।। সোহেল হাসান গালিব ।।
জলাতঙ্ক
তোমার নগ্নতাটুকু না-হয় আমিই ঢেকে দেব। বাঘের সমস্ত ক্ষুধা নিয়ে আহত হরিণকে দেব শুশ্রূষা—ঘাস চিবিয়ে সবুজ রস লাগাব তার জখমে।
তাই বলে সন্ত আমি নই। আছে হস্ত-পদ-স্কন্ধে তালের মতন এক মস্তকের ভার। আছে এ দেহের অন্ধকূপে অনন্ত পিপাসা। তৃষ্ণার্ত কুকুর হয়ে তবু—জলে শুধু মুখ দেখে ফিরে যাব—
ফিরে যাব, একসিন্ধু জলাতঙ্ক নিয়ে।
শিখণ্ডিত
অন্ধকারের রঙে ও রেখায় জেগে উঠল যে ছবি, আমি পাল্টাতে চাই তার আদল—তোমার ভেতর তাপমান-যন্ত্রের মতো নিজেকে ডুবিয়ে এই সত্য লাভ হলো।
দীর্ঘ ধূসর দেয়ালে বেগুনিবর্ণ একটা লম্বা দাগ কেটে চলে গেছে কেউ, সেমিট্রির পাশ দিয়ে, বিষণ্নতা-নাম্নী কোনো একগুঁয়ে বালিকার পিছনে পিছনে। সেই মেয়েটি এ দেশের নয়, তুমিই বলেছিলে। যে দেশে তার বাস, সেখানে শরতে শিশির তুহিন হয়ে ঝরে।
ঐসব আগুলে ছুঁলেই—একবার—কোনোমতে আঙুলে ছুঁলেই—হয়ে যাবে ফ্রিজ—যাকে বলে বরফমুরতি, তুষারতনু। তারপর অণুতে অণুতে প্রিজমের প্রাণ—ছড়িয়ে পড়বে বিবর্ণতা-নাম্নী এক রঙধনু।
আমি কি শুনতে পাব সেই ধনুকের টঙ্কার, প্রবাসের প্রদোষচূড়ায় উঠে কোনো একদিন? আমার একটি বাক্য যার ভগ্ন তির হয়ে ছুটে এসে, হে আলোকতৃণ, পড়েছে পায়ের উপর লুটিয়ে তোমার।
চিহ্ন
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পাগলনাথের মন্দির। মন্দিরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বাজার। নাম পাগলা বাজার।
কতদিন আগে? ঝাঁ ঝাঁ দুপুরবেলা বাসে যেতে যেতে ভাবি। সময় কি তবে স্তব্ধ হয়ে থাকে ইতিহাসের পাতার বাইরে কোথাও? হতে পারে?
অশথ-পাতার আড়ালে মন্দিরটিকে দেখি। সে প্রায় চোখেই পড়ে না। বাজারের কোনায় যেন কাঁচুমাচু বসে আছে এক বুড়ি। মুখে তার ভাঁজ, সহস্র রেখা—শতাব্দীমলিন।
‘অসহায়’ শব্দটি এই প্রথম মনে হলো, ঘাপটি মেরে থাকে ভিড়ের মধ্যেই। দাফন শব্দের মধ্যে যেমন লুকিয়ে থাকে কফিন। যেমন দেশভাগ মানেই দেশত্যাগের প্রসঙ্গ।
প্রসঙ্গ বদলের আগে আরও একবার তাকিয়ে দেখি। নিজেরই দিকে নাকি? কখন ছুটন্ত গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ে মন!
এই পাগলায়, পাগলনাথের চিহ্ন মিশে যাচ্ছে দ্রুত— চুপসে যাওয়া এক দুপুরের দীর্ঘশ্বাসের ভিতর।
আনুগত্য
পথের উপর নুয়ে ছিল গাছের একটি ডাল। মদিনায় ঢুকতে, মুহম্মদ এইখানে এসে এই গাছের কাছটা, মাথা নিচু করেই পেরুতেন। তার সঙ্গীরাও অনুসরণ করতেন তাকে। কেউ ভুলেও ভাবেন নি ডালটি কেটে ফেলার কথা।
কিন্তু মুহম্মদের মৃত্যুর পর একদিন গোটা গাছই ভেঙে পড়ল, ভীষণ এক মরুঝড়ে। তারপরও সাহাবিরা যতবার যেতেন ঐ পথ দিয়ে, মাথা নিচু করে যেতেন।
পৃথিবীর সব পথের ধারে গাছ নেই। নেই ছায়াবীথি। আছে তবু ডালপালা দিয়ে আকাশ-ছোঁয়া কিছু বিটপী-বটের স্মৃতি। চলেছে সবাই, আপন মনে, একটু হেলে, খানিকটা মাথা নিচু ক’রে।
প্রচ্ছদের ছবি: স্ট্যানলি ইঞ্চবোল্ড, যুক্তরাজ্য
সোহেল হাসান গালিব
জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৯৭৮, টাঙ্গাইল। বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। সহযোগী অধ্যাপক ও প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ, নায়েম, ঢাকা। প্রকাশিত বই : কবিতা— চৌষট্টি ডানার উড্ডয়ন [সমুত্থান, ২০০৭] দ্বৈপায়ন বেদনার থেকে [শুদ্ধস্বর, ২০০৯] রক্তমেমোরেন্ডাম [ভাষাচিত্র, ২০১১] অনঙ্গ রূপের দেশে [আড়িয়াল, ২০১৪] তিমিরে তারানা [অগ্রদূত, ২০১৭] ফুঁ [বাতিঘর, ২০২০] প্রবন্ধ— বাদ-মাগরিব (ভাষা-রাজনীতির গোপন পাঠ) [অগ্রদূত, ২০১৮] সম্পাদিত গ্রন্থ— শূন্যের কবিতা (প্রথম দশকের নির্বাচিত কবিতা) [বাঙলায়ন, ২০০৮] কহনকথা (সেলিম আল দীনের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার) [শুদ্ধস্বর, ২০০৮] সম্পাদনা [সাহিত্যপত্রিকা] : ক্রান্তিক, বনপাংশুল। ই-মেইল : galib.uttara@gmail.com
খুব ভালো লাগলো
সত্যি মখমলি ছোঁয়া পেলাম। সকালটা অনেক সুন্দর হয়ে গেল।
“অন্ধকারের রঙে ও রেখায় জেগে উঠল যে ছবি, আমি পাল্টাতে চাই তার আদল—তোমার ভেতর তাপমান-যন্ত্রের মতো নিজেকে ডুবিয়ে এই সত্য লাভ হলো।” – চমৎকার চিত্রল এই কথাগুলো মনকে নাড়া দিয়ে গেল।
“পৃথিবীর সব পথের ধারে গাছ নেই। নেই ছায়াবিথি। আছে তবু ডালপালা দিয়ে আকাশ-ছোঁয়া কিছু বিটপী-বটের স্মৃতি। চলেছে সবাই, আপন মনে, একটু হেলে, খানিকটা মাথা নিচু ক’রে।” – কী চমৎকার আর পরিপাটি এই কথাগুলো। নিগূঢ় ও আত্মিক এক-জীবনদর্শন অত্যন্ত নিপুণ কারুকাজে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এই শব্দগুচ্ছের মধ্য দিয়ে। অসম্ভব ভালো লাগল।