আজ শনিবার, ১৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

অভাগার স্বর্গলোভ

গুচ্ছ কবিতা

।। অপর্ণা হাওলাদার।।

আমাদের সব ভবিষ্যৎ প্রকল্প বানচাল হয়ে গেছে। 
কিন্তু আমরা এখনো অংশীদার হতে পারি কিছু মহত্ত্বর দুঃখবোধের
আমরা দুজন মিলে আমাকে খুন করে অন্তত 
কালরাতে যৌথভাবে ফেরারি হতে পারি

আমি এবং কয়েকজন

আমাদের প্রয়োজন নয় প্রেম— মানুষের ঘামের স্পর্শ কিংবা ঔদার্য। 
এইসব ভেঙেচুরে এগিয়ে এসেছি কয়েকজন, নিজেদের পায়ের উপর 
দানা বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে আধুনিক সময়, বিশ্বাসে নেই স্বর্গমর্ত্যপাতাল;  
প্রথমে গিয়েছে বংশের নাম, তারপর আমরা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে 
ক্ষমা করে দিয়েছি আমাদের পিতাদের, পিতামহকেও। এই ক্ষমা, আসলেও, 
মহত্ত্ব নয়, এ কেবল পরিত্রাণ পাওয়ার নামে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলা—
আমাদের কেবল সম্মুখে এগিয়ে যাবার নেশা, আমাদের প্রয়োজন 
ব্যাকপ্যাকে রাখা তোয়ালে-টুথব্রাশ এবং একটি মাত্র জামাপাজামা,  
এইসব জামাও কেবল পরিধানযোগ্য, এর ললিত কারুকার্য নেই; 
এই হলেই চলে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে সবদিন— আমাদের এমনকি তুমুল অসময়েও 
মনে পড়ে না প্রিয় কোনো বন্ধুর মুখ,  মুখিয়ে আছে যদিও কিছু গৌরী সেন – 
পথ নেই ঘর নেই আমাদের দুঃখের দিনে বিয়ারের গ্লাস আছে, বন্ধুর কাঁধ থেকে 
মাথা তোলবার প্রয়োজনবোধই নেই। এই নেই, এই না থাকাতেও আমাদের 
আনন্দ আছে। নিজেকে চেনার আনন্দ। না ফুরিয়ে যাবার সুখ আছে। 

আমাদের আর কিছু না থাকুক, পাপেপূণ্যে সুখেব্যথায় এইসবকালে—
আমাদের আমরা আছি। অবশেষে আয়নার সামনে যেতে এত সহস্রাব্দ পর
দেখো, অনুভব করো, আমরা কেউ আর ভয় পাচ্ছি না।


অভাগার স্বর্গলোভ

মন্দির ভেবে কালরাতে মসজিদে ঢুকে গিয়েছিলাম 
একইরকম প্রহরায় বসানো ছিলো, 
উঁচু দেওয়ালের ভেতর দেখতে পারিনি অতশত 
পাঁচিল টপকাতে গিয়ে তাই বুঝিনি কই ঢুকলাম – 
প্রাণের প্রণীত ব্যাকরণ ভুলে আরও কিছুদূর হামাগুড়ি দিয়ে 
ঈশ্বর ভেবে হাত তুলে বললাম 
জানি না এইসব কোথায় কখন কবে মুখস্থের মত আছে, তাঁর নাম – 
“যিনি সবকিছুকে পুনরায় সৃষ্টি করেন, 
যার থেকে সবকিছু অগ্রসর হয়, 
যার কাছে সবকিছু অবশ্যই ফিরে যাবে…” 

এইটুকু বলে একঘেঁয়ে লাগলো তাই ঈশ্বর বা আল্লাহর ঘর ছেড়ে বের হয়ে দেখি 
দারুণ ক্ষুধা ছিলো সমস্ত শরীর কাঁপছিল 
শিশু যেমন মায়ের মত যে কোনো নারীর বুকে মুখ পুরে দিতে চায়, 
এত বাছবিচারে কি চলে অভাগার স্বর্গলাভ, খোদা, বান্দা পাপীরও অধম; 
ধুর শালা ঈশ্বর ডাকার কথা ছিলো – 

যা পারি তাই দিলাম প্রভু, বাকিটা তুইই বুঝে নিস নিজের হিসাবমতো 
যা পারি তাই দিলাম মা, বাকিটা তুইই বুঝে নিস নিজের হিসাবমতো


যোগাযোগ

এলাম আবার। বারবার আসি। এভাবেই, জানো—
তোমাদের এই অহংকারের দাবানল কিছুটা ম্লান হলে
আমাকে আসতে হয় পৃথিবীতে—
ঐ আগুনে ঘিয়ের কয়েক ফোঁটা হওয়ার চাইতে বড় 
যোগ্যতা আমার ছিলো না কোনো জন্মেই, 
ফিরে আসতে চাইলেই আসা যায়, অথচ
পরিব্রাজনের লোভ আমাদের বড় হতে হতে 
স্থিরতা পুড়ে যায় বেদনার সবকটি গ্রাহ্য সড়ক থেকে; 
কিছুটা জলের লোভে—
হয়তো বেশিটাই খুঁজে নিতে মানুষের যেকোনো মুখ, 
আমি চেনা ঠিকানা ভিন্ন সব বাড়িতে কড়া নেড়ে নেড়ে যাই 

পান্থশালা ভেবে ঢুকে পড়ি হিমঘরে আবার – 
এভাবেই আসি। বারবার। 

এই জন্মে আমাকে ফেরাও কেউ!


আত্মশ্লাঘা

কাল রাত দশটা আঠাশে আমার বাম চোখ থেকে কর্নিয়া খুলে মেঝেতে পড়ে গেল।

অনেকদিন ধরেই আমার মনে হচ্ছিলো, কিছু একটা খুলে পড়ে যাবে,
আশা করছিলাম, কান বা একটা হাত গেলে ভালো হয়।

ডান চোখটা আমার আগে থেকেই কমজোরি,
তবুও প্রায় দশটা পঁয়ত্রিশে খুঁজে পেতে উঠিয়ে নিলাম কর্নিয়াটা
মেঝেতে একটু বাদামী দাগ বসে গেছে, বুঝতে পারছি –
কিন্তু পরে সেটা ঠিক করে নেওয়া যাবে

গত আঠারো ঘণ্টা ধরে আমি দরজায় লাগানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
আমার ডান হাতের তালুতে বাম চোখের কর্নিয়া
কিছুতেই কোটরে বসানো যাচ্ছে না আর।

মেঝেতে কিছুটা থেঁতলে যাওয়ার পর আকৃতি ভীষণ বদলে গেছে।
কিন্তু থেঁতলানো কর্নিয়াটা তালুতে দেখতেও আমার খারাপ লাগছে না।

একচোখের মানুষের এমন হয় হয়তো।


প্রস্তাব

আমাদের যৌথ প্রকল্পের সবকিছু ভেঙেচুরে গেছে; 
সেই দালান হাতড়ে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না আমাদের পুরানো আঙুল—
তবুও প্রতিবিম্বের কাছে এলে বারবার মনে হয়,
আমাদের, দেখো, অমিলের চেয়ে বহুলাংশে বেশি ছিল মিল,
এই তল্লাটে তুমি আর আমি ভিন্ন কেউ জানেনা সেই গাছের বাকল, 
ঘষেমেজে কার গায়ে তুলে দেবে পাখির লোমের মতো নরম দুপুর; 
এই তল্লাটে কেবল আমরাই দুজন পায়েপায়ে ফিরে আসতে পারি
ঠিকানা না রেখে মিলিয়ে গেছে যেসব নদী
তার উৎসের দিকে  – 
প্রকৃতঅর্থে আমরাই কেবল দুইজন গভীরভাবে আমাকে ঘৃণা করি 
এত ঘৃণা কোনো মাঝরাতে উঠে গলা টিপে ধরেনি আর কারো কোনোদিন। 

আমাদের সব ভবিষ্যৎ প্রকল্প বানচাল হয়ে গেছে। 
কিন্তু আমরা এখনো অংশীদার হতে পারি কিছু মহত্ত্বর দুঃখবোধের
আমরা দুজন মিলে আমাকে খুন করে অন্তত 
কালরাতে যৌথভাবে ফেরারি হতে পারি। 




অপর্ণা হাওলাদার


জন্ম বরিশাল, বেড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বর্তমানে আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। ঢাকা শহরের উদয়ন বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ভিকারুন্নিসা নুন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। ২০১১ সাল থেকে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে প্রবাসে, ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি শেষ করেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় থেকে। মূল কাজের ক্ষেত্র পরিবেশ ও কৃষি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top