।। ফরহাদ মজহার ।।
ঝরা পাতা
শীতে ঝরা পাতাগুলো পথের ওপর লাল হয়ে ঝরে যাচ্ছে। এই
পথেই তুমি আসবে। যেহেতু শীতের পরে বসন্ত।
সকাল থেকে আমি তোমার হেঁটে আসার পথটুকুন ঝাড়ু দিয়ে
সাফ করি। তুমি নিজের মতো আসো নিজের মতো যাও। অথচ
তোমাকে কখনই দেখি নি।
তবুও আমরা গল্পে বিশ্বাস করি।
বলি, সবার অগোচরে এই পথ দিয়ে তুমি বরফের মতো ঠাণ্ডা
পায়ে এসেছিলে। শিষ্ট ও মসৃণ হিম শীতল পায়ের ছাপ কেউই কি দেখে?
আমি দেখি। আমার হৃদপিণ্ডের নাম নয়ন এবং নয়নের নাম দৃষ্টি।
বুঝি, তুমি এসেছিলে। কারণ, পথটুকু আবার লাল ঝরা
পাতায় ঢেকে গিয়েছে। আবার আমি পথটুকু সাফ করি।
শীতের পরেই বসন্ত।
এইভাবেই আসায় এবং আশায় আমার ঋতু সাঙ্গ হয়।
ছাদ
এই বাড়ির ছাদে আমি একদিনও আসিনি।
আমার নিঃশ্বাস বদলাতে শুরু করেছে এবং সূর্যের পাশের
নক্ষত্রটিকে সূর্যের চেয়েও অধিক উজ্জ্বল মনে হচ্ছে।
আমি তাহলেই বাড়ির ছাদেই বসে থাকব।
অনন্তকাল।
পান্নালাল
ধরো পাহাড় না হোক, একটি টিলা বেয়ে পার হবার জন্যই
তোমার হাঁটা। পা দিচ্ছ সামনে অথচ চলে যাচ্ছে পেছনে। তুমি
অতো দূর্বল নও। আসলে ওটা ছিল হিমালয়, তুমি তাকে টিলা
ভেবে প্রস্তুতি ছাড়া হেঁটে পেরিয়ে যাবে ভেবেছিলে। এতে
হতাশ হবার কিছু নাই। যদি বিষাদ ও হতাশাই তোমার
আনন্দের খোরাক হয় তো বসে বসে এখন পাকা চুল গুনতে
পারো।
তবে হেঁটেই যদি তুমি গিরি লঙ্ঘন করতে চাও তাহলে জননীকে
ডাকো, যার সঙ্গে নাড়ির সম্বন্ধ ছিন্ন করেছো বলে আজ তোমার
এই দশা। তিনি পঙ্গুরেও গিরি লঙ্ঘিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু
সারা জীবন তো শুধু পরম পিতাকেই ডেকে গেলে।
হায় রে পুরুষতন্ত্র!
চলো আমরা আব্র পান্নালালের গান শুনি এবং নতুন উদ্যমে
গিরি লঙ্ঘন করি।
জেলার
বুঝি যে তুমি প্রাজ্ঞ; মৃত্যুর বাসনা তোমার আগের চেয়ে তীব্র।
জীবনের ভার বহন এখন অসহ্য এবং তুমি শালা এই জীবনের
কোনো মানেই ধরতে পারলে না!
আত্মহত্যার বাসনায় লজ্জার কিছু নাই।
বন্দীখানার যে ওয়ার্ডে তোমার কয়েদ বাস, সেখান থেকে অন্য
সেলে যাবার জন্য জেলারের কাছ থেকে পিটিশন দিতে পারো।
তিনি কবিদের প্রতি সদয় এবং তোমার আবেদন না-মঞ্জুর হবার
কোনো কারণ নাই।
ঠিকা আছে, না হয় কারাগারের অন্য প্রকোষ্ঠেও তোমার মৃত্যু
বাসনা আরো তীব্র হবে।
তাহলে বারবার পিটিশান এবং তারপর ভিন্ন সেলে ট্রান্সফার
এবং মৃত্যু বাসনা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাক।
ব্রাদার, এটাই জীবন।
তারপরও মানুষের মাত্র একটাই তো আশা: যে এক সেল
থেকে অন্য সেলে যাবার ফাঁকে চকিতে তুমি চিফ জেলারের
মুখটুকু দেখে ফেলতে পারো।
পারো না?
হ্যাঁ পারো।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, মানুষের জীবনের একটাই তো উদ্দেশ্য:
ঈ শ্ব র দ র্শ ন!!
হাড্ডিগুড্ডি
কিছু কুকুর দল বেঁধে আমাকে কামড়াতে এসেছিলো। আমি
আমার হাড়গোড় হাড্ডিগুড্ডি সবই তাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছি।
এখন তারা নিজেরাই কামড়াকামড়ি করছে।
কবিতাগুলি ফরহাদ মজহারের ‘সদরুদ্দীন’ কাব্যগ্রন্থের।