।।
-মাইয়া আমি পানিতে ফেলমু না, পোলার স্বভাব আগো বজলু মিয়ার মতই লাগতাছে। এক বজলু মিয়ার সংসার কইরা আমার অন্তর কালি, মাইয়ারে আমি জাইনা শুইনা পানিতে ফেলমু না।
আনুবিবি ভাবল, পানিতে তোমার ফেলতেই হবে, বোনের সুখের কথাও একবার ভাইবো। সে মুখে কিছু বলল না।
তবে বললো, মান ইজ্জত বড় ব্যাপার, মাইয়া সুখে না অসুখে এইটা না, আর তাছাড়া আমি শাহজাহানরে চিনি। ও এমন কারো লগে করে নাই।
আমেনা চুপ করে রইলো, আনুবিবি প্রবল অপেক্ষা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
একটু পর বলল, বজলু মিয়ারে জানাই তাইলে।
-না, তারে তুমি কি জানাবা? মাইয়ার ইজ্জত হরণ হইছে এইডা? নাইলে কেন বিয়া দিতাসো?
আমেনা দমে গেল। মেয়েকে সে নিজ ইচ্ছায় পার করতেই নিয়ে এসেছিল। আজ মনে হল মেয়ে না চাইতেই কত দূরে চলে গেল। এত তাড়ার কোন দরকার ছিল না। তার চোখে জল এলো।
আনুবিবি ব্যথিত স্বরে বলল, কাইন্দো না। আমি বিয়ার ব্যবস্থা করি।
আমেনা চুপ রইল।
*****
এক শুক্রবারে শাহজাহান আর নিশির বিয়ে হয়ে গেল।
আনুবিবি বিয়ের সব আয়োজন নিজ হাতে করলো, বিয়েতে খেতে আসা সব মানুষজনকে যত্ন করে খাওয়ালো নিজে তদারকি করে, মাঝে মাঝে রহিমার দিকে চোখ পড়ছিল তার, রহিমা অবাক হয়ে তাকে দেখছিল আবার চোখ পড়তেই সরিয়ে নিচ্ছিল।
অতিথিরা যখন চলে গেল গভীর রাত।
আনুবিবি রহিমা আর ময়নার হাতে বাকি কাজ গুলোর ভার দিয়ে ঘরে এসে দোর দিল।
তারপর শুরু করলো কান্না, তার ইচ্ছা হল চিৎকার করে কাঁদবে। কিন্ত ঘরে অনেকেই আছে, বোনের মেয়ের বিয়ের দিন কান্না মানায় না, কোন সমীকরণেই না।
আনুবিবি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলো। মাঝে মাঝে ফুপিয়ে উঠলো, তার জীবনটা এত কষ্টের কেন লিখে আনলো সে? গিয়েছে স্বামী বিদেশে ভাল কথা, প্রেমে পড়তে হল কেন তার? এখন সেই প্রেমিকের সাথে বোনের মেয়ের বিয়েও দিল সে, তার আর কি কি করতে হবে এই জীবনে?
শাহজাহানকে খুব খুশি ই মনে হল, এমন একটা লম্পট পুরুষকে ভালবাসার দাম এইভাবেই দিতে হয় আসলে? কেন সে নিশির জন্য পাগল হল? সে এড়িয়ে যেতে পারত না? না কচি মেয়ে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারলো না। হ্যা, ঠিক আছে আনুবিবি অনুরোধ করেছে, অনুরোধ ফেলতেও তো পারত।
তা তো করলো না, নিশির সাথে ধরা খাওয়ার পর চড় খেয়ে চলে গেল, অপমানবোধ নেই? ঠিকই আসলো বিয়ে করতে। রাগ, ঘৃণা, অনুশোচনা, যন্ত্রণায় আনুবিবির গা জ্বলতে লাগলো। সে বিছানায় শুয়ে পড়লো, বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। ঘরের দোরে আঘাত পড়লো, আমেনার কন্ঠ শোনা গেল। আনুবিবি তাড়াতাড়ি চোখ মুছে উঠলো, দোর খুলে দিল।
আমেনাও কাদছে, সে কাঁদছে অবশ্য মেয়ের দুঃখে।
আনুবিবি আমেনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলো না, দোর খুলে দিয়ে এসে বিছানার এক পাশে শূন্য চোখে বসে রইলো। আমেনা আনুবিবির থেকে একটু দূরে বসলো।
তারপর বলল, এইডা কি ঠিক হইল? তোর ভাইজান আমারে কি কইবে?
আনুবিবি এইবার জ্বলে উঠলো, কেন? সোনার টুকরা পোলা দেইখা ত মাইয়া তখনি পার কইরা দিতে চাইছো, এখন আবার এসব কও কেন।
আমেনা চুপ রইলো ধমক খেয়ে।
আনুবিবি এইবার নরম স্বরে বলল, মাইয়ার বয়স হইয়া গেলে ভাল বিয়া হইত না, আমি ত দুলাভাইরে জানি, চণ্ডাল লোক, কোন দিকে খেয়াল নাই, বিয়া দিছো, ভাল হইছে। আমেনা চোখ মুছে আনুবিবির দিকে তাকালো,
আনুবিবি আমেনার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। দুইবোন ই কাঁদছে, তবে দুইজনের দুঃখ আলাদা। আমেনা তা অবশ্য জানে না, সে জানে আনুবিবি নিশির কারণেই কাঁদছে হয়ত।
শাহজাহান আর নিশি রয়ে গেল আনুবিবির কাছেই। আমেনা বোনের হাতে মেয়েকে নিশ্চিন্তে তুলে দিয়ে বাড়ি গেল। শাহজাহানের এইবার আনুবিবির বাড়িতে থাকার বৈধ ব্যবস্থা হল। তবে শানু চেয়েছিল শাহজাহানকে নিজের কাছে রাখতে।
– খালা শাশুড়ির বাড়িত থাকা ঠিক হইব?
– কেন হইব না? নিশি ছোট মাইয়া, থাউক খালার কাছে কয়দিন। এরপর আমি নিজে বাসা নিমু এহানে।
শানু আর কিছু বলল না। তবে তার মন টা খচখচ করতে লাগলো। সে গিয়ে ধরলো আনুবিবিকে,
-শাহজাহান ত আমার বাড়ি থাকত, তোমার কি মনে হয় না বউ নিয়া ওর আমার বাড়ি ই যাওয়া উচিত?
আনুবিবি প্রমাদ গুণলো।
তবে সে শান্ত স্বরে বলল, তুমি একজনের ঝামেলা নিছ। এখন বউ এর ঝামেলাও নিবা?শানু বলল, নিতাম নাইলে। এখানে থাকা কেমন দেখাইব।
আমার কি সংসার বলে কিছু আছে? চার দেয়ালই ত বাড়ি হইল না। পোলা ছাড়া বাড়িতে সব পর মানুষ নিয়া থাকি। এখন দুইজন আপন মানুষ হইল। তারা থাউক।
শানু এই আবেগঘন কথায় গলে গেল। তবে সে চুপ রইলো।
আনুবিবি কৌশলে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।
শাহজাহানকে কাছে রাখার জন্য সে যতটা কষ্ট মাথা পেতে নিয়েছে কোন ভাবেই সে তা বৃথা যেতে দেবে না।
*****
রাত।
শাহজাহান আনুবিবির ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আনুবিবি দরজা খুলে শাহজাহানকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসলো।
শাহজাহান ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝতে পারলো না। সে নিজেকে সামলে নিয়ে তাকালো আনুবিবির দিক।। আনুবিবি ঘরের দোর দিল শাহজাহানের দিকে তাকিয়েই। সে দৃষ্টি রহস্যময়। আর শাহজাহান হাসছে। সে হাসি সরল।
আনুবিবি তার গায়ের সমস্ত আবরণ খুলে ফেলতে লাগলো। শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট, সব সে আস্তে আস্তে মেঝেতে ফেলে দিল। শাহজাহান তাকে দেখছিল নীরবেই। আনুবিবি এইবার এগিয়ে গেল। নগ্ন শরীরে শাহজাহানকে জড়িয়ে ধরলো, শাহজাহানও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আনুবিবিকে।
তারপর বলল, পাগলি তুমি।
আনুবিবি শাহজাহানের বুকে মুখ গুজে বলল, হু।
শাহজাহান তাকে কোলে তুলে নিল, তারপর চুমু খেল ঠোঁটে।
ফিস ফিস করে বলল, আমার বউ ত তুমিই।
-তাইলে নিশিরে বিয়া করলা কেন শুনি?
আনুবিবি মুখ ভার করে বলল।
শাহজাহান এইবার দুষ্টু স্বরে বলল, মেয়ে মানুষ আল্লাহর নেয়ামত, যত আল্লাহ দেয় তত নেয়া উচিত। বলে হাহা করে হাসলো।আনুবিবির রাগ হল, সে শাহজাহানের ঘাড়ে কামড় বসালো।
-উফ, পাগলি আমার।
শাহজাহান আনুবিবিকে বিছানায় ফেলে দিল, তারপর এগিয়ে গেল তার দিকে।
আনুবিবির বুকে শুয়ে বলল, নিশিরে আমার ভাল লাগছে ঠিকই, কিন্ত তোমার সাথে নিশির কোন তুলনা আমি করি না।
আনুবিবি বলল, থাক, হইছে।
শাহজাহান একটু লজ্জা পেল। আনুবিবির নগ্ন বুকে মুখ গুজে রইলো।
নিশি ঘরে একা বসে আছে। তার কিছু ভাল্লাগছে না, শাহজাহান কই গেল। এমন কেন মানুষ টা? স্বামীকে কি তার কাছে পাইতে ইচ্ছা করে না? তার পনেরো বছরের জীবনে মানুষটা তাকে নতুন অনুভূতির স্বাদ দিয়েছে।
যদিও সে পছন্দ করত না তাকে, তবে এখন ত সে স্বামী। তার একমাত্র আশ্রয়। নিশি প্রবল মায়া অনুভব করলো। সে অস্থির হয়ে উঠলো।
ঘর থেকে বেরোলো সে। শাহজাহান কই গিয়েছে খবর নিতে হবে। দরকার হলে খালাকে নিয়ে খুঁজবে সে। এত পাগল ত সে ছিল না, তার কি হল। কেমন নির্লজ্জ হয়ে উঠছে সে।
সে বের হয়ে পুরো ঘরে খুঁজলো, আমিরের ঘরে উকি দিল, আমির ঘুমাচ্ছে।
বাড়ির এক পাশে জায়গীর ছেলেগুলো থাকে, আলাদা ঘরে, ওদের দিকেও গেল সে। দরজা বন্ধ। এখানে কি থাকতে পারে শাহজাহান। দরজায় কান পাতলো সে। নাহ নীরব।
রান্নাঘরের দিকে একটা ঘরে রহিমা ঘুমায়। সেদিকেও উঁকি মারলো সে, নাই। কলঘরের দিকেও নাই। নিশি হতাশ হল, খালার ঘরে থাকতে পারে সে চিন্তাও সে করলো না।
তবে খালাকে ব্যাপারটা জানাতেই ওইদিকমুখো হল সে।
আঁচল ভাল ভাবে মাথায় তুলে খালার ঘরের দিকে গেল সে। দরজার সামনে দাড়াতেই কি যেন একটা শব্দ শুনলো ভিতর থেকে। সে ভাল ভাবে দরজায় কান পাতলো। তার বুক ধ্বক করে উঠলো, শাহজাহান হাসছে।
নিশি কি শুনলো এটা, ভুল না ত।
ভাল ভাবে কান পেতে রইলো সে, আনুবিবিকে বলতে শুনলো,
বউ এর কাছে যাইবা না?
শাহজাহান বলল, আইজ আমার বউ তুমি। আবার হাসি।
নিশির সারা শরীরে আগুন ধরে গেল।
ভয়ে, লজ্জায়, ঘৃণায় সে মাটিতে মিশে গেল। দৌড়ে নিজের ঘরে চলে আসলো সে। কোন ভাবে দোরটা দিতে পারলো। তারপর নিজেকে আছড়ে ফেলল বিছানায়। ছিঃ, সে কি দেখলো, কি শুনলো।
কাকে বলবে, শানু মামাকে বলবে? নিশির লজ্জা করতে লাগলো, তারই খালা, তারই স্বামী। কিভাবে বলবে সে, মা জানলে তো মরেই যাবে।
সে ফুঁপিয়ে কাদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়লো জানে না।
গভীর রাতে দরজায় আঘাত পড়তে লাগলো। নিশি চমকে ঘুম থেকে উঠলো, কি হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারলো না। তারপর শাড়ির আঁচল গায়ে ভালভাবে জড়িয়ে দোর খুলতে গেল সে। নিশ্চয়ই বদমাশ টা এসেছে।
দোর খুলে নিশি আর শাহজাহানের দিকে তাকালো না। সে বিছানায় এসে অন্য দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লো।
শাহজাহান বিছানায় এসে বসলো। তারপর নিশির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কি গো বউ।
নিশির ‘বউ’ ডাকটা শুনে গা জ্বলে উঠলো। সে চুপ করে রইলো।
শাহজাহান এইবার নিশিকে ধরতে গেল, পিঠে হাত দিতে চাইল সে।
নিশি এইবার ফুঁসিয়ে উঠলো, তারপর উঠে বসে চাপা স্বরে গর্জন করে বলল, আনু বউ এর সাথে খেলা শেষ হইছে? তাই আমার কাছে আইছো?
শাহজাহান বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর চড় বসিয়ে দিল নিশির গালে। নিশি চড় খেয়ে অবাক চোখে তাকে দেখলো। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আনুবিবি আর শাহজাহানের লীলা এখন নিশির সামনেই চলে। নিশি রাতে ঘরে একা শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যায়। আর শাহজাহান আসে গভীর রাতে। দোর খোলাই থাকে। ক্লান্ত শাহজাহান ঘুমিয়ে পড়ে। সেও নিশির সাথে আর কথা বলে না। নিশি চুপচাপই সহ্য করে যাচ্ছে সব। কপালে এই দূর্ভোগ লেখা ছিল কে জানত। সে নীরব থাকে, কারো সাথে কথা বলে না। আনুবিবিও তাকে এড়িয়ে চলে।
একদিন রাতে নিশি উঠোনে বসে তারা দেখছিল, মৃদুমন্দ বাতাসে তার ভালই লাগছিল।
‘বুবু’ , সে ফিরে দেখলো রহিমা এসেছে।
– কিরে।
– বসমু একটু আপনার কাছে?
– বয়।
রহিমা খুশি হয়ে পিঁড়ি নিয়ে আসলো। নিশি আকাশের দিকেই তাকিয়েছিল। রহিমা পাশে বসে কতক্ষণ চুপ করে রইলো।
তারপর বলল, আফনের কি মন খারাপ?
– নাহ। নিশি হতাশ স্বরে বলল।
– আমি জানি আফনের মন খারাপ। রহিমা ভয়ে ভয়ে বললো।
নিশি এইবার রহিমার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলল, তুই জানতি না?
আকস্মিক প্রশ্নে রহিমা হতবাক হয়ে গেল। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ বুবু।
– আমার মায় রে কইতে পারলি না?
– আপনি ত আপনার খালাম্মারে চিনেনই। উনি আমারে মাইরাই ফেলাইত।
নিশি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তারপর বলল, এখন যে আমি মরে গেলাম।
রহিমা তার কাঁধে হাত রাখলো ভয়ে ভয়ে।
তারপর বলল, বুবু আপনি চইলা যান। এই নরকে থাইকেন না। এই নরকে সব পাপ।
নিশি হতাশ স্বরে বলল, আমার আর যাওয়ার জায়গা নাই।
রহিমা বলল, আমারো নাই। নাইলে এই নষ্টামি দেখতাম না।
নিশি চুপ করে রইলো। একটা বাদুড় উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। আশেপাশে জোনাকির মেলা। নরক ও এত সুন্দর হয়, নিশি অবাক হয়ে ভাবলো।
*****
একদিন খবর এলো মইন মিয়া আসছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই আসছে।
আনুবিবি চিঠি পড়ে প্রমাদ গুণলো। তার এই নিষিদ্ধ খেলাঘরে মইন মিয়ার উপস্থিতি এখন ঠিক অসহ্য লাগবে তার কাছ।। আনুবিবি জানালার কাছে গেল, বাইরে বৃষ্টি। সবুজ ধানখেত, উপরে কালো মেঘ।
শাহজাহানের সাথে তার অবিশ্রান্ত মিলনে ক্লান্তি এসেছে ঠিকই, শাহজাহানও কেমন যেন অদ্ভুত আজকাল। আগের সেই উচ্ছ্বাস নাই। আসে, শোয়, চলে যায়।
তার মনে হয় শাহজাহান নিশির সাথে দূরত্বটা ঠিক মানতে পারছে না, এইজন্য হয়ত মনে মনে এই সম্পর্ক তার কাছে বোঝাই হয়ে গেল। যদিও মুখ ফুটে বলে না কিছু।
অবৈধ এবং দিশাহীন প্রেম আসলে ভাল কিছু বয়ে আনে না। একটা সম্পর্ক ত শুধুই শরীর নয়, জীবনের প্রতিটা অংশেই সেই সম্পর্কের প্রভাব থাকা উচিত, যখন থাকে না সেই সম্পর্ক বোঝা হয়ে যায়, এক অদ্ভুত মায়া টেনে রাখে দুইজনকে, দুইজনই সেই মায়ার জালে হাঁসফাঁস করে ওঠে, মুক্তি পেতে চায়। আনুবিবিও কি এই সম্পর্ক থেকে রেহাই চায়?
সে ভাবলো। সে অন্যায় করেছে, সবার সাথেই, কার জন্য করলো? শাহজাহানের জন্যই। আজ সব কিছু তার বোঝা মনে হচ্ছে, আসলেই কি এতকিছু দরকার ছিল? যেই নিঃসঙ্গতা বছরের পর বছর সে লালন করেছে, সেটা কি আজীবন টানতে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত?
তাছাড়া মইন মিয়া তো আসত ই। হোক স্বামী তার পর হয়েছে, বিদেশে গিয়ে অন্য নারীর অনুরক্ত হয়েছে, তাও একটা বৈধ সম্পর্ক ত ছিল, সমাজের কাছ থেকে যাকে পরম ভয়ে লুকানোর কোন তাড়া নেই। আনুবিবি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আনুবিবি ভাবলো সে আগের মত হয়ে যাবার চেষ্টা করবে। শাহজাহান নিশিকে চায়, তার সাথেই ভাল থাকুক। মইন মিয়া আসছে, আনুবিবি চাইবে দীর্ঘ বিরহ কাটিয়ে একটা সুন্দর মিলন হউক।
-আম্মা
আনুবিবি ফিরে তাকালো, আমির এসেছে।
ছেলেকে দেখে তার ভাল লাগলো, সে ছেলেকে কাছে টেনে বলল, বলো বাবা।
আমির কিছু বললো না, তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলো।
আনুবিবি উৎসুক হয়ে বলল, কিরে কিছু বলবি?
-না।
ছেলের চোখে কি যেন ছিল, আনুবিবি ভয় পেল। সে ছেলেকে ছেড়ে দিল।
আমির বলল, শাহজাহান ভাই এখানে থাকে কেন?
আনুবিবির বুক ধ্বক করে উঠলো। সে শান্ত স্বরে বলল,
তোমার বইনের স্বামী সে, তাই থাকে।
-তাগো কি এইখানে থাকার দরকার আছে?
আনুবিবি অবাক হয়ে বলল, না, কিন্ত তোমার শাহজাহান ভাই….
আমির কথা শেষ করতে দিল না, সে বলল, মানুষ তোমারে আর শাহজাহান ভাইরে নিয়া খারাপ কথা কয় কেন?
আনুবিবি কতক্ষণ চুপ করে রইলো।
তারপর শক্ত মুখে ছেলেকে বলল, মানুষ যা বলে তা সত্য না সবসময় মাথায় রাখবা, তোমার মাকে নিয়া মানুষজনের হিংসা আছে তা তুমি জানো।
আমির বলল, জানি। কিন্ত উনাদের এইখানে রাইখো না।
আনুবিবি অবাক হয়ে গেল, তার কিশোর ছেলে এত বড় হয়ে গেল কবে।
আনুবিবি সংক্ষিপ্ত করে উত্তর দিল, আচ্ছা।
*****
রহিমা রান্নাঘরে বসে ভাত খাচ্ছিল।
আনুবিবি সেই অবস্থায়ই রহিমার চুল ধরে টেনে তার ঘরে নিয়ে আসলো।
রহিমা হাঁসফাঁস করছিল, ‘খালাম্মা ছাড়েন, ও খালাম্মা’
আনুবিবি রহিমাকে চড় বসিয়ে দিল কয়েকটা। তারপর মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধল। তারপর শুরু করল বেদম মার, রহিমার চোখ দুটো বারবার কেঁপে উঠছিল, শরীর এঁকেবেঁকে যাচ্ছিল।
আনুবিবি রহিমার পেটে লাথি দিল, চুল ধরে পিঠ নামিয়ে কিল দিল, আর মুখে দিল কয়েক দফা চড়। রহিমা পরিশ্রান্ত হয়ে গেল। আনুবিবি তার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো।
তারপর বলল, মুখ খুলমু না চিল্লাবি?
রহিমা অসহায় ভাবে মাথা নাড়লো, তার চোখ থেকে পানি পড়ছিল।
-একটা শব্দ বাইরে গেলে একদম মাইরা ফেলমু আবার কইলাম, একবার ত কইছি, শুনস নাই।
রহিমা চোখ বন্ধ করে ফেলল। আনুবিবি মুখের বাঁধন খুলে দিল।
তারপর চুল ধরে উঠে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কথা বাইরে গেল কেম্নে? আমি জানি নিশি কইয়া বেড়ানোর মেয়ে না।
রহিমা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। আনুবিবির রাগ আরো বেড়ে গেল।
-গরম খুন্তির ছ্যাকা দিমু এহন তোরে?
রহিমা ডুকরে কেদে উঠলো, আনুবিবি মুখ চেপে ধরলো রহিমার।
-একটা শব্দ না।
রহিমা অনেক কষ্টে শান্ত হতে চেষ্টা করলো। আনুবিবি উঠে দাড়ালো।
তারপর বলল, যা এখন। সবাইরে বলবি আছাড় খাইয়া পড়ে গেছিলি।
রহিমা এলোমেলো হয়ে যাওয়া শাড়ি ঠিক করতে লাগলো, তার চোখ থেকে অঝোর ধারায় বান ডেকেছে।
-আবার কান্দে, চোখ মুছ হারামজাদি।
রহিমা তাড়াতাড়ি চোখ মুছলো।
আনুবিবি বলল, চক্ষের সামনে দিয়া যা। গোসল কইরা নিজের ঘরে শুইয়া থাক, আইজ কাম সব ময়না মায়ে করব।
রহিমা মাথা নাড়লো, তারপর উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল দ্রুত।
*****
মইন মিয়ার আসার দুইদিন আগে থেকে আনুবিবি ঘরদোর সাজানো শুরু করল।। শাহজাহানকে অনেকটা এড়িয়েই চলা শুরু করেছিল সে। রহিমা মার খেয়ে কয়েকদিন জ্বরে পড়ে রইলো, তারপর উঠে আস্তে আস্তে কাজকর্ম শুরু করলো। কারো সাথে কিছু বলল না সে। শাহজাহান দুইদিকেই অবহেলিত হয়ে অনেকটা উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
অফিসে যায়, আসে, আবার বের হয়ে যায়, ফেরে গভীর রাতে, তখন নিশি ঘুমিয়ে যায়।
সেও ঘুমিয়ে পড়ে।
আনুবিবি পুরো বাড়িঘর পরিষ্কার করালো, প্রতিটি বিছানার চাদর পাল্টালো, রঙিন জানালার পরদা লাগালো, উঠানের আগাছা গুলো তোলালো, পুরো বাড়ি ঝাড় দেয়ালো, সামনের ঘরে কিছু রঙিন কাগজের ফুলও লাগিয়ে দিল। পুরো বাড়ি ঝকমক করতে লাগলো।
জায়গীর ছেলেগুলোকেও নতুন জামাকাপড় কিনে দিল পরে মইন মিয়ার সামনে আসার জন্য,
আমির মায়ের এসব কর্মকাণ্ড অবাক হয়ে দেখতে লাগলো।
রহিমার গায়েও নতুন শাড়ি চড়লো, ময়নার মা নিজের জন্য পেল, তার মেয়ের জন্যও পেল।
নিশিকেও দুটো টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হল রহিমাকে দিয়ে। নিশি শাড়ি দুটোর দিকে প্রবল ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। পেল না শুধু শাহজাহান। তাকে এড়িয়ে যাওয়া হল সন্তর্পণে।
আর আনুবিবির ঘর?
সেটা যেন বাসর ঘর, চারদিকে রঙিন কাগজের ফুল, জানালায় রঙিন পরদা, বিছানায় ফুলেল সাদা চাদর। একপাশে টেবিলে রাখা ফুলদানি, সেখানে প্রতিদিন তাজা গোলাপ রাখা হবে।
আনুবিবি এখন প্রতিদিন গোসলের সময় গায়ে হলুদ মাখে, গোসলের পর গোলাপজল দেয়, চুলে দেয় জবজবে করে নারিকেল তেল।
তারপর সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলে চুল, ঝরঝরে হয়ে ওঠে চুলগুলো, আনুবিবির ভাল লাগে।
মইন মিয়া এসে পৌঁছালো এক শুক্রবার বিকেলে। শানু তাকে নিয়ে আসলো।
আনুবিবি লালশাড়ি পরে অপেক্ষা করছিল তার। চোখে কাজল, গলায় সীতাহার, পায়ে নুপুর, গালে পাউডার, এই সাজ আনুবিবি বিগত ১৫ বছরে দেয় নি। তার অন্য রকম লাগছিল। সে মইন মিয়াকে দেখেই ছুটে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো,
মইন মিয়া একটু অবাক হল, সে বুড়িয়ে গেছে, মাথায় সাদা চুল দেখা দিয়েছে, কামনা জীবিত আছে কিন্ত রং এর বয়স কি আছে। আনুবিবির এমন সাজ দেখে তার অস্বস্তি লাগলো, তাছাড়া আনুবিবি কি জানে সে আরেকটা বিয়ে করেছে। জানার ত কথা, পুরো গ্রামে ঢি ঢি পড়েছে সে শুনেছে। যদিও শানু তোলে নি, তবে সে বুঝতে পারে।
মইন মিয়া বিব্রত হয়ে বলল, থাক থাক ঠিক আছে।
আনুবিবি উঠে দাঁড়াল, মাথার কাপড়টা সুন্দর করে ঠিক করে বলল, ভাল আছেন স্বামী?
-হু ভাল, আমির কই?
মইন মিয়া এইদিক ওইদিক তাকালো।
আনুবিবি একটু রুষ্ট হল। তার এই সম্ভাষণ, তার এই বরণমেলা কিছুরই কোন দাম নেই?
শানু হেসে বলল, আছে হয়ত দুলাভাই, খেলতে গেছে। আপনি ঘরে আসেন।
মইন মিয়া ঘরে প্রথমেই ঢুকলো না।
সে বলল, উঠানে একটা চেয়ার আইন্না দাও, বই। আর আমার ব্যাগ গুলা ঘরে নিয়া যাও।
রহিমা আর ময়নার মা দুইজন বিশাল ঘোমটা দিয়ে এসে ব্যাগ গুলো ঘরে নিয়ে গেল।
চেয়ার আসলো দুটো, শানু আর মইন মিয়া বসলো। মইন মিয়া বলল, বাড়িতে কে জানি থাকে, শাহজাহান..
আনুবিবির বুক ধ্বক করে উঠলো আবার,
শানু বলল, হ আমাগো নিশির স্বামী
শানু ঘটনা বুঝতে পেরে বলল, দুলাভাই, মানুষ বুঝেনই ত। নানান রকম কথা।
মইন মিয়া জিজ্ঞাসা করল, কিসের কথা কইতাছো? আমি কিছু জিগাইসি তোমারে?
শানু চুপ হয়ে গেল।
একটু পর মইন মিয়া বলল, যা রটে কিছুটা হলেও সত্যি বটে।
শানু আনুবিবির দিকে তাকালো, আনুবিবি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখ লাল হয়ে গেছে।
মইন মিয়া আনুবিবির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কিছু কইবা?
আনুবিবি বলল, বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনার কাছে। আমি আপনার বিশ্বাস ভাঙি নাই।
মইন মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই দুনিয়া নষ্ট, এখানে এইসব কথার দাম নাই। সবাই সুখ খুজে।
আনুবিবির বলতে ইচ্ছা হল, সুখ কি আপনিও খোঁজেন নাই? তবু সে চুপ রইলো।
শানু বলল, শাহজাহানের সাথে যদি বইনার সেরকম সম্পর্ক ই থাকত, তাইলে কি নিশির সাথে বিয়া দিত?
মইন মিয়া কিছু বলল না।
একটু পর শানু বলল, দুলাভাই, অনেকদিন পর আইছেন, মানুষের কথায় মনডা কালা কইরেন না।
মইন মিয়া হেসে বলল, আচ্ছা কালা করলাম না।
দেহি একটু পানি দাও।
পানি, শরবত সব তৈরিই ছিল, মূহূর্তেই চলে আসলো। মইন মিয়া পানিতে চুমুক দিয়ে বাড়ির আশেপাশে তাকালো।
সন্তুষ্ট স্বরে আনুবিবিকে বলল, ভালই করছো সব।
আনুবিবির বুক থেকে পাথর নামলো, সে হাসলো।
তারপর বলল, আপনার জন্যই সব।
শানু বলল, বইনা নিজের হাতেই সব করছে। সব গাছ নিজের হাতেই লাগাইছে।
মইন মিয়া বলল, ভালই। বউ পাইছিলাম একটা গুণী।
আনুবিবি লজ্জা পেল, তারপর বলল, ঘরে চলেন।
একটু বিশ্রাম নিয়া পিঠা খাইবেন।
– কি পিঠা?
– নকশি পিঠা বানাইলাম, ছাচের পিঠা আছে, চালের আটার রুটি আছে, মাংস আছে, যা খান।
মইন মিয়া সন্তুষ্ট হল। বাঙালী নারীর এই স্বামী সেবা বিদেশে নাই।
শানু বলল, উঠি চলেন, বইনার মুখে পিঠার কথা শুইনা আর থাকতে পারতাছি না।
মইন মিয়া হাহা করে হাসলো, মিয়া, তোমরা ত প্রতিদিনই খাইতে পারো, আমার ত খাওয়া লাগে বিদেশী খাওন, না পাই স্বাদ, না পাই স্বস্তি।
আনুবিবির একটু কষ্ট লাগলো শুনে। সে বলল, আপনারা ঘরে আসেন, আমি খাবার দিতাছি। সে চলে গেল।
আনুবিবি চলে যাবার পর মইন মিয়া ধরলো শানুকে।
– আসল কাহিনী কও।
– কিয়ের আসল কাহিনী ভাইজান?
– শাহজাহানের লগে….
– না ভাইজান, আমার চোখে কিছু পড়ে নাই।
– রহিমা নাকি হেগো এক ঘরে দেখছে।
এক ঘরে ত থাকতেই পারে, যেহেতু একই বাড়িতে, কথা কইতেও ত আসতে পারে।
-না, রহিমা নাকি জড়াইয়া ধরতেও দেখছে।
শানু এইবার বিরক্ত হল, সে বলল, ছোটলোকের জাত এক কথা তিন কথা বানাইতে ওস্তাদ।
আপনিও এসব মাথায় নেন দুলাভাই।
মইন মিয়া একটু বিব্রত হল, তার বিশ্বাসও করতে ইচ্ছা হচ্ছে, আবার অবিশ্বাসও মাথাচাড়া দিয়ে আছে।
সে বলল, আচ্ছা চলো ঘরে যাই।
তারা উঠলো।
*****
রাত।
আনুবিবি একটা বেনারসি শাড়ি পড়েছে, ঠোটে রংও লাগিয়েছে, চোখে মোটা করে কাজল, আর গায়ে গয়ন। তাকে দেবী প্রতিমার মত লাগছে বললেও ভুল হবে না।
মইন মিয়া খেয়েদেয়ে এসে একটা কাগজ নিয়ে বসেছিল, আনুবিবি তখন এই সাজে ঘরে ঢুকলো। রহিমা সাজিয়ে দিয়েছে তাকে। মইন মিয়া দোর লাগানোর শব্দ পেয়ে তার দিকে তাকালো।
আনুবিবিকে দেখে একটু অবাক হল, আনুবিবির হাতে পানের বাহারি থালা। থালা হাতে সে বিছানায় এসে বসলো। আনুবিবি তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলোও। মইন মিয়া সহজ স্বরে বলল, ভালই রং শিখছো দেখি। বয়স কালে ত এত রং ছিল না।
আনুবিবি আহত হল।
সে দুঃখিত স্বরে বলল, বয়স কালে রং করার জন্য আপনারে পাইলাম কই? বিয়া হওয়ার এক বছর পরই ত চইলা গেলেন, কিছু বুঝতাম না তখন।
-আমি না থাকতে এত রং কই দিয়া শিখলা?
আনুবিবি পান বানাতে বানাতে আহ্লাদি স্বরে বলল, আপনার জন্যই শিখছি, আপনি আসবেন বলে।
-ভাল। মইন মিয়া হাতের কাগজ টা একপাশে রাখলো।
তারপর বলল, পান বানানো হইছে?
-হ্যা হইতেছে।
আনুবিবি পান সাজিয়ে দিল। মইন মিয়া পান মুখে দিয়ে ভরাট কন্ঠে বলল, পান আগের মতই ভাল বানাও।
আনুবিবি হাসলো।
সে এখন আসলেই চায় মইন মিয়াকে আপন করে নিতে।
শাহজাহান নামের যে ঝড়, যে পাপ তার জীবনে এসেছিল সে সব মুছে দিতে চায়। হোক তার স্বামী বিদেশে আরেকটা বিয়ে করেছে, সেই বউ ত নিশ্চয়ই তার রাজত্বে দখল নিতে আসবে না। তার স্বামী, তার সম্মান তার নিজের মতই আছে, থাকুক।
আনুবিবি একটু চুপ করে থেকে বলল, আমারে সোহাগ করবেন না?
মইন মিয়া পানদানিতে পিক ফেলতে ফেলতে বলল, বউ কি আমার আছে? বউত আরেকজন নিয়া গেছে। অন্যের জিনিসে কি করে সোহাগ করি। আনুবিবির বুকে ধাক্কা লাগলো। তার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল।
সে বলল, আপনি আমারে বিশ্বাস করেন না?
মইন মিয়া উদাসী কন্ঠে বলল, নাহ, যে যত কিছুই বলুক, আমি জানি তোমার মনে কি আছে। মানুষ ভাঙাইয়া খাই আমি। আনুবিবি চুপ রইলো।
-মাইয়া মানুষ স্বামীর অনুপস্থিতিতে এত বুদ্ধি, এত ঢং কই দিয়া পায় আমার আর বুঝতে বাকি নাই। আনুবিবির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।
-তবে তোমার উপরে আমার রাগ নাই, যা করছো খারাপ করো নাই, আমার টাকা পয়সা ভাল কইরা কামে লাগাইছো, বাড়ি করছো, জমি জিরাত বাড়াইছো, খারাপ ত না। তবে মাইয়া মানুষের সৌন্দর্য হইল বলদামিতে, বুদ্ধিতে তারে মানায় না।
আনুবিবির রাগ হতে লাগলো, সে শাড়ির আঁচল খামচে ধরলো।
মইন মিয়া হালকা স্বরে বলল, ঘুমাও।
রং নাগরদের সাথে কইরো গিয়া, আমি বুইড়া, আমার ঢং চক্কর ভাল লাগে না।
মইন মিয়া পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
আনুবিবি ঘর থেকে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বের হয়ে পড়লো। তার কান্না বাঁধ মানছে না। দৌড়ে উঠানে চলে গেল সে। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র, ঠিক তার বিয়ের দিনের মত।
সেদিনও সে সেজেছিল, মুখে রং ও মেখেছিল। তবে তা আঁখিজলে ধুয়ে যায় নি। কাজল লেপ্টেছিল স্বামীর আদরে। আজ লেপ্টে গেল চোখের জলে।
সে দাওয়ায় এসে বসে রইলো। পরনের বেনারসি শাড়ি এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। চুলের খোঁপা খুলে ফেলেছে। মৃদুমন্দ বাতাসে চুল গুলো উড়ছে। সে কি কোন দিন ভালবাসা পেয়েছে? স্বামী কি তাকে ভালবেসেছে কখনো? বা শাহজাহান?
না শুধু এই শরীর ই ছিল তাদের চাওয়া।
আনুবিবি তার শরীরের দিকে তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকালো। ইচ্ছা হল জ্বালিয়ে দিতে সোনার অঙ্গ। তার তো কোন দিন আশ্রয় হল না কোথাও। সে ফুঁপিয়ে কাদতে লাগলো। কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে।
রাত আরো যুবতী হল, চাঁদ যেন আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মায়াময় জোছনায় ভেসে গেল চারপাশ। পিছনে একটা মৃদু শব্দ শুনে আনুবিবি ফিরে তাকালো।
শাহজাহান দাঁড়িয়ে আছে। আনুবিবি মুখ ফিরিয়ে নিল।
শাহজাহান একটু পর এসে তার পাশে বসলো। তারপর আনুবিবিকে বুকে টেনে নিল। আনুবিবি আর না করলো না। জীবন যা দিল, তা হয়ত মেকি। কিন্ত এই মেকি ভালবাসা ছাড়া তার আর কি ই বা আছে বেঁচে থাকার মত।
আনুবিবি শাহজাহানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে।
আজ আর তার ভয় নেই। তার কিছুই আর হারাবার নাই।
……………
[ ছবির ড্রইং করেছেন ফাতেমা তুজ জোহরা স্বয়ং। আমরা লেখকদের এই চর্চাকে উৎসাহিত করি]