উত্তর সম্পাদকীয় ।। পারভেজ আলম ।।
আজকে শেখ হাসিনার অধীনস্ত আদালত যেই রায় দিয়েছে, তা শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশ এবং কূটচালেরই একটি আইনি মুখোশ মাত্র। নারী কোটা বাদ দিয়ে এবং আদিবাসী কোটা কমিয়ে (যা আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল না) জনগণকে বিভক্ত করাই হলো এই রায়ের উদ্দেশ্য…
আদতে আণবিক রাজনীতি নতুন কিছু না। বরং, অন্তত ফ্রেঞ্চ রিভোলুশনের সময় থেকেই এর অস্তিত্ব দেখা যায়। আদতে নূরায়ন তথা এনলাইটেনমেন্টের রাষ্ট্র-দার্শনিকরা জনতার গাঠনিক-ক্ষমতা (কনস্টিটিউটিভ পাওয়ার) বলতে যা বুঝাইতেন, আখেরি পুঁজিবাদী জমানায় তার প্রকাশিত রূপ ও ভাব হলো নির্দলীয় জনতার আণবিক রাজনৈতিক শক্তি। যেই জনগণের বিপ্লবী তৎপরতায় আধুনিক রাজনৈতিক সমাজ গঠিত হয়, সেই জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা থেকে লেজিটিমেসি নিয়ে ও তাকে আড়াল করেই গঠনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ, গণহত্যা, ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে “বীরত্ব, সাহস, ও বিপ্লবী তৎপরতা”র মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাকারী জনগণকেই স্বাধীন বাংলাদেশের লেজিটিমেসির উৎস মানা হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর রাষ্ট্রবাদী রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান, রাষ্ট্রযন্ত্র, এবং আমলাতন্ত্রকেই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস বানিয়ে ফেলেছে। আড়াল করেছে জনগণের আণবিক শক্তি
এই গণঅভ্যুত্থান আণবিক রাজনৈতিক ক্ষমতারই পুনরুত্থান
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা যখন নির্বাহী আদেশে কোটা বাতিল করে দিয়েছিলেন, তখনই পরিষ্কার হয়ে গেছিল যে এটি একটি রাজনৈতিক কূটচাল মাত্র। আন্দোলনকারীরা কোটা বাতিল চায় নাই, সংস্কার চেয়েছিল। কিন্তু হাসিনা সংস্কারের পদক্ষেপ না নিয়ে নিজের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন। এবং এই ২০২৪ সালে আদালত ব্যবহার করে সেই পুরাতন কোটা পদ্ধতিই ফেরত আনার পায়তারা করলেন। শেখ হাসিনার শাসনে বাংলাদেশের সংবিধানটি একটি অর্থহীন কাগজে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। শেখ হাসিনার সুরকারের গণতান্ত্রিক লেজিটেমেসি নাই। এবং আইন ও পুলিশ বাহিনীকে নিজেদের রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করে সহিংস শাসনের ব্যবসথা কায়েম করার ফলে সরকারটির আইনি ভিত্তিও নাই হয়ে গেছে। ফলে, বর্তমান বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানরত জনতাই হলো একমাত্র লেজিটিমেট গণতান্ত্রিক শক্তি। এই আন্দোলনকে কোন বিশেষ রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শিক পক্ষের আন্দোলন হিসাবে বোঝার চেষ্টা করা হবে ভয়াবহ ভুল। এবং তা হবে জনতার গাঠনিক ক্ষমতা ও আনবিক রাজনৈতিক শক্তির প্রতি অবজ্ঞা করাও। অথচ জনতার গাঠনিক ও আনবিক তৎপরতা ছাড়া গনতন্ত্রকে কল্পনা করাই সম্ভব না।
আমাদের যুগের রাজনীতিকে জিল দ্যলুজ দুইভাগ ভাগ করেছেনঃ
১। মলিকুলার তথা আণবিক রাজনীতি
২। মোলার তথা দ্রাব্যিক/দৈহিক রাজনীতি
যেধরণের রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রাম বহু ব্যক্তি ও ছোট ছোট গ্রুপের এজেন্সি দ্বারা পরিচালিত হয়, তাকেই দ্যলুজ বলেছেন আণবিক রাজনীতি। আণবিক রাজনীতির অংশ থাকা প্রতিটা ইউনিট বা অণু আপন রাজনৈতিক এজেন্সি নিয়ে হাজির থাকে, এবং আন্দোলনের এজেন্সির আধার হয়ে ওঠে।এ ধরনের আন্দোলন সাধারণত কেন্দ্রীয় কোন সাংগঠনিক কাঠামোর নির্দেশে পরিচালিত হয় না, বা তেমন কোন কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ রাখাও যায় না (চেষ্টা করা হলেও)। এ ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন প্রথম দেখা যায় ষাটের দশকের পাশ্চাত্যে, বিশেষ করে আটষট্টির ছাত্র আন্দোলনে। দ্যলুজ তার আণবিক রাজনীতি সংক্রান্ত তত্ত্ব মূলত এই আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করেই গড়ে তুলেছিলেন।
অন্যদিকে দ্রাব্যিক বা দৈহিক রাজনীতি ছিল গত শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত রাজনীতির একমাত্র স্বীকৃত গঠন/কাঠামো। এধরণের রাজনীতির এজেন্সি নির্ধারিত হয় একটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে অথবা/এবং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা অনুসারে। একটা রাজনৈতিক দ্রব্য বা দেহ (যেমন, রাষ্ট্র বা পার্টি) যেই অগণিত অণু দ্বারা গঠিত, সেই অণুদের এজেন্সি আড়াল করে দ্রব্য বা দেহকে রাজনৈতিক এজেন্সির মূল ধারক হিসাবে বিবেচনা করা হয় এধরণের রাজনীতিতে। রাষ্ট্রবাদী ও সংবিধানবাদী রাজনীতি, কিংবা এক দল ও/বা এক নেতা কেন্দ্রীক রাজনীতি হলো দ্রাব্যিক/দৈহিক রাজনীতি। এধরণের রাজনীতিতে ব্যক্তি, ছোট ছোট বিভিন্ন সংগঠন বা গ্রুপগুলার একমাত্র নিয়তি হলো দ্রব্য বা দেহের সার্বভৌমত্বের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া বা অদৃশ্য হয়ে থাকা। যেমন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া জনগণের আণবিক এজেন্সি আড়াল করে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবকে মুক্তিযুদ্ধের মালিক বানানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শক্তি শোষণ করে আওয়ামি লীগের দৈহিক বল বৃদ্ধি করা হয়েছে। এধরণের রাজনীতিতে জনগণকে খরচযোগ্য অণুর বেশী মূল্য দেয়া হয় না। অণু মারা গেলেতো দেহ মারা যায় না। অণুরাতো অগণিত। দেহের স্বার্থে তারা মারা যাবে, এটাই তাদের নিয়তি। এমনটাই মনে করেন এধরণের রাজনীতির অনুসারীরা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত কেউই এইক্ষেত্রে পিছিয়ে নাই।
পশ্চিম ইউরোপে ষাটের দশকে বেড়ে উঠলেও, বাংলাদেশে আণবিক রাজনীতি বিকাশ লাভ করেছে মূলত বর্তমান শতকের প্রথম দশকে। শূন্য দশকের উল্লেখযোগ্য আণবিক রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল ফুলবাড়ি, কানসাট, শনিরআখড়া আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির আন্দোলন, ক্যাম্পাস থেকে সামরিক বাহিনী খেদাবার আন্দোলন – ইত্যাদি। এসব আন্দোলন অবশ্য নিখাদ আণবিক রাজনীতির প্রকাশ ছিল না, বরং ছিল আণবিক রাজনীতি এবং দৈহিক রাজনীতির ফলপ্রসূ সমন্বয়ের ফলাফল (এবং এই ব্যাপারটি বর্তমান সময়কার সকল উল্লেখযোগ্য আণবিক শক্তি সম্পন্ন রাজনীতির ক্ষেত্রেই সত্য)। এর আগের প্রায় সব আন্দোলনই হয়েছে বড় রাজনৈতিক দল বা মোর্চাগুলার নেতৃত্বে। এবং শূন্য দশকের এসব আন্দোলনগুলাতেই প্রথম রাজনৈতিক দলগুলার নেতৃত্বের বাইরে জনতার এজেন্সি প্রকাশিত হয়েছে। তেরো সালে বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলনও শুরু হয়েছিল আণবিক রাজনীতি হিসাবে, কিন্তু দ্রুতই তা আওয়ামী লীগ ও সিপিবির মতো দলগুলোর দৈহিক রাজনীতির মধ্যে আত্মসাৎ হয়েছিল। নাস্তিক, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, সমকামী এহেন নানান পরিচয়ের মানুষদের বলির পাঠা বানিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ওয়ার অন টেররের বরকন্দাজ সাজা আওয়ামী লীগ সরকারের লেজিটিমেসি। হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের মাধ্যমে মাদ্রাসার ছাত্রদের আণবিক রাজনৈতিক এজেন্সি তৎকালীন জামায়াত ও বিএনপির দৈহিক রাজনীতির মধ্যে কবজা হয়েছিল। এই ছাত্রদের কুরবানি দিয়ে তারা ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনা রাখতো। কিন্তু ছাত্ররা কুরবান হলেও তাদের দৈহিক রাজনৈতিক বাসনা পুরণ হয় নাই। আঠারো সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনও হয়েছিল আণবিক রাজনীতির উপর ভর করেই। আঠারোর কোটা সংস্কার আন্দোলনটির নেতৃত্বের লুম্পেন এবং অতিডান প্রবণতার কারণে অবশ্য এই আন্দোলনের পুরো আণবিক শক্তিটিই দৈহিক রাজনীতিতে দ্রবিভূত হয়ে গেছে।
এই দিক থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনটি ছিল বিশেষ। যেহেতু এক পর্যায়ে দমিত এবং স্থিমিত হয়ে গেলেও তা কোন দৈহিক রাজনীতিতে দ্রবিভূত হয়ে যায় নাই। এবং, বর্তমান যেই কোটা সংস্কার আন্দোলন, তাও চরিত্রের দিক থেকে সেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সিলসিলাই বহন করে (এবং হয়তো ঐ আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হওয়া শিশু কিশোররা, যারা এখন আরো বড় হয়েছেন, তারা অনেকেই এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন)। তাই বলে এই আন্দোলনে কোন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের উপস্থিতি বা অবদান নাই, তাও না। বরং ফেসবুক বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বাংলাদেশের বাম ও ডান প্রায় সকল দলের (আওয়ামী লীগ ও জোট বাদে) তরুণ কর্মীদেরই এই আন্দোলনে তৎপর থাকতে দেখা গেছে। তারা বেশিরাভগই দলীয় কোন এজেন্ডা ছাড়াই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, যা আণবিক ও দৈহিক রাজনীতির সমন্বয়ের জন্যে সবচাইতে জরুরি বিষয়। ফিলিস্তিনের জনগণের গণহত্যার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক পাশ্চাত্যে ঘটা ছাত্র আন্দোলনের শক্তিও ছিল মূলত আণবিক ও দৈহিক রাজনীতির সমন্বয়ের মধ্যে। অবশ্য এইক্ষেত্রে দৈহিক রাজনীতির এজেন্সি নিয়ে যারা হাজির ছিলেন/আছেন, তারা বেশিরভাগই হয় অনলাইন জমানায় বেড়ে ওঠা ভেটেরান একটিভিস্ট অথবা এনার্কিস্ট এবং মার্ক্সবাদীদের বিভিন্ন ছোট সংগঠনের সদস্য।
আদতে আণবিক রাজনীতি নতুন কিছু না। বরং, অন্তত ফ্রেঞ্চ রিভোলুশনের সময় থেকেই এর অস্তিত্ব দেখা যায়। আদতে নূরায়ন তথা এনলাইটেনমেন্টের রাষ্ট্র-দার্শনিকরা জনতার গাঠনিক-ক্ষমতা (কনস্টিটিউটিভ পাওয়ার) বলতে যা বুঝাইতেন, আখেরি পুঁজিবাদী জমানায় তার প্রকাশিত রূপ ও ভাব হলো নির্দলীয় জনতার আণবিক রাজনৈতিক শক্তি। যেই জনগণের বিপ্লবী তৎপরতায় আধুনিক রাজনৈতিক সমাজ গঠিত হয়, সেই জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা থেকে লেজিটিমেসি নিয়ে ও তাকে আড়াল করেই গঠনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ, গণহত্যা, ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে “বীরত্ব, সাহস, ও বিপ্লবী তৎপরতা”র মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাকারী জনগণকেই স্বাধীন বাংলাদেশের লেজিটিমেসির উৎস মানা হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর রাষ্ট্রবাদী রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান, রাষ্ট্রযন্ত্র, এবং আমলাতন্ত্রকেই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস বানিয়ে ফেলেছে। আড়াল করেছে জনগণের আণবিক শক্তি।
আহমদ ছফার ওঙ্কার (১৯৭৫) উপন্যাসের বোবা বউকে সাধারণত পাকিস্তান আমলের বাংলাদেশের রুপক ভাবা হয়। এই উপন্যাসে বোবা বউয়ের কথা বলতে চাওয়ার যেই সংগ্রাম, ছফা সেই সংগ্রামকে বোবা বউয়ের দেহের প্রতিটা অণু পরমাণুর কথা বলতে চাওয়ার সংগ্রাম হিসাবেও চিত্রায়িত করেছেন। এইদিক থেকে, বোবা বউয়ের শাহাদাত আসলে আণবিক রাজনৈতিক শক্তির কুরবানি হওয়ারও ঘটনা। কোটা সংস্কারের নামে শুরু হওয়া বাংলাদেশের বর্তমান গণঅভ্যুত্থানটি মূলত সেই আণবিক রাজনৈতিক ক্ষমতারই পুনরুত্থান বা নতুন আত্মপ্রকাশ। জনতার এই গাঠনিক ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করে আইন আদালতকে মূখ্য করে তোলার মানে হলো বাংলাদেশের খুনি স্বৈরাচার সরকারটির দৈহিক বল বৃদ্ধি করা।
আজকে শেখ হাসিনার অধীনস্ত আদালত যেই রায় দিয়েছে, তা শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশ এবং কূটচালেরই একটি আইনি মুখোশ মাত্র। নারী কোটা বাদ দিয়ে এবং আদিবাসী কোটা কমিয়ে (যা আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল না) জনগণকে বিভক্ত করাই হলো এই রায়ের উদ্দেশ্য।
পারভেজ আলম
লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী। ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টার্ডামের সংস্কৃতি বিশ্লেষণ বিভাগে গবেষণারত। প্রকাশিত বইঃ মদিনা (২০২০), মুসলিম জগতের ক্ষমতা-সম্পর্কের ইতিহাস; জিহাদ ও খেলাফতের সিলসিলা (২০১৬), ডিসেপেয়ারিং পাবলিক স্ফিয়ার্স (২০১৬), শাহবাগের রাষ্ট্রপ্রকল্প (২০১৪), মুসলিম দুনিয়ার জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই (২০১১)।