আজ বৃহস্পতিবার, ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

‘এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন’

।। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন ।।

আধুনিক ধর্মতত্ত্বের বিরুদ্ধে যদি লড়তেই হয় তাহলে সবার আগে লড়তে হবে পরিচয়বাদ, জাতিবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এই সেই রাষ্ট্র যার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করবার জন্যই সাম্প্রদায়িক হানহানি অনিবার্য ভাবেই উস্‌কে দেওয়া হয়। ধর্ম যখন পরিচয়বাদ ও জাতিবাদে পর্যবসিত হয় তার করুণ পরিণতি আমরা দেখেছি, দেখাছি কীভাবে পরিচয়বাদ ও জাতিবাদ উপমহাদেশকে দুই ভাগ করে দিল। এখন সীমান্তের দুই দিকে যারা সংখ্যায় বেশী তারা প্রকট হিংসা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে যারা সংখ্যায় কম তাদের বিরুদ্ধে। হিন্দুত্ববাদী হিন্দু বলি- কিম্বা জাতিবাদী মুসলমান- তারা একই মুদ্রার এই পিঠ আর ঐ পিঠ।

‘এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন’

শব্দের ঘরে কে বারাম দেয়
নিঃশব্দে কে আছে সদাই
যেদিন হবে মহাপ্রলয়
কে কার করে দমন ।।
এই বেলা তোর ঘরের খবর
জেনে নে মন…

১৩১ বছর হলো, ফকির লালন সাঁই আমাদের দৃশ্য জগতের আড়ালে চলে গিয়েছেন। তাঁর পদ, কালাম, তাঁর সাধন ঘর আজও বৃহৎ বঙ্গে অধিষ্ঠিত। তিনি তাঁর ভাব নিয়ে আজও আমাদের মধ্যে, সাধুগুরু-রসিকজনের মধ্যে হাজির আছেন। কিন্তু তাঁকে কি আমরা এই আধুনিক পরিচয়বাদী মানুষের দল ধরে রাখতে পারছি? নাকি তাঁর স্মৃতিকে আমাদের সত্তা থেকে ক্রমশই খারিজ করে ফেলছি আমরা? এই প্রশ্ন আজ কোথাও কোথাও কারও কারও মনে উঁকি দিচ্ছে।

কোভিডের অজুহাতে ক্রমান্বয়ে সাঁইজীর দরবারে, ছেউড়িয়ায় ও বড় বাংলার নানাপ্রান্তে সাধুসমাগম বন্ধ রাখা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ও আর্ন্তরাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে। লালনচর্চা থমকে আছে শুধু তাই নয়, বরং লালনের নাম করে বেশ কিছু সময় ধরে চলে আসছে নানাবিধ তথ্য ও ভাববিকৃতি। আর এই বিকৃতির মাধ্যমে যেমন লালন সাঁইর চিন্তার জায়গাটা অবলীলায় নাই হয়ে যাচ্ছে ঠিক তেমনই এই বিকৃতির পাশাপাশি সমাজে নতুন করে উদয় হয়েছে ধর্মের নামে পরিচয়বাদী ও জাতিবাদী বিবাদ। এই বিবাদ বিষবৃক্ষ হয়ে উঠেছিল উনবিংশ শতকেই। আর আজ পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন বা বিশ্বায়িত সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজিই হয়ে উঠেছে ামামদের জীবন ও জীবন ব্যবস্থার পূর্ণ নিয়ন্ত্রক। পুঁজি-ই আজকের রিলিজিয়ন, যে রিলিজিয়ন মানুষকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে অধুনান্তিক জাতিবাদী চেহারা প্রকট করেছে। আমরা ঘরকে ভুলে গেছি তাই, আর ঘর বা ঘরের ভাণ্ডকে ভুলে গেলে তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান থেকেও চ্যুত হতে হয়। সেইটাই হচ্ছি আমরা। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে মহাপ্রলয়ের সেই দিন, যে দিন হয়তো বা জবাব দিতে হবে আমাদের সবাইকেই। ফকির লালন সাঁইয়ের কালামে কিন্তু এই হুঁশিয়ারি রয়েছে। আমাদের এই ব্যাপারে অনেক আগেই তিনি সজাগ করে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বলছেন, এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন। এই হুঁশিয়ারিকে স্রেফ অন্তর্মুখী মরমী আকুতি হিশাবে ভাবলে চলবে না। বরং বর্তমান পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় আমরা কীভাবে ‘বর্তমান’ আছি সেই হদিসও নিতে হবে।

আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে আমরা দেখি ধর্মে ধর্মে ভেদ হিংসার রূপ পরিগ্রহণ করে, কিন্তু আধুনিকেরা আধুনিকতা এবং আধুনিক সমাজের মধ্যে এই হিংসার কারণ অনুসন্ধান না করে এলোপাথাড়ি ধর্মকে দোষারোপ করতে শুরু করে। অথচ এই হিংসার সূত্র আধুনিক কালে পরিচয়বাদ, জাতিবাদ এবং অপরের বিনাশের মধ্য দিয়ে নিজের জাতিবাদী পরিচয়ের সত্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে নিহিত। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে তীব্র প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে অপরকে বিনাশের বাসনা ও হিংসা আরও ক্রূর রূপ নেয়। কেন আধুনিক সমাজে মানুষ ইহলৌকিক সমস্যার সমাধান বাদ দিয়ে পরলোকে মুক্তি খোঁজে? পুঁজি অল্প মানুষকে মহা ধনি করে তোলে, আর অধিকাংশকে পরিণত করে সর্বহারায়। সর্বহারা যদি পুঁজির কারবার না বোঝে তখন সে বেঁচে থাকার জন্য পরকালকেই আঁকড়ে ধরে। এই জন্মে সে কিছু পেল না, অতএব পরকালই তার একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে।

তাই ধর্মে ধর্মে পার্থক্য বা বিভেদ দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাখ্যা হয় না। বড় বাংলায় বা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হিংস্রতার ব্যাখ্যা ধর্ম দিয়ে হবে না। আধুনিক সাম্প্রদায়িক হিংসার কারন নিহিত রয়েছে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নে, নিহিত রয়েছে বাংলাদেশে দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট শাসন এবং বৃহৎ বঙ্গের পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরার ওপর দিল্লির হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি ব্যবস্থার ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে।

এই জন্য কথা উঠেছে দুর্গাপূজা কেন্দ্র করে দাঙ্গা ও হিংসার জন্য পাশাপাশি দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরাই দায়ী। একালে পুঁজি ছাড়া আর কোন ধর্ম নাই, ধর্মের নামে যে ঝাণ্ডা ওঠানো হয় বা যে ঝান্ডা তুলে ধরতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সেটা ধর্ম না, বরং অন্য সম্প্রদায়ের বিপরীতে স্রেফ নিজের সাম্প্রদায়িক বা জাতিবাদী পরিচয় প্রতিষ্ঠা।

সাম্প্রাদায়িক ধর্মীয় হানাহানিতে মানুষ কি মরে না? মরে অবশ্যই। কিন্তু ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কিলিংকে আধুনিক মিলিটারি-ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে অতীত কিম্বা বর্তমানে ধর্ম যুদ্ধ তার ধারে কাছেও যেতে পারে নি। যে হিটলার ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারলেন তিনি জাতিবাদী ছিলেন। জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। আধুনিক রাষ্ট্র নিত্যই দুনিয়াব্যাপী নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সার্বভৌম ক্ষমতা আগে আল্লাহ বা ঈশ্বরের ছিল, সেই সার্বভৌম ক্ষমতা এখন রাষ্ট্রের হাতে কুক্ষিগত। হিংসা, হত্যা ও যুদ্ধের ওপর আধুনিক রাষ্ট্রেরই একচেটিয়া, ধর্মের না। আধুনিক রাষ্ট্র ধর্মের জন্য হিংসা বরদাশত করে না, কিন্তু জাতির শহিদ হবার জন্য নাগরিকদের প্রণোদিত করে। হিংসা ও হত্যার ওপর একচেটিয়া এখতিয়ার আধুনিক রাষ্ট্র নিজের কাছে কুক্ষিগত রাখতে চায়।

আধুনিক রাষ্ট্র অনিবার্য ভাবেই ধর্মেরই আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। আধুনিক রাষ্ট্র ধর্মকে প্রতিস্থাপিত করেই রাষ্ট্র হয়। কার্ল মার্কসের কাছে তাই আধুনিক সেকুলার রাষ্ট্র একান্তই একটি ধর্মতাত্ত্বিক (Theological) প্রতিষ্ঠান। আধুনিক ধর্মতত্ত্বের বিরুদ্ধে যদি লড়তেই হয় তাহলে সবার আগে লড়তে হবে পরিচয়বাদ, জাতিবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এই সেই রাষ্ট্র যার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করবার জন্যই সাম্প্রদায়িক হানহানি অনিবার্য ভাবেই উসকে দেওয়া হয়। ধর্ম যখন পরিচয়বাদ ও জাতিবাদে পর্যবসিত হয় তার করুণ পরিণতি আমরা দেখেছি কিভাবে পরিচয়বাদ ও জাতিবাদ উপমহাদেশকে দুই ভাগ করে দিল। এখন সীমান্তের দুই দিকে যারা সংখ্যায় বেশী তারা প্রকট হিংসা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে যারা সংখ্যায় কম তাদের বিরুদ্ধে। হিন্দুত্ববাদী হিন্দু বলি- কিম্বা জাতিবাদী মুসলমান- তারা একই মূদ্রার এই পিঠ আর ঐ পিঠ।

আল্লার এই এক কুদরত মানুষ নিজের চেহারা নিজে দেখতে পায় না। আয়না, পানি, কিম্বা নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায় এমন কোন মসৃণ জিনিস ছাড়া মানুষ নিজেকে কোনদিনই দেখে না, নিজেকে চেনে না, জানে না। নদীয়ার সাধকরা তাই বলেন, মানুষই আসলে মানুষের আয়না। আমরা মানুষ কিনা সেটা ‘অপর’ মানুষই কেবল জানে। হিন্দু জানে মুসলাম মানুষ নাকি জানোয়ার, আর হিন্দু জানে মুসলমান পশু নাকি মানুষ। উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলাম পরস্পরের চেহারা দেখে ফেলেছে। আমরা এক কঠিন মুহূর্তে পৌঁছে গিয়েছি।

জাতপাত আশরাফ-আতরাফ বড়োলোক-ছোটলোকের ভেদ সমাজে সবসময়ই ছিল। এখনও আছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি উপমহাদেশে কতো প্রবল সেটা এবার দুর্গা পূজায় আমরা দেখেছি। হিংসা, দাঙ্গা পরস্পরকে নির্মূল করবার বাসনা এই অঞ্চলে নতুন কিছু না। কিন্তু ভেবেছিলাম আমরা বুঝি কিছুটা অগ্রসর হতে পেরেছি। অন্তত বাংলাদেশিরা, কারন আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। হায় একাত্তর!!

কেন এখন হিংসা তার জন্য তত্ত্ব দেবার ইচ্ছা আমাদের ছিল না কিন্তু সাঁইজীর তিরোধান দিবসে কথাগুলো মনে এল। ফকির লালন শাহ যখন রাসুলে করিম সম্পর্কে বলেন, তোমাকে দেখেছিলাম বটে একবার, তুমি দেখা দিয়েছিলে, কিন্তু হারিয়ে গেলে কেন? এখন আমরা বুঝি, কেন এই কালাম তিনি লিখেছিলেন!!! তোমাকে পাইনা কেন রাসুল, যখন আমার দরকার? নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে ছোট্ট মেয়ে পূর্ণিমা দাসের গাওয়া লালন সাঁইজীর গাওয়া কালাম, ‘তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না’। কোথায় সেই ‘দয়াল’?

(গান: ‘দেখা দিয়ে ওহে রসুল)

আমরা আতঙ্কিত বোধ করছি । আসলে কি তাঁকে আর পাওয়া যাবে না? কি জ্ঞান তিনি দিয়েছিলেন যা বাংলার ফকিরেরা গেয়ে বেড়ান? মদিনাবাসীদের কী ‘জ্ঞান’ রাসুল দিয়েছিলেন? কী সেই ‘জ্ঞান’ যা আমরা এখন হারিয়ে ফেলেছি? খুঁজে পাই না । আমরা কি হুঁশে আসব? আমাদের জ্ঞান কি ফিরে আসবে? কে জানে? আমরা সন্দিহান, কারণ আমরা ভুলে গেছি পুরুষ ও প্রকৃতির দোঁহে এক হয়ে থাকা পরমরতনকে, আমরা ‘জয়শ্রীরাম’ হুঙ্কার তোলা পেশিওয়ালা হনুমানের কারণে ভুলে গেছি সন্ত হনুমানকে। আমরা ভুলে গেছি আমাদের ভোলানাথ আর পার্বতীর যুগলরূপকে, আমাদের ভুবনে অবতীর্ণ হয়েছেন উত্তর ভারতের ‘রাম’, আমরা আর আলো পাই না প্রাণরামের! গ্লোবাল পুঁজি নিয়ন্ত্রিত জাতিবাদী মুসলমানরা আমাদের ভুলিয়ে দিতে চায়, আত্মসমর্পণকারী মুসলমানের কথা যে কি না চালিত আশিকানায়, রুহানিয়াতে আর ইনসাফে প্রত্যয়ে। কোথায় গেলেন রাধারানি? কোথায় হারালেন ঘনশ্যাম? আমরা ভুলে গেছি আমাদের নিজস্ব ভুবন। আমরা ভুলে গেছি প্রেমের ঠাকুরদ্বয় গৌর-নিতাইকে, আমরা ভুলে গেছি রাসুলে করিম (সা.)কে। আমরা ভুলে গেছি মানুষকে। আমরা ভুলে গেছি আমাদের।

এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে রে মন। পরম সাঁই থাকেন মানুষের আপন অন্তরে তাঁরে চিনতে হয় মানুষের ভজনা করেই, ভেদাভেদে নয়, গোল করে নয়। তাঁকে চিনুন। নিজেরে জানুন।

গান: এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নেরে মন

লালন সাঁই ও তাঁর ভাব পরম্পরা সম্পর্কে জানতে পড়ুন-

Share

1 thought on “‘এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন’”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top