।। অতনু সিংহ ।।
দেখা যাচ্ছে এবাদতের তরিকা, তার ভাষাব্যবস্থা, তার রূপকল্প ইত্যাদি নানা মত ও পথের হতে পারে প্রেক্ষিত অনুযায়ী। কিন্তু তার মধ্য দিয়ে সহোদর-সহোদরার সহিত একাত্মতা আর প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় হওয়া একান্ত জরুরী। এবং সেই নিবিড় প্রেমই পরমের সঙ্গে পরমার্থিক সম্বন্ধ রচনা করে দেয়। কিন্তু যখন তার অন্দরে কর্তৃত্বের রাজনীতি ঢুকে পড়ে তখন তা পর্যবসিত হয় পরিচয়বাদে। এই লেখাটা যখন লেখা হচ্ছে তখন অনেকেই পরম আল্লাহর কাছে নবীজী (সা.)-এর জন্য দোয়া করছেন এবং তাঁর স্মৃতি ও শিক্ষাকে স্মরণ করছেন, অঙ্গিকারবদ্ধ হচ্ছেন তাঁর সুন্নত মেনে চলার ব্যাপারে। আবার তার পাশেই বৌদ্ধভিক্ষুকরা একে অনের জ্ঞাত-অজ্ঞাত দোষত্রুটি স্বীকার করে, ক্ষমাপ্রার্থনায় এবং নববস্ত্র ধারণে নিজেকে নতুন করে নিচ্ছেন, পরমের জন্য নিহেতু প্রেমে আত্মসমর্পণ হেতু। উড়ছে ফানুস। আবার তার পাশেই লক্ষীর পাঁচালি পড়ছেন ব্রতপালনকারী বাংলার মেয়েরা। লক্ষীর পাঁচালি পাঠ করা হচ্ছে।
বিশেষ এক জরুরীকালীন অবস্থার মধ্যে দিয়ে সময় পার করছি আমরা। সামাজিক আগ্নেয়গিরির ভিতর জমে থাকা পরিচয়বাদের বিষলাভা আজ ফের আমাদের জ্বালামুখ হতে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে! অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিদ্বেষে আমরা ক্রমশই গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়ছি আমাদের নিজস্ব জাহান্নামের চৌহদ্দির মধ্যে আর পরিচয়বাদের বিষাক্ত লাভা জ্বলে যাচ্ছে আমাদের পরমার্থিক সত্তা, যে সত্তায় আমরা জীবকূলে অন্যদের থেকে পৃথক, কেননা সত্তার পরমার্থিক গুণের জন্যেই আমরা অনায়াসে প্রকৃতিনিবিড় হয়ে উঠি, কল্পনা করি পরমের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপনের, কল্পনার দ্বারা আমরা যেমন প্রাণ, প্রকৃতি ও পরমের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করি যেমন, ঠিক তেমনই আমরা সমাজের কল্পনা করে গোষ্ঠ রচনায় ব্রতী হই। এই মঙ্গলময় চেতনার জন্যেই আমরা মানুষ, আমরা মানুষ তাই আমরা পরমার্থিক, ইহাই আমাদের আধ্যাত্ম। কিন্তু আধুনিকতা, রাষ্ট্রবাদ, জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থা, ঔপনিবেশিক ইতিহাস আর তার পরম্পরায় গোলকায়ণের যে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে আমাদের পতিত হতে হয়েছে, তার জেরে আমরা নিজেরাই নিজেদের পরমার্থিক গুণ হতে ক্রমশই চ্যুত হচ্ছি। পরিচয়ের জাঁতাকলে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় যে আমরা মানুষ। যেহেতু আমরা নিজেদের নিগূঢ় পরিচয় থেকেই বিস্মৃত আর আরোপিত পরিচিতির বৃত্তে ঘুরপাক খেতে পছন্দ করছি আমরা তাই আমরা ক্রমশ বিস্মৃত হচ্ছি আমাদের ইতিহাস, ভূগোল, প্রকৃতিসত্তা, ভাষার অন্দরে ব্যকরণের রূপগরিমা ও তাহার নিগূঢ়ে থাকা নৈঃশব্দের অপার মহিমাকে। আমরা চ্যুত হচ্ছি আমাদের প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের বহুত্ব হতে। পরম হতে। আমরা সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়ে জাতিবাদের উস্কানিতে ক্রমশই খাড়াচ্ছি আমাদের সহোদর, সহোদরার বিরুদ্ধে।
কার বিশ্বাস, কার এবাদত/উপাসনা বড় তা নিয়ে মেতে উঠছি দাঙ্গা-হাঙ্গামায়। আমরা ভুয়া পরিচয়বাদকে উগড়ে দিচ্ছি আমাদের মনের অন্ধকার থেকে। আর তাতে জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে আমাদের বাহিরানা ও ঘরানা- দুই। এহেন পরিস্থিতিতে একই সঙ্গে বড় বাংলায় উদযাপিত হলো ঈদ-এ-মিলাদুন-নবী, কোজাগরী লক্ষীপূজা এবং প্রবরণা পূর্ণিমা। দুইজন ঐতিহাসিক আধ্যাত্মিক পুরুষের জীবন ও জীবনবোধের সঙ্গে এবং কৃষিনির্ভর বড় বাংলার প্রকৃতির রূপগরিমার রূপকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল দিনটি। ‘লক্ষী’ শব্দটিকে আমি ‘লক্ষ্মী’ লিখলাম না, কারণ, কেননা বঙ্গে ‘লখস্মি’ বা ‘লছমি’ নামে তাঁরে ডাকা হয় না। তিনি আমাদের ঘরের লক্ষী মেয়ে। তিনি বৈদিক দেবী নন, তিনি লোকায়ত বঙ্গের কৃষিমঙ্গলের লৌকিক রূপকল্পনা। তো এই যে একই সঙ্গে মিলাদুন-নবী, কোজাগরী লক্ষীপূজা এবং প্রবরণা পূর্ণিমার দিনটি পালিত হলো, এই তিনটি উৎসবের বাহ্যিক ও অন্তর্জগতের নানা ফারাক থাকা সত্ত্বেও একত্বে এগুলির জন্য এবারের দিনপঞ্জিকায় একটি দিন ধার্য হওয়ার মতো চমৎকার স্পিরিচুয়াল ও পোয়েটিক কোনো মর্মভাব আমরা কি উপলব্ধি করতে পারলাম? বোধহয় পারলাম না। কারণ আমাদের দিনযাপনের মধ্যে বর্হিজগতের চালিকাক্রিয়া এতই ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে যে আমরা বাহ্যের বাহ্যিকতার রূপভেদে বুঁদ হয়ে গেছি, বাহ্যের ফারাকে মনোনিবেশ করতে গিয়ে আমরা ভুলে গেছি আমাদের অন্তর্ভাব।
লালন সাঁইজী তাঁর কালামে বলছেন,
কোন নামে ডাকিলে তারে
হৃদাকাশে উদয় হবে
আপনার আপনি ফানা হলে
সে ভেদ জানা যাবে
আরবী ভাষায় বলে আল্লা
ফারসীতে কয় খোদাতা’লা
গড বলেছে যীশুর চ্যালা,
ভিন্ন দেসে ভিন্ন ভাবে।।
মনের ভাব প্রকাশিতে
ভাষার উদয় এ জগতে
মনাতীত অধরে চিনতে,
ভাষা বাক্য নাহি পাবে।।
আল্লা হরি ভজন পুজন
সকলই মানুষের সৃজন
অনামক অচিনায় বচন
বাগেন্দ্রিয় না সম্ভবে।।
যিনি অনামক, অচিনা তাঁরে বাগযন্ত্রে ধরা সম্ভব নয়, তিনি মনাতীত, অধর, তাঁকে ভাষা-বাক্যে ধরা সম্ভব নয়। তবু তাঁর প্রতি আমাদের আশিকানা, প্রেম। যে প্রেম নিহেতু প্রেম, তার কোনো হেতু নাই, কোনো কাঙ্খা নাই। তিনি পরম, তাঁর চোখে তাঁর সকল বান্দাই সমান। সকলের জন্যেই হক নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে তাঁর। কিন্তু এর পরেও মানুষের রূপকল্পনা থাকে তাঁর নিজস্ব প্রকৃতির প্রেক্ষিতে। জল-জমিন-জঙ্গলে ঢাকা এই বৃহৎ বঙ্গে এই উপমহাদেশে এহ বাহ্যে যা বর্তমান তাঁর রূপের ভিতর দিয়ে অধর, মনাতীত, না-সম্ভবকে সম্ভব করার বাসনা মূর্ত হয় এবাদতের। আর এই মূর্ত করার কল্পনা থেকেই মনের ভাব তৈরি হয়, তৈরি হয় ভাষাব্যবস্থা, আচার, সংস্কৃতি। কিন্তু নিগূঢ়ে সত্য থাকে একটাই, সব মত ও পথ পৌঁছায় সেই সত্যের অব্যক্তে। বাংলার ‘মধ্যযুগের’ বিশিষ্ট কবি, পীর সৈয়দ সুলতান তাঁর ‘জ্ঞানচৌতিষা’ কাব্যে লিখলেন,
খণ্ডিলে খণ্ডন নাহি সেই অখণ্ডন
খণ্ড খণ্ড হয়ে আছে তেঁই সে কারণ
অর্থাৎ তাঁকে কেউ খণ্ডন করতে পারে না, তিনি অখণ্ড, তাই তিনি খণ্ড খণ্ড হয়ে আছেন। খণ্ড খণ্ড হয়ে থাকা মানবসত্তার স্থান-কালের প্রেক্ষিত অনুযায়ী তিনি খণ্ড খণ্ড উপলব্ধির মধ্যে হাজির বলেই গোটা মানবসত্তার পরমার্থিক সম্বন্ধের ক্ষেত্রে তিনি অখণ্ড। এটাই বঙ্গের রূপ ও অরূপের খেলা। এখানে রূপ আর অরূপ মিলে মিশে গেছে। মিলে মিশে গেছে ভাব ও বস্তু। খণ্ড খণ্ড হয়ে আছে বলেই অখণ্ডের লীলা বর্তমান, যা আপনার আপনি ফানা হয়েই টের পাওয়া যায়, টের পাওয়া যায় হেতুহীন প্রেমে। এই হেতুহীন, বাসনাহীন প্রেমই ধর্ম। আর এই প্রেমই আমাদের ধারণ করে আছে কারণ ধর্ম মানুষকে ধারণ করে। একই সাথে মানুষও ধারণ করে ধর্মকে। মজার ব্যাপার হলো এই সৈয়দ সুলতানের ‘নবী বংশ’ যাঁরা পাঠ করেছেন তাঁরা জানেন যে কবি সৈয়দ সুলতান আদম থেকে বিশ্বনবী করিম (সা.)-এর মাঝে পবিত্র কোরআন শরীফ বর্ণিত সকল নবীদের পাশাপাশি উপমহাদেশের বিভিন্ন পৌরাণিক আধ্যাত্মিক চরিত্রগুলিকেও নবী হিসাবে চিহ্নিত করছেন। কেননা, আমরা জানি আল্লাহর ওহী থেকে সৃষ্ট গ্রন্থে উল্লেখিত নবীগণের পাশাপাশি বলা হয়েছে সকল সমাজেই আল্লাহ যুগে যুগে নবী পাঠিয়েছেন। তাঁদের নাম কোরআনে অনুল্লেখিত কিন্তু তাঁদের আবির্ভাব ও অস্তিত্বের কথা কোরআন স্বীকার করেছে অবলীলায়। আর তাই বঙ্গীয় তথা উপমহাদেশীয় সমাজের পীর ও কবি সৈয়দ সুলতানের বাধ সাধছেন না সনাতনী পুরাণের ধর্মীয় চরিত্রদের নবী হিসাবে কল্পনা করতে। না তিনি বেদাতি আচরণ করছেন না, কোরআন তাঁকে এলাউ করছে মোহাম্মদ (সা.)-এর আগে তাঁর সমাজে আবির্ভুত হওয়া মহাপুরুষদের নবী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে। এবং সকল নবীর পরেই নবী রাসূল হিসাবে বিশ্বে আবির্ভূত হচ্ছেন দয়ার সাগর ও ইনসাফ কায়েম করা আখেরে নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)। যিনি গোত্রবাদের বিরুদ্ধে, রক্তবাদের বিরুদ্ধে, ধনী-নির্ধন বিভাজনের বিরুদ্ধে ও লৈঙ্গিক সমতার পক্ষে লড়াই করলেন রুহানিয়াতের দাওয়াত দেওয়ার পাশাপাশি। যিনি মদিনা সনদের মাধ্যমে মুসলিম ও অমুসলিমের সমান অধিকারভুক্ত উম্মাহ গঠন করলেন।
তার মানে ধর্ম এই আপাত খণ্ড-খণ্ড অস্তিত্বের বৈচিত্র্যের মাধ্যমেই এক অখণ্ড পরম চেতনার সঙ্গে মানুষের পরমার্থিক সম্বন্ধ তৈয়ার করার রাস্তা যেমন, তেমনই বেইনসাফি বা অধর্মের বিরুদ্ধে ইনসাফ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার এক শুভ আহ্বান ছাড়া আর কিছুই নয়। ধর্ম খণ্ডের রূপকল্পনার ভিতর দিয়ে অরূপের প্রতি নিহেতু প্রেমকেও এলাউ করে যেমন, তেমনই যেখানে রূপকল্পনা জাহেলিয়াতের মূর্তি হয়ে ওঠে, সেখানে পৌত্তলিকতার বিনির্মাণ ও নিরাকারের ভজনার কথা বলে। কিন্তু তা প্রেক্ষিত নির্ভর। উপমহাদেশে সনাতনী রূপকল্পনা আর মোহাম্মদ (সা.) পূর্ববর্তী আরবের পৌত্তলিকতা সম্পূর্ণতই আলাদা। উপমহাদেশের সনাতনী রূপকল্পনা বিকেন্দ্রিক ও প্রকৃতির মেটাফর হিসাবে বর্তমান। তা নিরাকার ঈশ্বর নয় বরং নিরাকারের কাছে সমর্পণের প্রাকৃতিক রূপদরওয়াজা যা চোখের সামনে হাজির। আর আরবের প্রি-ইসলামিক দেবদেবীগুলি ছিল কাবাকেন্দ্রিক এবং সবগুলিই ছিল একেকটি ক্ল্যান বা গোত্রের মেটাফোরিক রিপ্রেজেন্টেশন। যে গোত্রের, যে গোষ্ঠীর ধনসম্পদ ও পেশীর ক্ষমতা যত বেশি সেই দেব-দেবীর দাম সমাজে তত বেশি। ফলত দেব-দেবীর ক্ষমতা কায়েম করতে হলে গোত্রের ক্ষমতা জাহির করা দরকার, তাই এ নিয়ে লেগে থাকতো বিবাদ-দাঙ্গা-হাঙ্গামা। তাই রূপের নিরাকরণ সে সমাজে জরুরী ছিল। রূপের নিরাকরণ এবং এক ও একমাত্র আল্লাহর পাঠানো ওহীর রাজনৈতিকতা তাই প্রাসঙ্গিক ছিল সে সমাজে।
কিন্তু এ পাশে অর্থাৎ উপমহাদেশে রূপকল্পনার বিপরীতে শঙ্করাচার্য নিরাকারকে এমনভাবে হাজির করেছিলেন যাতে কায়েম হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদ। কেননা তিনি বললেন, ‘জগত মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য’ এবং ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তির লাইসেন্স তুলে দেওয়া হলো ব্রাহ্মনের হাতে। জগতের রূপ-রঙ সব কিছুর নিরাকরণ করে তিনি ব্রাহ্মণ গোত্রের ক্ষমতায়ণ করতে চাইলেন, জগত মিথ্যা সুতরাং ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তির জন্য ছুটতে হবে বাউনের দরজার, বাউন বংশপরম্পরায় ধরে জগতের কর্মজীবী জনতা অর্থাৎ শূদ্রকে ‘ব্রহ্ম’ জ্ঞান দেবে। অর্থাৎ আরবে গোত্রবাদকে পরাস্ত করতে আল্লাহর নির্দেশনা মতো নবী করিম (সা.) মূর্তি বিলোপন করলেন আর ঠিক উল্টোটা দেখা গেল শঙ্করাচার্যের ক্ষেত্রে। নিরাকারের অছিলায় রূপবৈচিত্র্য খারিজের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ব্রাহ্মণ্যবাদ।
তার মানে বোঝা গেল, উপমহাদেশে রূপের মাধ্যমে অরূপের এবাদত ব্রাহ্মণ্যবাদী নয়, কেন্দ্রীভূত নয়। সুতরাং রূপ ও অরূপের আলাপ, তার সংগঠনবাদ প্রেক্ষিত ও পরিস্থিতি নির্ভর এবং তা রাজনৈতিক অভিমুখ সম্পর্কিত। নিহেতু প্রেমের দ্বারা চালিত হয়ে রূপের মধ্যে দিয়ে কেউ অরূপকে পাবেন বা কেউ নিরাকারকেই ভজবেন সেটা এক্সপ্রেশন নির্ভর এবং এই নিহেতু প্রেমে থাকলে যা এই প্রেমে ব্যাঘাত ঘটায় এবং সমাজে ফ্যাতনা-ফ্যাসাদ, বিভাজন তৈরি করে, বৈষম্য তৈরি করে– তার বিরুদ্ধে সে রুখে দাঁড়াবেই। কিন্তু রূপ বা অরূপ যদি হেতু নির্ভর হয়ে যায় এবং তা এমন এক বিষয়বাসনায় পর্যবসিত হয় যা থেকে পয়দা হয় নিজের বস্তুপ্রাপ্তি থেকে ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব কায়েমের অপরাজনীতির।
এই রাজনীতির দ্বারাই আদি শঙ্করাচার্য জগতকে নিরাকরণ করতে গিয়ে বৌদ্ধ গণহত্যা ঘটিয়েছিলেন নির্বিচারে। যে বৌদ্ধদের আত্মভুবন বা আত্মের অন্দরে থাকা ব্রহ্মাণ্ড ও পরমকে পর্যবেক্ষণ করে জগতের সঙ্গে সম্বন্ধ তৈরির পথ বাতলে দিয়েছিলেন ভগবান গৌতম বুদ্ধ। শিখিয়েছিলেন, রূপ ও অরূপের লীলাকে স্বপর্যবেক্ষণ বা বিপশ্যনায় মাধ্যমে মীমাংসার তরিকা । সত্তা ও শূন্যের সম্পর্ক জ্ঞাত করে তিনি দিয়েছেন প্রজ্ঞপারমিতার সন্ধান। উল্লেখ করা দরকার, এই বৌদ্ধ ধর্ম গোটা উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, রূপবৈচিত্র্যকে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার মধ্যে রেখেই রূপের ভিতর দিয়ে অরূপের কাছে যাওয়ার জন্যে আত্মনুসন্ধান ও সমাজ গড়ার কথা বলেছিল একসাথেই। আর তাই দেখা যায় আমাদের বঙ্গীয় আচার, অভ্যাস, ভাষা, লিপি, ব্যকরণ- প্রতিটির মধ্যেই বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধতন্ত্রের ব্যপক প্রভাব। যতটা প্রভাব ইসলামের। কিংবা অবৈদিক সনাতনী ধারাগুলোর।
ফলত দেখা যাচ্ছে এবাদতের তরিকা, তার ভাষাব্যবস্থা, তার রূপকল্প ইত্যাদি নানা মত ও পথের হতে পারে প্রেক্ষিত অনুযায়ী। কিন্তু তার মধ্য দিয়ে সহোদর-সহোদরার সহিত একাত্মতা আর প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় হওয়া একান্ত জরুরী। এবং সেই নিবিড় প্রেমই পরমের সঙ্গে পরমার্থিক সম্বন্ধ রচনা করে দেয়। কিন্তু যখন তার অন্দরে কর্তৃত্বের রাজনীতি ঢুকে পড়ে তখন তা পর্যবসিত হয় পরিচয়বাদে। এই লেখাটা যখন লেখা হচ্ছে তখন অনেকেই পরম আল্লাহর কাছে নবীজী (সা.)-এর জন্য দোয়া করছেন এবং তাঁর স্মৃতি ও শিক্ষাকে স্মরণ করছেন, অঙ্গিকারবদ্ধ হচ্ছেন তাঁর সুন্নত মেনে চলার ব্যাপারে । আবার তার পাশেই বৌদ্ধভিক্ষুকরা একে অনের জ্ঞাত-অজ্ঞাত দোষত্রুটি স্বীকার করে, ক্ষমাপ্রার্থনায় এবং নববস্ত্র ধারণে নিজেকে নতুন করে নিচ্ছেন, পরমের জন্য নিহেতু প্রেমে আত্মসমর্পণ হেতু। উড়ছে ফানুস। আবার তার পাশেই লক্ষীর পাঁচালি পড়ছেন ব্রতপালনকারী বাংলার মেয়েরা। লক্ষীর পাঁচালি পাঠ করা হচ্ছে।
ইনি সেই লক্ষী যিনি চঞ্চলা। আমরা তাঁরে ধরে রাখতে পারি না। আমরা কৃষিজমি উজাড় করে আবাসন বানাই, ন্যানো গাড়ির কারখানা বানানোর পাঁয়তারা করি, আমরা ঘরের মেয়েকে পুড়িয়ে মারি, তিনি তাই আমাদের কাছে আর ধরা দেন না আগের মতো। তবু যে তাঁরে পায় সে পায় তাঁরে। তিনিও খুঁজে বেড়ান তাঁর আপনজন আমেনা, রহিম, নীলমনি, কাজললতা, পার্বতী, শিবকুমারদের মতো আপনজনেদের, যারা তাঁকে বপন করে, লালন করে, তিনি এক পূর্ণিমা রাতে এইসব মানুষদের জিগান, ‘কো জাগো রি’? অর্থাৎ কেউ কি জেগে আছো? আমরা সে ডাক শুনতে পাই না, আমরা কুবেরের ধন নিয়ে মত্ত থাকি আমাদের সম্পদের প্রাচুর্যের অহং-এ। আমরা এইভাবে তাই একদিন নিঃস্বও হই। কিন্তু যাঁরা তাঁরে বপন করে, যাঁরা আবাদ করে আমাদের ভুবন, যাঁরা ঘাম ঝরায়, যারা ফসলের হকের জন্য জান কবুল মান কবুল করে, বাংলার সেইসব নিম্নবর্গের বাঙালি হিন্দু কৃষক, বাঙালি মুসলিম কৃষক, আদিবাসী কৃষক তাঁকে পায়, তাঁকে পায় প্রবরণায়, কোজাগরীতে। আমরা তাঁরে দেখিতে পাই না। আমরা হিন্দু-মুসলমান করি।
তো পরমসত্তাকে রূপের ভিতর দিয়ে ডেকে তাঁর অরূপের সঙ্গে একাত্ম হবেন না কি তাঁর অরূপেই সরাসরি আত্মসমর্পণ করবেন নাকি আত্মভুবন পর্যবেক্ষণ করে মিশে যাবেন শূন্যে, তা আপনার নিহেতু প্রেমের নিজস্ব চলনের ব্যাপার। কিন্তু সেই প্রেম যদি আশিকানাকে পরিচয়ের খোঁপে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলে তখন নিগূঢ় আমি’র বদলে স্থূল আমিত্বের কর্তৃত্ববাদে চালিত হবেন। আপনাকে এইভাবে চালিত করতে চেয়েছে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো, রাষ্ট্রীয় জাতিবাদ, গোলকায়িত বাজারবাদ, পুঁজির নানা অপদেবতা, আপনাকে এইভাবে চালিত করতে চায় দাজ্জাল। এই দাজ্জালকে লালন-পালন করে আসছে আধুনিকতাবাদ, যুক্তিআধিক্যবাদ, অপকল্পনার জাতিবাদ। আপনাকে ওরা লক্ষীছাড়া করতে চায়, আপনার বুদ্ধিনাশ করে আপনার বৌদ্ধচেতনার দফারফা করতে চায় ওরা, ওরা আপনাকে আল্লাহর কাছে গুনাহগার করতে চায়, আপনি কিন্তু সে পথেই অগ্রসর হচ্ছেন। আল্লাহর ওয়াস্তে পরিচয়বাদের কাছে যাবেন না, নিজের কাছে ফিরে আসুন, ধর্মের কাছে ফিরুন, প্রকৃতির কাছে ফিরুন, রূপে কিংবা অরূপে যেভাবে ইচ্ছা পরমের কথা স্মরণ করুন, পরমের তৈরি করা এই মানব ও প্রকৃতিসমাজের কথা চিন্তা করুন। একবার আল্লাহ বলো মন রে পাখী, আল্লাহ বলো মনপাখী আমার।
ছবি- তুফান চাকমা
কৃতজ্ঞতা- ফরহাদ মজহার, কুলাবধূতা সৎপুরানন্দ, অভিষেক ঘোষ, অরুণা দত্ত
অতনু সিংহ
কবি, গদ্যকার ও ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক।