আজ বৃহস্পতিবার, ২৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

হাওর কাহন, একটি ভাট কবিতা

।। সজলকান্তি সরকার ।।

প্রথমে গুরুর নামটি, জানি খাটি, অন্তরে আমার,
মাতা-পিতার চরণ বন্দি, আমি গুনা’গার
জেলা সুনামগঞ্জেতে, আছে তাতে, নগদাপাড়া গ্রাম,
সেই গ্রামেতে বসত করি, সজল আমার নাম
আমার মনের আশা, ভালোবাসা, খাল-বিল-হাওর,
লিখতে চাই মনের কথা, কবিতার ভিতর
আমি-নই পদকর্তা, লিখতে বার্তা, মনের পূর্ণ আশ,
লিখলাম শুধু মনোবাঞ্ছা, কবিতারও দাস
বলি বিনয় করি, মান্য ধরি, শোনেন দিয়া মন,
কালিদহ সাগর ছিল, এই হাওর তখন
তার পরের-কথা, ভিন্ন বার্তা, কী বলিব আর,
পলি জমে ভরে উঠে, হাওরেরও পাড়
গড়ে বসত বাড়ি, কেমন করি, আদিবাসীগণ,
বাঘ-শিয়ালের ভয় ছিল, হাওরে তখন
খাইত জংলার বাঘে, হিজল বাঘে, দিনের দুপুর,
মা-বাপে জানিত না, কি হইল পুত্রর
শিন্নি মানত্ করে, খোদার ঘরে, পুত্রর প্রাণের আশায়,
অভাগারে বাঘে খায়, কে তারে বাঁচায়
আছে পরের কথা, ভদ্র শ্রোতা, শোনেন দিয়া মন,
আল্যুয়া-জাল্যুয়াবসতি, করি গো বর্ণন
জাল্যুয়া মাছ ধরে, কেমন করে, হাওর-নদী-বিলে,
সাপ-বিচ্চুর ভয় ছিল, নল-খাগড়ার তলে
বুকে সাহস নিয়া, কুচ দিয়া, মাছে দিত ঘা
বড়ো মাছ ছোট লাগলে, তারা খাইত না
খাইত মাছের পেডি, রান’ত বেডি, ভাজাও রসায়
মাছের তেলে মাছ ভাজি, মনে যাহা চায়
খাইত মহাশোল, স্বাদে অতুল, ভোজনে বিলাস
পাথরকাটা গভীর স্রোতে, ডোয়ারেতে বাস
ছিল গহীন ডোয়ার, জলের আধাঁর, মাছের বসতি,
জাল যার জলা তার, এই ছিল রীতি
আইল্য ইজারাদার, কৈবর্ত সার, জলা হইল বিক্রি,
মাছগুলি বেঁচে তারা, ধরে খায় পাখি
নাই কুড়া পাখি, খাঁচায় রাখি, আউস করে পোষে,
স্বাদুমাছ তেমন নাই, ইজারার দোষে
বিলে সেচ দেয়, ধরিয়া নেয়, মাছের বংশ সব
এই বিলে আর হয়না, মাছের জলরব
বিলে মাছের আকাল, নিদান কাল, কী হবে এখন,
জাল্যুয়ানিরে লইয়া জাল্যুয়া বৈদেশে গমন
বলি হাল্যুয়ার কথা, আমার পিতা, জমি করে চাষ,
শাইল-বোর ফলাইয়া, খায় বারোমাস
যখন বর্ষা আসে, জলে ভাসে, কাম-কাজ নাই,
নাইওরীর আনাগুনা, নতুন জামাই
যখন হেমন্ত মাস, কী সর্বনাশ, ফসলের তরে,
মায়ে-ঝি’য়ে ব্রত করে, ধানের গুছি ধরে
ধানে গোলা ভরে, চাল কাড়ে, চাল-কাড়ানির মা,
দিন যায় বছর যায়, চাল ফুড়ায় না
খায় দুধে-ভাতে, একসাথে, নাতি-পুতি লইয়া,
ধানখেতে বর্গী আসে, অংশিদার হইয়া
তারপর কী হইল, পেশা গেল, রীতিনীতি নাই,
হাওর বিল ধ্বংস করে, করিছে কামাই
আইল ইরি ধান, কলের গান, মাটির সুর নাই,
জমিনেতে সার লাগে, হয়না বুট-কালাই
হয়না হষ-কিষ্যি, তিল তিশি, ঠিক আগের মত
কীট-নাশক ধ্বংস করল, মাটির গুণ যত
কত গুণীজন, জন্ম গ্রহণ, হইল হাওর পাড়ে,
হাসন রাজা, আবদুল করিম, বিশ-চরাচরে
হয়না গানের আসর, বাউলা অন্তর, সকলে মিলিয়া,
পদ্মপুরাণ গায় না বধু, উষারাতে বৈইয়া
নাই ভাটিয়ালী, বৈঠা খালি, নদী গেছে মরে,
বেরীবাঁধে হাওর খাইছে, তিল-তিল করে
নেই জলারণ্য, বৃক্ষশূন্য, নল-খাগড়ার ঝোপ,
কান্দাজুড়ে হিজল-করচ, নেই আগের রূপ
নেই চারণভূমি, চাষের জমি, হইতেছে ভরাট,
গোয়াল ঘরে নাই গরু, নাই খেলার মাঠ
মাঠে ইটভাটা, কৃষক বেটা, দিছে বড়ো করি,
কুঁড়ের ঘরে ইট লাগাইছে, ঝরিণা সুন্দরী
ঘরে ঝিলমিল বাতি, পসর অতি, দরজা দিয়া খিল
কারো সাথে কয়না কথা, বড়ো হইছে দিল
চালায় কলের গাড়ী, মল্লের বাড়ি, নাম হইছে তার
পাড়া পড়শি দেখলে লাগে, কাঁটা মান্দার
চলে কলের নাউ, ভাটির গাঁও, জলে দিয়া ঢেউ,
জলজউদ্ভিদ শেষ হয়, কয়-না কথা কেউ
মরে শাপলা-শালুক, জল তালুক, হইতেছে লুপাট,
আগের মত নাই ঢেউ, নাই জলের ঘাট
হবে মরুভূমি, ধানের জমি, আমার মনে হয়,
খেলছে খেলা রঙ্গিলা, সারা হাওরময়
হাওর অমূল্য ধন, মানিক কাঞ্চন, জুড়ি মেলা ভার,
মিঠাপানি রসের মাটি, নেই কোথাও আর
একখান কথা আছে, বলি ফিছে, বিনয় করিয়া
ঠুলিমুচি খেলিও না, এই হাওর লইয়া।।

সজলকান্তি সরকার

হাওর গবেষক ও ‘হাওরপারের ধামাইল (হাপাধা) বাংলাদেশ। মধ্যনগর, সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top