চৌষট্টি পাখুড়ি

।। সোহেল হাসান গালিব ।।

অয়ি চণ্ডি, তোমাকেই বাঞ্ছা করি—হরিতকী, জবা,
শালবনে নয়—জনারণ্যে। ডাকে ত্রাসপাখি ওই—
সর্বনাশপন্থি বাঁশিটির সুরে। দেখি ধ্যানভঙ্গ
রাত্রির নিশ্বাসে শঙ্খ-লাগা দুটি মেঘের চূড়ায়
আততায়ী জোছনার তির এসে বেঁধে। ঘুমহীন
এ চত্বরে গুম হয়ে থেমে যায় পথের বাতাস।
মুঠিতে লুণ্ঠিত হতে জ্বলে ওঠে প্রতিটি লন্ঠন;
ফুল-তোলা নারীটিও খোঁজে তার আঁচলে দস্যুতা।

চৌষট্টি পাখুড়ি

কতটা আকাশ প্রয়োজন বলো মানুষের, আর
কতটা মৃত্তিকা খুঁড়ে পিপাসার জল ওঠে তার
তীর্থগামী করপুটে—এই প্রশ্ন মনে রেখে তবু
একটি ভূখণ্ড শুধু পেয়ে, ভূমিপুত্রের উল্লাসে
আজও পৃথিবীকে বাসযোগ্য বলে মানি। একটিই
শ্যামাঙ্গীর স্মৃতি আমি গাই শ্যামা পাখিটির সুরে।
দূরের সৈকতে ঝাউবন-হাওয়া—ভাবি নি তাকেও
নীড়ের ভিড়ের থেকে একাকী ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
অথচ অনেক মেঘদূত অগণিত আষাঢ়ের
খবর এনেছে চুপে, মৌন আকাঙ্ক্ষার গিরিখাদে
এনেছে সম্মোহ ঘাসফুল তার ছোট্ট ইশারায়।
সে ইশারা নিরুত্তর রেখে জ্বেলে দেই একে একে
তুচ্ছতার দিনগুলি, ওই ম্লান ধুনীতে সঞ্চিত
আয়ুকণা। ধূপের রেখায় দেখি তারা সব মিলে
জাগিয়ে তুলেছে ধীরে একটি প্রতিমা। কে বসেছে
এই পদ্মাসনে, সেই প্রতিমা কি জানে? ইমনের
শান্ত ঈশিতায় মেঘগুলি ভেঙে পড়বার আগে
রাত্রির মুখশ্রী বাঁকা রামধনু দেখতে কি পায়?

আয়ুরেখা মুছে মুছে এতটা এসেছি। ভয়ে ভয়ে।
পুষ্প বা পাদুকা—কোনো চিহ্নই রাখি নি পিছে ফেলে।
সূর্যাস্ত কি ফেলে গেল কিছু—চুনসাদা বালুচরে?
মন্থর স্রোতের টানে থেমেছে ইঞ্জিন—যেন তারই
পূর্বাভাস পেয়ে। একে একে ভেসে যায় নৌকাগুলি
শেয়ালের ধর্ম জেগে ওঠা থমথম কাশবনে।
বাতাসে গুটিয়ে হাতা, গগনশিরীষ এল কবে
ছোট্ট জানালার পাশে! বিস্মৃতির মৃদু ঘ্রাণঝরা
সময় মোমের মূর্তি—জ্বলে ওঠে, তাই গলে যায়।
অঙ্গুলিহেলনে শুধু, এই ধূর্ত পৃথিবী এখন
কাছ থেকে নগ্নিকাই দেখে নেয়। দেখাতে কি পারে?
নির্বাক বাদুড় যতদূর ওড়ে—ছেয়ে ফ্যালে হিম
তমসায়। তমস্বিনী, কার হাত ধরে পার হব
এ রাত্রির গুহা—অমাময়ী মা আমার! ভয়ে ভয়ে
এখানে এসেছি। আয়ুরেখা মুছে মুছে। তাই আর
পুষ্প, পাদুকার কোনো চিহ্নই রাখি নি পিছে ফেলে।
পাথুরে চোয়াল ঠেলে, শুনতে পাই, এতদিন পর
গম্ভীর দেয়াল ডাকছে আমাকেই নাম ধরে—‘আয়’।

চুরাশি চুম্বনে ফোটা পাপড়িটিকে আজ পেয়ে যাই
গ্রন্থের ভিতর। সিদ্ধাচার্য আমি নই, নই সেই
পদকর্তা—একটি পদ্মের বুকে শিখি নি চৌষট্টি
পাখুড়ির নাচ। লিপ্সাহত এই জীবনের তুচ্ছ
ভণিতায় আমি জীবনপা, মৃত্যু-গোধূলির চর।
তুলোট পৃষ্ঠার ভাঁজে পড়ে থাকা ছেঁড়া পাপড়ি তাই
ছুঁয়ে দেখি। চটে গেছে রঙ তার, মিলিয়েছে গন্ধ,
শুয়ে আছে যেন এক ফুলের ফারাও, মমি হয়ে—
কত কীট আর কাঁটাবন তবু সে পেরিয়ে এল
স্তব্ধতার মুখে তুলে দিতে এক ফোঁটা সম্ভাষণ।

অনেক শব্দের ঢেউ ভেঙে ছুটে আসা, খুব মৃদু
ধ্বনিটির ইঙ্গিতেও যে নির্ভুল সাড়া জাগে মনে,
যেমন সম্ভব আজও গড়ে নেয়া, মর্ম-মূর্তি নয়,
স্মৃতির টুকরো আলো পথে পথে কুড়াতে কুড়াতে
শৈশবের একটি ম্যুরাল, তেমন কি হতে পারে—
হাত বেয়ে, আসবে শরীরে উঠে তোমার স্পন্দন
স্পর্শহীন? যদিবা সে উঠে আসে, উড়ন্ত ডানার
ছায়া কিন্তু পড়ে না মাটিতে—যেই ডানা শূন্যে লীন।

অয়ি চণ্ডি, তোমাকেই বাঞ্ছা করি—হরিতকী, জবা,
শালবনে নয়—জনারণ্যে। ডাকে ত্রাসপাখি ওই—
সর্বনাশপন্থি বাঁশিটির সুরে। দেখি ধ্যানভঙ্গ
রাত্রির নিশ্বাসে শঙ্খ-লাগা দুটি মেঘের চূড়ায়
আততায়ী জোছনার তির এসে বেঁধে। ঘুমহীন
এ চত্বরে গুম হয়ে থেমে যায় পথের বাতাস।
মুঠিতে লুণ্ঠিত হতে জ্বলে ওঠে প্রতিটি লন্ঠন;
ফুল-তোলা নারীটিও খোঁজে তার আঁচলে দস্যুতা।

দস্যু রত্নাকর আমি নই। তুচ্ছ ব্যাধের জীবন
কাটে পৃথিবীতে। ক্রৌঞ্চ সাক্ষী, আমি সেই কালকেতু,
শিকারির বেশে এসে যে নিজেই হয়েছে শিকার।
একটি গোসাপ ধ’রে ঘরে এনে দেখি—ফেলে দিয়ে
ছদ্মবেশ, ফুঁসে ওঠে বিষাক্ত সাপিনী। ফণা তুলে
ডাকে : ‘আয়।’ ভাবি, আজ ভয় কাকে, যদি শিখে থাকে
বিষহর চুম্বনের কলা—ওই রূপসন্ন্যাসিনী?
অথচ সে কেন দাঁড়ায় না ঘুরে, যে মানুষ পারে
উল্টোরথ টানা! চ, এই চণ্ড-চাঁড়ালের দেশে
তোমারই আসন মানি, কবি আমি, নিজ-চণ্ডী-দাস।

সেই ঘরে আমি ঢুকে পড়েছি, যে দরোজাই খুলি
দেখি আরো আরো ঘর, বেরোবার কোনো পথ নাই।
বরং এখানে রাত্রি ঝাড়-লন্ঠনের। বহুরঙা
পাখিটির পালক ছড়ানো শয্যাপাশে যত যাই—
উড়ে যাওয়া গন্ধ তার, ফেলে যাওয়া তাপ এসে লাগে।

জাগে কানাড়ায় মূর্খ মুশায়েরা—জল ও জোনাকি।
‘জানো নাকি, নিমন্ত্রিত শুধু একজন!’ বলেছি তা
সবাইরে ডেকে ডেকে। কিন্তু কোথায় কী! ঠান্ডা ওই
দেয়ালের ওপর একটি কোনো ছায়াপতঙ্গও
বসল না ভুলে। ফুল ও ফাঁকির মূলে শূন্য খাদ—
ভগ্নজাহাজের ইতিবৃত্তে গড়া। দম্ভচূর্ণ-পথে
কে ফিরবে তবে জীবিতের কাছে! মৃতের সাক্ষাৎ
নিতেই এসেছিলাম, দোভাষী জীবন কাঁধে নিয়ে…

এইভাবে বন্দি থাকা—স্মৃতিবন্ধা কবরের পেটে—
কত না রোমাঞ্চকর!—মৃত্যুময় অঢেল সময়
যদি হাতে—পিশাচের সাথে প্রেতমন্ত্র জপে যেতে।
দিনলিপি লিখে চলি তাই একা, পৈশাচী ভাষায়—
পৃথিবীর কত তন্ত্র, কত পন্থা অজান্তে পাল্টায়।

পাহাড়ের পাশে কেউ ফেলে গেছে একটি সবুজ
রাফখাতা—শিশুদের বাক্যরচনার—খুব গাঢ়
লাল টিক দিয়ে তাতে ফুটেছে অনামা কিছু ফুল।

সে ফুলের পাশে পড়ে আছে কারো—একটি অবুঝ
বোবা দেহ—কাদামাখা সাদা শার্ট—রক্তলাগা
ক্রস-চিহ্নে তবু লেখা : ‘ভুল নয়, পাপের মাশুল’।

পাখিদের ঠোঁট থেকে খসে পড়া শব্দেরা গড়ায়—
ধুতুরা ফলের কানে গিয়ে বলে, বলে খুব আস্তে :
এ বাতাস কিন্তু চেয়েছিল ফুলেদের রঙে সাজতে।

চেয়েছিল ক্লান্ত কোনো সাইকেল-আরোহীর পিছে
যেতে যেতে বনের ভিতর—খুঁজে নেবে ডাকঘর—
পড়ে নেবে পৃথিবীর ভাষা ডাকটিকেটের নিচে।

নির্জনতা তবুও সুদূর গ্রহ—রাত্রি-সীমানায়—
পরিত্যক্ত গ্যালাক্সির এক প্রান্তে ঘুরপাক খায়;
তাতে সূর্য নেই, আছে বাক-স্বাধীনতা, সুগম্ভীর—

সেই বাক বধিরের জন্য শুধু—কেউ না জানুক
আমরা তো জানি। জানি, কাকে বলে অভয়-বাগ্মিতা,
কাকে বলে বাগীশ্বর—ব্রজবুলিগান—বৈষ্ণবীর।

সোহেল হাসান গালিব

জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৯৭৮, টাঙ্গাইল। বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। সহযোগী অধ্যাপক ও প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ, নায়েম, ঢাকা। প্রকাশিত বই : কবিতা— চৌষট্টি ডানার উড্ডয়ন [সমুত্থান, ২০০৭] দ্বৈপায়ন বেদনার থেকে [শুদ্ধস্বর, ২০০৯] রক্তমেমোরেন্ডাম [ভাষাচিত্র, ২০১১] অনঙ্গ রূপের দেশে [আড়িয়াল, ২০১৪] তিমিরে তারানা [অগ্রদূত, ২০১৭] ফুঁ [বাতিঘর, ২০২০] প্রবন্ধ— বাদ-মাগরিব (ভাষা-রাজনীতির গোপন পাঠ) [অগ্রদূত, ২০১৮] সম্পাদিত গ্রন্থ— শূন্যের কবিতা (প্রথম দশকের নির্বাচিত কবিতা) [বাঙলায়ন, ২০০৮] কহনকথা (সেলিম আল দীনের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার) [শুদ্ধস্বর, ২০০৮] 

Share