কোম্পানির আমলা জেমস টডের রাণা প্রতাপ— একটি প্রাচ্যবাদী ইসলামদ্বেষী নির্মাণ

।। বিশ্বেন্দু নন্দ ।।

ইতিহাস থেকে মুঘল সময়কালকে মুছে ফেলার ব্যাপারে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের যে রাজনৈতিক প্রচেষ্টা, তার শিকড় ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের বয়ান নির্মাণ বা নবজাগরণী ইওরোপমন্য ইতিহাসচর্চার মধ্যেই রয়ে গেছে। যা আদতে ইসলামবিদ্বেষী প্রাচ্যবাদী ইতিহাসচর্চার ধারা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উচ্চপদস্থ আমলা জেমস টড সুকৌশলে রাণা প্রতাপকে এই তরিকাতেই ‘বীর’ করে তুলেছিলেন। যেটি ইতিহসাবিকৃতিই একপ্রকার। আর তাই টডের ভাষ্য ইসলামবিদ্বেষী ভদ্রবিত্তের বিকৃত ইতিহাসচর্চাকে প্রভাবিতও করেছে দারুণভাবে।

কোম্পানির আমলা জেমস টডের রাণা প্রতাপ— একটি প্রাচ্যবাদী ইসলামদ্বেষী নির্মাণ

উনবিংশ শতকের প্রথমার্দ্ধে ভারতবর্ষ শাসক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় আমলা এবং পশ্চিম রাজপুতানার পলিটিক্যাল রেসিডেন্ট জেমস টডের লেখা রাজপুতদের ইতিহাস মধ্যযুগের জাতীয়তাবাদী এবং পরের দিকে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসধারাকে তুমুলভাবে প্রভাবিত করেছে। আজ যেভাবে হিন্দুত্ববাদীরা পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল ইতিহাস ছেঁটে ফেলার কথা বলছে, তার ভ্রূণ লুকিয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদী ইসলামোফোবিক নবজাগরণীয় ইতিহাস রচনার ভাবনায়। রাজপুত সামন্ততন্ত্র নিয়ে টডের তাত্ত্বিক অবস্থান বহু আগেই ঐতিহাসিকভাবে খারিজ হয়েছে, কিন্তু টডের হাতে তৈরি মধ্যযুগের রাজপুত ইতিহাসকে অনেকেই রাজপুতানার প্রামাণিক ইতিহাস হিসেবে গণ্য করেন — বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিক আর রাজনীতিবিদেরা। মেওয়ারের শিশোদিয়া গোষ্ঠী আজও মনে করে টডের এনালস এন্ড এন্টিকুইটি অব রাজস্থান (১৮২৯ থেকে ১৮৩২এর মধ্যে প্রকাশিত; এই প্রবন্ধে এখন থেকে এনালস নামে পরিচিত হবে) তাদের গোষ্ঠীর নথিকৃত ইতিহাস বয়ান করে।  ফলে বহু সামাজিক, ঐতিহাসিক আলোচনায় টডের এনালসই রাজুতদের শৌর্য-বীর্য মহত্ব ইত্যাদির রেণুগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আধার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে; এবং টডের এনালসের মত প্রাচ্যবাদী গালগল্প, উপনিবেশিক ভারতবর্ষে রূপান্তরিত হয়েছে প্রামাণ্য ইতিহাসে। এরই সঙ্গে বলা দরকার মধ্যযুগের রাজপুত আর রাজস্থান নিয়ে টডের বয়ান কীভাবে উপনিবেশিক ঐতিহাসিক, জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিকেরা বিশেষ করে নবজাগরিত বাংলার মহাপ্রাণেরা ব্যবহার করেছেন ইতিহাস, সাহিত্য বয়ানে, সেই প্রচেষ্টা নথিবদ্ধ করার কিছু কিছু কাজও শুরু হয়েছে। এই প্রবন্ধে সে আলোচনার সুযোগ নেই; সম্পাদক কোনোদিন সুযোগ দিলে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। আপাতত টডের প্রকৃতি উন্মোচন।

টডের রাজপুতদের চরিত্রচিত্রণটি কীভাবে উপনিবেশিক ঐতিহাসিক বা জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের কাজকর্মকে প্রভাবিত করেছে, সেটা নিয়ে ঐতিহাসিকেরা গবেষণা করেছেন— যেমন নরবার্ট পিবয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন, টডের কাজ ‘উনবিংশ শতাব্দে বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং অযুত জাতীয়তাবাদী কবি লেখক নাট্যকারের কাজকর্মকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে এবং কখনও কখনও তাদের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতিও নির্ণয় করতেও সাহায্য করেছে’। ঐতিহাসিকেরা টডের রাজপুতদের ইতিহাসটিকে দেখার পিছনে তৎকালীন ইওরোপিয় রাজনীতির প্রভাব, ভারতবর্ষে উপনিবেশিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্যম এবং তাঁর নিজের বৌদ্ধিকতার স্তরটি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। নরবার্ট দেখাচ্ছেন টডের রাজপুতানার চরিত্র বাখান ইওরোপের জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মস্ত হাতিয়ার হয়েছে। লয়েড রুডলফ একই রাস্তায় যুক্তি শাণিয়ে বলছেন, জেমস টড শুধু যে রাজস্থানী ভাটেদের গীতিকথাগুলিই নথিবদ্ধ করেন নি, সেটাকে মনের মাধুরীর রঙে মিশিয়ে উপস্থাপন করেছেন তৎকালীন ইওরোপের রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতা এবং বিতর্কে জারিত মন-মানসিকতা অনুসারে। 

পদ্মিনী কিংবদন্তির ইতিহাস গবেষক রাম্যা শ্রীনিবাসন বলছেন, টডের তাত্ত্বিকতায় কীভাবে ‘ঔপনিবেশিক দৃষ্টিতে প্রাক-ঔপনিবেশিক রাজপুত ঐতিহ্যকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং রাজস্থানে পদ্মিনীর গালগল্পকেও টডের তত্ত্বে জারিত করে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে’। রুডলফ এবং রম্যা উভয়েই বলছেন টডের গবেষণার কাঠামো ভিত্তি করে যেমন সমসাময়িক ইওরোপীয়রা ভারতীয় সামন্তবাদ বোঝার চেষ্টা করেছেন, তেমনি আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, টডের রাজপুত বিষয়ক ভাবনাচিন্তা সেই সমাজে উপনিবেশিক হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়ে প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী তৈরিতে সহায়তা করেছে।

পিবয়, রুডলফ এবং রম্যা বলেছেন কোন পদ্ধতিতে টড, তাঁর এনালস বইতে ১৫৭২ থেকে ১৫৯৭ সময়ের শিশোদিয়া রাজপুত নায়ক রাণা প্রতাপ চরিত্র বিশ্লেষণ করে তাঁর প্রাচ্যবাদী ইমেজ তৈরি করেছেন। টডের রাজপুত ইতিহাসকে প্রাচ্যবাদী নজরে দেখার বৌদ্ধিক মনজগত তৈরিতে ইংলন্ডে পড়াশোনার ভূমিকার কথা বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন রুডলফ। ১৮২১-এ উসমানিয়দের বিরুদ্ধে গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রামটি টডের হলদিঘাটি যুদ্ধ বর্ণনায় এবং মুঘল-রাজপুত দ্বন্দ্ব তৈরিতে ব্যাপকভাবে ছায়া ফেলেছে।

জেমস টড

কিন্তু টডের কাজ নিয়ে অধিকাংশ আলোচনা, তাঁর লেখাপত্রে প্রকাশ্য ইসলামোফোবিয়া ফুটে ওঠা নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চুপ। অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতকের প্রাচ্যবাদী ধারণা নিষিক্ত টডের মানসিকতায় ইসলামোফোবিয়ার জারন এবং কীভাবে সেটা এনালস রচনাকে প্রভাবিত করেছে সে বিশ্লেষণ প্রায় কোনো আলোচনাতেই উঠে আসে নি। টডের ইসলামোফোবিক মানসিকতার বিপুল প্রভাব পড়েছে এনালসে – সেটা আমরা এই প্রবন্ধে দেখাব। টডের রাণা প্রতাপ চরিত্র চিত্রণ নিয়ে কাজ করেছেন রেণু বহুগুণা, জেমস টডস পোট্রেয়াল অব দ্য লাইফ এন্ড ডিডস অব রাণা প্রতাপ – আ ক্রিটিক্যাল এক্সামিনেশন প্রবন্ধে। টড বিশ্লেষণে আমরা অনুসরণ করব রেণু বহুগুণার কাজটিকে।

আমরা জানি কর্নেল টড, মেওয়ার এবং রাজস্থানের অন্যান্য অঞ্চলের বৃহত্তর ইতিহাস রচনায় এনালস বইটিতে শুধুই রাণা প্রতাপের জন্যে বরাদ্দ করেছেন ২২ পাতা।  তাঁর আলোচনা ভিত্তি হল সে সময়ের শিশোদিয়া রাজপুতদের ভাটেদের গীতি কবিতা এবং শিশোদিয়া সমাজে প্রচলিত গান গল্পে তৈরি রাণা প্রতাপের চরিত্র চিত্রণ। রাণা প্রতাপের চরিত্র উপস্থাপন করতে উল্লিখিত গল্পগুলোকে টড এনেকডোট চরিত্রের বললেও, আমরা আজকে যাকে রাজপুত বীরত্ব শৌর্যের মূল্যবোধের রেণু হিসেবে জানি, সেগুলোকে তিনি নিজের হাতে আলাদা আলাদা করে রাণা প্রতাপের জীবনে জুড়ে, রাণাকে শৌর্যমণ্ডিত করে পাঠকদের কাছে উপস্থাপনা করেন — প্রতাপের রাজকীয় লাক্সারি ছেড়ে নিজের সম্মান রক্ষায় জঙ্গলে বাস করা, বাবা উদয় সিংহের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব-বিবাদ এবং পিতামহ রাণা সঙ্গের স্তুতি, রাণা প্রতাপের পোড়া মাটির নীতি বাস্তবায়ন, কাছোয়াদের রাজা মান সিংহ আর তাদের কন্যাদের মুঘল শাহী পরিবারে বিয়ে দেওয়ায় সেই অপবিত্র সমাজের সঙ্গে এক পাতে খাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা, হলদিঘাটি যুদ্ধে হেরে পালাবার পথে প্রতাপকে ছোট ভাই শক্তি সিংহের সাহায্যের হাত বাড়ানো, আকবর, রাণা প্রতাপকে ধ্বংস করার চেষ্টা করলেও খারাপ অবস্থায় থেকেও আকবরের প্রতি প্রতাপের মহানুভবতার প্রকাশ, মেওয়ারের পাহাড় জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াবার সময় তার পরিবারের দুঃখ কষ্ট সহ্য না করতে পেরে শেষ পর্যন্ত আকবরের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার সিদ্ধান্ত, আকবরের সভাকবি পৃথ্বীরাজ রাঠোড়ের প্রতাপের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে রাজপুত বীরত্বের মূল্যবোধ পালন করার অনুরোধ এবং শেষে প্রতাপকে সেনা বাহিনী গড়ে তোলার জন্যে ভামা শাহের সম্পদ দান।

টড যে রাণা প্রতাপের জীবন সংগ্রাম তাঁর এনালসে তুলে ধরেছেন, সেটা শুধুই উনবিংশ শতকের প্রথম পাদে মেওয়ারের রাজপুতদের ভাটদের গানেরই বিষয় ছিল না— আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের তৈরি জাতি, ধর্ম, স্বাধীনতার ধারণাকে উপনিবেশ-পূর্ব সময়ের রাজপুতদের বংশগত মহত্ব, গর্বের ধারণা, গোষ্ঠীর থাকবন্দীত্ব, অঞ্চল ও পদাধিকারের ব্যবস্থাপনা, আন্তঃ-বংশীয় সম্পর্ক রক্ষার তরিকা ইত্যাদির সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে উপস্থাপনেরও উদ্যম হিসেবে গণ্য করতে হবে। টড এনালসে ইংরেজি শিক্ষিত পাঠকের হাতে যে রাজস্থানের ছবি উপস্থাপন করেন, তার সঙ্গে রাজস্থানেরই ভাট সম্প্রদায় যে আঙ্গিকে গীতি কবিতা রাজস্থানী শ্রোতার সামনে উপস্থাপন করতেন – সেই দুটির চরিত্র আমূল ভিন্ন।

রাজপুতদের বিষয়ে টডের দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাণা প্রতাপ, শিশোদিয়া রাজপরিবার এবং গোষ্ঠী বিষয়ে তাঁর পক্ষপাতিত্বর ধারণাটা বুঝতে আমাদের সে যুগের দুটো অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকা কিন্তু পরস্পরের থেকে আলাদা প্রবণতা বিষয়ে নজর দিতে হবে – ১] আধুনিক ইওরোপের পণ্ডিতদের কল্পনা এবং বিশ্বাসের অভিব্যক্তি হিসাবে আধুনিক প্রাচ্যবাদের বাড়বাড়ন্তের সময়টি এবং সেই সেই একই প্রাচ্যবাদ ব্যবহার করে এশিয়া আর আফ্রিকায় উপনিবেশ অবদমিত রাখতে পশ্চিমি ক্ষমতাতন্ত্রের বিতর্কের তরিকা আর সে বিষয়ে প্রথাগত জ্ঞানচর্চার ধারা এবং ২]  ঔপনিবেশিক শাসন আমলে রাজপুত রাজ্য আর উপরাজ্যগুলিকে উপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামোয় অধীনস্থ করানোর ব্রিটিশ প্রচেষ্টা।

আকবর ও রাণা প্রতাপ

এডওয়ার্ড সঈদ বলছেন, প্রাচ্যবাদ হল প্রাচ্যের সংগঠন, ভাষা, জ্ঞানচর্চা, কল্পনা, মতবাদ, এমন কী উপনিবেশিক আমলাতন্ত্র এবং উপনিবেশিক আঙ্গিক নিয়ে আলোচনার তরিকা। অধিকাংশ সময়ে আধুনিক প্রাচ্যের বহু প্রাচ্যবাদী গবেষক জেনে, না জেনে প্রাচ্যবাদ অবলম্বন করে প্রাচ্যকে অবদমিত করার পশ্চিমি প্রচেষ্টার সঙ্গী হন। প্রাচ্যবাদ  আদতে প্রাচ্যের উপর আধিপত্য করা, উপনিবেশিতদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করা এবং একই সঙ্গে তাদের ওপর কর্তৃত্ব করার আদর্শ হিসেবে উদ্ভব হয়েছে। প্রাচ্যবাদ হল পূর্বকে পশ্চিমের কুক্ষিগত করে অবদমিত করার হাতিয়ার। প্রাচ্যবাদ প্রাচ্যের নিজস্ব দৃষ্টিতে প্রাচ্যকে দেখার চেষ্টা করে না, বরং প্রাচ্যের বাস্তবতার বাইরে, পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী জাতিরাষ্ট্রীয় ধ্যানধারণা আর নির্মাণের ওপর দাঁড়িয়ে প্রাচ্যকে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। প্রাচ্যবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ ইসলামবিদ্বেষ। অষ্টাদশ শতকে পশ্চিমের এনলাইটেনমেন্টের[নবজাগরণের] যুগটি (যে এনলাইটেনমেন্টের ধারণা টডের মনে স্থায়ী আসন নেবে) প্রাচ্যবাদ নির্ভর করে ইসলামবিদ্বেষ আরও স্থায়ী হবে এবং তাকে নবতপম ব্যপ্তি প্রদান করবে। প্রাচ্যবাদীরা ইসলামে মুসলমান নামের ঠিকঠাক উচ্চারণ না করে মহামেডানিজম তত্ত্ব বিকশিত করে নতুন ধরণের নাম ব্যবহার করল। আমরা প্রাচ্যবাদ, বিশেষ করে তার ইসলামদ্বেষ নিয়ে ছোট করে যে আলোচনা করলাম, তাকে ব্যবহার করে আমরা টডের এনালসে উল্লিখিত রাণা প্রতাপের চরিত্র এবং তাঁর মুঘল বিরোধিতার অবশ্যম্ভাবী প্রাচ্যবাদী বায়াসটিকে নির্ণয় করতে পারব।

১৯২০’র এনালস সংস্করণের মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে উইলিয়াম ক্রুক আমাদের জানাচ্ছেন টডের ভারতীয় ইতিহাস, জাতিতত্ত্ব, ধর্ম এবং কুসংস্কার নিয়ে উৎসাহ তৈরি হয়েছিল উইলিয়াম জোনসের মতো প্রাচ্যবাদী তাত্ত্বিকের কাজকর্ম অনুসরণে। এনালস লেখা শেষ করে টড প্রাচ্যবাদী সংগঠন এবং প্রাচ্যবাদের ঘাঁটি রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করবেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলা থাকবন্দীত্বে দীর্ঘ চব্বিশ বছর কাজ করেছেন। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে রাজস্থানে। তিনি ১৮২২-এ ভারত ছাড়বেন। ১৮১৮ থেকে ১৮২২ এই সময়কালের মধ্যে রাজপুতানা রাজ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে তৈরি কোম্পানির আমলাপদ পলিটিক্যাল এজেন্ট বা রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে রাজপুতানার পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রক হিসেবেও উপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন। কোম্পানির কাছে রাজস্থান যখন প্রায় অপরিচিত ভূখণ্ড, সে সময় সার্ভেয়ার হিসেবে রাজস্থানের রাজ্যগুলোর ওপর কোম্পানির আধিপত্য তৈরির কাজ করেছেন টড। টডের সারাজীবনের গবেষণার কাজ হিসেবে এনালসকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, এনালস হল ইতিহাস, ভূগোল, রাজনৈতিক অর্থনীতি, জাতিতত্ত্ব, বংশলতিকা, মিথোলজি, লৌকিক গুজব, ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার বিষয়ে উদ্ভুত ককটেল যা তিনি অযাচিতভাবে সরকারকে উপহার দেন।

টডের এনালস আদতে প্রাচ্যের (এখানে রাজস্থানের) প্রতিনিধিত্ব করার এবং প্রাচ্যের ওপর খবরদারি করার দাবিদার হিসেবে পশ্চিমের প্রাচ্যবাদী অবস্থানের যৌক্তিকতাকে জোরদার প্রাচ্যবাদী যুক্তি দিয়ে সাজায়। যখন বলা হয় এনালস হল ‘রাজপুতানা এবং রাজপুত বিষয়ে প্রায় সব কিছুরই অনানুষ্ঠানিক কিন্তু নির্দেশমূলক (unofficial but authoritative) ব্রিটিশ গাইডবুক’ তখন আমাদের কাছে এ৪ই প্রচেষ্টার অনেক উদ্দেশই পরিষ্কার না হয়ে যায় না। ভারতবর্ষ শাসন করা ব্রিটিশেরা জানত জ্ঞানই ক্ষমতা রাখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। রাজপুত এবং রাজপুরত সমাজ বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান উপনিবেশিক সরকারকে সরবরাহ করার গুরুত্বপুর্ণ মাধ্যম হল উপনিবেশিক আমলা টডের উদ্যমে তৈরি এনালস গ্রন্থটা। আধুনিক প্রাচ্যবিদ্যার অন্যতম কাঠামো পুরুষতন্ত্র অবলম্বন করে টড রাজপুত চরিত্র চিত্রণ করলেন। ‘বহুকালের নিপীড়িত জাতি’ রাজপুতদের জন্যে তিনি ব্রিটিশ রাজার পিতৃত্বসুলভ হস্তক্ষেপ দাবি করেন কারণ তিনি মনে করেন ‘জনগণের প্রতিভা বিকাশে পিতৃত্ববাদী কাঠামোই একমাত্র অবলম্বন’।

মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইসলাম এবং মুসলমান শাসনকে কোনো রাখঢাক না রেখে প্রাচ্যবাদের আদলে এনালসে বারবার নিন্দা করেছেন। মুসলমান বোঝাতে তিনি মহামেডান এবং ইসলামের প্রতিশব্দ হিসেবে মহামেডানিজম-এর মত কটূ শব্দ ব্যবহার করলেন। তিনি ‘মহামেডানদের আগ্রাসনে হেরে যাওয়া’ হিন্দুদের কথা বার বার উল্লেখ করে ‘চেঙ্গিজ খানের জন্যে মহামেডানেরা ঘৃণিত হয়েছেন’— এ সব আলোচনাও তাঁর বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন। বহিরাগত মুঘলদের হাতে দীর্ঘকাল ধরে নিপীড়িত রাজপুতদের প্রতি সহানুভূতি জাগানোর অবলম্বনই হল এনালস। নবী মহম্মদ যে স্নেহের উপহার হিসেবে ভাইপোর মুখে থুথু দিয়েছেন সেটিও এনালসে উল্লেখ করেছেন। মধ্যযুগের আকবর বা অন্যান্য শাসককে তৎকালীন সময়ের ঘৃণিত নবজাগরণী, শব্দ তাতার নামে উল্লেখ করেন টড। টডের আকবর হলেন চতুর কৌশলী আর অমেয় স্বেচ্ছাচারী। মুঘল দরবারের ঐতিহাসিকেরা টডের ভাবনায় শুধুই মুসলমান পক্ষীয় ঐতিহাসিক। টড জানিয়ে দিলেন লম্পট মুঘল সম্রাটেরা নওরোজ উৎসব উপলক্ষ্যে রাজপুত মহিলাদের অসম্মান করতেন। দিল্লির তাতার শাসকদের বাড়িতে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে অসম্মানিত হওয়ার হাজারো গল্প এনালসে উল্লেখ করেছেন তিনি। তার মতে, ‘এই দূষিত প্রথা’ রাজপুতদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেছে এবং রাণা প্রতাপ এই সব পতিত রাজপুতদের রীতিনীতি বর্জন করে ঘৃণিত প্রথায় লিপ্ত রাজপুতদের সঙ্গে ত্যাগ করেন। আমলা টড মধ্যযুগের ভারতবর্ষীয় মুসলমান শাসকদের বস্তাপচা ভাবমূর্তি নির্মান করে তাতার বা তুর্ক নামে অভিহিত করে, তাদের আক্রমণকারী, বিজয়ী দাগিয়ে দেন। একই সঙ্গে বলে দেন মুঘলদের কৃষ্টি রাজপুতদের বিকশিত কৃষ্টির তুলনায় অতি নিকৃষ্টমানের। হিন্দুত্ব বা ইসলামকে দুটি আলাদা ধর্মীয় বিশ্বাস হিসেবে গণ্য না করে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে নামা আলাদা জাতি, রাষ্ট্র এবং সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করার প্রথম যুগের উপনিবেশিক লেখক।

প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে তিনি ইংরেজি শিক্ষিত পাঠাকদের কাছে রাজপুতদের এক্সটিক জাতি হিসেবে তুলে ধরেন। দুর্দান্ত উৎসাহে তিনি রাজপুতদের বীরত্ব এবং রোম্যান্সের গল্পগাছা বর্ণনা করেন। তাঁর এই উদ্যম স্পষ্ট হয়ে যায় এনালসে রাণা প্রতাপ খণ্ডের মুখড়ায়। তিনি লিখছেন,

ওপরের বয়ানটি এক ঐতিহাসিক চরিত্রের ওপর মনের মাধুরী মিশিয়ে তুলে ধরার আয়োজনের অত্যুৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। টড, রাণা প্রতাপে সিংহাসনে আরোহণপর্বকে তাঁর মত করে রাঙিয়ে এবং রাণার গুণগুলোকে নাটুকে আকারে উপস্থাপন করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।  রানা প্রতাপকে কীভাবে তার প্রজারা মনে রেখেছেন, সে তথ্য বয়ান করেন বাস্তবকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে।

টড, রাণা প্রতাপের পর্বটা এমণ নায়োকোচিতভাবে শেষ করছেন, যাতে ইংরেজি শিক্ষিত পাঠকদের মনে তাঁর শিশোদিয়া নায়কের প্রতি আলাদা সহানুভূতি জাগরিত হয়। রানার গুণ বর্ণনার পরে, পাঠকদের তাঁর শিশোদিয়া নায়কের গুণ আরও ভালভাবে বোঝানোর জন্যে তিনি উপমা জুড়লেন,

Undaunted heroism, inflexible fortitude, that which ‘keeps honour bright’, perseverance, – with fidelity such as no nation can boast, were the materials opposed to a soaring ambition, commanding talents, unlimited means, and the fervour or religious zeal; all, however, insufficient to contend with one unconquerable mind. There is not a pass in the alpine Aravalli that is not sanctified by some deed of Pratap — some brilliant victory or, oftener, more glorious defeat. Haldighati is the Thermopylae of Mewar; the field of Dawer her Marathon.

এই উদ্ধৃতি থেকে দিল্লির ‘তাতার’ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা রাজপুতদের প্রতি টডের পরিষ্কার সহানুভূতি লক্ষ্য না করে পারি না। শুধু রাণা প্রতাপের শৌর্যই নয় অন্যান্য রাজপুত নায়ক সম্বন্ধে টড তথ্য নিয়েছেন মূলত ভাটেদের বর্ণনা সূত্রে, কিন্তু টডের লেখায় ভাটেদের বর্ণনাই শেষ কথা ছিল না, সেই গপ্পগুলোর ওপরে তিনি কয়েক পোঁচ প্রাচ্যবাদের রঙ চড়িয়েছেন, সঙ্গে জুড়েছে তাঁর অসাধারণ আখ্যান শৈলী, এ-সব মিলে ভাটেদের গল্পগুলি ঐতিহাসিক সত্যতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং এবং তাতে বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যের অনপনেয় ছাপ পড়েছে। নবজাগরণ-উত্তর সময়ে রাজপুতদের বর্ণনায় টড আধুনিক জাতি, রাষ্ট্র আর ধর্মের ধারণা ব্যবহার করে এনালসকে আরও বৃহত্তর পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেবেন। ভাটেদের আখ্যান ইংরেজিতে অনুদিত হয়ে রাজপুত বা রাজস্থানের সার্বিক বাস্তবতা বিষয়ে অজ্ঞ পাঠকদের কাছে সম্পূর্ণ আলাদা কৃষ্টি পণ্যে রূপান্তরিত হল। রাজপুতদের চরিত্র চিত্রণে টডের এই ধারণা প্রয়োগের বিষয়টি ভাটেদের শুধু নয় রাজপুতদেরও অজানা ছিল।

টডের রাজপুত এবং রাণা প্রতাপকে উপস্থাপন করার তরিকা উপনিবেশিক, জাতীয়তাবাদী এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো ক্রমশ তীব্র বেগে বুক ফুলিয়ে আত্মসাৎ করতে থাকে। টডের ভাষায় রাজপুতেরা ‘প্রাচীন এবং আকর্ষণীয় জাত’ এবং রাণা প্রতাপ তাঁর ‘জাতির মহত্ব গুণাবলীর একমাত্র পাত্র’। রাণাই একমাত্র ‘তাঁর জাতির মধ্যে মহৎ’প্রাণ। রাণা প্রতাপের আত্মা ‘তার জাতির গৌরব মোচনের জন্য প্রজ্বলিত’।  টড মনে করতেন, তার সমসাময়িক রাজপুতদের ‘দেশপ্রেমিক’ প্রতাপের প্রশংসা, যোদ্ধা রাজপুতদের জাতিরাষ্ট্রবাদী উদ্যমে উদ্বুদ্ধ করে এবং এই সময় প্রত্যেক রাজপুতের দৃষ্টি আকবরের বিরুদ্ধে চলতে থাকা রাণা প্রতাপের দ্বন্দ্বেঈ শুধু নিবদ্ধ ছিল। পলাতক হুমায়ুনের সঙ্গে মারওয়ারের শাসক মালদেওর অসদাচরণকে তিনি রাজপুতদের অজাতীয়তাবাদী ব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত করলেন। অন্য বেশ কিছু প্রসঙ্গে তিনি রাজপুতদের বিরুদ্ধে ‘জাতীয়তাবাদী দম্ভ’ বজায় না রাখতে পারা, তাদের ‘জাতীয় গৌরব এবং স্বাধীনতা’ ঊর্ধ্বে ধরতে না পারার অভিযোগ এনেছেন। আমরা দেখলাম টড জাতি, রাষ্ট্র ইত্যাদির আধুনিক ধারণা নিয়ে মধ্যযুগের যে রাজপুত ইতিহাস বর্ণনা করেছেন, সেটা আদতে তার মনে গেঁথে থাকা প্রাচ্যবাদী প্রভাবের ফল।

এখানে আমি একটু প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে শুধু উল্লেখ করে যাব কীভাবে প্রাচ্যবাদী বয়ান প্রবাহিত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কর্নেল টড থেকে যদুনাথ সরকার হয়ে বহু হিন্দুবাদীই নয়, এমনকী প্রগতিশীল ধারাতেও। আমরা দেখি টড রীতিমত জীবিত হয়ে ওঠেন একশ বছর পরের উপনিবেশিক ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের হিস্ট্রি অব আওরঙ্গজেব-এর খণ্ডগুলোয়। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে টডের এই উপনিবেশিক প্রাচ্যবাদী নির্মাণটিকে আরও কয়েক পোঁচ রঙ চড়িয়ে উপস্থাপন করবেন। মুঘল সিংহাসনের লড়াই-এর প্রথম যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে দারার হয়ে যুদ্ধ করতে আসা প্রধান সেনাপতি যশোবন্ত সিংহের হেরে রণক্ষেত্র ছেড়ে পালানো বীরের জাত রাজপুত চরিত্র বিরোধী হিসেবে দাগিয়ে দেন যদুনাথ। টড আর ভাটেদের সূত্র উল্লেখ করে যদুনাথ জানিয়ে দেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিঠ দেখিয়ে পালানো যশবন্তকে না কী রাজস্থানীরা মুখ দেখে নি, উপরন্তু তার স্ত্রী তাঁকে কাপুরুষতার জন্যে তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দেন নি, এমনকি তাঁর মৃত্যুই নাকী কামনা করেছেন। অথচ যদুনাথের পাটনায় অধ্যাপনার সহকর্মী কালিকারঞ্জন কানুনগোও যে কম প্রাচ্যবাদী ঐতিহাসিক ছিলেন না তার রেশ কিছুটা দারার জীবনীগ্রন্থে পাই। তিনি কিন্তু যশবন্ত নিয়ে যদুনাথের এই প্রাচ্যবাদী বয়ান খারিজ করেন। এই লেখকের সদ্য প্রকাশিত ‘আওরঙ্গজেব ভ্রম নিরসন’ বইতে লিখেছি ‘তৃতীয় মুঘল সিংহাসনের লড়াইয়ের প্রথমটি ধারামতের যুদ্ধ। এখানে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে লড়ে, হেরে দারার সেনাপতি যশোবন্ত সিংহ যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে আসেন। যদিও যদুনাথ সরকার আওরঙ্গওজেবের ইতিহাস লিখতে গিয়ে দাবি করছেন, যুদ্ধ শেষে যশোবন্তের আর খোঁজ পাওয়া যায় নি, কিন্তু রাজস্থানের ইতিহাস বলে, যশোবন্তের ইতিহাস এখানেই শেষ হবে না আরও অনেকদূর যাবে। নিউ লাইট অন দ্য ব্যাটল অফ ধারামাত প্রবন্ধে করুণা যোশী বলছেন যশোবন্ত যুদ্ধ শেষে শাহী দরবারে পৌঁছান এবং সেখানে দারা, সম্রাট শাহজাহান হেরো সেনাপতিকে ৭০০০ মনসবে বরণ করে নেন। টডের লেখা যশোবন্তের মিথ ভেঙে কালিকারঞ্জন কানুনগো শাহজাদা দারাশুকোতে লিখছেন, ‘মহারাজা যশোবন্ত তাঁহার হতাবশিষ্ট সামন্তবর্গের সহিত যোধপুর ফিরিয়া আসিলেন। অতঃপর তাঁহার কী দশা হইল? যশোবন্ত যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিয়াছেন এই কথা যোধপুর দূরে থাকুক হিন্দুস্তানে কেহ সহজে বিশ্বাস করিতে পারে নাই। এই ঘটনা অবলম্বন করিয়া মুখে মুখে বিবিধ জনরব আগরার বাজার পর্যন্ত ছড়াইয়াছিল, সমসাময়িক বেসরকারি বৃত্তান্তে উহা ইতিহাসের স্থান দখল করিয়াছে; অথচ এইরূপ কোনও কাহিনীর কোনও অস্তিত্ব এবং ঐতিহাসিকতা রাজস্থানের আধুনিক খ্যাতনামা ঐতিহাসিকগণ (গৌরীশঙ্কর ওঝা-কৃত যোধপুর রাজ্যকা ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ৪৩৫, পাদটীকা দ্রষ্টব্য) স্বীকার করেন না। ধর্মাতের যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত কোনও শিশোদিয়া রাজকুমারীকে যশোবন্ত বিবাহই করেন নাই; তিনি সমসাময়িক মহারাণা রাজসিংহের ভায়রাভাই, বুন্দীরাজ ছত্রশাল হাড়ার জামাতা, যশোবন্তের শাশুড়ি শিশোদিয়া বংশজাতা ছিলেন। এক শিলালিপিতে পাওয়া গিয়াছে বুন্দীরাজ ছত্রশাল হাড়া দেবলিয়ার শিশোদিয়ার রাবত সিনহা-র রাজকুমারী নামক কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। এই স্ত্রীর গর্ভজাত কন্যা করমেতা বাঈর সঙ্গে যশোবন্তের বিবাহ হইয়াছিল। … টড সাহেবের ইতিহাসে শিশোদিয়া রানি কর্তৃক যোধপুর দুর্গে যশবন্তের প্রবেশ নিষেধ; কন্যাকে বুঝাইবার জন্যে মেবার হইতে মাতার আগমন ইত্যাদি কাহিনীর পুনরুল্লেখ অন্তত বাংলাদেশে নিষ্প্রয়োজন’।  

ফিরি মূল আলোচনায়। প্রাচ্যবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে টডের প্রাথমিক প্রকল্প ছিল তাঁর এনালসের মাধ্যমে ইওরোপিয় শিক্ষিতজনের কাছে ইওরোপিয়দের ইতিহাস চেতনা, ইওরোপিয় ইতিহাসের চেনা ঘটনাবলী, ইওরোপিয় চরিত্র এবং ইওরোপিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রেক্ষিতকে মিলিয়ে মিশিয়ে রাজস্থানি, রাজপুতদের ইতিহাস উপস্থিত করা। তাই ইওরোপিয় ইতিহাসের সঙ্গে রাজস্থানের ইতিহাসে ঘন-ঘন মিল খুঁজেছেন তিনি, টেনেছেন উপযুক্ত যৌথ উপমাও। বুকের মধ্যে প্রাচ্যবাদের তত্ত্ব ধারণ করা সাম্রাজ্যের তাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পাঠকের সামনে ইসলাম বিষয়ে প্রাচ্যবাদপ্রসূত নেতিবাচক ছবি উপস্থাপন করা। এডওয়ার্ড সঈদ প্রাচ্যবাদ বিশ্লেষণ এবং সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, ইওরোপিয়দের জীবনে ইসলাম ছিল এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত এবং আধুনিক পূর্ব সময়ে অটোমান তুর্কি বা তাতারদের (তুর্কি) ইওরোপিয় সভ্যতার সামনে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা ইওরোপিয় জনজীবনের টানাপড়েনের সঙ্গে গভীরভাবে বুনে গিয়েছিল। টড এনালসে ইওরোপিয় ইসলামোফোবিয়া ধার করে মুঘলদের তাতার বা তুর্কি দুর্ণামে অভিহিত করলেন। তিনি যেন নিজেকে বাধ্য করেছেন রাজপুত ইতিহাসের সঙ্গে ইওরোপিয় ইতিহাসের তুলনা টানার অবসেসনে বাস করতে। আধুনিক প্রাচ্যবাদী ইওরোপিয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য মন্তেস্কু, হিউম, মিলার বা গিবন তাঁর আদর্শ এবং আশ্রয় হয়ে ওঠেন। তিনি প্রাচীন যোদ্ধা জাতি ইয়োরোপীয়দের উদ্ভবকে, যোদ্ধা রাজপুতদের উদ্ভবের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। রাণা প্রতাপের সঙ্গে মুঘলদের দ্বন্দ্বকে তুলনা করলেন ইওরোপিয় ইতিহাসের ঘটনাবলীর সঙ্গে। প্রতাপের মৃত্যুকে তিনি তুলনা করলেন দেশের স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া কার্থাজিনিয়ানদের সঙ্গে। রাণা প্রতাপের দেশে মুঘলদের আবির্ভূত হওয়াকে তিনি তুলনা করলেন গ্রিসে বর্বর পারসিক হামলার সঙ্গে। টড বিশ্বাস করেন হলদিঘাটি হল মেওয়ারের থারমোপাইলি আর দাওয়ার মারাঠা যুদ্ধক্ষেত্র। ইওরোপিয় ইতিহাসের সঙ্গে রাজপুত ইতিহাসের মিল দেখিয়ে টড মনে করেন ইওরপিয় সামন্তবাদ আর ভারতীয় সামন্তবাদ অভিন্ন, অনেক কাছাকাছি — যে ধারণাটি আমরা পরের সময় বহু বামপন্থী, প্রগতিশীল ইতিহাসে অবিকৃতভাবে আত্মীকৃত হতে দেখব।

এনালস প্রাচ্যবাদী টেক্সট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালীও। কিন্তু টড তো শুধু প্রাচ্যবাদী তাত্ত্বিক নন, কোম্পানির উচ্চপদাধিকারিকও বটে – তত্ত্বের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বাস্তবে প্রয়োগও করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে তাঁর প্রধান কাজ ছিল সক্রিয়ভাবে রাজপুতানা রাজ্যগুলোয় ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন বিস্তৃতি এবং ব্রিটিশ উপনিবেশিক থাকবন্দী রক্ষা করা। প্রাচ্যবাদী কুসংস্কারগুলো ব্যবহার করে উপনিবেশিক শাসন বিস্তারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার ধ্রুপদী নিদর্শন হয়ে থাকবে টডের এনালস। টড উনবিংশ শতকের প্রথম পাদের রাজপুতানা রাজ্যকে, ততদিনে বিলয় হয়ে যাওয়া মুঘল রাষ্ট্রের ভিক্টিম হিসেবে তুলে ধরলেন, এবং একই সঙ্গে তিনি মারাঠাদের হিংস্র লোভী আক্রমণকারী হিসেবেও চিহ্নিত করে বললেন, তাদের লুঠের জন্যেই আজকের রাজপুতানা গরীব হয়েছে— যদিও এই বয়ানটা পরবর্তী জাতিয়তাবাদীরা প্রত্যাখ্যান করে ৪ লক্ষ বাঙালির হত্যাকারীদের স্তুতিতে মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত লিখতে হাত কাঁপবে না চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধেপ্রাপ্ত জমিদার আইসিএস রমেশচন্দ্র দত্তের। তিনি মারাঠাদের মুঘলদের থেকেও খারাপ আক্রমণকারী এবং রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার আখ্যা দিয়ে বললেন, তারা মুঘলদের থেকেও সক্রিয়ভাবে রাজপুতানাকে শোষণ করেছে। রাজপুত রাজ্যগুলোর হালত ফেরানোর দাওয়াই দিলেন কোম্পানি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। উপনিবেশবাদী মানসিকতায় বললেন রাজপুতেরা ব্রিটিশ সরকারকে ‘সাচ্চা রাজ’ হিসেবে গণ্য করে। রাজপুতানায় ব্রিটিশ রাজত্বের হস্তক্ষেপকে সক্রিয় সমর্থন করে তিনি বললেন, রাজপুতেরা বরাবরই সিংহাসনের অর্থাৎ রাজার অনুগামী। তাই রাজার নেতৃত্বে ভারত শাসন করা ব্রিটিশ কোম্পানিই একমাত্র রাজপুতদের বহিরাগত মারাঠা আর মুঘল শোষণের প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে মুক্তি দেবে। প্রতাপ এবং অন্যান্য রাজপুত গোষ্ঠীপতিকে সহানুভূতির আখরে উপস্থাপন করার প্রাথমিক উদ্দেশ্যই হল রাজপুতদের অঞ্চলে ব্রিটিশ রাজের বিস্তৃতি এবং ব্রিটিশদের বহিরাগত এবং উপনিবেশিক চেহারা লুকিয়ে তাদের সামগ্রিকভাবে রাজপুতানার উদ্ধারকারী হিসেবে উপস্থাপন করা।

এনালস শুধু উপনিবেশিক বা প্রাচ্যবাদী চরিত্রের আখ্যানই নয়, ইতিহাস হিসেবেও এর যখেষ্ট খামতি লক্ষ্য করি। আমরা যদি টডের হাতে তৈরি রাণা প্রতাপের জীবন আলেখ্য লক্ষ্য করি, তাহলে এই খামতিগুলো এতই সমস্যাজনক হয়ে ওঠে যে এগুলোকে ইগনোর করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এনালস সম্পাদনা করা উইলিয়াম ক্রুক মুখবন্ধতে বলছেন টড রাজপুতদের দুর্বলতাগুলো হয় অগ্রাহ্য করেছেন, না হয় গুরুত্ব দেন নি। হলদিঘাটির পরাজয়ের মত তাদেরর অধিকাংশ পরাজয় যাতে পাঠকদের সহানুভূতি উদ্রেক করে সেই চেষ্টা টডের ছিল। ঐতিহাসিক বাস্তবতাগুলো লুকোতে তিনি সাহিত্য ঘোমটার আশ্রয় নেন।

ভাট গল্পগাথার ওপর অত্যধিক এবং সমালোচনাবিহীন নির্ভরতার জন্যে এনালসে বহু তথ্যের খামতি হয়েছে। তিনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তার সঙ্গে বইতে ব্যবহৃত তথ্যের সাযুজ্য থাকে না। মহম্মদ হাবিব বলছেন, টড মুঘলদের বিষয়ে পারসিক ইতিহাসের সাহায্যই গ্রহণ করেন নি এবং বহু সময় তাঁর উপস্থাপিত যুক্তির প্রবাহ পাঠকের বুদ্ধিমত্তাকে উপহাস করে। তিনি মনে করেন শাহজাদা সেলিম, পরে জাহাঙ্গীর ১৫৭৬এর হলদিঘাটির যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন এবং মুঘল অভিজাত মহাবত খান সাগরজী, রাণা প্রতাপের ছোট ভায়ের ধর্মত্যাগী সন্তান। টড রাজপুতানায় ব্রিটিশ রাজত্ব বিস্তারের এতই উৎসুক ছিলেন যে তিনি মেওয়ার আর মারওয়াড়ের পাশে দাঁড়িয়ে জয়পুরের কাছোয়াদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন কারণ তারা ব্রিটিশ উপনিবেশের সামিল হতে বেশ কিছু দিন দোনোমনা করছিল। কাছোয়াদের প্রতি টডের বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে হলদিঘাটি যুদ্ধে প্রতাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সেনাপতি মানসিংহের চরিত্র চিত্রণে।

পরের প্রজন্মের বহু উপনিবেশিক ঐতিহাসিক টডের কাজে ভুল আবিষ্কার করলেও, অধিকাংশই তাঁর প্রাচ্যবাদী মানসিকতা এবং উপনিবেশিক কুসংস্কারকে বিনা বাক্যব্যয়ে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ভিনসেন্ট স্মিথ ১৯১৭য় প্রকাশিত আকবর দ্য গ্রেট মোগুল (Mogul) বইতে টডের ব্যবহৃত তথ্যের নানান ভুল চিহ্নিত করেছেন এবং তাঁর দৃঢ়তাকে ভুল আখ্যা দিয়েছেন। এতদ সত্ত্বেও ভিনসেন্ট স্মিথ এনালসের পিঠ চাপড়ে লেখেন রাজপুতদের মৌখিক পরম্পরাকে টড বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থিত করেছেন। স্মিথ বা অন্যান্য উপনিবেশিক ঐতিহাসিক তাঁর প্রাচ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী মানসিকতাকে প্রশ্ন করেন না। বরং আকবর, রাণা প্রতাপের দ্বন্দ্বের বিবরণ তিনি এনালস থেকেই অবলীলায় আত্মস্যাত করেন। টডের প্রাচ্যবাদী মানসিকতাকে প্রশ্ন না করে লেখেন, রাণা প্রতাপ সিদ্ধান্ত নিলেন যে বিদেশীর রক্তের সাথে মিশে তিনি নিজের রক্ত ​​দূষিত হতে দেবেন না এবং তাঁর মাতৃভূমি স্বাধীন মানুষদেরই বিচরণের জন্যে উন্মুক্ত থাকবে। বহু লড়াইয়ের পরে তিনি সফল হলেন এবং আকবর ব্যর্থ হলেন।

Resolved that his blood should never be contaminated by intermixture with that of the foreigner, and that his country should remain a land of freemen. After much tribulation he succeeded, and Akbar failed.

রাণা প্রতাপ বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত, তাঁর পরাজয়, বিজয়ীর থেকেও মহত্তর-

Vanquished, it may be, were greater than the victor.

১৯২০’র এনালস]-এর মুখবন্ধে উইলিয়াম ক্রুক পারসিক সূত্রকে উহ্য করে যাওয়া এবং অন্যান্য সমস্যা নিয়ে টডের সমালোচনা করেছেন। টডের অনেক তথ্যভ্রান্তি নিয়ে তিনি বহু সংশোধনী উল্লেখ করেছেন। তাসত্ত্বেও ক্রুক কিন্তু টডের প্রাচ্যবাদী মানসিকতা ত্যাগ করতে পারেন নি। তিনি মনে করেন, মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান আক্রমণের জোয়ারে তাদের বহু প্রতিষ্ঠান, আচার-ব্যবহার, পড়াশোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই অদৃশ্য হয়ে গেছে।

Institutions and manners against the rising tide of Muhammadan invasions, without their protection much that is important for the study of the Hindus must have disappeared.

অন্য এক জায়গায় ক্রুক টডের অনুসরণে বলছেন, রাজপুত মেয়েদের বিরুদ্ধে আকবরের অশালীন আচরণ মুসলমান ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেন না কিন্তু সেটা ঘোর বাস্তব। বহু জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিকও টডের তাত্ত্বিক এজেন্ডা বিনা প্রশ্নে অনুসরণ করেন।

আজ যে সঙ্ঘের উদ্যোগে মুঘল ইতিহাসকে হয় বাতিল করা হচ্ছে বা নতুন করে প্রাচ্যবাদী বয়ানে লেখা হচ্ছে, সেই প্রবণতার শেকড় চিনতে আমাদের প্রাচ্যবাদী ইতিহাসকে ছিন্নভিন্ন করে বিশ্লেষিত করতে হবে, তবেই আমরা হয়ত এই অপইতিহাসের শেকড় ছিঁড়তে পারব। 

সূত্র

James Tod, Annals and Antiqiuties of Rajasthan
Norbert Peabody, Tod’s Rajasthan and the Boundaries Imperial Rule
Lloyd 1. Rudolph, ‘Producing and Reproducing Rajasthan: Why Col. Tod Represented Rajasthan the Way he did not and its consequences fot Imperial, Nationalist and Rajput Historiography’
Ramya Sreenivasan, The Many Lives of a Rajput Queen: Historical Pasts in Indiac. I 500-190a, c. I 500-190a
Edward W. Said, Orientalism
Mohammad Habib, Studies in the history of Rajasthan
V. A. Smith, Akbar the Great Mogul, 1542-1605
Renu Bahuguna, James Tod’s Portrayal of the Life and Deeds of Rana Pratap: A Critical Examination

বিশ্বেন্দু নন্দ
বিশ্বেন্দু নন্দ

লেখক, গবেষক, সংগঠক, প্রকাশক। উপনিবেশপূর্ব সময়ের সমাজ অর্থনীতিতে  কারিগরদের ইতিহাসের খোঁজে সর্বক্ষণের কর্মী। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন বিক্রেতাদের বিষয়ে লিখেছেন নিরন্তর। বাংলার উপনিবেশপূর্ব সময়ের পরম্পরার চাষী-হকার-কারিগর-ব্যবস্থা বিষয়ে খোঁজ করছেন। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। ‘পরম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব, ম্যান এন্ড দ্য মিথ, স্বেন বেকার্ট এম্পায়ার অব কটন, যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেসন, আহকমই আলমগিরি অনুবাদ করেছেন। পলাশীপূর্বের বাংলার ৫০ বছর, পলাশীপূর্বের বাংলার বাণিজ্য দুটি মৌলিক পুস্তকের রচয়িতা। 

Share