আজ শুক্রবার, ২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ধর্মীয় জাতিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার যুগে ফিরে দেখা লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে

।। আর্য সারথী ।।

আজকের দিনে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা উপমহাদেশের সামগ্রিক বিকাশে অন্যতম বড় বাধা। অথচ লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবা নিজে এইসব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তাই আজও বাবার ধাম বারদীতে হিন্দু-মুসলমানের কোনো সংকট নেই৷ লোকনাথ বাবা মক্কায় যাত্রায় সময় মুসলমানদের আদর ও অভ্যর্থনায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। কাবুলে পৌঁছে পরিচিত হন ইসলাম ধর্মের পণ্ডিত সাধক মোল্লা সাদীর সাথে। তাঁর কাছে কোরানুল করিমের ব্যাখ্যা শুনে অভিভূত হয়ে যান। তিনি মোল্লা সাদীর কাছে কোরানুল করিমের তালিম নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মোল্লা সাদী তাতে সম্মত হন এবং তিনিও সনাতন ধর্মের তত্ত্ব বুঝে নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন লোকনাথ বাবার কাছে। সেইমত চলতে থাকল দুই সাধকের চর্চা৷ মোল্লা সাদীর কাছে তিনি লাভ করেন কোরানুল করিমের সত্য এবং তাঁর কাছ থেকে সাধক মোল্লা সাদী লাভ করেন সনাতন ধর্মের সত্য। সাধক সাদীর সাথে সঙ্গ করার পরই হয়ত লোকনাথ বাবা অনুভব করেছিলেন এবং পরে ভক্তদের বলেছিলেন, “মুসলমান কথা এসেছে মুসল্লম ঈমান কথা থেকে। এর অর্থ ষোল আনা ঈমান যার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত কেবল সেই মুসলমান। ” খেয়াল রাখতে হবে কথাটা ব্যাকরণ ও ব্যুৎপত্তি মাথায় নিয়ে বলেন নি লোকনাথ বাবা৷ তিনি বলেছেন দার্শনিক চিন্তার জায়গা থেকে। অবশ্য বাণীটার বিকল্প পাঠ আছে, ‘‘মুসল্লম ঈমান যার বা ষোল-আনা ঈমান যার সেই মুসলমান ।’’

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তিরোভাব দিবস পালন করছি কিন্তু আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর থেকে কি আমরা তাঁকে পাঠ করতে পেরেছি? আজও তাঁকে কাল্টের ঘরে বেঁধে রেখেছি, এই হল আমাদের ‘সচেতনতা’। এত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব লোকনাথ বাবা, তাঁর পর্যালোচনাই শেষ করতে পারি নি, আমাদের উন্নতি কীভাবে আশা করা যায়? বাঙালী মুসলমানের কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। কেননা ঐতিহাসিকভাবে যে ক্ষতগুলো সৃষ্টি হয়েছিল তাতে এই কাজ হওয়া অসম্ভব ছিল । কিন্তু বাঙালী হিন্দু সমাজকে এই দায় থেকে কি নিষ্কৃতি দেওয়া যায়?

তথাকথিত বাঙালী হিন্দু সমাজ লোকনাথ বাবাকে যাজক ও ছোটবড় ব্যবসায়ী (দোকানদার, সুদখোর, মহাজন, আড়তদার ইত্যাদি) শ্রেণির হাতে বন্দী করে রেখেছে। এত দিনেও তাদের সামর্থ্য হয় নি লোকনাথ ব্রহ্মচারীর পর্যালোচনা করার। অথচ এই তথাকথিত হিন্দু সমাজ পশ্চিম ও উত্তর ভারতের সংস্কৃতিকে নকল করে হিন্দুত্ববাদের কল্পলোকে মশগুল। এদের একটা অংশ আবার লোকনাথ বাবাকে নকল ভগবানের সিরিয়ালে ফেলেছে।

লোকনাথ বাবা ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র-লিঙ্গ নির্বিশেষে আমার ও আপনার। শ্রেণীর বিচারে তিনি কৃষক-শ্রমিক- মেহনতি মানুষের তথা মজলুমের প্রতিনিধি। তাঁকে নির্দ্বিধায় নিজের করে নিন এবং নতুন করে পাঠ করুন। তাঁকে বুঝতে যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের সর্বনাশের খুব একটা বাকি থাকবে না৷

১৯শে জ্যৈষ্ঠ আসলেই মনের কোণে বেজে ওঠে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার আহবান। তাঁর তত্ত্ব বছরের সবগুলো দিনই হয়ত মনে থাকে, কিন্তু এত উচ্চকোটির সাধকের তিরোভাব দিবস বলে কথা। মায়িক দেহ ত্যাগের সময় বলিষ্ঠতার সাথে বলেছিলেন যে তিনি দেহটা ছেড়ে গেলেও এই বিশ্বজগৎকে ছেড়ে যাচ্ছেন না। ভক্তদের খুবই কাছাকাছি থাকবেন দেহত্যাগের পরেই। ফলে ১৯শে জ্যৈষ্ঠ তারিখটা শুধু লোকনাথ বাবার তিরোভাবের তারিখ নয়, পরম হয়ে ওঠারও তারিখ। এই মায়িক দেহত্যাগের দ্বারা ভক্তবৃন্দের কাছে পরমের সমান হয়েছেন। তাই আজ তাঁর ছবি কিংবা মূর্তির পূজা হয়। ভক্তরা শুধু “ জয় বাবা লোকনাথ, জয় মা লোকনাথ, জয় শিব লোকনাথ, জয় ব্রহ্ম লোকনাথ ” এই বাংলা কথা বলেই বাবার পূজা-বন্দনা সম্পন্ন করতে পারেন , ভক্তি দেন। লোকনাথ বাবাকে নিয়ে হয়ত অনেকের অনেক রকম আপত্তি থাকবে, থাকাটাও হয়ত অমূলক নয়। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা দার্শনিক অবস্থান আছে। কিন্তু আজকের এই (সংকটকালীন) পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় এবং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশব্যাপী বিস্তৃত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ,ভূগোলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এবং কৃষিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ( উৎপাদন সম্পর্ক ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ) সংঘাত-মিলন-মিশ্রণের ফলে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার সময় লোকনাথ বাবার কথা বারবার মনে পড়ে যায়। আক্ষেপের ব্যাপার একটাই লোকনাথ ভক্তেরা বুঝলেন না বাবার শিক্ষাকে বাস্তবায়িত না করে কেবল বাবার পূজা করার অর্থ হল পুঁজির পূজা করা, ফ্যাসিবাদের বিকাশে নিযুক্ত হওয়া। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ-উপনিবেশবাদ প্রভাবিত অনেকে নকল ভগবানের সিরিয়াল করার সময় লোকনাথ বাবাকে তালিকায় ফেলে দিয়ে বিশাল পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করেন। আমরা যারা বুঝতে পারি না বা জানি না কোন দার্শনিক চর্চার মধ্যদিয়ে লোকনাথ বাবা ঈশ্বরসম হয়ে উঠলেন তারাও হয়ত এগুলোতে তোল্লাই দেই। এগুলো নিয়ে বাদ-বিতণ্ডা চলছে, চলবে। কিন্তু কাজের কাজ হবে কি?

লোকনাথ বাবা নিঃসন্দেহে পরমের পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন৷ কিন্তু পরম হৃদয়ে বসে যে ঐকতান বাজিয়ে চলেছেন দমে দমে সেটা না শুনতে পারলে যে তাঁর উপাসনা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হল, আমরা যারা বাবাকে মানি তারা কি আদৌ সে আহবান শুনতে পাই? বাবার ধাম বারদীতে আমরা শুধু ১৯শে জ্যৈষ্ঠে যাই এমন নয়, সারা বছরব্যাপী আমাদের যাতায়াত চলতেই থাকে ৷ আমাদের বিশ্বাস হল রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে বিপদে পড়লেই বাবা উদ্ধার করবেন। তাছাড়া আমাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস হল বাবা সকল ইচ্ছা পূরণ করেন। এখন প্রশ্ন, হল বাবার কাছে কি শুধু নিজের চাওয়া-পাওয়ার দাবী জানাতেই যাওয়া? যাঁকে ঈশ্বরজ্ঞান করি আমরা তাঁর কাছে যদি শুধু চাওয়া আর পাওয়া থাকে তাহলে আমরা নিজেরাই তাঁর প্রতি শরণাগত (ঈমানদার) হতে পারি নি৷ আমরা শুধু বাবাকে আমাদের আইডেন্টিটি বানিয়ে রেখেছি। আমরা আমাদের মত করে একটা কাল্টের বিকাশ ঘটিয়েছি। মোটকথা বাবাকে কুকথা বলার জন্য আমাদের সমস্যা নাই, আমাদের সমস্যা আমাদের আইডেন্টিটি ভেঙে গেলে। অর্থাৎ এই বুর্জোয়া যুগে বাবার প্রতি ভক্তির নামে বাবাকে স্রেফ কাল্টের প্রতীক বা আইডেন্টিটি বানিয়ে রাখার অর্থ হল বাবার প্রতি বিন্দুমাত্র ভক্তি না থাকা। বাবা ঈশ্বর নন, আমাদের কাছে ঈশ্বর পুঁজি। বাবার সামনে পুঁজির বন্দনা করে আমরা চাওয়া-পাওয়ার দোকানদারি খুলেছি ; আবার নিজেরা অধিকার, সুন্দর জীবন ইত্যাদি কামনা করছি। তাই আমরা কেবল বাবার চরণ ধরতে উদগ্রীব। লোকনাথ বাবা বলেছিলেন, “ আমার চরণ ধরিস না, আচরণ ধর ”। কেন এই কথা বলেছিলেন তা আজও বুঝতে সচেষ্ট নই। যাঁকে পরম জ্ঞান করি তাঁর চরণ ধরব এটা স্বাভাবিক। কিন্তু লোকনাথ বাবা সতর্ক করে দিচ্ছেন যাতে আমরা চরণ না ধরে আচরণ ধরি। এখন বাবার আচরণ ধরা বলতে আমরা কি বুঝব? বাবা তো ছিলেন নাগা শৈব সন্ন্যাসী এবং তান্ত্রিক। তাহলে আমরা সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে নাগা শৈব হয়ে যাব? বাবা কি তাই চান? বাবা বোধহয় তা চান না। যদি চাইতেন তাহলে নিজে কাল্ট জাতীয় কিছু তৈরি করে ফেলতেন৷ তাঁর মত সাধক বহু শিষ্য করে নিজের দল বানাতে পারতেন৷ মজার ব্যাপার তিনি তা করেন নি। তাই লোকনাথপন্থী বলতে কিছুই নেই এই পৃথিবীতে। যা আছে তা হল লোকনাথ বাবার শিক্ষা বা আচরণ। বাবা ১৬০ বছর যে সাধনালব্ধ শিক্ষা আমাদের দিয়ে দেহত্যাগ করেছেন একমাত্র সেটাই পৃথিবীতে আছে। সেই আচরণের মর্ম আমরা আজও বুঝতে পারি নি। তাই আজও বাবার আচরণ না ধরে বাবার ভক্ত হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করি৷ কিন্তু ভুলে যাই, “ তোরা জাগতিক চাওয়া নিয়েই ভুলে থাকিস না, সত্য লাভ করার জন্য চেষ্টা কর, আমার কৃপা তোদের সাধন পথকে সুগম করে তুলবে। ”

“ শত বছরের অধিক পাহাড় পর্বত বন জঙ্গলে ঘুরে তোদের ঈশ্বরের সাথে আমার দেখা হল না। আমি শুধু দেখলাম আমাকে, আমি বদ্ধ আছি সংসারে, সংসার বদ্ধ আছে জিহবা এবং উপস্থে। যে এই দুটোর সংযম করতে পেরেছে একমাত্র সেই সিদ্ধিলাভের অধিকারী। ”
“ হিমালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে চরম সত্যে পৌঁছে দেখলাম আমি ছাড়া আর কোথাও কেউ নেই। তখন সবার দুঃখ নিজের মতন করেই হৃদয়ে অনুভব করলাম। তাই তো ছুটে এলাম তোদের মধ্যে, তোদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবার জন্য।”
বাবার এই বাণীদুটি আমরা শুনেছি হয়ত বহুবার কিন্তু বুঝে উঠতে পারি নি। যিনি নিজে এতবড় সাধক অথচ এটা কি বল্লেন? আসলে সত্যই তাই। আমিই আমার ইষ্ট। আমি ছাড়া কোনো ইষ্ট নেই তাই চরম সত্যেও আমিই আছি। তন্ত্রশাস্ত্র হরেক রকম উপায়ে এই সরল কথাটাই বোঝাতে চেয়েছে আমাদের। বুদ্ধও আমাদের এই সরল কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল আমরা সত্য উপলব্ধি করতে পারি না। আমরা সবকিছু অনুমানের উপর করি। কিন্তু এইসব কাজ অনুমানের নয়। আমরা সারাজীবন অনুমানে নষ্ট করি বলেই আধ্যাত্মিক চর্চা ও জগতের সেবাকে পরস্পর বিরোধী হিসেবে দেখি৷ এক আমি বহু হবার বাসনা যাঁর হল সেও আমি, জগতে বসে যে সাধনা করছি সেও আমি, যে কষ্ট করছে সেও আমি, যে সুখ পাচ্ছে সেও আমি, ন্যায়-অন্যায় যে যাই করুক সবই আমি। তাই শুধু আমার উন্নতিতে আমার উন্নতি নয়। কারণ যে অনুন্নত রইল সেও আমি। যদি তাই না হয় তবে এক আমি বহু হলো কিভাব? এক সামান্য আমি বহু বিশেষ আমিতে আসে এবং বিশেষে শক্তির স্ফূরণে বহু আমির প্রকাশ ঘটে। নির্বিশেষ থেকে বিশেষে এলেই এই স্ফূরণ দেখা যায়। তবে বিশেষ-নির্বিশেষ থেকে ঊর্ধ্বে পরমে যাওয়াই আসল কথা। প্রকৃত সাধকের কথাই এটা। কিন্তু আমাদের কাছে এই সময়ে সাধনা বলতে শুধুই সাধনা হয়ে রইল। যদি এটাই একমাত্র কাজ হত তাহলে বাবা নিজে কেন আসতেন লোকালয়ে? আমি সাধক হলাম আর শুধু ক্ষুদ্র আমির জন্যই সারাদিন ব্যয় করলাম। অর্থাৎ শুধু আমার প্রয়োজনেই বিভিন্ন আসনাদি জপ তপ করে গেলাম। তাহলে এটা কেমন কাজ হল? এটা কি বাবার শিক্ষা হল? আমিকে অনুভব করলে যদি সারা জগৎকে উপলব্ধি করা যায় তাহলে আমরা কেন সকল প্রকার অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই না? অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে এবং জগতের কল্যাণে ভূমিকা না রেখে কোনও সাধনা করা সম্ভব নয়। এটা লোকনাথ বাবার শিক্ষা। আজও এই সত্য কেন আমাদের উপলব্ধ হল না কে জানে। অথচ বাবা নিজে বলে গিয়েছেন:

১) দুঃখ দরিদ্রতায় ভরা সমাজের দুঃখ দূর করার জন্য সর্বদা চেষ্টা করবি।
) জগতে যখন মানুষের শরীর নিয়ে এসেছিস, তখন দশের সেবা করে, তাদের প্রসন্ন করে জীবন সার্থক করে নে। এতে তোরও মঙ্গল জগতেরও মঙ্গল।
৩) অন্ধ সমাজ। চোখ থাকতেও অন্ধের মত চলছে।
৪) দীন দরিদ্র অসহায় মানুষের হাতে যা দিবি তা আমিই পাব। আমিই গ্রহণ করব।
৫) যে যোগী আত্মজ্ঞান লাভ করার পর করুণায় বিগলিত হয়ে সর্বজীবের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করেন ;সেই-ই পরম যোগী, আমার সবথেকে প্রিয়।

এখন দুঃখ-দরিদ্রতায় ভরা সমাজের দুঃখ দূর কিভাবে হবে? দশের সেবা কিভাবে? মানুষকে কেবলমাত্র দুটো টাকা ধরিয়ে দেওয়াই সেবা? না, এভাবে সেবার সবটা হয় না। সামর্থ্য অনুসারে মানুষকে অর্থ, অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় প্রভৃতি দিয়ে সেবা অবশ্যই করতে হবে, এর অন্যথা করা চলবে না। কিন্তু যে ব্যবস্থা মানুষের উপর শোষণের যাঁতাকল চালায় তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা কি সেবা নয়? মানুষের উপর মানুষের শোষণ জিইয়ে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করলে কিসের ধর্ম, কিসের সাধনা? শোষণ-নির্যাতন এর বিরুদ্ধে লড়াই করলেই ধর্মকর্ম করা সম্ভব। কেননা, ধর্ম কেবল জপ তপ নয়। অন্যায়কে সমর্থন না করাও ধর্ম। যদি তাই হয় তাহলে প্রতিবাদ কেন নয়।

আজকের দিনে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা উপমহাদেশের সামগ্রিক বিকাশে অন্যতম বড় বাধা। অথচ লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবা নিজে এইসব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তাই আজও বাবার ধাম বারদীতে হিন্দু-মুসলমানের কোনো সংকট নেই৷ লোকনাথ বাবা মক্কায় যাত্রায় সময় মুসলমানদের আদর ও অভ্যর্থনায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। কাবুলে পৌঁছে পরিচিত হন ইসলাম ধর্মের পণ্ডিত সাধক মোল্লা সাদীর সাথে। তাঁর কাছে কোরানুল করিমের ব্যাখ্যা শুনে অভিভূত হয়ে যান। তিনি মোল্লা সাদীর কাছে কোরানুল করিমের তালিম নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মোল্লা সাদী তাতে সম্মত হন এবং তিনিও সনাতন ধর্মের তত্ত্ব বুঝে নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন লোকনাথ বাবার কাছে। সেইমত চলতে থাকল দুই সাধকের চর্চা৷ মোল্লা সাদীর কাছে তিনি লাভ করেন কোরানুল করিমের সত্য এবং তাঁর কাছ থেকে সাধক মোল্লা সাদী লাভ করেন সনাতন ধর্মের সত্য। সাধক সাদীর সাথে সঙ্গ করার পরই হয়ত লোকনাথ বাবা অনুভব করেছিলেন এবং পরে ভক্তদের বলেছিলেন, “মুসলমান কথা এসেছে মুসল্লম ঈমান কথা থেকে। এর অর্থ ষোল আনা ঈমান যার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত কেবল সেই মুসলমান। ” খেয়াল রাখতে হবে কথাটা ব্যাকরণ ও ব্যুৎপত্তি মাথায় নিয়ে বলেন নি লোকনাথ বাবা৷ তিনি বলেছেন দার্শনিক চিন্তার জায়গা থেকে। অবশ্য বাণীটার বিকল্প পাঠ আছে, ‘ মুসল্লম ঈমান যার বা ষোল আনা ঈমান যার সেই মুসলমান ’ ।

সাদীর কাছে ইসলামের তালিম নিয়ে এবং সাদীকে সনাতন ধর্মের তালিম দিয়ে লোকনাথ বাবা মক্কা অভিমুখে যান। সেখানেই দেখা পান মহাসাধক যোগী আব্দুল গফুরের৷ লোকনাথ বাবার তিনজন গুরুর একজন মুসলমান৷ ভগবান গাঙ্গুলী, ত্রৈলঙ্গস্বামী এবং আব্দুল গফুর। লোকনাথ বাবা নিজে বলেছেন যে উনি সারাজীবনে দুজন ব্রাহ্মণ বা ব্রহ্মজ্ঞানী দেখেছেন। একজন হলেন কাশীর ত্রৈলঙ্গস্বামী (তৈলঙ্গস্বামী) এবং আরেকজন হলেন মক্কায় দর্শন পাওয়া গুপ্ত সাধক আব্দুল গফুর। আব্দুল গফুর কাউকে ধরা দিতেন না। কিন্তু হঠাৎ করেই লোকনাথ বাবা মক্কা ভ্রমণ করতে গিয়ে এই সাধকের সন্ধান পান। আসলে লোকনাথ ও গফুরের মাঝে শুধু গুরু-শিষ্য নয় আরও উপরের সম্পর্ক ছিল। আর গফুর কত উচ্চকোটির সাধক ছিলেন তা আমরা লোকনাথ বাবার বাণী থেকে জানতে পারি। উনি দেড়শ বছরে যে দুজন ব্রহ্মজ্ঞানীর বা ব্রাহ্মণের সাক্ষাৎ পেয়েছেন তাঁদের একজন হলেন গফুর।

সাধনভজন সম্পর্কে লোকনাথ বাবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ রয়েছে ৷ যথা :
১) আত্মনিষ্ঠ যোগেই তোদের মুক্তির পথ। ভক্তিই সারবস্তু। মন্ত্রাদি সহায় মাত্র। ভক্তিকে সম্বল করে এগিয়ে চল, তোদেরকে রুখবে কে রে, তোরা আমারই সন্তান৷
২) আগে খণ্ডকে জানতে হবে। কারণ খণ্ডকে চাইতে না জানলে অখণ্ডের মহানন্দ চাওয়ার ভাবটি আসবে কোথা থেকে?
৩) সর্বদাই আনন্দে থাক। আনন্দে থাকাই শ্রীভগবানকে নিয়ে থাকা।
৪) যোগযুক্ত হও, শ্বাসে ও প্রশ্বাসে জপই হল যোগ৷
৫) নিজেকে বড় না করে তাঁকে বড় কর, নিজে কর্তা না সেজে তাঁকে কর্তা জ্ঞান করার চেষ্টা কর, তাহলেই ত্যাগ আসবে।
৬) যাঁকে পাবার জন্য এত যোগসাধনা, এত ভক্তি, তিনি শুধু মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহের মধ্যে না সাধু মহাপুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? তিনি যে সবের মধ্যেই আছেন।
৭) গীতা কি আর নিত্যপাঠ্য জিনিস, গীতা যে গীতা। গীতা পাঠ করলে কি হবে, শোনার চেষ্টা করতে হবে। প্রতিটি জীবের হৃদয়ে বসে যে ভগবান নিত্য গীতা শোনাচ্ছেন। যেদিন শুনবি সেদিন গীতা হয়ে যাবি।
৮) সেই কালীই ব্রহ্মশক্তি, তিনি শবের হৃদয় অধিকার করে রয়েছেন।
৯) যে কারণে শিব মৃত্যুঞ্জয়, সেই কারণেই শিব-শব। জীব যখনই বাসনা শূন্য হয়, তখনই তার জীবত্ব শেষ হয়ে যায় এবং তিনি শিবত্ব লাভ করেন। অর্থাৎ জীবভাব ব্রহ্মসত্তায় বিলীন হয়ে যায়। সেই অবস্থায় ইচ্ছাময়ী ব্রহ্মশক্তি তাঁর শবদেহ অধিকার করে বসেন এবং সেই শব শরীর আশ্রয় করে সৃষ্টি, স্থিতি, লয় করে থাকেন। এ রূপে ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবানের শক্তি ও গুণসম্পন্ন হয়ে শব শিব রূপে কথিত।
১০) ধর্মই শ্রেয়, ক্ষমাই একমাত্র শান্তি, বিদ্যাই একমাত্র তৃপ্তি আর অহিংসাই একমাত্র সুখনিদান।
১১) যা সাধারণের জন্য হিতজনক তাই সত্য। সত্যই শ্রেয়লাভের অদ্বিতীয় উপায়৷ সত্যের প্রভাবেই যথার্থ জ্ঞান ও হিতসাধন হয়।
১২) সাধারণ লোকেরা মনে করে ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয় উপভোগ না করাই ইন্দ্রিয় সংযম। কিন্তু ইন্দ্রিয় সংযম কি শুধুই বিষয় উপভোগ না করা? না, তা নয়। ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয় উপভোগ না করলেই জিতেন্দ্রিয় হওয়া যায় না। জরাগ্রস্ত, রুগ্ন আর বিকলেন্দ্রিয় লোকেরা উপভোগে অসমর্থ। অনেক লোক লোকনিন্দার ভয়ে ইন্দ্রিয়ভোগ স্থগিত রেখে কষ্টসাধ্য ব্রত ও তপস্যাদিতে নিযুক্ত হয়। এরা কেউই জিতেন্দ্রিয় নয়। তাই বাসনার নিবৃত্তি না হলে প্রজ্ঞা স্থির হয় না, জিতেন্দ্রিয় হওয়া যায় না।

সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, শোষণ ও আধ্যাত্মিক চর্চা সবকিছুতেই আজ লোকনাথ বাবাকে প্রয়োজন। তাঁর দূরদর্শী পদক্ষেপই আমাদের এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে। তিনি পরম কিভাবে হয়েছেন সেটা বোঝা দরকার৷ শাস্ত্রে আছে সত্যং পরং ধীমহি। অর্থাৎ সত্যস্বরূপ পরমের ধ্যান করি। লোকনাথ বাবা তাঁর শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে সেই সত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। সেই সত্যের ব্রহ্মপুত্রকে তাঁর সাধন পাশুপত বলে সাধারণ মানুষের নিকটে এনে দিয়েছেন। সেই সত্যে স্নান করে পাপক্ষয় সম্ভব। এর অর্থ তাঁর উছিলাতেই আমরা জানতে পারি সত্য তথা ধর্মকে। সেক্ষেত্রে ভক্ত তাঁকে উছিলা ধরেই ভক্তিগঙ্গায় ডুব দিতে পারে৷ যদি তাই হয় তাহলে তিনিই ভক্তের কাছে পরমের স্বরূপ। পরম ভক্তের কাছে লোকনাথ বাবার রূপে এসে সত্যদর্শন করিয়েছেন। তাই লোকনাথ বাবার পূজা করাতে বিন্দুমাত্র সমস্যা নেই। যাঁর ভক্তি আছে সে অবশ্যই ছবি বা মূর্তি দিয়ে লোকনাথ বাবার পূজা সম্ভব। গোটা ব্যাপারটাই ভাবভক্তির ব্যাপার। ভাবভক্তির কুঞ্জে নিয়ম নীতির বালাই নেই৷ তাছাড়া পরম তো সবই। পরম ছাড়া এই জগতে দ্বিতীয় কিছু কি আছে? এই যাবতীয় বস্তু ও চৈতন্য সবই সেই পরমেরই অংশ। তাই বিভিন্ন রূপে পরমই আমাদের কাছে সত্যদর্শন করান। যিনি সত্যদর্শন করার সাধনার ক্ষেত্রে তাঁকে উপাসনা করাতে কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়। কেননা আকার সাধনার ক্ষেত্রে এমন আকার প্রয়োজন যাতে ভক্তি আসবে এবং মন নিবিষ্ট করা যাবে। কেউ আকারের পূজা করে না, করে আকার ও নিরাকারের অতীত জ্যোতির্ময় থাকা পরমের। সেক্ষেত্রে আকার বা নিরাকার যেকোনো উপাসনার মূলে আকার-নিরাকারের অতীত থাকা পরমের পূজা লোকনাথ বাবার মধ্যদিয়ে অবশ্যই করা যাবে। ভক্তের হৃদয়ে সত্যের সুরধুনী লোকনাথ বাবা বইয়ে দেন তাহলে ভক্তের কাছে সেটাই সত্য। সাধনার ক্ষেত্রে বা উপাসনার ক্ষেত্রে ফাঁকি বা অনুমানের জায়গা নেই। নগদ নগদ বুঝে নিতে হয়। কারও কাছে যদি লোকনাথ বাবা প্রত্যক্ষ হয়ে থাকেন তাহলে এর চেয়ে বড় সত্য দ্বিতীয়টি তার কাছে নেই এবং এর উপাসানাই পরম ধর্ম। মোটকথা, বাবার ভক্ত হোক বা ভক্ত না হোক সবারই উচিত বাবাকে স্মরণ করা। তাঁকে স্মরণ করার মাধ্যমে আমরা নতুন পথ পাবো৷

আর্য সারথী

২৯ শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪০৭ বঙ্গাব্দে গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদিনিবাস জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার রায়দেরপাড়া গ্রামে। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, সঙ্গীত প্রভৃতির প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় । তাঁর ইতোপূর্বে প্রকাশিত ‘মজলুমের সহজপাঠ প্রথম পর্ব’ ও ‘ভাব সমাহার’ সুধী মহলে সাড়া ফেলেছে। বর্তমানে ইউটিউবে ভিডিও তৈরি করে থাকেন।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top