আজ শুক্রবার, ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

পারমার্থিক আঞ্চলিকতা ও গ্রহচিন্তা

পরমার্থিক আঞ্চলিকতা ও গ্রহচিন্তা

প্রতিপক্ষ: আপনি সম্প্রতি বাংলাদেশে লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবসে প্রধান বক্তা হিসাবে গিয়েছিলেন। সেই বক্তব্যে আপনি একটা কথা বলেছিলেন সেটা হল, ‘পারমার্থিক আঞ্চলিকতা’।  এবং এটা আপনি বলেছেন যে এটা নাগরিকতার থেকেও অধিক। আপনি যদি এই ‘পারমার্থিক আঞ্চলিকতার’ বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলেন।

স্পিভাক: আঞ্চলিক কথাটা তো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভেবে দেখুন আমাদের দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি! আবার বাংলাদেশেও ভারত সম্পর্কে একইরকম বিদ্বেষ! এরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। আসলে আমরা একদম ছোট অর্থে দেশকে ভাবি। তাতে আমাদের অত্যন্ত ক্ষতি হয়। এই যে বিশ্ব পুঁজি, আমরা কোনোকালেই এই বিশ্ব পুঁজির সামনে দাঁড়াতে পারব না। তার কারণ হল, ঘরের লোকগুলোই দেশ নিয়ে ঝগড়া করছে। এদিকে মোদি, শাহ তাঁরা কিন্তু জানেন বিশ্ব পুজির খবর। বাইরে তাঁরা উন্নয়ন উন্নয়ন ভাব দেখান, কিন্তু তার মধ্যে নানা গণ্ডগোল। অন্যদিকে বিশ্ব পুঁজির পথ খোলা। আমার জন্মের সময় এইরকম দেশ, রাষ্ট্র বলে কি কিছু ছিল? তখন স্বাধীন ছিলাম, আবার পরাধীনও ছিলাম। আর এখনও তো আমরা পরাধীন। বিশ্ব পুঁজির কাছে পরাধীন। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সলিমুল্লাহ খান আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন, তার উত্তরে আমি বলেছিলাম National liberation is not a revolution (মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিপ্লব নয়)। জাফরভাই (জাফরুল্লাহ চৌধুরী) সামনে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ ওই কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠে বললেন, “গায়ত্রী আপনি ভারতীয় লোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সত্যি কথাটা বললেন।” কাজেই এই যে আমরা নামকরা দেশগুলো নিয়ে পড়ে থাকি, তার মধ্যে আসলে যেটা আছে, তা হল এই নাগরিকতা। আর এই ‘নাগরিকতা’ বিষয়টি দরকার নির্বাচনের খাতিরে।  নাগরিকতার মধ্যে একটা প্রতিশ্রুতি থাকে।  আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে সেই প্রতিস্রুতি যাচাই করি। কেউ যদি প্রতিশ্রুতি না পালন করে তো অন্য দল ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু গ্লোবাল গভর্নেন্সে (আন্তর্জাতিক প্রশাসনে) ওইসব কিছু নেই। জাতিসংঘ বলো আর অন্য কিছু বলো, কাজেই নাগরিকতাটা রাখতে হয় কারণ নাগরিকতা ছাড়া নাকি আমাদের আর কোনো উপায় নেই। কাজেই আমরা যারা নাগরিকতার এই গণ্ডিটাকে বিশ্বাস করিনা, তাদের সব সময় বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকতার বিষয়টিতে এইভাবে আটকে থাকতে হয়। অন্যদিকে আঞ্চলিকতার বিষয়। নাগরিকতার থেকে আঞ্চলিকতাটা হল আসল কথা। আমরা একই অঞ্চলের লোক। একই অঞ্চলের লোকরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন। অস্ট্রিয়া-বলকান। তাই আঞ্চলিকতা বিষয়টা আসল। ভৌগোলিক আঞ্চলিকতা। সিন্ধু উপত্যকা তো আঞ্চলিক ছিল । তখন পাকিস্তান-ভারত আলাদা করা ছিল না। কিন্তু আমরা নামকরা দেশগুলো সহজেই ঝগড়া করতে পারি, তাই আঞ্চলিকতা বিষয়টা চলে গেল। এইজন্যেই আমি বলেছিলাম আঞ্চলিকতা।  আসলে লালনের মধ্যে ঢোকার পর পর আমি যেটা বুঝতে পারলাম সেটা বাংলাতে হয়ত বলা যাবে না। বাংলা আর সবসময় তো এক না। কিন্তু যেটা আসল কথা, সেটা হল ইংরেজিতে ‘Transcendental’। এটার মানে সুপারন্যাচারাল নয়। এর মধ্যে ধর্মের কোনো ব্যাপার নেই। কান্ট (Immanuel Kant) যখন লককে (John Locke) বুঝিয়ে ছিলেন যে কোনো কোনো জিনিস আমাদের দরকার হয়, যেগুলো চিন্তা না করলে আমরা চিন্তা করতে পারি না। কিন্তু সেগুলো আমরা কোনো আইন দিয়ে প্রমাণ করতে পারব না। Transcendental মানে হল তাই, যেগুলি ছাড়া  আমরা চিন্তাই করতে পারি না। এটাকে পারমার্থিক বলা যেতে পারে।

প্রতিপক্ষ: এক্ষেত্রে আপনি লালনের শরণাগত হতে বলেছেন। এক্ষেত্রে লালনের শরণাগত হওয়ার সঙ্গে আঞ্চলিক পারমার্থিকতার মধ্যে মিল কোথায়?

স্পিভাক: আমি শুধু বলেছি লালনের জায়গাটা হল ওই ‘Transcendental’, কারণ লালনের কয়েকটা কথা আমি প্রমাণ করতে পারব না। প্রথমে যেটা বলেছি যে ভাষায় যেটা বোঝা যায় না, যেটা মনাতীত। কিন্তু নিশানায় ডাকা যায় ন্যায় চিনবার জন্য। এখন নিশানা যদি Trace (চিহ্ন) হয়, তাহলে Trace কী? হাতি চলে গেছে তার পায়ের ছাপ ফেলে রেখে। ওই হচ্ছে নিশানা। হাতি চলে গেছে, তার পায়ের ছাপ নিশানা। কিন্তু ওটা তো ভুলও হতে পারে। আপনাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে কেউ হাতির পায়ের ছাপের মতো করে রেখেছে, এটাও তো হতে পারে। আবার এটাও হতে পারে যে হাতির পায়ের ছাপ ওরকম নয়ই। হয়তো একদল জিরাফ গিয়েছে। কাজেই Trace ওরকমই যার কোনো অঙ্গিকার থাকে না। Sign system-এ অর্থাৎ ভাষায় একটা অঙ্গিকার থাকে যে আপনি শিখুন, মানে পাবেন। মানে আছে Sign system-এ। কিন্তু Trace-এ ওরকম কোনো ‘মানে’ থাকে না। ‘মানে’র ধোঁকা থাকে না।

প্রতিপক্ষ: লালনের যে গানের মধ্যে ওই ‘মনাতীত’র প্রসঙ্গ আসছে, মানে ওই যে ‘মনাতীত অধরকে চিনতে ভাষা-বাক্য নাহি পাবে’, ওখানে উনি কি একারণেই ‘বাগেন্দ্রিয় না-সম্ভবে’ বাক্যটিও উচ্চারণ করছেন?

স্পিভাক: ওই অংশটা ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসঙ্গে উনি বলছেন। ওটা Sign system। কিন্তু বড় হচ্ছে নিশানা। আসলে লালন শাহের মতো লোকের থেকে যদি আমাদের কিছু শিখতে হয়, তাহলে ওই ‘Transcendental’ বিষয়টাকে একটু রক্ষা করতে হয়। একটু সম্মান করতে হয়। আসলে কাজেই লালন শাহের মতো লোকের কাছ থেকে যদি কিছু শিখতে হয় তাহলে ওই ‘Transcendental’ কথাটাকে রক্ষা করতে হয়, সম্মান করতে হয়। আমরাই যে সব যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারব এরকমটা নয়। আসলে আমরা কেবল লালনের সম্পর্কে কিছু লেখা পড়েছি, যেখানে আছে, লালন কেমন হিন্দু-মুসলমানের ভেদ রাখেননি, জাতিভেদ রাখেননি,তাঁর বসন্ত হয়েছিল, মুসলমানদের ঘরে মানুষ হয়েছিলেন বলে মুসলমানদের ভালবাসতে শিখলেন, এইসব ভালো ভালো কথা। এইসব বর্ণনামূলক কথাই রয়েছে। কিন্তু এইগুলি শুধুই তথ্য, যুক্তির কথা। কিন্তু এগুলোর মধ্য দিয়ে ওঁর সম্ভাবনার বিষয়গুলো প্রকাশ পায়নি। কারণ এমন বিষয় তো, এমন জীবন তো অনেক লোকেরই।

প্রতিপক্ষ: রামকৃষ্ণও ‘Transcendental’ ছিলেন?

স্পিভাক: কেউ ‘Transcendental’ থাকেন না। এমন মানুষকে বুঝতে গেলে আমাকে ‘Transcendental’ হতে হবে। রামকৃষ্ণদেবের ভাবনাচিন্তা আমি ধরতে পেরেছি  এ কথা আমি বলব না। তেমনই লালনের ভাবনাচিন্তা আমি ধরতে পেরেছি এ কথাও বলব না। এমনকী হেগেলের (Georg Wilhelm Friedrich Hegel)  ভাবনা চিন্তাও ধরতে পেরেছি সেকথাও বলা যাবে না। কিন্তু হেগেলের মধ্যেই ধরুন ‘Geist’ বলে যে কথাটা আছে, ঢাকায় সবাই সেটাকে ‘স্পিরিট’ বলছে। কিন্তু ওটা আদৌ স্পিরিট নয়। হেগেল মনে করতেন কান্ট কিছুই করতে পারেন না, ভাবতে পারেন না, হেগেলের মতে কান্ট ভয়ানক ধার্মিক ছিলেন। হেগেল মনে করেছেন কান্ট তাঁর ভাবনাকে দার্শনিকের মতো করে ফিলোসফাইজ করতে পারেননি, উনি ধর্মের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। তাই ওঁর সবকিছুতে তিন ভাগ, তিন ভাগ তিন ভাগ। কারণ খ্রিস্টধর্মের মধ্যে সব কিছু তো Holy Trinity। আর মার্কস তো এটাকেই হাস্যরসাত্মকভাবে ‘Trinity formula’ বলছেন Capital-এ। মার্কস দেখাচ্ছেন, জগতে কোনো কিছুই অমোঘ নয়। তিনি দেখাচ্ছেন যে যেসব লোকেরা মেকানিক্যালি ভাবেন ‘Capital-Profit, Ground-Rent, and Labor-Wages’ ফর্মুলাতেই সব কিছু চালিত, তাঁরা তো ওই খ্রিস্টান ধর্মের Trinity formula-র মতো করেই ভাবেন। আসলে  ‘Transcendental’ ব্যাপারটা হল ‘Geist’-এর  মতো।  হেগেল এমন একটা জায়গা খুঁজছেন, যেখানে এমন চিন্তার কথা ভাবা যাবে যা আমাদের মনের মধ্যে আটকানো নেই। আসলে আমরা ওই বলি না যে ‘আমি বুঝেছি’। আসলে আমি কিছু বুঝিনি। এই বুঝেছি, এই জায়গা থেকে বেরোতে হবে। আমাদের সাধারণ কথা মধ্যেও আছে যে আমরা যদি কিছু বুঝতে চাই, তখন আমরা মন দিই, কিন্তু সেটা মনের মধ্যে নিই না। ওই যে বলা হয়, মন দাও, মনোযোগ দাও, অর্থাৎ এই যে আমিই সব বুঝেছি, এইভাবে এগোলে পরে যুক্তি দিয়ে বোঝা হয়, আর নন্দলাল বসুর আঁকা থার্ডক্লাস ছবি লালন সাঁইয়ের ছবি বলে সর্বত্র দেখানো হয়। আর পারমার্থিক আঞ্চলিকতার কথা বলতে গেলে এটা বলতে হবে যে অঞ্চলটারও বদল হয়ে যাচ্ছে। কারণ দুনিয়ার সকল আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। সুতরাং আঞ্চলিকতাটাও আর কিছু  নয়। সেই অঞ্চলটাকে ভাবতে হবে যার কোনো নাম নেই ভাষা নেই। এইটা হচ্ছে পৃথিবী গ্রহ যার নাম নেই, ভাষা নেই, কিছু নেই। এইভাবে ভাবতে হবে। পৃথিবীর মানুষকে কোনো দরকার নেই। পৃথিবীর পারমার্থিকতা নিয়ে যদি ভাবতে হয়, তাহলে তার উল্টো নেই, অর্থাৎ ওই নাগরিক-টাগরিক ওসব কিছু নেই। কাজেই এই অর্থেও পারমার্থিক। পারমার্থিক মানে ধর্মকথা নয়।

প্রতিপক্ষ: আপনি বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এলেন। কেমন দেখলেন? এই যে গোটা ভারতে প্রবলভাবে বাংলাদেশবিদ্বেষ তথা সার্বিকভাবেই বাংলাবিদ্বেষ শুরু হয়েছে, এটাকে কীভাবে দেখছেন?

স্পিভাক: আমি একজন ভারতীয় নাগরিক। আগে যেভাবে দেখতাম এখনও সেভাবেই দেখছি। বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসার পর আমার মতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে এখানে বাঙালি বিদ্বেষ তো শুধু বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে নয়। আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেভাবে এখানে দাঁড়ানো হচ্ছে, সেটা টিকবে না। বেশিদিন এসব বিদ্বেষ থাকবে না।

প্রতিপক্ষ: বাংলাদেশে যেখানে একটা গণঅভ্যুত্থান হল তারপর আপনি ওখানে গেলেন। ওখানে গিয়ে আপনার উপলব্ধি কেমন? যখন আপনি গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে যাচ্ছেন, তখন ভারতব্যাপী একটা বাঙালি বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে।

স্পিভাক: ওখান থেকে ফিরে এসে আমি সবাইকে তো বলছি যে কত ভালো দেখলাম। তবে ওখানকার ওখানকার ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে আমার একটু ভয় হল। সেটা আমি ফরহাদকেও বলেছি। ওখানকার ছাত্ররা আমার লেখা আগেও পড়েছে, এখনও পড়ে। কিন্তু ওরা বলল, দিদি আগে যেরকম কথা হত আপনার সঙ্গে তেমনটা আর হবে না, কারণ আমরা এখন রাজনীতিতে ঢুকেছি। আমি বললাম রাজনীতি ও জীবন যদি আলাদাভাবে ধরো তাহলে কিন্তু ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাছাড়া জামায়াত নাকি নির্বাচনে প্রবল সুযোগ-সুবিধা পাবে। আমি ১৯৭৩ সালে মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, কামরুজ্জামান মিলিটারি গাড়ি দিয়েছিলেন, কারণ আমার মা বীরাঙ্গনাদের জন্যে অনেক কাজ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়।  আমাদের পূর্বপুরুষের আসল বাড়ি পূর্ববঙ্গে। মায়ের ঠাকুরদাদা বিধবা বিবাহ করেছিলেন বলে ব্রাহ্মণরা ওঁকে এক ঘরে করেছিলেন। ঠাকুরদা গ্রামের নায়েব ছিলেন। তিনি পৈতে ছেড়ে চলে এসেছিলেন। তারপর আমাদের কেউ ডাকেনি। তারপর যখন গিয়েছিলাম, তখন মানুষের নানা প্রশ্ন করেছিল, ‘দেখুন দিদি হিন্দুরা এসে সব ব্রিজ ভেঙে দিয়ে গেল, আর আমরা নাকি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গেলাম! হল কী আমাদের দেশে!” খোলাখুলিভাবেই এসব বলছিল। কাজেই এই সব বিদ্বেষ তো থাকবেই, কিন্তু এই লোকবিদ্বেষ নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। এইসব বিদ্বেষ আমাদের ধরা উচিত নাকি! বিদ্বেষ থেকে যেকোনো কিছু শুরু করাটা ভুল, এটা মনে করা উচিত, যদিও এটা সত্যি নয়। আমরা যারা সাহিত্য পড়াই, আমরা তো সবসময় যেটা সত্যি নয়, সেটা নিয়েই কাজ করি। আমরা তো ‘Fiction’ নিয়ে কাজ করি। আমার কাছে ফিকশন হল মায়া। মায়াকে কি ইলিউশন বলা যায়? দেবী দুর্গাকে কি ইলিউশন বলা যায়? না এটা হচ্ছে ফিকশন, Underived Fiction, যে ফিকশন নিয়ে আমরা কাজ করি। ওখানে যে প্রেমের সম্ভাবনাটা আছে সেই ফিকশনটা নিয়ে এগোন। খালি আপনার বিরুদ্ধে অমুকে কী বলছে, তমুক কী বছলছে, এসব নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমি তো বিরোধটা দেখতেই পারি না আর, সে কারণে আমার এত চুরি হয়! চুরি হয়ে যায়, সেক্রেটারিরা থাকে না… এই যে ভুল করা এবং ভুল করে সাপোর্ট করা, প্রেমের সম্ভাবনাটাকে ভুল জেনেও স্বীকার করা… কাজেই সবসময় এর বিরুদ্ধে ও, তার বিরুদ্ধে আমি, এভাবে থাকলে ভবিষ্যতের কোনো আশাই নেই। তার কারণ যুদ্ধ করে তো শান্তি আসে না। এই যে কত লোককে মারা হল, এটা কি শান্তির পথ! কিংবা অনেক বেশি লোকজনকে মারা হয়েছে দেখে একটু বসে সইটই তারপর আবার মারা হবে, এটা তো শান্তির পথ না। হয়তো এটা বোকার মতো কথা বলছি। কিন্তু এই বোকার মতো কথাই হয়তো শান্তির পথ। যুদ্ধফুদ্ধ করে তাই কিচ্ছু হবে না। লোকজনকে মেরে তারপর আবার একটু বসে সইটই করে ফের মারামারি, এভাবে চললে ভবিষ্যতের কোনো আশা নেই। তাই এসব নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। বিদ্বেষ থেকে শুরু করাটাই ভুল।

প্রতিপক্ষ: আপনি লালনের তিরোধান দিবসে গিয়ে বলেছেন বাংলাদেশ হবে ন্যায়ের নিশান। এবং আল্লাহর যে ন্যায়রূপ সেই রূপই হল, ন্যায়ের নিশান। এটা নিয়ে যদি একটু ব্যাখ্যা করে বলেন।

স্পিভাক:  ‘ন্যায়’ তো একটা বাংলা কথা। আবার একটা সংস্কৃত কথাও আছে। আবার সংস্কৃতের ‘ন্যায়’ কথাটা খুব একটা বড় কথা নয়। কারণ ন্যায় শেখা যায়। ‘সাংখ্য’, সংখ্যা দিয়ে যুক্তি-টুক্তি দিয়ে শেখা যায়। আর একটা কথা ‘বেদান্ত’। এই কথাটা এখন একটু ধার্মিক হয়ে গেছে। সেটা actually বেদের criticism, সেটা অন্য জিনিস। এই ‘ন্যায়’-এর মধ্যে কারণ-টারণ ব্যাখ্যা করা যায়। আপনারা যে ‘প্রতিপক্ষ’ নাম দিয়েছেন আপনাদের পত্রিকার, এটা ভালো দিয়েছেন, কারণ ন্যায়ের পরীক্ষার একটা ব্যাপারই ছিল যে পরীক্ষায় নিজের মতো করে বলে-টলে সে পাস করল, কিন্তু তারপর তাকে তার উলটো দিক প্রতিপক্ষ যে তার হয়ে এমনভাবে বলতে হবে যে লোকে ধরতে পারবে না যে এটা তার মত নয়। এটা হচ্ছে ‘ন্যায়’-এর নিয়ম। আমি ‘ন্যায়’-এর কথা বলছি না। আমি ‘ন্যায়’ কথাটা বলছি না, আমি ‘ন্যায়’ কথাটা ব্যবহার করছি এখানে, সম্পূর্ণ বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে। কিসের বাংলা প্রতিশব্দ, এখানে আমি ইংরাজিতে শব্দটা বলছি সেটা হচ্ছে ‘Justice’। এই জাস্টিস আমরা অ্যাপ্রোচ করতে পারি না। ন্যায় শেখা যায় নৈয়ায়িক হওয়া যায়। ‘ন্যায়’ বলতে বুঝিয়েছি যে জিনিস আমরা চিন্তা করতে পারি না। দেরিদার (Jacques Derrida) একটা লাইন ছিল, যার মানেটা আমরা অনেক বদলে নিয়েছি, মানেটা অন্য ছিল। কথাটা হচ্ছে “It is just, that there be law, but law is not justice”। কারণ Law বদলানো যায়, আমরা মানুষরা এটা বদলাতে পারি, (আইন) হওয়া উচিত। আইন না থাকলে কি চলে? কিন্তু law বদলানো যায়। মানুষ সেটাকে বদলাতে পারে। কিন্তু ‘জাস্টিস’ আমরা ধরতে পারিনা । জানি জাস্টিস আছে, Positive Law আছে, Natural Law আছে, কিন্তু ‘Justice’ আমরা ধরতে পারি না, জানি আছে কিন্তু সেটা ধরতে পারিনা। ফলে আমাদের বোকা হতে হবে। না জেনে, না শুনে কাজ করতে হবে। শুধু যুক্তি দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। ফলে ওই জিনিসটার (‘Justice’) যে রূপ সেটা দেখা যায় Transcendental-এর মধ্যে। লোকে কতরকম কথা বলে, মাঠে নেমে কাজ করতে গেলে তখন বোঝা যায়,  কোনগুলো করা যায় আর কোন কোন করা যায় না, মাঠে নেমে কাজ করতে গেলে সাধারন মানুষ যেটা আমাদের শেখায় সেটাও দরকার আছে। তো এই হল ন্যায়ের রূপ। আমি আল্লাহর নাম করলাম কেন, কারণ আমি বাংলাদেশে কথা বলছি, আর লালন সম্পর্কে কথা বলছি, আমি তো সম্পূর্ণ নাস্তিক কিন্তু এই আল্লাহর বিভিন্ন নাম, এই নামগুলো আমার কাছে কী, এটা হচ্ছে কবিতা, কেননা আমি তো কবিতার কাছে আমার জীবন দিয়ে দিয়েছি… কাব্যকে কি কেউ বিশ্বাস করে!।

প্রতিপক্ষ: কাব্য কি একভাবে Sense of Justice তৈরি করে?

স্পিভাক: আসলে Sense of Justice কাউকে শেখানো যায় না। এটা প্রত্যেকেরই আছে। এই ছবিটিতে দেখুন (মোবাইলে ছবি তোলা এক নিম্নবর্গের মহিলাকে দেখিয়ে), এই যে মহিলা কাল আমাদের স্কুলে (বীরভূম) এসেছিলেন। তিনি আমার পাশে বসেছেন। আমি ওইখানে প্রশিক্ষণ চলার সময় শিক্ষকদের প্রশ্ন করছি, তখন ওই মহিলা চেয়ার থেকে উঠে বলছেন, ‘এটা আমি কিন্তু জানি না, ওটা আমি কিন্তু জানি না’… অথচ আমি তো তাঁকে প্রশ্ন করিনি, তার মানে উনি Subaltern Agency claim করছেন। এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সত্যি ওঁর কাছে থেকে আমার অনেক কিছু শেখার আচগে, এই যে কোথা থেকে শিখব, এটা বোঝাতে গিয়েই আমি পারমার্থিকতার কথা বলেছিলাম, ন্যায়রূপের কথা বলেছিলাম। আর আল্লাহ নামটা করেছিলাম, কারণ আমি ‘Phenomenology’ কথাটা ব্যবহার করি। তো জাস্টিসটা বেরোবে কখন?  একটা ‘form of appearance’-এর মধ্যে একরকমভাবে বেরোবে। কাজেই ওই ঘটনার মধ্যে ওই ‘Phenomenological’ প্রেক্ষিতে আল্লাহ নামটা নেওয়া আমার শোভন মনে হয়েছিল। কেননা আমি চেয়েছিলাম একজন ভারতীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ ‘আল্লাহ’ নামটা নিক। কেননা আমার কাছে আল্লাহ নামটা যা মহেশ্বর নামটাও তাই। আমাকে নাইজেরিয়ার ইলোরিনের এমির তাঁর প্যালেসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পুরনো ইসলাম, খুব উদার। উনি উনার সাঙ্গপাঙ্গদের বলেছিলেন প্রফেসর স্পিভাক আসছেন, উনি কিন্তু মুসলমান নন। ওঁকে জুতো খুলতে বলবে না, মাথায় কাপড় দিতে বলবে না। আমি কিন্তু মাথায় কাপড় দিয়ে এবং জুতো খুলে প্যালেসে ঢুকেছিলাম। এটাই তো হওয়া উচিত।  উনি কি বলবেন যে মুসলমান নয় বলে ভিতরে আসতে দেবে না? এটাই তো ‘Sense of justice’। আর একটা কিছু তো Transcendental-এর একটা নাম দিতে হয়, ওই প্রেক্ষিতে তাই আল্লাহর কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, আল্লাহর ন্যায়রূপের কথা। আর বক্তৃতারও তো একটা Form of appearance রয়েছে, সেটাকে নিয়ে কি আপনি পলিসি তৈরি করতে পারেন! পলিসির মধ্যে তো অনেক অন্যরকম আলোচনা ঢোকাতে হয়। অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হয়। তাছাড়া আমি যে আঞ্চলিকতার কথা বলছি, সেটাও কিছু নয়। আসল হল ‘গ্রহচিন্তা’। আমরা সমস্ত কিছু নষ্ট করে ফেলছি। এটা মনে রাখতে হবে, পৃথিবীও আমাদের আর চায় না। এই যে সবাই বলে আমরা পৃথিবীকে বাঁচাচ্ছি, এটা করছি, ওটা করছি, ওইসব বাজে কথা। ওটা নিজেদের খুশি করতে বলা হয়। পৃথিবীর কোনো দরকার নেই মানুষকে। পৃথিবীর সবকিছু যদি উড়ে, পুড়েও যায়, তাতেও মানুষকে তার দরকার নেই। বরং পৃথিবীকে দরকার আমাদেরই। এটা যদি বুঝতে পারি, তাহলে কে কার  বিরুদ্ধে বিদ্বেষপোষণ করছে সেটা নিয়ে আমরা আর বেশি কথা বলব না।

প্রতিপক্ষ: এটা বুঝতে পারাটাও মনে হয় একটা Transcendental ব্যাপার।

স্পিভাক: হ্যাঁ। কিন্তু পৃথিবীর প্রশ্নটা transcendental ব্যাপারটাকেও অতিক্রম করে যায়। কেননা গ্রহ বা পৃথিবীর মধ্যে মনুষ্যত্বের কিছু নেই। পৃথিবীর ব্যাপারটা একেবারে চিহ্নহীন। ‌ তার কোনো সময় নেই, ঘড়ির কাঁটা নেই। মনে রাখবে রাজ্য, দেশ কিছু থাকবে না। ফলে কার হাতে ক্ষমতা এল, আর গেল তাতে পৃথিবীর কিছু যায় আসে না। সেটা যদি মাথায় রাখা যায় তবেই কিছু করা যাবে।  লালন সাঁই বলছেন ‘দোটানায় পড়লে সন্ধ্যাবেলায় উপায় নাই উপায় নাই’। উনি কি গ্রহচিন্তা করে বলেছেন? কিন্তু এই কথাটাকে ধারণ করতে হবে। এই কথাটাকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। গুরুবাদ মানে শুধু পা ধরে বসে থাকা নয়। কথার মর্মার্থকে ধারণ করতে হবে।

প্রতিপক্ষ: আপনি দেশীয় রাজনৈতিক লোকজনকে লালনে ডুবতে বলেছেন?

স্পিভাক: আমি সকলকেই বলি কিছু যদি জানতে হয়, পড়তে হয়, করতে হয়, তাহলে সেখানে ডুবতে হবে। আমি আমি করে কিছু হবে না। আমি এর বিরুদ্ধে, ও আমার বিরুদ্ধে এসব করে কিছু লাভ নেই। এমনকী প্রতিপক্ষ বলতে যেটা শেখায় সেটা হলো শত্রুকে হ্যাঁ বলতে শিখতে হবে। প্রতিপক্ষ শত্রু হলেও তাকে ‘ইয়েস’ বলতে হবে। যদি এটা না বলা যায় তাহলে কিছু হবে না, শান্তিও আসবে না।  পুতিনকে (ভাদিমির পুতিন) ইয়েস বলার সাধ্য কার আছে? তাই শান্তি আসছে না।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top