।। স্বপন রায় ।।
আমি হতে পারিনি আকাশ, মনে হয়। হেমন্ত, আমার আরো মনে হয় নদীর ওপারে কে যেন থাকে, শাদাসিধে পোশাক, চোখে চশমা, গান গাওয়ার আগে আঙুল ঘুরছে হারমোনিয়ামে…
গানবাড়ি
১.
এই বাড়ির নাম গান। জানলার নাম পাখোয়াজ। দরজার নাম বীণা। তোমার নাম,‘সখী’। মধ্যনাম,‘ভাবনা’। পদবী,‘ কাহারে বলে’। কলে জল পড়ছে,ভোরে। ভৈঁরোল, কলকলিয়ে। রেওয়াজি দেওয়াল। কয়েকটা গলাবসা খুক্খুক্ লেগে আছে।জানলার ক্যাঁচকোঁচও গিঁটখোলা হারমোনিয়ামে মিশলো। এলো এলো মৌসুমি,ঝড় এলো। ওড়নায় চাপা বিদ্যুৎ মিশবে কি মিশবে না আকাশে, যুগলবন্দী তারপর, মিশলে। ঝড় গেল, ঝর ঝর এলো। সখী, বীণা, পাখোয়াজ, ভাবনা,জল সব একাকার। গান উধাও বাড়ি, সুর তেপান্তরে।আমার সাইকেলটাও..
২.
হেমন্ত,আরো দূরে হেলান দেয়া রোদ্দুর, দূরান্তে আমি। দেখছি দূর থেকে, কোয়েলে হাঁসেরা, কোয়েলে মরিয়ম কুজুর, ব্রিজের ছায়া দেখছি। বকুল হাসলো না, ভ্রমরের কথা বোঁ বোঁ করছে। হাসবে কেন, একটু বিরক্তি, সামান্য ঘাম যেখানে মেশে, আবছা ঘূর্ণী হয়, তেপান্তরে মলিন হয় রোদের আস্কারা, হাসবে কেন, কাঁদে। দুটো পথের দিকে তাকিয়ে, একটায় হেমন্ত, আরেকটায় ওই, হেমন্ত! মন তো আজ সব কিছুতেই ফ্লু। জ্বর আবজিয়ে দেয় রাতের পাশফেরা। আমাদের রাত। আমার, তোমার। কারখানার গেটে কুয়াশা নামে। মুছে যায় মজদুর বর্গ। মুছে যাওয়া দিনগুলো সব, শব হয়ে ছাই থেকে ফেরা, কতদিন পরে এলে, বলি নাকি বলি না? হেমন্ত, ঋতুর কী যেন হয়। কী যেন হয় আমার, অনেক দূরে। কোয়েলের জল, মনে হয় মা। আমি হতে পারিনি আকাশ, মনে হয়। হেমন্ত, আমার আরো মনে হয় নদীর ওপারে কে যেন থাকে, শাদাসিধে পোশাক, চোখে চশমা, গান গাওয়ার আগে আঙুল ঘুরছে হারমোনিয়ামে….
৩.
কেন যে আবার খাঁ খাঁ হলো
কবে কোথায় কিছু চলে যাওয়ার টানে নিঝুম বাদামীতে
লয়
লয়কারি কেন যে
বাড়ি
বাঁধটাকরা বেড়ায়
জল পিপাসা মেটালো
তবু জল
আর কিভাবে যেন কার কারা
রাত যে রঙ বানায়
রঙ যে শৈলী আর শৈলী যে বাড়িতে থাকে তার গায়ে পড়া
শোর
কিছুটা ওই বুটের শব্দ
লয় লয়কারি
রাত হলেই হামলা মেশে
মহল্লা সেভাবে মেশে না…
৪.
গান হতে চাইলেই, পাখিরা ঢঙ্গী। ঠোঁট সাঁতলে দেয়, আর সিটি মারে। দাল-মক্ষণী, বেশ বেশ। সুর্মাভ্রমর। গানের ঢাকায় ভাপা চোখ, ডাল-রোটির তীব্র বিরোধী। গানের তামাম সুর, চোখ বেয়ে আকাশিয়া। পাখিটা তো ওখানেই, স্বরবিতান ঝাড়তো! পালক কুড়াতো স্বপন। পাখিটা তো জম্পেশ, একটা বাঁক দেখালেই সাঁবরিয়া…
৫.
কোনও একটি দূরে, কোনও একটি সুর। কোনও একটি বাড়ি, একটাই কোনও দিন। দূরের দিনে, সুরের বাড়ি। রিড খোলা, জলছুম ঘোর লেগে থাকে গ্রীলে। সুর বসে, দাঁড়ায়, দৌড়য় আর গান হাত নাড়ে। হাতে বন্দর, আঙুলে নৌকো, কোনও একটি বৃষ্টি নখ ছাড়িয়ে রঞ্জনী ভিজিয়ে একটি, দুটি হাহাকার। সন্ধ্যা নামছে, সাইকেল মুছে যাচ্ছে এমন…
৬.
আটকে থাকা কিসব জাল, মাকড়সার হতে পারে বা বাসি অন্ধকারের। দূরে ওড়া ওড়া একটা গল্প। স্কার্ফ আটকে আছে ঝাউয়ের গায়ে, তাতে সামান্য হিম। র-চা র-চা গন্ধটাও। খুলে মনে হল, আমি খুলতে পারি। বন্ধ করতে পারি। তাতে কী? চাউনি ঢোকে। আলোর টুকরো, স্যাঁতস্যাঁতে হয়, ওই ঢুকেই। খোলা আর বন্ধের ভেতরেই আমার মনে হয় সে ছিল।
সে বা শ্রেণিসংগ্রাম, ছটফট করছিল ‘ইশতেহারা’ মেয়েটি। স্কার্ফটা কী ওরই, ‘রেপড অ্যান্ড ডুমড’ একটা মেয়ে জালের ভেতরে, খালের ভেতরে, মাকড়সাদের তিলককামোদে, একটাই মেয়ে। ডুরে-পাড়, কমনরুমের দেয়ালে আটকানো ‘মেনু’ দেখতে দেখতে যে ভেবেছিল। যে গেয়েছিল। যার প্লেটে বসত সিংগাড়া, ফুটে উঠত ‘কমসিন’ ‘নাদান’ এক খিদে।
সে নেমে আসে। আমার হারিয়ে যাওয়া টেলিগ্রাম। সিপিয়া আকাশের যদি হয়, রোজানা ‘গজল’ই সে।জগতচোরা আলো ফিনিক দিল, কুর্তিময়। স্টেশন ছিল উপোষি চানাওয়ালার, ‘চানা জোর গরম’ বললেই এখানে সেভাবে জল নেই, সংকট আছে বোঝা যেত।
৭.
ভেতরে ঢোকার আগে পাঁজর সরালো। অত ঝাঁঝরা নয়। ঝাঁঝরিয়া নয়। একটা গান বাসা বেঁধে আছে, হাড়ের রঙ নিয়ে। আমার চেয়ে ছোট, ইন্তু টাইপের। ইন্তুর কভার ড্রাইভ আর পুল। কমনরুম পেয়ে গেল, ক্রিকেট কিট। হাড়ে হাড়ে, মজ্জায়। হ্যান্ড গ্লোভস, প্যাড, অ্যাবডোমেন গার্ড। ‘ইহাতে বিচির সুরক্ষা হয়’, কোচ তখন সুবীরদা। ছক্কা তখন মেরে হামসফর। আমার ভেতরের দিকে যেসব গোলমাল মাংসল ছিল, কমনরুমের দেয়াল হেলান দিল। সেখানে কী আরাম! চাঁদ নামে, কী স্নিগ্ধ মোমছাল, পটাশ। আর বুনছে বুনছে গেরিলারা জঙ্গল শুধুই, চে হ্যাভারস্যাক নামালো আমার মাংসে, দেখল অবাক কমনরুম। রক্ত বেশ গরম তখন, চিন চিনও করছে!
৮.
তার শার্টের বাইরে চিরকাল। বোতামে ধরা মুহূর্তের সা, খুললে ধাক্কার আগে যে গাড়িটা রোমশ অন্ধকারে রে রে, তার পার্টস চিকণ হয়ে ওঠে। গাড়ির বনেটে বসে কবেকার মধুবালা। গায়ে হিল্লোল। মাৎ করা
পা
স্বপ্নসমগ্রে
মোজা পরেই
পড়ল
একটা ছাতা চাই, শুধু শুধু ঘুরবে। ধা ধা ধাঁধাঁ। হাসলেই হয় যে প্রকার রেলিংবুলিং, জল পড়ছে তার লোহায় ঝাঁক ঝাঁক, যাকে বৃষ্টি বলে, সেই। ছাতা খুলল মধুবালা, কী সুষমা!
নিজেই জানতো না সে, চিরকাল কিছু নয়
শার্টে বোতাম বসানো
ছিঁড়ে গেলে সেলাই করা, এই আর কী…
৯.
গায়েপড়া বর্ষা কি ছিল? হাজারে একটা। ক্লাউড কম্পিউটিং থামিয়ে, সে ধারালুপ্ত আঙিনায় পড়ছে। গায়ে উদলা শিকড়। একটাই হাজারে।
আমি আনিনি, বৃষ্টিকীলক আমি জন্মেও যা শুনিনি।
জানিনা বৃষ্টি কিভাবে নোডাল এজেন্ট হয়েছিল খেতিবাড়ির, গায়ে পড়ল যেদিন খুব যে লেগেছিল তা নয়, শুধু অবাক আমার দিকে তাকিয়ে সে, তার শরীরে বেজে উঠল, ‘কি লোক তুমি, কীলক বোঝো না’ এই গানটা
এখন কিন্তু শুনতে পাচ্ছি। ভেজা ভেজা হাওয়ামহল শোনাচ্ছে। যেখানে আমার নিঃশ্বাসও জমা পড়ে গেল…..
১০.
গানবাড়ি, আজকে যা, কালকেও তাই কীভাবে! একটা তারের ফারাক, সেতার না হলেও, একটা চোখচেরা থ্রু-এর তফাৎ, থাকবেই। সেই যে জলের গ্লাস এগিয়ে দিল, আর তরঙ্গ এদিকে সুর্মা। জল ভাবে, তরঙ্গ ভাঙে।কী যে ঢেউ-ছিপছিপে সব, দুটি আশায় দুটি ভালবাসা, আঃ রহো, অবরহ, ফল সামান্য বেরিয়ে, আমি অসামান্য তাকিয়ে, বৃষ্টি আবার এলো।
গানবাড়ি এখন গানবারি।
১১.
রোদের অপেক্ষা-ধরা খিলখিল এ কেমন গ্রাম হে
গান জমে
জমে শ্যাওলানিহার থেকে আশানুরূপ মা
মা
পায়ে পায়ে তুলে আনে ঘুমপাড়ানি সুর ও রবিবার
একবাড়ি গান
খোকা ওঠে, মা-বিনা এ ঘর শুনসান ছিল
তার বৌ কথা বলেই পাখি
মা
একটা জাল ফেলে দেয় এসেই তার গ্রামে
একটি সংসার পায় সুর
গান আবার চিহ্ন রাখার ফলে হীন হীন হীন হয়ে যায়
স্বপন রায়
কবি। জন্ম ১৯৫৬। ভারতের দুটো ইস্পাতনগরী জামশেদপুর এবং রাউরকেলা স্বপন রায়ের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রথমটি জন্মসূত্রে। দ্বিতীয়টি বড় হয়ে ওঠার সূত্রে। নব্বই দশকের শুরুতে ‘নতুন কবিতা’র ভাবনায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পুরনো, প্রতিষ্ঠিত ধারাকবিতা ত্যাগ করে কবিতাকে নানাভাবে নতুন করার কথা ভাবতে শুরু করেন। এই ভাবনাসূত্রে গাঁথা বেশ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে প্রকাশ করতে থাকেন কবিতা ক্যাম্পাস। ২০০২ সালে ‘নতুন কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশনায় হাত দেন কবিবন্ধু রঞ্জন মৈত্র’র সংগে। নতুন ধারার কবিতার বই প্রকাশ করতে থাকে ‘নতুন কবিতা প্রকাশনী’। তবে স্বপন রায় গদ্যও লিখেছেন। মূলত তাঁরই উৎসাহে কবিতার ট্রেকিং শুরু হয়। হিমালয়ের গহীন গভীরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কবিরা কেন্দ্র ছেড়ে বেরিয়ে আসেন শারীরিকভাবে। স্বপন তাঁর কলমে বাংলা সাহিত্যে কখনো না হওয়া কবিতার ট্রেকিং তুলে এনেছেন স্থানিক লোককথার মিশ্রণে। এই গদ্যগুলোকে তিনি বলেন ভ্রমণকল্প। তাঁর বেশকিছু প্রকাশিত কবিতা এবং গদ্য’র বই আছে। তিনি এখনো সক্রিয়।
প্রকাশিত বই: কাব্যগ্রন্থ: ‘আমি আসছি’ (সংস্কৃতি খবর, ১৯৮৪), ‘চে’ (সংস্কৃতি খবর, ১৯৯০), ‘লেনিন নগরী’ (কবিতা ক্যাম্পাস, ১৯৯২), ‘কুয়াশা কেবিন’ (নতুন কবিতা, ১৯৯৫), ‘ডুরে কমনরুম’ (কবিতা ক্যাম্পাস, ১৯৯৭), ‘মেঘান্তারা’ (নতুন কবিতা, ২০০৩), ‘হ থেকে রিণ‘ (নতুন কবিতা, ২০০৯), ‘স্বপনে বানানো একা‘ (সঙ্কলন, কৌরব, ২০১০), ‘দেশরাগ’ (নতুন কবিতা, ২০১১), ‘সিনেমা সিনেমা’ (নতুন কবিতা, ২০১৫)। গদ্যগ্রন্থ: ‘স্বর্গের ফোকাস’ (কবিতা ক্যাম্পাস), ‘রুয়ামের সঙ্গে’ (কবিতা ক্যাম্পাস), ‘একশো সূর্যে’ (নতুন কবিতা, ২০০৯), ‘কুঁচবাহার’ (ঐহিক, ২০১৭)।
অনবদ্য লেখা