আজ বৃহস্পতিবার, ৮ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

এবারের ঈদে কিছু কথা

। সম্পাদকীয় দফতর ।।

ইসলাম কেবলমাত্র ‘মুসলমান’ পরিচিতির একটি ধর্মীয় ব্যবস্থা হিসাবে গড়ে ওঠেনি। ইসলাম মানব মুক্তির উপায় হিসাবেই হাজির হয়েছে আল্লাহর সৃষ্ট এই দুনিয়ায়। ইসলাম সার্বিকভাবে যে রবুবিয়াত বা প্রতিপালনের কথা বলে, সেখানে আল্লাহুর চোখে যেমন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- সবাই সমান, ঠিক তেমনই আল্লাহ মানুষ, পশু-পাখী, গাছপালা, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি সবকিছুর জন্যেই হক নির্দিষ্ট করেছেন। মানুষ হিশাবে, আল্লাহর বান্দা হিশাবে আমাদের কর্তব্য নিজের এবং প্রত্যেকের হকের ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকা। ইনসাফ ও সমানাধিকারের পক্ষে থাকা। বেইনসাফের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আমাদের স্মরণে রাখা উচিত, ইসলাম যেহেতু গোত্রবাদ ও জাতিবাদের উপরে উঠে মানুষের বিশ্ব উম্মাহ গঠনের কথা বলেছে, তাই দেশ-কাল-পাত্র নিরপেক্ষভাবে ইসলামের মূল মর্মবানী সর্বত্রই এক। আবার তার মানে এই নয়, যেহেতু ইসলামিক সভ্যতার যাত্রা শুরু আরব দুনিয়া থেকে তাই আরব দুনিয়ার সাংস্কৃতিক চিহ্নসমূহকে ইসলাম তার ধর্মের নামে সকল সমাজে রফতানি করে জগতের বৈচিত্র্যসমূহের নিরাকারণ চায়। এমনটা মোটেও ইসলাম নয়। বরং ইসলাম যেহেতু জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী তাই সে বিশ্ব উম্মাহ গঠনে একদিকে তার মূল মর্মভাবের ঐক্যেই জগতের বৈচিত্র্যগুলোকে ধারণ করতে চায়, কারণ, আল্লাহ পরম প্রতিপালক এবং তিনি অতীব দয়ালু।

আজ পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। গোটা বিশ্বের পাশাপাশি বড় বাংলায় সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে এই দিন। রোজা পালনের মধ্য দিয়ে পুরা একটি মাস নিজের মহৎগুণগুলো বিকাশের জন্য যে সাধনা তা আনন্দ হয়ে আজ হাজির হয়েছে। বড় বাংলার সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রতিপক্ষ’র তরফ থেকে সকল পাঠক, লেখক ও শিল্পীদের সকলের সঙ্গে সেই আনন্দ আমরাও উপলব্ধি করতে চাই। ঈদের শুভেচ্ছা জানাই। মোবারকবাদ। ভালোবাসা সবাইকে। ইনসাফ ও সাম্য নির্ভর সমাজ তৈরির সংগ্রামে দাওয়াত সবাইকে। একদিকে জায়ানপন্থী জাতিবাদ, অন্যদিকে বৃহৎ পুঁজির নিয়ন্ত্রক কর্পোরেটতন্ত্র, মার্কিন খবরদারি এবং উপমহাদেশের হিন্দুত্ববাদ তথা হিন্দি-হিন্দু জাতিবাদ বিশ্বের বড় একটা অংশকে বিপণ্ণ করে তুলেছে। আর এসবের মোকাবেলায় যে মুসলিম জাতিবাদ মাথা তুলতে চাইছে, তাও সৌভাতৃত্ব, ইনসাফ ও সাম্যের প্রশ্নগুলিকে বিপাকে ফেলে দেয়। পবিত্র ঈদের দিনে আমাদের প্রার্থনা, আমরা যাতে সকল প্রকার গোত্রবাদ ও জাতিবাদকে প্রতিহত করতে পারি, আল্লাহ আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। এশিয়ায় ফিলিস্তিনের জাতীয় গণতান্ত্রিক আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ইনসাফ কায়েমের লড়াই আজ আমাদের কাছে প্রেরণা। দশকের পর দশক ধরে জায়ানবাদীরা নিপীড়নের সামনে দাঁড়িয়ে মুক্তিকামী ফিলিস্তিনীয় জনতা যে প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাতের লড়াই নামিয়ে এনেছে তা উপমহাদেশের সকল নিপীড়িত মানুষকে বিশেষভাবে প্রেরণা দেয়। বিশেষত বড় বাংলাকে। বড় বাংলা তথা উপমহাদেশের সামনে বড় বিপদ দিল্লির ‘জায়ানবাদী’ বা হিন্দুত্ববাদীরা। হিন্দি-হিন্দু জাতিবাদীরা চাইছে বৃহৎ বঙ্গের জল-জমিন-জঙ্গল, জান-মাল-সম্ভ্রম সব লুঠ করতে। বড় বাংলার বাংলা ভাষাভাষি মানুষ আজ তাদের টার্গেট। এই নয়া নাৎসিদের ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কাণ্ডজ্ঞান বজায় রাখতে হবে আমাদের।

আজকের এই দিনে আমাদের মনে রাখা উচিত ইসলাম রক্তবাদ, গোত্রবাদ ও জাতিবাদ প্রতিহত করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে রুহানিয়াত বা পরমার্থিক স্তরে উন্নীত করবার প্রতিশ্রুতি দেয়। আমরা চাই সেই প্রতিশ্রুতি জারি থাকুক এবং ধর্ম নির্বিশেষে আমরা আমাদের আত্মার আকুতিটুকু যেন শুনি, নিজেরা বুঝতে পারি, অপরকে বোঝাতে পারি এবং সাড়া দিতে সক্ষম হই। সকল প্রকার সংকীর্ণ পরিচয়বাদের ঊর্দ্ধে উঠে আমরা যেন দাবি করতে পারি আমরা মানুষ। যে মানুষকে স্বয়ং আল্লাহ ফেরেশতাদের সিজদা দিতে নির্দেশ দিয়েছেলেন। মানুষের জয় হোক।

হক ও ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি ও সহাবস্থানের বিশ্ব সমাজ তথা উম্মাহ গঠনে ব্যাপারে ইসলামের মূল যে মর্মবাণী, তা এই ঈদ–উল-ফিতরের মধ্যে প্রতিভাত হয়। রমজানে দীর্ঘ একমাসব্যাপী রোজা রাখার মাধ্যমে ত্যাগ-তিতীক্ষা ও সংযমের দৃষ্টান্ত তৈরি ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রত্যয় দৃঢ় করেন ঈমানদারগণ। পরমের সঙ্গে সমন্ধ দৃঢ় করার পাশাপাশি প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যের ব্যাপারেও ঈমানদারদের সচেতন করে ঈদ-উল-ফিতর। নামাজ-রোজা ও জাকাত, এই সকল গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে ঋজু যে ইসলাম, ঈদ আমাদের তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়। বান্দার রুহানি বিকাশ যে পরমের সঙ্গে নিত্য সম্পর্ক জারি রাখার পাশাপাশি পারিপার্শ্বের প্রতি নিজের দায়িত্বপালনের মধ্যে দিয়েই সম্ভব, ঈদ-উল-ফিতর ইসলামের এই মর্মবাণীকে আমাদের স্মরণ করায়।

আমাদের আরও মনে রাখা উচিত ইসলাম কেবলমাত্র ‘মুসলমান’ পরিচিতির একটি ধর্মীয় ব্যবস্থা হিসাবে গড়ে ওঠেনি। ইসলাম মানব মুক্তির উপায় হিসাবেই হাজির হয়েছে আল্লাহর সৃষ্ট এই দুনিয়ায়। ইসলাম সার্বিকভাবে যে রবুবিয়াত বা প্রতিপালনের কথা বলে, সেখানে আল্লাহুর চোখে যেমন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- সবাই সমান, ঠিক তেমনই আল্লাহ মানুষ, পশু-পাখী, গাছপালা, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি সবকিছুর জন্যেই হক নির্দিষ্ট করেছেন। মানুষ হিশাবে, আল্লাহর বান্দা হিশাবে আমাদের কর্তব্য নিজের এবং প্রত্যেকের হকের ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকা। ইনসাফ ও সমানাধিকারের পক্ষে থাকা। বেইনসাফের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আমাদের স্মরণে রাখা উচিত, ইসলাম যেহেতু গোত্রবাদ ও জাতিবাদের উপরে উঠে মানুষের বিশ্ব উম্মাহ গঠনের কথা বলেছে, তাই দেশ-কাল-পাত্র নিরপেক্ষভাবে ইসলামের মূল মর্মবানী সর্বত্রই এক। আবার তার মানে এই নয়, যেহেতু ইসলামিক সভ্যতার যাত্রা শুরু আরব দুনিয়া থেকে তাই আরব দুনিয়ার সাংস্কৃতিক চিহ্নসমূহকে ইসলাম তার ধর্মের নামে সকল সমাজে রফতানি করে জগতের বৈচিত্র্যসমূহের নিরাকারণ চায়। এমনটা মোটেও ইসলাম নয়। বরং ইসলাম যেহেতু জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী তাই সে বিশ্ব উম্মাহ গঠনে একদিকে তার মূল মর্মভাবের ঐক্যেই জগতের বৈচিত্র্যগুলোকে ধারণ করতে চায়, কারণ, আল্লাহ পরম প্রতিপালক এবং তিনি অতীব দয়ালু। আর তাই ইসলাম একই সাথে হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক আবার একইসাথে স্থানীয়। স্থানিক ও বৈশ্বিক চেতনা ইসলামে যুগপৎ প্রবাহমান। তাই বড় বাংলায় ইসলামের হাজির থাকা একেবারেই বড় বাংলার মানুষের নিজস্বতাকে আমলে রেখে যেমন, তেমনই বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তার সম্বন্ধ-সম্পর্ক বিদ্যমান রেখেই নিজের রূপ বিকশিত করতে পারে।

ইতিহাস বলছে, গণউৎসব আকারে বঙ্গে ঈদ পালন শুরু হয় মোঘল আমল থেকে। ঢাকাতেই এর সূচনা। বৃহৎ বঙ্গের ইতিহাসে, সমাজ জীবনে, দৈনন্দিন যাপনে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আমাদের ইসলামেরও রঙ-রূপেরও কিছু নিজস্বতা আছে। এই অঞ্চলে ইসলাম তার যাত্রা শুরু করার পর থেকেই আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক করেছে, ভাবের বিনিময় উদার, প্রশস্ত ও আন্তরিক করেছে। বড় বাংলার সংস্কৃতি বেগবান হয়েছে ইসলামের আগমনে যেমন, যেমন আরবী-ফার্সি আর তুর্কি ভাষার উপাদান যুক্ত হয়েছে বাঙলা ভাষায়, ঠিক তেমনই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আবার এখানকার ভাবজগতের উপাদানে ইসলাম নিজেও নিজেকে বঙ্গজীবনের অংশ করেছে অবলীলায়। গড়ে উঠেছে বাংলার ফকিরি, বয়াতি, মুর্শিদি, সুফি ধারা। এই ধারাগুলো প্রকৃতিনিবিড় গণযাপনের সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত, তেমনই সাংখ্য-সহ বঙ্গের অবৈদিক ভাববৈচিত্র্য বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নদীয়ার ভাবচর্চা ইসলামের মর্মভাব দ্বারা যেমন পরিপুষ্ট তেমনই ইসলাম বঙ্গের লৌকিক ভক্তির ধারাগুলি আত্মস্থ করে নিজস্ব একটা রূপ পরিগ্রহণ করেছে। তাই ইসলামের বিবেচনায় বিশ্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই লোকেশন, লোক, লোকজগতও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা কখনোই পরিচয়বাদ বা জাতিবাদের আয়না দিয়ে ধরা যাবে না। ইসলাম জাতিবাদকে বরদাস্ত করে না। তা সে আরবী জাতিবাদ, ইরানী বা তুরানী জাতিবাদ হোক কিংবা বাঙালি জাতিবাদ অথবা হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দুস্তানি জাতিবাদ। ইসলাম মানব সমাজের পক্ষে কথা বলে, প্রাণ-প্রকৃতি ও পরমের দৃ্ঢ় সম্পর্কযুক্ত সমাজের পক্ষে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও লৈঙ্গিক বিভাজন-বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার অবস্থান শক্তপোক্ত।

ঈদ-উল-ফিতরের এই উৎসবের দিনে এই কথাগুলো আমরা যাতে স্মরণে রেখে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি, সবাই যেন তাদের নিজ নিজ অনুপ্রেণার উৎস থেকে সেই তৌফিক লাভ করে। আমিন।

Eid Prayers In Barashalghar, Debidwar, Comilla
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top