আজ বৃহস্পতিবার, ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কুচুন, করোনা আর পায়রা

ছোটগল্প

।। অর্ক চট্টোপাধ্যায় ।।

পাখিদের কি করোনা হয়? তাদের কে চিকিৎসা করে। তাদের সরকারও কি আমাদের মতো তাদের মরতে ছেড়ে দেয়? তাদের লাশও কি গঙ্গায় ভেসে যায়? রক্তের গন্ধে ভরে যায় বাতাস? নাছোড়বান্দা প্রশ্নেরা কুচুনের মগজের ভেতর চুল কাটছিল। 

সদ্য মুদ্রিত বইয়ের জুড়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলোর দিকে কখনো তাকিয়ে দেখেছেন পাঠক? আঙুল দিয়ে পাতাগুলোকে কেটে আলাদা করতে গিয়ে অনেকসময় কাগজ বাইরের দিকে বেরিয়ে যায়, এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়। কিন্তু পাতাগুলো না কাটলে জানা যাবে না বইয়ের ঐ জায়গায় কি হয়েছিল। জুড়ে যাওয়া পাতা কাঁচি দিয়ে কাটতে গেলে কুচুন করে শব্দ হয়।    

নাম কুচুন। চুল কাটার শব্দে রাখা নাম। কুচ করে কাটা চুলের সঙ্গে নাম কিন্তু খসে পড়েনি। বাপ-ঠাকুরদা নাপিত ছিল। কুচুন বিয়েথা করেনি। তাই নাপিত বংশ বই এখানেই শেষ হল। আজকাল অবশ্য পরের কথা ভাবার সময় নেই, এখনকার বাজার এতই খারাপ! কী যেন একটা বেল্লিক ভাইরাস এসেছে। মালটাকে দেখা যায় না কিন্তু লাইন দিয়ে লোক মরে যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে সবাই ডাক্তারদের মতো মুখোশ পরে ঘুরছে। বিদঘুটে পরিস্থিতি। লোকে ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী নিজে খবরের চ্যানেলে এসে বলেছে, ভারত আত্মনির্ভর হচ্ছে। তা বলে কি লোকে বাড়িতে বসে চুল দাড়ি কাটছে? মাসের পর মাস সেলুনে লোক নেই। লকডাউনের সময় নয় তাও ঠিক ছিল কিন্তু এখন কুচুনের সন্দেহ হচ্ছে লোকজন বোধ হয় আত্মনির্ভরভাবে চুলদাড়ি কাটার অভ্যাস করে ফেলেছে। সেলুন তাই গড়ের মাঠ।   

সেদিন বাজারে মুখোশখান  নাকের একটু নীচে নামিয়ে রফিক মিয়া কুচুনকে বলেছিল: “যে কোন গণ্ডগোল হলে গরীব মানুষেরই সব থেকে বড় ঝামেলা, কুচুনদা। সবাই ভাবছে আমরা গরীব লোকেরা যেন করোনার আড়ৎ! ভয়ে তফাৎ থাকছে।”  কুচুন বোকাসোকা লোক তবে মনে হল মিয়া খুব ভুল বোধ হয় বলেনি। এমনিতেই তার সেলুন পুরোনো, ভাঙাচোরা। এখনকার দিনের এস্পা-টেস্পা কুচুন বোঝে না। ওসব বানিয়ে কাজ নেই। আজকাল একা একা নিজেই নিজের সেলুনে বসে থাকে। কালেভদ্রে একটা দুটো খদ্দের। বাকিটা মাছি মারা। 

বাপ ঠাকুরদার চোট খাওয়া দেওয়ালের দিকে চেয়ে ভাবে নাপিত বংশের আসন্ন সন্ধ্যাকালের কথা। কুচুনের আলো নিভলেই চুল কাটায় অন্ধকার নেমে আসবে। সেলুন-ঘরের কোণে পড়ে থাকা চুলের ঢিপি ছোট হতে হতে একরত্তিতে এসে ঠেকেছে। যা দিনকাল তাতে করোনা থেকে মরোনা হতে আর কতক্ষণ! জীবনমৃত্যু নিয়ে এসব সাতপাঁচ ভাবছিল এমনসময় ফড়ফড় করে শব্দ হতে চোখ তুলে দেখলো একটা পায়রা এসে বসেছে খদ্দের বসার ফাঁকা বেঞ্চে। কুচুনের চিন্তিত মুখে একফালি হাসি খেলে গেল। পাখাটা বন্ধ করে দিল পাছে কাটা পড়ে। নড়াচড়াতে ভয় পেলনা পায়রা। সাহস আছে বলতে হবে! কুচুন ওর দিকে চেয়ে বললো, “কি রে পালক কাটতে এলি নাকি? তোর বুঝি করোনার ভয় নেই! দো গজ কি দুরি কই?” পায়রাটা কি বুঝলো কে জানে, ঠায় তাকিয়ে রইলো কুচুনের দিকে। তারপর হঠাৎ উড়ে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।

এরপর একদিন এল করোনার থাবা। কুচুনের শরীরে উপসর্গ দেখা দিতে লাগলো। গন্ধ, স্বাদ, উবে গেল। চুলের গন্ধও বন্ধ হয়ে গেল। সারাজীবন কুচুন একঘরে অনেকগুলো লোকের সঙ্গে থাকলে তাদের সবার মাথা থেকে ভেসে আসা চুলের গন্ধ পেয়ে এসেছে। জম্ম নাপিত যাকে বলে। করোনায় সেই বিশেষ ক্ষমতাও চলে গেল। জ্বর, দুর্বলতায় শরীর ভেঙে পড়লো একেবারে। ধুমজ্বরের ঘোরে কুচুন দেখল:-

ওর সেলুনে পাখা ঘুরছে। ফুল স্পিডে। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে সেই পায়রাখান। চেয়ারের হাতলে বাচ্চাদের চুল কাটার জন্য রাখা পাটাতনের ওপর চুপটি করে বসে আছে। কাট টু পাখা। ফুল স্পিডে ঘুরছে। হঠাৎ কী যে হলো, মৃত্যুর কী এমন ঝোঁকে, পায়রাটা একলাফে উড়ে গেল ওপরে, পাখার দিকে। ব্যাস, তারপর ছড়িয়ে গেল রক্ত! পাখার ব্লেডে আর মেঝেতে। ঘরের কোণে যেখানে চুলের ঢিপি থাকতো তার পাশে পালকের ঢের। 

জ্বরের মধ্যে একই স্বপ্নের রিপিট টেলিকাস্ট হতে লাগল। একটু হুঁশ এলে কুচুন ভাবলো, তবে কি শেষদিন সেলুন বন্ধ করার সময় পায়রাটা ভুল করে আটকে পড়লো? কুচুন কি পাখাটা বন্ধ করতে ভুলে গেল? এতদিন ধরে পাখা কি ঘুরেই চলেছে? আর রক্ত? পালকের ঢিপি? 

কোনোরকমে তিন হপ্তা কাটলো। টেস্ট এবার নেগেটিভ। কুচুন দুর্বল শরীর নিয়েই সেলুনে গেল। তাকে জানতেই হবে বন্ধ দরজার ওপারে কী আছে। ভয়ে ভয়ে তালা খুলে দেখলো কই, কোথাও কিছু নেই। পাখা বন্ধ রয়েছে। পায়রা, রক্ত, পালকের ঢের, কিছুই নেই। তাহলে সবই কি করোনার অলীক কল্পনা? কিন্তু কুচুনের মনে হল পায়রাটার ফিরে আসা দরকার। না হলে সে নিশ্চিত হতে পারছে না। পায়রাটাকে একবার দেখে নিতে পারলে আশ্বস্ত বোধ করবে। 

নিজের চুল কাটার চেয়ারে বসে বাইরের দিকে চেয়ে রইলো কুচুন। চোখ আকাশে। ইলেক্ট্রিকের তারে। যদি হঠাৎ উড়ে এসে বসে পায়রাটা! বাইরে কাঠফাটা রোদ। লকডাউন না থাকলেও করোনার ভয়ে রাস্তাঘাটে লোকজন কম। কুচুনের মনের ভিতর কেউ যেন আলতো করে কাঁচি চালাচ্ছিল আর কুচ কুচ করে ঝরে যাচ্ছিল চুলচেরা চিন্তার দলবল। পাখিদের কি করোনা হয়? তাদের কে চিকিৎসা করে। তাদের সরকারও কি আমাদের মতো তাদের মরতে ছেড়ে দেয়? তাদের লাশও কি গঙ্গায় ভেসে যায়? রক্তের গন্ধে ভরে যায় বাতাস? নাছোড়বান্দা প্রশ্নেরা কুচুনের মগজের ভেতর চুল কাটছিল। 

পায়রাটা আর ফেরেনি। কুচুনও নিশ্চিত হতে পারেনি। রোজ সেলুনে বসে আকাশের দিকে, ইলেক্ট্রিকের তারের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করেছে। করোনায় কোথায় কিভাবে কতশত পাখি মরেছে অথবা  মরেনি তার কোন রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। 

কুচুনের কাঁচি দিয়ে জুড়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলো সমান করে কেটে ফুঁ দিয়ে ভেতর ঢুকলে দেখা যাবে ঐ পাতাদুটোয় কিছুই লেখা নেই। একেবারে সাদা পাতা! ধপধপে পালকে রক্তের ছিটেফোঁটাও নেই!

মুদ্রণপ্রমাদ। 

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কথাসাহিত্যিক। পেশায় অধ্যাপক। জন্ম ১৯৮৫ সালে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার উত্তরপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। আই,আই,টি গান্ধীনগরের মানববিদ্যা বিভাগে সাহিত্য এবং দর্শন পড়ান। পেশাসূত্রে বসবাস করেন গুজরাতের গান্ধীনগরে। সম্পাদনা করেছেন ‘অ্যাশট্রে’ পত্রিকা। প্রকাশিত বই: ‘পিং পং গন্ধ’ (গল্পগ্রন্থ, ২০০৯), ‘সাইজ জিরো’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৫), ‘অলিখিত হ্রস্বস্বরের সন্ধানে’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৮), ‘উপন্যস্ত’ (উপন্যাস, ২০১৮), ‘আতশবাজি ছায়াপথে ফিরে যাও’ (গল্পগ্রন্থ, ২০২১)

Share

1 thought on “কুচুন, করোনা আর পায়রা”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top