আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

যোগেন মণ্ডলের পূর্বকাণ্ড (১৯৩৭-১৯৪৭)

।। সৌরভ রায় ।।

পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী যোগেন মণ্ডলকে ‘মুসলিম-তফশিলি জোট রাজনীতির ব্যর্থ প্রচারক’ বলে বর্ণনা করে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক সক্রিয়তার ইতিহাসচর্চাকে খারিজ করতে হিন্দুত্ববাদীরা। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে মাত্র হাতে গোণা কয়েকজন লেখক, ইতিহাসবীদ, সমাজতাত্ত্বিক লেখালেখি করেছেন। হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যোগেন মণ্ডলের জীবনের পূর্বকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড নিয়ে লিখছেন সৌরভ রায়। প্রথমে পূর্বকাণ্ড (১৯৩৭-১৯৪৭) তারপর উত্তরকাণ্ড (১৯৪৭-১৯৬৮)

যোগেন মণ্ডলের পূর্বকাণ্ড (১৯৩৭-১৯৪৭) প্রথম পর্ব

যোগেন মণ্ডলের সঙ্গে আপনার হয়তো আগেও দেখা হয়েছে, কিন্তু সেভাবে আলাপ হয়েছে কি? আমার মতো আপনারও নিম্নোক্ত দুটি হিন্দুত্ববাদী চটি পড়ার মতো ভাগ্যবিপর্যয় হয়ে থাকতেই পারে। রায়বাবু ও সিংহবাবু বঙ্গবিভাগ ও উদ্বাস্তু-সমস্যার কথা প্রসঙ্গে সেথায় মিঃ মণ্ডলের কথা তুলেছিলেন। (‘কেন উদ্বাস্তু হতে হল’, দেবজ্যোতি রায়, বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, ২০০১ | ‘শ্যামাপ্রসাদ : বঙ্গবিভাগ ও পশ্চিমবঙ্গ’, ডঃ দীনেশচন্দ্র সিংহ, গ্রন্থরশ্মি, ২০০০) সেখানে যোগেন মণ্ডল মুসলিম-তফশিলি জোট রাজনীতির এক ব্যর্থ প্রচারক বলে বর্ণিত। কিন্তু এখানে বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে এই দুর্মুখ লেখকদ্বয় যোগেন মণ্ডলের নিন্দা বেশ মোলায়েম সুরেই করেছেন। যেন ‘আহা বেচারা অবাস্তব হাঁসজারু রাজনীতি করতে গিয়ে পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী হলে পারল বটে, কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারল না, ইস্তফা দিয়ে লেজ গুটিয়ে হিন্দুস্তানেই ফিরে আসতে হলো। এই বাসি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা আর কিইবা দেবো?’

পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রথম আইনমন্ত্রী যোগেন মণ্ডল

এই দুটি বইয়ের প্রকাশকাল গোধরাকাণ্ডের কাছাকাছি, এবং গেরুয়াশিবির তাদের যে কোনো বড় একশনের অনেক আগে থেকেই তাদের মুসলিমনিধনপ্রকল্পের পদাতিক সৈনিকনিয়োজনের স্বার্থে দলিত ও তপশিলিদের তেল দিতে থাকে, যে কারণে দেবজ্যোতি রায়ের বইতে আম্বেদকরের সম্বন্ধে অনেক তথ্যবিরোধী এতল-বেতল স্তুতি আছে। কিন্তু যোগেন মণ্ডলের উল্লেখ ও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ব্যর্থতার প্রতি মোলায়েম সুরের কারণ আমার মতে অন্য। যে যোগেন মণ্ডলকে সব রকম ইতিহাসের পাতার ফুটনোট থেকেও নিঃশেষে মুছে দেওয়া হয়েছে, তাঁর আবাহনে বাংলার গেরুয়াবাদীদের কি লাভ? প্রথমত, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ এই দশ বছরের মধ্যে যোগেন মণ্ডল যে মুসলিম-তফশিলি জোট রাজনীতির স্বপ্ন দেখেছিলেন তার সম্ভাব্য শক্তিবলয় মোটেই নিরীহ হাঁসজারু-গোছের ছিল না, বরং ছিল তিমিঙ্গিল-প্রমাণ যা তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির দাবার ছক উলটে দিতে পারলেও পারত। আর দ্বিতীয়ত, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বাংলাভাগের দাঙ্গা আর উদ্বাস্তুসমস্যার ক্ষতকে জাগিয়ে, খুঁচিয়ে বিজেপি যে ভোট লুটতে চেয়েছিল, তা এহ বাহ্য। অতএব যোগেন মণ্ডলের রাজনীতির পরাজয় বাংলার গেরুয়ারাজনীতির কাছে এক বড় ঐতিহাসিক জয় ছিল। আর সেই মুসলিম-তফশিলি জোট রাজনীতির আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাকে পশ্চিমবাংলায় বিজেপি যে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে চায় তা বলাই বাহুল্য। বাংলার গেরুয়াবাদী  ইতিহাসে যোগেন মণ্ডল এক ঐতিহাসিক ভুলের, হিন্দু-মুসলিম রাজনীতি মেরুকরণের অবিমৃষ্যকারী বিরোধিতার পাপের শাস্তির এক জ্বলজলে উদাহরণ। যোগেন মণ্ডল পশ্চিমবাংলা বিজেপির মতে তাদের ‘ইউজফুল ইডিয়ট'(https://en.wikipedia.org/wiki/Useful_idiot), তাই তাঁর জন্য নিক্তিমাপা আছে খানিক ক্ষমাঘেন্না।

বরিশালের যোগেন মণ্ডলকে নিয়ে নিবিড়পাঠপ্রকল্পে প্রবেশের আগে জানা ভালো যে, দেবেশ রায়ের ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ (দে’জ পাবলিশিং,২০১৭) কাহিনীমূলক লেখা। গভীর-গম্ভীর আলোচনা-কাটাছেঁড়ার জন্য অকাহিনীমূলক লেখার চেয়ে তা জাতে নাকি খাটো। এমনকি হিন্দুত্ববাদী চটি বই – যেগুলো গাঁজাখুরি তত্ত্ব ও তথ্যে ভরপুর – সেগুলোও নিজেদের শতপ্রতিশত গবেষণাভিত্তিক বলে দাবি করে। অতএব প্রশ্ন ওঠে, ১০৫৯ পাতার হিমালয়প্রমাণ, অতিসুখপাঠ্য ও মোটের ওপর হৃদয়বিদারক দেবেশ রায়ের এই বইটি কি আমাদের একটু কম মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিত? যতই হোক, নভেল বই তো নয়! ঝট করে যাতে এই আঁতলামি আমরা করে না ফেলি, সে জন্য কিছু কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। প্রথমত, দেবেশ রায়ের রচনারীতির সম্বন্ধে যারা ওয়াকিফহাল তাঁরা এর গবেষণানিবিড়তা সম্বন্ধে জানেন। প্রচুর বই-দলিল-দস্তাবেজনির্ভর দুরারোহ গবেষণাকে দেবেশ রায় তাঁর উপন্যাসে কল্পনার কাঁচামাল ও কাহিনীক্রমের অবকাঠামো, এই দুই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করেন। অনেক উপন্যাসে (যেমন ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’) দেবেশ রায় তাঁর পরিচ্ছেদগুলি আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক বহির্জগত ও বিভিন্ন চরিত্রের অন্তর্জগত এই ক্রমে পরিষ্কার ভাগ করে দেন – যাতে পাঠকের গবেষক-দেবেশ ও নভেলিস্ট-দেবেশের বক্তব্য আলাদা করে নিতে কোন অসুবিধা না হয়। ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ এর ব্যতিক্রম নয়। দ্বিতীয়তঃ, যে গবেষণাভিত্তিক বইগুলিকে আমরা প্রামাণ্য-প্রণম্য বলে মনে করি, তা কি পাথুরে প্রমাণের তথ্যে ও সম্মানীয় তত্ত্বে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা? তাতে কি কাহিনীমূলকতার কোনো প্রবেশ নেই?আছে, আছে। ঐতিহাসিক হেডেন হোয়াইটের ‘ট্রপিক অফ ডিসকোর্স’ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বাক্য দিয়ে গাঁথা যেকোনো জ্ঞান তা ইতিহাসই হোক বা কল্পকাহিনী – তা ন্যারেটিভের নির্ভরতা এড়াতে পারে না। পাথুরে প্রমাণের তথ্য ও সম্মানীয় তত্ত্ব শুধু কাঠামোর কাজ করে, বাকি মূর্তির মাটি গড়ে তোলে বিশ্লেষণী ও ব্যাখ্যাময়ী কল্পনা। উপন্যাসের ক্ষেত্রে সেই কল্পনা মূলতঃ অন্তর্জাগতিক আর গবেষণাগ্রন্থের ক্ষেত্রে সেই কল্পনা মূলতঃ বহির্জাগতিক, এই যা।

যোগেন মণ্ডলের রাজনীতির পরাজয় বাংলার গেরুয়ারাজনীতির কাছে এক বড় ঐতিহাসিক জয় ছিল। আর সেই মুসলিম-তফশিলি জোট রাজনীতির আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাকে পশ্চিমবাংলায় বিজেপি যে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে চায় তা বলাই বাহুল্য। বাংলার গেরুয়াবাদী  ইতিহাসে যোগেন মণ্ডল এক ঐতিহাসিক ভুলের, হিন্দু-মুসলিম রাজনীতি মেরুকরণের অবিমৃষ্যকারী বিরোধিতার পাপের শাস্তির এক জ্বলজলে উদাহরণ। যোগেন মণ্ডল পশ্চিমবাংলা বিজেপির মতে তাদের ‘ইউজফুল ইডিয়ট'(https://en.wikipedia.org/wiki/Useful_idiot), তাই তাঁর জন্য নিক্তিমাপা আছে খানিক ক্ষমাঘেন্না।

যোগেন মণ্ডলের ব্যর্থকাম রাজনীতি-প্রচেষ্টা কিভাবে তৎকালীন সমস্ত রাজনৈতিক জোটবদ্ধতার, বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জোটবদ্ধতার বিপ্রতীপে ছিল, তা বিশ্লেষণ করার আগে, যোগেন মণ্ডলের আদিপর্ব আমরা একটু ঝালিয়ে নেব। এই ঝালাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একটি লেখা থেকে ধার করা (‘যোগেন মণ্ডলের একাকিত্ব’, কঙ্ক, দেবেশ রায় সম্মাননা সংখ্যা, শ্রাবণ ১৪২১, চতুর্দশ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৫৯-৬৮): “যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের জন্ম ১৯০৪ সালে বরিশালের গৌরনদী থানার মৈস্তারকান্দি গ্রামে। তাঁদের নমঃশূদ্র পরিবারে কোনকালেও চাষ করার মত ‘একডা কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ির মাপের জমিও ছিল না’। বাড়ির পুরুষেরা কাঠের কাজ করত, মেয়েরা সম্পন্ন উচ্চবর্ণের বাড়িতে ঘরের কাজ করতে যেত। যোগেন পাঠশালা আর গ্রামের ইস্কুলে মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিত হল। ম্যাট্রিক পাশ করে নানা বাধা পেরিয়ে বরিশালে কলেজে পড়তে গেল। তারপর কলকাতায় আইন পড়ে বরিশালে ওকালতি। বামুন-কায়েত বাড়ির ছেলে হলে এই বায়োডেটায় বৈশিষ্ট্য কিছুই থাকত না। কিন্তু যোগেনের নমশূদ্র পরিবারে কেউ কোনোদিন পাঠশালা পেরিয়ে ইস্কুল অবধি পৌঁছেছে কিনা সন্দেহ। তাই যোগেনের উন্নতি শুধু তার পরিবার, জ্ঞাতিগুষ্টি বা বরিশালের নমশূদ্র সমাজের কাছেই নয়, তার আশেপাশের গ্রামের সকলের কাছেই একটা গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। এহেন যোগেন মণ্ডল বরিশালে ওকালতি পেশায় সুনাম ও পশার অর্জন করলেন। শুধু নমশূদ্রদের কাছেই নয়, স্থানীয় উকিল ও মক্কেল সকলের মধ্যেই তাঁর আইনজ্ঞান, আদালতে সওয়াল করার নৈপুন্য আর বাগ্মিতার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ল। এতদূর পর্যন্ত বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ ১৯৩৬ সালে – কী হইতে কী হইয়া গেল! একাধিক স্থানীয় মান্যগণ্য ব্যাক্তির অনুরোধে যোগেন প্রাদেশিক আইনসভার আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেসের জমিদার প্রার্থী সরল দত্তের বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়াতে রাজী হয়ে গেলেন। সংরক্ষিত তপশিলি আসনে নয়, সাধারণ আসনে। এতদিন যোগেনের রাজনৈতিক মতামত বা চিন্তা নিয়ে বিশেষ কিছুই যানা যায় নি। তাঁর স্বজাতির ধর্মীয় বা সামাজিক আন্দোলনেও তিনি কোনোদিন তেমন সক্রিয় ভূমিকা নেননি। ১৯৩৬-৩৭-এর নির্বাচনী প্রচার ও জয়লাভ যোগেন মণ্ডলের জীবন সম্পূর্ণ বদলে দিল।” (পৃষ্ঠা ৫৯)

ফজলুর রহমান ও খাজা নাজিমুদ্দিনের পাশে বসে। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

এখানে আমরা থামব ও ‘যোগেন মণ্ডলের জীবন সম্পূর্ণ বদলে দিল’ এই বাক্যবন্ধটির কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে দেখব। এই সর্বভারতীয় নির্বাচনে সাধারণ আসনে একমাত্র বিজয়ী তপশিলি প্রার্থী হিসাবে   রাজনীতি জগতে অজ্ঞাতকুলশীল যোগেন সব দলের সব হোমরাচোমরাদের চোখ কপালে তুলে দিয়েছিল, তা তো অবশ্যই। কিন্তু তার ফলে সমসাময়িক রাজনীতির ছকে যোগেনের ধুলোমুঠি রাতারাতি সোনামুঠি হয়েছিল কেন, তা বুঝতে গেলে ১৯৩২-এর ‘কম্যুনাল এওয়ার্ডের’ কথা মনে করতে হবে, যেখানে সরকার বাহাদুর ১৯৩১-এর জনগণনা অনুযায়ী উচ্চবর্ণ, তপশিলি, মুসলমান, বৌদ্ধ, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও ইউরোপিয়ানদের জন্য জনসংখ্যা অনুযায়ী আলাদা আলাদা ইলেক্টরেটের প্রস্তাব আনেন, এবং ধর্ম-জাতি অনুযায়ী প্রার্থী ও ভোটার ভাগ ভাগ করে যার-যার-তার-তার মত ভোট, প্রার্থীনির্বাচন ও আইনসভার সদস্যনির্বাচন হবে। যার পরের ঘটনা আমরা জানি , গান্ধী হিন্দু একতার প্রতি গোরা সাহেবদের এই ‘টুকড়ে-টুকড়ে-গ্যাং-ওয়ারের’ প্রতিবাদে অনশনে বসেন, আম্বেদকার আসরে নামেন, বিস্তর টানাহেঁচড়ার পর পুনা প্যাক্টে ঠিক হয় যে হিন্দু ইলেক্টরেটের মধ্যেই তপশিলিদের সংরক্ষণ থাকবে। তপশিলিদের সত্তার নাড়ি হিন্দুদের থেকে পুরোপুরি কাটা গেল না। এই ভাগাভাগির হিসাব নিয়ে ভারতবর্ষের প্রথম ভোট হয় ১৯৩৭-এ। জাতি-ধর্ম-সত্তা এই প্রথম তথাকথিত নিরপেক্ষ ‘ফিলজফি অফ নাম্বারসে’ পর্যবসিত হয়, যার ভিত এত বছর ধরে জনগণনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল। হঠাতই বোঝা গেল যে রাজনৈতিক শক্তিকে রাষ্ট্রনৈতিক শক্তিতে পরিবর্তন করতে গেলে জোট-ঘোঁটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করাই মূল লক্ষ্য, রাজনৈতিক আদর্শ চুলোয় যাক গে যাক। এখন আমরা এই নির্লজ্জ অথচ অনিবার্য সাংখ্য রাজনীতির সাথে খুব ভালভাবেই পরিচিত, কিন্তু ভারতের নেতাকুল ও ভোটারমণ্ডলীর কাছে ১৯৩৭-এ এই পরিস্থিতি ছিল আনকোরা, ক্রমজায়মান। “ (১৯৩৭)-এর ভোটের ফল আইন-অনুযায়ী এইসব অংশ উল্লেখ করে-করে বেরিয়েছিল – সাধারণ : শহর, সাধারণ : গ্রাম, মুসলমান : শহর, মুসলমান : গ্রাম,  সাধারণ : নারী : শহর, মুসলমান : নারী : শহর, এংলো-ইন্ডিয়ান, ইয়োরোপিয়ান, ভারতীয় খ্রিস্টান, শিল্পবাণিজ্য, জমিদার, শ্রমিক, বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো বানরকেও যদি বলা হত, তাহলে, সে এর চাইতে এলোমেলো অংশ-ভাগ করতে পারত না।”(পৃষ্ঠা ১৫৪-১৫৫) এই  সংখ্যাভিত্তিক রাজনীতি যে কতটা এলেমেলো ছিল তা একটা ছোট্ট উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, যে সুভাষ চন্দ্র বোস একদিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির ওপর ঐকান্তিক ঘৃণা জাহির করছেন, সেই তিনিই আবার ১৯৪০-এর কলকাতা কর্পোরেশন ভোটে শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে দায়ে পড়ে জোট বাঁধতে চেয়ে বিফল হচ্ছেন(পৃষ্ঠা ৮৫১)। যোগেন মণ্ডলের চোখধাঁধানো জয়ে বোঝা গেল যে তাঁর পক্ষতলে আছে নমশুদ্রদের এক বিরাট সংখ্যার সমর্থন ও তাঁর মাথায় আছে নানারঙের নানা বড় নেতাদের স্বতঃস্ফুর্ত আশীর্বাদী। তাঁর এই যৌথঅভিজ্ঞান ও যূথশক্তিকে নিজের কবলে আনার জন্য তাঁর পালে নানা রকম বাঘ পড়ল। কিন্তু যোগেন জানতেন “ঘুঁটি যখন বোঝে সে ঘুঁটি, তখন তার ঘুঁটি হবার দাম-আদায় আর কোনদিনই শেষ হয় না।” (পৃষ্ঠা ১৯৮)

সমসাময়িক রাজনীতির ছকে যোগেনের ধুলোমুঠি রাতারাতি সোনামুঠি হয়েছিল কেন, তা বুঝতে গেলে ১৯৩২-এর ‘কম্যুনাল এওয়ার্ডের’ কথা মনে করতে হবে, যেখানে সরকার বাহাদুর ১৯৩১-এর জনগণনা অনুযায়ী উচ্চবর্ণ, তপশিলি, মুসলমান, বৌদ্ধ, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও ইউরোপিয়ানদের জন্য জনসংখ্যা অনুযায়ী আলাদা আলাদা ইলেক্টরেটের প্রস্তাব আনেন, এবং ধর্ম-জাতি অনুযায়ী প্রার্থী ও ভোটার ভাগ ভাগ করে যার-যার-তার-তার মত ভোট, প্রার্থীনির্বাচন ও আইনসভার সদস্যনির্বাচন হবে। যার পরের ঘটনা আমরা জানি , গান্ধী হিন্দু একতার প্রতি গোরা সাহেবদের এই ‘টুকড়ে-টুকড়ে-গ্যাং-ওয়ারের’ প্রতিবাদে অনশনে বসেন, আম্বেদকার আসরে নামেন, বিস্তর টানাহেঁচড়ার পর পুনা প্যাক্টে ঠিক হয় যে হিন্দু ইলেক্টরেটের মধ্যেই তপশিলিদের সংরক্ষণ থাকবে। তপশিলিদের সত্তার নাড়ি হিন্দুদের থেকে পুরোপুরি কাটা গেল না। এই ভাগাভাগির হিসাব নিয়ে ভারতবর্ষের প্রথম ভোট হয় ১৯৩৭-এ। জাতি-ধর্ম-সত্তা এই প্রথম তথাকথিত নিরপেক্ষ ‘ফিলজফি অফ নাম্বারসে’ পর্যবসিত হয়, যার ভিত এত বছর ধরে জনগণনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল…

আবার ফিরে যাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যোগেন মণ্ডলের একাকিত্ব’ লেখায়। “ আইনসভায় যোগেন্দ্রনাথকে দলে নিতে চাইল অনেকেই। ফজলুল হক বরিশাল থেকেই তাঁকে টোপ দিতে লাগলেন, যোগেন এড়িয়ে গেলেন। কলকাতায় ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠনের বিচিত্র কান্ডকারখানা, মুসলিম লিগের উর্দুভাষী নেতাদের সাহেব-নির্ভরতা, কংগ্রেস হাই কমান্ড ও শরৎ বসুর প্রাদেশিক কংগ্রেসের মতানৈক্য, ফজলুল হকের দোলাচল, গভর্নর অ্যান্ডারসন আর সাহেব আমলাদের কৌশলে বাজিমাত – সবই যোগেন্দ্রনাথ লক্ষ্য করলেন, অল্প একটু দুর থেকে…যোগেন স্থির করলেন কিছুতেই তিনি ভুল নেতার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না। গান্ধীজির সঙ্গে একঝলক দেখা হয় তাঁর, শরৎ বসুর বাড়িতে, আইনসভার তফসিলি সদস্যদের সঙ্গে এক আলোচনা সভায়। বাপুজির আকর্ষণীশক্তিতে আক্রান্ত না হওয়া শক্ত ছিল। গান্ধীমুগ্ধতা কাটাতে যোগেনকে কিছুটা বেগ পেতে হয়। কিন্তু মনে মনে প্রবল একটা জেদ ধরে বসেছিলেন যে, গান্ধীজ্বরে কিছুতেই তিনি কাত হবেন না। নিজের সঙ্গে ক্রমাগত তর্ক করে করে যোগেন গান্ধীজ্বর ঠেকালেন। সুভাষচন্দ্রের প্রতি খুবই আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। কিছুদিন সুভাষের অনুগামী হিসেবেই পরিচিত হলেন তিনি, বিশেষ করে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনের আগে-পরে। কিন্তু জাতি-বিষয়ে সুভাষের অস্পষ্ট মতামত যোগেন সমর্থন করতে পারতেন না।…যদিও যোগেন যথেষ্টই সচেতন ছিলেন যে বৃহত্তর রাজনৈতিক দাবার বোর্ডে মুসলিম লীগ আর কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে সুভাষ হয়তো তাকে বোড়ে হিসাবে ব্যবহার করছেন, তবু এ-সময় তিনি শরৎ বসু- সুভাষ বসুর নেতৃত্ব মেনে নিতে গররাজি ছিলেন না।”(পৃষ্ঠা ৬০-৬১-৬২)

গান্ধীমুগ্ধতা কাটাতে যোগেনকে কিছুটা বেগ পেতে হয়। কিন্তু মনে মনে প্রবল একটা জেদ ধরে বসেছিলেন যে, গান্ধীজ্বরে কিছুতেই তিনি কাত হবেন না। নিজের সঙ্গে ক্রমাগত তর্ক করে করে যোগেন গান্ধীজ্বর ঠেকালেন। সুভাষচন্দ্রের প্রতি খুবই আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। কিছুদিন সুভাষের অনুগামী হিসেবেই পরিচিত হলেন তিনি, বিশেষ করে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনের আগে-পরে। কিন্তু জাতি-বিষয়ে সুভাষের অস্পষ্ট মতামত যোগেন সমর্থন করতে পারতেন না।…যদিও যোগেন যথেষ্টই সচেতন ছিলেন যে বৃহত্তর রাজনৈতিক দাবার বোর্ডে মুসলিম লীগ আর কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে সুভাষ হয়তো তাকে বোড়ে হিসাবে ব্যবহার করছেন, তবু এ-সময় তিনি শরৎ বসু- সুভাষ বসুর নেতৃত্ব মেনে নিতে গররাজি ছিলেন না।

এখানে বোঝা দরকার, বিবিধ আকচাআকচি থেকে সমদূরত্ব রাখার মাধ্যমে যোগেন মণ্ডল – নামব-জলে-কিন্তু-বেণী-ভিজাব-না নীতি বা পাটোয়ারি বুদ্ধিমত যার-লগে-কাম-তার-লগে-যাম নীতি – কোনটাই নিতে চান নি। তিনি এমন এক রাজনীতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যা একই সঙ্গে অতিসহজবোধ্য এবং অত্যন্তআয়াসসাধ্য। মুসলিম-তফশিলি জোট রাজনীতি বা শ্যাখ-শুদ্দুরের রাজনীতি।
“সমান। স্বাধীনতা। শূদ্র মুসলমান / পাশের আইলের সম্মান। সেন্স অব অনার।”(পৃষ্ঠা ১০২৩) কিন্তু এই জোট-রাজনীতির অনুপ্রেরণা বা নির্ণায়ক কিন্তু নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার মৃগতৃষ্ণা নয়। যোগেনের মতে এই কাঁধে-কাঁধ-মেলানোর যোগসূত্র আসবে শ্যাখ-শুদ্দুরের সমসত্ব যাপন থেকে। “শূদ্র ও মুসলমানদের দুক্ষ-কষ্ট, আয়-ব্যয়, চাষ-আবাদ, মাছ ধরা, নৌকো-চালানো, সুখ-অসুখ, চেঁচামেচি, ডাকাডাকি, অসুখ-বিসুখ, টোটকা-টুটকি সবই এক রকম।” (পৃষ্ঠা ১০৩২) এক কবিগানের আসরে যোগেন গেয়ে ওঠে যে ‘শ্যাখ-শুদ্দুর’ রাম-লক্ষ্মণের মত ভাই-ভাই, যারা সৎ ভাই হলেও, সহোদর ভাইদের থেকে অনেক বেশী একজোট ও সহমত। (পৃষ্ঠা ৩৫৯-৩৬০)

কিন্তু এই সহমতি কি শ্রেণীমৈত্রী? যোগেন তা মনে করতেন না, বামপন্থীদের মেধা ও তাঁদের তত্ত্বের সাথে যোগেন বৌদ্ধিক ভাবে সশ্রদ্ধ ছিলেন, কিন্ত তাঁদের যুক্তির প্রতি অতিনির্ভরতা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি : “(বামপন্থীদের) নিজেদের মতটা বলতে পারলেই হলো – অং বং টং। জাতপাত কিছু না। এগুলো তো সব শ্রেণীদ্বন্দ্বের ফল। যেমন নিচুজাতের লোক মানে ওঁদের প্রলেতারিয়েত। প্রলেতারিয়েত তো বটেই। প্রলেতারিয়েত হলে সে নিচুজাত হতে পারে না? বরং সে তো  ডবল- প্রলেতারিয়েত। ওঁদের শ্রেণী হিশেবে আবার জাতে নীচু বলে। …’মেনিফেস্টো’ যোগেনের মুখস্থ হয়ে গেছে। ওরকম লেখা মুখস্থ না হয়ে পারে? ‘মেনিফেস্টো’-র প্রত্যেকটা কথাই চমকে দেয়। প্রলেতারিয়েতের কিছুই হারাবার নেই। মুগ্ধতা থেকেও তো মজা আসে। এই কথাটিতে যোগেন মজা করে ভাবে – তাহলে, তাদের, শূদ্রদের, কিছু না হারাবার না-থাকাটাও ডবল না-থাকা, ট্যাঁকেও কিছু নেই, জাতেও কিছু নেই। না থাকার ডবল। সেটা মাপা যায় কি ভাবে। ওঁদের মতো একটা না-থাকা বাদ দিয়ে না। নীহারেন্দুবাবুদের ভাষণ শুনলে বিদ্যাসুন্দর পালা মনে আসে। কাক তাড়ানোর ছলে সুন্দরকে সংকেত দেয় বিদ্যা – ‘পশ্চিমে কাউয়া উড়ে / পুবে বিদ্যা ঢিল ছোঁড়ে।’” (পৃষ্ঠা ৪৮৮-৪৮৯) কিন্তু বামপন্থা যে শুধুই তত্ত্ব নয়, তা  যোগেন মণ্ডল হাতেনাতে দেখলেন ইরান থেকে আসা কমিউনিস্ট নেত্রী সাকিনা বেগমের ধাঙড় ধর্মঘট থেকে। কুড়ি হাজার তথাকথিত রাজনীতিচেতনাহীন মানুষকে কিভাবে তাদেরই জীবন থেকে নেওয়া জ্ঞানের নির্যাস দিয়ে উদবুদ্ধ করে একসুত্রে ইউনিয়নাইজ করা যায়, তা দেখে তাঁর মধ্যে মুগ্ধতা এলো।

কিন্তু শ্রেণীচেতনার যাথার্থ্য নিয়ে যোগেনের কোন দ্বিধা ছিল না। যে নমশূদ্র শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধি তিনি, তাঁর নিজের শিক্ষা, সুযোগ, বাসস্থান, ক্ষমতায়ন-হেতু তিনি যে নিজেই ধীরে ধীরে সেই শ্রেণী ছেড়ে ওপরের দিকে উঠে চলেছেন – সে বিষয়ে তিনি বিলক্ষণ সচেতন ছিলেন। গভীর রাতে এক সরু সর্পসঙ্কুল খাঁড়ি দিয়ে এক বাচ্চা মাঝি যখন বিনাপ্রশ্নে ও বিনাআলোচনায় সওয়ারি বোঝাই এক নৌকো গুণ টেনে নিয়ে যায়, তখন যোগেন বুঝতে পারে যে মাঝিরা অম্লানবদনে এ কাজ করে যেতে পারে, কারণ তাদের শ্রম যে এক পণ্য ও তার যে কোনো দাম আছে এ নিয়ে তাদের কোনো সচেতনতা নেই। আর সাথে সাথে এও বোঝে যে এই অচেতনতার বোধ তার হতে পেরেছে, কারণ সে  ঐ নমশূদ্র শ্রমজীবী যাপন ছেড়ে এক নিম-ভদ্রলোক যাপনে উত্তরিত হতে পেরেছে। (পৃষ্ঠা ৯১-৯২) আর এই নিম-ভদ্দরলোক হওয়া, যে একই সঙ্গে তাঁকে তাঁর রাজনীতিমণ্ডলের ভদ্রলোক আর নমশূদ্র ছোটলোকদের থেকে এক সমদূরত্বে প্রতিস্থাপিত করেছে, তা তিনি পদে পদে বুঝে চলতেন। যতই যোগেন তার চলনে-বলনে-উচ্চারণে মেকি ভদ্রলোকী ও দেখনদার ছোটলোকী থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করুক না কেন, যতই সে বলুক না কেন, “যোগেন শুদ্দুরবাবু হইছে, বাবুশুদ্দুর হয় নাই”, (পৃষ্ঠা ৩৫) এ ত্রিশঙ্কুতা তার ভবিতব্য। “যোগেন ভোটের মুখে কোনো কিছুতেই সম্পূর্ণ ছিল না, সবকিছুই ছিল একটু- আধটু – বুড়িছোঁয়ার থেকে বেশি, ডুবন্ত মানুষের জল-ঝাপটানোর চাইতে কম। একটু ‘জাতীয়তাবাদী’, একটু বর্ণহিন্দু-বিরোধী, একটু হিন্দুও, একটু অচ্ছুৎ, একটু উকিল, একটু মুসলিমঘেঁষা, একটু হিন্দুঘেঁষা, একটু গান্ধীবাদী, একটু আধটু গাইতে পারে, একটু ভাষণও দিতে পারে, লিখতেও পারে। এটাই যোগেনের স্বভাব ছিল। পুর্বপ্রস্তুত কোনো নকশা অনুযায়ী যে-কোনো পরিস্থিতিকে সে সাজিয়ে নিত না। কিন্তু যে-কোনো পরিস্থিতির জন্য পুর্বপ্রস্তুত থাকত এমনকী প্রস্তুতি বলতে যেসব উপাদান-উপকরণ দরকার তা কোথাও না-থাকলেও। যোগেনের এই স্বভাব তার ব্যক্তিগত স্বভাব ছিল না। বামুন-কায়েতদের সামাজিক-ধার্মিক দাপটের তলায় কোনো নমশূদ্রের পক্ষেই কোনো পরিকল্পনা ভেবে রাখা সম্ভব ছিল না।”(পৃষ্ঠা ১৬৬)

কিন্তু ভোটে জিতে আইনসভার সদস্য হয়ে আসার পরে একটি লক্ষ্যে যোগেন মণ্ডলের কোনো ত্রিশঙ্কু-দশা বা দ্বিধা ছিল না, তা হল “আইনসভার ৩১ জন তফসিলি সদস্যকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ব্লক তৈরী করা, যারা নিজেদের ভেতর আলোচনা করে সব বিষয়ে একত্রে ভোট দেবে। এভাবেই শুরু হল যোগেনের নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ নির্মাণ, যার প্রাথমিক শর্ত হলো নমশূদ্র হিসাবে নিজেদের পৃথক রাজনৈতিক পরিচয় তৈরী করা। যোগেন স্বীকার করলেন, বাংলায় কংগ্রেস অর্থাৎ হিন্দু ভদ্রলোকদের ঠেকাতে ইংরেজরাই মুসলমান ও অচ্ছুৎ হিন্দুদের খানিক ক্ষমতার ভাগ দিয়েছে। কিন্তু তাতে তাঁর লজ্জিত হওয়ারই বা কী আছে? সাহেবরা জমিদারি আর চাকরি দিয়েছিল বলেই না হিন্দুরা আজ ভদ্রলোক হয়েছে। শুরু হলো যোগেন্দ্রনাথের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পথসন্ধান। এখন থেকে তিনি প্রতিনিয়ত নমশূদ্রদের জিজ্ঞাসা করতে থাকলেন, ‘তোমরা হিন্দুগর ভিতরে অনুন্নত টুকরা বইল্যা নিজের পরিচয় দিব্যা, নাকি নিজের পরিচয় দিবা এই বইল্যা যে দ্যাশের সব মানুষ হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হইয়া যায় নাই।’ তাঁর নিজের স্পষ্ট উত্তর: ‘আমরা স্বতন্ত্র জাইত। হিন্দুও না মুসলমানও না আমরা তপশিল জাতি। আমাদের স্বার্থে কাজ হইলে সরকার রাইখব। আমাগ বিপক্ষে কাজ হইলে সরকার ফেল্যায়া দিব।’ ” (চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৬০-৬১)

কিন্তু এ তো গেলো আইনসভার তপশিলি রাজনীতি। আইনসভার বাইরে আমশূদ্র ভোটার আর তাঁদের ছাওয়ালপাওয়ালদের জন্য নিদান কি? প্রথম নিদান ক্ষমতায়ন। উচ্চবর্ণের, উচ্চবিত্ত সমাজের সৎ রাজনীতিকদের কাছে রাজনীতি একধরনের আত্মত্যাগ। কিন্তু তপশিলি আর মুসলমানদের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন “একটা ভোগ, বড়রকমের লাভই…ক্ষমতার জায়গায় পৌঁছনোটাই আমাদের স্বার্থ…ক্ষমতা চাই, ক্ষমতার প্রমাণ দিতে চাই।” (পৃষ্ঠা ৮৭০) “মুসলমান আর শিডিউলদের সম্পর্কে সবাই মনে করে যে এদের একমাত্র উদ্দেশ্য কোটায় চাকরি পাওয়া আর চাকরির কোটা বাড়ানো। স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারকাছ দিয়েও নেই। সবাই মনে করে, মানে হিন্দুরাই বটে কিন্তু বড়লোক মুসলমানরাও ওরকম ভাবে। বাংলার রাজনীতিতে বিধান রায়ের সঙ্গে স্যার আবদুর রহিমের এক বাদানুবাদ লোককথা হয়ে গেছে। এক বৈঠকে বিধান রায় বলেছিলেন, ‘মুসলমানদের তো ঐ এক কথা – দেশের জন্য কিছু করব না কিন্তু চাকরির ভাগ দাও।’ স্যার আবদুর রহিম সঙ্গে-সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘তাহলে হিন্দুদেরও এক কথা – চাকরির ভাগ দেব না কিন্তু দেশোদ্ধারে এসো। হিন্দুদের লড়াই তো একটা ফ্রন্টে – ব্রিটিশরাজের সঙ্গে। আর মুসলমানদের লড়াই তিন ফ্রন্টে – সামনে ব্রিটিশ, ডাইনে হিন্দুরা আর বাঁয়ে মোল্লারা।’ এই ক-মাসে এই গল্পটা যোগেনের মনে ফিরে ফিরে এসেছে – তাইলে আমাগ, চাঁড়ালগ, শিডিউলগ, কয়ডা লড়াই? সামনে শাহেব। ডাইনে হিন্দু। আর বাঁয়ে মোল্লা? তাইলে মুসলমান আর চাঁড়ালগ লড়াইত তো একডাই দাঁড়ায়।”(পৃষ্ঠা ২৬৯) যোগেন মণ্ডল সবচেয়ে নিদারূন উপমা দেয় ফজলুল হককে তপশিলি আর মুসলমানদের সর্বহারাত্ব বোঝাতে। হাটের মাঝে ন্যাংটো ভিখিরির উপমা। যে ভিখিরি লজ্জার অভাবে ন্যাংটো নয়, কাপড় কেনার পয়সার অভাবে ন্যাংটো। তাই সে যখন কাপড় কেনার জন্য বিনীত ভাবে ভিক্ষা চায়, তাকে শুনতে হয় যে, সে মনুষ্যেতর, তার লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য কাপড় দাবি করাটা অন্যায় রকম বাড়াবাড়ি। কিন্তু ভিক্ষা না চেয়ে সে যখন বামুন-কায়েত-বর্ণহিন্দুর পরনের ধুতি ধরে টানাহেঁচড়া করে, ছিঁড়েফেড়ে নিতে চায় তাকে ত্যানা করার জন্য, তখন সবার টনক নড়ে ভিখিরির ন্যূনতম চাহিদার প্রতি, মানুষ হিসাবে যা তার – বিনাদাবিতে, অনেক আগেই প্রাপ্য ছিল। এই ত্যানা যোগাড় করা গভীর শ্রমের কাজ। “৩৭ থিক্যা এই ৪৬ নয়-দশ বছর জুইড়্যা পায়ের তলার চামড়ার ফোস্কা ফ্যালাইয়া ছাওয়াল-পাওয়ালগ লাইগ্যা দুইডা-একডা হস্টেল আর তাগ বাবাগ লাইগ্যা নিম্নপ্রকারের চাকরির সামান্য শতাংশ রিজার্ভ কইরতে মাত্র পারা গিছে।”(পৃষ্ঠা ১০২৩)

এক বৈঠকে বিধান রায় বলেছিলেন, ‘মুসলমানদের তো ঐ এক কথা – দেশের জন্য কিছু করব না কিন্তু চাকরির ভাগ দাও।’ স্যার আবদুর রহিম সঙ্গে-সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘তাহলে হিন্দুদেরও এক কথা – চাকরির ভাগ দেব না কিন্তু দেশোদ্ধারে এসো। হিন্দুদের লড়াই তো একটা ফ্রন্টে – ব্রিটিশরাজের সঙ্গে। আর মুসলমানদের লড়াই তিন ফ্রন্টে – সামনে ব্রিটিশ, ডাইনে হিন্দুরা আর বাঁয়ে মোল্লারা।’

কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদ নির্মিত শূদ্রসত্তা থেকে ইংরেজনির্মিত শিডিউলসত্তায় উত্তরণ যে মোটেই সোজা নয়, তা যোগেন পদে পদে বুঝতে পারে। পথের প্রথম কাঁটা হল নমশুদ্রদের পূর্বাশ্রম মতুয়াসত্তা ও তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞান। ১৮৮০ থেকে ১৯২৫ বাংলায় পাটচাষ চালু হবার সুবাদে বাখরগঞ্জ-ফরিদপুর-যশোর-খুলনায় নমশূদ্রদের মধ্যে একটু সমৃদ্ধি আসে, “গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া আন্দোলন বেশ ছড়ায় গুছোয়।…তাঁরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন , তাঁরা স্বাধীনতার বিপক্ষে ও ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে।” (পৃষ্ঠা ৩২৯) গান্ধীবাবার অসহযোগ আন্দোলন বর্ণহিন্দু ভদ্দরলোকেদের জন্য, যাদের এক ভাই জেলে গেলে, অন্য ভাইরা তাঁদের চাকরির মাইনে আর জমানো টাকা দিয়ে সংসার চালাবে। কিন্তু নমশূদ্র চাষী জেলে গেলে, তার চাষ মার গেলে, ঘরপরিবার শুকিয়ে মরবে। নমশুদ্ররা চিরকালই খাটিয়ে-লড়িয়ে এবং হিন্দু উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তের সব হিংসামূলক কাজের পদাতিক সৈনিক। অতএব গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে হাতে-হাতে-সড়কিতে-লাঠিতে অসহযোগীদের মোকাবিলা করতে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হল না। আর ব্রিটিশ শাসকের পুলিশের মদত তো তাদের সাথে ছিলই। ‘কম্যুনাল এওয়ার্ডের’ পরে সংখ্যামেলানোর রাজনীতি শুরু হলে হিন্দুবাদী কংগ্রেস ও হিন্দুত্ববাদী দলসমূহ বুঝল যে ‘শিডিউল’রা নিজেদের হিন্দু বলে সেন্সাসে ও রাজনীতিতে স্বীকার না করলে বাংলার মত মুসলিমপ্রধান রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাখা অসম্ভব। “মাহিষ্য, নমশূদ্র আর রাজবংশী এই তিন জাত মিলেই তো মোট বাঙালির প্রায় তিনভাগের  একভাগ, ঠিকঠাক হিসেবে পাঁচ আনি আর বামুন-কায়েতরা আটভাগের একভাগ, ঠিকঠাক হিসেবে দুই-আনি-দুই-পয়সা।”(পৃষ্ঠা ১৯৯) যোগেন জানত, তপশিলিরা নিজেদের না-হিন্দু বলে ঘোষণা করলেই প্রশ্ন উঠবে, তবে কি তাদের মুসলমান হতে হবে? তার উত্তর তৈরি। “আগে কি কহনো শিডিউল বইল্যা কুনো জাইত ছিল? ছিল না। তহন আলাদা-আলাদা জাইত ছিল – চাঁড়াল, মেথর, ডোম, ধাঙর, রাজবংশী। এই আলাদা জাতগুইল্যা কিন্তু হিন্দুধর্মের বিধান। এহন যদি সেই সব মিল্যা শিডিউল হয়, তাইলে তো ব্রিটিশ-গবর্নমেন্টের আইন মোতাবেক শিডিউল। তয়? সরকার একটা নতুন জাত দিল আমরা নি না।”(পৃষ্ঠা ৩১৯) কিন্তু কখনও কখনও তর্কেতে মিলয়ে বস্তু বিশ্বাসে বহুদূর।।

যোগেন মণ্ডলের পূর্বকাণ্ড (১৯৩৭-১৯৪৭)- দ্বিতীয় পর্ব

এই লেখার শেষ অংশ আমি তাই বরাদ্দ রাখছি যোগেন মণ্ডলের রাজনীতি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে বোঝার ও রোখার যে গভীর ক্ষমতা রাখে সেই সংক্রান্ত আলোচনায়, যা আজও আমাদের কাছে খুব জরুরী হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭-এর ঘোলা রাজনীতিতে যোগেন মণ্ডল কিভাবে ‘কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার অঘোষিত জোটের অঘোষিত নেতা’ (পৃষ্ঠা ১০২৭) শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির ‘অপর’ বা other হয়ে উঠেছিলেন, তা দেবেশ রায়ের লেখায় বারবার উঠে এসেছে।

যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল

” Ambedkar cites the list of Scheduled Castes in all the provinces from a 1935 survey by the Government of India and calls it a ” terrifying ” list…there exist four hundred and twenty-nine communities!” ( p. 223, Soumyabrata Choudhury, Ambedkar and Other Immortals : An Untouchable Research Programme, (New Delhi: Navayana, 2018) )

জাতিভেদব্যবস্থার শক্তি ঠিক এখানেই– Graded inequality বা Graded non-sovereignty, যেখানে প্রতিটি দলিত দলকে আরেকটি দলিত দলের তুলনায় কিছু আলাদা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। যাতে Gordon Allport-এর The Nature of Prejudice-এর  in-group / out-group হিসাব মতে মনে হয়, আমরা যত খারাপই থাকি, অমুকদের এবং তমুকদের থেকে তো ভালো আছি। আমরা আর যাই হই, সবচেয়ে নিচু জাত নই। অতএব এই বিভাজনের অতিপ্রাচীন রাজনীতির কাছে ব্রিটিশ-এর ‘divide-and-rule’ তো শিশু!

কিন্তু সংখ্যার রাজনীতিকে সদর্থকভাবে ব্যবহার করে মুসলমান-তপশিলি জোট বেঁধে ‘শক্তিসাম্যের নিয়ামক ও বাংলার ভাগ্যনির্ণায়ক’ (পৃষ্ঠা ৫৮৯) হবার দূরদৃষ্টি বলাই বাহুল্য বাকি ৩০ জন তপশিলি নেতার ছিল না। বর্ণহিন্দু প্রভুজাতি ‘তু’ বললে ছুটে যাওয়ার মজ্জাগত অভ্যাস, ও এই সুযোগে জাতে ওঠার লোভ তো ছিলই – যদিও যোগেন তাঁদের মনে করিয়ে দেয় যে বহু সচ্ছল নমশুদ্র বহু প্রজন্ম ধরে পইতে পরে ও বামুনদের দান করেও জাতে উঠতে পারেনি – তার থেকেও বেশী ভয় ছিল বর্ণহিন্দু প্রভুজাতি্দের ‘না’ বলার স্পর্ধা দেখালে তার ফলাফল কি হবে। অতএব যোগেনের মুসলমান-তপশিলি জোট রাজনীতির বিরোধিতা হিসেবে তপশিলি নেতা পি আর ঠাকুর (হরিচাঁদ ঠাকুরের উত্তরসুরী) যে অভিযোগ আনেন – “আপনি রাজনীতিতে এই জট পাকিয়ে দিয়েছেন। তপশিলিদের এন্টি-হিন্দু পরিচয়কে প্রধান করেছেন…আপনি নিজেই তো দাঙ্গায় প্ররোচনা ও নেতৃত্ব দিলেন গোপালগঞ্জে । হিন্দুদের মহাসম্মিলনও করতে দেন নি।”(পৃষ্ঠা ১০২৩) আর হিন্দু মহাসভার নতুন নেতা কালীশ বিশ্বাস যে অভিযোগ আনেন, “এই শিডিউলগুল্যাই মোছলাগুলির সাথে মিইল্যা মোছলাগো ত্যাজ বাড়াইয়্যা দিছে।” (পৃষ্ঠা ৭২৬) দুটিতেই আমরা শুনি আচমকা-চোট-খাওয়া বর্ণহিন্দুস্বার্থের শক্তিতন্ত্রের গজরানি।

আর মুসলমান জোট? যেই জোটের কাঁধে কাঁধ মেলাবে বলে যোগেন সলতে পাকাচ্ছিল? সেই রাজনৈতিক জোট কি শুধু মুসলমানত্বের কারণে বাংলায় হাতে-গরম তৈরি হয়ে ছিল? না। ফজলুল হক  একদিকে জমিদারি হঠানোর মত সার্বজনীন জিগির বাংলার গ্রামে গ্রামে তুলেছিলেন। আবার বাংলার শহরে আলাদা-আলাদা বিভিন্ন মুসলিম  শ্রমিকগোষ্ঠী (লশকর, দর্জি) এদের সাথে মুখোমুখি বসে তাঁদের সুবিধা-চাহিদা মত আলাদা-আলাদা প্রতিশ্রুতি দিয়ে কৃষক প্রজা পার্টির জন্য এক নিম-টেঁকসই মুসলমানি জোট পাকিয়ে তুলেছিলেন, যাকে জিন্না তাঁর মুসলিম লিগের জন্য টুপ করে পেড়ে নিয়েছিলেন, হকশাহেবকে খাঁচায় পুরে ফেলে। “মুসলিম নেতারা মুখে যাই বলুন, এবং জিন্না যতই যোগেন মণ্ডলকে তুরুপের তাস হিসেবে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চালাবার চেষ্টা করুন, মুসলিম লিগের বঙ্গীয় নেতারা কিন্তু তফসিলি জাতিদের আনুগত্যের ব্যাপারে মোটেই নিশ্চিত ছিলেন না। হারুন-অ-রশিদ সংকলিত মুসলিম নেতাদের চিঠিপত্র থেকে দেখছি, সোহরাওয়ার্দি ১৯শে মে ১৯৪৭ তারিখে লিয়াকত আলিকে বেশ উৎসাহের সঙ্গে লিখছেন, ‘যোগেন মণ্ডলের সাথে দীর্ঘ কথা হল। আমরা বোধহয় ওঁর সম্বন্ধে অনাবশ্যক হতাশ হয়েছিলাম। উনি বর্ধমান, খুলনা ও ২৪-পরগণায় খুব ভালো মিটিং করেছেন।  সেখানে তফসিলি জাতিদের শীঘ্রই আমাদের দিকে নিয়ে আসা যাবে বলে মনে হয়।’ মাত্র দু-দিন বাদে, ২১শে মে তারিখে, তিনি ঠিক উলটো কথা লিখছেন – অনুমান করা যায় অন্য সূত্রে ইতিমধ্যে খবর পেয়ে তাঁর আগের মত বদলাতে হয়েছে। এবার লিখছেন, ‘একমাত্র বর্ধমান ডিভিশনে দুটো মিটিং ছাড়া আর কোথাও আমরা তফশিলি জাতিদের সঙ্গে মিটিং করতে পারিনি। তাছাড়া তাঁদের মধ্যে কিছুটা সাড়া জাগাতে সক্ষম হলেও তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সকলেই বাংলার পার্টিশনের পক্ষে ভোট দেবে। শুধু তাই নয়, ভারত-পাকিস্তান ভাগ নিয়েও এবার ঘোষণা হয়ে গেলে, বর্ণহিন্দু বা তপশিলি কারো মতই আমাদের পক্ষে থাকবে না। এই নিয়ে যদি মারামারি হয়, পশ্চিমবাংলার মুসলিমরা সম্পূর্ণ মুছে যাবে, কেউ তাদের বাঁচাতে পারবে না। একই ভাবে, পূর্ব বাংলার হিন্দুরা একেবারে মুছে যাবে। আমরা যতই বর্ণহিন্দু আর তফশিলিদের মধ্যে তফাৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করি না কেন, সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হলে কোনো তফাৎ বজায় থাকবে না। ক’দিন আগেই কুমিল্লা আর নোয়াখালীতে মুসলিমরা তফশিলি হিন্দুদের আক্রমণ করেছিল, ঠিক যেমন কলকাতা আর বিহারের হিন্দুরা কংগ্রেসি মুসলমানদেরও আক্রমণ করেছিল।’” (চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৬৫)

অতএব যোগেন মণ্ডল বর্ণহিন্দুদের কাছে হলেন ‘যোগেন মোল্লা’ ও মুসলমানদের কাছে হলেন ‘চোরা-হিন্দু’, তাঁর শ্যাখ-শুদ্দুর মিলনের রাজনীতি-আদর্শ একমাত্র ব্যক্তিগত জীবনে পালন করতে পারলেন তিনি – কিছুদিনের জন্য পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী হয়ে। সেখানেও উগ্রহিন্দুবিদ্বেষের শিকার হয়ে তাঁকে জীবন বাঁচাতে ইস্তফা দিয়ে পালিয়ে আসতে হল। এই র‍্যাডিকালি দিকপরিবর্তক রাজনীতির সম্ভাবনা যে বুদবুদের মত যে কোন সময় বিলীন হয়ে যেতে পারে, সে কথা সুভাষ যোগেনকে আগেই বলেছিলেন – “কিন্তু আপনার মতটায়, আপনি বলছেন, আপনি পৌঁছেছেন থ্রু ইয়োর বিলংগিং টু দিজ ইয়ারমার্কড আনটাচেবল কাস্টস। এটা কোন মত নাও হতে পারে। এটা শুধু একটা অনুভুতিও হতে পারে। অনুভূতি থেকে ধারণা তৈরি হতেও পারে, নাও পারে। ধারণা থেকে মত তৈরি হতেও পারে, নাও পারে। মত থেকে একশন তৈরি হতেও পারে, নাও পারে।” (পৃষ্ঠা ৭৪৯) যোগেন মণ্ডলের এই ঘোর ব্যর্থতার মহাকাব্যিক ট্রাজেডিকে কন্ডুয়ন করা ও সুভাষচন্দ্রের মহাকাব্যিক ট্রাজেডির সাথে এর তুলনামূলক আলোচনা করা পিপলস পাঠচক্র নিবিড়পাঠপ্রকল্পের এজেন্ডার বাইরে। এই ট্র্যাজিক ব্যর্থতার কারণ পার্থবাবু বর্ণিত আলুভাতে বাইনারি ‘তত্ত্ব বনাম কৌশল’ কিনা তা আমরা এর পরে দ্বৈপায়ন সেনের ‘The Decline of the Caste Question: Jogendranath Mandal and the Defeat of Dalit Politics in Bengal’ (Cambridge University Press, 2018) পড়ে আরও ভালো বুঝতে পারব। কিন্তু এই উপন্যাসে পাটচাষী আর পাটকলমজুরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রসঙ্গে একটি লাগসই উপমা আছে, যেটি হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ রাজনীতির জাঁতাকলে পিষে যাওয়া তপশিলি রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। (পৃষ্ঠা ৮৭২) এক রথের মেলায় যদি কোন বাবু দশটাকার খুচরো করে শুধু অন্ধ আর কুষ্ঠরোগীদের মধ্যে বিলি করবেন বলে ঘোষণা করেন, তাহলে সব ভিখিরিই হয় অন্ধ নয় কুষ্ঠরোগী বলে নিজেকে পরিচয় দেবে। কেউ বলবে না, আমার দৃষ্টিশক্তিও আছে, কুষ্ঠরোগ-ও নেই, কিন্তু আমিও ভিখিরি বাবু, আমারও ভিক্ষে চাই।

বর্ণহিন্দু প্রভুজাতি ‘তু’ বললে ছুটে যাওয়ার মজ্জাগত অভ্যাস, ও এই সুযোগে জাতে ওঠার লোভ তো ছিলই – যদিও যোগেন তাঁদের মনে করিয়ে দেয় যে বহু সচ্ছল নমশুদ্র বহু প্রজন্ম ধরে পইতে পরে ও বামুনদের দান করেও জাতে উঠতে পারেনি – তার থেকেও বেশী ভয় ছিল বর্ণহিন্দু প্রভুজাতি্দের ‘না’ বলার স্পর্ধা দেখালে তার ফলাফল কি হবে। অতএব যোগেনের মুসলমান-তপশিলি জোট রাজনীতির বিরোধিতা হিসেবে তপশিলি নেতা পি আর ঠাকুর (হরিচাঁদ ঠাকুরের উত্তরসুরী) যে অভিযোগ আনেন – “আপনি রাজনীতিতে এই জট পাকিয়ে দিয়েছেন। তপশিলিদের এন্টি-হিন্দু পরিচয়কে প্রধান করেছেন…আপনি নিজেই তো দাঙ্গায় প্ররোচনা ও নেতৃত্ব দিলেন গোপালগঞ্জে । হিন্দুদের মহাসম্মিলনও করতে দেন নি।”(পৃষ্ঠা ১০২৩) আর হিন্দু মহাসভার নতুন নেতা কালীশ বিশ্বাস যে অভিযোগ আনেন, “এই শিডিউলগুল্যাই মোছলাগুলির সাথে মিইল্যা মোছলাগো ত্যাজ বাড়াইয়্যা দিছে।” (পৃষ্ঠা ৭২৬) দুটিতেই আমরা শুনি আচমকা-চোট-খাওয়া বর্ণহিন্দুস্বার্থের শক্তিতন্ত্রের গজরানি

এই লেখার শেষ অংশ আমি তাই বরাদ্দ রাখছি যোগেন মণ্ডলের রাজনীতি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে বোঝার ও রোখার যে গভীর ক্ষমতা রাখে সেই সংক্রান্ত আলোচনায়, যা আজও আমাদের কাছে খুব জরুরী হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭-এর ঘোলা রাজনীতিতে যোগেন মণ্ডল কিভাবে ‘কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার অঘোষিত জোটের অঘোষিত নেতা’ (পৃষ্ঠা ১০২৭) শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির ‘অপর’ বা other হয়ে উঠেছিলেন, তা দেবেশ রায়ের লেখায় বার বার উঠে এসেছে।

যোগেন মণ্ডলের শূদ্রত্ব জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি। তাই ব্রাহ্মণ্যবাদ-সঞ্জাত হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের চালচলন বুঝতে অন্য উচ্চবর্ণদের মতো তাঁর দেরী লাগে না। অন্যদিকে মুসলমানেরা কয়েকশো বছর ধরে বাংলায় হিন্দুদের পাশাপাশি থাকলেও জাতপাত সংক্রান্ত নানা প্যাঁচপয়জার নিয়ে অনেক সময়েই সম্পূর্ণ অজ্ঞ। যেমন এক বিত্তবান, প্রবীণ, অভিজ্ঞ মুসলিম ব্যবসায়ী দুধু মিয়া যোগেন মণ্ডলের কাছেই প্রথম অস্পৃশ্য শুদ্রত্বের কথা শুনে বলে ওঠেন, “আমরা শুধু শিখ্যা রাখছি হিন্দুরা মুসলমানগ ছোঁয়ও না, ছোঁয়াও খায় না। হিন্দুরা যে হিন্দুগ ছোঁয়াও খায় না, এমন আজব জীব খোদাতালা বানাইছিল ক্যা।” (পৃষ্ঠা ৭১৯) ১৯৩১-এর জনগণনার ভিত্তিতে ১৯৩২-এর ‘কম্যুনাল এওয়ার্ডের’ পরে যোগেন মণ্ডলের নেতৃত্বে তপশিলিরা তাদের হিন্দু পরিচয় ঝেড়ে ফেলে মুসলমানদের সাথে জোট বাঁধার তোড়জোর করার পরে নানা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন তেড়েফুঁড়ে নামে মুসলিমদের ধর্মান্তরিত করার কাজে, যদিও তা হিন্দুশাস্ত্র মতে অসিদ্ধ। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের মতে বাংলার সব মুসলিমই কয়েকশো বছর আগে
আগে জবরদস্তি করে ধর্মান্তর করা নিচুজাতের হিন্দু। কিন্তু প্রামাণ্য ইতিহাস বলে বাংলায় ইসলাম ধর্মান্তরণের ইতিহাস অনেক বেশী প্রাচীন ও জটিল। মুসলিম শাসকদের প্রভাবে ও প্রকোপে যত না ধর্মান্তরণ হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশী হয়েছে স্বেচ্ছায়, ইসলামে জাতপাত-বর্ণবিভাজন না থাকায়, ফকির-দরবেশ-সুফিদের প্রভাবে। (দেখুন Richard M. Eaton, “The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760”, University of California Press,1996) হিন্দুদের দল ভারি করার জন্য চাপ দিয়ে এই যে মুসলমানদের হিন্দু বানানো হতো, হিন্দুসমাজে তাদের স্থান হতো কিন্তু শূদ্র হিসাবে। কারণ হিন্দুসমাজে শ্রম এবং হিংসার জন্য শুদ্দুরের চাহিদা কখনও কমে না। অর্থাৎ ‘আয় ভাই (নমশুদ্দুর) বুকে আয়, রায়টের সময় বাঁচাস।’ (পৃষ্ঠা ১০২৩) অন্য সময় তফাত থাকিস আর গায়ের খাটনিগুলো মাগনায় বা সস্তায় খেটে দিস।

একই ফ্রেমে ডানদিক যোগেন মণ্ডল ও বি আর আম্বেদকর। ডানদিক থেকে তৃতীয়জন যোগেন মণ্ডল এবং বাম দিক থেকে দ্বিতীয়জন আম্বেদকর।

এক ভোটদানকারী রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে বাংলায় মুসলিম সমাজের উত্থানে ‘শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর’-এর জুজুতে, নিজেদের শতাব্দীপ্রাচীন ক্ষমতার ভিত হারানোর ভয়ে সাধারণ ও উচ্চকোটির বর্ণহিন্দুরা অস্থির হয়ে উঠেছিল কিন্তু এই অস্থিরতা থেকে ভদ্রতার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলা তাদের পক্ষে সহজ ছিল না। “হিংসুটে, তালেবর, ছুঁকছুঁকে, সবজান্তা, গোঁড়া, হাফ-স্বদেশী, এন্টি-মুসলিম কিন্তু…চাকরির সুবাদে এন্টি-হিন্দুও, নিঃসংশয়ে ঘুষখোর…এরাই সেই নতুন শ্রেনী…যাদের ওপর বাংলার রাজনীতি নির্ভর করছে বা করবে” (পৃষ্ঠা ৪১১)  সেখানেই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও বাংলা কাগজ হয়ে ওঠে বর্ণহিন্দুদের ছুপা-মুসলিম ঘৃণার আত্মস্বরুপ। এই ঘৃণা ও ভয়ই শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাগ ডেকে এনেছিল। বাংলার মুসলিম জনমত অখণ্ড বাংলা পাকিস্তানের শাসনাধীন হতেই চেয়েছিল। “তফসিলি সমাজের ভেতর বাংলা ভাগ নিয়ে বিতর্কে যোগেন্দ্র নাথ নিশ্চিতভাবে পরাজিত হলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি যুক্তি দিলেন, বাংলা যদি ভাগ হয় তাহলে পূর্ববঙ্গে বিত্তশালী বর্ণহিন্দুরা অনায়াসেই পশ্চিমে এসে নতুন করে বসবাস করতে পারবে, কিন্তু হতদরিদ্র তফশিলিরা কোথাও যেতে পারবে না। উচ্চবর্ণহীন পূর্ববঙ্গে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের হাতে মারা পড়বে। উত্তরে রাধানাথ দাস নোয়াখালির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে লিখলেন, আমরা যদি পশ্চিমবাংলার পক্ষ থেকে নোয়াখালির নমঃশূদ্রদের আহ্বান করি এদিকে চলে আসার জন্য, তাহলে যোগেনবাবু তাঁর স্বজাতির একজনকেও নোয়াখালিতে ধরে রাখতে পারবেন না। দরিদ্র তফশিলিরাই বরং অনেক সহজে নিজেদের বাসস্থান বদলাতে পারে, কারণ তাদের সম্পত্তি বলে কিছুই নেই।”(চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭) এই কুযুক্তি যে কত ভয়ঙ্কর ভাবে ভুল তা আমরা প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তীর ‘প্রান্তিক মানব’ পড়ার সময় বুঝেছি।

বর্ণহিন্দুর রাগ-ভয়-ঘেন্না শুধু শ্যামাপ্রসাদের বকলমে জ্বালামুখী বক্তৃতা হয়েই বেরোয়নি, তা বেরিয়েছে বিপুল পরিমাণ গোঁড়াহিন্দু ব্যবসায়ী অর্থসাহায্যে তৈরি এক দাঙ্গানির্মাণ কর্মকার্যে। এর এক ছক আমরা দেখি গোপালগঞ্জে যেখানে এক খুঁড়ে তোলা মন্দিরে রাতারাতি বিগ্রহ স্থাপনে য়ার তার চারপাশে ব্রাহ্মণ পাড়া গড়ে তুলে। তারপর কয়েকজন শূদ্রদের সেই মন্দিরের ত্রিসীমানায় জুতো পরে আসার জন্য মারধর বা খুনজখম করলেই কেল্লা ফতে। এই শয়তানি থামাতে গিয়ে এক ভাড়া করা পশ্চিমা বামুন গুণ্ডার ছোঁড়া ইঁটে জখম হয় যোগেন, আর দাঙ্গা থামাতে গিয়ে দোষী হয় দাঙ্গা বাধানোর জন্য।(পৃষ্ঠা ৪৩৫) দেবেশ রায়ের কলমে আমরা পড়ি যোগেন মণ্ডল ও রসিকলাল মণ্ডল লাউজানিতে কিভাবে এক ঘনসম্বদ্ধ, বহুমাত্রিক দাঙ্গাকর্মসূচীকে বানচাল করে। (পৃষ্ঠা ৫৬৭-৫৮১) এর প্রথম মাত্রা হল হিন্দুত্ববাদী কাজকর্মের জন্য স্থাননির্বাচন, ও সেখানে মঠ-অফিস খুলে মোটা মাইনে দিয়ে শিক্ষিত, শহুরে, বলিয়ে-কইয়ে দেখনদার লোক মোতায়েন। “মিশন বা সংঘ বেছে-বেছে এই সব জেলাতেই আসছে…যেখানে হিন্দু বসতির চাইতে মুসলমান বসতি অনেকগুণ বেশি। তাঁরা মধ্য ও উত্তরবঙ্গের হিন্দুপ্রধান জেলাগুলিতে যাচ্ছে না…মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান, বীরভূম – এইসব জিলায় তো সিকিভাগ মুসলমানও নেই। তাই সেখানে (হিন্দু) মিশনও নেই। এমনকি যেখানে আট-আনি মুসলমান, সেখানেও নেই, মুর্শিদাবাদ-দিনাজপুরে।”(পৃষ্ঠা ৫৮১) এই স্থাননির্বাচনের প্রধান কারণ হল, হিন্দুদের মনে সংখ্যালঘুত্বের ভয় প্রতিষ্ঠা করা এখানে সহজ।

দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতা, ১৯৪৬

বর্ণহিন্দুর রাগ-ভয়-ঘেন্না শুধু শ্যামাপ্রসাদের বকলমে জ্বালামুখী বক্তৃতা হয়েই বেরোয়নি, তা বেরিয়েছে বিপুল পরিমাণ গোঁড়াহিন্দু ব্যবসায়ী অর্থসাহায্যে তৈরি এক দাঙ্গানির্মাণ কর্মকার্যে। এর এক ছক আমরা দেখি গোপালগঞ্জে যেখানে এক খুঁড়ে তোলা মন্দিরে রাতারাতি বিগ্রহ স্থাপনে য়ার তার চারপাশে ব্রাহ্মণ পাড়া গড়ে তুলে। তারপর কয়েকজন শূদ্রদের সেই মন্দিরের ত্রিসীমানায় জুতো পরে আসার জন্য মারধর বা খুনজখম করলেই কেল্লা ফতে। এই শয়তানি থামাতে গিয়ে এক ভাড়া করা পশ্চিমা বামুন গুণ্ডার ছোঁড়া ইঁটে জখম হয় যোগেন, আর দাঙ্গা থামাতে গিয়ে দোষী হয় দাঙ্গা বাধানোর জন্য।(পৃষ্ঠা ৪৩৫) দেবেশ রায়ের কলমে আমরা পড়ি যোগেন মণ্ডল ও রসিকলাল মণ্ডল লাউজানিতে কিভাবে এক ঘনসম্বদ্ধ, বহুমাত্রিক দাঙ্গাকর্মসূচীকে বানচাল করে।

দ্বিতীয় মাত্রা হলো, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা কম্যুনাল রায়টের ডিসকোর্স সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া। যেহেতু কলকাতা শহরে বাংলা কাগজপত্র বেশীর ভাগ বর্ণহিন্দুদের হাতে ছিল, মুসলমানদের হাতে ছিল ইংরিজি আর উর্দু কাগজ, তাই পুর্ববঙ্গে নানা জায়গায় ক্রমান্বয়ে রায়টে হিন্দুরা আক্রান্ত এই খবর ক্রমাগত শহুরে ও গ্রাম্য বাঙালী বর্ণহিন্দুদের মধ্যে জাহির করা খুব একটা শক্ত নয়। এই খবর বেশীর ভাগ সময় ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ভুলে ভর্তি, কিন্ত সেই ভুল – জায়গার ভুল নাম, জাতিওয়াড়ি ও ধর্মওয়াড়ি জনসংখ্যার ভুল অনুপাত – এগুলো খুব বিচক্ষণ স্থানীয় লোকপ্রতিনিধি ছাড়া কারোর বোঝার উপায় নেই। কিন্ত এই সুনির্মিত ‘ফেক নিউজে’ কোন খুনের কথা থাকত না, বরং সরকারবাহাদুরের সেপাইরা যে ঠিক সময়ে গিয়ে খুনি মোল্লাদের আটকেছে সেই কথা থাকত। নইলে সরকারপক্ষ থেকে হিংসক গুজব ছড়ানোর অপরাধে সম্পাদকের গ্রেপ্তার হবার ভয় ছিল। কিন্তু এই খবরগুলি পুরোপুরি হাওয়া থেকে তৈরি মনে করা ভুল হবে, গাঁয়ে বিশেষতঃ গরীব মানুষের মধ্যে ঝগড়া-মারামারি-খুনোখুনি লেগে থাকে, যার প্রধান কারণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক, ধর্মভিত্তিক নয়। এই নানা ঘটনার টুকরো টুকরো মালা গেঁথে তাতে সাম্প্রদায়িকতার রং লাগিয়ে তাকে রায়ট বলে চালানো হত। দুই বিরোধী পক্ষে দুই ধর্মের দুটি নাম পাওয়া গেলেই হল। আনন্দবাজারও এই কাজে পোক্ত ছিল বলে শোনা যায়।

তৃতীয় মাত্রা হলো, যারা নিরক্ষর তাদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষের গল্প ছড়িয়ে দেওয়া। স্থানীয় কোন হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ধন্য জনপ্রিয় পির-গাজী-দেব-দেবীর আখ্যানকে একটু বদলে তাতে ইতিহাস থেকে মুসলিম দ্বারা হিন্দু নিপীড়নের মালমশলা ঢুকিয়ে তাকে ‘ইতিহাসের আসল ভাষ্য’ বলে নানা ভাবে প্রচার ও প্রসার করা হত। অতএব আমরা দেখি সংবাদের মাধ্যমে হোক বা লোককথার মাধ্যমেই হোক হিন্দুত্ববাদ আকর্ষক, হিংসক অথচ বিশ্বাসযোগ্য কল্পগল্প তৈরি করায় বড়ই পটু। আর আমার মতে এই দক্ষতার জিন লুকিয়ে আছে ব্রাহ্মণ্য পুরাণরচনারীতির মধ্যে। যেখানে গল্পের ভেলা ভাসিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয় সবকিছু।

১৯৪৬-এর দাঙ্গায় কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে বিধ্বস্ত ‘ইসলামিয়া লাইব্রেরি’

বহুমাত্রিক দাঙ্গাকর্মসূচীর চতুর্থ মাত্রা হলো, এই সব কাল্পনিক দাঙ্গার মিথ্যা হিন্দু ভিক্টিম তালিকা তৈরি করা। বিরাট বড় এক তালিকা তৈরি করা হতো, যেখানে একই জায়গার নাম নানাভাবে বদলে বদলে লেখা থাকত, যেমন একটা গ্রামের বিভিন্ন মহল্লার নাম আলাদা আলাদা গ্রাম হিসাবে লেখা থাকত, আরেক সুচতুর মিথ্যা। এইবারে হিন্দুদের কাছে গিয়ে জনে জনে বলা হত, শহর থেকে অনুদান এসেছে,  আপনারা হিন্দু ভিক্টিম, রিলিফ নিন – টাকা, চাল, কাপড় ইত্যাদি। সৎ মানুষ অবাক হয়ে বলতেন, না না আমরা ঠিকই আছি, কিসের দাঙ্গা, কিসের রিলিফ? নিয়ে যান, লাগবে না। তাঁদের জোরাজুরি করা হত, পাচ্ছেন, রেখে দিন, আমাদের হিসেব মেলাতে হবে। আর মতলববাজ হিন্দুরা বুঝে যেত এই ব্যাসকূট, যে দাঙ্গা লাগান হবে, আর হিন্দু মিশনের পক্ষে লাঠি ধরার জন্য এটা আগাম ঘুষ। এতে হিন্দুত্ববাদী সংস্থাগুলির জন্য দাঙ্গার আরো একটা কাগুজে প্রমাণ তৈরি হ্তো। শহুরে কাগজে এই দাঙ্গাবিদ্ধস্ত-দের দান-ধ্যানের কথা পড়ে বর্ণহিন্দুবাবুদের বুক দশহাত হত, সঙ্ঘের দানপেটী আরও উপচে উঠত। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের এইভাবে দিনের পর দিন কাঠি করে যাওয়াতে, একদিন তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙত, এতদিন ধরে ফুঁকে ফুঁকে তোলা মিছে দাঙ্গার ফুল্কি, মিথ্যেবাদী রাখালবালকের গল্পের মত, একদিন সত্যি দাঙ্গার দাবানল হিসেবে দেখা দিত, তখন গেরুয়াবাদীরা সব দাঁত-নখ বের করে বলত, কেমন? আগেই বলেছিলাম কিনা!

বহুমাত্রিক দাঙ্গাকর্মসূচীর চতুর্থ মাত্রা হলো, এই সব কাল্পনিক দাঙ্গার মিথ্যা হিন্দু ভিক্টিম তালিকা তৈরি করা। বিরাট বড় এক তালিকা তৈরি করা হতো, যেখানে একই জায়গার নাম নানাভাবে বদলে বদলে লেখা থাকত, যেমন একটা গ্রামের বিভিন্ন মহল্লার নাম আলাদা আলাদা গ্রাম হিসাবে লেখা থাকত, আরেক সুচতুর মিথ্যা। এইবারে হিন্দুদের কাছে গিয়ে জনে জনে বলা হত, শহর থেকে অনুদান এসেছে,  আপনারা হিন্দু ভিক্টিম, রিলিফ নিন – টাকা, চাল, কাপড় ইত্যাদি। সৎ মানুষ অবাক হয়ে বলতেন, না না আমরা ঠিকই আছি, কিসের দাঙ্গা, কিসের রিলিফ? নিয়ে যান, লাগবে না। তাঁদের জোরাজুরি করা হত, পাচ্ছেন, রেখে দিন, আমাদের হিসেব মেলাতে হবে। আর মতলববাজ হিন্দুরা বুঝে যেত এই ব্যাসকূট, যে দাঙ্গা লাগান হবে, আর হিন্দু মিশনের পক্ষে লাঠি ধরার জন্য এটা আগাম ঘুষ। এতে হিন্দুত্ববাদী সংস্থাগুলির জন্য দাঙ্গার আরো একটা কাগুজে প্রমাণ তৈরি হ্তো। শহুরে কাগজে এই দাঙ্গাবিদ্ধস্ত-দের দান-ধ্যানের কথা পড়ে বর্ণহিন্দুবাবুদের বুক দশহাত হত, সঙ্ঘের দানপেটী আরও উপচে উঠত। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের এইভাবে দিনের পর দিন কাঠি করে যাওয়াতে, একদিন তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙত, এতদিন ধরে ফুঁকে ফুঁকে তোলা মিছে দাঙ্গার ফুল্কি, মিথ্যেবাদী রাখালবালকের গল্পের মত, একদিন সত্যি দাঙ্গার দাবানল হিসেবে দেখা দিত, তখন গেরুয়াবাদীরা সব দাঁত-নখ বের করে বলত, কেমন? আগেই বলেছিলাম কিনা!

সুনির্মিত ‘ফেক নিউজে’ কোন খুনের কথা থাকত না, বরং সরকারবাহাদুরের সেপাইরা যে ঠিক সময়ে গিয়ে খুনি মোল্লাদের আটকেছে সেই কথা থাকত। নইলে সরকারপক্ষ থেকে হিংসক গুজব ছড়ানোর অপরাধে সম্পাদকের গ্রেপ্তার হবার ভয় ছিল। কিন্তু এই খবরগুলি পুরোপুরি হাওয়া থেকে তৈরি মনে করা ভুল হবে, গাঁয়ে বিশেষতঃ গরীব মানুষের মধ্যে ঝগড়া-মারামারি-খুনোখুনি লেগে থাকে, যার প্রধান কারণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক, ধর্মভিত্তিক নয়। এই নানা ঘটনার টুকরো টুকরো মালা গেঁথে তাতে সাম্প্রদায়িকতার রং লাগিয়ে তাকে রায়ট বলে চালানো হত। দুই বিরোধী পক্ষে দুই ধর্মের দুটি নাম পাওয়া গেলেই হল। আনন্দবাজারও এই কাজে পোক্ত ছিল বলে শোনা যায়।

যোগেন মণ্ডল এই বহুমাত্রিক দাঙ্গাছক এক অতিসফল মডেল হয়ে ওঠার আগেই তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝেছিলেন ও এবং বুঝেছিলেন এই ছকের প্রধান শক্তি হলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ও তাঁর বিষাক্ত, জ্বালামুখী ভাষণ। ঐ ভাষণের কয়েক সপ্তাহ বা এক মাসের মধ্যেই ঐ জায়গায় দাঙ্গা অবধারিত। অতএব যেখানে যেখানে তাঁর প্রভাব ছিল, যেমন গোপালগঞ্জে তিনি শ্যাখ-শুদ্দুর শক্তিকে এক করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে সভা করতে দেওয়া তো দুরস্থান, স্টিমার থেকে নামতেই দেন নি। কিন্তু ধীরে ধীরে রাজনীতিতে কোনঠাসা হতে থাকেন তিনি, এসে যায় ১৯৪১-এর সেন্সাস, যাতে কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভা জোট মরিয়া হয়ে ওঠে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করার, ঢাকার রায়ট যার এক বিষময় ফল, সেই বিষ আরও বাড়িয়ে তোলে আর ছড়িয়ে দেয় শ্যামাপ্রসাদের তত্ত্বাবধানে ‘ফারদার হিন্দু রায়টার রিক্রুটমেন্ট ভায়া সিলেক্টিভ রিলিফ’-এর রাজনীতি।

যারা নিরক্ষর তাদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষের গল্প ছড়িয়ে দেওয়া। স্থানীয় কোন হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ধন্য জনপ্রিয় পীর-গাজী-দেব-দেবীর আখ্যানকে একটু বদলে তাতে ইতিহাস থেকে মুসলিম দ্বারা হিন্দু নিপীড়নের মালমশলা ঢুকিয়ে তাকে ‘ইতিহাসের আসল ভাষ্য’ বলে নানা ভাবে প্রচার ও প্রসার করা হত। অতএব আমরা দেখি সংবাদের মাধ্যমে হোক বা লোককথার মাধ্যমেই হোক হিন্দুত্ববাদ আকর্ষক, হিংসক অথচ বিশ্বাসযোগ্য কল্পগল্প তৈরি করায় বড়ই পটু। আর আমার মতে এই দক্ষতার জিন লুকিয়ে আছে ব্রাহ্মণ্য পুরাণরচনারীতির মধ্যে। যেখানে গল্পের ভেলা ভাসিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয় সবকিছু।

বাংলার তপশিলি-মুসলমান-বর্ণহিন্দুর জটিল রাজনীতির ভাণ্ডার ও আমাদের সমসময়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে তার থেকে কোন কোন অস্ত্র আমরা তুলে নিতে পারি, তা বুঝতে গেলে যোগেন মন্ডলের উত্তরকাণ্ড আরও বহুমাত্রিকভাবে পড়তে হ’বে।

ছবি সূত্র: indianexpress.com ও news18.com

আগামীপর্বে উত্তরকাণ্ড (১৯৪৭-১৯৬৮)

সৌরভ রায়

বাংলা ও ইংরিজি এই দুই ভাষার লেখালেখিতে রত আছেন সৌরভ রায়, এছাড়া বাংলা থেকে ইংরাজিতে নিয়মিত নানা কিছু তিনি অনুবাদ করে থাকেন। তাঁর প্রথম দিকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। প্রায় এক দশক বিজ্ঞাপনী জগতে চাকরি করেছেন। তার পরে চিত্রবিদ্যায় দুটি স্নাতক (Dr. Bhau Daji Lad Museum – Mumbai 2012-13, School of Arts & Aesthetics, Jawaharlal Nehru University – New Delhi , 2014-16) করেছেন এবং Tasveer Ghar Fellowship 2017-18 পেয়েছেন। বর্তমানে দুটি গবেষণাপ্রকল্পের (স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের সেক্যুলারিজম বিষয়ক চিত্রজগত, আন্তর্জালে ভারতীয় Queer পুরুষদের চিত্রজগত) সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া লন্ডনের Stimulus -> Respond Magazine-এর সাহিত্য সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top