আজ শনিবার, ৩রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

নিভে আসা আকাশে

গুচ্ছ কবিতা

।। সুদীপ্ত চক্রবর্তী।।




গৃহদেবতা

জানালার বাইরে বিস্কুটের গুঁড়ো, চাল, মুড়ি
এক বাটি জল রেখে দিয়েছি

একদিন একা একজন বিস্কুটের গুঁড়ো তোলে ঠোঁটে
আর ত্রস্ত সরে সরে যায়
চোখ ঘোরে এদিক সেদিক
অতঃপর দুই, পরদিন তিন চার
শেষে এক দঙ্গল ছাতারে পাখি আকাশ পেরিয়ে
জানালায় ভিড় করে আসে

খাবার ফুরিয়ে গেলে জানালার কাচে
ঠোকরায় আজকাল
মৃদুমন্দ হাসি নিয়ে কাচটি সরাই
পরদিন আরো খানিকটা ছড়িয়ে দিই
কিছুটা বিস্কুটের গুঁড়ো, চিড়া, মুড়ি
ঘরের সামান্যে জানালার ভিতরে এনে রাখি
ভাবি একদিন একে একে
ঢুকে আসবে ঘরে…

বুঝবে এ-খাবার আকাশ থেকে পড়েনি


নবপ্রস্তর যুগ

পাথর ছিল উল্টিয়ে ওই ঘরের কিনারে
হাতে তুলতেই উঠেছিল ফুটে
চোখ নাক আর চিবুকের মাঝে
মেদহীন সেই পাথুরে ইগোতে
বিশাল একটি সর্ববিনাশী হাঁ

যদিও মাথায় চুল নেই তার
কান দুটি খসে পড়ে গেছে আর
প্রাণের মাঝেতে সুর নেই তাই
মুখে নেই কোন রা


ভালোবাসার কথা

(১)

মানুষের মধ্যে যারা খুব উপকারী
মানুষ থেকে তাদের দূরে থাকাই ভালো

কাছাকাছি বলতে একটা বেড়াল নিয়েও
জীবন কেটে যায়
বিছানায় হেগে দিয়েছে বলে
ঝাঁটা মারতে মারতে দূর করে দেওয়া
কিছুদিন ত্রিসীমানা লকডাউন

উপকারী মানুষেরা বরং প্রাতঃকৃত্য আদি
উপযুক্ত স্নানাহার সেরে
ঝকঝকে বেরিয়ে পড়ুক ওই শহরের পথে
গ্রীষ্মের খর দুপুর বেলায়, খাঁ-খাঁ চৌরাস্তা জুড়ে
মুটের পাথুরে পিঠ থেকে ছিটকে আসা রোদে
ধর্মতলায় সানগ্লাস পরুক

তারপর ফের একদিন সন্ধ্যার বাজার
মাছ, মাছের প্যাটলা, কানকো
খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানা পেতে দিতে দিতে
একটা জীবন কেটে যায়

(২)

মানুষের পা ভেবে চেয়ারের পায়ায়
মাথা ঘষে অবুঝ বেড়াল

মানুষ বিদ্রূপ করে বলে
চেয়ারকে খেতে দিতে বল

বিড়াল বোঝেনা অত শ্লেষ
তার চাই ছোট মাছ
ঘুমের আবেশ


নতুন মানুষ

(১)

নতুন নায়ক পর্দায় আসতেই দেখি
চুলের ছাঁঁট পাড়ার বাজারের
শান্তির দোকানের মতো

লোকমুখে শুনলাম ভালোই অভিনয়
ছবিটিও নাকি বেশ

শান্তির কথা ভেবে আমার খুব আনন্দ হলো

সুদূর হলিউড থেকে আসা এক সুপুরুষ
বসে আছে শান্তির রিভলবিং চেয়ারে

নায়ককে ঘোরাতে ঘোরাতে
শান্তি কাঁচি চালাচ্ছে, ঘাড়ের নরম হাড়ে
শান্তি তাঁর নিখুঁত ক্ষুরটি বুলিয়ে চলেছে

পর্দার ভিলেনটির প্রতি বিদ্রুপ ছড়াতে ছড়াতে
রবিবার সকালে
হাওয়াই চটি গলিয়ে

শান্তির দিকে হাঁটা লাগালাম

(২)

নতুন স্ট্রাইকার মাঠে নামতেই দেখলাম
সে আমাদের খেপের পটল

পেনাল্টি মিস করে যার
ধন্যি মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছিল

নিজের পেনাল্টি বক্সে গোল বাঁচাতে এসে
প্রথম গোল করেছিল সে।
বিপক্ষ দল তাকে ট্রফির মতোই নাচিয়েছিল
ভিনদেশী গ্যালারির দিকে

যদিও গোল করে পটলের খুব আনন্দ হয়েছিল
যদিও নিজের আনন্দে সে দুঃখ পেয়েছিল


বিকেল

মরা বিকেলের মাঝে দুখজাগানিয়া
ওই মাঠ জেগে আছে
দু’একটি গরু চরে বেড়াচ্ছে, ছ’সাতটি বক
অদ্ভুত এই প্রণয়ের মাঝে
ঠিক করলাম হেঁটে ফিরবো আজ

অথচ সেই অনিবার্য রিক্সা
চালকের উদ্ভ্রান্ত মুখ
দেখে এক অবুঝ আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো
অদূরের বুক

ঈষৎ দ্রুতগামী এই অত্যাশ্চর্য যানে চড়ে

মাঠটি পেরিয়ে যেতে যেতে
নিভে আসা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল
এক তীব্র হাহুতাশ

ছেলেটি গোল মিস করেছে আর
মেয়েটির ঘরে গানের মাস্টার এসেছে


ভ্রমণ

প্রবাসের বাঁশি বাজে শেষ দুপুরেতে
অতঃপর গোছগাছ, প্যানোরামা লেন্স
সানগ্লাস পাড়ি দেয় পাহাড়ের ফ্রেমে

শশব্যস্ত সংসার ছোটে পিছে পিছে
শেষ স্টেশনেতে

ভোরবেলা পার হয়ে আমাদের রিজার্ভেশন
প্ল্যাটফর্মহীন এক স্টেশনে দাঁড়ায়


ব্রহ্ম ও বান্ধব

সিমেন্ট ঘেরা ঝকঝকে নীল জলাশয়ে
সাঁতারুটিকে সঙ বলে মনে হয়

এমনই এক অমানবিক, ক্লাসিক্যাল ঢঙের উপর
ঘন ও সবুজ শ্যাওলা মাখাবো আজ
ঘাট হবে তুমুল পিচ্ছিল।
ওপারে নারকেল তাল ফলসা করমচা
সাথে এক ঝাঁকড়া কুলগাছ
ভরপুর কুল ও কাঁটায়

কিছু নীচে, যেখানেতে জল এসে গোড়ালি ছুঁয়েছে
কাঁকড়ার কিছু গর্ত বসাবো।
আশেপাশে শামুকের মাংস দেখলেই যারা
কাঙালের মতো গৃহস্থের রান্নাঘরে যাবে

তাদের দিকে এই শেষ বিকেলেতে
চেয়ে চেয়ে
মাইকেল ও বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়ে


বন্ধু

যত অসময় হোক
আমরা যেন কিছু ভুলে না যাই

অনাহারে মরে যাবার আগে
গুলি খেয়ে মরে যাবার আগে
নেহাতই রোড আ্যক্সিডেন্টে

সত্যি সত্যি মরে যাবার আগে



অলঙ্করণ: বৈশালী



সুদীপ্ত চক্রবর্তী

জন্ম: ১৯৭৪। পশ্চিমবঙ্গের নব্বই দশকের ভিন্ন স্বরের গুরুত্বপূর্ণ কবি। পেশা সূত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একজন প্রশাসক। জন্ম ও যাপন হাওড়া ও কলকাতা জেলায়, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে পেশার কারণে বসবাস করছেন। প্রকাশিত কবিতার বই – জলের শহর ( ২০০৫ ), স্মৃতি ও পুনর্জন্ম ( ২০১০), কাঠবেড়ালির সেতু (২০১৬ )।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top