।। মানস চৌধুরী ।।
সত্যজিতের প্রতিদ্বন্দ্বী কেবল প্রায় সিদ্ধার্থেরই জগত মাত্র। আর সেই জগতটাকে বানাতে সত্যজিৎ তাঁর দারুণ সামর্থ্যের সবটা ব্যবহার করতে পারেন, সম্ভবত। কেবল ছবিটাকে সিদ্ধার্থেরই জগত বানাতে পারাই তাঁর সেই চাঁছাই (বা বাছাই) কার্যক্রমের ফলাফল।
প্রতিদ্বন্দ্বী অনায়াসে সত্যজিৎ রায়ের সেসব ছবির কাতারে থাকতে পারত যেগুলো আমার অতিশয় অপছন্দের। রোমান্টীয় পলায়নপরতা, ফ্যান্টাসীয় মাপাজোকা বিপ্লকাত্মক ভঙ্গিময়তা, গার্হস্থ্য সংঘর্ষে তাঁর অপেক্ষাকৃত নর্ম্যাটিভদের প্রতি পক্ষপাত, নমনীয় নারীত্ব নির্মাণ – এর সবগুলোই আমার অপছন্দ হবার জন্য পর্যাপ্ত কারণ হতে পারত। কিন্তু সত্যজিতের এই ছবিটি আমার খুবই পছন্দের। এমনকি যদি মেরিটলিস্ট করতে দেয়া হয় – যেহেতু দুই বাংলাতেই মেরিটলিস্ট অতিশয় পছন্দ, হেন কোনো নামজ্ঞাত কবি-সাহিত্যিক পাওয়া যাবে না যাঁরা জীবদ্দশাতেই নিজের ‘শ্রেষ্ঠ সংকলন’ না-প্রকাশ করে শান্তি পেয়ে থেকেছেন, কিংবা এমন কোনো সাহিত্যশিল্প সমালোচক পাওয়া মুস্কিল যিনি গলার রগ ফুলিয়ে কোনো রচনায় না-বলে থাকতে পেরেছেন যে কে বা কী শ্রেষ্ঠ – আমি সত্যজিতের সেরা ছবি হিসাবেই প্রতিদ্বন্দ্বী বাছাই করব। সত্যি সত্যিই। এবং এর সঙ্গে প্রারম্ভিক কালের সুনীল রচিত সাহিত্যকর্মের প্রতি আমার আকর্ষণ, কিংবা বিপ্লবী বা সাবেক-বিপ্লবী চরিত্রগুলোর প্রতি আমার ঈর্ষামুগ্ধতার ব্যাকরণের তেমন কোনো সম্বন্ধ নেই।
এই ছবিটাতে সত্যজিৎ রায় কী ভেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নেন নাই তা আমার জানা নেই। কখনো কোথাও পড়ে থাকলেও ভুলে গেছি। হয়তো সৌমিত্র তখন ব্যস্ত ছিলেন। তবে তিনি সৌমিত্রকে না নেবার কারণে আমার জন্য ছবিটা পছন্দনীয় হওয়া সহজ হয়েছে। এমনিতে অভিনেতা সৌমিত্রের প্রতি আমার কোনোই বিদ্বেষ নেই, বরং দারুণ অনুরাগ আছে। এমনকি তাঁর ‘চ’ ও ‘ছ’-এর প্রভেদহীন উচ্চারণ সত্ত্বেও নাগরিক চরিত্রগুলোতে আমি কোনোরকম সংক্ষোভ ছাড়াই তাঁকে গ্রহণ করে থেকে এসেছি। কিন্তু সত্যজিতের ছায়াছবিগুলোতে তাঁর উপস্থিতির সংখ্যাধিক্যের কারণেই কেবল নয়, তাঁর লাগাতার নিজেরই ম্যানারিজম কপি করতে থাকাতে আমার অত্যধিক ক্লান্ত লাগে। সেটা সমস্যা হয়ে ওঠেনি কখনো ফেলুদা হিসাবে দেখতে; বস্তুত সেটাই সত্যজিতের সৌমিত্রের আমার সবচেয়ে প্রিয় ভার্সন। তবে আসলে হীরক রাজার দেশের ন্যায্যতাপন্থী সৌমিত্রকেও আমার বেশ লেগেছে। যা ও যতটুকু তিনি সেখানে ফর্মুলাভিত্তিক ন্যায়পন্থী, তা ও ততটুকু একেবারেই পরিচালকীয় ফর্মুলাই। ফলে তাঁকে ভাল লেগেছে। তবে অপরাজিতর সৌমিত্র যে মায়া-জাগানিয়া সেটাও অস্বীকারের উপায় নেই। হতে পারে যে অ-ফেলুদা সৌমিত্র সত্যজিতের কেবল এই ছবিটিতেই অনবদ্য।
ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়কে সিদ্ধার্থ হিসাবে গ্রহণ করে সত্যজিৎ ধৃতিমানকে কৃতজ্ঞ করে থাকতে পারেন, আমাকে কৃতজ্ঞ করেছিলেন অনেক বেশি। বস্তুত ধৃতিমান সম্ভবত সত্যজিতের আর একটি মাত্র ছবিতেই কাজ করেছেন – আগন্তুক। এর সুপারম্যান যে চরিত্রটাকে (উৎপল দত্ত) সকলে মিলে অভিমন্যু-বধের মতো করে ঘিরে ধরে আক্রমণ করছিলেন, অতিশয় সরল ফর্মুলার এক দৃশ্য, সেখানে বাক্যবাণ নিঃসরণের ভূমিকায় দেখা গেছিল ধৃতিমানকে। ধৃতিমানের প্রতি আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতার কথা বাদ দিলেও প্রতিদ্বন্দ্বী ছায়াছবিতে তাঁর উপস্থিতির কারণেই অত সহজে কেয়ার (জয়শ্রী রায়, তখন) নমনীয় নারীত্বকে বরদাশত করা গেছে। সিদ্ধার্থের যে নম্রতা আর সূক্ষ্মতাগুলো তা ধৃতিমানের ‘আন্ডারস্টেটেড’ অভিনয়শৈলীতে দারুণ দাঁড়িয়ে গেছে। অবশ্যই সিদ্ধার্থ লাগাতার বিনম্র আর সূক্ষ্ম নন, তিনি কখনো ক্রুদ্ধ, কখনো সংক্ষুব্ধ, কখনো বেয়াড়া ক্রোধ সামলে চাকুরিপ্রার্থীর ‘ভব্যতা’ দেখানোর চেষ্টায় রত। এগুলো উপন্যাস থেকেই গ্রহণ করেছেন সত্যজিৎ, যাতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। উপন্যাস/গল্প থেকে কাজ করতে গিয়ে কাহিনিকারের চরিত্রবিন্যাসকে অধিগ্রহণ করার দক্ষতা সত্যজিতের ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। আমার মনে পড়ে না যে, সন্দ্বীপকে রবীন্দ্রনাথের থেকে বেখাপ্পা রকমের ভিলেনীয় বানানো ছাড়া কিংবা বিমলাকে অধিক পাপবিদ্ধমনাক্রান্ত বানানো ছাড়া গুরুতর কিছু বদল তিনি কখনো করেছেন। কিংবা হয়তো, আরো সূক্ষ্ম দর্শক দাবি করবেন যে কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বের গণশত্রুর ডাক্তারসাহেবও ইবসেনের নির্মাণের তুলনায় অধিক চঞ্চল। যাহোক, এগুলো সব স্বতন্ত্র আলাপ। তাছাড়া ৮০’র দশকের পরের সত্যজিতের উৎপাদন নিয়ে খুব কঠোরভাবে আরেকটা আলাপ না-করতে বসে একটা দুইটা ঢিল ছুঁড়তে আজকে আমি রাজি নই।
সিদ্ধার্থের এক চাকরির ইন্টারভ্যু ছাড়া বৃহত্তর ব্যবস্থার দিকে দৃকপাত না-করতে সত্যজিৎ বদ্ধপরিকর ছিলেন। কোলকাতা শহরের আমলাতন্ত্র ও উচ্চ(মধ্য)বিত্তীয় জীবনপ্রবাহের প্রায় একমাত্র স্মারক হিসাবে ওই চাকুরিপ্রার্থিতাটা হাজির থেকেছে। যা ও যতটুকু বাকি কোনো স্মারক এসেছে তা সিদ্ধার্থের বোনের ‘অনৈতিক’ জীবনের সাথে ‘বড়লোক বস’ যেভাবে যুক্ত থেকেছেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেখানে আছে। ফলে, একদমই বিস্ময়ের না যে চাকরির ইন্টারভ্যুটা অত্যধিক ভারে জর্জরিত একটা দৃশ্য হিসাবে পর্যবসিত হয়েছে…
একটা সত্তাশ্রয়ী রচনার মধ্যে এখন পাঠককে জানানো আমার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু গল্প আমার দারুণ পছন্দের। এখানে বর্গবিভাজন নিয়ে চিন্তিত না হয়ে বললাম – ছোটগল্প, বড়গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি। তার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। আমার যতটা মনে পড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী এবং কেন্দ্রবিন্দু দুইটাই বড়গল্প হিসাবে পুস্তককৃত হয়েছিল। আমার আন্দাজ যে তিনি বিলাতবাসী হলে এদুটোই নভেলা হিসাবে প্রকাশিত হলেও হতে পারত। আবার নব্বই দশকের বাংলাদেশে তিনি বিরাজমান থাকলে প্রকাশকেরা, হুমায়ূন আহমেদের সাথে পাল্লা দেয়ানোর জন্য হলেও, তা উপন্যাস নামেই প্রকাশ করে ছাড়তেন। ফলে এসবের নাম নিয়ে আমার মাথাব্যথা কম। আমি যখন প্রথমবার প্রতিদ্বন্দ্বী ছায়াছবিটি দেখি, আমার একটা অনুভূতি ছিল ‘আহা! তিনি যদি কেন্দ্রবিন্দুটাও ছবি বানাতেন!’ তবে ততোদিনে সত্যজিৎ তাঁর আশির দশকের ওই সংলাপ-উপদ্রুত ছবিগুলো বানাতে শুরু করে দিয়েছেন। যাহোক দুইটা কাহিনি আমার কোন পর্যায়ের পছন্দ তা বোঝাতে গিয়ে এই কথার অবতারণা।
কেন্দ্রবিন্দুর মতো প্রতিদ্বন্দ্বী র মুখ্যনায়ক বা প্রটাগনিস্টও সাবেক নকশাল। বলাই বাহুল্য, পরাস্ত নকশাল। বিজয়ী নকশাল বলতে আসলে কিছু আর ইতিহাসে নেই। যে সময়কালটাতে এইসব পরাস্ত নকশালদের বাংলার, মুখ্যত ভারতের পশ্চিমবাংলা রাজ্যের, সাহিত্যিকেরা চিত্রিত করছেন ঠিক সেই সময়কালটাতে, তার কিছু আগে, নকশালদের সর্বাত্মক সংহারকাজে রাষ্ট্রপক্ষের বিবিধ কারকেরা শামিল হয়েছিলেন। এই কারকদের বিষয়ে জনজবান ও ইতিহাসগ্রন্থে নানান রকমের দিকনির্দেশনা আছে। ইন্দিরা কংগ্রেসের সংহারমূর্তি, ভারতীয় সেনাবাহিনির খতম অভিযান ছাড়াও এমনকি সিপিএমের সংশ্লিষ্টতার বার্তাও ঘুরেফিরে আসে। কথাসাহিত্যের বেশকিছু কাজেও কমবেশি এসবের দিকনির্দেশনা আছে। বলাই বাহুল্য, সত্যজিৎ রায় সেসবের ধারেকাছে যাননি। তিনি মোটের উপর তাঁর কোনো কাজেই রাষ্ট্রের নিপীড়ক ভূমিকা নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তিত হয়েছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া মুস্কিল। হয়তো হীরক রাজার দেশে (১৯৮০) হিসাবের বাইরে রাখলে সদগতিই, টেনেটুনে, একমাত্র ব্যতিক্রম। সদ্গতি (১৯৮১) টেলিভিশন উৎপাদ হবার কারণে, এবং দূরদর্শন এর প্রযোজক হওয়াতে সেটার মাত্রাও খুব স্বতন্ত্র বটে। প্রসঙ্গসূত্রেই জানিয়ে রাখি যে আমি মনে করি দূরদর্শনের প্রযোজিত টেলিভিশন-ছায়াছবির জন্য মুন্সি প্রেমচাঁদের গল্প বাছাই করা এবং বিশেষভাবে সেই গল্পটা বাছাই করা যেখানে নিখিল ভারতের বর্ণবৈষম্যকে নিদারুণ লেন্সে দেখা যায়, সত্যজিতের তরফে সজাগ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল। মুন্সি প্রেমচাঁদের গল্প নিয়ে সত্যজিৎ আগেও কাজ করেছিলেন, সকলে জানেন – শতরঞ্জ কি খিলাড়ি (১৯৭৭), সদগতির বাইরে তাঁর একমাত্র হিন্দি মাধ্যমের কাজ। হতে পারে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত তাঁর দুইটা প্রেমচাঁদের গল্প বানানো, দুইটাই হিন্দি মাধ্যমে, যার মধ্যে একটা আবার টেলিভিশনের জন্য, সাথে হীরক রাজার দেশের মতো রূপকনির্ভর স্যাটায়ার, সবটাই কাকতাল নয়। হতে পারে, ভারতে জরুরি অবস্থা ও ইত্যাদির সাথে সত্যজিতের রাজনৈতিক সত্তার একান্ত যোগসূত্র। কিন্তু আবারো এটা বলা আমার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে যে সত্যজিতের রাজনৈতিক চেতনার স্ফুলিঙ্গ আবিষ্কার আমার মুখ্য আগ্রহের জায়গা নয়; বরং যেভাবে তিনি গড়পরতা রাষ্ট্রভাবনা ও রাষ্ট্রক্রিয়াতে আরামেই থাকতে পেরেছেন (ও চেয়েছেন) তাঁর সেই আরামপ্রবণতাই আমাকে বেশি আগ্রহী করে রাখে। তদুপরি, আমার বিবেচনায় প্রতিদ্বন্দ্বী ও কেন্দ্রবিন্দু দুয়েতেই অল্পবিস্তর অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ ছিল, তাঁর জন্য। এই দুটোর মধ্যে একটাকে বাছাই করার স্বাধীনতা তিনি আলবৎ রাখেন। কিন্তু এটুকু মনে করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, দুটোর মধ্যেও কেন্দ্রবিন্দুর পরাস্ত নায়ককে চিত্রিত করতে গেলে একটা মৃতদেহ দিয়ে শুরু করতে হয়, বা শেষ করতে হয়। আর সেই মৃতদেহ নিজগুণে রাষ্ট্রব্যবস্থাতে পরিচালকের মনোযোগকে টেনেহিঁচড়ে আনতে সক্ষম। মনে হয় নাই কখনো যে এসবে সত্যজিৎ বিশেষ উৎসাহী লোক। আর যেসব বিষয়ে কোনো চিত্র-পরিচালক বা উপন্যাস-লিখিয়ে আগ্রহী নন, সেসব বিষয়ে কেন তিনি আগ্রহী নন ধরে তাঁকে নিয়ে নিন্দামন্দ করার বদলে আমার উৎসাহ বরং এই অনাগ্রহের পাটাতনকে বুঝতে, এবং যা বুঝলাম তা খোলতাই করে বলতে।
তারপরও, প্রতিদ্বন্দ্বী বানাতে গিয়ে তিনি কমবেশি সুনীলের সিদ্ধার্থকে চেঁছেপুছে আলাদা করেছেন। অনেকটা ফোটো যেভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে কাঁচি দিয়ে আলাদা করে; কিংবা ইদানীং তো কম্পুটারেই করা যায়। তারপর সেই অবয়বটাকেই আরেকটা পটভূমিতে চাইলে বসানো যায়। এটাকে বলা হয়ে থাকে জাক্সটাপোজিশন। তবে এ কথা বলা যাবে না যে সত্যজিৎ সুনীলের সিদ্ধার্থকে রাখেননি। রেখেছেন তো বটেই, খুবই হৃদয়কাড়াভাবে রেখেছেন। একথাও মারাত্মক অন্যায় অভিযোগ হবে যে সত্যজিৎ চেঁছেপুছে সিদ্ধার্থকে যে পটভূমির উপর বসিয়েছেন সেটা সুনীলের থেকে নেননি। তিনি সুনীল থেকেই নিয়েছেন। সুনীল থেকেই নিয়ে সেটাকে কমবেশি নিম্নমধ্যবিত্ত গার্হস্থ্য সঙ্কটের মধ্যে প্রোথিত করেছেন – চাকরি না-পেতে থাকা, ছোটভাইয়ের রাজনৈতিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ, নিজের ‘বড়ভাই মার্কা’ দায়িত্ব পালনের চাপ, মোটামুটি একটা হেটারোসেক্সুয়াল জুটির সম্ভাবনা, বোনের ‘অনৈতিক’ জীবনের প্রতি শাসন করার ইচ্ছা ও সামর্থ্যের অভাবের টানাপড়েন। মোটামুটি এই। তাঁর চাঁছাই কার্যক্রমটা সেই হিসাবে একটা বাছাই কার্যক্রম। সিদ্ধার্থের এক চাকরির ইন্টারভ্যু ছাড়া বৃহত্তর ব্যবস্থার দিকে দৃকপাত না-করতে সত্যজিৎ বদ্ধপরিকর ছিলেন। কোলকাতা শহরের আমলাতন্ত্র ও উচ্চ(মধ্য)বিত্তীয় জীবনপ্রবাহের প্রায় একমাত্র স্মারক হিসাবে ওই চাকুরিপ্রার্থিতাটা হাজির থেকেছে। যা ও যতটুকু বাকি কোনো স্মারক এসেছে তা সিদ্ধার্থের বোনের ‘অনৈতিক’ জীবনের সাথে ‘বড়লোক বস’ যেভাবে যুক্ত থেকেছেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেখানে আছে। ফলে, একদমই বিস্ময়ের না যে চাকরির ইন্টারভ্যুটা অত্যধিক ভারে জর্জরিত একটা দৃশ্য হিসাবে পর্যবসিত হয়েছে। সম্ভবত, এই ছায়াছবিটার সবচেয়ে দুর্বল এবং/বা স্থূলার্থময় অংশ।
এসব মন্দকথা বলেও আমি ছবিটিকে সত্যজিতের বানানো আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি হিসাবে দাবি করছে কেন ও কীভাবে এই প্রশ্ন দেখা দেয়া খুবই সঙ্গত। আসলে সিদ্ধার্থকে বৃহত্তর রাষ্ট্রীক-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমি থেকে সরালেও দারুণ এক অন্তর্গত কোমল সিদ্ধার্থ আস্তে আস্তে করে উদ্ভাসিত হন ছায়াছবিটিতে। তাঁর সংক্ষোভ এবং সহিষ্ণুতা, তাঁর হতোদ্যমতা আর হীনম্মন্যতা, তাঁর কর্তব্যবোধ ও ক্লিষ্টতা, তাঁর প্রণয় ও পলায়নপরতা সবকিছুর একটা মসৃণ মিশেল আমি পাই এই ছায়াছবিতে। সত্যজিতের প্রতিদ্বন্দ্বী কেবল প্রায় সিদ্ধার্থেরই জগত মাত্র। আর সেই জগতটাকে বানাতে সত্যজিৎ তাঁর দারুণ সামর্থ্যের সবটা ব্যবহার করতে পারেন, সম্ভবত। কেবল ছবিটাকে সিদ্ধার্থেরই জগত বানাতে পারাই তাঁর সেই চাঁছাই (বা বাছাই) কার্যক্রমের ফলাফল। সেজন্যই, সিদ্ধার্থের নিরঙ্কুশ জগত উদ্ভাসিত করবার দক্ষতার কারণেই, চাঁছাই কার্যক্রমটাকেও বরদাশত করা গেছে। সিদ্ধার্থের সেই জগত অন্তর্গত, সূক্ষ্ম, প্রতিদ্বন্দ্বিতাময়, বিযুক্তির লিপিকার, ও পরিশেষে বিষাদকর; ঠিক যেভাবে ইংরাজি মেলানকোলিয়া শব্দের প্রয়োগ ঘটে থাকে। ওই স্বাদটার কারণেই, ওই নম্রগতির কারণেই, এমনকি ইন্টারভ্যু বোর্ডের স্থূল দৃশ্যময়তার পরও, এই ছবিটা কেমন যেন স্বাদ-লেগে-থাকা স্বাদ দিয়ে যায়।
তারপর, কেয়ার সাথে একটা কেমন যেন, মিঠা মিঠা, আধো আধো, প্রণয়-উদ্ভাসের সময়েই তাঁর চাকরিটা হয়। কিন্তু একই সাথে তাঁর কোলকাতাতেই একটা চাকরি হবার আগ্রহ বা ‘স্বপ্নে’র সৌধ হয়ে যায় এতে। ধৃতিমান বলেই কিনা, যেমনটা আগেও বলেছি, ওই আধো-আধো উদ্ভাসে তাঁর ‘অপৌরুষময়’ উপস্থিতি কেয়ার বাসাতে আচমকা ওই বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফর্মুলাভিত্তিক প্রণয়কালে দারুণ মিষ্টিই থেকে যায়। জয়শ্রী রায় (পরবর্তীতে যিনি জয়শ্রী কবির বলে পরিচিত, ও বাংলাদেশবাসী হন) ওই বিনম্র-নাজুক-মায়াময় চরিত্রে মনকাড়া মায়াবী হয়ে থাকতে থাকেন। সিদ্ধার্থের ছোটভাইয়ের (নাম ভুলে গেছি) তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে-থাকাটা তখন যেন দর্শককেই বিদ্ধ করে রাখে – এ কি হার? এ কি জিৎ? এ কি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের অধিকন্তু রাজনৈতিক কর্তব্যবোধের অবলুপ্ত নিশানা? একই ভাবে কেয়াও বিরাজ করতে থাকেন – এই বিচ্ছেদ কি দুর্বহ? কাঙ্ক্ষিত? এ কি যুগলপ্রেমের বিবাহ-ফর্মুলার চাপমুক্ত হতে পারল? এইসব আটপৌরে অথচ তীব্র, সূক্ষ্ম অথচ গাঢ় অনুভূতিগুলো মাথাময় কিলবিল করতে থাকে। তখনই সিদ্ধার্থ তাঁর কোলকাতার জীবন ছেড়ে ছোট্ট শহরটাতে (পশ্চিম দিনাজপুর কি?) বিপণন কর্মচারির চাকরিটা নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হন। তারপর ছোট্ট হস্টেলটার জানালা খোলেন যখন সিদ্ধার্থ, তখন সেই শৈশবের পাখিটা জানালার বাইরে থেকে ডাক দিয়ে ওঠে। আরেকটা জগতের সাথে সম্পৃক্ত হন সিদ্ধার্থ, সত্যজিৎ, সুনীল, আর ছবির দর্শকেরা, সেই জগত যাতে না-ঢুকতে মরিয়া চেষ্টা ছিল সিদ্ধার্থের। অথচ যেখানে নিমেষের মধ্যে, পরম মসৃণতায়, যেন বা পাখিটা একটা উপলক্ষমাত্র, চালান করে দিল। এ শুধু সিদ্ধার্থের বা তাঁর দর্শকদের নস্ট্যালজিয়াক্রান্তি নয়। কিংবা পলায়ন তো আরো নয়। বরং এটা একটা সেতুবন্ধ। নিরন্তর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে থাকা সত্তাগুলোর মধ্যকার সেতু, একটা সুলাহ; অবসাদের নিষ্পত্তি।
সিদ্ধার্থের চিঠিখানা আসলে ঠিক তখনই লেখা চলে। প্রেমিকা হোন বা না হোন, যখন আপনি প্রশমিত, সমাধিস্থপ্রায়, সেই নিরুত্তেজিত আপনিটা কয়েকটা শব্দ যখন তাঁর উদ্দেশ্যে লেখেন, যার নাম চিঠি, তখন শব্দগুলো কালান্তরের সার্বভৌম বাণী হয়ে ওঠে। প্রেমও তখন গৌণ হয়ে পড়ে। বাণী তখন প্রেমেরও অধিকন্তু। নিস্তরঙ্গ চরাচরের মধ্যে সিদ্ধার্থ যেন সেই পাখিটার আওয়াজ, যে পাখিকে আমরা কেউ দেখতে পাইনি!
(১০, ২৭ অক্টোবর ২০২১।। আদাবর, ঢাকা। রাত ৭:৪৮)
মানস চৌধুরী
জন্ম: বরগুনা, ২৮ মার্চ ১৯৬৯
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক। লেখক, সংকলক ও অনুবাদক। শিল্পকলার পত্রিকা Depart-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর। জন্ম বরগুনা, ২৮ মার্চ ১৯৬৯।
লেখকের বিদ্যাজাগতিক বই:
১. নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ (রেহনুমা আহমেদ-এর সঙ্গে যৌথ বিরচিত), একুশে পাবলিশার্স, ঢাকা ২০০৩।
২. কর্তার সংসার: নারীবাদী রচনা সংকলন (সায়দিয়া গুলরুখ-এর সঙ্গে যৌথ সম্পাদিত), রূপান্তর প্রকাশনা, ঢাকা ২০০০।
৩. এইডস ও যৌনতা নিয়ে ডিসকোর্স (সায়দিয়া গুলরুখ-এর সঙ্গে যৌথ বিরচিত), রূপান্তর প্রকাশনা, ঢাকা ২০০০।
৪. নৃবিজ্ঞান পরিচিতি (প্রশান্ত ত্রিপুরা ও রেহনুমা আহমেদ-এর সঙ্গে যৌথ বিরচিত), উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ২০০২।
৫. মুক্ত আলোচনা (আইনুন নাহার-এর সঙ্গে যৌথ সম্পাদিত), নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ২০০০।
৬. সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞান (নুরুল আলম এবং আইনুন নাহার-এর সঙ্গে যৌথ সম্পাদিত), নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ২০০০।
৭. চর্চা (জহির আহমেদ-এর সঙ্গে যৌথ সম্পাদিত), নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ২০০১।
লেখকের ছোটগল্পের বই:
১. কাকগৃহ, পাঠসূত্র, ঢাকা ২০০৮।
২. আয়ানাতে নিজের মুখটা, বাঙলায়ন, ঢাকা ২০১০।
৩. ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু, বাঙলায়ন, ঢাকা ২০১০।
লেখকের ইলেকট্রনিক প্রকাশিত বই:
১. ইনফ্লুয়েঞ্জা ও অন্যান্য কবিতা, স্বপ্নছেঁড়া প্রকাশনী, ২০০৬।
www.geocities.com/sristi_manos/index.html
২. কাকগৃহ, স্বপ্নছেঁড়া প্রকাশনী, ২০০৭।
www.geocities.com/sristi_mag/ebook/manos/index.html
৩. ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু, স্বপ্নছেঁড়া প্রকাশনী, ২০০৭।
www.geocities.com/sristi_mag/ebook/manos2/index.html