আজ বৃহস্পতিবার, ২৩শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আমার দ্বারা কিস্যু হবে না ভেবে

কবিতাগুচ্ছ

।। অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় ।।

একটা অদৃশ্য তালায়-চাবিতে
বন্ধ করে রাখি
আমাদের সমস্ত যাতায়াত—
স্মৃতির থকথকে গায়ে পর্দা লেপে
কাগজের নৌকা বানাই
ভাসিয়ে দিই করলায়
হয়তো তিস্তায় গিয়ে মেশে

বিড়াল

ঝরা বসন্তের পাতায়
মৃত বিড়ালের মুখ ভাসে
কবে কে দুমড়ে-মুচড়ে তাকে
পোড়া ভূত করে দিয়ে গেছে
কতকাল পড়ে আছে
আঁতকে ওঠা মৃত্যুভঙ্গি নিয়ে।

কালো অন্ধকারে খননকার্য চলে
গড়ে নিতে চায় ডানা
তুড়তুড়ে ফুরফুরে হাওয়ায়
উড়ে যাবে সে তার মায়ের কাছে
বহুদিন বাদে দেখা হবে দুজনায়
মায়ে আর পোয়ে গল্প জমে যাবে
তারা কেউ দেখেছে
হাওয়ায় ভাসা পাখিদের মৃতদেহ,
আকাশের কারখানা,
কেউ রেশমের গুঁটিদের দেখেছে,
ফুটতে ফুটতে হঠাৎ
ছিঁড়ে নেওয়া ফুলেদের কান্না শুনেছে,
আমরা দেখিনি কিছু
অশুভ কান্নার শঙ্কা ও ত্রাসে
আঁতকে উঠেছি শুধু
গড়ে তুলেছি বিষ মাখানো ফলা
একে অপরকে বিদ্ধ করতে করতে
ভূলে গেছি সব…

অথচ, চারপাশে পাতা ঝরে পড়ে
প্রতি পাতায় ভেসে ওঠে তাহাদের মরামুখ।


ঘর-১

কেউ ভালোবাসা দেয়নি
ভেবে পিছনে তাকালেই
দেখি তুমি দাঁড়িয়ে আছো
দু’হাত বাড়িয়ে আকাশের মতো
মৃদু আলোকগুচ্ছে
জ্বলজ্বল করছে তোমার চোখ
কাছে এসে কিছুই বলছ না
শুধু ঢেউ খেলে যাচ্ছে
আমাদের ব্যবধানে

কেউ ভালোবাসা দেয়নি
এ কথা ভাবলেই
টুঁটি চেপে ধরছে
আমারই শিরা-উপশিরা
দম বন্ধ হয়ে আসার আগেই
মৃত্যুর শীতলতায়
টেরপাচ্ছি এক উষ্ণ-প্রস্রবণ
আর মূহুর্তেই ভ্যানিস হয়ে যাচ্ছে
রোগব্যাধির কারখানা।


ঘর ২

আমার দ্বারা
কিচ্ছু হবে না ভেবে
শুয়ে থাকি
তুমি কাজ করো
আমি দেখি
শুয়ে শুয়ে তোমায় দেখি
তোমার বোকামি দেখি,
কপটতা দেখি,
ফ্যালফ্যলে চোখে
চেয়ে থাকা দেখি
টের পাওনা তুমি

এখন শ্মশানে বসে
দেহ পুড়তে দেখছো
একদিন আমরাও
এইভাবে পুড়ে যাবো
এ কথা কবেই জেনেছ
যেমন সবাই জানে
অথচ অবাক হয় না
শুধু মাঝে মাঝে
ভিতরে ভিতরে শিহরিত হয়
তারপর ফের কাজে লেগে পড়ে

ফের তুমি গিয়ে মরা পোড়ানো দ্যাখো
কিংবা জল দাও মৃত্যুপথযাত্রীকে
আমি ফের শুয়ে পড়ি বিছানায়
আমার দ্বারা কিস্যু হবে না ভেবে
অসীম অবকাশ কাঁধে
তোমায় দেখি খুব দূর থেকে।


ঘর- ৩

আমার কোনো লেখা
তুমি পড়ো না কখনোই
আমি তোমার সমস্ত
লেখা, গান সযত্নে
সিন্দুকে তুলে রাখি
একটা অদৃশ্য তালায়-চাবিতে
বন্ধ করে রাখি
আমাদের সমস্ত যাতায়াত—
স্মৃতির থকথকে গায়ে পর্দা লেপে
কাগজের নৌকা বানাই
ভাসিয়ে দিই করলায়
হয়তো তিস্তায় গিয়ে মেশে

সব জল এক জল
তাই বৃষ্টি হয়ে পড়ে
তুমি ছাতা নিয়ে
টুকটুক করে হেঁটে এসে
পাড়ার মোড়ে দাঁড়াও
সিগারেট ধরাও
আমি বৃষ্টির শব্দে অস্থির হয়ে
সিন্দুকের দরজাটা একটু খুলেই
ফের বন্ধ করে দিই।


নিষ্কৃতি

শুনেছি পাগলদের কোনো কষ্ট থাকে না
বরং কষ্ট থেকে চিরতরে নিষ্কৃতি পেয়েই
ওরা পাগল হয়ে যায়।

সেদিন বর্ণালীদি বলছিল
ওর মায়ের কথা
কাকিমা বহুদিন ধরেই
মানসিক ভারসাম্যবিহীন

ওদের বাড়ি গেলেই কাকিমাকে দেখি
কতো আলাপই তো করেন
তারপর অক্লেশে ভুলে যান সব…

প্রতিদিন নতুন করে আলাপ হয় কাকিমার সাথে।

কাকিমার চোখদুটো
ফ্যালফ্যালে সাদা
মনির ভেতরে দুটো
তারা জ্বলে থাকে
তার আরও ভিতর
একা বসে থাকেন কাকিমা।

সবকিছু ভুলে গিয়ে
এই পৃথিবীর বুকে
একা।

অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

জন্ম ১৯৯৫ সালের ১৫ মার্চ। বাড়ি জলপাইগুড়ি জেলায়। বাসা কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে। লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক। বর্তমানে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন। পশ্চিমবঙ্গের একের দশকের কবি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top