আজ বৃহস্পতিবার, ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

‘নেচার কনজারভেশন’

।। জেসমিন নাহার ।।

আমি ওদের এই কথার কোনও জবাব না দিয়ে, পড়ায়  ফিরিয়ে আনি। ফিরে যাই পাখির জগতে। শালিক, টিয়া, ময়না, মাছরাঙা, দোয়েল, কোকিল, বাঁশপাতি সহ নানান পাখির গায়ের রঙ আর তার বর্ণনা পড়ি আটজন একসাথে। নাম না জানা পরিচিত আর অজানা পাখি চিনতে আমি ফোন বের করলাম। তাতে ওরা আটজন আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। ধনেশ পাখি সার্চ দিলাম। পাখি দেখেই নিবিড় চিৎকার করে, 
– ওরে মাথায় দ্যাহ চে, রাবেয়ার নাগাল মুকুট পিন্দছে।

‘নেচার কনজারভেশন’

– তর নাগাল খারাপ মানুষ আমি জীবনেও দেহি নাই রাবেয়া! 
– তর নাগাল খারাপ মানুষও আমি দেহি নাই জুনায়েদ।
– খারাপ তো কী করবি! মারবি আমারে! ব্যাকে তো বক ধরে। তাগো কিছু কইতে পারস না ক্যা? 
– ক্যা! তুই ধরবি ক্যা? মাদ্রাসা থেনে যাইয়া একটু খেলাইয়া,আমি পড়বার নাইজ্ঞা আইছি, ও অনে গ্যাছে গা বক ধরবার। 
– হ, তুই জানস! পইড়া নয়া শাপলা তুলবার যাইয়া দেহি কী, বক উড়াল দিলো। 
– হ, পাখি উড়াল দি্লো। 
– আরে রাবেয়া, মিছা কথা কস ক্যা ম্যাডামের সামনে! তুই চিনস না আমারে? কতোবার কইছি, একটা বেটাই নেশা দিয়া থুইছাল। বক খাইয়া মরবার নইছাল। পরে আমরা আইনা ঝুলাভাতি খাইছিলাম,ব্যাকটি মিইল্যা। 
– খাইলি ক্যা!
– ব্যাটা কইছাল তোমরা নিয়া যাওগা, মাছ মারবার গেছিলাম ব্যাকে, ছোট্টপুলাপান মিইল্যা,চেলাপুটি মাছ। 
– দেহুন ম্যাডাম, ইট্টু আগেই কইলো শাপলা তুলবার গ্যাছাল। মিছা কথাই ফাস্টো কেলাস। 

রাবেয়া এবং জুনায়েদ মামাতো, ফুফাতো ভাইবোন। পিঠোপিঠি ভাইবোনের মতো সারাক্ষণ ঝগড়া লেগেই থাকে ওদের। আবার একে অপরকে ছাড়া বাঁচে না। আমার ক্লাসে বসে ওরা প্রতিদিন ঝগড়া করে। ওদের ঝগড়া দিয়ে আমার প্রথম ক্লাস শুরু হয়। ওরা যখন ঝগড়া করে তখন আমার অন্য ছাত্ররা পড়ে,  আবার কেউ গল্প করে। আমি পড়া, ঝগড়া আর গল্প একসাথে শুনি। ওরা আমার চতুর্থ শ্রেণির  ছাত্র-ছাত্রী। প্রথম যেদিন ওদের ক্লাসে আমাকে ক্লাস নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল সেদিন আমি বিরোধিতা করেছিলাম। মনে হয়েছিল আমাকে বুঝি শাস্তি দেবার জন্য নীচের ক্লাসে দেওয়া হয়েছে। যাইনি ওদের ক্লাসে৷ কিন্তু এখন ওদের ক্লাসেই আমার ভালোলাগে বেশি। 
ওদের শিশুমন নিষ্পাপ, সুন্দর। পৃথিবীর গায়ে লেগে থাকা পাপ কেবল ওদের হৃদয়ে জং ধরাবার চেষ্টা শুরু করেছে। 

ঝগড়া সংক্রামক। সুন্দর। বিশেষত শিশুরা যখ ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারে না ঝগড়াটা কিসের! এখন ওদের বাকবিতণ্ডা আমার অন্য ছাত্রছাত্রীদেরও গ্রাস করছে ধীরে ধীরে। মাদ্রাসার প্রায় সকল বাচ্চাই গল্প এবং ঝগড়া করবার সময় ভুলে যায় ওদের শিক্ষক ওদের সামনে আছেন। নাকি তারা আমাকে শোনাবার জন্যই ঝগড়া করে? কিন্তু চতুর্থ শ্রেনির এই বাচ্চারা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ে, আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গল্প করে এবং ঝগড়াটাও আমাকে শুনিয়ে শুনিয়েই করে। এখন তাদের ঝগড়া চলছে। আশ্চর্য! আমার ভালোলাগছে। 

– ওরে থামবার ক রিয়া, ম্যাডাম তো আঙ্গো ক্লাসে একটা আছে নিহি? 
– রাবেয়া থামচে!
– আমারে থামাস ক্যা! জুনায়েদরে থামতো ক, হে কাইলকা ওগো পুরান বাড়ি থাইকা আঙ্গো নতুন বাড়িতে যাইবার নইছিল, আইতে সুম বক দেখছিল। হে সেই বকের পায়ে ঢিল মারছিল, মিছা কথা ক এবার? ছুট মামাই দেখছিল। পাখির পেটের মধ্যে ঢিল নাইগ্যা গিছিল। হেইডা হে পুরান বাইত্তে নিয়া যাইয়া দাদিরে দিছে, দাদি দেখছে হাতে নিয়া বকের পেটে জখম। দাদি উঠানে বকটারে রাখছে, বকে মাথা খালি এবা ওবা ডানে বামে ঘুরাইতাছে। দাদি হেইডা নতুন বাড়িতে নিয়া যাবার কইছে। ছোট মামুনি হেইডা রান্দা করছে। ব্যাকে খাইছি। 

– খাইছিলি তো, এহন খালি আমার নামে নালিশ দিতাছোস ক্যা? 
– নালিশ দিম না ক্যা? তুই মারছোস ক্যা? মারছিলি,মইরা যাইতাছিল, রান্না করছিল, খাইছি, শ্যাষ। এহন ম্যাডামরে কমু বিচার করবার। 
– আমাগো ঝগড়া তো হারাদিনই নাইগা থাকে। ম্যাডামের কাছে বিচার দেওন নাগবো ক্যা?
– ম্যাডামরে এডাও কমু, তোগো নাও আছে, তাও আঙ্গো নাও নিয়া যাস খালি। 
– কহন নিছি তোগো নাও? মাদ্রাসায় আসমু ক্যামনে? মাদ্রাসায় থন যামু বা ক্যামনে তোগো নাও ছাড়া? আঙ্গো নাও ঘাটে। আব্বাই আলকাতরা দিছে। 
– চুপ থাক, তর সাথে নাড়াই করবার আর কোন ইচ্ছা নাই আমার। 

রাবেয়া এবং জুনায়েদের ঝগড়া থামে। কিন্তু চিন্তার ভাঁজ দেখা যায় রিয়া এবং সানিয়ার মুখে। ওরা ক্লাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। সানিয়া গায়ে ধাক্কা দেয় রিয়ার। দু:খ প্রকাশ করে,
– ও আল্লাহ! ওনেকার টাগৈ এহন এম্ফি আসতাছে। (ওদিকের কচুরিপানা এখন এদিকে আসছে)  আঙ্গো বাড়ি এহন ভইরা যামু গা। মাদ্রাসায় আসমু ক্যামনে ও রিয়া? 
– হ, হ পুবিনা বাতাস। পুবিনা বাতাসে পানি কমবো। মায়ে কয় পশ্চিমা বাতাসে পানি বাড়ে। পুবিনা বাতাসে পানি কমে। 
– রাখ তর বাড়া, কমা। টাগৈ পাহাড়ের নাগাল পুবে যাইতাছে গা। 

ওদের ঝগড়া এবং গল্পের মাঝে আমার এক ছাত্র ক্লাসে প্রবেশ করে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, শোয়াইব সাহেব,আপনি কোথায় ছিলেন? ক্লাস তো দশমিনিট পার হয়ে গেছে। কৈফিয়ত দিল,
– পানি ম্যাডাম। আব্বু প্রথমে সাজিমরে (তার ছোট ভাই) পরে আমাকে কোলে কইরা পার কইরা দিছে, হের নাইগা আইতে দেরি হইছে। 

শোয়াইবকে বেঞ্চে বসতে বললাম। বসিয়ে আটজন ছাত্রছাত্রীকে দেখলাম। সবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম
– তোমরা কেমন আছ? 
আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সকলে একযোগে জিজ্ঞাসা করল,
– আন্নে কেমুন আছুন ম্যাডাম? 
জবাব দিলাম,
–খুব ভালো। 

আর কোনও কথা বলতে না দিয়ে হাজিরা খাতা বের করে, আটজনের নাম ধরে ডাক দিলাম। আর অনুপস্থিত চৌদ্দজনকে উপস্থিতি দিয়ে দিলাম। এবং নিজেকে বললাম, বাহ, ম্যাডাম, মনের বিরুদ্ধে তুমি অনেক কাজ করতে শিখে গেছো।  ছাত্রছাত্রীদের বললাম, 
– তোমাদের ঝগড়া এবং গল্প শেষ হয়েছে? এখন আমরা লেখাপড়া করি? সকলে একসঙ্গে বলল,
– ম্যাডাম, আজ পাখিদের জগৎ পড়া। 

সুমাইয়া এবং রিয়া কথা বলতে শুরু করল। রিয়া আমাকে বলল, 
– ম্যাডাম, আইচকা এডি থেনে এই তুরি পড়া। 
– কন থেনে রিয়া! উরাগেই পড়া আছাল। ও ম্যাডাম! পাখির জগৎ না, উরাগেই পড়া আছাল?

– এডাইতো কইলাম সুমাইয়া, যে এডি থেনে এই তুরি মানে উরাগিই পড়া। 

‘উরাগেই’  মানে পুরাটাই। পুরা লেখাটাই ওদের পড়তে দিয়েছিলাম। খুব সাধারণ কথা ওরা এমন ভাবে বলে মাঝে মাঝে, মনে হয় যেন বহুদিনের বাঁধাবাঁধি ওদের। আমি বললাম কথা থামাও, এবার চলো পাখির জগতে প্রবেশ করা যাক। পাখির জগৎ আমি ওদের একেকজনের দিয়ে রিডিং পড়ালাম। এবং আমি নিজেও পড়ে শোনালাম। নিবিড় জিজ্ঞাসা করলো, 

– এ্যাঙ্গা কী পাখি ম্যাডাম? একটারেও চিনিনা। 
– চিনন নাগবো না তর। তুই হইর‍্যা যা নিবিড়, এক করবার যামু। ও ম্যাডাম এক আইছে। 

ছোট ওরা। আমি ওদের এসব কাণ্ডকারখানা দিয়েই বুঝি ওরা ছোট। সকলের শৈশব হয়তো এরকম থাকে না। হয়তো আবার কারও ওদের মতই থাকে। আমি অনুমতি দেবার আগেই, নিবিড় চিৎকার দিয়ে শোয়াইবকে দেখিয়ে  বলে, 
– ম্যাডাম, ঐতি পাদ দিছে, উহ হু, এতো গন্ধ ক্যা? খুব গন্ধ আইতাছে। ম্যাডাম ঐতি না কাইলকা নামাজ পড়বার সুমও পুত কইরা পাদ দিছিল। ব্যাকের সামনে, মসজিদের অমবুরায় বইসা। আপনে অহন বিচার করুন। 

বাচ্চাদের কাছে এই প্রাকৃতিক বিষয়গুলো সহজ সরল ব্যাপার। এটা যে এভাবে বলা ঠিক না সেই সহবত শেখাতে হয়। কিন্তু এখন বলতে গেলে লজ্জা পাবে। অন্য সময় সুযোগ বুঝে বোঝাতে হবে। শোয়াইব অবশ্য ইতোমধ্যে প্রতিবাদ করে।
– ম্যাডাম, নিবিড় মিছা কথা কইছে, নামাজের সুম না ম্যাডাম, নামাজের শেষে, একমিনিট আগে। 

এখন এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে  শিশুদের পাদের বিচার কী করব জানিনা। তবে আমার আট স্টুডেন্টকে প্রাণখুলে মানুষের স্বাভাবিক বাহ্য ক্রিয়াদি বিষয়ে তুমুল আমোদিত ও হাসতে দেখলাম। হাসতে হাসতে ওরা একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। শোয়াইব আমাকে বললো,
– ম্যাডাম বিচার কইরেন না। আমি একটা পাখির নাম কয়া হারুম। ম্যাডাম, ও ম্যাডাম। আমার কথা আপনার কাছে একবারই তো বিচার গ্যাছে গা। জুনায়েদের তো অনেকবার গ্যাছে। 

শোয়াইবকে শান্ত করবার চেষ্টা করি। এটা কোনও সমস্যা না। এর কোনও বিচার নাই। তবু সে ভয় পায়। তার ধারণা মসজিদে নামাজ পড়ার সময় পাদ দেওয়া খুবই গর্হিত অপরাধ হয়েছে। সে আমার মন গলাতে চেষ্টা করে। 

– ম্যাডাম, আপনে মাঝে মাঝে আপনার মায়ের বুগলে যান না? ম্যাডাম আমি কিন্তু এহন আর বোল্লার পোক দিয়া মাছ ধরবার যাই না। 

বললাম, শোয়াইব তুমি ওয়াশরুমে যাও। বেঞ্চ থেকে বের হবার সময়  নিবিড়কে বলল, দ্যাখছোত, এটা অপরাধ না! শোয়াইব ওয়াশরুমে গেলো। পাশের ক্লাসরুমে ক্লাস টিচার এলো। রিয়া আমাকে বললো, 

– ম্যাডাম, আপনে আহুন হারাহারি যান গা ব্যাক স্যারের শ্যাষে। কেলাস থ্রির স্যার অহন আইলো, আর আপনে নাম ডাইকা, পড়াইয়া সাইরা, কেলাস করাইতাছুন। 
সানিয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম সত্যি নাকি? 
সানিয়া এবার বিস্তারিত জবাব দিল।
– হ, ম্যাডাম, আপনে খেয়াল কইর‍্যা দেহেন চে, স্যার পতিদিনই দেরি কইর‍্যা আহে, কিন্তু আপনে যাইবার কালে,হে  আমাগো ক্লাসে আবার হারাহারি আহে। আয়া না আমাগো পড়া দিয়া থুইয়া যায় গা। অনেকক্ষন পরে আহে, যেসুমকা অন্য হুজুর আহে। হেসুমকা আয়া নয়া কয়, পড়া হিকসো( শিখেছো)? একেকদিন আবার কয় যে, পড়া হিকো,আমি আয়তাছি। পরে, অনেকক্ষন পরে আয়া কয়, এহনো লেখপার বহনি কেন? লেখ, লেখ! তারপর আবার যায় গা। যায়া নয়া আবার একসুম আহে, আইসা কয়, এইহানে পড়া। 
বললাম, ও আচ্ছা। এখন আমার প্রতি তোমাদের রাগ হচ্ছে? জবাব দিল.
–  না। কিন্তু আপনেও একটু দেরি কইরা আইলে আর হারাহারি গেলে গা আমরা ইট্টু খেলাইবার পারি। 

আমি ওদের এই কথার কোন জবাব না দিয়ে, পড়ায়  ফিরিয়ে আনি। ফিরে যাই পাখির জগতে। শালিক, টিয়া, ময়না, মাছরাঙা, দোয়েল, কোকিল, বাঁশপাতি সহ নানান পাখির গায়ের রঙ আর তার বর্ণনা পড়ি আটজন একসাথে। নাম না জানা পরিচিত আর অজানা পাখি চিনতে আমি ফোন বের করলাম। তাতে ওরা আটজন আমাকে ঘিরে দাঁড়ালো। ধনেশ পাখি সার্চ দিলাম। পাখি দেখেই নিবিড় চিৎকার করে, 
– ওরে মাথায় দ্যাহ চে, রাবেয়ার নাগাল মুকুট পিন্দছে।
রাবেয়া রাগ করে, বলে,
– বেয়াদব। 

সার্চ দিলাম শ্যামা পাখিকে। শ্যামার নানান প্রজাতি বের হলো। শোয়াইব বলল, 
– ম্যাডাম, এই কালা হলুদ আর আর এই বাঘের নাগাল দাগ দাগ শ্যামা আছে আঙ্গো চাকদহে।

সকলে তাকে সমর্থন দিলো। হরিয়ালের ছবি বের করতেই, নিবিড় বলল,
– ম্যাডাম, এই পাখির নাম না হরিকালী। এই পাখি লুডুসের( নুডুলস) নাগাল হাগে।

আবারও সবাই হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে ওরা ঝগড়া শুরু করে দিলো পুনরায়। রনি বলল, 
– ম্যাডাম, জুনায়েদ পাখি ধরে, হ্যাঙনা বক মাইর‍্যা, ডেক( ডাহুক) মাইর‍্যা খায়। 
রাবেয়া রনিকে সাহস জোগায়। বললো, হ ম্যাডাম, এডি নিয়াইতো ক্লাসে পরথম হের সাথ নাড়াই করছিলাম। জুনায়েদ রেগে যায়। রাবেয়াকে বলে,
– তুই ছবি দেখপার নইছত, পড়বার নইছত পড়। আমার পিছে নাগপার আইছত ক্যা! 
আমি জুনায়েদ কে আমার কাছে রেখে, আর সাতজনকে বেঞ্চে পাঠালাম।
বললাম, তুমি পানকৌড়ি, বক, ডাহুক মারবে না। ঘুঘু ধরবে না। ঘুঘুর বাসা ভাঙবে না। ওরা আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। 

আমি প্রকৃতি ও পাখপাখালি নিয়ে মোটামুটি ওরা বুঝুক না বুঝুক আমার পাণ্ডিত্য প্রকাশ করলাম। মনে হল এখন আমি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশান অব নেচারে চাকরির জন্য একটা দরখাস্ত করতে পারি। বাচ্চাদের মধ্যে থেকেও  হঠাৎ আমার মধ্যে একটা উদাস উদাস বৈজ্ঞানিক ভাব আসতে শুরু করল। ওদের সরল মধুর নিষ্পাপ চেহারাগুলো অস্পষ্ট হয়ে যাবার আগেই আমি আমার  চাকদহে ভাঙাচোরা মাদ্রাসা  অভাবে দীর্ণ শিশুদের কাছে ফিরে এলাম। এদের ফেলে আমি কই যাবো?

জুনায়েদ এবার নিজের প্রশস্তি গায়।
– আরে! আমি ধরিনা ম্যাডাম। 
– আচ্ছা বিশ্বাস করলাম যে তুমি পাখি ধরো না। খাওনা। ভালো ছেলে জুনায়েদ।
জুনায়েদ উৎফুল্ল হয়। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, 
– শোন,জুনায়েদ আর পাখি ধরবে না। 
সুমাইয়া যেন কী বলবে বলে দাঁড়ায়। 
– কিছু বলতে চাও সুমাইয়া? 
– ম্যাডাম, টেনে পড়ে জিদানে না! হেরা না,  মাংস কিনা হারে না, খুব গরিব। তাই হেরা না, পানিকামুড় (পানকৌড়ি), ডেক (ডাহুক), বাইলা হাঁস (বেলে হাঁস), ধইর‍্যা ধইর‍্যা খায়। এহন অগো হাতে হোচপাঁচড়া (খোশ পাঁচড়া, চর্ম রোগ) অইছে। ব্যাকে কয়,পাখিদের অভিশাপ নাগছে। 
বললাম, পাখিদের অভিশাপ লেগেছে কিনা জানিনা। তবে পাখি খাওয়া যাবে না। পাখি খাবে না। জুনায়েদ হঠাৎ লাফ দিয়ে আমার কাছে আসে। 
– ম্যাডাম, ব্যাকে খালি আমার নাম কইতাছে, জুনায়েদ জুনায়েদ করতাছে। শোয়াইব, নিবিড় বোল্লার পোক ভাইঙ্যা,মাছ ধইর‍্যা খায়। 
শোয়াইব ক্ষেপে যায়। 
– এই তুই এতা কস ক্যা! জুনায়েদ তর এতা কি ঠ্যাকা? তুই যে ডেকের বাচ্চা ধরছোস! 

রাবেয়া কথা বলবার সুযোগ পায়,
– হ, ম্যাডাম। হেইদিন হে হাতুর (সাঁতার) পাড়বার নইছে পাগারে (পগারে) আর একটা পানিকামুড়ও হাতুর পাড়বার নইছে, ও হেই পানিকামুড়রে ডাল দিয়া ধরছে। ধইর‍্যা আমারে কইতাছে লইয়্যা যা বাইত্তে। আমি কইছি যে পারুম না। ঠাঠা পড়া রইদ, ও হের মইদ্যে হেই পাখি ধরছে। 
– তুই কয়া দিলি ম্যাডামরে রাবেয়া। 
– হ,কইলাম। ম্যাডাম, ও আরো কয়, আমি তরে নিয়া যাবার কইলাম। তুই নিয়া গেলি না। দেহিসনি, ফলডা ভালো হবো না। আমি আহে নয়া এহনই তরে মারুম। দাও দে কুপামু, তরে চাবুক দিয়া মারুম। 
–মিছা কথা এগুলা ম্যাডাম৷ 
– ক্যান, কস নাই? 
– ম্যাডাম জানুন না, হেরে একদিন চুবান দিসিলাম মিছা কথা কওয়ার লাগি। 

ওদের ঝগড়া আমি নীরবে শুনছি। কেন শুনছি আমি জানিনা, তবে শুনছি মনোযোগ দিয়ে।

– তুইও যে ফুফুর হাতে কতগুলো চুবান খালি। ব্যাকে যেখানে গোবর ফালাই, হ্যানো তুই গোসল করস। 
– এইয়্যা, সত্যি আমি হেনো গিয়া কখনো গোসল করিনি ম্যাডাম, তয় পানিকামুড় ধরছিলাম। ব্যাকে কয় খাইলে ব্যথা সারে। আর ধরুম না ম্যাডাম। আপনে যহন বারণ করছেন। পাখি ধরবার না করছেন। আর ধরুম না। 
– ম্যাডাম এঙনা পানিতে গোসল করতে যায়া না, জুনায়েদের হাত কাইটা গ্যাসে গা। 

-না, ম্যাডাম। রাবেয়াগো নাওয়ের মধ্যে না ইট্টু ভাঙা আছাল। তাতে কাইটা গ্যাছে। যে দুঃখ পাইছি। 
– আবারো মিছা কথা বলে।
– হ, মিছা কথা! বিছরাইতাছি, কনে যান কাটছাল। এই যে এতহানি।
হাতের কনুইটা দেখায় আমাকে। আমি দেখি সত্যিই বেশ খানিকটা কেটে গেছে। ভালো করে চাইতেই, আদরে বিগলিত হলো,
– আমার আবার হামুকে(শামুকে)পা কাটছাল এতহানি। 
রাবেয়া মুখ বাঁকায়। মুখ বাঁকা রেখেই বলে, 
–অর পাও ই এতোটুকু। ও কয়, এতহানি কাটছাল। 
রাগ করে জুনায়েদ, 
– তরে মারলে না আমার কেমুন জানি লাগে, তরে মারবার মনে চায় না, তবু আমার সাথে হত্রুতামি (শত্রুতা) করস যে, দেহিস তাই তরে একদিন সত্যিই মারুম। 

ওদের ঝগড়া আমি শুনলাম। বললাম তোমরা কেউ খারাপ পানিতে গোসল কোরনা। কেউ পাখি মেরো না। একদিকে তোমার শরীর এবং পাখপাখালি মারলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এখন পড়া নাও। পাখিদের জগতের মূলভাব পড়ে আসবে। পড়াও দিলাম, ঘন্টাও পড়লো। ক্লাসরুম থেকে বের হবার সময় সবাই বই নিয়ে আমার সামনে হাজির হলো। সবাইকে বইতে দাগিয়ে দিলাম। ক্লাস থেকে পা বের করা মাত্র ওরা সালাম দিল।
– আসসালামু ওয়ালাইকুম।
জবাব দিলাম, মনে মনে। ওয়ালাইকুম আস সালাম। হেঁটে অফিসে আসবার সময় শুনলাম ক্লাস সিক্সের বাচ্চাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। 
– কুন্তা পড়া দিলো?
–  ক্যান,কুন্তা? 
– হ্যাট তিন নম্বর ডা। 
আমি শুনতে শুনতে টিনশেড পার করে বিল্ডিংয়ের দিকে পা বাড়ালাম। আজ রোববার, চতুর্থ শ্রেণিতে  রোজকার মতো আজও আমার পঁয়তাল্লিশ মিনিট পার হল। 

ঘরে ফিরে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশান অব নেচারে চাকরির জন্য পাঠাব বলে দরখাস্তটি বের করলাম। এই অজ পাড়াগাঁ সম্পর্কে যতো মন্দ কথা ভাবা যায় মোটামুটি সেইসব নানান দিক থেকে ভাবলাম। মাদ্রাসা ছেড়ে বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেলে অভাব অনটনের জীবনে কি কি সুরাহা হয় তারও একটা তালিকা করলাম। কি কি কিনব বলে তালিকা করেছি, কিন্তু টাকার অভাবে কিনতে পারিনি তার লিস্টও বানালাম। নতুন  কিছু যোগ করলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারলাম না।

ঘুম ভাঙল পানকৌড়িদের ডাকে। বাইরে এসে দেখি দূরে দহে শিশুদের দেখা যাচ্ছে। ওদেরই কেউ হবে যাদের মাংস কিনে খাবার সাধ্য নাই। আকাশে পাখি উড়ছে। শীতের পাখি কি আসতে শুরু করেছে? এত আগে?
মাদ্রাসা ছুটি হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ । আমি আমার বাচ্চাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করি। ভয় হয় যদি ওরা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। আমি তো আর ওদের ঝগড়া শুনতে পারব না। ঘরে ফিরে আসি।

টেবিলে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব নেচার কনজারভেশানে চাকুরির দরখাস্ত পড়ে রইল। তারপর দরখাস্তের জীবন ডাস্টবিনে নাকি চুলার আগুনে পুড়ে শেষ হল সেটা এখন দরকারি কোনও খবর না। এখনও আমার ঘুম ঘুম ভাব, আর এ ঘুম ঘুম ভাবের মধ্যে শিশুদের বিপুল কোলাহল। তারা প্রত্যকে একেকটা পাখির নাম ধরে উড়ছে আর পাখিদের ডাক নকল করছে। 

পৃথিবী সুন্দর। কারণ এখানে শিশু  ও পাখি সকল বাস করে।

ছবি- মেঘনা

জেসমিন নাহার

তরুণ গল্পকার। উপন্যাস লিখনেও হাত দিয়েছেন। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকাতে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যশোহর জেলার শার্শা উপজেলায় বাড়ি। গোরপাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম (রহঃ) চিশতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। সেই কারণে ফকিরি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছ। মা রওশানারা বেগমের সঙ্গে বাস করেন জেসমিন। আধুনিকতার মধ্যে নামসাকিন হারিয়ে বিমূর্ত হতে চান না। প্রকৃতির মাঝে যাপিত জীবনকে মূর্তভাবে পরখ করতে চান। গদ্যেও জীবনের মূর্তভাবকে প্রকাশ করার ইচ্ছায় লেখালেখি করেন।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top