আজ বৃহস্পতিবার, ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

প্রাক

।। অভিষেক ঝা ।।

                                      

সারা শরীরে ঘাস মেখে গাছেদের সাথে লুকোচুরি খেলা। এসব খেলতে খেলতে কখন যেন তার সাত বছরের মেয়েটা মরে  গেল— শুকরু আলাদা করে গা করে নি। সব্বার চোখ ফাঁকি দিয়ে এ বাগানের এক গাছের নিচে গোর দিল মেয়েকে। বাগানে গেল না কিছুদিন। আবার গেল  কিছুদিন পর… না গিয়ে তো ভালো ছিল না। হামাগুড়ি দিয়ে গাছটার নিচে গেল আরও কিছুদিন পর। তারপর গলা উঁচু করে কুকুরের মত কেঁদে নিল খানিক। একদিন…দু দিন… কয়েকদিন।  তারপর আবার ব্যাঙ আর ঘাস ঘাস খেলা।

প্রাক

তারপর পুরো গল্পটা জুড়ে ঘুমে চোখ বুজে আসা ঘাসেদের দপ করে জেগে ওঠা এক গন্ধ মরে যাওয়া আরেক গল্পের ভিতর গল্প হয়ে ঢুলতে থাকল।



— গাছ
— মাটি
— মানুষ লাগে । মানুষ লাগে।
— মানুষ মানুষ লাগে।
— লাগে।
— মাটি।
— বাল।
— বাল লাগে। বালই লাগে। 
— লাগে।
— মাটি।

বেঁচে থাকতে মেয়েটাকে সে অত গায়ে লাগায় নি হয়ত, যতটা গায়ে লাগাতে থাকল এ বাগানের মাটির তলে মেয়েটাকে রেখে দিয়ে। কান পেতে শুনতে চাইত গাছটার বুকে মাথা দিয়ে। ফিসফিসে কোন গলা ঘুরপাক খাচ্ছে কিনা ভিতর-গাছে ঠাওরাবার চেষ্টা করত । বাসন মাজার আওয়াজ, দেশলাই জ্বালানোর আওয়াজ , জবাইয়ের সময় ফট করে বুজে আসা বাঁচতে চাওয়া চোখের শব্দ, কফ ফেলার শব্দ সব পেত… জায়গাটার সামনে ব্যাঙ হয়ে বসে  থাকত সে। নামাজের পর নামাজ ভেসে আসত দূর থেকে।

যদি কবরের উপর ঘাস গজায়, গাছ বেড়ে ওঠে— মানে কবরটা জুড়ে একটা জীবন— জীবন ভাব লকলক করতে থাকে কৈশোরের খাবি খাওয়া হাত মারতে  চাওয়ার মতো, তখন কবরের ভিতর শুয়ে থাকা সম্পর্কটা আবার আলোর মুখ দেখতে পায়। তাই তার মানুষ-গাছ-মাটি লাগে, সবশেষে সবকিছুকে লাগে বাল, কারণ সে তখন লকলকেভাবে জীবন্ত।

এ আমবাগানটার দেখভাল শুকরু হক করে আসছে তিন-পুরুষ। ছমারু আর হেকম্যানের মরার পর যখন আলো-জল-বাতাসের মতো নিয়ম মেনেই শুকরু এ বাগানের সাথে জুতে গেল সেদিনের বিকালটা ছিল শুরা লাগা খেসারির ডালের মত।  চান করে, কড়কড়া লাটিম লুঙ্গি পরে শুকরু এসেছিল সতীশ উপাধ্যায়ের দালানে। বসেছিল চকমিলানো বারান্দার এক কোণে। প্রতিবারের মত একটা কোণ ভাঙা চীনামাটির প্লেটে একটা কেকের টুকরা, আর ডান্ঠি ভাঙা কাপে চা এসেছিল। শুকরু জানে এটা বড়দিনের কেক। ছোটবেলা থেকে এ বাড়িতে আসে সে । চকমিলানো বারান্দার আরেক কোণে আব্দুল রউফ আর সতীশ উপাধ্যায় চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। রউফ আর উপাধ্যায় যে বিষয় নিয়ে ইষদ দুঃখ পেয়ে বৈকালিক চায়ে চুমুক  দিচ্ছিল তার কোনোকিছুই শুকরু বুঝে উঠতে পারছিল না, তবু সে জানে এসব সময় শুকরুদের মুখ মির্জা আর উপ্যাধ্যায়দের মুখ দেখে ঠিক করে নিতে হয়। তার  বড়দাদা ছমারু শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিল তাকে এ বাড়িতে পা দেওয়ার আগেই। শুকরু বুঝেছিল সোভিয়েত বলে কেউ আজ মারা গেছে, আর কানে লেগেছিল রউফ মির্জার গলা “বুঝলা হে সতীশ, কিছুই না থাকলে আর কী নিয়ে কাঁদব আমরা? কাঁদার জন্যও তো আঁকড়ে ধরার মতো কিছু চায়। আঁকড়ে ধরে হাউহাউ করে না কাঁদতে পারলে কি আর নতুন স্বপ্ন দেখা যায় হে?” “ শুকরু তুঝক গঙ্গা দিয়ারার  খাসমহলক বাগিচা দেখনো পড়েহ হো”… সতীশ উপাধ্যায় কম কথার মানুষ।

 বাগানের পাতা ছাড়া দেখেই আন্দাজ পেতে পারে এ দিয়ারার সবকিছুতে তেমন চোখ শুকরুর কোনোকালেই ছিল না। তার ছিল কান। খাসমহলের শুধু গোপালভোগ গাছে ভর্তি এই বাগানে সে কত কথা যে শুনতে পেত! বাগান জুড়ে  তখন শুধু সে, সার সার একশো দু’শো বছর পুরানা গোপালভোগ গাছ আর ভার হয়ে চেপে থাকা বিকাল বা কালীর মাই-এর মতো ঝুলতে থাকা রাত। সে শুনলো ঘড়ঘড় করে ইঁদারা থেকে জল তুলতে তুলতে ঝপাং করে বালতি ছিঁড়ে জলে পড়ে গেল… এত আওয়াজ কি বালতি পড়লে হয়… নাকি বালতি শুদ্ধ কেউ? লকড়ী ফাড়ার শব্দ… অথচ বাগানে সে একা । প্রথম প্রথম ভয় পেত খুব। তারপর  একদিন ছমারুর গলা শুনতে পেল এক গাছ থেকে। রিঠা মাছের গায়ের মত ছিল দুপুরটা। আলো পিছলাচ্ছিল মেঘের গা থেকে। দক্ষিণ পূর্বে মাচানা থেকে পঞ্চাশ পা দূরে থাকা গাছটা ছমারু গলায় বলেছিল, “ডর না পাও। গাছের গোড়া যখন পানি টানে তখন মানুষ মানুষ লাগেক সবকিছু। কানপট্টি তোর আমারই মত হইছে, তোর  বাপের ছিল তিখা চোখ তাই শুনতে পেত না কিছুই, তাই তোকে এসব কিছু বাতায় নি… ঘাপটি মেরে যদি গাছেদেরও ফাঁকি দিয়ে ঘাস করি নিস লিজেকে, শুনতে পাবি  মরে যাওয়া মা- বাপ কে… আর বজরার পর বজরা চলে যাওয়ার আওয়াজ পেলে  জানবি…”। শুকরু ডরহীন ভাবে শুনত তারপর থেকে । খালি শুনতোই। চোখ বুজে শুনলে মনে হয় বা যেন দেখছিও। বাগানে অন্য কোন মানুষ না থাকলে সে দু পায়ে হাঁটতে পারত না আর। হামগুড়ির চেয়েও আপন ছিল ব্যাঙের মতো চলা।  তার চেয়েও কাছের ঠেকে ন্যাংটো হয়ে সারা শরীরে ঘাস মেখে গাছেদের সাথে লুকোচুরি খেলা। এসব খেলতে খেলতে কখন যেন তার সাত বছরের মেয়েটা মরে  গেল— শুকরু আলাদা করে গা করে নি। সব্বার চোখ ফাঁকি দিয়ে এ বাগানের এক গাছের নিচে গোর দিল মেয়েকে। বাগানে গেল না কিছুদিন। আবার গেল  কিছুদিন পর… না গিয়ে তো ভালো ছিল না। হামাগুড়ি দিয়ে গাছটার নিচে গেল আরও কিছুদিন পর। তারপর গলা উঁচু করে কুকুরের মত কেঁদে নিল খানিক। একদিন…দু দিন… কয়েকদিন।  তারপর আবার ব্যাঙ আর ঘাস ঘাস খেলা।

বেঁচে থাকতে মেয়েটাকে সে অত গায়ে লাগায় নি হয়ত, যতটা গায়ে লাগাতে থাকল এ বাগানের মাটির তলে মেয়েটাকে রেখে দিয়ে। কান পেতে শুনতে চাইত গাছটার বুকে মাথা দিয়ে। ফিসফিসে কোন গলা ঘুরপাক খাচ্ছে কিনা ভিতর-গাছে ঠাওরাবার চেষ্টা করত । বাসন মাজার আওয়াজ, দেশলাই জ্বালানোর আওয়াজ , জবাইয়ের সময় ফট করে বুজে আসা বাঁচতে চাওয়া চোখের শব্দ, কফ ফেলার শব্দ সব পেত… জায়গাটার সামনে ব্যাঙ হয়ে বসে  থাকত সে। নামাজের পর নামাজ ভেসে আসত দূর থেকে। ন্যাংটো হতে লজ্জা লাগত খুব এইখানে। একদিন  লজ্জা ছেড়ে লুঙ্গি খুলে ফেলল। ঘাস মাখামাখি করল। পাছা উপুড় করে যেখানে মেয়েকে পুঁতে দিয়েছে সেখানে শুয়ে থাকল। ঘাসগুলোতে গরম ভাপ দিল ট্যালট্যালা সাদা ফ্যাদা। সেদিন শুকরু জল কেটে যাওয়া বজরার আওয়াজ  শুনেছিল মাটির ভিতর। সব বজরা জল কেটে চলে গেলে পড়ে থাকে গাছ, মাটি, মরে যাওয়া সব মানুষ আর মনকেমন এক বাল।  ভাগ্যিস শুকরু দেখতে জানে না, হেকম্যান বেঁচে  থাকলে শুকরুকে বলে দিত গঙ্গায় যে রঙ ধরেছে এ বাগান যেতে খুব বেশি হলে এক বছর। ছমারু জানে এই বছরভর মাটির তল দিয়ে বজরা ছাড়া আর কিছুরই আওয়াজ পাবে না শুকরু… 

ফটোগ্রাফ- অতনু সিংহ

অভিষেক ঝা

জন্ম ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার গঙ্গা দিয়ারা অঞ্চলে।  কর্মস্থল কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ির তিস্তা অববাহিকায় অবস্থিত। বর্তমানে বসবাস করেন জলপাইগুড়ি শহরে। অভিষেক মূলত গদ্যকার। তার গদ্যের একমাত্র সংকলন “হোঃ” নিষাদ থেকে প্রকাশিত। গদ্য লেখার পাশাপাশি অনুবাদও করে থাকেন অভিষেক। অদ্বয় চৌধুরির সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন ‘কাশঃ কাশ্মীরি পণ্ডিত ও  কাশ্মীরি মুসলমানদের সাম্প্রতিকতম  ছোটোগল্পের অনুসৃজন’ । অভিষেকের সম্পাদনায় অহমীয়া ও অহমীয়া দোয়ান থেকে অনূদিত ‘ত্রস্তের শিকড়বাকড়: নির্বাচিত মিঁঞা কবিতা’ এখন অবধি যেকোনো ভাষায় মিঞা কবিতার একমাত্র সংকলন। 

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top