লাল বই

।। ইমরান আল হাদী ।।

ময়ফল ঋজুরে একদিন কাছে ডাকে তার বৃত্তান্ত জানতে। তাতে ঋজু দূরে দাঁড়াইয়া কয়, “তুমি একটা গাছের লগে মিলিত হইছো, তোমার কাছে যাইতে আমার ঘৃণা লাগে। তোমার গা থিকা গাছের গন্ধ আসে, আমার ভালোলাগে না।” ময়ফল ভাবে, ঋজু তারে না পাইয়া পাগল হইছে নিশ্চয়। সে গাছের লগে মিলিত হইবে ক্যামনে সে তো মিলিত হইছে জহুর লগে। তবে জহুর গায়ে গাছের গন্ধ আছে কি নাই তা ময়ফল মনে করতে পারে না, তবে কি একটা ফুলের গন্ধ আছে জহুর গায়। কড়া ফুলের গন্ধ, এমন ফুল মুনিগঞ্জে কখনও ছিল না। জহুর লগে মিলিত হইলেই সে এমন ফুলের গন্ধ পায়।

লাল বই

ময়ফল পলাইতে চায়, বাস্তবিক পলাইতে চায় সে।মুনিগঞ্জ থাইকা চইলা যাইতে চায় যে কোনভাবে। যাইতে চায় অন্য কোথাও। ময়ফল তা পরে না, পারে না এই কারণে যে মুনিগঞ্জের চতুর দিকে নদী আর খাল দিয়া ঘেরা। পশ্চিম দক্ষিণে খাল, পূব উত্তরে নদী।

খাল পাড়ে ময়না মাদার আর কাটা বহরি দিয়া ঘেরা তা ময়ফলের পলায়নে বাধা হইয়া দাঁড়ায়। নদী ময়ফল পাড়ি দিতে পারে না যেহেতু তার কোনও নৌকা থাকে না বা মুনিগঞ্জে কোনও নৌকাই ছিল না কখনও। ময়ফলের পলানের সম্ভাবনা যে পথে একটু থাকে তা হইলো খাল পাড়ি দিয়া।

ময়ফল খাল পাড়ি দিয়া পলাইতে চাইলে, বিবিধ কাঁটায় ময়ফলের শরীরে আঘাত পাইলে বা পায়ে কাঁটা বিন্ধিলে কী বা লুঙ্গি ছিঁড়িয়া গেলে, সে বিবিধ যন্ত্রণায় বারবার ফিরে আসে। ময়ফল বারবার পলায়নে ব্যর্থ হওয়াতে সে পইড়া থাকে তার কওমের ভিতরে, কূল-বংশের ভিতরে বন্দি হইয়া। এমনকী তার গোষ্ঠীর মানুষেরাও তারে রাখতে চায় ধইরা বাইন্ধা। তেজিয়ান পুরুষ ময়ফল, তবুও সে শুধু পলানের পথ খুঁইজা মরে সারা জীবন ধইরা।

ময়ফলের মায় যে মা, ছতু বিবি সে ও বুড়া কাদুর লগে ফন্দি করে ক্যামনে ময়ফল রে ধইরা রাখা যায়। তাতে বুড়া কাদু ময়ফলের লগে কথা কয় তার কাছারি ঘরে। বুড়া কাদু ময়ফল রে কয়, “তুমি তো জানো আমার কাচারিতে কাউরে সহজে আমি ডাকিনা, তোমার মায়ের অনুরোধে তোমারে কাচারিতে ঢুকাইছি। তুমি আমার কথা শুনলে তোমার ভালো, মুনিগঞ্জের সবার ভালো,আর না শুনলে তোমার ক্ষতি। তুমি মুনিগঞ্জ ছাইড়া যাইতে পারবানা, তা তোমার দ্বারা সম্ভব না কারুর দ্বারাই সম্ভব না। তোমার লগে রিজুর বিবাহ হইবে তুমি জোয়ান মরদ, তোমার বীর্যে পয়দা হইবে নতুন মানুষ।’’

ময়ফল বুড়া কাদুরে কিছু কয় না, সে জানে বুড়ার লগে কথা কইয়া কোন ফায়দা নাই। বুড়া পারেনা এমন কোন কায়দা নাই। বুড়া কালা কউয়া পালে, কউয়ারে ঠোঁটেঠোঁটে খাওন খাওয়ায় আন্ধার রাইতে। ময়ফলের যেহেতু রাইতে হাঁটোনের অভ্যাস, এক রাইতে সে এই ঘটনা দ্যাখে। প্রায় মানুষের সমান বড় একটা কালা কাউয়ারে ঠোঁটেঠোঁট মিলাইয়া খাওন খাওয়াইতেছে কাদু বুড়া। মানুষের টের পাইয়া কাউয়াডা মাইনষের ছইল (শরীর) ধরে আর তা যেন ঋজুর মতো লাগে ময়ফলের। তবে ময়ফলের বিশ্বাস হয় না যে এই কালাশাড়ি পরা মাইয়াডা রিজু। ময়ফলের বিশ্বাস সে বিরাট পাখনার একটা কউয়াই দেখছে। আরো পরে সে দ্যাখে আন্ধার রাইতে-রে আরও আন্ধার কইরা কাউয়াটা বিরাট পাখনা মেইলা মান্দার গাছে গিয়া বসে। ময়ফল ভালো কইরা দেখনের লাইগা মান্দার গাছের কাছে গেলে মাইয়ালি কন্ঠে কেউ কয়, ‘‘ময়ফল তুমি এই হানে কী করো?’’ তাতে ময়ফল কিছুটা চমকাইয়া দেখে ঋজু তার সামনে খাড়াইয়া, পরনে কালা শাড়ি। ময়ফল ঋজুরে কিছু না বইলা চইলা আসে। ময়ফলের বিশ্বাস, এইটা ঋজু না এইটা কাদু বুড়ার পালা কাউয়া।

ময়ফল বুড়া কাদুরে ডরায় আরেকটা কারণে, বুড়ার কাছে যে লাল বই আছে সে বই বড় মারাত্মক জিনিস। মুনিগঞ্জে সবাই জানে লাল বই কী জিনিস। তবে বইটা অনেকেই দ্যাখে নাই। ময়ফল দ্যাখছে একবার লুকাইয়া যখন মা কালীরে ডাইকা নেয়া হয় তার মউতের খবর কওনের জন্য। ময়ফল বিষয়টা যে কোনওভাবে জানতে পারলে লুকাইয়া থাকে কাছারি ঘরের আবডালে।

ময়ফল দেখছিল, বইটা চামড়ায় বাঁধাই করা, কালচে খয়েরি রংয়ের বইটা এক সময় হয়তো লাল রঙের আছিল। বহু ব্যবহারে এর রং এমন হইছে। এই কারনে হয়তো এর নাম লাল বই। বইয়ের ফ্যাকাসে পাতায় লাল হরফে কি সব লেখা, যেহেতু ময়ফল পড়তে জানেনা তাই সে কিছু বুঝতে পারে না। তবে সে শুনছিল মকালির মৃত্যুর তারিখ, তা শুইনা মকালি যেন হাফ ছাইড়া বাঁচলো। মকালিরে কাদু বুড়া মউতের টাইম দিছিলো দুই প্রহর রাইতে,আর মকালিরে খাওয়ানো হইছিল লাল রংয়ে কোন পানিয়। মকালি সে পানি খাওনে কেমন ফ্যাকাসে হইয়া গেছিল, তবে সে যেন আনন্দ পাইছিল। মুনিগঞ্জের সব বুড়াই মৃত্যুরে এমন ভাবে পায়।

মুনিগঞ্জে জন্ম-মৃত্যর ক্রম আছে। আগে জন্ম যার আগে মৃত্যু তার এই নিয়ম। আর তা লেখা হয় লাল বইয়ে। কোনও বাচ্চা হইলে কাদু বুড়ার কাছে গিয়া লাল বইতে লিখাইতে হয় তার নাম আর জন্ম তারিখ। মৃত্যুর তারিখ নির্ধারণ করে লাল বই। কাদু বুড়ার বয়ানে বলা যায় সব চেয়ে যে মানুষটার বয়স বেশি তার নাম বইয়ের মৃত্যু তালিকায় লেখা হয়ে যায় আপনা আপনি। এতে কাদু বুড়ার কোনও হাত নাই সে কেবল মৃত্যু নির্দিষ্ট ব্যাক্তিরে তারিখ জানায় মাত্র। কাদু বুড়া বলে সে প্রতি দিন মৃত্যুর তালিকা দ্যাখে তাতে কারো নাম উঠলো কিনা। কাদু বুড়া কয়, “তোমরা ভাগ্যবান যে তোমারা অকালে মরো না। সবাই বুড়া হইয় মরো, সবার চেয়ে যে বয়সে বড় সেই আগে মরে। আমার লাল বইয়ে তোমাগো নাম আছে তোমরা তো ভাগ্যবান।” কাদু বুড়া কয়, “জোয়ান মরদ অকালে মরলে আমার কওম চালবে ক্যামনে। বংশ টিকবে ক্যামনে। তোমাগো মঙ্গলের লাইগাই আমার লাল বই”।

তবে ময়ফলের মনে হয় কাদু বুড়াই মুনিগঞ্জের সবচেয়ে বুড়া হইবে। তারে কেউ মরতে দেখলো না ক্যান বা তারে জন্মাইতেও তো দ্যাখে নাই মুনিগঞ্জের কেউ। সে কীভাবে মুনিগঞ্জ আইলো বা সে তার লাল বই কিভাবে পাইলো তা কেউ কইতে পারেনা। লাল বইয়ে তার নাম ওঠে না ক্যান। ময়ফল তার মা ছতু বিবির কাছে এ কথা জানতে চাইলে, ছতু বিবি ময়ফল রে কয়, “বুড়া কাদু মরলে লাল বই ল্যাখবে কেডা?” তাতে ময়ফল কিছুটা চিন্তায় পইড়ে কয়, “মুনিগঞ্জের কেউ ল্যাখবে, তখন ছতু বিবি ময়ফল রে কয় মুনিগঞ্জে কেই ল্যাকতে পরে, যে লাল বইয়ে ল্যাখবে?” ময়ফল বলে, “ল্যাখার দরকার কি যেমনে ইচ্ছা মানষে মরেবে তা সে ল্যাখনের কেডা?” ছতু বিবি কয়, “তাইলে তো অকালে মরবে সবাই। ময়ফল তাতে বলে মরলে মরবে তা তোমরা আটকাবা ক্যা। এর লাইগাই তো আমি পলাইতে চাই, মরতেও তো পারি না নিজ ইচ্ছায়।”

ময়ফল মরতেও গেছিল দড়ি নিয়া তাও পারে নাই। মুনিগঞ্জে ফাঁস নেবার মত বড় কোন গাছ না থাকাতে সে জুত মতো কোনও ফাঁসি কাষ্ঠ পায় না। ময়ফল অনেক খুঁইজা একটা মান্দার গাছ পাইলে তাতে উইঠা পরলে দেখে এক ঝাক কালা কাউয়া উইড়া আইসা বসে মান্দারের ডালে আর সবচেয়ে বড় কাউয়াডা ঠোঁকরায় ময়ফলের মাথার উপর। তাতে ময়ফল কাউয়া গুলি তাড়াইতে চাইলে মান্দার ডালের উপর বাড়তি জোড় পড়ে, ফলে ডাল ভাইঙা নিচে পইরা যায় ময়ফল। গলায় বন্ধা থাকে ফাঁসের দড়ি।ময়ফল পলাইতে গেলে বা মরতে গেলে কাউয়া গুলা তারে তাড়া করে। তাতে ময়ফল পলাইতে বা শান্তিতে মরতেও পারে না আর।

ময়ফল কি নদী দিয়াও পলাইতে চায় নাই? চাইছিল তাতে সে একটা মান্দার গাছ কাইটা তাতে খোড়ল কইরা ঢোঙা নৌকা বানাইতে চায়। ময়ফলের দোস্ত যে মোনাছেফ সেও ময়ফলরে এক শর্ত দিয়া নৌকা বানাইতে সাহায্য করে। শর্ত হইলো, ময়ফলের মায় আর কাদু বুড়া ঋজুর লগে যে ময়ফলের বিবাহের প্রস্তাব আনছে সে প্রস্তাব মানা যাবে না। মোনাছেফের লগে ঋজুর বিবাহের ব্যবস্থা করন লাগবে। ঋজুর বাপ সয়ফুল চাঁনের কাছে প্রস্তাব লইয়া যাইতে হবে ময়ফলের। তাতে ময়ফল রাজি হয়।

তবে ময়ফল আর মোনাছেফ নৌকার মতো কিছু একটা বানাইলেও তাতে ময়ফলের পলায়ন আর হয় না। হয় না এ কারনে যে ময়ফল রাইতে যখন নৌকা নিয়া পলাইতে যায় তখন নৌকা আর নড়ে না। যেন মান্দার গাছ জীবিত হইয়া শেকড় পুঁইতা দিছে মাটির গভীরে। নৌকার গা ভইরা উঠছে মান্দারের কাটায়। নৌকার আগায় মাথায় গজাইছে মান্দারের ডাল। নৌকার খোড়লে শুইয়া আছে কাদু বুড়ার পালা কাউয়া। কাউডা ময়ফল রে কয় আমারে বিবাহ না কইরা কই যাবা ময়ফল। কাউয়ারে তখন রিজু মনে হয় ময়ফলের। ঋজুর কালাশাড়ি বাতাসে কেবল উড়তে থাকলে, ময়ফলের মনে হয় তারে উড়াইয়া নিতে কাদু বুড়া তার পালা কাউয়ারে পাঠাইছে, তাতে ময়ফল ডরে কেবল দৌড়াইতে থাকলে বনের কাছে চইলা যায় সে।

ময়ফল বনের কাছে বইসা জিরাইতে থাকলে এক মাইয়া সামনে খাড়ায়। ময়ফল ভাবে, কাদু বুড়ার কাউয়া অন্য মাইয়ার ছইল ধইরা আবার আইছে। ময়ফল তারে কয়, “তোমারে চিনছি, তুমি কাদু বুড়ার পালা কাউয়া, তাতে মাইয়া কয় তুমি যা ভাবছো তা আমি না। তয় তোমারে আমি পলাইতে সাহায্য করতে পারি আর তা না পারলেও নিদেন পক্ষে মরতে সাহায্য করতে পারি।” ময়ফল তারে জিগায়, “তুমি কেডা?” তাতে মাইয়া কয়, “আমি জহু, আমিও মুনিগঞ্জের মাইয়া আমারে চিনবা না কিন্তু আমারে তোমার চিননের দরকার।” এই বইলা মাইয়া বনের ভিতরে চইলা যায়।

ময়ফল নৌকায় নদী পাড়ি দিতে না পারলেও, শর্ত মাইনা মোনাছেফের লগে ঋজুর বিবাহের প্রস্তাব নিয়া যায় সয়ফুল চাঁনের কাছে। প্রস্তাবে সয়ফুল চাঁন কিছুটা রাগ হইলে-ও মাইনা নেয়। তবে সে এও বলে, “তুমি মুনিগঞ্জের নিয়মের খেলাপ করলা তোমার বা মোনাছেফের এতে ভালো হইবে না। কাদু বুড়ার কথা কেউ খেলাপ করেনা। তবে আমি তারে বুঝাবো সে আমার কথা ফেলবে না।”

রিজু মোনাছেফ রে মানতে পারেনা, সে ময়ফলের পিছনে লাইগা থাকে। দিনে কি রাইতে খাড়াইয়া থাকে ময়ফলের সামনে, ময়ফলের মনে হয় সে যেন উইড়া আসে তার কাছে। কাদু বুড়ার পালা কাউয়া হইয়া, এতে ময়ফল মুনিগঞ্জে কোথােও টিকতে না পাইরা চইলা যায় বনের ধারে। বনের ধারে দেখা পায় জহুর। জহুরে পাইয়া ময়ফলের মনে শান্তি আসে। জহুরে ময়ফল জিগায়, তার ঘর কোথায়, তাতে জহু কয়, তার ঘর এই বনের পাশেই। জহু কয়, “ময়ফল তুমি আমারে লও তাতে তুমি কাদু বুড়ার হাত থাইকা বাঁচতে না পারলেও মরতে পারবা নিজ ইচ্ছায়। কাদু বুড়া তোমার লগে ঋজুর বিবাহ দিয়া তার খিদমতগার হিসাবে আমারে নিবে।” ময়ফল ভাবে, ঋজু হইলো কাদু বুড়ার পালা কাউয়া, পুরান কাউয়া বাদ দিয়ে নতুন কাউয়া বানাইবে বুড়া। ময়ফল জহুরে জিগায়, তার কী করন লাগবে? জহু কয়, “তুমি আমি মিলিত হইলে তাতে কাদু বুড়ার তেজ কমবে।” ময়ফল আর জহু মিলিত হইলে তারা দেখে কাদু বুড়ার কাউয়া তাদের মাথার উপরে চক্রাকারে উড়তে আছে। আবার কখনও দেখা যাইতো ঋজু কালাশাড়ি পিন্ধিয়া খাড়াইয়া আছে গাছের আবডালে। ময়ফল আর জহুর মিলিত হবার পর ঋজু আর ময়ফলের সামনে আসে না।

ময়ফল ঋজুরে একদিন কাছে ডাকে তার বৃত্তান্ত জানতে। তাতে ঋজু দূরে দাঁড়াইয়া কয়, “তুমি একটা গাছের লগে মিলিত হইছো, তোমার কাছে যাইতে আমার ঘৃণা লাগে। তোমার গা থিকা গাছের গন্ধ আসে, আমার ভালোলাগে না।” ময়ফল ভাবে, ঋজু তারে না পাইয়া পাগল হইছে নিশ্চয়। সে গাছের লগে মিলিত হইবে ক্যামনে সে তো মিলিত হইছে জহুর লগে। তবে জহুর গায়ে গাছের গন্ধ আছে কি নাই তা ময়ফল মনে করতে পারে না, তবে কি একটা ফুলের গন্ধ আছে জহুর গায়। কড়া ফুলের গন্ধ, এমন ফুল মুনিগঞ্জে কখনও ছিল না। জহুর লগে মিলিত হইলেই সে এমন ফুলের গন্ধ পায়।

ময়ফলের আবার ডাক পড়ে কাদু বুড়ার কাছারি ঘরে। কাদু বুড়া ময়ফলরে কয়, “তুমি দুইটা অন্যায় করছো, এক অন্যায় করছো ঋজুরে বিবাহ না কইরা আর দ্বিতীয় অন্যায় হইছে জহুর লগে মিলিত হইয়া। তাতে তুমি আমার লাল বইয়ের শর্ত খেলাপ করছো। তোমার শাস্তি পাওন লাগবে!” ময়ফলরে শাস্তি দিতে তারে পান করানো হয় লাল রঙের কারণ-বারি। ময়ফল ভাবে তারে বুঝি কাদু বুড়া বিষ খাওয়াইলো। ময়ফল এমন মরন চায় নাই, সে চাইছে ইচ্ছামরণ। ময়ফল ভাবে কাদু বুড়া, লাল বই আর তার কওম, তারে আর তার ইচ্ছা-রে কাইড় নিলো। তখন কাদু বুড়া ময়ফলরে কয়, ‘‘তুমি মরবা না, তবে বেহুঁসে থাকবা। তোমার বেহুঁসে থাকা আমার কওমের আর মুনিগঞ্জের লাইগা মঙ্গল।’’
ময়ফলরে বেহুঁসে বেশি দিন রাখা যায় না, তারে ছাড়তে হয়। না ছাড়লে তার মউত হইতে পারে, তাতে লাল বইয়ের শর্ত খেলাপ হয়। তাই ময়ফলরে ছাড়া হয়, তারে কাদু বুড়া সতর্ক কইরা দেয় যাতে সে আর কোনও অন্যায় না করে। ময়ফল বেহুঁস থাইকা ছাড়া পাইয়া চইলা যায় জহুর কাছে বনের ধারে। জহু ময়ফলরে কয়, ‘‘কাদু বুড়া তোমারে মারবে না আর ছাড়বেও না, তুমি কি এই জীবন চাও?’’ ময়ফল যে ‘এই জীবন চায় না’ তা বলাতে জহু ময়ফলরে কয় তুমি বুড়া কাদুর নিয়মরে ভাইঙা দাও। তা কীভাবে ময়ফল জানতে চাইলে, জহু কয়. ‘‘কাদু বুড়ার লাল বই পুড়াইয়া ফালাও তাতে কাদু বুড়া মুনিগঞ্জের কারও ইচ্ছা কাইড়া নিতে পারবে না।’’

ময়ফল ভাবে, ক্যামনে লাল বই পুড়াইবে সে! কাদু বুড়া যে কাদু বুড়া সে তো রাইতে ঘুমায় না। তার কালা কাউয়ারে ঠোঁটেঠোঁটে খাওন খাওয়ায়। ময়ফল ধরা খাইলে তারে কারণ-বারি খাওয়াইয়া বেহুঁসে রাখবে আমরণ। বুড়ার কওম তার পক্ষে, তারা চায় নিশ্চিন্ত জীবন আর মইরা যাবে বুড়ার নিয়মে। গোষ্ঠীর লোক, কওমের লোক লাল বই পোড়ানো মানবে না।

ময়ফল যায় ঋজুর কাছে, ঋজুরে কয়, ‘‘তোমার লগে আমার বিবাহ হইতে পারে, তুমি যদি লাল বইটা আমারে আইনা দিতে পারো। তাতে ঋজু কয়, ‘‘লাল বই আমার ধরা নিষেধ আর তোমার লগে আমার বিবাহ হইতে পারে না। তোমার মিলন হইছে একটা গাছের লগে।’’ ময়ফল ঋজুরে বুঝায়, ‘‘লাল বইতে তোমার আমার বিবাহের বিষয়ে লেখা আছে, তা কাদু বুড়া তোমারে কয় নাই! সে তোমারে তার পালা কাউয়া বানাইয়া রাখছে।’’ তাতে ঋজু রাজি হয়। ঋজু ময়ফলরে কয়, ‘‘রাইতে তুমি কাছারিঘরে আইসো তোমারে লাল বই দিবো।’’

রাইতে ময়ফল যায় কাছারি ঘরে, ঋজু লাল বই নিয়া আসে। ঋজু কয়, ‘‘বুড়া কারণ-বারি খাইছে বেহুঁস আছে।’’ ময়ফলরে ঋজু কয়, “তাড়াতাড়ি দ্যাখো লেখা আছে কিনা তোমার আমার বিয়ার বিষয়ে।” ময়ফল বইটা হাতে নিয়া দ্যাখে আর বইতে আগুন ধরাইয়া দেয়। ঋজু চেঁচায় সে চেঁচানি ময়ফলের মনে হয় কালা কাউয়ার ডাক। ঋজু আগুনে ধরা বইটা নিয়ে দৌড়ে কাছারি ঘর দিকে যায় আর তার কালাশাড়ি তে আগুন ধরলে, ময়ফল দ্যাখে, কাদু বুড়ার কালা কাউয়ার পাখনায় য্যান আগুন জ্বলছে। সে আগুন ছড়াইয়া পড়ে সমস্ত কাছারি ঘরে।

ময়ফল ভয় পায়, সে দৌড়ায়। জহুরে খোঁজে, ময়ফল বনের কাছে যায়, বনে গিয়া পায় জহুরে। জহুর কাছে বই পোড়ানোর বৃত্তান্ত খুইলা কইলে, জহু কয়, ‘‘তুমি বাঁচতে পারবা না, তোমারে বাঁচতে দিবেনা কাদু বুড়ার কওমের লোকেরা, তোমারে মাইরা ফালাইবে। তোমার ইচ্ছামরণ হইবে না, তুমি যদি ইচ্ছামরণ চাও তাইলে এই বৃক্ষে উইঠা ফাঁস লও বৃক্ষের ডালে।’’ ময়ফল দ্যাখে, তার সামনে দাড়াইয়া আছে বিরাট গাছ। আর গাছের ফুল অদ্ভুত মাদকতা ময় গন্ধ ছড়াইতেছে, ময়ফল গন্ধটা চেনে, জহুর গায়েও এমন গন্ধ পাইতো সে। ময়ফল কয়,‘‘ মুনিগঞ্জে তো এরকম কোনও গাছ ছিল না’’– তাতে জহু কয়, ‘‘এইটা ছাতিম বৃক্ষ। তোমরা এত দিন কিছুই দ্যাখো নাই।’’

মুনিগঞ্জের মানুষেরা ময়ফলরে পায় বিরাট বৃক্ষের ডালে ঝুলানো। মুনিগঞ্জে এমন সফল মৃত্যু আগে কখনও ঘটে নাই। ময়ফলের মরন তাদের কাছে আশ্চর্য ঘটনা। তার চেয়েও তাদের কাছে আশ্চর্য লাগে অচিন বৃক্ষরে। তারা ভাবে, মুনিগঞ্জে এমন গাছ ছিল, তা তারা আগে দ্যাখে নাই ক্যামনে! ছতু বিবি যে ময়ফলের মা, ময়ফল রে দেইখা তার কাঁন্দোন আইলে সে পষ্ট জবানে কয়, মুনিগঞ্জে তো কাঁন্দোন আছিলো না, শোক আছিলো না, তাইলে আমার ক্যান শোক আইলো? আমারেই ক্যান প্রথম কাঁনতে হইলো। ময়ফলের মরনে মুনিগঞ্জের মানুষে শোক পায়, কাঁন্দোন পায়। আনন্দ আর শোকের ফারাক পায়, সর্বোপরি তারা শোক আর আনন্দ নিয়া বাঁচে আর মইরা যায় নিয়মে অনিয়মে । মুনিগঞ্জের বাতাসে ভাসে ছাতিম ফুলের গন্ধ মাদকতা।

ইমরান আল হাদী

কবি, কথা সাহিত্যিক। জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সাল। বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানাধীন বোয়ালিয়া গ্রামে। সে গ্রামেই বসবাস। প্রকাশিত বই ‘হায়াতুননেছা’ (কবিতা ২০২১)

Share