।। শেখ সাদ্দাম হোসাইন ।।
তাঁর গায়ে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের মতো ময়লা শাল জড়ানো থাকে! আমি মার্ক টোয়েনের ‘জিনিয়াস’ কবিতায় পড়ছিলাম, ‘যার চুল উশকোখুশকো, জামা ময়লাযুক্ত সে জিনিয়াস!’ আমার হাসি পায় কবিতাটা পড়লে! যা-হোক আমরা একটা টিলার উপর জুতো ছেড়ে বসি। আমি তারে জিজ্ঞাসা করি, স্যার, আপনি আজ কতদিন হইলো গরম ভাত না খেয়ে আছেন? তিনি কাঁচাপাকা দাড়িতে মিটিমিটি হেসে উত্তর দেন:
– ওহো, আমি তো ভুলেই গেছিলাম খাওয়ার কথা; দুদিন আগে সম্ভবত আমি খেয়ে থাকবো।
আমার পড়ার ঘর বলতে বারান্দা। বারান্দার এক কোণায় এক ড্রয়ার বিশিষ্ট একটা কদম কাঠের সস্তা টেবিলে বসে আমি পড়ি। আজ অনেক রাত হয়েছে— এত রাত পর্যন্ত সাধারণত আমি পড়ি না। আব্বা ফিরে নাই এখনো। আজকাল তারে আব্বা বলতেও মনটা বিষিয়ে ওঠে!
বাইরে দাঁড়িয়ে কারা যেন কথা বলে, খুব একটা শব্দ করে তারা কথা বলে না তবু রাতের নিস্তব্ধতা চারিদিকে ছড়িয়ে থাকায় অনেক দূর থেকেও তাদের আলোচনা শুনতে পাওয়া যায়। দু-চারটা শিয়ালের ডাকাডাকির শব্দ ছাড়া কয়েকটা পাতা ঝরে পড়ার শব্দও কানে আসে। বাইরে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে যে দু’জন কথা বলে তাদের মধ্যে একজন আমার বাবা আরেকজন এলাকায় কুকামের রোল মডেল। তাদের মধ্যে অনেক পিরিত। তারা একলগে বাইকে ঘুইরা বেড়ায়, এক কালারের শার্ট পইরা মাঞ্জা মাইরা বাজার কাঁপায়। লোকে আমারে নিয়া আড়ালে বলাবলি করে, আমি নাকি জালেমের ঘরে আলেম হইছি!
এত রাতে কার সর্বনাশের পরিকল্পনা করে কুকর্মের গডফাদারেরা! বাবার হাতে গোল-গোল বিচির মতো কিসের পুল্টা যেন হিরাজ রহমত ধরায় দেয়। হিরাজ থেকে সে এখন হিরু হইছে। গেল নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র সে একাই পাহারা দিছে। আমার বন্ধুদের মুখে শুনছি ওর কাছে নাকি মেশিনও আছে। আমার নিজ চোখে দেখা, গেল নির্বাচনে স্বতন্ত্র পার্টির লোকেরা ক্যাম্পেইন করতে বাইর হইলে তাদের লিডারের পকেটে সে নিজ হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে সেই টাকা নিজেই বের করে এনে মানুষের সামনে তাকে টাকা বিলিয়ে ভোট কেনার অভিযোগে মারধর পর্যন্ত করে। হিরাজ রহমতদের কারো কিচ্ছু বলার সাহস নাই কারণ পুলিশ তাদের পক্ষে।
নির্বাচনের পরে এলাকায় এককভাবে ইয়াবা সাপ্লাইয়ের ডিলারশীপ নিয়া নেয় সে; সে ছাড়া অন্য কেও গুটি বেচলে পুলিশ আইসা ধইরা নিয়া যায়, কয়দিন আগে একজনরে ক্রসফায়ারেও দেয়া হইছে। এলাকায় ডিশ লাইনের ব্যবসা করে হিরু, বালু ফেলার ট্রলার আছে তার। রাতারাতি মেলা ট্যাকাপয়সা কইরা এলাকায় গদি কইরা বসছে সে। এলাকার বিচার আচারে হিরু যার পক্ষে সেদিকেই রায় যায়। মাঝেমধ্যেই সে এলাকায় বাইকের মহড়া দেয়, পোলাপানরে খাওয়ায় দাওয়ায়, বাইকের তেল খরচ দেয়। এলাকার যুবকদের জন্য সবধরণের নেশাদ্রব্যের সহজলভ্যতা কইরা দিছে হিরু রহমত। চেয়ারম্যানের ডান হাত সে; থানা, পুলিশ সবার লগে তার খাতির।
আমার বাবা এমন ছিল না। আমাদের ছিল সুখী সংসার। একদিনের ঘটনা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। অমন প্রেম আমি আর কোনোদিন দেখি নাই, কোত্থাও দেখি নাই। আমি তখন একেবারেই ছোট। বর্ষাকাল। বর্ষার বাড়ন্ত জল খাল উপচে মাটির কাঁচা রাস্তায় উঠে এসেছে। আজিজুদ্দিনের বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণে খালটি একটি বাঁক নিয়ে সোজা চলে গেছে ইছামতী নদীর দিকে। ছোট্ট খাল হলেও মারাত্মক তেজ তার। সপ্তাহখানেকের মধ্যে হাড়িকান্দায় বর্ষা রূপ নেয় বন্যায়। চারিদিকে সবসময় কেমন একটা ভুতুরে ‘শু-শু’ শব্দ। রাতের গভীরে বাতাস আর জলের সঙ্গমে বেড়ে ওঠে পানি। রাস্তা পেরিয়ে আবাদি জমি গিলে নেয় ভরা যৌবনা জল। সে জল এমন জল যার কাছে মানব মানবীকে মনে হয় জন্ম-জন্মান্তরের দাস। মুহূর্তের মধ্যে যেন মিলিয়ে দিতে পারে মানব সভ্যতা।
ছোট্ট খালটির একেবারে মাথায় বাস করতাম আমরা। বাজারে ছিল বাবার চালের আড়ত। এমন ঘর ছুঁইছুঁই বন্যায় সাপ মানুষ যখন গলাগলি করে ঘুমায় তখন বাড়ি ফিরতে বাবার দেরি হচ্ছিল একদিন। আমার মায়ের মন ডাঙায় তোলা কই মাছে মতো ছটফট করছিল বাবার চিন্তায়। মোবাইল ফোন তখনও ঘরে ঘরে ছিল না। কী করে মা বাবার খবর নেবে ভেবে কোন কূল পাচ্ছিলো না। কোথায় আছে, এমন দেরি তো হয় না, কোনো বিপদ হল না তো- এমন সব আশঙ্কায় থৈথৈ জলের মাঝেও মায়ের গোটা জগত যেন ফেটে চৌচির হয়ে যেতে লাগলো।
বাবা প্রচণ্ড আদরে রাখতো মা’কে। মা মেট্রিক পাশ করেছিল বলে পাড়ার প্রতিবেশীরা হ্যারিকেন হাতে মায়ের কাছে আসতো চিঠি লিখিয়ে নিতে। বিদেশে থাকা ছেলে/স্বামীর কাছে কান্না জড়ানো কণ্ঠে মনের গহীন থেকে উঠে আসা জমে থাকা কথা নির্মল বাতাসের মতো মৃদু স্বরে তারা বলে যেত মা’কে আর মা লিখে যেতো পাতার পর পাতা। চিঠির পাতা ফুঁড়িয়ে আসত তবু তাদের কথা ফুঁড়তে চাইতো না। চিঠি লেখা শেষ হলে ঘুমটা টেনে নতুন বউয়েরা চলে যেত। মা’কে তারা ভাবি বলে ডাকতো। তাই তাদের মধ্যে ছিলো রসিকতার সম্পর্ক। তাদের রসিকতা আমি বুঝতাম না ঠিক তবে তাদের হাসি দেখে আমারও হাসি পেতো। আমার হাসি দেখে নতুন বউয়েরা আমার গাল টিপে দিতো। নতুন বউয়েরা তার স্বামীকে চিঠি লিখতে যখন মায়ের কাছে আসতো তখন মা তাদের চিমটি কেটে বলত, প্রেম দেইখা বাঁচি না। তখন নতুন বউয়েরা কদম ফুলের মতো হেসে কুটিকুটি হতো। লজ্জায় ঘুমটা টেনে মুখ আড়াল করতো। তারা যখন লেখার জন্য বলতে শুরু করত আমি খেয়াল করে দেখতাম তাদের কাজল কালো চোখ দুটি দেবী প্রতিমার মতো জ্বলতে থাকতো আর তাদের হৃদয়ে যেন বাজতে থাকত প্রেমের ঢাক ঢোল। বুড়িরা চিঠি লিখিয়ে লাঠি ভর করে ঠক্ঠক্ করে চলে যেত। যাওয়ায় সময় মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যেত, বেঁচে থাক মা, সুখি হ মা। মায়ের চোখে তখন ঘর ভ’রে মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা জোনাকিরা আকাশের তারা হয়ে ভাসতে থাকতো। মানুষের দোয়া করা হাতের স্পর্শ, কী নরম পরম ভালবাসার স্পর্শ!
বাবার দেরি হওয়ায় মা উপায় না পেয়ে দুখাই মাঝিকে ডাকতে যায়। রাতের বেলায় মেঘলা আকাশ মাথায় আমাকে জড়িয়ে ধরে হ্যারিকেন হাতে নৌকার মাঝখানে বসে বাবার কথা ভাবতে থাকে মা। ভাটির দিকে নৌকা ভাসে। খাল ফেলে খোলা চক ধরে নৌকা চলে। আজও স্পষ্ট দেখতে পাই সেদিনকার আকাশে চমকানো অবিরত বিজলি। সেগুলো ছিল যেন আমার মায়ের আত্মচিৎকার। মা’কে আমি সেদিন অজগর সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে বলছিলাম, “মা ডর করে!” মা বলে, “ধুর বোকা কিসের ডর, আমি আছি না!”
জগত জোড়া নির্জনতা ভেঙে দুখাই মাঝি বলে, “ভাইয়ের লিগা টেনশন কইরেন না ভাবি, মনে লয় সড়কে দাঁড়ায় আছে, দেড়ি অওনে মন অয় নাউ পায় নাই।” দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল সড়ক। একটা লাইট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নৌকার দিকে মারছিলো কে যেন! দুখাই মাঝি পারে নৌকা ভেড়ায়। বাবার হাঁটু পর্যন্ত উঠানো প্যান্ট দেখে অস্থিরতার মাঝেও মা হেসে ফেলে। দ্রুত মুখ লুকায় মা। বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়ি আমি। এরপর বাবাকে জিজ্ঞাসা করি, “তুমার আসতে এত দেড়ি হইল কেন বাবা? মা কতো কাঁদছে তুমি জানো?” বাবা বলে, “কোথায় দেরি! এইত চইলা আইছি…”, এ কথা বলে আমাকে চুমু খায় বাবা। এরপর মা’কে ডান হাতে টেনে নিয়ে দুখাই মাঝিকে বাবা বলে, “দুখাই তর নাউ ভাসা তাড়াতাড়ি, আকাশে আবার মেঘ করতেছে, ডলগ হইবো, জলদি ল।”
এভাবেই আগলে রেখেছিল আমাদের বাবা। সেই বাবাকে আমরা আজও খুঁজে ফিরি।
আধা শহর হইয়া উঠা আমার গ্রাম বদলাইয়া গ্যাছে। কিছু বইটই পইড়া আমার বিবেচনার জায়গাগুলা সক্রিয় হইছে। আমি প্লেটোর রিপাব্লিকের মতো নীতির শক্তি, অ-নীতির শক্তি পরীক্ষা কইরা দেখি। মিনি সক্রেটিস আমার মাঝে বাস করে এমন বোধ জন্ম লইছে আমার মধ্যে। তাই আমারে প্রশ্ন করে আমার বিবেচনা বোধ, এই যে নগরায়ণের দিকে আমার গ্রামটা যে যাইতেছে তাতে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়া জালেমের শক্তিও কি দৃঢ় হইতেছে না? আমি জালেমের চোখে আঙুল দিতে শিখা যাইতেছি। তারা আমার শত্রুতে পরিণত হইতেছে। কলেজে পড়ি অথচ আমার কোনো বন্ধু নাই, বান্ধবী আছে। ফলে সিগারেট খাই না, কিন্তু ফোনে কথা বলি। আর আছে একজন প্রাক্তন মাস্টারমশাই। তাঁরে সকলে জানে ‘গরম ভাতের পাগল’ বইলা। আমি স্কুলে থাকাকালীন তার কাছে পড়তাম। এরপর সে নাকি পাগল হয়ে গেছে এই ফতোয়া দিয়ে তার প্রায় সব টিউশান হাত ছাড়া করে দেয় সভ্যতার পথে অগ্রসর অ্যান্টি-পাগল গ্রামবাসী!
আমি আর মাস্টারমশাই বিকেল বেলা হাঁটতে বের হই। তাঁর গায়ে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের মতো ময়লা শাল জড়ানো থাকে! যদিও চর্মচক্ষুতে যাহা ময়লা শাল, আসলে তা ময়াল সাপ! যেন দুনিয়ার সকল বিষের আধার কন্ঠে ধারণ করে শ্মশানেমশানে ঘুরে বেড়ানো শিব! আমি মার্ক টোয়েনের ‘জিনিয়াস’ কবিতায় পড়ছিলাম, ‘যার চুল উশকোখুশকো, জামা ময়লাযুক্ত সে জিনিয়াস!’ আমার হাসি পায় কবিতাটা পড়লে! যা-হোক আমরা একটা টিলার উপর জুতো ছেড়ে বসি। আমি তারে জিজ্ঞাসা করি, স্যার, আপনি আজ কতদিন হইলো গরম ভাত না খেয়ে আছেন? তিনি কাঁচাপাকা দাড়িতে মিটিমিটি হেসে উত্তর দেন:
– ওহো, আমি তো ভুলেই গেছিলাম খাওয়ার কথা; দুদিন আগে সম্ভবত আমি খেয়ে থাকবো।
– এই নেন, আপনার জন্য গরম ভাত আর ভাজা মাছ নিয়া আসছি। খান। পানিও আছে ব্যাগটাতে।
– মানুষকে খাওয়ানো ভালো কাজ অবশ্য, তোমারে থ্যাংকস দেয়া যায়। তবে শোনো নরম শরীরের নারী দেখলেই যেমন আমার কামনা জাগে না, গরম ভাত আর ভাজা মাছ দেখলেই তেমনি আমার ক্ষুধা লাগে না। তুমি জেনে থাকবা খাওয়ার হিংস্রতা আরেক জনার পাতেও হাত বসিয়ে দেয়, চারিদিকে দেখবা কেবলই খাই খাই!
আমাদের সামনে গোধূলির সূর্য উদাসীন আলো ছড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। আঁধার ঘিরে আসছে। দু’য়েকটা শিয়াল ছুটোছুটি করছে। গভীর জঙ্গল থেকে হিরুর ডান হাত নেসার আলী বের হয়ে আসে। তার চোখ মুখ লাল। শূকরের মতো লালা ঝরছে জিহ্বা দিয়ে। চোখ দুটো বের হয়ে আসছে প্রায়। আমরা বিপদের একটা গন্ধ পাই। দৌড়িয়ে যাই যেখান দিয়ে সে বের হয়ে আসে সেখান দিয়ে। ভেতরের দিকে গিয়ে দেখি অর্ধনগ্ন শরীরে কাপড় ঠিক করছে রাজ্জাকের বউ। না ধর্ষণ না। পরকীয়া। রাজ্জাকের বউ ভীত সন্ত্রস্ত নয় আমাদের দেখে। সে জানে নেসার আলীর ক্ষমতা কতো! আমি তার ব্লাউজের উপর দিয়ে পাঁচশ টাকার একটা নোটের কোনা বেরিয়ে থাকতে দেখি। তারপর যেন আমরা কিছু দেখি নি এমন চোখে প্রায় শুকিয়ে আসা নদীটির দিকে এগিয়ে যাই।
মাস্টারমশাই এরপর বলে যেতে থাকে, “বুঝলা বাবুই, মানুষগুলার বড্ড ক্ষিদা বাড়ছে। মাংসের ক্ষিদা, ভাল থাকার ক্ষিদা, আরও কতো রকমের ক্ষিদা! তাই আর তাদের আনন্দে থাকার সময় কই! রঠা-র একটা গান মনে পড়লো, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না/ শুধু সুখ চলে যায়/ এমনই মায়ার ছলনায়/ এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়, ভুলে যায়’।”
“ছার, আপনি খুব সুন্দর গাইতে জানেন। আচ্ছা স্যার, এই কারে ছেড়ে কারে চায়, ভুলে যায় এইটাই কি স্বাভাবিক না? সলিমুল্লাহ খানের স্বাধীনতা ব্যবসায় পড়তে গিয়া পাইলাম, অ্যালান পাকুলার এক ছবির নাম সোফি’জ চয়েজ বা সুফিয়ার নির্বাচন। ছবির নায়িকা তাঁর এক কন্যা আর এক পুত্র নিয়ে আউশবিৎস বন্দিশিবিরে হাজির হন। একটি জার্মান সৈন্য এসে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে তিনি কম্যুনিস্ট নন, ইহুদিও নন। বরং জাতে পোলদেশি আর ধর্মে ক্যাথলিক অর্থাৎ সহি বড়, আদি ও আসল নাসারা। জার্মান সৈন্যটি বলে, আপনি যখন নাসারাধর্মে বিশ্বাসী তখন আপনি একটা সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ আপনি বেছে নিতে পারবেন। আপনার ছেলে ও মেয়ের মধ্যে কোনো একটিকে আপনি চাইলে বাঁচাতে পারবেন। যদি একটিকেও বাঁচাতে না চান তাও পারবেন। ধর্মে জোর জবরদস্তি নাই। যদি বাছাই না করেন তো আমরা সন্তান দুটোকেই পুড়িয়ে মেরে ফেলব। সুফিয়া প্রথমত ইতস্তত করলেন। কিন্তু সকল দ্বিধার সীমানাই সিধা। জার্মান সৈন্যরা যখন দু’সন্তানকেই চুলার দিকে নিয়ে যেতে উদ্যত হল তখন তিনি অন্যমনস্ক হাতে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলেন। সৈন্যরা নিয়ে গেল মেয়েটিকে। টীকাকার বলেও পরিচিত মহাত্মা খান সাব বলেন, ”যাহাকে বলে স্বাধীনতার স্বাদ, তা পাইলো সুফিয়া। কিন্তু এই স্বাদ এতো বিস্বাদ কেন? যারা স্বাধীনতা বলতে কেবল বাছাই করবার সুযোগ, বাছাই করবার সুযোগ বলে চিৎকার করেন তাঁদের উচিৎ শিক্ষা হয়েছে এই গল্পে”।”
স্যার বলেন, “হ্যাঁ, বিষয়গুলা তো আসলে এত সরলও না।”
বাড়ি ফিরে দেখি বিদ্যুৎ নাই। মা একটা মোমবাতি জ্বেলে ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছে। আজ মা শাড়ি পরেছে। ফুটফুটে রাঙা বউয়ের মতো লাগছে। চার-পাঁচ বছরে আজই অনেকদিন বাদে মা এই রাতের আঁধারে একটু সেজেছে বলে মনে হলো আমার। বাবা আগে খুব ভালোবাসতো মাকে। আমি তখন ছোট থাকলেও চুমুর মানে বুঝতাম। সে চুমু আর দীর্ঘকাল দেখা হয় নি। এখন শুধু দেখি লড়াই, চিৎকার চেঁচামেচি। “এমন করেই কি মানুষের চুমুর দিন ফুরায়!” নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করি, না হয় খালের মাথাতেই থাকতাম, না হয় সাঁকোই পেরোতে হতো, না হয় নৌকায় করে বাড়ি ফিরতাম কিন্তু তাই বলে এই জালিমের সুখ? একেই কি তবে বলে জালিমের সুখ?
রান্না ঘরে আমি মায়ের পাশে গিয়ে বসি। মাকে বলি, “মা তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। একদম নতুন বউয়ের মতো।” অনেকদিন পর মা একটু হেসে কথা বলল আমার সাথে। মা বলল, “খুব যে দুষ্টু হয়েছিস!”
“তোমার ছেলে বড় হইতেছে না!”
মাথায় হাত রেখে মা বলে, “হ, আমার বাবা আসলেই অনেক বড় হইছে।”
আমি আদরে গদগদ হইয়া মায়েরে হালকা জড়ায় ধইরা কইলাম, মা তুমারে অনেক ভালবাসি। তারপর আমি রান্নাঘর থেকে উঠে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসলাম। মা একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। মা একটু বসলো আমার পাশে। আমি জিগাইলাম, মা কিছু কইবা?
– আজকে নাকি বিচার বইছিল হিরু রহমতের বাড়ি? তুই কিছু জানস?
– ওসব বাজে ঘটনা মা। শুইনা কাম নাই।
– কাম আছে। তুই ক।
– রাজ্জাকের বউর পেটে বাচ্চা আইছে কিন্তু সেই বাচ্চার বাপ হিসেবে রাজ্জাক তার অস্বীকৃতি জানাইছে। কইছে এই বাচ্চা তার না।
– কী কস!
– এর জন্য রাজ্জাকরে খুব মাইরধর করা হইছে। হিরুর ডাইন হাত নেসার আলী খুব মারছে। অথচ দ্যাখো মা, রাজ্জাকের বউ একবারও বললো না তার স্বামীরে না মারতে। আমি তো জানি কেন এইগুলা ঘটতেছে।
ফস কইরা এই কথা বের হয়ে গেলে নিজেকে সামলে নেয়ার অভিনয় করলাম। কিন্তু মা হাত দুইটা টাইনা ধইরা কইল, কী জানস তুই আমারে বল বাবা।
আমি কইলাম, ‘‘ঐ বাচ্চার বাপ নেসার আলী। ওদের আমি আর মাস্টারমশাই হাঁটতে গিয়া জঙ্গলে দেখছি।মা চুপচাপ উইঠা গেল। বসা থেকে উঠতে গিয়া একটু কেঁপে উঠলো মা। এখনো কিবা তেমন বয়স। খুব হইলে পঁয়ত্রিশ। এমন বয়সে তো বিয়েও হয়! অথচ মা’টা কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন!’’
বাবা এলো খুব রাতে। এসে ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচি করল। আমার চোখে তখন ভেসে উঠছিল সন্ধ্যায় মায়ের রাঙা মুখখানি।
পরের দিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙে। কেও খোঁয়ার খোলে নি সম্ভবত। তাই বোধ হয় মোরগ ডাকছে না বা মৃদু স্বরে ডাকছে হয়তো। মোরগগুলার কথা আমি কিছুক্ষণ ভাবি। ওরা হয়তো জেগে বসে আছে কখন খোঁয়ার থেকে ছাড়া মেলবে সে অপেক্ষায়। পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। মুখটা ধুয়ে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলাম। দু’একজন জেলে ভেজা গায়ে হাঁড়ি হাতে মাছ নিয়ে যাচ্ছে বাজারে। গায়ে তাদের হালকা কাঁপুনি। দু’য়েকজন বালতি ভ’রে দুধ নিয়ে যাচ্ছে, কেও বা মাথায় করে লাউ, শাক নিয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখি মাস্টারমশাইও আমার দিকেই আসছেন। আমাকে দেখে শাল থেকে এক হাত বের করে আমার কাঁধে দিয়ে বুকের কাছাকাছি নিয়ে নেন। তারপর জিজ্ঞাসা করেন, “কী খবর সক্রেটিস সাব?”
আমি হেসে উত্তর দিলাম, “ভালো। সকালটা ভা্লো। এর সঙ্গে নির্দ্বিধায় প্রেম করা যায়।”
– কুয়াশা দেখলে বয়ান ঠিক থাকবে তো?
– আলবৎ!
– তাহলে চলেন উত্তরের দিকে হাঁইটা আসি।
আমিও মশকরা কইরা স্যাররে বলি, “চলুন হে পাঞ্জেরী!”
দুজনেই নির্মল হেসে উঠলাম।
– আচ্ছা স্যার আপনি বিয়ে করেন নি কেন?
– করেছিলাম।
– কই সবাই তো বলে ও আপনার পাগলামো।
– তুমিও বলো?
– না। আমি বলি মিস্টেরি। আপনি কী আমাকে বলবেন?
– আমি চেয়েছিলাম, ইনিভজিবল বাট আল্টিমেট অ্যাটাচমেন্ট। যা থাকবে মজ্জার সাথে মিশে কিন্তু তার বাস্তব উপস্থিতি থাকবে না। তাকে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, শুধু অনুভব করা যাবে। তবে মাঝে-মধ্যে এ বড়ো কষ্টের। মৃত্যুর কাছে নিয়ে যায়। সে হলো ভালোবাসা, প্রেম। যা সকল সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। আমি ছোট থেকেই দেখেছি আমার আশেপাশে সংসার করা মানুষদের। তাদের দেখেছি শুধু অভাব। বিত্তবানেরাও এর বাইরে নয়। এদের সকলের সকাল-সন্ধ্যার অভাব। এদের হিংসার প্রতিযোগিতা। এমন একটা কালচারে আমি অবশ্য বিয়ে করার সাহসও করে উঠতে পারি নাই। যদি বিয়ে করতাম খুব সম্ভবত আমার সন্তান হলেও এই তোমার মতো আজ তাকে নিয়ে সকালবেলা হয়তো হাঁটতে বের হওয়া হতো না। বেশিরভাগ সাংসারিক মানুষই কাজের সময়টুকু ছাড়া সাথে করে বয়ে বেড়ায় কেবলই অলসতা। আমি তো নীৎসে’র মতো, মিরাক্যলে বিশ্বাসী, দৈবাতে বিশ্বাসী। আমি পরিকল্পিত সুখের জগতে দেখেছি শুধু ক্লান্তি।
– তবে আমি কী করবো স্যার! (কথাটা বলে লজ্জা পেলাম)
– আস্ক ইয়োরসেলফ। ফাইন্ড ইয়োরসেলফ। রিড ইয়োর মাইন্ড। গো থ্রু ইয়োর লাইফ।
খুব মোটিভেশন নেয়া হলো!
হেঁটে হেঁটে আমরা বাজারে চলে আসি। হরেক রকমের তরতাজা মাছে ভ’রে গেছে বাজার। আজকাল এদিকেও পালা মাছ উঠতেছে। মাছগুলা একেবারেই মুখে তোলা যায় না। মানুষ এখন বেশি খায় কিন্তু অখাদ্য খায়। আমি বলি, কম খা, তবু অরগ্যানিক খা। হিরু রহমতের সামনাসামনি পরলাম আমরা। আমি সালাম দিলাম না। তিনি আমারে আমার বাবার কথা জিগাইলেন। আমি মনে মনে মিনতি কইরা প্রভুরে কইলাম, তারে রক্ষা করো। রহমত সাবরে কইলাম, তিনি তো বাড়িতে। মাস্টারমশাইয়ের দিকে শকুনি চোখ দিয়া রহমত গিলা খাইয়া ফেলতে চাইলো। কিন্তু কিছু না বলে চলে গেল। তার হাত ভর্তি বাজার। বাজার কইরা সে কাওকে এক টাকাও দেয় না। হিরু চলে গেলে আমি মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, চা খাবেন?
– খাওয়াবা?
– চলেন।
– তোমার মাও এমনই খাওয়াতো! বলেই কেমন যেন আকাশ পাতাল তোলপাড় হয়ে যাওয়ার মতো কেঁপে উঠলো তিনি।
প্রথম কথাটুকু ভুলে গিয়ে আমি তাকে দু’হাতে টেনে ধরলাম যাতে পরে না যায়। তিনি সামলে নিয়ে বসলেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো কিনা।
– বরং মরতে দাও, আর কতো রিপিটেশন!
– আপনি মাঝেমধ্যে বড্ড পেসিমিস্টের মতো কথা বলেন।
– ও তুমি বুঝবে না।
মনে মনে বললাম, ‘‘আজ আসলেই আপনাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। শুধু মিস্ট্রি ছড়িয়ে দিচ্ছেন আমার জগতে।’’
স্যার বললেন, ‘‘চলো, বাড়ির দিকে যাই।’’
আমি হেসে বললাম, ‘‘চলেন।’’ কিন্তু আমার মাথায় ঘুরতে লাগলো, ‘‘তোমার মাও ঠিক এমনি খাওয়াতো!’’ কথাটা। কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না।
আজ বাড়ি ফিরে দীর্ঘক্ষণ মাকে দেখলাম। মায়ের চোখের নিচের কালো দাগ দুর্গার চোখের কালির মতো ফুটে উঠেছে! কিছু বলতে আমার সাহস হয় না। শুধু মাথায় ঘুরতে থাকে মাস্টারমশাইয়ের কথাখানা ‘‘তোমার মাও ঠিক এমনি খাওয়াতো!’’
আজ মা’ই যেচে আসলো কথা বলতে। দোয়ার ঝাড়ু দেয়া শেষ করে এলো। কিছু একটা ঘটেছে টাইপের চেহারা করে বললো, ‘‘জানস, দুলালের ছেলের সাথে ইসহাকের মেয়ে ভাগছে!’’
আমি চেহারা ঠিকঠাক রেখে উত্তর দেই, ‘‘তো ইহা কী নতুন কিছু নাকি? নিত্যই তো ঘটতেছে। আর এই ভাগাভাগি ছাড়া ওদের আর করবারই বা কী আছে? সিনেমা, নাটকে নায়ক নায়িকারা তো তাই করতেছে!’’
– তাই বইলা একটা নেশাখোরের লগে?
– নেশাখোররা নেশা কইরা মেয়েদের কথা মনোযোগ দিয়া শোনে, কোনো কথা বলে না। মেয়েরা যা বলে তা-ই শোনে। একারণে মেয়েরা নেশাখোরদের লগেই ভাগে, বুঝলা? (বইলা হাসলাম আমি!)
– তোর লেকচার শুনতে আসি নাই আমি। তুইও ভাগবি কিনা সেটা বল! (বলে মাও হাসে।)
আমিও হেসে বলি, ‘‘ভাগলেও আমাদের সাথে তুমারে নিয়া যামু মা। আচ্ছা মা মাস্টারমশাই লোকটারে তোমার কেমন লাগে?’’
হঠাৎ মা নির্বাক হয়ে যায়। মুখে কথা যোগায় না। মা ‘কাজ আছে’ বলে চলে যায়। আমি সেই কথাটাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভাবতে থাকি।
আজ সন্ধ্যাতেই ঘুম পেয়ে গেল। হঠাৎ খুব চিৎকারের শব্দ। মা কাঁদছে। বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। দৌড়ে গেলাম বাইরে। বাবাকে পুলিশের গাড়িতে তোলা দেখলাম, সাথে হিরু রহমত আর তার ডাইন হাত নেসার আলীও।
এই নির্বাচনে লোকে ভোট দিছে। নতুন চেয়ারম্যান বিজয়ী হইছে। আশা করি আমার পুরানা বাপেরে আমরা আবার ফিরে পাবো।
অলঙ্করণ: বৈশালী
লেখক পরিচিতি:
শেখ সাদ্দাম হোসাইন
তরুণ গদ্যকার, কবি ও চিন্তক। জন্ম: ১৯৯৫ সালে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানায়। পড়াশুনা: ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং-এ বিবিএ।