।। সোহেল হাসান গালিব ।।
“অজস্র অজস্র গ্রন্থ নয়, দুএকটি বই লেখা যায়
কীটভাষা—কলার পাতায়—
পেটমোটা ঝলমলে বিক্রিবহু মলাটের মোহপাপ মুছে।
পাণিনিও নয় ঠিক, পতঞ্জলি নয়; তবু
কোনো এক পাঠকের যদি মনে হয়
অসমাপ্ত দুর্বোধ্য এ ভূমণ্ডল, তবে তাকে ব’লো :
মানুষের জীবন আসলে মহামানবের
ভূমিকাসম্বল”…
ভূমিকা
পৃথিবীর সব গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠা পড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়।
এক নিশ্বাসে। একাকী। এই নিরক্ষর দীপালোয় ব’সে।
আর বেশ হয়, যদি পাই ওতে একটি নিটোল ভূমিকা।
ভূমিকার জানালাটা খুলে আমি দিগন্ত-দেউল,
দেউলের উদাস খিলানগুলো দেখি।
সব পথে কারো যাওয়া তো হবে না, সব বই পড়া।
সমুদ্রের ভাঁজ খুলে ঝিনুকের গান তাই
রৌদ্র-সারসের কথা বলে, বলে ফেননিভ জীবনের কথা।
ঝাউ-বাকলের ঠান্ডা ঝরঝরে স্মৃতি নিয়ে
করে সে আলাপ ওই দূর ঝুরঝুর
বালু-পাহাড়ের কাছে।
অজস্র অজস্র গ্রন্থ নয়, দুএকটি বই লেখা যায়
কীটভাষা—কলার পাতায়—
পেটমোটা ঝলমলে বিক্রিবহু মলাটের মোহপাপ মুছে।
পাণিনিও নয় ঠিক, পতঞ্জলি নয়; তবু
কোনো এক পাঠকের যদি মনে হয়
অসমাপ্ত দুর্বোধ্য এ ভূমণ্ডল, তবে তাকে ব’লো :
মানুষের জীবন আসলে মহামানবের
ভূমিকাসম্বল।
প্রথম দিনের কথা আমরা জানি না,
আমাদের জানা নেই কী হবে শেষের দিনে।
নিজেরই জীবন নিয়ে এত অস্পষ্টতা, এত অনুদ্ভাস—
‘আছি এক মধ্যখণ্ডনের কালে—
তমসার কূলে ভেসে ওঠা রাংতামাছের হুতাশ।’
—কেউ দেয় না এ জবানবন্দি,
দেয় নি সেদিনও কবিয়াল—টপ্পা গানে।
তবে এই খণ্ডিতহৃদয় বেঁচে থাকা, বলো সে কিসের টানে!
প্রশ্নকে আড়াল করে শুধু কপালের ভাঁজ
হাত দিয়ে ঢেকে রাখা আর মগ্ন থাকা
যে প্রথম আমার মৃত্যুসংবাদ বয়ে নিয়ে যাবে
তারই মুখ আঁকবার দুঃসাধ্য চেষ্টায়—
পান করে যাওয়া—সারাদিন সারারাত
হাওয়ানল, ধুলোজল—এই এক অমিয়-বিষাদ।
ভাষা
ভাষার বাইরে যদি কোনো চিন্তা থাকে—একেবারে
ভাষার বাইরে, কিছুতেই যদি সে না পায় ভাষার আকার—
যদি থাকে কোনো রঙ—দৃশ্য থেকে দূরে ওই নির্জন পুকুরে
জলের গভীরে জল হয়ে মিশে—স্থির, টলোমলো—
উপরে পানার ফুল—বাতাসে ঘ্রাণের দুল—যেভাবে লাবণ্য—
ফোটে মৌন রেখার আড়ালে রূপ—
যেভাবে পাতার পাশে আনত সন্ধ্যার স্তূপ—জ্বলে ওঠে
ধ্যান ও ধুনুচির কণা বিস্মৃতির এক কোণে—
যার থেকে উঠে এসে ধোঁয়া খুব সন্তর্পণে ধুয়ে দেয়
নীরব আয়নার বুকে ঘুমন্তের আর্তনাদ, আনে পূজারিণী-ভাব
বিগত উনিশ শতকের কোনো নটিনীর চোখে,
কণ্ঠে রামপ্রসাদ কি মীরার ভজনা—
তারই আরাধনা—উপাসনা উলঙ্গ লোকের—
পায়ে পায়ে মৃত্তিকা-ত্বকের রেণু মেখে চলে যাওয়া
ফিরে আসা প্রতিদিন মাটির ঘরের কাছে—
যেটুকু পরাগ আছে বাক্যহীন এক রক্তজবার ভিতর
স্বপ্নপ্রেত এসে যদি তা দিয়ে ছড়ায় জনান্তিকে
নৈঃশব্দ্যের ঝড়—বন্ধ ঘরের জানালা খুলে অবসন্ন এই রাত্রিভর
তারার মার্বেল ছুড়ে দুএকটি জোনাকিও আঁকে—
সেই ভূত যদি সত্যি থাকে, যাকে মন্ত্রে বশ করা দায়,
যে হয় না জব্দ, উচ্চারিত কোনো শব্দে—অজাতশত্রুর পথ
যদি ছুটে চলে তারই ইশারায়—’আমায় নে তুই দলে, ফিরিয়ে সব দে’
বলে সেও পড়ে যায় ভিখারি ভিক্ষুর পাকে—কে এসে ঠেকাবে তাকে?
কতদূর আর প্রসারিত চিনের প্রাচীর, পৃথিবী-প্রাকার—
কেউ যদি হতে চায় তারই হাতে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার!
ব্যর্থ হলে সব কিছু, থেমে গেলে হাওয়া, হুলু, হ্রেষা—
লাগবে না জলে এসে তবু ওই নিঃসঙ্গ চাঁদের টান?
অরণ্য কি সমুদ্র অথবা শঙ্খ—ভেসে গিয়ে জোছনায়—
মেঘের পর্বতে—শুনবে না কান পেতে
পটমঞ্জরি-শাখায় পাখির পাহ্লভি গান?
সোহেল হাসান গালিব
জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৯৭৮, টাঙ্গাইল। বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। সহযোগী অধ্যাপক ও প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ, নায়েম, ঢাকা। প্রকাশিত বই : কবিতা— চৌষট্টি ডানার উড্ডয়ন [সমুত্থান, ২০০৭] দ্বৈপায়ন বেদনার থেকে [শুদ্ধস্বর, ২০০৯] রক্তমেমোরেন্ডাম [ভাষাচিত্র, ২০১১] অনঙ্গ রূপের দেশে [আড়িয়াল, ২০১৪] তিমিরে তারানা [অগ্রদূত, ২০১৭] ফুঁ [বাতিঘর, ২০২০] প্রবন্ধ— বাদ-মাগরিব (ভাষা-রাজনীতির গোপন পাঠ) [অগ্রদূত, ২০১৮] সম্পাদিত গ্রন্থ— শূন্যের কবিতা (প্রথম দশকের নির্বাচিত কবিতা) [বাঙলায়ন, ২০০৮] কহনকথা (সেলিম আল দীনের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার) [শুদ্ধস্বর, ২০০৮]