আজ বৃহস্পতিবার, ৮ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিকল্পহীনতার কুৎসিত রাজনীতি

উত্তর সম্পাদকীয় ।। নাদিয়া ইসলাম ।।

গত ১ জুলাই থেকে যে কোটা সংস্কারের আন্দোলন চলছে, তাতে কোনো পক্ষই সংরক্ষিত নারী কোটা তুলে দেবার কথা বলে নাই। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে এখনো নারীদের সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন আছে। এছাড়াও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ৫% থেকে ১% কোটায় নামিয়ে নিয়ে আসাও সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। স্পষ্টতই এটা বলা দরকার, শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকার ও শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের পোষা বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার একাংশ এই আন্দোলনকে যেভাবে একদিকে রাজাকারদের আন্দোলন বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছে, সেভাবেই আন্দোলনকে নারী বিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও চোখে পড়েছে। আর সেই অপ-রাজনীতি সূত্রেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত নারী কোটা তুলে দিয়ে তার দায় ছাত্রদের ওপর বর্তাতে চায়। অথচ এই আন্দোলনে কোথাও নারী কোটা তুলে দেওয়ার এক বর্ণও দাবি ছিল না। আওয়ামী মিডিয়া ও ভারতের গোদি মিডিয়া এবং চেতনাজীবী ও দিল্লিপন্থীরা শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজকেও মিথ্যা বয়ানে বিভ্রান্ত করেছে যে এই আন্দোলন রাজাকারদের, এই আন্দোলন নারী স্বাধীনতাহরণকারীদের। এই গোয়েবেলসীয় বয়ানকে উপমহাদেশের জনমানসে প্রতিষ্ঠা করতেই আওয়ামী বিচারালয় নারী কোটা তুলে দিয়েছে। অমর্ত্য সেন এবং মার্থা নাসবৌমের কেপাবিলিটি এ্যাপ্রোচের সূত্র ধরে আমরা জানি, একটা সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কী কারণে আমাদের এই সংখ্যালঘু কোটা সংরক্ষণ প্রয়োজন। আমাদের বুঝতে হবে, ইন্টারসেকশনালিটি এমন কোনো উপলব্ধি না যেখানে নারী পুরুষ নন-বাইনারি সমকামী বিষমকামী বাঙালি চাকমা গারো হিন্দু মুসলমান নাস্তিক আমরা আলাদাভাবে সমাজে বাস করি। আমাদের বুঝতে হবে আমাদের সবাইকে নিয়ে আমাদের সমাজ। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টারা এইসব বিষয় আমলে আনলে তো আমাদের কারুরই কথা বলার প্রয়োজনই হতো না। এছাড়াও এতোগুলি লাশ পড়ে যাওয়ার পরে বাঁশি বাজানো নিরোর টনক নড়লে এখন তড়িঘড়ি করে পাছার কাপড় বাঁচানোর চেষ্টা করলে এরকম সিদ্ধান্তই অবশ্য আসার কথা, নয় কি?

বিকল্পহীনতার কুৎসিত রাজনীতি

দেশে যাবার ই-টিকেট হাতে নিয়ে বসে আছি।

মাবাবাবন্ধুরা বলছেন, যেও না। যেও না। যেও না।

এতো অস্থির এতো ক্লান্ত এতো নিরুপায় এতো বিপন্ন নিজেকে কোনোদিন মনে হয় নাই আমার। যারা দেশে যেতে না করছেন তারা সবাই আমার মতো বাংলাদেশের বাইরে আছেন। নিরাপদে আছেন। তাদের সাথে ইন্টারনেট আছে, তাদের ফোন কাজ করছে। আমি জানি তারা সুস্থ আছেন, আমি জানি তারা বেঁচে আছেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছে বন্ধু লিমা আপার কথা। লিমা আপার একমাত্র বাচ্চা স্বপ্নীলের কথা। স্বপ্নীলের বয়স ১৭। এই সামনের অগাস্টে ১৮ হবে। লিমা আপার সাথে শেষ কথা হলো তিন দিন আগে। তখনো বাংলাদেশে ইন্টারনেট কাজ করছে। আমাকে লিমা আপা বললেন “সপু তো রাস্তায় নামতে চাচ্ছে। আমি দিচ্ছি না”— আমি বললাম, “স্বপ্নীলকে যেতে দাও। ওর সব বন্ধুরা যাচ্ছেন। তুমি যেতে না দিলে স্বপ্নীল অপরাধবোধে ভুগবেন। এই বয়সেই বাচ্চারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তো!”

আমি এখন স্বপ্নীলের খোঁজ পাচ্ছি না। আমার তীব্র গ্লানি কাজ করছে। সবকিছু অসহ্য লাগছে। শেষ খবর যখন দেখলাম, দেখলাম স্বপ্নীলের বয়সী বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেদের বাংলাদেশের পোলিস গুলি করে মেরে ফেলেছে। তাহমিদের বয়স ১৪ আর ফাইয়াজের ১৭। এই মৃত্যুগুলিকে বাংলাদেশ সরকার কিভাবে লেজিটিমাইজ করবে? কোন্‌ ব্যখ্যায় এই মৃত্যুগুলি জাস্টিফায়েড হবে? তাহমিদ বা ফাইয়াজের মতো শিশুদের কি লীগ সরকার জামাত শিবির রাজাকার বানাতে পারবে যেভাবে তারা সবসময় বানায়? গত চোদ্দ বছরে যেভাবে তারা নিজেদের প্রতিটা দায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে অস্বীকার করেছে? যেভাবে প্রতিটা সাগর রুনি অভিজিতের ঘটনায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বীয় ঢঙে নন-এগজিস্টিং জামাত শিবির বিএনপি রাজাকারের ওপর দায় দিয়েছে? তাদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হওয়া সমালোচনার প্রতিটা শব্দকে যেভাবে রাজাকারের ভাষ্য বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে?

ডিভাইড এ্যান্ড রুলের এই রাজনীতি, এই মোল্লাজুজুর ভয় দেখানো, এই এক ওয়ার অন টেরোরের এই “বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে”-র মিথ্যা গল্প, এই এক ইসলামোফোবিয়া এই এক “বাংলা হবে আফগান”-র কাল্পনিক বয়ান এই এক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এই এক একাত্তরের আলাপের এই এক ভাঙা রেকর্ড তুলে নিজেরা বাদে বাকি সবাইকে রাজাকার আলবদর দেশদ্রোহী বানানোর রাজনীতি লাইলাতুল ইলেকশানের অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অবশ্য নতুন রাজনীতি না। বাংলাদেশে যে ধর্মীয় উগ্রবাদের রাজনীতি নাই, তা না। বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদের থ্রেট নাই, তা না। পাকিস্তানকে সোনার ডিমপাড়া হাঁস ভেবে “ওপারেতে সর্বসুখ” ভেবে মনে মনে অর্গাজম হয়ে যাওয়া ‘আশরাফ’ পাকিস্তানকে মুসলিম উম্মাহর অংশ ভেবে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত প্লাস তাহাজ্জুতের ওয়াক্তে আরো একবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বিহারি এলিটিস্টদের দল যে বাংলাদেশে নাই তা না। বিচ্ছিন্নতাবাদী বা তার অপর পক্ষে দুই বাংলা এক করে ফেলার স্বপ্নে বিভোর দলেরও অভাব নাই। কিন্তু এরকম মনে মনে মনকলা খেয়ে স্বপ্নে স্বপ্নেই জিওপলিটিকাল ম্যাপ পালটে ফেলা দল তো পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে সব জায়গায় আছে, নয় কি? তবে বাংলাদেশই সম্ভবতঃ আধুনিক বিশ্বের একমাত্র গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র যে নিজের জনগণের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গণঘৃণা উপেক্ষা করে নিজের জনগণকেই ‘অপর’ করে দেবার রাজনীতিতে যুক্ত। বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মানুষ মুসলমান। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই আওয়ামী লীগ এই সাধারণ মুসলমানকে নিজের রাষ্ট্রে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন বানিয়ে মুসলমানের প্রতিটা চিহ্নকে প্রতিটা দাঁড়িটুপিহিজাবকে রাজাকারের চিহ্ন জঙ্গিবাদের অনগ্রসরতার দেশদ্রোহিতার পাকিস্তানের আরবের বিদেশের অপরের চিহ্ন বলে আলাদা করে দিয়েছে। এবং তা করতে গিয়ে বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি খ্রিশ্চান বা নাস্তিক বা আদিবাসীদের উপর যে খুব ন্যয্য আচরণ করেছে, তাদের প্রাপ্য গণতান্ত্রিক অধিকার দু’লাইন বাড়িয়ে দিয়েছে, এমনও না। বরং শেখ মুজিব যেভাবে বাংলার সকল চাকমা মারমা গারো তঞ্চঙ্গা সহ সকল আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা ভিন্ন জাতিসত্তাকে গায়ের জোরে বাঙালি বানিয়ে ফেলার জাতিবাদী অকালকুষ্মাণ্ডীয় অকালফুলকপীয় আবদার করে গেছেন, তারই কনটিনিউয়েশানে তার সুযোগ্য বাকশালী কন্যা বাংলাদেশে অবৈধ পথে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশের প্রতিটা দলকে একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সেই কেওস থিওরিতে নিয়ন্ত্রিত অর্ডারড পদ্ধতিতে ফ্যাশিজমের বীজ বুনেছেন, হিন্দুদের প্রতিটা দুর্গাপুজার আগের রাতে প্রতিমা ভেঙে, গ্রামের পর হিন্দু গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে তার দায় দিয়েছেন পাশের বাসার সাধারণ নির্বিরোধী মুসলমান মোখলেসের ওপর।

শেখ হাসিনাকে শুধু স্বৈরাচার বললে কম বলা হবে। তিনি এবং তার আওয়ামী লীগ সরকার শুধু স্বৈরাচারী নন, বরং এই সরকার একটা ফ্যাসিস্ট সরকার। স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিস্টের মধ্যে খুব স্বতন্ত্র পার্থক্য আছে। স্বৈরাচারী বা একনায়কতন্ত্রে সর্বময় ক্ষমতা একজনের হাতে থাকে। সে অর্থে হাসিনা অতি অবশ্যই স্বৈরাচারী। কিন্তু ফ্যাশিজম হচ্ছে ম্যাকিয়াভেলিয়ান স্বৈরাচারের মুসোলিনিয়ান বড় ভাই; অতিডান উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ যা ডিক্টেটোরিয়াল পাওয়ার এবং সমস্ত বিরোধীদলের সাপ্রেশানের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখে। এবং আমরা গত চোদ্দবছর এই সাপ্রেশানের সমস্ত রঙ রূপ রস মাধুর্য দেখেছি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বহীনতা বা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা দশ ট্রাক অস্ত্র লেজেগোবরে করার বিচক্ষণতার অভাব বা দূর্নীতির যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, ২১ অগাস্টের বোমা হামলার জন্য তাদের যতভাবেই অভিযোগ করা হোক না কেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যে নির্মম পদ্ধতিতে বিএনপির প্রতিটা সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ নেতৃত্বকে হেনস্তা [পড়েন— কচুকাটা] করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার বুড়িগঙ্গার কালো পানিতে ফেলে দিয়ে বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে যেভাবে চিকিৎসা বঞ্চিত করে প্রকাশ্যে জাতীয় সংসদে বসে তাকে বেশ্যা প্রমাণ করার নোংরা রসিকতা করার কুৎসিত মানসিকতা দেখিয়েছে, সরকারের সামান্যতম সমালোচনা করা সাংবাদিকদের নির্যাতন এবং গুমখুন করেছে, তার কাছে বিএনপি জামাতের সম্মিলিত শয়তানি সব শিশুশ্রেণির দুধভাত এবং এইসব আওয়ামী কর্মকাণ্ড পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন না হলেও বিশেষ পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। স্কোপ অভ পাওয়ার বা কন্ট্রোল মেকানিজমের বাইরে লীগের ইকোনমিক পলিসির দিকে তাকালেও এই ফ্যাশিজমের ভুরিভুরি উদাহরণ দেখা যায় তাদের প্রতি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পদক্ষেপে।

কোটা সংস্কারের এই অতি সাধারণ আন্দোলন সেই কারণেই আজকে এক কথায় এক লাফে একটা সরকারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে।

সরকারী চাকরিতে কোটার সুবিধা চালু হয়েছিলো ১৯৭২ সালে, শেখ মুজিবের হাত ধরে। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে কোটাভুক্ত করা খুব ন্যয্য পদক্ষেপ ছিলো অতি অবশ্যই। ২০২২ এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা যদি ১৭১.১৯ মিলিয়ন এবং সনদভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা যদি ১,৪৭,৫৭৩ [সূত্র-০১] জন হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে জনসংখ্যার বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মাত্র ০.০৮৬%; এই সংখ্যা অতি সামান্য, সত্য। এখন কথা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে আজকে থেকে ৫৩ বছর আগে। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই এখন আর বেঁচে নাই। এছাড়াও হিসাব অনুযায়ী তাদের সন্তানরাও সরকারী চাকরির বয়সসীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন। সেক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নামে ৩০% কোটা সংরক্ষণ আজকের ছাত্রদের কাছে অন্যয্য মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এছাড়া জাল বা ভুয়া সার্টিফিকেটের মাধ্যমে কোটাব্যবস্থার অপব্যবহার বাংলাদেশ দেখে আসছে অনেক দিন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের স্বজনপ্রীতির রাস্তা খোলা রাখার মাধ্যম এই কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ। তো ২০১৮ সালে এই পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে প্রথম আন্দোলন শুরু হয় খুব স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই। আন্দোলনকারীদের পাঁচ দফা দাবি ছিলো “কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা” [সূত্র-০২]। লাগাতার আন্দোলনের মুখে ৪৬ বছর ধরে চলা কোটাব্যবস্থার একাংশ, অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা বাতিল হয় ২০১৯ সালে [সূত্র-০৩]। এরপর এই বছরের জুন মাসে হাইকোর্টের রায়ে বাতিল হওয়া কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল হলে জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয় আবার। এবং এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ এবং নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতেই চলছিলো। ঝামেলা শুরু হয় এই প্রসঙ্গে ফ্যাশিস্ট হাসিনার অনিয়ন্ত্রিত কথাবার্তার মাধ্যমে।

রাজনৈতিক ভব্যতাহীন ড্রয়িংরুমের চায়ের দোকানের চিন্তাহীন অদরকারী অপরিণামদর্শী কথা হাসিনার পুরানো রোগ। বাংলাদেশকে যেহেতু তিনি তার বাপের দেশ বলে ভাবেন, বাংলাদেশের জনগণকে ভাবেন তার চাকর, তাই যা ইচ্ছা তাই বলার অভ্যাসও তার পুরানো। এর আগে অবশ্য এসব উলটাপালটা কথার খেসারত তাকে দিতে হয় নাই। বাংলাদেশীরা বেশিরভাগই হাসিনার পলিটিকাল কারেক্টনেসের শেখ মুজিবকে ফজিলাতুন্নেসা করে দেওয়া আজেবাজে স্থূল রসিকতাকে পাশ কাটিয়ে ভাত খেয়ে মশারীর নিচে ঘুমিয়ে গেছেন পাশ ফিরে। পাশ না কাটালে হাসিনার পোষ্য হেলমেট বাহিনীকে রাস্তায় নামানো হয়েছে। তারা হকিস্টিকের বাড়ি রামদার কোপে সবকিছু জয়বাংলার লাইনে নিয়ে এসেছে। এবারও সেই কারণেই হাসিনা হয়তো ভেবেছিলেন তার এক ধমকেই সব আন্দোলনকারীরা সুরসুর করে “ইয়েস স্যার জ্বি স্যার” বলে আনন্দের গান গাইতে গাইতে শাহবাগ মোড়ে লেফট-রাইট লেফট-রাইট প্যারেড করা শুরু করবেন সাতসকাল বেলা। কিন্তু এইবার সেই ঘটনা ঘটে নাই।

সবকিছুর একটা শেষ থাকে বলেই হয়তো।

এইবার প্রধানমন্ত্রীর আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ সম্বোধন আন্দোলনকারীরা বরাবরের মতো হজম করেন নাই। তারা বরং এইসব অপরায়নে দমে না গিয়ে, রাজাকার ট্যাগে কান্নাকাটি শুরু না করে উল্টাভাবে গায়ের জোরে গলা উঁচু করে বলা শুরু করলেন, “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।” আর লীগের তাবেদাররা স্লোগানের মর্ম, স্লোগানের রাগ অভিমান উষ্মা ব্যঙ্গ ক্ষোভ কিছুই না বুঝে, বা বরাবরের মতো বুঝেও না বোঝার ভান করে স্লোগানের প্রথম বাক্য ধরে বলা শুরু করলেন নিজেকে রাজাকার সম্বোধন করা এই স্লোগান নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতি গভীর অসম্মান প্রদর্শন! এসব মেরুদণ্ডহীন তাবেদারি দালালি পা-চাটা অবশ্য আওয়ামী জামানার পুরানো বিষয়। ইল্লেজিটিমেট আওয়ামী লীগের লেজিটেমিসি ধরেই রেখেছেন জাফর ইকবাল মাসুদা ভাট্টি শাহরিয়ার কবীর রামেন্দু মজুমদার মুন্নি সাহা মামুনুর রশীদ সুপ্রীতি ধর মুনতাসির মামুন নামক জ্বি-হুজুর জাঁহাপনা জপা এস্টাবলিশমেন্টের দালালের দল। তবে সাধারণ মানুষ তো ঘাস খান না। তারা এসব দালালের এসব গলা কাঁপাকাঁপি দেশপ্রেম নামক বস্তাপচা দলকানা চেতনা, এইসব “পাকি বীর্য” “পাকিস্তানের প্রেতাত্মা” ট্যাগের ক্যানসেল কালচার এখন তো আর পাত্তা দেন না। তারা রাজাকার শব্দের কনোটেশান জেনেও, বাংলাদেশের কনটেক্সটে রাজাকারের মতো কুৎসিত অপমানজনক ঘৃণিত শব্দ নিজের গায়ে মাখতে কুণ্ঠিত বোধ করেন না। কারণ এই জাতীয়তাবাদী লেবু গত এক যুগে এতোবার কচলানো হয়েছে যে লেবু বেচারার নিজের তেতো স্বাদে নিজেরই ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি জাতীয় ত্রাহি মধুসূদনীয় ধরণী-দ্বিধা-হও-আমি-গাছে-চড়ি অবস্থা, জনগণের অবস্থা এক্ষেত্রে তো বলাই বাহুল্য।

এবং এ কারণেই এই আন্দোলনের শহীদ আবু সাঈদের হাসিনার পোলিস বাহিনীর সামনে দুই হাত দুই দিকে মেলে রাস্তার ঠিক মাঝখানে নিরস্ত্র দাঁড়িয়ে থেকে বুকে গুলি খেয়ে মরে যাওয়ার হলিউডি দৃশ্যে আমি অবাক নাই। কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু অবাক হই নাই। আমার মনে হয়েছে, এমনটাই হওয়ার কথা। মানুষের যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, মানুষের যখন হারানোর আর কিছু বাকি থাকে না, মানুষের যখন সবগুলি স্বপ্ন মরে যায়, মানুষ যখন এই লাঙল টানার ন’টার পাঁচটার ভাত রাঁধার বাচ্চা জন্ম দেওয়ার বাজার থেকে শিমআলুপটল কেনার মশারির নিচের নিঃশব্দ যৌন সঙ্গমের কোলবালিশের শ্বশুরের কফের ওষুধের বাড়িভাড়ার রসিদের সিগারেটের রিক্সাওয়ালার সাথে পাঁচ টাকা ভাড়া বেশির জীবনের আর কোনো অর্থ খুঁজে পান না, যখন মানুষ তার নিজের অতি প্রিয় জীবনকে নিজেকে বহন করা শরীরকে নিজেকে আইডেন্টিফাই করা মাথাকেও নগন্য মনে করেন, মানুষ যখন নিজেকে নিজের চাইতে তুচ্ছ মনে করেন, মানুষের কাছে যখন দেশ রাষ্ট্র সমাজ এবং পাশের মানুষজন নিজের চাইতে বড় হয়ে ওঠে, তখন মানুষ জুলিয়ান আসাঞ্জ হয়ে ওঠেন, তখন মানুষ শামসুজ্জোহা, নূর হোসেন এবং আবু সাঈদ হয়ে ওঠেন। তখন বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে আসেন। তখন পোলিস টিয়ারগ্যাস র‍্যাবের আর্মার্ড কার ট্যাংক কারফিউ রাবার বুলেট হেলিকপ্টার বার্ড শট হেলমেট হকিস্টিক রামদা কোনো কিছুই আর কাউকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। তখন সাধারণ কোটা আন্দোলনের সামান্য ছিদ্র দিয়ে বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়ে সরকারপতনের আন্দোলনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের পাহাড়ি নদীর ঢল। হ্যাঁ এই আন্দোলনে যে মধ্যসত্তভোগী সুবিধাবাদী অন্যের আগুন লাগা বাড়িতে আলু পোড়ানো দলের উপস্থিতি নাই, তা না। কিন্তু আজকের ভেরিফায়েড বিদেশী মিডিয়ার তথ্য অনুসারে এই যে ১৩৮+ ছাত্রের লাশ পাওয়া গেলো, এই যে বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মাবাবাভাইবোনের কান্নার জান্তব চিৎকারে ফেইসবুক ফিড ভারি হয়ে গেলো, এরা সবাই, এরা প্রত্যেকে তো কোনোভাবেই জামাত শিবির রাজাকার দেশদ্রোহী ষড়যন্ত্রকারী র সিআইএ আমেরিকা ভারত হতে পারে না। মরে যাওয়ার আগে যেই আবু সাঈদের ফিডে শেখ মুজিবকে “মহান নেতা” বলে সম্বোধন করা, তার ফিড খুঁড়ে দেলোয়ার হোসেন সাইদীর মৃত্যুতে জান্নাত কামনা করার একটা পোস্ট পাওয়া গেলেই তো তাকে জামাত শিবির হেফাজত বলে ট্যাগ করা যায় না। আর যদি তারা তা হয়েও থাকেন, তাহলেও কি একটা গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র বিচার বহির্ভূতভাবে রাস্তায় বিনা প্রোভোকেশানে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার অধিকার রাখে? এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে মৃতদের ফরেনসিক এবং ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট অনুযায়ী আবু সাঈদ এবং অন্যান্যদের ওপর যা আক্রমণ চালানো হয়েছে তা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ [সূত্র-০৪]। এই দায় বাংলাদেশ সরকার কী ভাবে এড়াবে এখন? কীভাবে এই মৃত্যু জাস্টিফাই করবে লীগের অবৈধ সরকার?

এই লেখাটা যখন লিখছি, এর মধ্যেই খবর পেলাম ইন্টারনেট এবং মোবাইল পরিষেবা বন্ধ থাকা অবস্থাতেই, কারফিউ জারি থাকা অবস্থাতেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করা হয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী ৯৩% নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। বাকি ৭% এর মধ্যে ৫% মুক্তিযোদ্ধা কোটা। ১% ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আর ১% প্রতিবন্ধী-তৃতীয় লিঙ্গের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তবে সরকার চাইলে এই অংশে কমবেশি করতে পারবে। এখানে কয়েকটা বিষয় উল্লেখযোগ্য। প্রথম কথা হচ্ছে বাংলাদেশের আইন বিভাগ যে স্বাধীন না, এই বিভাগ যে সরকারের নিয়ন্ত্রনাধীন, তা এই ঘটনায় স্পষ্ট। অর্থাৎ সরকার চাইলেই ইচ্ছামতো আইন তৈরি বা বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে কেউ এই নিয়ে আন্দোলন না করলেও সংরক্ষিত ১০% নারী কোটা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক প্রান্তিকের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আরেক প্রান্তিক শিকার করছে লীগ সরকার। গত ১ জুলাই থেকে যে কোটা সংস্কারের আন্দোলন চলছে, তাতে কোনো পক্ষই সংরক্ষিত নারী কোটা তুলে দেবার কথা বলে নাই। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে এখনো নারীদের সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন আছে। এছাড়াও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ৫% থেকে ১% কোটায় নামিয়ে নিয়ে আসাও সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। স্পষ্টতই এটা বলা দরকার, শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকার ও শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের পোষা বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার একাংশ এই আন্দোলনকে যেভাবে একদিকে রাজাকারদের আন্দোলন বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছে, সেভাবেই আন্দোলনকে নারী বিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও চোখে পড়েছে। আর সেই অপ-রাজনীতি সূত্রেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত নারী কোটা তুলে দিয়ে তার দায় ছাত্রদের ওপর বর্তাতে চায়। অথচ এই আন্দোলনে কোথাও নারী কোটা তুলে দেওয়ার এক বর্ণও দাবি ছিল না। আওয়ামী মিডিয়া ও ভারতের গোদি মিডিয়া এবং চেতনাজীবী ও দিল্লিপন্থীরা শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজকেও মিথ্যা বয়ানে বিভ্রান্ত করেছে যে এই আন্দোলন রাজাকারদের, এই আন্দোলন নারী স্বাধীনতাহরণকারীদের। এই গোয়েবেলসীয় বয়ানকে উপমহাদেশের জনমানসে প্রতিষ্ঠা করতেই আওয়ামী বিচারালয় নারী কোটা তুলে দিয়েছে। অমর্ত্য সেন এবং মার্থা নাসবৌমের কেপাবিলিটি এ্যাপ্রোচের সূত্র ধরে আমরা জানি, একটা সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কী কারণে আমাদের এই সংখ্যালঘু কোটা সংরক্ষণ প্রয়োজন। আমাদের বুঝতে হবে, ইন্টারসেকশনালিটি এমন কোনো উপলব্ধি না যেখানে নারী পুরুষ নন-বাইনারি সমকামী বিষমকামী বাঙালি চাকমা গারো হিন্দু মুসলমান নাস্তিক আমরা আলাদাভাবে সমাজে বাস করি। আমাদের বুঝতে হবে আমাদের সবাইকে নিয়ে আমাদের সমাজ। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টারা এইসব বিষয় আমলে আনলে তো আমাদের কারুরই কথা বলার প্রয়োজনই হতো না। এছাড়াও এতোগুলি লাশ পড়ে যাওয়ার পরে বাঁশি বাজানো নিরোর টনক নড়লে এখন তড়িঘড়ি করে পাছার কাপড় বাঁচানোর চেষ্টা করলে এরকম সিদ্ধান্তই অবশ্য আসার কথা, নয় কি?

আর আমি এই কারণে এখনও মনে করি, ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে ৭ অগাস্টের সুপ্রিম কোর্টের রায় ২১ জুলাই টেনে আনার পরেও, এতোদিন গুণ্ডামি চালিয়ে এখন গর্তে পড়ে সুরসুর করে এক দিনের মাথায় কোটা সংস্কার করে ফেলার পরেও এই আন্দোলন থামবে না। থামা উচিতও না। এতোগুলি লাশের, এতোগুলি বাচ্চার মৃতদেহের জবাবদিহিতা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ ছাড়া, এই কথায় কথায় ইন্টারনেট এবং মোবাইল পরিষেবা বন্ধের অসভ্যতার কারণ দর্শানো ছাড়া এই আন্দোলন থামা উচিত না। কোটা সংস্কারের নামে ভিক্ষা দেওয়ার ভঙ্গিতে, ছিঃছিৎকারের তাড়িয়ে দেওয়ার নাক সিঁটকানোর ভঙ্গিতে সুবিধাবঞ্চিত দলগুলির কোটা বাতিল করে দেওয়ার গুণ্ডামি বন্ধ হওয়া ছাড়া এই আন্দোলন থামা উচিত না।

গত কয়েক রাত ধরে আমি ঘুমাতে পারছি না।

না, কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে আমি আমি-কেন্দ্রিক আলাপ বানাচ্ছি না। আমার মতো অসংখ্য মানুষ এভাবে নির্ঘুম অসহ্য রাত কাটাচ্ছেন আমি জানি। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের যে বিনা কারণে শাস্তি দেওয়া হলো, আমাদের বন্ধুদের সাথে পরিবারের সাথে আমাদের বিচ্ছিন্ন করা হলো, কোনোপ্রকার উস্কানি ছাড়া আমাদের বাচ্চাদের মেরে ফেলা হলো, একটা গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের সেই ক্ষমতা থাকা উচিত না। সেই ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের নাই। সেই ক্ষমতা আছে শুধু ফ্যাশিজমের। কিন্তু ফ্যাশিস্ট শেখ হাসিনার পরিবারের নির্মম পরিণতির দায় তো বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের না। আমার না। স্বপ্নীলের না। আবু সাঈদের না। আমি তাই এই সংস্কার হওয়ার নামে যে ফাজলামো করা হলো বাংলাদেশের মানুষের সাথে, সেই সংস্কার নিলাম না। এই প্রতিহিংসার ফাজলামো আমি নিলাম না। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার মুখে আমি পাকিস্তানী দানব আইয়ুব খাঁ আমলের গল্প শুনেছি। আমি বিশ্বাস করি, এমনকি পাকিস্তানী সৈন্যরা এতো নির্মম ছিলো না, এমনকি পাকিস্তানী আমলে এভাবে প্রকাশ্যে রাস্তায় নির্বিচারে নিজেদের ছাত্র মেরে ফেলা হয় নাই। আমি পাকিস্তানী আমলের কোনো ছবিতে দেখি নাই একজন নিরস্ত্র মানুষ দুই হাত দুই দিকে তুলে শান্ত দাঁড়িয়ে আছেন, আর রাস্তার অন্যপাশ থেকে কয়েকশ পোলিস মূহুর্মুহু গুলিতে তাকে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। আমি পাকিস্তানী আমলের কোনো গল্পে শুনি নাই নিজেদের বাচ্চা ছেলেকে আর্মার্ড কারের ভেতর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে রাস্তার ডিভাইডারের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সেই বাচ্চা তখনও জীবিত। রাস্তায় পড়ে তার মাথা থেঁতলে যাচ্ছে। আমি জানি না কবে আমার মাথা থেকে এই রক্তের বুলেটের কালো ধোঁওয়ার সাইরেনের হেলিকপ্টারের পাখার গন্ধ শব্দ দৃশ্য মুছবে, আমি জানি না আমার অভ্যন্তরের ক্ষত আমাদের অভ্যন্তরের ক্ষত কবে শুকাবে। আমি এই সংস্কার নামক ফাজলামো তাই নিচ্ছি না। নিচ্ছি না। নিচ্ছি না। আমি আবু সাঈদের লাশের কসম খেয়ে বলছি, আমি তনুর ধর্ষিত মৃতদেহের কসম খেয়ে বলছি, রানা প্লাজায় শ্বাসরোধে মারা যাওয়া শ্রমিকের রক্তের কসম খেয়ে বলছি, আমি কল্পনা চাকমার নিখোঁজ শরীরের কসম খেয়ে বলছি, আমি এই সংস্কার নামের নাটক নিচ্ছি না। আমি এই দয়া করে ভিক্ষা দেওয়া ভঙ্গির কোটা সংস্কার নিচ্ছি না। আমি এই সরকারের কাছে এতোগুলি লাশের জবাবদিহিতা ছাড়া আমার অবস্থান থেকে সরছি না। আমি এই অবৈধ সরকারের পতন দেখতে চাই। আমি উন্নয়নের নামে এক টাকার পদ্মাসেতুতে চার টাকার চুরির হিসাব চাই। আমি হাসিনার বাপের দেশের ভঙ্গি থেকে মুক্তি চাই। আমি হাসিনার প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত দেখতে চাই। আমি হাসিনার ফ্যাশিস্ট রেজিমের ওপর ঘৃণার থুতু দিতে চাই। আমি তাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আমার নিজের পরিবার আওয়ামী রাজনীতি থেকে উঠে আসা পরিবার। এবং আজকে আমার লীগের প্রতি অসীম ঘৃণার দায় একান্তই হাসিনার। আমি তাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আমার মতো অসংখ্য মানুষের, শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু সম্বোধন করা, তার এক কথায়, শেখের বেটির এক কথায় জীবন দিয়ে দেওয়া হাজার হাজার মানুষের স্বপ্নভঙ্গের দায়, বাংলাদেশকে ডিজিটাইজেশানের নামে, উন্নয়নের নামে সুন্দরবন ধ্বংস করে বাতাস পানি মাটি বিষাক্ত করে মৃত্যুপুরী বানানোর দায় একান্তই হাসিনা এবং তার ফ্যাসিস্ট দুর্নীতিবাজ রক্তলোলুপ সরকারের।

বিকল্প কোথায়, এই ফালতু গল্প শোনার আমার সময় নাই।

আমার ঘরে আগুন লেগেছে। ঘর থেকে বের হওয়া আমার প্রথম কাজ। কার্বন মনোক্সাইড থেকে বাঁচা আমার প্রথম কাজ। এরপর আমি দ্বিতীয় ঘর কোথায় বানাবো কবে বানাবো কীভাবে বানাবো সেই বিবেচনা করবো। কিন্তু আমাকে ঘর থেকে বের হতে হবে। আমার স্বপ্নীলের খোঁজ করতে হবে। আমার এই হাসিনা নামক এই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হবে।

আমার ভাই আবু সাঈদের কসম, এই জঞ্জাল না সরিয়ে আমি দ্বিতীয় আলাপে যাচ্ছি না। ভারত সরকার যদি এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে শান্তিসেনা পাঠায় [সূত্র-০৫], তাহলে সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে নামবে বাংলাদেশ। এখন আমি এবং আমরা আর দ্বিতীয় আলাপ করবো না।

দ্বিতীয় আলাপের সময় অনেক, অনেক আগেই পার হয়ে গেছে।

সূত্র:

[০১] https://unb.com.bd/category/Bangladesh/list-of-147537-freedom-fighters-published/66594
[০২] https://www.prothomalo.com/bangladesh/crime/%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%A8-%E0%A6%86%E0%A6%9F%E0%A6%95-%E0%A7%AB%E0%A7%A6
[০৩] https://www.prothomalo.com/politics/%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%B8%E0%A7%81-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%A8%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A6%BE
[০৪]
https://www.amnesty.org/en/latest/news/2024/07/government-of-bangladesh-must-urgently-halt-mounting-death-toll-of-protestors/#:~:text=On%2017%20July%202024%2C%20Amnesty%20International%20verified%20evidence,to%20ensure%20protestors%20are%20protected%20from%20further%20harm.
[০৫]
https://www.sangbadpratidin.in/india/does-delhi-send-peace-troops-to-bangladesh/

নাদিয়া ইসলাম

লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top