।। জিল দেল্যুজ ।।
ফরাশি দার্শনিক জিল দেল্যুজ (১৯২৫-১৯৯৫) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী দুনিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তাবিদ। নিজেকে ‘বিশুদ্ধ অধিবিদ্যাবাদী’ বলে পরিচয় দিতেন তিনি। তবে তাঁর অধিবিদ্যা ছিল সমকালের বিজ্ঞান, রাজনীতি, শিল্পকলা এবং বাসনার নানা প্রতিসরণের সৃজন-মত্ত উপস্থাপন। পশ্চিমের ষাট-সত্তরের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের মর্ম তাঁর দার্শনিক লেখাজোখায় সবচেয়ে ভাল ধরা পড়ে। তাঁর বহুব্যাপ্ত-বহুশাস্ত্রীয় রচনায় সমকালীন নানা প্রশ্নের মধ্যে প্যালেস্ট্যাইন (ফিলিস্তিন) প্রশ্নটিও উত্থাপিত হয়েছে বারেবারে। এখানে ১৯৭৮ সালে এই প্রশ্নে তাঁর লেখা একটি নিবন্ধের বাংলা অনুবাদ পেশ করা হল। ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছে ইতিহাসচর্চার সংগঠন ‘বাংলার ইতিহাস চক্র’ (BENGAL HISTORY COLLECTIVE বা বেহিকা), ঢাকা, বাংলাদেশ।
অনুবাদকের নোট
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশরা তাদের ম্যান্ডেট উপস্থিতি প্রত্যাহার করে। এই সময় ইসরায়েল রাষ্ট্র কায়েমের প্রাক্কালে নাকবার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা হয়। জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা বাদে ম্যান্ডেটরি ফিলিস্তিনের বাদবাকি এলাকা ইসরায়েলের অধিকারে যায়। ১৯৬৮ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্য দিয়েও এই সংকটের কোন সমাধান হয় নি। দেশচ্যুত ফিলিস্তিনিরা নানা দেশে শরণার্থী হিসাবে ঠাঁই নেয়। তাদের অন্যতম ঠাঁই হয় লেবাননের দক্ষিণ অঞ্চল। ফলে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা বা পিএলওর কর্মকাণ্ডের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে দক্ষিণ লেবানন। ইসরায়েল এই অঞ্চলে একাধিক বিমান হামলা চালায়। এর মধ্যে ফিলিস্তিন প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সাল থেকে লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। অন্যদিকে মিশরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় শুরু করেন। এই জটিল পরিস্থিতিতে দক্ষিণ লেবাননে অবস্থানরত পিএলও কর্মীদের পক্ষ থেকে ১৯৭৮ সালে ইসরায়েলে এক সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়, যার নাম কোস্টাল রোড হত্যাকাণ্ড। তখন ইসরায়েল অপারেশন লিটানি নামে এক অভিযান শুরু করে, এবং ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী দক্ষিণ লেবাননে ঢুকে পড়ে। জাতিসংঘ ইসরায়েলকে সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব পাশ করে। পরিশেষে পিএলও দক্ষিণ লেবানন থেকে অনেকটা সরে আসে, জাতিসংঘ দক্ষিণ লেবাননে আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন করে, আর ইসরায়েল সেখানে দখলাধীন এলাকায় নিজস্ব উপস্থিতির পাশাপাশি “দক্ষিণ লেবাননি বাহিনী” নামক খ্রিস্টান-প্রধান মিলিশিয়ার দ্বারা এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখে। এইসকল ঘটনার ঘনঘটার প্রেক্ষিতে দেল্যুজ ফরাশি পত্রিকা ল্য মোন্দে এই লেখাটি লেখেন।
ঝামেলাবাজের দল
ফিলিস্তিনিদের কেন ‘সম-মর্যাদার প্রতিপক্ষ’ হতে হবে যেখানে তাদের দেশই নাই? দেশ তাদের থাকবে কেন, কেড়েই যখন নেওয়া হয়েছে তা? নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ বাদে তাদের আর কোন রাস্তাই তো দেওয়া হয় নি কখনো। দেওয়া হয়েছে কেবল মরে যাওয়ার সুযোগ। যে যুদ্ধ তাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ইসরায়েলের মুখোমুখি, তাতে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে দেখা হয় বৈধ প্রত্যাঘাত হিসাবে (যদি বা সেই প্রত্যাঘাতকে কিছুটা মাত্রাছাড়া বলে ঠাহর হয়েও থাকে), আর ফিলিস্তিনিদের কর্মকাণ্ডকে দেখা হয় নিছকই সন্ত্রাসবাদী অপরাধ হিসাবে। আর কোন আরবের মরণ কখনো কোন ইসরায়েলির মরণের সমান মূল্যে, সমান ওজনে মাপা হয় না।
১৯৬৯ থেকেই ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে ক্রমাগত বোমাবাজি-শেলবাজি করে চলেছে। ইসরায়েল খোলাখুলিই স্বীকার করেছে যে লেবাননে তাদের সাম্প্রতিক দখলাভিযান তেল আবিব কমান্ডোকাণ্ডের প্রতিশোধ নয় (যে কমান্ডোকাণ্ডে এগার জন সন্ত্রাসবাদীর বিরুদ্ধে ছিল ত্রিশ হাজার সৈন্য), বরং তা ছিল ইসরায়েলেরই শুরু করা উপর্যুপরি কতগুলো পূর্বপরিকল্পিত কাজের চূড়ান্ত পর্যায়। ইসরায়েল এইসকল কর্মকাণ্ড চালালে তার সঙ্গে যে অন্য সকল রাষ্ট্র প্রায় সর্বসম্মতভাবেই যোগসাজশ করবে – খানিক চুলচেরা সাতপাঁচ সীমাবদ্ধতা সহকারে হলেও – এই ভরসা ইসরায়েলের আছে। যে ফিলিস্তিনি জনগণের না আছে ভূখণ্ড না আছে রাষ্ট্র – তাদের সবাই দেখে ঝামেলাবাজ বা গণ্ডগোলকারী হিসাবে। কিছু দেশ থেকে যত অস্ত্র আর যত টাকাই তারা পাক না কেন, তারা যখন বলে তারা একেবারে একা – সেই কথাটার অর্থ কেবল তারাই জানে।
ফিলিস্তিনি যোদ্ধারাও বলে তাদের এই দফা একটা জিত হয়েছে। দক্ষিণ লেবাননে তারা নিছক প্রতিরোধী দল রেখে গিয়েছিল – আর সেই দলগুলি বেশ ভালই রুখে দাঁড়াতে পেরেছে। বিপরীতে ইসরায়েলি দখলাভিযান অন্ধের মতো ফিলিস্তিনি শরণার্থী, লেবাননি চাষী আর সব গরিব জিরাতি মানুষের উপর হামলা করেছে। গ্রাম-শহর ধ্বংস হয়েছে, বেসামরিক মানুষ গণহারে নিধন হয়েছে – এইসবই সূত্রসমর্থিত খবর। বেশ কিছু জায়গায় গুচ্ছবোমার ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। ইসরায়েলি এইসকল আঘাত – যেগুলোকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা করার জো নাই —- তার দরুন দক্ষিণ লেবাননি জনতা অনেক বছর ধরেই বারবার পালাচ্ছে আর ফিরে আসছে – এক অন্তহীন দেশান্তরি যেন। এবারের বাড়াবাড়ির ফলে দুই লাখ মানুষ নিরাশ্রয় হয়ে রাস্তায় নেমেছে। গালিলীতে যে পন্থা কাজে লেগেছে, ১৯৪৮ সালে অন্যত্র যে পন্থা কাজে লেগেছে, ইসরায়েল রাষ্ট্র এবার দক্ষিণ লেবাননে সেই পন্থা খাটাচ্ছে: ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননকে “ফিলিস্তিনিকরণ” করছে।
ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা শরণার্থীদের মধ্য থেকেই আসা। ইসরায়েল বলছে তারা যোদ্ধাদের দমন করছে – কিন্তু তার মধ্য দিয়ে তারা আরও হাজার-হাজার মানুষকে শরণার্থী বানাচ্ছে – যার ভেতর থেকে জন্ম নেবে নতুন যোদ্ধার দল।
ইসরায়েল যে একটা নাজুক, জটিল দেশকে হত্যা করছে, এই কথাটা আমরা নিছক লেবাননের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কারণে বলছি না। আরও একটা দিক আছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আদলটা ইউরোপসুদ্ধু দুনিয়ার হালের সন্ত্রাসবাদের তাবৎ সমস্যার নির্ধারকস্বরূপ। সারা দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার যে বোঝাপড়া এবং বিশ্বজোড়া এক্তিয়ারধারী একটা আবিশ্ব পুলিশ বাহিনী সংগঠনের যেসব তোড়জোড় চলছে তার ফলে ক্রমাগত আরও বেশি বেশি মানুষকে প্রায়- ‘সন্ত্রাসী’ বলে খোপবদ্ধ করার প্রসার ঘটবে। আমরা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের মতো একটা পরিস্থিতিতে পড়ছি বলে দেখতে পাচ্ছি, যেখানে স্পেন হয়ে উঠেছিল ভীষণতর এক ভবিষ্যতের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগার।
আজ সেইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার নেতৃত্ব দিচ্ছে ইসরায়েল। দেশটা দমনপীড়নের এমন এক আদল খাড়া করছে যা অন্যান্য দেশও নিজ নিজ ক্ষেত্রে খাপ খাইয়ে আমল করবে। দেশটার রাজনীতিতে ধারাবাহিকতা ব্যাপক। জাতিসংঘ যত প্রস্তাবের দ্বারা তার কাজকর্মের মৌখিক নিন্দা করেছে, ইসরায়েল সেইসব নিন্দাকে নিজের কাজের যথার্থতার প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করেছে। দখলাধীন অঞ্চল থেকে প্রত্যাহারের আহ্বানকে ইসরায়েল পরিণত করেছে সে অঞ্চলে বসতি কায়েমের জরুরি দায়িত্ব হিসাবে। অধুনা দক্ষিণ লেবাননে আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের ধারণাটাকেও ইসরায়েলের কাছে দারুণ প্রস্তাব বলে মনে হচ্ছে … কেবল শর্ত এই যে, এই আন্তর্জাতিক বাহিনীর কাজ যেন হয় পুরো এলাকাটাকে নজরবন্দি এলাকা বা নিয়ন্ত্রিত বিরানভূমিতে পরিণত করা। চাপ দিয়ে দাবি আদায়ের এই কায়দা বলিহারি। ফিলিস্তিনিরা আসলে যা – তারা যে ‘সমমানের প্রতিপক্ষ’, কারণ যে যুদ্ধদশায় তারা আছে তার জন্য যে তারা দায়ী নয় – এই মর্যাদা শেষটায় যেদিন স্বীকার করে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত চাপ সঞ্চয় করা যাবে, সেদিনই এহেন জবরদস্তি দাবি-আদায়ে নতিস্বীকার থেকে তামাম পৃথিবী সরে আসবে।
প্রথম প্রকাশ: ল্য মোন্দ, এপ্রিল ৭, ১৯৭৮
বাংলার ইতিহাস চক্র
ইতিহাসচর্চার সংগঠন। ঢাকা, বাংলাদেশ।