আজ বৃহস্পতিবার, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

গোলাপী দৃশ্য বারংবার

ধারাবাহিক উপন্যাস। প্রথম পর্ব।

।। সম্বিত বসু ।।

এক কালে একটাই রাজ্য ছিল, তারাসাং। তার পূর্ব প্রান্তে মহারাজ ব্রজকিশোর তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে নাম রাখেন দারাসাং। সেই থেকে দারাসাংবাসীদের ঘামান্ড যে তারা রাজধানীর বাসিন্দা আর পশ্চিম তারাসাং-এর লোকেরা ঠাট্টা করে বলে এই তো সেদিনের এলাকা, আর তাও তারাসাং-এর অংশ, তাদের এলাকা খাশ তারাসাং, দারাসাং-এর অংশ নয়। এখানে অনেকেরই অক্ষর পরিচয় নেই এবং সেই নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপও নেই; যারা ভাষাকে মুম্ফালি বানিয়ে ঠোঙায় পুরে রাখে তাদের আবার লেখার বালাই! বুজুর্গরা জানে এই দোসাং-এ অনেক মানুষ লোপাট হয়েছে, এখনও কেউ কেউ হয়। আন্ডারওয়ার্ড বা বেশ্যালয়ে নয়, বিলকুল অন্য জগতে যাওয়ার বন্দবস্ত আছে এখানেই কোথাও গুহার গভীরে অথবা অতর্কিতে সময় পরিপক্ক হলে কুম্ভকপূর্বক উপযুক্ত ধ্বনিতে হয়তো-বা হাওয়াতেই হাপিস, হাওয়া যদিও দিতেই থাকে অনবরত, উন্মুক্ত বাতাসী করিডোরে। কেউ গায়েব হয়ে গেলে এই জগত সংসারে তাদের সমস্ত স্মৃতি, নথিপত্র, দলিল দস্তাবেজও লোপাট হয়ে যায় আর তাই কারুর মনেও হয় না যে কোনোকালে সেই ব্যক্তি আদৌ স্বশরীরে হেঁটে চলে বেড়াত।

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (প্রথম পর্ব)

“And humans are no fool
Gravity happens to pull!”              
            

তারাসাং দারাসাং ধাবা আর পেট্রল পাম্পে ছয়লাপ, দুরপাল্লার ট্রাকেদের ফুয়েলিং পয়েন্ট, পাওয়ার কাটের এমার্জেন্সি মওকা বুঝে  জালনোট গছিয়ে দিলে কিচ্ছুটি করার নেই আবারও প্রতি-সুযোগের অপেক্ষা করা ছাড়া। বুজুর্গে বুজরুকে চোখের দেখায় যে টুকু ফারাক, জালনোট আর আসলি নোটে ফারাক সে টুকুই এই বিণসমুদ্র বন্দরে যা কিনা বর্ডারের গঞ্জও বটে। অথচ এখানকার পুরোনো বাসিন্দাদের মাটিতে পা পড়ে না জাত্যাভিমানে, দো-সাং-এর না লেখা ইতিহাসে গর্বিত হয়ে; আসল কথা এখানকার অতীত ইতিহাসকে পুষ্ট না করে কেবলই ভরে গেছে উপকথা-লোককথার কলসী হাঁড়ি; এক ভাঁড় খেঁজুর রসে এক সহস্রাব্দের মার-কাটে মলম দিয়ে রুচিসম্মত, পরিবেশনযোগ্য মিষ্টতা। শেকড়ে টান না পড়লে মুখে কথা সরে না দোসাংবাসীদের, পেট পচছে ভেজালে, চোখের ইশারায় জালনোটের অবাধ বিনিময়, মোবাইলের রিংটোনে বলিউড রকমারী, যত্রতত্র পানের পিক, তৎসত্ত্বেও অবিনশ্বর কিছু, গন্ধমাদন থাকলে তা এখানেই, গুপ্তনকশা গুম করে বেমালুম ফুঁটো মাস্তানি আর শব্দভেদী রংবাজী। সাঁ-সাঁ করে ছুটে যাওয়া রকেট বাসেদের এখানে দাঁড়াতেই হয় ত্রিপল খাটানো ধাবাগুলোয় তড়কা রুটি আর দেশী-বিলিতি মদ খেয়ে বাকি পথের সাপেক্ষে শরীর ঝেলে নিতে। বরবাদ কবি আর নেশাতুর ড্রাইভার জানে এই স্থানের মাহাত্ম্য, সকালের বাজারে সাইনবোর্ড লাগিয়ে অকারণ সব্জির পাইকারি ভাও তোলা আর বেলা বাড়লেই ছাড়, পালা ফুরিয়ে এলে যে যা দিচ্ছে তাই নিয়েই সিট ভরানো, আর নাটকের নিয়ম উল্লঙ্ঘন না করতে পারায় শেষটাই যা দেখার। বাজারে মাংস বিক্রি হয় না, এ দো-সাং-এর পুরোনো রীতি, এ এই অঞ্চলের রীতি, রীতি এতই অমোঘ যে বাজারকে এখানে সবজি-মন্ডি বলে; বাজারের বাইরে তাই আরও এক মাংসের বাজার। আস্ত খাসি ঝোলে, মাছি তাড়াতে কসাই তাদের দোল দেয় থেকে থেকে। চর্বির চাহিদা এ অঞ্চলে খুব; প্রায় সব ধাবাতেই চর্বির চাট খুব জনপ্রিয়, কাই কম, ঝাল বেশী। বাজারে মনিহারী জিনিসের দোকানও আছে, আছে পাহাড়ি ফুলের দোকান, যেখানে মাঝে মধ্যেই উঁকি দেয় বিরল অর্কিড, বাজারে ঢুকতেই যাদবদের দোকানে সিঙাড়া, কচুরী জিলিপি আর তার পাশের গলির ঝংকার অডিওর দোকানের মোবাইলবাজরা আওয়াজ দেয় ‘অত খায় না।” 

বাজার বন্ধ হলে চকে বসে আগুন জ্বেলে বুজুর্গদের চরসের আসর; জীবদ্দশার অধিকাংশব্যোম টানে বন্ধক রেখে গাল চুপসিয়ে আমসিপানা কিন্তু এখনও কী টঙ্কার মেজাজ, লব্জের রংবাজী আর শীত সহিষ্ণুতা! সরকারের বদৌলতে দোসাং-এর রাস্তাঘাট শিশুর গালের মতো মসৃণ, মেলা-তেওহারের মতো সারাটা বছরই আলো ঝলমলে। যেসব জায়গায় ট্রাক-লরির আড্ডা সেখানকার কথা আলাদা, নতুন রাস্তা খানা-খন্দে ভরিয়ে দিতে প্রতিনিয়ত অতিকায় চাকাদের কসরত আর ব্রেকাব্রেকি, ও কোনোদিন শুধরোবার নয়, লরি থেকে যে ধীরে নামে সে ড্রাইভার আর যে লাফিয়ে নামে সে সদাহাস্য হেল্পার। এসবও কথা হয় সাং-সাং গুণে। এক কালে একটাই রাজ্য ছিল, তারাসাং। তার পূর্ব প্রান্তে মহারাজ ব্রজকিশোর তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে নাম রাখেন দারাসাং। সেই থেকে দারাসাংবাসীদের ঘামান্ড যে তারা রাজধানীর বাসিন্দা আর পশ্চিম তারাসাং-এর লোকেরা ঠাট্টা করে বলে এই তো সেদিনের এলাকা, আর তাও তারাসাং-এর অংশ, তাদের এলাকা খাশ তারাসাং, দারাসাং-এর অংশ নয়। এখানে অনেকেরই অক্ষর পরিচয় নেই এবং সেই নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপও নেই; যারা ভাষাকে মুম্ফালি বানিয়ে ঠোঙায় পুরে রাখে তাদের আবার লেখার বালাই! বুজুর্গরা জানে এই দোসাং-এ অনেক মানুষ লোপাট হয়েছে, এখনও কেউ কেউ হয়। আন্ডারওয়ার্ড বা বেশ্যালয়ে নয়, বিলকুল অন্য জগতে যাওয়ার বন্দবস্ত আছে এখানেই কোথাও গুহার গভীরে অথবা অতর্কিতে সময় পরিপক্ক হলে কুম্ভকপূর্বক উপযুক্ত ধ্বনিতে হয়তো-বা হাওয়াতেই হাপিস, হাওয়া যদিও দিতেই থাকে অনবরত, উন্মুক্ত বাতাসী করিডোরে। কেউ গায়েব হয়ে গেলে এই জগত সংসারে তাদের সমস্ত স্মৃতি, নথিপত্র, দলিল দস্তাবেজও লোপাট হয়ে যায় আর তাই কারুর মনেও হয় না যে কোনোকালে সেই ব্যক্তি আদৌ স্বশরীরে হেঁটে চলে বেড়াত। শ্বাশুড়ি পুত্রবধূ আর নাতনিকে মনে করেন আজন্মের আশ্রিতা, পুত্রবধুর আচানাক সিঙ্গল মাদার হাবভাব; মাঝখান থেকে মানুষটা জাস্ট ভ্যানিস! তা বুজুর্গরা বোঝেন কি করে এই পারাপার কিসসা? এই তো? তাঁরা যে পুরোটা সার্কাস ধৈর্য্য ধরে দেখেন, জোকারের অ্যাম্বিশানকে দর্পন আর দন্তপাটির সম্পর্ক দিয়ে বুঝে, টুঁ শব্দটি না করে সকলের অগচরে ভূত পোষেন; তাদের কাছে খোদ মহাকালেরও ‘চুষি, চুষিনী, পুসি পুসিনী’ কাঁদুনী গাওয়া অরণ্যে রোদন। বহুত দিন হয়ে গেলো এই মফঃসলে খুন-খারাবি হওয়ার পরে খুনী ধরা পড়েছে, খুন হলে তো বোঝার উপায় নেই তা খুন না জগান্তর। এবার সব গুলিয়ে যাবে যদি বলে দেওয়া না হয় যে কেউ গুম হয়ে গেলেও যাবত স্মৃতিসুদ্ধু লোপাট হলেও বোঝার উপায় থেকেই যায় যে সে হারিয়ে গেছে, বুজুর্গদের কাছ থেকে জানা আছে জগতান্তর প্রক্রিয়া আর হঠাৎ দেখা ওই দোকানটা অনেক দিন হয়ে গেলো খুলছে না অথবা খোলা কিন্তু দোকানী নেই, তখনই মনে সন্দেহ হয়, কপালে বুকে ঢিপ-ঢাপ আঙুল ঠেকে, ঠোঁটে ছ্যাঁকা লাগে ঠান্ডা লকেটের, আরও একটা মানুষ বুঝি চলে গেলো ওপারে। মোটা দুধের চা আর চরসে তাদের সৎকার করেন খোদ বুজুর্গরা। জ্ঞানী, তেয়াগী আর রাজীব এখানকার তিন মাথা, বিখ্যাত বুজুর্গ, সকলে চেনে এবং মান্য করে। খানদানী জ্যাকেট আর হালের স্নিকার, কম্ফর্টার তিব্বতি উলের, টিকোলো নাক লাল হয়ে যায় চরসে ভেজাল থাকলে; তখন গেয়ানী পরিহাস করে বলে, “মিট্টি সে বার্তান ধুলওয়াতে হো, ঘার ভি ধুলওয়াগে কেয়া?” রাজীব, হেসে উত্তর দেয়, “হাঁ ভাই কিউ নাহি ঘার ভি তো মিট্টি সে হি বানা। মিট্টি সে ধুলওয়ানেমে দিক্কাত কেয়া হ্যায়?” তেয়াগীর এদিকে মেজাজ বিগড়ে গেছে ভুসি চরস ফুঁকে, সে প্রতিবাদ করে, “আরে ছোড়ো ইয়ে সাব ফিজুল কি বাতে, ইয়ে কা পি রাহে হ্যায় হাম? ই আগার চারাস হ্যায় তো ম্যায় ভি মেট্রিক পাস।” কেউ খুন হলে এই বুজুর্গদের কাছ থেকেই শোনা “ভবের ভেতর থেকে করে ওরা যাওয়া আসা”-র গল্পে সন্দেহ হয় গুম হয়েছে না খুন? ব্যক্তির স্মৃতি মানসপটে অটুট থাকলে তা আলবাত খুন! ডিজিটাল কাউন্টার বসেনি দোসাং-এর পেট্রল পাম্পে, মেকানিকাল কাউন্টারের হলদে-সাদা খয়া খয়া সংখ্যারা ঘূর্ণনে অপর এক ঘুর্ণনে মেয়াদ নির্ণয় করে। হত্যা কাহিনী, খুনের খবর সেই ফাঁকেই চালাচালি হয় পাম্প কর্মীতে-ড্রাইভারে। পাম্পের মালিক গুরচরণও যোগ দেয় সেই গুকতানিতে, তবে তা দূর থেকে ইয়ার্কির ছলে, “আরে সাহি বোলা ভাই আগার কাতিল মিল যায়ে তো ম্যাঁ য় উসে একঠো নোবেল প্রাইজ দুঙ্গা!”

গুরচরণের পাম্প এই এলাকায় সব চেয়ে পুরোনো, তার পাম্পের সাথে লাগোয়া একটা ধাবা আর একটা ধোচন হোটেলও আছে, হোটেলে একই ঘরে দু রকম রেট, বিন-সাফাই আর সাফ-সুতরা। এখানে মিডওয়ে হল্টের প্রয়োজন বুঝে যারা ব্যাবসা করতে বাইরে থেকে এসেছে তাদের এখানকার লোকেরা বিন্দুমাত্র বাধা দেয়নি, বলতে গেলে আপন করে নিয়েছে, বাইরের কালচারে বা বিনোদনের অদ্ভূত উগ্রতায় তাদের প্রত্যক্ষ সায়, কিন্তু একটি বিষয় এখনও আছে যা দিয়ে এখনও বোঝা যায় যে বান্দা দোসেঙে: এখানকার কেউ প্রায় ইস্কুলে যায় না বললেই চলে। দোসাং-এ যে কটা ইস্কুল সব বাইরে থেকে আসা লোকেদের, তাদের বাড়ির বাচ্চারাই যায় সে সব স্কুলে। ন্যাশানাল এক্সপ্রেসের (রেল) রিজার্ভ কম্পার্টমেন্টে যদি-বা কোনোক্রমে স্থান সঙ্কুলান হয়, সেই আশায় বুক বেঁধে এখানকার স্থানীয় এক আধজন দুরু-দুরু বুকে স্কুলে পাঠায় ছেলে-মেয়েদের; বাকিরা হয় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ভ্যানিস হওয়ার তক্কে-তক্কে থাকে নতুবা স্রেফ পেটে খেয়ে পিঠে সওয়া ম্যানুয়াল লেবার। এখানে যে পুরোনো কাহাবাতেই আছে, ‘কিতাব পাড়কে তুলসীদাস, আঁখ আকালকা সাত্যানাশ!’ পড়াশোনা না করেও ঝরঝরে নোটের হিসেব, ঠোঁটোস্থ হালের হিট গান। বুজুর্গরা তাল দেয় আর নবীনরা পাহাড় বা পড়া-শোনা কোনোটারই তোয়াক্কা না করে ‘সব জানি’ হাবভাব করে সিগারেট দু আঙুলে ঠোঁটে ধরার পোজে পুচুত করে ফেলে দেয় পুরিয়ার পিক। বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় সেই দাগ আর স্টেট হসপিটালের ওরাল ক্যানসারের পেসেন্টরা মানতে চায় না যে তাদের এই ভোগান্তির সাথে যৌবনের যথেচ্ছ তম্বুল সেবনের কোনো সম্পর্ক আছে।

সায়েরীর এই বাবাটিও কল্পিত, সে আমলে দিনে দশ-বারোটা খদ্দের নিত ছেদি, কার মেয়ে এই পুঁচকেটা সে নিজেও তা জানতো না, আর মেয়ে বড় হয়ে ‘ব্যাব্যা, ব্যাব্যা” করে তার নামে আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে খালি ছেদিকে ছোট করে, অপমান করে, আবার তার কথা বিশ্বাস না করলে সে দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্তারক্তি কান্ড বাধায়! সে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে পাপ আঁকে দেয়ালে। ছেদীর রাগ আর কান্না  একই সঙ্গে পায়, মেয়ে এক বছর ভালো থাকে তো এক বছর একদিনের মাথায় অদৃশ্য মানুষের সাথে কথা বলতে বাড়ির দরজা হাঁ করে খুলে রেখে চলে যায় জঙ্গলের দিকে। তারপর খোঁজ-খোঁজ, লাচার ছেদী পাপবোধের তিক্ত পানা কোনোমতে গলাধঃকরণ করে; বাহারী বুনো-ফলের বিষে বেগুনী হয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘরে ফেরে সায়েরী।

মানুষের কারবার করে ছেদি, সায়েরীর মা ছেদি। বাচ্চা আর জোয়ানদের স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় পাচার করে দেয় ছ’ গ্রাম পেরিয়ে ভীষণ সুন্দর সান্ডমরু পাস বরাবর যেখানে পাহাড়ি টিয়াদের কিচির-মিচিরে অপহৃতদের জ্ঞান-গম্মি লোপ পায়। কালো ধান্দার ছায়াবাজিতে বাজারও কালো হয়, তবে জায়গাটাও তারাসাং, ‘মেঘের কাজ মানুষ করেছে’ ভাব করে লোকেরা নিজেদের তালে থাকে, কতো এলো গেল, হাপিস হওয়ার হলে চলতি-ফিরতি হাপিস হয়ে যাবে টেরও পাবে না, ইয়ে তারাসাং হ্যায় বাবু! দেশ থেকে মায়ে খেদিয়েছে, তবু সায়েরীর মোহ ঘোচেনি, থেকে থেকে সিমলা স্টেট আসাইলামে দেশের গল্প বলতো সেলজাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, বাড়ির সামনের গাছতলার জুয়ার ঠেকের জুয়াড়িদের ফিরিস্তি দিতো, এমনকি যে মা তাকে মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি করার পর থেকে আর সেই ভাবে কোনোদিন তার খবর করেনি সেই মায়ের জন্য কান্নাকাটি করতো দুর্বোধ্য অথচ নিশ্চিত গালিগালাজে। প্রথম প্রথম সিমলা ভিলায় এসে সায়েরী ঠিক করে খেতে পারতো না, সব খাবারে সে পচা মাছের গন্ধ পেত, দিনে দিনে যত সিঁটিয়েছে সায়েরী ততই মোটা হয়েছে তার কেস হিস্ট্রির ফাইল।

সায়েরীর এই বাবাটিও কল্পিত, সে আমলে দিনে দশ-বারোটা খদ্দের নিত ছেদি, কার মেয়ে এই পুঁচকেটা সে নিজেও তা জানতো না, আর মেয়ে বড় হয়ে ‘ব্যাব্যা, ব্যাব্যা” করে তার নামে আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে খালি ছেদিকে ছোট করে, অপমান করে, আবার তার কথা বিশ্বাস না করলে সে দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্তারক্তি কান্ড বাধায়! সে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে পাপ আঁকে দেয়ালে। ছেদীর রাগ আর কান্না  একই সঙ্গে পায়, মেয়ে এক বছর ভালো থাকে তো এক বছর একদিনের মাথায় অদৃশ্য মানুষের সাথে কথা বলতে বাড়ির দরজা হাঁ করে খুলে রেখে চলে যায় জঙ্গলের দিকে। তারপর খোঁজ-খোঁজ, লাচার ছেদী পাপবোধের তিক্ত পানা কোনোমতে গলাধঃকরণ করে; বাহারী বুনো-ফলের বিষে বেগুনী হয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘরে ফেরে সায়েরী।

সায়েরীর এক অদ্ভূত স্বভাব ছিল, সে দোষই বলো আর বাতিকই বলো, সে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতো লোকেদের নিয়ে, এমন সব লোকেদের নিয়ে যাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। হাওয়ার মানুষ বানিয়ে হাওয়ায় ছাড়তো সে। “বরকত চাচাসে সমঝোতা কারলো, উসে অর না সাতাও”- লাল্লুকে বলে বসলো বিচ বাজার, লাল্লু তো আকাশ থেকে পড়ে, বরকত আবার কে! “সায়েরী বেটি, ইয়ে বারকত কউন হ্যায়?” লাল্লুর প্রশ্নে সায়েরী ফায়ার, উগ্রে দেয় রাগ আর তিরষ্কার, যদিও তা বলাই বাহুল্য হিন্দি ফিল্ম স্টাইলে: “লাল্লুজী ক্যাসা ইনসান হো তুম, বরকত চাচাকো ভুল গ্যায়ে! তুমহারা দোস্ত, ঘার ভি তো বানওয়ায়া উঙ্কে পয়সা সে, উনকে এহসান সে তুম আজ শেঠ বানে অর আজ পুছতে হো, বরকত কৌন! তুমহারা বেটা তো জুম্মা জুম্মা দোদিন চরস ভি পী তা হ্যায়, বাইকিং কারতা হ্যায়, মা তো মার গায়া, দুধ কউন পিলায়া, বরত চাচানেহি না! ওয়া ভাই, নামাকহারামী কোই তুমসে শিখে!” কোমরে হাত দিয়ে সায়েরী বিলকুল সোলে-র বাসান্তি, বকতে পেলে আর কিছু চায় না, লাল্লুকে ঝাঁঝিয়ে যাচ্ছে তো ঝাঁঝিয়েই যাচ্ছে, ওদিকে বাজারে ওদের ঘিরে লোক জমতে আরম্ভ করেছে, লাল্লুর ফর্সা গাল অপমানে টুক-টুক করছে, সে সায়েরীকে পাগলী, ডাইনি, এইসব বলতে বলতে সেখান থেকে চলে যায়। পরে ছেদির সঙ্গে দেখা হলে সায়েরীর নামে নালিশ, করে, অকথ্য গালিগালাজ, লোন ক্যানসেল, ইত্যাদি, ইত্যাদি। ছেদি মেয়েকে পিটিয়ে পিছমোড়া করে রেখে কাজে চলে যায়। যবে থেকে সে দেহ ব্যবসা ছেড়ে হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর আবছা নেটওয়ার্কে নিজের মতো দালালী, খবরী করে খাচ্ছে তবে থেকে সে সায়েরীর এইসব উৎপাটাং গল্পগাছায় মই দিয়ে তাকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখাচ্ছে, আর সায়েরী আফশোস করছে যে তার বাবা যদি বেঁচে থাকত তাহলে তাকে আজ এই দিন দেখতে হতো না। সায়েরীর এই বাবাটিও কল্পিত, সে আমলে দিনে দশ-বারোটা খদ্দের নিত ছেদি, কার মেয়ে এই পুঁচকেটা সে নিজেও তা জানতো না, আর মেয়ে বড় হয়ে ‘ব্যাব্যা, ব্যাব্যা” করে তার নামে আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে খালি ছেদিকে ছোট করে, অপমান করে, আবার তার কথা বিশ্বাস না করলে সে দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্তারক্তি কান্ড বাধায়! সে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে পাপ আঁকে দেয়ালে। ছেদীর রাগ আর কান্না  একই সঙ্গে পায়, মেয়ে এক বছর ভালো থাকে তো এক বছর একদিনের মাথায় অদৃশ্য মানুষের সাথে কথা বলতে বাড়ির দরজা হাঁ করে খুলে রেখে চলে যায় জঙ্গলের দিকে। তারপর খোঁজ-খোঁজ, লাচার ছেদী পাপবোধের তিক্ত পানা কোনোমতে গলাধঃকরণ করে; বাহারী বুনো-ফলের বিষে বেগুনী হয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘরে ফেরে সায়েরী। এই পর্ব বেশীদিন সইতে পারেনি ছেদী, বইতে পারেনি অভিশাপ; পাগলাগারদেই দিয়ে দিল সায়েরীকে শেষমেশ। সায়েরী তার কল্পিত বাবার এক নামও দিয়েছিল, পেয়ারেমোহন সিং, সেই নামেই কাগজ করিয়ে সিমলা স্টেট আসাইলামে ভর্তি করিয়ে দেয় ছেদী। সার্টিফিকেটের সেই নাম দেওয়ার কথা জেনে গিয়েছিল সায়েরী। সায়েরী যাতে মাথা খারাপ না করে তাই ছেদী তার দুই বন্ধুর জিম্মায় তাকে দিয়ে ট্রেনের অন্য কামরায় ও অন্য বাসে চেপে সিমলা ভিলায় এসেছিল। গোটা যাত্রাপথে তাদের দেখা হয়নি।

আসাইলামে ভর্তি করিয়ে চলে যাওয়ার আগে যখন ছেদী চোখের জল সম্বরণ করে মেয়েকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিল, তখন সায়েরী কেঁদে, হেসে একাকার, উত্তেজণায় থুতু ছিট্‌কিয়ে বলেছিল, “আখের মান্‌নাই পাঢ়া না, কে প্যারেমোহানজি মেরে পিতাজি হ্যায়। ম্যায় ঠিক কহা কারতি থি, তু উসে চ্যান সে জিনে নেহি দিয়া, পহলে সার খায়ি ফির রুপায়া খায়ি ফির…” নার্সরা তাকে ধরে-বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল ওয়ার্ডে। ছেদি তার আরাধ্য দেবীকে ‘কুত্তি কি চ্যুত, মু মে লান্ড, ইসকে বাদ গ্যামাক্সিন মিলা দুঙ্গি প্রসাদ মে…’ .ইত্যাদি মনে মনে বলে শাপান্ত করতে করতে বেরিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে কারণ সায়রীকে খিস্তি দেওয়া মানেও বেকার ব্যাটারি খরচা করা। এখন সায়েরীকে বিদায় করে ঝাড়া হাত-পা হয়ে ছেদি মহা-উৎসাহে শিশু পাচার করে, মাইগ্রান্ট লেবারে ফাঁসিয়ে দেয় মুখ্যু-সুখ্যু বান্দাদের। সিমলা স্টেট আসাইলামে আপাতত সায়েরী কমিটেড; সে মায়ের জন্য কাঁদে, টুপি বোনে মনে-মনে, সে তারাসাং-দারাসাং-এর জন্য কাঁদে, হাওয়া মানুষগুলোর জন্যও কাঁদে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর গান গায়, এমনকি নাচেও।

প্রচ্ছদের ছবি- রাম কুমার
অলঙ্করণ- মিশুক শান্তনু

সম্বিত বসু

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের গল্পকার, কথাসাহিত্যিক। নিবাস কলকাতার ভবানীপুরে। চলচ্চিত্রবিদ্যায় পড়াশুনা। গল্পপত্রিকা ‘পরিধি’তে নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে কলকাতাকেন্দ্রিক বহু সমান্তরাল পত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখেছেন। প্রকাশিত উপন্যাস, ‘গৃহস্থগীতি’।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top