।। ফরহাদ মজহার।।
ষাট দশকের শেষের দিকে আমরা যখন কবিতা লিখে কিছুটা পরিচিতি অর্জন করেছি তখন ফরিদ উদ্দিন-এর নাম শুনি। তাঁর নাম প্রথম কানে এলো ব্যাপারটা এমন নয়। আমরা যারা আধা-মফস্বল আধা-গ্রাম থেকে শহরে পড়তে এসেছিলাম তাদের বাড়িতে কোথাও না কোথাও ‘মকছুদুল মোমেনীন’-এর পাশে ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ শোভা পেতো। আউলিয়াদের গল্প যতোটা ঐ বাংলা অনুবাদে পড়েছি, তার চেয়ে গুরুজনদের মুখে ধর্মীয় কেচ্ছাকাহিনী হিশাবে শুনেছি। আমাদের অনেকের কৈশোর অলি-আউলিয়াদের গল্পে ভর্তি।
একই গল্প নানা দিক থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও চলতো। মুখে মুখে বলা গল্পগুলো আকর্ষণ করতো যে কোন গল্পের মতোই। কিন্তু বাংলা ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ বা আউলিয়াদের স্মৃতিকথার বাংলা অনুবাদ খুব ভাল ছিল না, পড়তে মজা পাই নি। তখন অবশ্য আমরা রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র পড়ে ভাষার যে অভ্যাস গড়ে তুলেছিলাম সেখানে গুরুজনদের সাহিত্য রুচির সঙ্গে আমাদের বড়সড় ফারাক ঘটে গিয়েছিল। পশ্চিম বাংলার আধুনিক সাহিত্যের ভাষা কিভাবে আমাদের সঙ্গে গুরুজনদের ফারাক ঘটিয়ে দিচ্ছিল, সেটা তখন বুঝি নি। এখন কষ্ট করে ইতিহাস নতুন করে পড়ে বুঝতে হয়।
তদুপরি কিশোর বয়সে নাস্তিক্যবাদের প্রতি ঝোঁক থাকা স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া। আঠারো বছর বয়সে নাস্তিক না হলে, বোঝা যায়, বয়স বাড়ে নি। ‘না’ বলতে পারা খুবই সহজ। কিন্তু কী ‘আছে’ তার অন্বেষণই মনুষ্য জীবনের পরমার্থ। কিশোর বয়সেই দ্রোহী তারুণ্যের প্রমাণ দিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য জারি করা জরুরী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আবার আরেক মজা আছে। ৩৫ বছরের পর আস্তিক-নাস্তিক বাইনারি থেকে বের হয়ে যেতে না পারার অর্থও বয়স বাড়ে নি। সকলেই প্রাপ্তবয়স্ক হয় না। কেউ কেউ বয়সের স্বাদ পায়।
নাস্তিক্যবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে বা আমাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বিশেষ ছিল না। অনেকে হয়তো বেড়ে উঠতে চায় নি, কিম্বা চায় না, সেটা আলাদা তর্ক। তবে এটা বুঝেছি, আল্লা ‘নাই’ বলা খুব সহজ, কিন্তু কী ‘আছে’ বা কিভাবে ‘আছে’ সেটা নির্ণয় করা কিম্বা স্রেফ নির্ণয় করবার কথা চিন্তা করতে পারাটাই বিশাল কাজ। উল্লম্ফন।
নাস্তিকতার কারণে কৈশোরে ‘ইসলামি সাহিত্য’ থেকে দূরে থাকা রপ্ত করেছি। পণ করেছিলাম ‘আধুনিক’ হব। নিজের পরিবার, সমাজ, ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন অনৈতিহাসিক মন জবরদস্ত গড়ে ওঠে। বয়স্কদের কাছে ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ বা ‘কিসাসুল আম্বিয়া’ প্রিয় বই হলেও, আমরা পড়েছি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, নজরুল ইত্যাদি। আর সাহিত্য নিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দ্রুতই জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে অমিয় চক্রবর্তীরা আমাদের ঘরে ঢুকে পড়লেন। তটিদিনে কোরানে হাফেজ হয়ে কৃতিত্ব নেবার দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। আমরা অনর্গল আধুনিক কবিদের কবিতা হেফজ করেছি। মুখস্ত আবৃত্তি করতে পেরেছি ঘন্টার পর ঘন্টা। রবীন্দ্রনাথের পূজার গান, কিম্বা নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতে কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু ‘ইসলামি গান’ আর আমাদের তরুণদের কোঠায় বাজত না। সেটা বড়রাই বেশী শুনতেন।
তাজকিরাতুল আউলিয়া ঘরেই ছিল, ফরিদ উদ্দিন আত্তার ঘরেই ছিলেন। বিশ্ব সাহিত্যের বিচারে তিনি নতুন ধরণের ‘রীতি’ (genre) তৈরি করেছেন সেটা বোঝার মতো দূরদর্শিতা অর্জন করবার আগেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের পরম আরাধ্য হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতিবাদ ততোদিনে ইসলাম নামচিহ্ন বহনকারী চিন্তা চেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সেই তোড়ে ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’ সহ ফরিদ উদ্দিন আত্তার আমার কিশোর বয়সের স্মৃতি থেকে নিঃশব্দে অপসৃত হয়েছিলেন।
কিন্তু মনে পড়ে ঢাকায় নিউমার্কেটের কোন একটি বইয়ের দোকানে এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি অনুবাদ দেখে লেখকের নাম পরিচিত মনে হোল। ‘বার্ড পার্লামেন্ট’ কেনা হোল। আত্তার আবা্র অনেকটা উড়ে এসে হাজির হয়েছিলেন। তো সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পাগল তরুণদের কিছু নিয়ম ছিল। আমরা একজনে কিনে পনেরো জন পড়বার অভ্যাস পয়সার অভাবে তখন গড়ে তুলেছিলাম। সেই সুবাদে সেটা কেনা এবং হপ্তাখানেকের মধ্যে পড়বার অধিকার আমার জুটে গেল। যতোদূর মনে পড়ে সাযযাদ কাদির কিনেছিলেন। ফিটজেরাল্ড ওমর খৈয়ামের অনুবাদ করেছেন, তাঁর প্রতি আমাদের আকর্ষণ ছিল। ওমর খৈয়ামের কবিতায় প্রেমিকা, শরাব, গোলাপ ইত্যাদির আকর্ষণ ছিল। কিন্তু আফসোস ‘পাখিদের পার্লামেন্ট’ আমাদের খুব একটা আকৃষ্ট করে নি।
ফরিদ উদ্দিন আত্তার কবি ছাড়াও আরেকটি কারনে আমাকে বেশ আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন ফার্মাসিস্ট, আতর তৈরি করতেন ও বিক্রি করতেন। যে কারণে তার নাম ‘আত্তার’। আমিও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসির ছাত্র। আকর্ষণ সেখানে। প্রাকটিকাল ক্লাসে প্রফেসর আব্দুল জব্বার স্যার যখন আমাদের কিভাবে ফুল ও পাতা থেকে সুগন্ধ তেল (essential oil) বের করে আনবার বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া কার্জন হলের পুরানা ও প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে শেখাতেন, তখন আমি নিশাপুরের শায়খ ফরিদ উদ্দিন আত্তারের আতরের তৈরি ল্যাবরটরি সম্পর্কে মনে মনে বিস্তর কল্পকাহিনী বানাচ্ছি। প্রাকটিকাল ক্লাশে আতর বানানো হোল কিনা তাতে অবশ্য আমার বিশেষ কিছু আসতো যেতো না, কিন্তু নিশাপুর থেকে আতরের সুগন্ধ কার্জন হলের কলোনিয়াল স্থাপত্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়তো। বলা বাহুল্য হাতে নাতে ভেষজ বিজ্ঞান শিক্ষার ক্লাশে হজরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার (রাঃ) যেভাবে বাংলা ভাষার একজন তরুণ কবির মখলুকাত দখল করে নিয়েছিলেন তার মূল্য আমাকে দিতে হয়েছিল। প্রাকটিকাল ক্লাসে আমি টেনেটুনে পাশ করেছিলাম। কিন্তু নিশাপুর থেকে হজরত আতর পাঠাতে কসুর করলেন না। শুধু তাই নয়। তাঁর তাসাউফের জোব্বা সহ আমা্র সঙ্গে আমার কবিতায় এবং এবাদতে রয়ে গেলেন।
জীবনে বাসনা ছিল একদিন ফারসি শিখব আর ‘মানতিকুত্ তোয়ায়ের’ অনুবাদ করব। কিন্তু এ জন্মে সেটা হোল না। তবে ইসলামিয়া লাইব্রেরি থেকে আব্দুল জলিল-এর করা একটি অনুবাদ ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয়। সত্তর দশকে কেনা সেই বই এখনও আমার কাছে আছে। আর কেউ অনুবাদ করেছেন কিনা জানা নাই। ফিটজেরাল্ডের অনুবাদ ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত আফহাম দারবন্দি ও ডিক ডেভিস-এর অনুবাদও ইন্টারনেটে সুলভ।
ফরিদ উদ্দিন আত্তার ইরানি (১১৪৫-১২২১)। পুরা নাম আবু হামিদ বিন আবু বকর ইব্রাহিম। ইরানের উত্তর পূর্বে নিশাপুর শহরে তাঁর জন্ম। ওমর খৈয়ামের জন্মও একই শহরে। তিনি ঠিক কবে জন্মেছিলেন তা নিয়ে তর্ক আছে। তবে ইরানে মোঙ্গলদের হামলায় তিনি হিজরি ৬২৭ সাল (১২২৯ খ্রিস্টাব্দ) অথবা ৬৩২ হিজরি সালে (১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে) মারা যান। এটাও হতে পারে হিজরি ৬১৭ সালে (১২২০ খ্রিস্টাব্দ) চেঙ্গিজ খান যখন তাঁর শহর নিশাপুর দখলে করেছিলেন তখনই শায়খের মৃত্যু হয়।‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ ও ‘মানতিকুত তোয়াইয়ের’ ছাড়া তাঁর দুটো কবিতার বই আছে। ‘দিওয়ান’ ও মুখতারনামা’।‘পান্দনামা’ নামে নীতিশিক্ষা্র বইও রয়েছে। তবে তাঁর খ্যাতি বিশেষ ভাবে ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ ও ‘মানতিকুত তোয়ায়ের’-এর জন্য।
ফরিদ উদ্দীন আত্তার নানা ভাবে আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছেন।‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ কিভাবে আমার পূর্বপুরুষদের ধর্ম ও নৈতিক বোধকে নির্ণয় ও গঠন করেছে সেটা আমি মহামতি আত্তার-এর আউলিয়াদের কেচ্ছা পড়ে সহজে বুঝতে পারি। অন্যদেরও, বিশেষত নিরক্ষর সাধারণ মানুষদেরও সহজে বোঝাতে পারি। ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের কেতাব বাদ দিয়ে হৃদয় দিয়ে যখন আমি আমার পূর্বপুরুষদের বুঝতে চাই, তখন এই আতরওয়ালা আমার সামনে আতর নিয়ে হাজির হয়ে যান। আতর বিলিয়ে যান। অনুপ্রাণনার এটা প্রথম কারন।
দ্বিতীয়ত, তিনি কখনই কোন জালিমশাহীর শাসন মেনে নেন নি। কোন রাজা বাদশাহের পয়বন্দি করেন নি, কোন ক্ষমতাধরের গোলামি তাঁর ধাতে ছিল না। তাই কিশোর বয়স থেকেই আমি কবি বলতে মুক্ত বা স্বাধীন মানুষ বুঝেছি, যারা কোন ক্ষমতাধরের না, বরং নিজের দিব্য উপলব্ধির আলোয় নিজের পথ নিজে চিনতে সক্ষম।
তৃতীয়ত, নাফসানিয়াত থেকে রুহানিয়াতের উন্নীত হওয়া এক লহমায় হয় না, এক আন্তরিক কিন্তু রক্তাক্ত জিহাদের মধ্য দিয়ে এই সফরে উত্তীর্ণ হতে হয়, এটাও তাঁর কাছ থেকেই শেখা। ফরিদ উদ্দীন শিখিয়েছেন, প্রথমে দরকার ‘তলব’ বা অন্বেষণের তৃষ্ণা। এই ‘প্রান্তর’ পার হতে পারলেই যাকে খুঁজছি তাঁর জন্য আকুতি তৈরি হয়। এর পরের স্তরে তাই হাজির হয় ‘এশক’ বা প্রেমের স্তর। দেখা যাচ্ছে প্রেমকে তিনি শুরুতেই আরাধ্য গণ্য করছেন না। এটি আপনা আপনি হয় না, তাই সবাই প্রেমিক হতে পারে না। অন্বেষণের আকুতি থেকে এশেক তৈরি হয়। তৃতীয় স্তরে গিয়ে হয় তত্ত্বজ্ঞান। পাশ্চাত্যে তত্ত্বজ্ঞানের অনুমান বা ধারনার সঙ্গে এখানে বিরাট পার্থক্য। অন্বেষণ এবং প্রেমের পর্যায় পার না হলে তত্ত্বজ্ঞানী হওয়া যায় না। পাশ্চাত্য ‘নলেজ’ বলতে যা বোঝে প্রাচ্য তার বিপরীতটা বোঝে: অনেষণ ও প্রেম। নইর্ব্যক্তিক জ্ঞান নয়, বরং ব্যক্তির আনন্দ ও বেদনা সহ সত্যের উপলব্দধি। প্রেমে পড়বার জন্য যে ইলম বা জ্ঞান তাই তত্ত্ব জ্ঞান। দিব্যজ্ঞানের সঙ্গে এই জ্ঞানের ফারাক শুধু নামে। সত্যের নিশ্চয়তা বিধানের দাবি বা বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করা ‘নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান’ মুলত ‘ক্ষমতা’ চর্চার কারবারের সঙ্গে যুক্ত। এটা এখন আমরা ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর কাছ থেকে শিখছি। তত্ত্বজ্ঞান প্রেমের প্রান্তরে পৌঁছাবার পরে উদয় হয়। আগে নয়। প্রেমকে প্রজ্ঞা থেকে কিম্বা প্রজ্ঞানে প্রেম থেকে আলাদা করা যায় না।
এর পরের বা চতুর্থ পর্যায় হচ্ছে ‘এস্তেগনা’। কোন কিছুর মুখাপেক্ষি না হওয়া, অমুখাপেক্ষি হওয়া। যে বোধ, সত্য বা দিব্যজ্ঞানের উপলব্ধি ঘটছে তাকে কোন বরাত বা কারন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কারনের অতীত হয়ে তার উদয় ঘটে। যার নিশ্চয়তা নির্ণয়ের জন্য আলাদা করে বুদ্ধির সাক্ষ্য নেবার দরকারও পড়ে না। অর্থাৎ এমন একটি স্তরে পৌঁছানো যেখানে সত্যের নিশ্চয়তার জন্য বুদ্ধিকে সাক্ষ্য মানতে হয় না, সেটা বরং নিজের শরীর ও সকল বৃত্তি সহ উপলব্ধি, সামগ্রিক উপলব্ধির শিহরণে শিহরিত হতে পারার হাল। এই অর্জন সকল বৃত্তির সাধনা, শুধু বুদ্ধির না। কেবল তার পরেই পঞ্চম পর্যায়ে বা স্তরে হাজির হয় তৌহিদ বা ‘এক’ হয়ে যাবার হাল। দেখা যাচ্ছে তৌহিদী হাল নিছকই একত্ববাদে বিশ্বাস করা না করার ব্যাপার না, এটি (ক) তলব (খ) এশেক (গ) তত্ত্বজ্ঞান এবং (ঘ) সকল প্রকার মুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত হওয়া অবস্থা। এটা খ্রিস্টিয় অর্থে ‘বিশ্বাস’ নয়, বরং বিশেষ অবস্থা অর্জন করবার বিষয়। মানবিক বৃত্তির বিকাশ। দেহ ও মনের দিব্য সম্ভাবনাকে মূর্ত করে তোলা। এরপরই ষষ্ঠ স্তরে ঘটে ‘হায়রত’ বা বিহ্বলতার স্তর। আর সপ্তম পরিণতি হচ্ছে সর্বহারা হওয়া বা ‘ফানা’ লাভ করা।
কার্ল মার্কস ‘সর্বহারা’ ধারনাটি অর্থনৈতিক সংজ্ঞা হিশাবে ব্যবহার করেছেন। যার বিপরীতে রয়েছে পুঁজি বা পুঁজিপতি। তিনি সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের রূপান্তরের ওপর জোর দিয়েছেন, ফরিদ উদ্দীনের সর্বহারা হাল আরও ব্যাপক রুহানি তাৎপর্যের ইঙ্গিত দেয়। রুহানি রাজনীতি সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের রূপান্তর চায়, অবশ্যই, কিন্তু তাকে যথেষ্ট মনে করে না। অসম্পূর্ণ জ্ঞান করে। শেষাবধি মানুষের রূপান্তর বা নাফসানিয়াত থেকে রুহানিয়াতের হালে উন্নীত হতে না পারলে সব বিপ্লবই রুশীয় বলশেভিক বিপ্লবের মতো তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে। অথবা বিপ্লবোত্তর ইরানের মতো স্ববিরোধিতায় আটকে যাবে। ওপর থেকে জবরদস্তি ইসলামি শাসন কখনই পোক্ত হতে পারবে না। লেনিন যে কারনে পারেন নি, একই কারনে আয়াতুল্লাহরাও পারবেন না। ইরানি জনগণের বড় একটি অংশের পাশ্চাত্য লিবারেল চিন্তার তোড়ে যে কোন মূহূর্তে ভেসে যাবে।
ফরিদ উদ্দীন আত্তার পড়লে আমরা বুঝি ইসলাম আমাদের রুহানিয়াতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো, যে স্কুলে আখেরি নবী হেড মাস্টার, যিনি শিক্ষা দিচ্ছেন আমরা যেন কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ গোষ্ঠি না হয়ে সমস্ত মানুষকে রুহানিয়াতের পথে সঙ্গী করে নিতে পারি। ইসলাম বদ্ধ ঘর থেকে বের হবার সদর দরজা। বেরিয়ে গেলে সামনে শুধু এক ও অদ্বিতীয় ‘তিনি’, তিনিই আছেন, আর কেউ না, আর কিছুই না। আমি না। আমরা না। ধর্মের উদ্দেশ্য কোন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি হয়ে ওঠা নয়, বরং সর্বহারা মানুষ হয়ে ওঠা। যার আর কোন শৃংখলের ভয় থাকে না। যার ভেতর বাহির একাকার। সকল প্রকার দৈহিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মতাদর্শিক শৃংখল থেকে যে মানুষ নিজে মুক্ত এবং অন্যকে হুদ হুদ পাখির মতো সেই দিকে যাবার জন্য উড়াল দিতে ডাক দিচ্ছে যে খানে পৌঁছালে যে কেউই দেখবে তারা নিজেরাই আসলে একেকজন সী-মোরগ।। এর বাইরে সুফিরা ফানা ফিল্লাহ বলতে ভিন্ন কী বুঝিয়েছেন? এটাই।
তাহলে নাফসানিয়াত থেকে রুহানিয়াতে উন্নীত হওয়া রাজনৈতিক-আধ্যাত্মিক চর্চা। ব্যক্তি পর্যায়ে স্তরের পর স্তর অতিক্রম করার চেষ্টা। সমাজ থেকে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি উৎখাত করা গেলেও ‘আমি’ বা ‘অহং’ বিলুপ্ত হয়, এটা ঠিক না। নাফস অতিক্রম করতে হলে নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদের তরিকা দরকার হয়। সেটা আলাদা। রুশো, হেগেল, মার্কস, মাও প্রমুখ সেখানে কাজে আসে না। পাশ্চাত্য চিন্তার সঙ্গে প্রাচ্যের চিন্তার এই ফারাকগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
আতরওয়ালা এই দিক্গুলো বুঝতে আমাকে খুবই সাহায্য করেছে। ভেতর বাহিরের লড়াই এক সঙ্গে পরিচালনা করবার অর্থ আমি কিছুটা বুঝেছি বলে মনে হয়।
তাঁর ওপর আল্লার রহমত বর্ষিত হোক।