।। শেখ সাদ্দাম হোসাইন ।।
আমার মা সে রাতেই আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছিল। মায়ের সেই ঝুলন্ত লাশ আজও আমার চোখে ভাসে। ধর্ষণ শব্দটা শুনলে আমি সবকিছু ঝাপসা দেখি। আমি এই ধর্ষণের পেছনে মূখ্য কারণ হিসেবে দেখি ক্ষমতার বিষয়টিকে। আমরাও তো মুসলমান। সেদিন রাতে মুসলমান জালেমরাই মুসলমান নারীদের ধর্ষণ করেছিল। ধর্ম তো ছিলই — কই ধর্মের নামে তো এর আগে কোনদিন কোন জালেম ধলেশ্বরীর মা-বোনকে ধর্ষণ করেনি। কিন্তু তারা ২৮শে জুন করেছিল, কারণ তারা জুলুমের শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিল। ধর্ষণ আর খুন করে তারা তাদের ক্ষমতার জানান দিতে চেয়েছিল, ধলেশ্বরীর মানুষকে বানাতে চেয়েছিল তাদের দাস। তারা ধলেশ্বরীর মানুষের জবান বন্ধ করতে চেয়েছিল ২৮শে জুন রাতে।
ধলেশ্বরী
১৯৯৯ সালে ‘ধলেশ্বরী’ নামের একটি দেশে মজলুম ও জালেমদের মধ্যে একটি ভয়াবহ যুদ্ধ বাধে। অসংখ্য মজলুম সে যুদ্ধে মারা যায়। অনেক নারী ধর্ষিত হয়।
এক
আমরা যখন গ্রামে ছিলাম, যতদূর স্মৃতি যায় (মায়ের বুকের দুধ খাওয়া পর্যন্ত), মোরগের ডাকে এমনকি ফজরের আজানে আমাদের ঘুম ভেঙেছে এমন একটি সকালের উদাহরণ দেয়া আমার পক্ষে পসিবল না— কারণ, তরুণের দাদি, মানিক কাকার মা আল্লার তিরিশটা দিন ভোররাতে বাঁশঝাড়ের আড়ালে বসে নিরলস কাঁদতে থাকতেন আর বুক চাপড়ে চাপড়ে বিলাপ করতে থাকতেন ‘মানিক, মানিক, মানিক বাবা আমার’ বলে— সে আর্তনাদ বাঁশের পাতার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ছড়িয়ে পড়তো পুরো পাড়া জুড়ে।
আমার ছোট সময়ের ভোরগুলি তাই আজানের ধ্বনি কিংবা চায়ের কাপে ঠোঁট রেখে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে হতো না। আমার ভোরগুলি ছিল মানিক কাকার মায়ের রাত্রিকালীন রাগ ‘বেহাগ’ এর ব্যথাতুর সুরে কাতর— আর তাই আকাশ থেকে যেন শীত-বর্ষা-শরৎ বারো মাস মেঘ সরতো না! আমার শৈশবের ভোরের বেলায় টিনের চালায় রুমঝুম বাজতে থাকা বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে আছে মানিক কাকার মায়ের কান্না। আমার বেড়ে ওঠা শীতকালের একেকটি দিনের কুয়াশা জুড়ে ভেসে আছে মানিক কাকার মায়ের চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু।
মানিক কাকার ছেলে তরুণ ও আমি সমবয়সী। তরুণের বাবা-মা দুজনই ৯৯ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তরুণের মাকে জালেমরা বাসায় এসে, তরুণের দাদিকে বেধে রেখে, তার চোখের সামনে ধর্ষণ করেছিল। গলায় দড়ি দিয়ে এরপর আত্মহত্যা করেছিল তরুণের মা।
তরুণের সাথে আমার প্রতিবেশী, বন্ধু ও ভাই এর সম্পর্ক। আমার দাদা আর তরুণের দাদা একই মায়ের পেটের আপন ভাই (সহোদর) ছিলেন। আমার দাদা-দাদি কেউই এখন আর বেঁচে নেই। আমরা একই স্কুলে পড়তাম। স্কুল শেষ করবার পর আমরা ঢাকায় চলে আসি। আমার বাবার গ্রামের বাজারে কাপড়ের দোকান ছিল, আমার দাদার তাঁত ছিল।
তরুণের দাদা কৃষি কাজ করেন, ভালো গান বাঁধতে জানেন বলে দশ গাঁয়ে তার নামডাক আছে। তরুণের দাদা কৃষিকাজ ধরে রাখলেও আমার দাদা কিছু জমিজমা বেচে তাঁত দিয়েছিলেন। সে সূত্রেই আমার বাবা কাপড়ের ব্যবসা করেন আর পরে ঢাকার ইসলামপুরে একটি পাইকারি দোকান নিলে আমরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসি।
দুই
দীর্ঘদিন পর বর্তমানে ঢাকাবাসী, কাপড় ব্যবসায়ীর ছেলে সেলিমের সাথে বাবা-মা হারা, কৃষক দাদা-দাদির কাছে মানুষ হওয়া তরুণের দেখা হয়ে যায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে।
তরুণকে অনেক দিন পর হঠাত করে দূর থেকে আম গাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেলিমের একবার মনে হয় ‘আরে কি ভুলভাল দেখছি’! পরে যতই কাছে এগিয়ে যেতে থাকে সেলিম, তরুণের মুখ ততই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার কাছে। সেলিম হিসেব মিলিয়ে ওঠার আগেই তরুণও সেলিমকে দেখে ফেলে আর রীতিমতো চিল্লাপাল্লা করে হাট জমিয়ে বসে। সেলিমকে কিছু বলতে না দিয়েই বুকে টেনে নিয়ে কোলাকোলিরত অবস্থায় সেলিম কৌতূহলের স্বরে তরুণ জিজ্ঞাসা করে, “তুই এখানে?”
— আমি তো কম্পিউটার সায়েন্সে ব্যাচেলর করছি এখানে। কিন্তু তুই এখানে কী করছিস?
— আমি ইতিহাসে ব্যাচেলর করতেছি; এদ্দিন বাদে দেখা হইলো, এটা কোন কথা!”
কোলাকোলি শেষ হলে সেলিম কিছুটা বিব্রত হাসি মুখে ধরে রেখে তার সাথে থাকা বন্ধুদের সাথে তরুণকে পরিচয় করিয়ে দেয়।
“Guys, ওর নাম তরুণ, আমার গ্রামের কাজিন।”.
সেলিমের বন্ধুরা পাত্তা দেয় না। একজন আরেকজনের সাথে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে থাকে। সেলিম আর তরুণ দুজনেই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পরে যায়।
তরুণ নিজে থেকেই এগিয়ে গিয়ে সবার সাথে হাত মিলিয়ে বলে, “চলেন চা খাই।”
সেলিম তার বন্ধুদের চেহারার দিকে চেয়ে বলে, “আজ থাক, অন্যদিন। কোথায় থাকছিস?”
“পলিটিক্যাল লবিং না থাকায় হলে তো সিট পাই নাই বন্ধু। আশেপাশেই মেসের খোঁজ করছিলাম— খরচা বেশি পইড়া যায় বলে নদীর ওপারে চইলা গেলাম।”
“নদীর ওপারে চলে গেলাম মানে?”
“মানে, বসিলা ব্রিজ ক্রস করে ওপারে গেলে মেস ভাড়াটা কম। তবে বাসাটা সুন্দর। খোলামেলা, নদী দেখা যায় আবার পচা পানির গন্ধও নাকে আইসা পৌছায় না, গাছপালা আছে। নাগরিক সুবিধার পাশাপাশি এগুলো পেয়ে নিজেকে তো আমার ওয়েস্টার্ন ওয়েস্টার্ন লাগে মাঝেমধ্যে!” কৌতুক করে চুপচাপ রিয়্যাকশন পর্যবেক্ষণ করে তরুণ।
সেলিমের বন্ধুরা সবাই হেসে ওঠে একসাথে। তরুণকে ফানি আর ইন্ট্রেস্টিং মনে হয় তাদের। তাদের নিজেদের সার্কেলে যেহেতু মজা নেওয়ার মতো কেও নাই তাই তারা তরুণকে পেয়ে অনেকটা খুশিই হয়ে যায়। তারা নিজে থেকেই সেলিমকে বলে, “চল চা-টা খেয়ে বের হই।” তরুণ তার প্রতিবেশী, চাচাতো ভাই, ক্লাসমেট, বাল্যবন্ধু সেলিমের কাঁধে হাত রেখে টি-স্টলের দিকে হেঁটে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করে, কাকা-কাকি কেমন আছে? শরীল-স্বাস্থ্য ভালো?
— তুই এখনো ‘শরীল’ বলিস?
— কেন, তুই?
— আমি তো এখন শরীর বলি।
— কেন?
— আমি যাদের সাথে মিশি ওদের কাছে শরীল শব্দটা হাস্যকর, ক্ষ্যাত। তুই এখানে একই ডিপার্টমেন্টে অনেকগুলো গ্রুপ দেখতে পাবি, সব গ্রুপে সবকিছু চলে না। এদের রুচি ভিন্ন, অর্থনৈতিক অবস্থান ভিন্ন। বুঝলি?
— তুই যাদের লগে চলস ওদের বাপের বাড়ি কই?
— সেটা যেখানেই হোক, ওরা ঢাকায় বড় হয়েছে। ওরা বইয়ের ভাষাতেই কথা বলে বড় হয়েছে।
— অতি কষ্টে হাসি চেপে রেখে তরুণ বলে, তাইলে আমি তর বন্ধুদের লগে মিশতে পারবো না?
— লেটস সি!
চায়ের দোকানে পৌঁছে যায় সবাই। চা দিতে বলে তরুণ। সেলিমের এক বন্ধু দর্শনে পড়ে, অস্তিত্ববাদে আগ্রহ, চায়ের দোকানদারকে নির্দেশনা দেয়, মামা, দুধ চা, চিনি বেশি।
তরুণ মুখে হাসি ধরে রেখে জিজ্ঞাসা করে, গাঞ্জা খাইছেন নাকি?
সেলিমের অস্তিত্ববাদে আগ্রহী বন্ধুটি তরুণের প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, মানে?
তরুণ একইভাবে মুখে হাসি ধরে রেখে বলে, না, মানে আমি শুনছি গাঞ্জা খাওয়ার পর বেশি কইরা চিনি খাইলে নাকি পিনিকটা ভালো হয়!
সেলিমের বন্ধুটির কান লাল হয়ে গেলেও হেসে হেসেই জিজ্ঞাসা করে, আপনিও খান নাকি?
— ‘শুনছি’ বলছি তো। তবে জানার জন্য খেয়ে দেখা যাইতেই পারে! (হাসি)
চোখে চশমা, দেখতে ‘বাংলা মিডিয়াম’ সাহিত্যিক ভঙ্গিতে মানে কিছুটা উদাস চিত্তে চা পান করছিল সেলিমের আরেকটি বন্ধু। দোকানে ঝুলতে থাকা কলার কাঁদি থেকে একটা কলা ছিড়ে নিয়ে অস্তিত্ববাদীকে সাইড করে দিয়ে বাংলা মিডিয়ামের কাছে যায় তরুণ, পাশে বসে। বসে কলায় কামড় দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করে, এইযে বাংলা মিডিয়াম, আপনার বাপের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
—পঞ্চগড়, তবে আমি যাইনি কোনদিন, খুব ছোটবেলায় একবার গেলে গিয়েও থাকতে পারি, মনে নেই।
— আপনার দাদার নাম কী, পেশা কী ছিল?
— মো: আজগর আলী, কেরানী ছিলেন। কিছু মনে করবেন না, আপনার উচ্চারণে অনেক সমস্যা আছে। কিছুক্ষণ আগে আপনি ‘কইরা’ বলে উচ্চারণ করেছেন যে শব্দটি সেটির প্রকৃত উচ্চারণ হবে ‘করে’। গ্রাম থেকে এসেছেন কতদিন হলো?
— এইতো দেড় বছর।
— ব্যাপার না। দীর্ঘদিনের গ্রাম্যতা এতো স্বল্প সময়ে কাটিয়ে উঠবার নয়। তবে চেষ্টাটা থাকতে হবে, বুঝলেন দাদা?
তরুণ একগাল হেসে উত্তর দেয়, আজ্ঞে, বুঝলুম দাদা!
তরুণ খেয়াল করে সেলিমের আর যে ২ টি বন্ধু আছে তারা তাকে পাত্তা দিতে নারাজ। সেলিমের এই দুটি বন্ধু আলাদাভাবে মিউজিক নিয়ে আলাপ করছিল। এর আগে শুনেনি এরকম কয়েকটি ব্যান্ডের নাম কানে ভেসে আসে তরুণের।
তরুণ এই দুজনের সাথে আলাপে ঢোকার জন্য ভিন্ন স্ট্র্যাটেজি নেয়। হুট করেই জিজ্ঞাসা করে বসে, আচ্ছা, আপনারা দুজন কি বাকি ৩ জনের চেয়ে বেশি বড়লোক?
দুজনের মধ্যে একজন বলে ওঠে, অভদ্রের মতো প্রশ্ন করছেন কেন?
— আচ্ছা, আপনারা দুজন কি গাড়ি নিয়ে আসেন? আমি অনুমান করতে চাই আপনারা দুজন যদি গাড়ি নিয়ে আসেন তবে আপনার গাড়িটার দাম আপনার ‘অভদ্র’ না বলা বন্ধুটির চাইতে বেশি! (হাসি)
এই দুজন রেগে গেলেন আর চায়ের বিল কে দেবে তার সুরাহা না করেই তীব্র রাগে হনহন করে চলে গেলেন। সেলিম এতক্ষণ ধরে বসে বসে কেবল তরুণের কর্মকাণ্ড দেখছিল – তার সকল বন্ধুদের মন মেজাজ খিটখিটে করে তোলায় সেও তরুণকে কিছু না বলেই মন বেজার করে চলে যায়।
যাওয়ার আগে দর্শনের ছাত্রটি বলে যায়, হিস্ট্রি সম্পর্কে হেগেল কী বলছেন জানেন, বলছেন, আমরা হিস্ট্রি থেকে এইটাই শিখি যে আমরা হিস্ট্রি থেকে কিছুই শিখি না। বুঝলেন মিয়া দিনশেষে সবকিছুই অর্থহীন।
দর্শনের ছাত্রের পিছুপিছু কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তরুণ বলে, গাঁজা না হয় পরেও খাওয়া যাবে, বিলটা যদি শেয়ার করতেন!
অস্তিত্ববাদী ছেলেটি বিল শেয়ার করে না। দোকানের বিল মিটিয়ে তরুণ মেসে ফিরবে বলে শাহবাগের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
তিন
শাহবাগে অনেক মানুষের জটলা, সকলের মুখে শ্লোগান ‘ধর্ষকের বিচার চাই’। ধর্ষক শব্দটা তরুণের কানে আসতেই তরুণ ফিরে যায় ২৮ শে জুন কালো রাতে। তার পুরো শরীর-মন জুড়ে বাজতে থাকে তার মায়ের চিৎকার। পাথর হয়ে যায় তরুণ। প্রতিবাদকারীদের মধ্যেকার একটি মেয়ে, ইতিহাসেরই ছাত্রী – তরুণকে দেখে হাত ধরে টান দেয়। তরুণ ফিরে আসে দুনিয়ায়, শাহবাগে।
— আরে প্রিয়তি, কেমন আছো?
— আপনি করে বলেন। ব্যস্ত? কোথাও যাচ্ছেন?
— না, ওরকম কিছু না, বাসায় ফিরবো ভেবেছিলাম কিন্তু এভাবে একটা মেয়ে টেনে ধরলে বাসায় ফেরার ভাবনাটা কি আর মুখ্য থাকতে পারে বলেন! (সরল হাসি)
— আপনাদের এই এক সমস্যা, নারীদের শুধু সেক্সুয়াল জায়গা থেকে কানেক্ট করতে চান, মানুষ হিসেবে ট্রিট করতে চান না।
বলতে বলতে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে প্রিয়তি। অন্যান্য পকেটে রাইসা ম্যাচ খুঁজতে থাকলে তরুণ তার পকেট থেকে লাইটারটা বের করে প্রিয়তির সিগারেট ধরাতে হেল্প করে। প্রিয়তি তরুণকে একটি সিগারেট অফার করলে তরুণ বলে, ‘সেই ছোটবেলায় বিটিভি তে একটা জনসচেতনতা মূলক বিজ্ঞাপন দেখে যে ভয় পেয়েছিলাম সেই ভয়টা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’ প্রিয়তি নিবিড় চিত্তে সিগারেট টানতে থাকলে তরুণ গুন-গুন করে গাইতে থাকে, ‘সিগারেট থেকে শুরু, শেষ কালে হিরোয়িন/লা লা লা!’
শাহবাগের প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে বেরিয়ে তারা রমনার দিকে হাঁটতে থাকে। এর মাঝে তরুণ প্রিয়তিকে জিজ্ঞাসা করে, আপনারা ধর্ষকের বিচার দাবি করছেন কেন, স্বাভাবিক ভাবেই এর বিচার হবার কথা না?
—হ্যাঁ, কিন্তু হচ্ছে না তো।
— তাহলে প্রতিদিন ধর্ষণ হবে আর প্রতিদিন এভাবে বিচারের দাবি জানিয়ে বিচার করাতে হবে?
— আর বলবেন না, দেশের মানুষ যতদিন ভালো না হচ্ছে ততদিনে কিচ্ছুটি পরিবর্তন হবার নয়।
— ও, আচ্ছা। এইযে প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে এর পেছনে কী কী কারণ কাজ করছে বলে আপনার মনে হয়?
— ধর্মীয় কারণকে আমি মুখ্য করে দেখছি। যারা ধর্ষণের পেছনে কাপড়, নারী-পুরুষের অবাধ চলাফেরাকে দায়ী করে তারাই ধর্ষণের পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
— কিন্তু একজন হুজুরই যখন বলাৎকার করছে, ধর্ষণ করছে; যখন পর্দা করা একটি মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে, যখন ৭০ বছরের বৃদ্ধা থেকে শুরু করে ৩ বছরের শিশু ধর্ষিত হচ্ছে তখন ধর্ষণের পেছনে কারণ হিসেবে কী কাজ করছে বলে মনে করবেন?
— আমি বলবো, যৌন অবদমনই এর মূল কারণ, সেক্সুয়াল ফ্রাস্টেশন থেকে এগুলো ঘটছে।
— আপনি কি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কারো স্ত্রীকে ধর্ষণ করাকেও সেক্সুয়াল ফ্রাস্টেশন দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন?
— আপনি আসলে কী বলতে চাইছেন?
— আমি বলতে চাচ্ছি, আমরা কি ধর্ষণের কারণ বিচারে গুরুত্বপূর্ণ একটা পয়েন্ট এড়িয়ে যাচ্ছি কিনা।
— কী সেটা?
— ক্ষমতার সাথে ধর্ষণের সম্পর্ক বিচার। একাজটা আমরা করছি না সম্ভবত। আপনাকে একটা সত্য ঘটনা বলি, শোনেন, আমার মা আমার চোখের সামনে ২৮ শে জুন রাতে জালেমদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল।
বলতে গিয়ে তরুণের কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে।
আমার মা সে রাতেই আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছিল। মায়ের সেই ঝুলন্ত লাশ আজও আমার চোখে ভাসে। ধর্ষণ শব্দটা শুনলে আমি সবকিছু ঝাপসা দেখি। আমি এই ধর্ষণের পেছনে মূখ্য কারণ হিসেবে দেখি ক্ষমতার বিষয়টিকে। আমরাও তো মুসলমান। সেদিন রাতে মুসলমান জালেমরাই মুসলমান নারীদের ধর্ষণ করেছিল। ধর্ম তো ছিলই—কই ধর্মের নামে তো এর আগে কোনদিন কোন জালেম ধলেশ্বরীর মা-বোনকে ধর্ষণ করেনি। কিন্তু তারা ২৮শে জুন করেছিল, কারণ তারা জুলুমের শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিল। ধর্ষণ আর খুন করে তারা তাদের ক্ষমতার জানান দিতে চেয়েছিল, ধলেশ্বরীর মানুষকে বানাতে চেয়েছিল তাদের দাস। তারা ধলেশ্বরীর মানুষের জবান বন্ধ করতে চেয়েছিল ২৮শে জুন রাতে।
কথা বলতে বলতে মৎস ভবন হয়ে প্রেসক্লাবের কাছাকাছি চলে আসে প্রিয়তি আর তরুণ। ধর্ষণবিরোধী আরো একটি প্রতিবাদী মিছিল দেখতে পায় তারা। এরা একটি ইসলামী সংগঠন। এদেরও একই দাবী, ‘ধর্ষকের বিচার চাই’।
প্রিয়তি হঠাত খেয়াল করলো তারা হেটে হেটে অনেক দূর চলে এসেছে। সে শাহবাগে ব্যাক করতে চাইলো। তরুণও সম্মতি জানিয়ে বললো, একটা রিক্সা নিই বরং। আমাকে শাহবাগ পর্যন্ত নিয়ে চলুন, ওখান থেকে আমি বসিলার বাস ধরবো।
রিক্সায় তারা শাহবাগ পর্যন্ত আসে। প্রিয়তি ভাড়া দিতে চাইলে তরুণ বলে, আপনিই বরং ভাড়াটা দেন, আমি দিতে গেলে আবার কী না কী মনে করবেন। একবার এক মেয়ের ভাড়া দিতে চেয়েছিলাম, পরে সে আমাকে কি বলেছিল জানেন, বলেছিল, রাখেন। আমিই ভাড়া দিবো। আপনারা একদিন একটা মেয়ের বাস ভাড়া দিয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প করে বেড়াবেন মেয়েরা শুধু ছেলেদের পকেট ফাঁকা করে বেড়ায়। সে সুযোগ আমি আপনাকে দিচ্ছি না।
এরপর থেকে ভাড়া দেয়ার আগে কয়েকবার ভেবে নিই আমি! (হাসি)
ভাড়া দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে পরে প্রিয়তি। রিক্সা থেকে নেমেই প্রিয়তি তার এক বান্ধবী কে দেখতে পায়। তরুণ কে হাত নেড়ে বিদায় দিয়ে প্রিয়তি তার বান্ধবীর দিকে এগিয়ে যায়। একজন আরেকজনকে হাগ (Hug) দেয়। বান্ধবী প্রিয়তির কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করে, এই ছেলের সাথে কোথায় গিয়েছিলি?
—তুই চিনিস নাকি ওকে?
— চিনবো না আবার! এরাই তো ধুরন্ধর সব নব্য রাজাকার।
কথাটা শুনে প্রিয়তির মনে পড়ে যায় ৯৯ সালে ধর্ষণ হওয়া তরুণের মায়ের কথা। বান্ধবীর মুখের দিকে চেয়ে প্রিয়তি কিছু বলেনা, ছোট্ট করে একটু হাসে কেবল।
চার
রিক্সা থেকে নেমে তরুণ একটা বাস ধরে বাসায় ফেরে। বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে গোসলে যায়। এরমধ্যে তরুণের এক বন্ধু বাথরুমের দরোজায় নক করতে থাকে। তরুণের মাথা গরম হয়ে যায়।
— আরে মাত্রই তো ঢুকলাম। গোসলটাও করতে দিবি না নাকি?
— তোর গ্রামের বাড়ি থেকে কে যেন এসেছে, বললো কি যেন একটা খারাপ সংবাদ আছে।
— উপরে নিয়া আইছস?
— হ।
গোসল করা রেখে লুঙ্গিটা কোনরকম পরেই তরুণ দৌড়ে বের হয়।
প্রতিবেশী চাচা সোবহান মিয়া আসছেন দেইখা তরুণ অবাক হয়। বুকে ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে যায়। এর আগে কোনদিন সে তরুণকে দেখতে আসে নাই। আসার কথাও না। কিন্তু কেন এসেছে, কোনো খারাপ সংবাদ না তো? এসব ভেবে চিন্তায় কুঁকড়ে গিয়ে তরুন তার প্রতিবেশি চাচাকে সালাম দেয়, আসসালামুয়ালাইকুম, চাচা। কেমন আছেন?
— আমি ভালো আছি বাজান কিন্তু তোমার দাদার অবস্থা ভালো না। গতকাল রাইতে এলাকার একদল মুসল্লি তোমাদের বাড়িতে আইসা তোমার দাদারে মারধোর করছে, গান-বাজনা বন্ধ করতে বলছে আর সব বাদ্যযন্ত্র আগুন দিয়া পুড়ায়া ফেলছে। কালকে রাতে থিকাই তোমার দাদা বিছানায় পড়া, কথা কয় না, খায় না।
তরুণের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। কোনরকম একটা ব্যাগে একটা প্যান্ট, ২ টা গেঞ্জি আর একটা লুঙ্গি ভাজ করে ঢুকিয়ে তখনি চাচাকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে।
পাঁচ
সারাটা রাস্তা জুড়ে আমার মনটা দাদার জন্য আকুপাকু করতে থাকে। বাবা-মাকে ৩ বছর বয়সে হারাইছি— এরপর দাদা-দাদিই আমাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে। কতো জায়গায় গেছি দাদার সাথে— আমার গোটা শৈশব জুড়ে আমার দাদা। আজ ভীষণ মনে পড়ছে সেসব কথা, দাদা যেখানেই গান করতে যেতো সেখানেই আমি যাওয়ার জন্য কান্না জুড়ে দিতাম। ছোট্ট একটা মানুষ আমি হাজার হাজার মানুষের মধ্যে বসে গান শুনতাম। কতরকম মানুষ দেখছি দাদার লগে ঘুইরা ঘুইরা।
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে বাড়ির কাছে চইলা আসছি বলতে পারবো না। বাস থেকে নাইমা চাচার অপেক্ষা না করেই দৌড়ে চলে গেলাম দাদার কাছে। গিয়ে দেখি হা করে অতিকষ্টে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন দাদা। দাদার পাশে গিয়ে বসি— মাথাটা কোলের উপর নিয়ে কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। দাদার মুখ ভরা দাড়ির সেই পুরনো গন্ধ। আমার চোখ ভিজা আসে। দম বন্ধ হইয়া আসতে চায়। গলা ফাটায়া কানতে ইচ্ছা করে। দাদার ঠোঁট নড়তে থাকে, কিছু বলতে চায় দাদা আমাকে। কিন্তু সে কথাটা বলার আগেই আমার কোলে মাথা রাইখা দাদা পরপারে চইলা যান।
ছয়
ইউনিভার্সিটিতে দেখা হওয়ার পর অনেকদিন আর সেলিমের সাথে তরুণের দেখাসাক্ষাৎ হয় না। তরুণের দাদা মারা যাওয়ায় আপন চাচার জানাজায় সপরিবারে সেলিমের বাবা উপস্থিত হন।
তরুণকে জড়িয়ে ধরে সেলিম। কান্নারত কণ্ঠে তরুণ বলে, দাদি ছাড়া আমার আর কেও রইলো না রে সেলিম!
আছরের নামাজ শেষে দাফনকাজ সম্পন্ন হয়। তরুণের মন হালকা করতে তাকে হাটতে নিয়ে যায় সেলিম। একটা মুরগি সাথে করে তার বাচ্চাদের নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে। বিকালের মিঠা রইদ ছড়িয়ে থাকে চারিদিকে। গাছের পাতায় পাতায় মৃদু কাঁপন, শিরশিরানি বাতাস।
সেলিম আর তরুণ সরু একটা রাস্তা ধরে হাঁটে। সেলিম কথা বলতে শুরু করে, গায়ের লোক তোর বাবা-মায়ের মৃত্যু নিয়ে নানান কথা বলে। আমরাও কিছু কিছু জানি, তর কি সেদিন রাতের কথা কিছু মনে আছে?
আমার তো তখন মাত্র ৩ বছর বয়স। কিছুই মনে নেই কেবল কয়েকটি দৃশ্য আর চিৎকার ছাড়া। দাদির কাছেই শুনছি।
১৯৯৯ সালের ২৮ শে জুন সকালে আমার বাবা আর দাদা বরিশাল যান ধানের কারবারে। বাসায় ছিলাম আমি, আমার মা আর দাদি। তুই তো জানিসই ছেলে বলতে আমার দাদা-দাদির কেবল আমার বাবাই ছিল। তাও অনেক প্রতীক্ষার পর আমার বাবা তাদের কোল জুইড়া আসছিল। তাই অনেক আদরে বড় হইছিল সে।
— ২৮ শে জুন রাতে আমাদের এলাকায় জালিমেরা ঝাপায়া পড়ছিল।
— হ্যাঁ, সেটা তো আমিও জানি। বাবা বলেছে। অনেকেই নাকি সেদিন খুন, ধর্ষণের স্বীকার হয়েছিল।
— হ, আমাদের বাড়িতেও ওদের ভয়াল থাবা পড়ছিল। বুটের শব্দে দাদি আর মা ভয়েই প্রায় মারা যাচ্ছিল সে রাতে। দরোজায় কড়া নাড়ে জানোয়ারেরা। দাদি কিছু বলতে গেলে মা তার মুখ চেপে ধরে। জালিমেরা দরোজায় আরো জোরে জোরে আঘাত করলে দাদি মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, বাসায় কোন পুরুষ মানুষ নাই, তারা কায়কারবারের কাজে বরিশাল গেছে।
— দরোজা খোল গরিবের বাচ্চা।
— সাব, সত্যি কইরা কইতেছি কেও নাই।
যখন দাদি বুঝতে পারলো হায়নাগুলি দরোজা ভেঙেই ঢুকে পড়বে তখন তাড়াতাড়ি করে আমাকে খাটের তলায় এক কোণে লুকিয়ে রাখে। দরোজা ভেঙে ঢুকে পরে জালিমের দল।
আমার মনে পরে ওরা আমার মাকে দাদির কাছ থেকে টেনে হিচড়ে ওদের কাছে নিয়া নিছিল সেদিন আর দাদিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে খাটের পাশেই ফেলে রেখেছিল। দাদির সেদিনকার চোখের ওঠানামা আজও আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। দাদি একবার চেয়ে আমাকে দেখছিল আরেকবার চেয়ে আমার বিবস্ত্র মাকে দেখছিল।
তরুণের গলা শুকিয়ে আসে।
সেলিম তার হাতে থাকা পানির বোতলটি তরুণকে এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে তরুণ বলতে শুরু করে, বাসা থেকে জালিমেরা চলে যাওয়ার পর আমাদের ঘরে রাজ্যের স্তব্ধতা নেমে আসে। কেও একটা কথাও বলে না। বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে দুই হাঁটু জড়িয়ে ধরে সেই যে মা চুপ করলো আর কথা বললো না। মধ্যরাতে আমার আর দাদির কিছুটা ঝিমুনি এলে আমরা চোখ মেলে তাকাই ফজরের আজান শুনে। তাকিয়ে দেখি আমাদেরই চোখের সামনে মায়ের লাশ ঝুলছে।
আমি তো তখনো জন্ম-মৃত্যুর কিছুই বুঝি না। দাদির মুখে শুনেছি, মাকে ওভাবে ঝুলে থাকতে দেখে আমি নাকি মায়ের শাড়ির পাড় টেনে ধরে কয়েকবার ‘মা, মা’ বলে ডেকেছিলাম।
সকালে বাবা আর দাদা বাড়ি ফেরেন। বাবার মাথায় আকাশ ভাইঙ্গা পরে। দাদা সবাইকে আগলে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার মিথ্যে অভিনয় করেন। মায়ের দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। এর মাঝে বাবা একটা কথাও কয় না। জানাজা শেষ মায়ের কবর থিকা এক মুঠ মাটি হাতে নিয়া বাবা যুদ্ধে চইলা যান আর দাদি রে বইলা যান, মা আমার পোলাডারে দেইখা রাইখো।
শেখ সাদ্দাম হোসাইন
তরুণ গদ্যকার, কবি ও চিন্তক। জন্ম: ১৯৯৫ সালে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানায়।
পড়াশুনা: ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং-এ বিবিএ।
সমসাময়িক বিষয়গুলোকে সুগভীর ভাবনায় চিত্রিত করা হয়েছে। খুব সহজ ভাষায়। চাপিয়ে দেয়া মনে হয়নি। ছোট গল্পের সরু দেহে এতো বিশাল ভাবনা দর্শন সত্যিই মুগ্ধ করেছে। বেশ ভালো লাগলো। গানের মতো হেলা করো না, ভাই।
লিখো নিয়মিত। জয় হোক কলমের