।। ইমরান আল হাদী ।।
শিবু পালের চেতন-অচেতনের মধ্যবর্তী অবস্থা থেকে পূর্ণ বোধ শক্তি ফিরে পেলে রাতের ঘটনাটির একটি সরল কার্যকারণ খুঁজতে থাকলে সে আরও ধোঁয়াশায় পরে যায়। সে দারুণ শঙ্কায় পরে যায় যেহেতু তার নতুন চাকরি আর চাকরিতে ঢোকার মাস কয়েকের মধ্যে এ সংকট; আর সে চাকরির সুযোগ সুবিধা ছুটিছাটা সম্পর্কে কিছুই জানেনা, এও জানে না সে ভর্তি আছে কোন্ হাসপাতালে।
শিবু পালের পা
পরপর কয়েকটি প্রচণ্ড শব্দে শিবু পালের পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠে। তার কানে তালা লেগে যায়। রাস্তার পাশের দোকান গুলি আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। রাত একটু বেশি হলে রাস্তাটি ফাঁকা হয়ে যায় তবু দুইটা রিকশা একটা সিএজি একটা মোটর সাইকেল রাস্তার মাঝে পরে থাকে। আরোহী বা চালক চোখের নিমিষে হাওয়া হয়ে যায়।
শিবু পাল হতচকিত হয়ে প্রথমে একটু দৌড়ায় আর কোনদিক তার জন্য নিরাপদ সে সিদ্ধান্তহীনতায় রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে। শিবু পাল সর্বশেষ শব্দটি যখন শুনতে পায় তখন তার মনে হয় তার বাম পা বুঝি তীব্র শব্দে ফেটে গেছে আর সে তীব্রতায় তাকে ছিটকে ফেলে দেয় রাস্তায়।
শিবু পাল সোডিয়াম লাইটের আলোয় দেখতে পায় ঈষৎ উষ্ণ কালো তরল তার পা বেয়ে ঝরে পড়ছে। আর তখনই তার মনে হয় সেই কালো তরলের চেয়েও গভীর অন্ধকার নেমে আসে তার চোখে। মনে হয় গভীর জলে ডুবে যাচ্ছে সে আর তখনি তীব্র আলোর ঝলকানি তাকে এ আকস্মিক ঘটনা থেকে ছিটকে দেয় দূরে, এমন কি তার নিজ থেকেও দূরে। তবু কিছু কালো– কালোর অধিক, কালো পোষাকে ধুপধাপ বুটের শব্দে কিছু মানুষ শিবু পালকে ঘিরে ধরে।
শিবু পাল চোখ মেলে তাকালে তার চোখে যে আলো এসে পরে সে আলো কোমল আর সহনীয় মনে হয়। আর সে আলোর ভিতর থেকে মায়ের মুখ ভেসে উঠলে দেখে স্যালাইনের ব্যাগ থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়া ফোটার চেয়ে দ্বিগুণ হারে তার মায়ের চোখ থেকে জল ঝরছে। তার মনে হয় জল পরার হার দ্বিগুণ তিনগুণ পাঁচগুণ করে বাড়তে বাড়তে সহস্র ফোঁটায় ঝরে পরছে এবং শিবু পালের মনে হতে থাকে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে সে শুয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তার প্রচণ্ড শীত অনুভূত হয়।
শিবু পাল তার পরিপার্শ্ব দেখে বুঝে নেয় সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। তখনই তার মা তাকে আলগোছে ডাক দিলে সে দেখতে পায় বাস্তবিক তার মা তার পাশে বসে আছে। শিবু পাল বুঝতে পারে না তার মা কীভাবে এত দূরে এলো আর তখনই তার মনে পরে ,সেও একটি হাসপাতালে অতিসম্প্রতি চাকরি পেয়েছে। আর সে হাসপাতালের নামটি সে মনে করতে পারে না বা সে কখনই সে হাসপাতালের নাম মনে রাখতে পারেনি।
এমনকী তার মাকেও বলতে পারেনি। তার মা যখন তাকে জিজ্ঞাসা করে কোথায় কাজ পেয়েছে তখন সে কেবল বলছিল একটি হাসপাতালে। যেহেতু সে প্রায় শিক্ষাহীন আর তার কাজটাও স্বভাবতই নিচু পদের তাই নাম জানা বা না জানার মধ্যে কোন লাভ ক্ষতি সে খুঁজে পায় না। আর কোন প্রতিষ্ঠানের নাম বিভিন্ন জনের নামের সাথে মিলিয়ে কেন যে রাখা হয় তাও সে বুঝতে পারে না।
শিবু পালের চেতন-অচেতনের মধ্যবর্তী অবস্থা থেকে পূর্ণ বোধ শক্তি ফিরে পেলে রাতের ঘটনাটির একটি সরল কার্যকারণ খুঁজতে থাকলে সে আরও ধোঁয়াশায় পরে যায়। সে দারুণ শঙ্কায় পরে যায় যেহেতু তার নতুন চাকরি আর চাকরিতে ঢোকার মাস কয়েকের মধ্যে এ সংকট; আর সে চাকরির সুযোগ সুবিধা ছুটিছাটা সম্পর্কে কিছুই জানেনা, এও জানে না সে ভর্তি আছে কোন্ হাসপাতালে।
আর এই প্রশ্নের উত্তর সে পেয়ে যায় যখন একজন নার্স তার বেডের কাছে আসে এবং শিবু পালের হাতের ক্যানোলায় ইঞ্জেকশন দিতে দিতে বলে, শিবু পাল যেহেতু এই হাসপাতালেই চাকরি করে তাই সিঙ্গেল ক্যাবিন পেয়েছে। আরও বলে সার্জারি বিভাগের প্রধান তার অপারেশন করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন শিবু পালের কিছুটা নির্ভার লাগে।
যখন আরও পরে তার মা সুমিতা রানি পাল ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে, ‘এক পা নিয়াও তো কত মানষে বাইচ্চা আছে জীবন চালায় কাজ কাম করে।’ তখন শিবু পাল হতচকিত হয়ে যায়, সে দুই হাতে ভর দিয়ে বসে পড়ে তাতে তার মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে আর সে দেখতে পায় বাম পায়ের হাঁটুতে সাদা ব্যান্ডেজের পোটলা ; এবং হাঁটুর নীচ থেকে পা নেই। আর এই পা না থাকায় তার মধ্যে কোনও উদ্বেগ বা হাহাকার সে টের পায় না। শিবু পাল ধীরে শুয়ে পরে আর তার খুব ক্লান্ত লাগলে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
শিবু পালের ঘুম ভাঙে প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে। তার বাম পায়ে চুলকায় আর এ চুকানি এত অসহনীয় যে, সে তার মাকে বাম পা চুলকাতে বললে সে জানতে চায় পায়ের কোথায় চুলকায়; তাতে সে তার মাকে বলে পায়ের গোড়ালিতে। শিবু পালের মা প্রচণ্ড দ্বিধায় পড়ে যায়। অন্যদিকে শিবু পাল বারবার তাগাদা দিলে তার মা বাম পায়ের গোড়ালি কীভাবে চুলকাবে এই সমস্যার কোন সমাধান পায় না। যেহেতু শিবু পালের বাম পায়ে গুলি লাগার কারণে হাঁটুর নীচ থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে।
শিবু পালের বাম পায়ের চুলকানি বিষয়ক সমস্যা ও জটিলতা চলাকালীন কেবিনের ভিতরে দুইজন লোক আসে। তাদের সাথে আসে বড় ডাক্তার যিনি শিবু পালের অপারেশন করেছিলেন। ওই দুই জন লোককে শিবু পাল চিন্তে পারে। চিন্তে পারে এই কারণে যে তারা পুলিশি পোশাকে ছিল। শিবু পালের পা হারানো পরিস্থিতিতে, তার কাছে তারা যেন আরো বেশি পুলিশ হয়ে ওঠে। তবে তাদের আসার কারণ সে বুঝতে পারে না।
তারা শিবু পালকে নানান প্রশ্ন করতে থাকে। কেন অত রাতে শিবু পাল রাস্তায় ছিল? কোথায় থাকে এর আগে কোথায় কাজ করতো এই সব নানান বিষয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। সবশেষে একটি নাম বলে আর জানতে চায় তার সাথে কোন পরিচয় বা যোগাযোগ ছিল কিনা। অতঃপর তারা চলে গেলে শিবু পাল বাম পায়ের চুলকানি বিষয়ক সমস্যা ও জটিলতা আর অনুভব করে না।
এর মধ্যে শিবু পাল বিভিন্নজন যেমন তার সহকর্মী, নার্স ও ডাক্তারদের কাছ থেকে টুকরো টুকরো কথা এবং সবিশেষ তার মায়ের মুখের জবানে সে জানতে পারে, সে যখন ওই রাতে তার বাসা থেকে হেঁটে নাইট ডিউটিতে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিল তখন সেই রাস্তায় আইনের লোক ও এক খারাপ লোকের সাথে কোন ধরনের সমস্যা হয় আর সে সমস্যার মধ্যে পড়ে যায় শিবু পাল। শিবু পালের মায়ের বয়ানে সেই ফায়ার ক্রস বা ক্রস ফায়ার জাতীয় কোন কিছুর মধ্যে পড়ে যায় সে। শিবু পালের মায়ের ধারণা, এতে সব দোষ তার সে যদি এর মধ্যে ঢুকে না যেত তবে সম্মানিত লোকদের কাজে বিঘ্ন ঘটতো না সেও তার পা হারাতো না।
শিবু পালের মা যখন এ সব কথা বলছিল আর শিবু পাল একটি ঠাণ্ডা সেদ্ধ ডিম খাচ্ছিল তখন জন তিনেক লোক তার কেবিনে ঢোকে এবং তারা শিবু পালের কিছু ফটো তুলতে ও কথা বলতে অনুমোদিত চায়। শিবু পাল বা তার মা কিছু বলার আগেই তারা শিবু পালের কিছু ছবি তুলে ফেলে। আর তারাও ঐ পুলিশি পোষাক পড়া লোকদের মত কিছু প্রশ্ন করে। তাদের কেও শিবু পাল চিনতে পারে। তারা টিভিতে থাকে খবরের কাগজে ভালো ভালো কথা লিখে। শিবু পাল বুজতে পারে সে একটি খবরের বিষয় বস্তু। সে কারণে এই সব লোক গুলো যেন শিবু পালের কাছে অধিক খবরের লোক মনে হয়। শিবু পাল যা জানে না তাও তারা তার মুখে থেকে বের করে নিতে চায়। যেন সে যা না, তারা তাকে তারও অধিক কিছু বানাতে ব্যাকুল।
লোকগুলো চলে গেলে শিবু পাল তার মাকে বলতে থাকে যে তার বাম পায়ের পাতায় একটি নীল ডুমো মাছি বারবার পড়ছে আর বোবো শব্দ করছে। সে তার মাকে মাছিটি তাড়াতে বললে, শিবু পালের মা আবারো দ্বিধায় পরে যায় সে কী করবে তা বুঝে উঠতে না পেরে ঠায় বসে থাকে। শিবু পাল মাছির যন্ত্রণায় অস্থির হলেও তার মা কোনো মাছি বা পায়ের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না।
শিবু পালের চুলকানি ও নীল ডুমো মাছি পড়া বিষয়ক জটিলতা হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন আরো কয়েক বার ঘটতে থাকে এবং শিবু পালের কাছে আরো কয়েক বার পুলিশি পোশাকের লোক ও ছবি তোলা খবরের লোকেরা আসে। তাতে শিবু পাল একটি বিষয় লক্ষ করে যে এ সকল লোকেরা তার কাছে আসলে তার চুলকানি ও নীল ডুমো মাছি পায়ে পড়া বিষয়ক জটিলতা দেখা দেয়।
সে আরো নির্দিষ্ট ভাবে লক্ষ করে পুলিশি পোশাক পড়া লোকেরা আসলে তার বাম পায়ে চুলকায় এবং ছবি তোলা খবরের লোকেরা আসলে তার বাম পায়ে নীল মাছি বসে।
শিবু পাল এ সকল সমস্যা থেকে মুক্তি পায়! তার কাছে আর পুলিশি পোশাক পরা লোকেরা আসে না এবং তার বাম পা চুলকায় না। তার কাছে ছবি তোলা খবরের লোকেরা আসে না আর নীল ডুমো মাছি তার বাম পায়ে বসে না। শিবু পালের পায়ের ক্ষত শুকিয়ে যায় এবং সে ‘একটি পা’ না থাকা পরিস্থিতির সাথে ধীরে মানিয়ে নিতে থাকে।
শিবু পাল তার পা হারানোর সাথে চাকরি হারানোর যে আশঙ্কার ছিল সে আশঙ্কা কেটে যায়। যখন তাকে কর্তৃপক্ষ কাজে যোগ দিতে বলে এবং সহযোগিতা আশ্বাস পায়।
শিবু পাল যেদিন তার পা হারানোর পর, প্রথম কাজে যাবে সেদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। সে যখন তার ডান পায়ের জুতাটি পড়লো তখন তার মনে হল, তার বাকি জীবনে এক পাটি জুতা অব্যবহৃত থেকে যাবে। তখন তার মনে পড়ে যায় এ জুতা জোড়াও প্রায় নতুন। সেই রাতেও এই জুতা জোড়া তার পায়ে ছিল। আর তার সাথে জুতা জোড়াও হাসপাতালে চলে গিয়েছিল। বাম পাটি জুতায় রক্ত লেগেছিল পরে তার মা, তা পরিষ্কার করে রেখে দেয়। এখনো জুতা জোড়া প্রায় নতুনের মতই আছে আর শিবু পাল ভাবে বাম পায়ের জুতাটি নতুন থেকে যাবে সব সময়।
শিবু পাল কাজে যোগ দিলে তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে যায় দুটি ক্রাচ। সে ক্রাচে ভর দিয়ে ধীরে হেঁটে যায় হাসপাতালের এক ইউনিট থেকে আরেক ইউনিটে। মৃদু ঠুক ঠুক শব্দ চলে যায় তার সাথে সাথে। শিবু পাল হাসপাতালের লম্বা করিডোর দিয়ে হেঁটে গেলে তার পরিচিত যারা তারা একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করে, তারা দেখে শিবু পাল যখন ধীরে হাঁটে তখন তার কাটা বাম পায়ের নিচে একপাটি জুতা যেন হেঁটে যায়। তবে অনেকে ভেবে নেয় আলো আঁধারির বিভ্রমে এ রকম দেখা যেতে পারে। যদিও মানুষ বিভ্রম বলে মনে করে তার পরেও তারা বারবার একই দৃশ্য দেখে যেতে থাকে; শিবু পালের কাটা বাম পায়ের নিচে এক পাটি জুতা হেঁটে চলে। অন্যদিকে শিবু পাল লক্ষ করে তার জুতা জোড়া সমান ভাবে পুরোনো হয়ে যাচ্ছে।
২৬.০১.২০২১
ইমরান আল হাদী
কবি, কথা সাহিত্যিক। জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সাল। বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানাধীন বোয়ালিয়া গ্রামে। সে গ্রামেই বসবাস। প্রকাশিত বই ‘হায়াতুননেছা’ (কবিতা ২০২১)