।। অতনু সিংহ ।।
বড় বাংলায় ইসলামের একটি অপূর্ব রূপ আছে যার সঙ্গে আমরা যথেষ্ট পরিচিত নই। এই অপরিচয়ের কারণ পাশ্চাত্যকেই সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশ গণ্য করা। আমরা হাটেমাঠে মানুষের অন্তরে দেখি সেখানে সকল জৈবিকসত্তা, মানবসত্তায প্রকৃতি ও পরমের মধ্যে সম্বন্ধ তৈরির ঐশী বয়ান হিশাবে ইসলাম হাজির। সেই বয়ান নাজিল হচ্ছে মানুষের কাছে, মানুষের মাধ্যমে, নবী যে ঐশী বাণীর দূত। কিন্তু তার তাফসির চলেছে মানুষ থেকে মানুষে, মানুষের মাধুর্য ভজনার জন্য মানুষ থেকে মানুষে। চলছে প্রাণ-প্রকৃতির ভারসাম্যের মাঝে মানুষের মধ্য দিয়েই পরমের ঐশীক্রিয়ার জাগতিক মীমাংসা নিশ্চিত করা। যেহেতু মানুষ জৈবিক ক্রিয়ার অতিরিক্ত আরো কিছু করে, যা সকল সৃজনশীল ভাবের প্রকাশ বা ভাব দিয়ে ভাব নিয়ে রাঙাচরণ প্রাপ্তির , সেই অতিরিক্তকে চিহ্নিত করা যায় ‘পরমার্থ’ শব্দে। এই পরমার্থের হদিশ মানুষ নিজে। মানুষের মধ্যে পরমার্থের প্রকাশের কথা ঐশীবানীতেই শুধু নয়, আছে নবী মোহাম্মদের (সা.) জীবনচরিতে, তাঁর সুন্নতেও।
নবীকে নিরঞ্জন ভাবি
ইসলাম-সহ যেকােনও আধ্যাত্মিক পরম্পরায় তিরোধান দিবস যতটা তাৎপর্যপূর্ণ, জন্মদিবসের আধ্যাত্মিক ততটা নয়। যদি সেটি জন্মদিন বা ‘বার্থ ডে’ হয়। এশিয়ায় কোনও মহামানবের জন্মক্ষণ উদযাপনের ক্ষেত্রে দিবসের থেকে অবশ্য তিথির গুরুত্ব রয়েছে। যেহেতু গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ডের সম্পর্কের যোগসূত্র রচনায় ব্যক্তি ও মহাপ্রকৃতির মধ্যে সম্বন্ধ তৈরি করে দেয় তিথির হিসাব– তাই জন্মতিথি গুরুত্বপূর্ণ অ-ইওরোপীয় বা এশীয় সভ্যতার ক্ষেত্রে। ঈদ-এ-মিলাদুননবী ইসলামিক সংস্কৃতির পরম্পরায় স্থান-কাল নির্বিশেষে সর্বত্র গ্রহণযোগ্য কোনও বিষয় নয়, এ কথা ঠিক, কিন্তু সমস্ত ইসলামিক মত ও পথ বা মজহাব নিরপেক্ষ জায়গা থেকে সাম্প্রতিক সময়ে মহানবীর আবির্ভাব দিবস পালন রাজনৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্যপূর্ণ বিশেষভাবে। কেননা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ বা ওয়ার অন টেরর বা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদসহ পশ্চিমা চক্রের যে নয়া উপনিবেশবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কার্যক্রম, তা একইসঙ্গে কমিউনিজম ও ইসলামের বিরুদ্ধে সক্রিয়। বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেডিয় ক্ষমতাতন্ত্রের নানাবিধ প্রোপাগান্ডা ও পশ্চিমা পুঁজির অতিসক্রিয় ভূমিকা দৃশ্যমান। ইসালমোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষকে এ কারণেই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সর্বস্তরে। আর এই ইসলামবিদ্বেষী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইসলামের ভিতর ও বাহির থেকে এই ধর্ম ও তার মহানবীর বিরুদ্ধে ভুয়া প্রোপাগান্ডা ও কোরআনের বিকৃত ব্যাখ্যা গণমগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে সুপরিকল্পিতভাবে। পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শক্তিসমূহ জায়ানিস্টদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এশিয়ায় বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী অপশক্তি-সহ হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি জাতিবাদীদের রাজনৈতিক উত্থানে প্রত্যক্ষ মদত জুগিয়ে যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে তাই মহানবী (সা.)-এর জীবন ও তাঁর ভাবধারার বস্তুনিরপেক্ষ চর্চাকে জনমানসের সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ঈদ-এ-মিলাদুন নবী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ কথা মাথায় রেখেই নবী হয়রত মোহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব দিবসে তাঁর শরণ নেব তাঁর সম্পর্কে আমাদের আশাপাশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্ররা কী কী বলছেন তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
বৃহৎ বঙ্গে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলামভীতিকে রাজনৈতিকভাবে গণমানসে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গোড়াপত্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছিল। নবী মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতি, অপপ্রচার ও পবিত্র কোরআনের ভুয়া ব্যাখ্যার মতো সংগঠিত অপকর্ম তখন থেকেই। চিরটাকাল এমনটা ছিল না। এমনকী বৈদিক ধর্মের সমান্তরালে এখানে যে সকল ধর্মীয় চর্চা বহমান ছিল, ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক সেইসব অবৈদিক আধ্যাত্মিক চর্চাকে বৈদিক ধর্মের বর্ণাশ্রম কাঠামোর ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়ার আগে অবধি এসব অবৈদিক ধর্ম বা ভাবঘরগুলোর মধ্যে সরাসরি ইসলাম ও মোহাম্মদ (সা.)-এর উচ্চপ্রশংসা আমার দেখেতে পাই। অওধি কিংবা হিন্দুস্তানী ভাষায় রচিত নাথ সম্প্রদায়ের অন্যতম গুরু গোরক্ষনাথের গোরখ শবদির (কাব্য) বিভিন্ন পদে আমরা মহানবীর প্রসঙ্গ খেয়াল করতে পারি। এবং আমরা দেখতে পাই গোরক্ষনাথ কীভাবে মোহাম্মদকে একজন উচ্চমার্গের গুরু তথা আলোকপুরুষ হিসেবে বন্দনা করছেন।
নাথ নাম জপেও জগৎ বাঁধা
(গোরখ শবদি, গোরক্ষনাথ, অনুবাদ অভিষেক ঘোষ)
গোরখ জপেও গুপ্ত
কলমার গুরু মহম্মদ হয়
তিনিও হয়েছেন সুপ্ত।।
…
নাথ কহন্তা সব জগ নাথ্যা
গোরখ কহন্তা গোই।
কলমাকা গুর মহমঁদ হোতা
পহলৈ মুবা সোই।।
শুধু ‘মধ্যযুগের’ বিভিন্ন সাধক, পদকার ও কবির রচনায় আমরা নবীজীর কথা উল্লেখ পাই তা নয়। বরং আধুনিক সময়কালে এসেও সফট হিন্দুত্ববাদের লোক মোহনদাস করম চঁাদ গান্ধিকেও ঔপনিবেশিক ইসালমোফোবিয়ার বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলতে শুনি–
এ মোহাম্মদকে ঘিরে যে পশ্চিমা অপবাদ পুঞ্জিভূত হয়ে আছে– যার ভালো অর্থ হতে পারে ধর্মান্ধতা। এটা আমাদের নিজেদের জন্যই লজ্জাজনক।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি, ‘Young India,’1924.
উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট নেতা মানবেন্দ্র রায় তাঁর THE HISTORICAL ROLE OF ISLAM বইতে লিখলেন
The phenomenal success of Islam was primarily due to its revolutionary significance and its ability to lead the masses out of the hopeless situation created by the decay of antique, civilizations not only of Greece and Rome but of Persia and China and of India. The sword of Islam, wielded ostensibly at the service of God, actually contributed to the victory of a new social force—the blossoming of a new intellectual life which eventually dug the graves of all religions and faiths, The spirit of Islam was not invented by the genius of Mohammad; nor was it revealed to him. It was a heritage of history conferred on the Arabian nation. The greatness of Mohammad was his ability to recognize the value of the heritage and make his countrymen conscious of it.
THE HISTORICAL ROLE OF ISLAM, M. N. ROY.
আমরা জানি রামকৃষ্ণ দেব স্বয়ং শাক্ত সাধনার শেষে বেশ কিছুদিন ইসালেমর শরিয়ত জীবনাচার অভ্যাস করে মারেফতের সাধনায় রত হয়েছিলেন। ইসলাম কবুল করেছিলেন তাঁর মুর্শীদ গোবিন্দ শেখের কাছ থেকে। অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দ বৈদান্তিক পথে আস্থা রাখলেও মোহম্মদ (সা.)র ব্যাপারে ছিলেন যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। তিনি বলেছেন–
মহম্মদ নিজ জীবনের দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইয়া গেলেন যে, মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণ সাম্য ও ভ্রাতৃভাব থাকা উচিত। উহার মধ্যে বিভিন্ন জাতি, মতামত, বর্ণ বা লিঙ্গ ভেদ কিছু থাকিবে না। তুরস্কের সুলতান আফ্রিকার বাজার হইতে একজন নিগ্রোকে কিনিয়া তাহাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া তুরস্কে আনিতে পারেন। কিন্তু সে যদি মুসলমান হয়, আর যদি তাহার উপযুক্ত গুণ থাকে, তবে সে সুলতানের কন্যাকে বিবাহ করিতে পারে। মুসলমানদের এই উদার ভাবের সহিত এদেশে (আমেরিকায়) নিগ্রো ও রেড ইণ্ডিয়ানদের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করা হয় তুলনা করিয়া দেখ। আর হিন্দুরা কী করিয়া থাকে? যদি তােমাদের একজন মিশনারি হঠাৎ কোনও গোঁড়া হিন্দুর খাদ্য ছুঁইয়া ফেলে, সে তৎক্ষণাৎ উহা ফেলিয় দিবে। আমাদের এত উচ্চ দর্শনশাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও কার্যের সময়, আচরণের সময়, আমরা কিরূপ দুর্বলতার পরিচয় দিয়া থাকি তাহা লক্ষ করিও। কিন্তু অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় এইখানে মুসলমানদের মহত্ত্বজাতি বা বর্ণ বিচার না করিয়া সকলের প্রতি সাম্য ভাব প্রদর্শন।
মহাপুরুষ প্রসঙ্গ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৮, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ.১৯৪-১৯৫।
ইওরোপের বহু আগে জ্ঞানচর্চায়, শিল্প-সাহিত্য চর্চায় মুসলিম সভ্যতা যে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিল তাা স্বামী বিবেকানন্দ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’তে পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, ইসলামে বা কোরআন যে নারীদের সুউচ্চ স্থান দিয়েছে, তা যেভাবে ঔপনিবেশিক পশ্চিমা সভ্যতা আড়াল করে রাখতে চায় এবং ঠিক এর উল্টোটা প্রচার করে, তার বিরুদ্ধেও কিন্তু স্বামীজী তঁার লেখায় দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। তিনি লিখছেন,
মুসলমান ধর্মাবলম্বীগণ স্ত্রীজাতির কোনও আত্মা আছে বলিয়া বিশ্বাস করে না—এই প্রকার যে উক্তি এখানে আমার নিকট করা হইয়াছে তাহা ভ্রান্ত।কথা প্রসঙ্গে বলিয়া রাখি যে আমি মুসলমান নই, কিন্তু উক্ত ধর্ম সম্বন্ধে অনুশীলন করিবার সুযােগ আমার হইয়াছিল এবং আমি দেখিয়াছি, কোরানে এমন একটিও উত্তি নাই যার অর্থ নারীর আত্মা নাই বস্তুত কোরান বলে নারীর আত্মা আছে।
স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, খণ্ড-৩, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৪১৭ ‘আত্মানুসন্ধান বা আধ্যাত্মিক গবেষণার ভিত্তি’ লন্ডনের বক্তৃতা
বড় বাংলার বঙ্গের ভাববৈচিত্র্যের ঐক্য ও তার পরম্পরার সঙ্গে ইসলামের ভাবগত সাদৃশ্যের বেশ কিছু জায়গাগুলো আমাদের আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়। সেমেটিক ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলামের সঙ্গে বঙ্গের ভাবের আদানপ্রদান, মিল-মহব্বতের ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। সেখানে দ্বন্দ্ব ও বিরোধিতাও রয়েছে। সেই দিকগুলোকে ইতিহাস হিশাবে আমাদের বুঝতে হবে। বঙ্গের ভাবাবৈচিত্র্য ও ভাবান্দোলনের পরম্পরা যেভাবে মানুষের জয়গান গায়, তার সঙ্গে ইসলামে মানুষকে মহিমা বা জয়গাঁথার সম্বন্ধ রয়েছে। হয়তো তা পথ হারিয়ে ফেলেছে নানান সময়। কিন্তু মানুষকে দুনিয়ার আল্লার প্রতিনিধি বা ‘খলিফা’ গণ্য করারা মধ্যে মানুষের যে মহিমার কীর্তন সেটাই বাংলার ভাবজগতে ‘মানুষ ভজনা’র ধারণায় রূপ নিয়েছে। ফলে বড় বাংলা সহজেই বলতে পেরেছে:
অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
লালন শাহ
শুনি মানবের উওর কিছুই নাই
দেব দেবতাগন করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।।
এই মানুষে হবে মাধুর্য ভজন
তাইতে মানুষ-রূপ গঠলেন নিরঞ্জন
এবার ঠকিলে আর না দেখি কিনার
অধীন লালন কয় কাতর ভাবে।।
তৈরি হয়েছে মানুষের দরবারে পরমের এবাদত। এবং নবী মোহাম্মদের তরিকাও আসলে সেই মানুষের দরবারে মানুষ ও পরমের সম্বন্ধ রচনার অভিসন্দর্ভ। নিপীড়িতের-মজলুমের ও আশিকের জন্যে এ বিশ্বকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার।
ইসলাম একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক যেমন, তেমনই রাজনৈতিক। কারন ইসলাম ইনসাফ ও হক প্রতিষ্ঠার ভাব, ফলে বে-ইনসাফি ও জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই তার মর্মের বয়ান। মার্গ। ইসলাম সব সময় সেই ভাবের দাঁড়িয়ে থেকেছে তা নিয়ে পর্যালোচনা হতে পারে, কিন্তু তা মানুষকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করবার ঘোষণা নাকচ করে না। বাংলার নিপীড়িত সাধারণ মানুষ তাই সহজেই গেয়ে ওঠে:
তুমি মাটির আদমকে প্রথম সৃষ্টি করিয়া
লালন শাহ
ঘোষণা করিয়া দিলে শ্রেষ্ঠ বলিয়া
তাই নূরের ফেরেশতা
করে মানুষকে সেজদা
সবার চেয়ে দিলে মাটির মানুষকে সম্মান
এটা পরিষ্কার বোঝা যায় বড় বাংলায় ইসলামের একটি অপূর্ব রূপ আছে যার সঙ্গে আমরা যথেষ্ট পরিচিত নই। এই অপরিচয়ের কারণ পাশ্চাত্যকেই সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশ গণ্য করা। আমরা হাটেমাঠে মানুষের অন্তরে দেখি সেখানে সকল জৈবিকসত্তা, মানবসত্তায প্রকৃতি ও পরমের মধ্যে সম্বন্ধ তৈরির ঐশী বয়ান হিশাবে ইসলাম হাজির। সেই বয়ান নাজিল হচ্ছে মানুষের কাছে, মানুষের মাধ্যমে, নবী যে ঐশী বাণীর দূত। কিন্তু তার তাফসির চলেছে মানুষ থেকে মানুষে, মানুষের মাধুর্য ভজনার জন্য মানুষ থেকে মানুষে। চলছে প্রাণ-প্রকৃতির ভারসাম্যের মাঝে মানুষের মধ্য দিয়েই পরমের ঐশীক্রিয়ার জাগতিক মীমাংসা নিশ্চিত করা। যেহেতু মানুষ জৈবিক ক্রিয়ার অতিরিক্ত আরো কিছু করে, যা সকল সৃজনশীল ভাবের প্রকাশ বা ভাব দিয়ে ভাব নিয়ে রাঙাচরণ প্রাপ্তির , সেই অতিরিক্তকে চিহ্নিত করা যায় ‘পরমার্থ’ শব্দে। এই পরমার্থের হদিশ মানুষ নিজে। মানুষের মধ্যে পরমার্থের প্রকাশের কথা ঐশীবানীতেই শুধু নয়, আছে নবী মোহাম্মদের (সা.) জীবনচরিতে, তাঁর সুন্নতেও।
লালন বলছেন নবীকেই তিনি নিরঞ্জন বলে মনে করেন। কারণ নবী এমন এক তরিকত এনেছেন এই দুনিয়ায় বা তাঁর কাছে ঐশীবাণী নাজেল হওয়ার মধ্য দিয়ে জগৎ সংসারে অনেক ফ্যাতনা, ফ্যাসাদ, বৈষম্য দূর করার পথ খুলে গিয়েছে। যা কিছু মানুষে মানুষে ভেদাভেদ আর বৈষম্য তৈরি করে, যা কিথু মানুষ ও প্রকৃতির সকল প্রাণিক সত্তার নষ্ট করে সেই সকল অস্তিত্বকে নাকচ করে দয়াময় ও ইনসাফের নিশ্চয়তা প্রদানকারী পরমের কাছে আত্মসমপর্ণ করার পথ খুলে গিয়েছে মহানবীর মধ্য দিয়ে।
কে তাহারে চিনতে পারে
লালন শাহ
তরিক কে আনিল, এ সংসারে।
সবে বলে নবী নবী
নবীকে নিরঞ্জন ভাবি
দেল ঢুঁড়িলে দেখতে পাবি
আহম্মদ নাম বলে কারে ॥
যার মর্ম সে যদি না কয়
কার সাধ্য কে জানিতে পায়
তাইতে আমার দীন দয়াময়
মানুষ রূপে ঘোরে ফিরে ॥
নফি এজবাত যে জানে না
মিছে রে তার পড়াশুনা
লালন কয় ভেদ উপাসনা
না জেনে চটকে মারে ॥