আজ বৃহস্পতিবার, ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ভারতীয় মিডিয়ার মাফিয়াগিরি ও ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডা

।। নজরুল আহমেদ জমাদার ।।

সম্প্রতি কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মর্মান্তিক ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ স্তম্ভিত। যাদপুরের মতো পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং মৃত্যুর পিছনে কারণ হিসেবে র‍্যাগিংয়ের কথা উঠে আসার বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে নাগরিক সমাজে। প্রত্যেকেই এই মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেছেন। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের বড় অংশের বৈদ্যুতিন ও আন্তর্জালিক (ইন্টারনেট) সংবাদমাধ্যম তাদের যে ভূমিকাকে সামনে এনেছে তাতে নতুন করে আজকের ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের চরিত্র ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহের নিরিখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোনও অপমৃত্যুর তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা নিয়ে খোঁজখবর করার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের দৈনন্দিন কাজের অঙ্গ, কিন্তু বহুলাংশে কলকাত্তাইয়া বাংলা বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমকে দেখা যাচ্ছে এই মৃত্যুর বিচারপ্রক্রিয়াটা যেন তারাই হস্তগত করেছে এবং যার জেরে গোটা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্থা-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে তারা ছাত্রমৃত্যুর জন্য দায়ি করে ফেলছে অবলীলায়। ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনার বাইরে নিজেদের মধ্যে মেলামেশা কেন করবেন, কেন পড়াশুনা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধী ছাত্র রাজনীতি করা হবে, কেন শুধুই কেরিয়ার গড়তে মন দেবেন না ছাত্রছাত্রীরা, কেন রাষ্ট্র মেরামতে ছাত্রছাত্রীরা সরব অবস্থান নেবেন, কেন জুলুম-বৈষম্য, বেইনসাফি ও জাতিবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীরা গর্জে উঠবেন- ছলেবলে এসব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এই সকল ক্রিয়াকর্মে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকাকে ‘খুনি’, ‘সন্ত্রাসী’, ‘সমাজবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে ছাত্রমৃত্যুর পিছনে দায়ি করা হচ্ছে এবং তাদের এই প্রোপাগান্ডায় জনমগজ ধোলাইয়ের চেষ্টা চলছে জোরকদমে। এটা করছে ক্ষমতাতন্ত্রের পদলেহী ভারতীয় বৈদ্যুতিন মিডিয়া, যারা দিল্লির মসনদে আসীন একটি অপরাধমনস্ক, লুঠেরা, আধিপত্যবাদী হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হয়ে নিউজরুমে বসে চিল্লায়, যারা স্টুডিওতে প্রতিপক্ষকে গলার জোরে ও হুমকি-ধমকি দিয়ে হেনস্তা করে, যারা মাসমিডিয়ার মাফিয়াগিরিতে র‍্যাগিং কালচার প্রোডিউস করে… ভারতে যে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিদ্যমান তার মাফিয়ারাষ্ট্রবাদী ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতি নির্মাণ করছে ভারতীয় মাসমিডিয়ার একটি বা দুটি নির্দিষ্ট বর্গ, ইলেকট্রনিক মিডিয়া তার অন্যতম। এরা নিজেরাই হয়ে উঠেছে সোশিও-কালচারাল র‍্যাগার, আবার এরাই নাকি ক্যাম্পাস র‍্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে সরব! অথচ আমরা সকলেই জানি মিডিয়া ব্যাপারটি সমাজ-রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, কিন্তু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের মিডিয়া ক্রমেই গোয়েবেলসীয় প্রোপাগান্ডা মেশিনারি হয়ে উঠে চতুর্থ স্তম্ভকে ভেঙে ফেলে ধ্বংস করতে চায় গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে তার প্রমাণ এই ভারতীয় মিডিয়ার মাফিয়াগিরি ও ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির হাতিয়ার হয়ে ওঠার ঘটনাক্রম। ‘প্রতিপক্ষ’ বড় বাংলার সাহিত্য পত্রিকা, কিন্তু যেহেতু সাহিত্যের সঙ্গে সমাজ, গণতন্ত্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রেক্ষিত ও গণমাধ্যমের সম্পর্ক খুবই জোরালো তাই আমরা এই ভারতীয় মিডিয়ার আজকের চরিত্র নিয়েও অবগত হতে চাই, পাঠকের সঙ্গেও ভাগ করে নিতে চাই এ বিষয়কার পর্যবেক্ষণ। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি ফ্যাসিস্ট শাসনামলের আজকের ভারতে মিডিয়ার ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডা-সহ তার কার্যপ্রণালী নিয়ে তাই ‘প্রতিপক্ষ’তে লিখছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম বিষয়ক গবেষক ও সাবেক সাংবাদিক নজরুল আহমেদ জমাদার।

– কার্যনির্বাহী সম্পাদক, ‘প্রতিপক্ষ’

মার্কিন লেখক এবং সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান ১৯২২ সালে ‘পাবলিক ওপিনিয়ন’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন সাংবাদিকরা কীভাবে প্রোপাগান্ডা চালায়। আসল ঘটনা না দেখিয়ে ঘটনার খণ্ডাংশ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয় এবং আসল বাস্তব ঘটনার কীভাবে বিকৃতি ঘটায়। আর সোসিও -সাইকোলজিস্ট হলেন এডওয়ার্ড বার্নেস। যাকে বলা হয় ‘দ্য ফাদার অফ পাবলিক রিলেশন’। তিনি ‘প্রোপাগান্ডা’ নামেই ১৯২৮ সালে একটি বই লিখেছিলেন। যদিও বার্নেস প্রোপাগান্ডা পুরোপুরি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেননি। তিনি মানুষের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রোপাগান্ডার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘মানুষের সংগঠিত ব্যবহার এবং মতামতকে সচেতনভাবে এবং বৌদ্ধিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করাটাও গণতান্ত্রিক সমাজে এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’’ যদিও ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে গদি মিডিয়াগুলো কোনওভাবেই এই কাজ করে না। তারা রাষ্ট্রের স্বার্থে এমনভাবে প্রোপাগান্ডা চালায় যেটা মানুষ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকেই প্রোপাগান্ডাকে নেতিবাচক এবং ক্ষতিকারক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে অভিমত পোষণ করেছেন এডওয়ার্ড বার্নেস। আরেক আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল পোপাগান্ডা থিওরিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাজে একটা বিষন্নতা তৈরি করে। সেই সময়ে আরো বেশি করে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের হয়ে প্রোপাগান্ডা চালায় সংবাদ মাধ্যমগুলি।’’

ভারতীয় মিডিয়ার মাফিয়াগিরি ও ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডা

বর্তমান ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের উগ্র ও নগ্ন জাতিবাদের ইতিহাস বিশ্লেষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ১৯২৩ সাল ও ১৯২৫ সাল। ১৯২৩ সালে ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির রাজনীতিকরণ করেন দামোদর বীর সাভারকার। আর ১৯২৫ সালে চরম মুসলিম বিদ্বেষী কে ডি হেডগোয়ারের হাতে তৈরি হয় উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। ব্রিটিশ ভারতের অধীনে ওই দুটি ঘটনার অনেক বিতর্ক এবং তাকে নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হতেই পারে। কিন্তু দুটিরই মূল স্পিরিট ছিল ভারতীয় উপমহাদেশকে হিন্দু রাষ্ট্র করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা। সাভারকারের সৃষ্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এবং পরবর্তীকালে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহের দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্রিটিশ ভারতকে ভারত ও পাকিস্তানে (যদিও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র তৈরি হয়) ভাগ করলেও মূল ভারত এখনও লিখিতভাবে হিন্দু রাষ্ট্র হয়নি। যদিও সেই পথেই এগোচ্ছে আরএসএস ও তার রাজনৈতিক শাখা বিজেপি। এখনও পর্যন্ত হিন্দু রাষ্ট্র করতে না পারলেও, মূলত ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ভারতের মসনদে দখল নেওয়ার পর ভারতের সমাজ এবং জনজীবনকে অনেকটাই হিন্দুত্বকরণ করতে সক্ষম হয়েছে আরএসএস বিজেপি। ধর্মে ধর্মে, জাতিতে জাতিতে, দাঙ্গা লাগিয়ে সেখান থেকে রাজনৈতিক ময়দানে মেরুকরণ ঘটিয়ে সুবিধা লাভ করেছে বিজেপি। এ কাজে তাদের হয়ে পূর্ণ সহযোগিতা করেছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের বিরাট অংশ। ভারতের জাতিগত ও ভাষাগত, ধর্মগত, সংস্কৃতিগত বহুত্ববাদের পক্ষে সওয়াল করার বদলে বিজেপি-আরএসএসের মতাদর্শ ‘হিন্দি হিন্দু এবং হিন্দুস্তান’কে সফল করতে সর্বতোভাবেই গত দু’দশকের ওপর সহযোগিতা করে চলেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বড় অংশ। এ ব্যাপারে তারা নিজেদের পুরোপুরি গেরুয়া বাহিনীর প্রোপাগান্ডা ইন্সট্রুমেন্ট করে তুলতে সক্ষম।

তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে আরএসএস বিজেপি বাহিনী তিনটে রাজনৈতিক এজেন্ডা রেখেছিল। প্রথমটি হল, বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির তৈরি করা। দ্বিতীয়টা হল কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ। তৃতীয়ত, গোটা দেশে অভিন্ন দেওয়ানিবিধি (ইউনিফর্ম সিভিল কোড) চালু করা । পেশীবলের দ্বারা বাবরি মসজিদকে ভেঙে এবং সুপ্রিমকোর্টকে প্রভাবিত করে ইতিমধ্যেই প্রথম এজেন্ডাটা সফল করেছে গেরুয়া বাহিনী। কাশ্মীরের মানুষের কোনও মতামত না নিয়ে এবং সেখানকার বিধানসভাকে পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়ে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার ক্ষেত্রেও সফল হয়েছে বিজেপি-আরএসএস-সহ গোটা সংঘ পরিবার। যদিও ৩৭০ ধারা বিলোপের বিষয়টা এখনও বিচারাধীন। ধরে নেওয়া যায় এটাতেও হয়তো শেষমেশ জিতে যাবে গেরুয়া বাহিনী। এ আশঙ্কার কথা বলছি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয় ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক। ভারতীয় সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে সমস্ত রায় দেবে সুপ্রিম কোর্ট এটাই জনমানুষে প্রচলিত। বাবরি মসজিদ এবং রাম মন্দির মামলায় কোন যুক্তি না, পুরোটাই মানুষের বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। তখন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান প্রধান বিচারপতি ছিলেন রঞ্জন গগৈ । পুরস্কারস্বরূপ অবসর নেওয়ার পরেই তাকে রাজ্যসভার সাংসদ করে দেয় শাসক দল। প্রথম দুটো এজেন্ডার সাফল্যে বিজেপি আরএসএসের পুরো সহযোগী হয়েই একপ্রকার কাজ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বিরাট অংশ। মিডিয়া তাদের প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে সংখ্যাগুরু মানুষের মনকে এ বিষয়ে শাসকের পক্ষে নিয়ন্ত্রিত করেছে। বাকি থাকছে আর একটা এজেন্ডা। তা হল অভিন্ন দেওয়ানী বিধি চালু করা। ইতিমধ্যেই এটা নিয়ে বিজেপি নেতারা পরিষ্কারভাবেই বলে দিয়েছে তারা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করবেই। আর এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে এখন থেকেই বিজেপির পক্ষে জনমত তৈরি করতে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে।

সংসদে সংখ্যার নিরিখে বিজেপি বিরোধীদের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও সংসদের বাইরের লড়াই যে খুব একতরফা তা কিন্তু নয়। তার কারণ প্রায় ভারতবর্ষের ভোটারদের ৫০ শতাংশের ওপর মানুষ বিজেপিকে ভোট দেন না। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতবর্ষের বেশ কিছু রাজ্যের সাংস্কৃতিক ভিন্নতাও বিজেপির লক্ষ্য পূরণের পথে অনেকটাই অন্তরায়। এই ভিন্নতাকে বিজেপির সমীকরণ অনুযায়ী একমাত্রিক রূপ দিতে পুরোদমে প্রচার চালাচ্ছে গদি মিডিয়াগুলি (ক্ষমতাতন্ত্রের লেজুড়)। বিজেপি আরএসএসের লক্ষ্য পূরণে আর একটা বড় বাধা হল বৌদ্ধিক প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ মূলত গড়ে ওঠে সর্বভারতীয় স্তরের দলিত, মুসলিম ও ‘র‍্যাডিক্যাল লেফট’-দের থেকে। দিল্লির জহওরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ), জামিয়ামিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কিছুদিন আগে অবধি প্রেসিডেন্সি কলেজ বা আজকের প্রেসিডেন্সি বিদ্যালয়-সহ দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অল ইন্ডিয়া স্পেসে একটা বৌদ্ধিক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় সংঘ পরিবারের ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকে। আর তাই গেরুয়া বাহিনীর টার্গেট জোনের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যতম। জেএনইউ, যাদবপুর, জামিয়ামিলিয়া ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হল গোটা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রথম সারির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মূল টার্গেটের অন্যতম, কারণ র‍্যাডিক্যাল স্টুডেন্টস পলিটিক্সের চর্চা এখানকার অন্যতম আইডেন্টিটি। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের পরিবেশ থাকাকেও খুব একটা ভালো চোখে দেখে না গেরুয়া শিবির। এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মাওবাদীদের আখড়া’ এবং ‘দেশদ্রোহীদের আস্তানা’ হিসাবে চিহ্নিত করে গেরুয়া শিবির। অন্যদিকে জামিয়ামিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে টার্গেট করা হয়, এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম প্রভাবিত বলে।

ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশিপ (এনআরসি) এবং সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা সিএএ লাগু করার নামে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ভারতের বাঙালি জাতি ও নানাক্ষেত্রে ধর্মীয়ভাবে মুসলিম পরিচিতিকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে ভিটেমাটি কেড়ে নেওয়ার যে নীল নকশার রচনা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি কীভাবে এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । এর পরিণতি হিসেবে জহওরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল বিজেপির গুন্ডা বাহিনী। অন্য দিকে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকে দিল্লি পুলিশ ছাত্রদের ওপর অকথ্য আক্রমণ করেছিল। লাইব্রেরির ভিতরে পাঠরত অবস্থায় ছাত্রদের টেনে বার করে রীতিমতো পিটিয়ে ছিল দিল্লি পুলিশ। একই ঘটনা ঘটেছিল আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়েও। এই সময়ে যদি বিশেষত ভারতীয় ইলেকট্রনিক মিডিয়্যার বড় অংশের ভূমিকাকে দেখি, তাহলে দেখব, এরা এই সময় নগ্নভাবে বিজেপি-আরএসএসের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিল । তাদের ভাষ্য ছিল, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভারতের সনাতন সংস্কৃতিকে নষ্ট করছে এবং এখানে দেশদ্রোহের চাষ হয়। কখনও এদের পাকিস্তানের কখনওবা চীনের ‘চর’ বলে দাগিয়ে দিয়েছে গদি মিডিয়াগুলি।

সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা ভারতেই বিতর্ক তৈরি করেছে। র‍্যাগিংয়ের কারণে এই ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে তদন্ত করছে পুলিশ। এই মৃত্যুর ঘটনাকে কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটা অত্যন্ত লজ্জার এবং বেদনার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্র ছাত্রী-সহ শিক্ষকরা র‍্যাগিংয়ের তীব্র নিন্দা করেছেন। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিডিয়ার এক অংশ পুরো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করছে। শুধু তাই নয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজকে জনমানুষে খাটো করে দেখান হচ্ছে। পুরো দোষটাই চাপানো হচ্ছে নানাভাবে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কটা ছাত্সংগঠন আছে, তারা কীভাবে কাজ করে, তাদের রাজনৈতিক আদর্শই বা কী, কোনও কিছু না জেনেই একতরফাভাবে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষকদের দায়ী করছে মিডিয়ার একটা অংশ। ঘটনার দু’একদিনের মধ্যেই যেখানে ৩-৪ জন অভিযুক্ত ধরা পড়েছে এবং বিষয়টা নিয়ে যখন তদন্ত চলছে তখন জি ২৪ ঘন্টা টিভি চ্যানেলের মৌপিয়া নন্দী বলে দিলেন এটা নাকি একটা প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা। এই ঘটনার পর ‘দ্য ওয়ার ‘-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, মিডিয়ার এক বড় অংশই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং জহওরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, ‘নেশাখোর’ ও ‘নৈরাজ্যের আখড়া’ বলে আক্রমণ করেছে। ঠিক একইভাবেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুরকে আতঙ্কপুর বলে আক্রমণ করেছেন। শুধু তাই নয়, জহওরলাল নেহের বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কেন বহুত্ববাদী পরিবেশ থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অতি দক্ষিণপন্থীদের হয়ে পোপাগান্ডা চালানো সংবাদমাধ্যম। কিন্তু ওই মধ্য মেধার এবং নিম্ন মেধার সাংবাদিকরা জানেনা যে মুক্ত চিন্তার পরিবেশের মধ্য দিয়েই ছাত্রদের মনে ক্রিটিকাল থিংকিং-এর জন্ম হয়। ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং থেকেই মনে প্রশ্ন জাগে। আর এই প্রশ্ন থেকেই তৈরি হয় রিসার্চ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ছাত্রদের এই মুক্ত পরিবেশের ধরে রাখার সুযোগ দেন বলেই গবেষণায় অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় যাদবপুর। এখন পাশ করে বহু ছাত্রছাত্রী দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত।

উল্লেখ্য, কেরালার সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ ভি শিবদাসন ভারতের শিক্ষা মন্ত্রককে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন যে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্র আত্মহত্যার পরিস্থিতিটা কী? এর উত্তরে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক জানিয়েছে ২০১৮ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে আইআইটি, এনআইটি ও এইমস-সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-মৃত্যুর সংখ্যা ৯৮। সম্প্রতি খড়গপুর আইআইটিতে ফাইজান নামে এক ছাত্রেরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ধরলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৯৯। এইগুলো নিয়ে মিডিয়ার কোন উচ্চবাচ্য নেই। রাষ্ট্রের প্রযুক্তিবিদ্যার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ বা আইআইটিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই র‍্যাগিংয়ের আখড়া। খড়গপুর আইটিতে ফাইজান নামের মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে সেটা নিয়ে কটা প্যানেল ডিসকাশন করেছে আমাদের দেশ সহ বাংলার মিডিয়াগুলি। আসলে ফাইজান ধর্মে মুসলমান। আর আইআইটিগুলো ইউনিয়ন সরকারের অধীনে। তাই এইগুলোকে নিয়ে আলোচনা করলে বিজেপি আরএসএস-এর স্বার্থসিদ্ধি হবে না। তাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে চুপ গদি মিডিয়া। আসলে এরা চায় জহরওলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে দক্ষিণপন্থী তথা হিন্দি-হিন্দু জাতিবাদীদের আখড়া বানাতে । বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী নামক এক গোপন্থীকে উপাধ্যক্ষ পদে বসিয়ে যেমনটা করা হয়েছে। এটাই এদের হিডেন এজেন্ডা। তার জন্য যতটা পারা যায় প্রোপাগান্ডা চালানো দরকার সেটাই চালাচ্ছে সংবাদমাধ্যমের এই অংশ।এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিজেপি আরএসএসের টার্গেটের অন্যতম আর একটা কারণ হলো এরা শিক্ষার গৈরিকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। একদিকে শিক্ষার গৈরিকিকরন অন্যদিকে শিক্ষার বেসরকারিকরণ। এই দুটি উদ্দেশ্য সফল করার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কার্যত পঙ্গু করতে চাই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ঠিক এই কারণেই নয়া শিক্ষনীতি তৈরি করে তা চাপিয়ে দিচ্ছে বিজেপি সরকার। নয়া শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ গুলি হচ্ছে সেই প্রতিবাদের প্রথম সারিতেই আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কে শেষ করার জন্য দুটো পথ বেছে নিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ফান্ড কমিয়ে দেওয়া অন্যদিকে মিডিয়াকে দিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ে দেশবিরোধী কলঙ্ক সেঁটে দেওয়া।

সম্প্রতি ‘লোকনীতি’ ও ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলাপিং সোসাইটি’ যুগ্মভাবে একটি সমীক্ষা করেছে। যার নাম, ‘ভারতীয় প্রচার মাধ্যম: প্রবণতা ও ধরণ’। এই সমীক্ষায় ৮২ শতাংশ সাংবাদিকই বলেছেন, বিজেপির হয়ে কাজ করাটাই তাঁদের কাজের শর্ত। তাঁদের মিডিয়া হাউজগুলি বিজেপির পক্ষেই কাজ করে। এই জন্যই বিশ্ব ‘প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্স’-এ ভারতের স্থান ১৬১। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো রাষ্ট্র ভারতের আগে। হবেই বা না কেন? যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নই করতে দেন না। পৃথিবীর সবথেকে বড় লিখিত গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্ন করতে দেন না এটাই তো সব থেকে বড় লজ্জার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় গিয়েছিলেন । কোনও এক অনুষ্ঠানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এর পাশে বসেছিলেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকী ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন। সেই জন্য গেরুয়া বাহিনীরা সামাজিক মাধ্যমে তাকে কম আক্রমণ করেননি। এই হচ্ছে ভারতবর্ষের সাংবাদিকতার অবস্থা। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এসেছিলেন সংবাদমাধ্যমের অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা বর্ষীয়ান আমেরিকান সাংবাদিক জোয়েল সাইমন। বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ভারতবর্ষের সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভারতীয় সাংবাদিকতার দুরাবস্থা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রতি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা ও প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিকদের প্রশ্নকে গ্রহণ না করা নিয়ে ওনাকে মেইল করেছিলাম। সাংবাদিকতার এই দুরাবস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া নিয়ে উনি গভীর হতাশ প্রকাশ করেছেন। সংবাদমাধ্যমের প্রোপাগান্ডা মূলক প্রচার সমাজের জন্য ক্ষতিকারক বলেও জানিয়েছেন তিনি।

ভারতীয় মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা

ভারতের মিডিয়াগুলো কীভাবে প্রোপাগান্ডা চালায়? প্রোপাগান্ডা জিনিসটাই বা কী? এটা বুঝতে গেলে যেমন প্রোপাগান্ডার ইতিহাসকে জানতে হবে পাশাপাশি আরও দুটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। সেই দুটি বিষয় হল ‘ম্যানুফাকচারিং কনসেন্ট’ ও ‘হেজিমনি’। জেমস ওয়াটসন ও অ্যানি হিলের ‘ডিকশনারি অফ মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন স্টাডিজ’-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘‘Propaganda indicates a deliberate manipulation of thoughts behavior, attitude and beliefs utilizing symbols i.e. words, gestures, images flag, monuments, music and many others.” অর্থাৎ কোনও মাধ্যম দ্বারা মানুষের চিন্তা, ব্যবহার ও বিশ্বাসকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ন্ত্রণ করাটাই হলো প্রোপাগান্ডা। বাংলা উইকিপিডিয়া ‘প্রোপাগান্ডা’কে বলছে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা’। এর দ্বারা ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে পক্ষপাত মূলকভাবে একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা হয়। যদিও প্রোপাগান্ডা শব্দটি তৈরি হয়েছিল ১৬৬২ সালে রোমান ক্যাথলিক গির্জা দ্বারা একটা নতুন প্রশাসনিক সংগঠন থেকে। সংগঠনটির নাম ছিল ‘কংগ্রেগেশিও ডে প্রোপাগান্ডা ফিদে’। এর মানে হল, বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘প্রোপাগান্ডা’ বলা হত। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অক্যাথলিক দেশে ক্যাথলিক বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেওয়া হত।

মার্কিন লেখক এবং সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান ১৯২২ সালে ‘পাবলিক ওপিনিয়ন’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন সাংবাদিকরা কীভাবে প্রোপাগান্ডা চালায়। আসল ঘটনা না দেখিয়ে ঘটনার খণ্ডাংশ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয় এবং আসল বাস্তব ঘটনার কীভাবে বিকৃতি ঘটায়। আর এক আমেরিকান সোসিও -সাইকোলজিস্ট হলেন এডওয়ার্ড বার্নেস। যাকে বলা হয় ‘দ্য ফাদার অফ পাবলিক রিলেশন’। তিনি ‘প্রোপাগান্ডা’ নামেই ১৯২৮ সালে একটি বই লিখেছিলেন। যদিও বার্নেস প্রোপাগান্ডাকে পুরোপুরি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেননি। তিনি মানুষের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রোপাগান্ডার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “মানুষের সংগঠিত ব্যবহার এবং মতামতকে সচেতনভাবে এবং বৌদ্ধিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করাটাও গণতান্ত্রিক সমাজে এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।” যদিও ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে গদি মিডিয়াগুলো কোনওভাবেই এই কাজ করে না। তারা রাষ্ট্রের স্বার্থে এমনভাবে প্রোপাগান্ডা চালায় যেটা মানুষ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকেই প্রোপাগান্ডাকে নেতিবাচক এবং ক্ষতিকারক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে অভিমত পোষণ করেছেন এডওয়ার্ড বার্নেস। আরেক আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল পোপাগান্ডা থিওরিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাজে একটা বিষন্নতা তৈরি করে। সেই সময়ে আরো বেশি করে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের হয়ে প্রোপাগান্ডা চালায় সংবাদ মাধ্যমগুলি।” ঠিক বর্তমানে যে ঘটনাটি ঘটছে ভারতবর্ষে। পল জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন নাৎসি জার্মানির প্রোপাগান্ডা দফতরের মন্ত্রী। তাঁর কাজ ছিল, হিটলারের পক্ষে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো। অর্থাৎ মিথ্যাকে সত্য বানানো। তাঁর থিওরি ছিল- মিথ্যা+মিথ্যা+মিথ্যা…= সত্য। তাঁর মত অনুযায়ী একটি মিথ্যাকে দশবার বললে তা ‘সত্যের মতো’ শোনায়। গোয়েবলসের মন্ত্রকের অধীনে ফিল্ম প্রোপাগান্ডা ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিলেন ফ্রিটজ হিপ্লার। তিনি প্রোপাগান্ডার কার্যকারিতা নিয়ে কাজ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পোপাগান্ডার কার্যকারিতা বৃদ্ধি নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘একটি জটিল বিষয়কে সহজ সরল করতে হবে। এবং এই সহজ সরল প্রক্রিয়ার কাজটা যদি বারে বারেই করা যায় তাহলে প্রোপাগান্ডার কার্যকারিতা অনেক বেশি বেড়ে যায়।’’ যদিও সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের আধুনিক প্রোপাগান্ডা মডেলটা পাওয়া যায় এডওয়ার্ড এস হারমান ও নোয়াম চমস্কির বিখ্যাত বই ‘ম্যানুফাকচারিং কনসেন্ট: দ্যা পলিটিকাল ইকনোমি অফ মাস মিডিয়া’র মধ্যে। হারমান ও চমস্কি এখানে বলেছেন মূলত এলিট মানুষদের স্বার্থেই প্রোপাগান্ড ক্যাম্পেনটা চালানো হয়। এক্ষেত্রে সরকার ও সংবাদমাধ্যম জয়েন্ট ভেঞ্চার হিসাবে কাজ করে বলে অভিমত তাঁদের।

প্রোপাগান্ডা শব্দটি তৈরি হয়েছিল ১৬৬২ সালে রোমান ক্যাথলিক গির্জা দ্বারা একটা নতুন প্রশাসনিক সংগঠন থেকে। সংগঠনটির নাম ছিল ‘কংগ্রেগেশিও ডে প্রোপাগান্ডা ফিদে’। এর মানে হল, বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘প্রোপাগান্ডা’ বলা হত। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অক্যাথলিক দেশে ক্যাথলিক বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেওয়া হত।

‘ম্যানুফাকচারিং কনসেন্ট’, এই শব্দবন্ধটি প্রথম পাওয়া যায় ওয়াল্টার লিফম্যানের বিখ্যাত বই ‘পাবলিক ওপিনিয়ন’ -এ। পরে এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন হারমান ও চমস্কি। এর বাংলা প্রতিশব্দ যদি করতে হয় তাহলে মোটামুটি যেটা কাছাকাছি আসে এটা হল ‘উৎপাদিত সম্মতি’। অর্থাৎ মানুষের একটা নিজস্ব মতামত আছে। সংবাদ মাধ্যম অথবা অন্য কোন মাধ্যম দ্বারা কৃত্রিমভাবে মানুষের সেই মতামতকে প্রভাবিত করে বা নিয়ন্ত্রণ করে এলিট শ্রেণীর মানুষ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে আসল খবর টাকে সংবাদ মাধ্যম নিজেদের মত বিকৃতি ঘটিয়ে মানুষের চিন্তা চেতনাকে প্রভাবিত করে সরকার বা কর্পোরেট এলিটদের স্বার্থে। দুই মার্কসীয় চিন্তক আন্তোনীয় গ্রামসি ও লুইস আলথুসার সংবাদমাধ্যমের এই ভূমিকা নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন। এই ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্টের মধ্য দিয়ে প্রভাবশালীরা নিজেদের হেজিমনি (আধিপত্য) তৈরি করে।

ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুযায়ী হেজিমনি বলতে মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের কথা বলা হলেও গ্রামসি সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কথা বলেছেন। অর্থাৎ শাসক শ্রেণী তাদের সংস্কৃতি অপরের ওপর চাপাতে চায়। এই সংস্কৃতিক আধিপত্য সৃষ্টি করতে শাসকশ্রেণি মিডিয়া সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগায়। এই মিডিয়া সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকেই আর এক মার্কসীয় চিন্তক লুইস আলথুসার বলেছেন ‘ইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস’। অর্থাৎ মিডিয়ার মাধ্যমে শাসকশ্রেণি মানুষের চিন্তা ও চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের আদর্শ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের স্বার্থে। ভারত রাষ্ট্র তাদের ইডিওলজিক্যাল এজেন্ডা ‘হিন্দি হিন্দু ও হিন্দুস্তান’কে ঠিক এভাবেই গোটা দেশে চাপাতে চায়। হারমান ও চমস্কি দেখিয়েছেন কিভাবে সংবাদ মাধ্যম শাসক শ্রেণীর হয়ে মানুষের সম্মতি উৎপাদন করে। শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষকে সচেতন করে। যদিও এঙ্গেলস থেকে শুরু করে ফ্রাঙ্কফ্রুট স্কুলের মার্কসীয় চিন্তাকরা এটাকে ফলস কনশাসনেস ( মিথ্যা চেতনা) বলেছেন। অর্থাৎ শাসক শ্রেণীর হয়ে মিডিয়া যে প্রচার করে সেই প্রচারে মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হয়, তাতে তাদের কোন স্বার্থসিদ্ধি না হলেও লাভবান হয় শাসক শ্রেণী। ভারতের ক্ষেত্রে এটা ভীষণভাবে প্রযোজ্য। তাহলে যেটা বোঝা যাচ্ছে ‘প্রোপাগান্ডা’, ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ এবং ‘হেজিমনি’ – তিনটি শব্দ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ওতোপত ভাবে জড়িত। প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট হয়। অর্থাৎ মানুষের সম্মতি উৎপাদনে শাসকশ্রেণি প্রোপাগান্ডাকে অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগায়। আর মানুষের সম্মতি উৎপাদন হলেই শাসকের হেজিমনি ( আধিপত্য) তৈরি হয়।

রাষ্ট্র ও কর্পোরেট এলিটরা কিভাবে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সংবাদমাধ্যমগুলোকে দিয়ে তাদের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালায় এটা বোঝাতে গিয়ে হারমান এবং চমস্কি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিকাল ইকনমি অফ দা মাস মিডিয়া’ বইতে পাঁচটা ফিল্টারের কথা বলেছেন। এই পাঁচটা ফিল্টার এর মধ্য দিয়ে সমস্ত সংবাদ মাধ্যমগুলিকে যেতে হয় বলে তারা এই বইতে উল্লেখ করেছেন। মূলত আমেরিকান প্রেক্ষিতেই এই পাঁচটা ফিল্টার কে বর্ণনা করলেও এখানে ভারতীয় প্রেক্ষিতেই আলোচনাটা হবে।

প্রথম ফিল্টারটি হল গণমাধ্যমের মালিকানা (Ownership)। এসেল গ্রুপ, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, বেনেট অ্যান্ড কোলম্যান, এবিপি গ্রুপ, ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপ– এই কর্পোরেশনগুলিই মূলত ভারতের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম গুলিকে চালায়। এই কোম্পানিগুলির আসল লক্ষ্যই হল সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে লাগামছাড়া মুনাফা উপার্জন করা। বহুমাত্রিক সংস্কৃতি দেশে বিরাজ করলে এদের ব্যাবসা চালাতে অসুবিধা হবে । তাই এরা চাই দেশে একমাত্রিক সংস্কৃতি। এদের দ্বারা পরিচালিত সংবাদ মাধ্যমগুলি সরাসরি বা ঘুরপথে বিজেপির হিন্দুত্ব এজেন্ডাকে সমর্থন করে তাদের ব্যবসার স্বার্থেই। ‘কোবরা পোস্ট অপারেশন-১৩৬’-এর তথ্য অনুযায়ী যত বড় মিডিয়া হাউজ তারা ততই হিন্দুত্ব এজেন্ডাকে সমর্থন করে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে।

হারমান ও চমস্কির দ্বিতীয় ফিল্টারটি হল বিজ্ঞাপন (Advertising)। গণমাধ্যম চালাতে যে বিশাল খরচ হয় তার খুব ক্ষুদ্র অংশই গ্রাহকদের কাছ থেকে আসে। গণমাধ্যমগুলিকে নির্ভর করতে হয় বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের ওপর। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার মাদার কোম্পানি ‘বেনেট অ্যান্ড কোলম্যান’-এর ভাইস চেয়ারম্যান সমীর জৈন একদা বলেছিলেন, ‘‘আমরা নিউজ পেপার বিজনেস করিনা, বিজ্ঞাপন বিজনেস করি…’’, এই কথা থেকেই পরিষ্কার নিউজ পেপারটা মূলত বিজ্ঞাপন ছাপানোর একটা জায়গা। বড় বিজনেস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকে সরকারের। মিডিয়া হাউজ গুলোকে শুধু বিজ্ঞাপন দাতাদের নয়, সঙ্গে সঙ্গে সরকারেরও মন জুগিয়ে চলতে হয়।

তৃতীয় ফিল্টারটি হল সংবাদের উৎস (Sourcing)। সংবাদ সংগ্রহের জন্যেও সাংবাদিকদের সরকারি সংস্থা ও কর্পোরেট সংস্থার উপর নির্ভর করতে হয়।

চতুর্থ ফিল্টারটি হল ‘Flak’। হারমান ও চমস্কি ‘Flak’ কে বর্ণনা করেছেন নেগেটিভ রেসপন্স (নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া) হিসাবে। সংবাদ মাধ্যম যদি সরকার বা কর্পোরেট বিরোধী কোনও খবর পরিবেশন করে তাহলে ওই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া জানাবে সরকার কিংবা কর্পোরেট সংস্থাগুলি। এবং সেই প্রতিক্রিয়া হতে পারে যেমন শাস্তিমূলক , তেমনই সংবাদ মাধ্যমগুলিকে এক ঘরে করে দেয়ারও প্রচেষ্টা চলতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতবর্ষে অনেক উদাহরণ আছে। এর সবথেকে বড় উদাহরণ হল এনডিটিভির মালিকানা কৌশলে ছিনিয়ে নেওয়া, এমনকী কলকাতার বৈদ্যুতিন মাধ্যম ‘কলকাতার টিভি’র কর্নধারকে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো। এনডিটিভি সরাসরি বিজেপি সরকারের সমালোচনা করত তাই দীর্ঘ দিন ধরেই এই টিভি চ্যানেল সরকারের নজরে ছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি বলে পরিচিত গৌতম আদানি। গৌতম আদানি একপ্রকার রাজনৈতিক কৌশলে এই টিভি চ্যানেলটিকে কিনে নিয়েছে। এই বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে কম সমালোচনা হয়নি। আল জাজিরা, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং ভারতের ম্যাগাজিন ফ্রন্টলাইন এই কৌশলে চ্যানেলটিকে কিনে নেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেছে। একইভাবে বাংলা টিভি চ্যানেল কলকাতা টিভি বিজেপির বিরুদ্ধে খবর পরিবেশন করে বলে সেই টিভি চ্যানেলকেও বন্ধ করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিজেপির হয়ে ফেক ও প্রোপাগান্ডা নিউজকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য অল্ট নিউজের কো ফাউন্ডার মোহাম্মদ জুবেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল । প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের বিরুদ্ধেও। এরকম অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ আছে যেখানে সরকার বিরোধী খবর করলেই তাদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে।

হারমান ও চমস্কির পঞ্চম ও সর্বশেষ ফিল্টারটি হল ‘ইডিওলজি অফ অ্যান্টি কমিউনিজম’ (কমিউনিজম বিরোধী আদর্শ)। ভারতের ক্ষেত্রে অ্যান্টি কমিউনিজমের পাশাপাশি ‘ইসলামোফোবিয়া’কেও পঞ্চম ফিল্টার হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। জনসম্মতি উৎপাদনের জন্য রাষ্ট্র সব সময় কিছু শত্রুকে সামনে রাখে। বামপন্থা ও মুসলমানদের দেশের শত্রু হিসেবে দেখিয়ে মিডিয়া সংখ্যাগুরু অংশের মনে ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে নিয়ে আসে। ঠিক এইভাবে জহরওলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে মানুষের কাছে দেশদ্রোহী হিসাবে দেখানো হয়। যেহেতু এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ই ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকরা বামপন্থা দ্বারা প্রভাবিত। মুসলিমদের শত্রু হিসেবে দেখিয়ে বলা হয়, যে হারে দেশে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে তাতে একদিন ভারতবর্ষ মুসলমানদের কবলে চলে যাবে। যদিও ভারত সরকারের তৈরি সেনসাস বলছে দেশে মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার আগের থেকে কমছে। কিন্তু যুক্তি, সেন্সাস এর তথ্যকে গুরুত্ব না দিয়ে পুরুটায় কাল্পনিকভাবে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সামনে মুসলমানদের শত্রু হিসেবে দেখানোর বিজেপির যে হিডেন এজেন্ডা সেটাকেই চ্যাম্পিয়ন করার চেষ্টা করে সংবাদ মাধ্যমের একটা বিরাট অংশ। কোভিডের সময়ে তাবলিঘের জমায়াতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য মুসলমানদের দায়ী করতে দেখা গিয়েছিল সংবাদ মাধ্যমকে। কিংবা সিএএ ও এনআরসি আন্দোলনের সময়ও মিডিয়ার একাংশ তীব্র মুসলিম বিরোধী প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিল।

ভারতের প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমগুলিতে শুধুই যে সরকার এবং কর্পোরেটের আধিপত্য কাজ করে তাই নয়, নিউজরুমগুলিতে উচ্চবর্ণের কর্তৃত্ব দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে রমন ম্যাগসেসাই অ্যাওয়ার্ড জয়ী সাংবাদিক পি সাইনাথ একদা বলেছিলেন, ‘‘ভারতে দলিত রাষ্ট্রপতি, দলিত বিচারপতি, দলিত ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার হয়েছে। কিন্তু প্রথম সারির বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমগুলির নিউজরুমগুলিতে দলিত, আদিবাসী প্রতিনিধি খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।’’ বর্তমানে প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলির মালিকরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসক দল বিজেপির সঙ্গে যুক্ত। যে দুটি সংবাদমাধ্যম বেশি বিজেপির হয়ে প্রোপাগান্ডা চালায় তারা হল জি মিডিয়া ও রিপাবলিক টিভি। মিডিয়া ব্যারন সুভাষচন্দ্র হলেন জি মিডিয়া কর্পোরেশনের মালিক। তিনি বিজেপির সাহায্য নিয়ে প্রাক্তন রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। রিপাবলিক টিভি তৈরি করেছিলেন অর্ণব গোস্বামী ও রাজীব চন্দ্রশেখর। রাজীব চন্দ্রশেখর বর্তমানে একজন বিজেপির সদস্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। অন্যদিকে অর্ণব গোস্বামীও যে বিজেপির একদম কাছের লোক সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এনডিটিভির বর্তমান মালিক গৌতম আদানিকে পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নয়নের মণি হিসাবেই ধরা হয়। অন্যদিকে নেটওয়ার্ক ১৮ গ্রুপের কর্ণধার মুকেশ আম্বানিও মোদির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এই কারণেই প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমের পলিসি বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা প্রভাবিত। ভারতের প্রায় ৯০% প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যম কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যেকটা পদক্ষেপকেই সমর্থন করে। এই বিষয়টাকে ইন্দিরা গান্ধীর সময়কার এমার্জেন্সির সঙ্গে তুলনা টেনে পি সাইনাথ কটাক্ষ করে বলেছেন,‘‘ইমার্জেন্সসির সময়ে সংবাদ মাধ্যমগুলিকে ঝুঁকতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তারা হামাগুড়ি দিয়েছিল। কিন্তু এখন সংবাদ মাধ্যমগুলিকে আর কিছু বলারই দরকার হয় না।’’ এর মানে, পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় গেছে যে সংবাদমাধ্যমগুলোকে না বললেও তারা হামাগুড়ি দিতে থাকে।

এবার দেখা যাক ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলির গত দু’তিন বছরের প্রোপাগান্ডার চিত্র। ওই সময়ের মধ্যে ৫৬ ইঞ্চির ছাতির প্রধানমন্ত্রীকে যেটা সবথেকে বেগ দিয়েছিল কৃষক আন্দোলন। স্বাধীনতার পর কৃষক আন্দোলন এক অর্থে ঐতিহাসিক। এই আন্দোলনে কমপক্ষে ৭০০ কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। জাতি, ধর্ম সব এক হয়ে কৃষকরা এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই কৃষক আন্দোলনকে কম আক্রমণ করেনি মোদিপন্থী মিডিয়াগুলি। এই কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে কখনও খালিস্তানি জঙ্গিদের যোগ কখনও আবার পাকিস্তানের যোগ আছে বলে আন্দোলনকে দাগিয়ে দিয়েছিল ওই সংবাদমাধ্যমগুলি। কিন্তু দীর্ঘ কৃষক আন্দোলনের পর ২০২১ সালের ১৯শে নভেম্বর নরেন্দ্র মোদি একপ্রকার বাধ্য হয়ে বিতর্কিত কৃষি বিল প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। এতদিন যে সংবাদ মাধ্যমগুলি আন্দোলনের সমালোচনা করেছিল তারায় ঐদিন মোদির হয়ে প্রোপাগান্ডামূলক প্রচার করতে শুরু করে দিয়েছিলো। ওইদিন রিপাবলিক টিভির আলোচনায় অর্ণব গোস্বামীর বক্তব্য, ‘কৃষক আন্দোলনের নাম করে যারা এতদিন দেশটাকে জ্বালাতে চেয়েছিল তাদের আর এখন কিছুই করার নেই। তারা এখন রাস্তা আটক করতে পারবে না, তাদের কাছে পাকিস্তানি কিংবা খালিস্তানিদের সমর্থন নেওয়ার আর সুযোগ থাকলো না।” অর্থাৎ কি ধরনের প্রোপাগান্ডা চালালে এ ধরনের কথা বলা যেতে পারে গোস্বামীর এই বক্তব্য থেকেই সেটা পরিষ্কার। ‘নিউজ নেশনের’ দীপক চৌরাসিয়া, ‘নিউজ ইন্ডিয়া ১৮’-এর আমন চোপড়া বা ‘ আজ তাক ‘-এর অঞ্জনা ওম কাশ্যপ – এরা তো মোদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন।

দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরীতে ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল যখন মুসলমানদের ঘর এবং দোকান বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দিয়েছিল বিজেপি পরিচালিত দিল্লি মিউনিসিপাল কর্পোরেশন সেই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি মিউনিসিপাল কর্পোরেশন এর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করলেও সংবাদমাধ্যমের একাংশ নির্লজ্জ হবে এই ঘটনাকে বলেছিল, ”‘‘বেআইনি দখলের বিরুদ্ধে এটা দিল্লি কর্পোরেশনের ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।’’ প্রোপাগান্ডা ফিল্ম ‘কাশ্মীর ফাইলস’কে জনমগজে ছড়িয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী-সহ গোটা কেন্দ্রীয় সরকার উঠে পড়ে লেগেছিল তার উদাহরণ আমরা দেখেছি। এ সম্বন্ধে ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার আনন্দ পটবর্ধন বলেছেন, ‘‘আমরা ইতিহাসে এই প্রথম দেখলাম কোনও এক প্রধানমন্ত্রী একটা ঘৃণা ছড়ানো সিনেমার বক্স অফিস সাফল্যের জন্য সিনেমা দালাল হিসেবে কাজ করছে।’’

উত্তরপূর্বের রাজ্য মণিপুরে গত প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে চলছে জাতি দাঙ্গা। কত চার্চ পুড়েছে, ঘরবাড়ি পুড়েছে, কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, মহিলাদের বিবস্ত্র অবস্থায় ঘোরানো হয়েছে, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কেন্দ্রেও বিজেপি সরকার, মণিপুরেও বিজেপি সরকার। কটা সংবাদ মাধ্যম বিজেপি সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে? এত নির্মম ঘটনার পরেও রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি হলো না, এটা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম প্রশ্ন তুলেছে কি? এটাও এক ধরনের মিডিয়া প্রোপাগান্ডা। অর্থাৎ সরকারকে রক্ষা করাও এক ধরনের প্রোপাগান্ডা। গত ৩১ শে জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় মণিপুর নিয়ে একটি খবর বেড়িয়েছে। খবরের শিরোনাম হল, ‘‘মনিপুরে হিংসার পর্দার আড়ালে মাদকের কারবার’’। বলছিনা যে খবরটা ভুল। নিশ্চয়ই এটা একটা খবর। কিন্তু আসল ঘটনাকে আড়াল করে দেওয়ার এটা কি একটা প্রচেষ্টা নয়? কিছু সামাজিক মাধ্যমে খবর বেড়িয়েছিল যে মনিপুরের মাটির নিচে বিশাল খনিজ সম্পদ আছে। সেই খনিজ সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতেই চক্রান্ত করে এই দাঙ্গা বাঁধানো হয়েছে বলে সমাজ মাধ্যমে বহু লেখালেখি হয়েছে। অন্যদিকে সংখ্যাগুরু মেইতেইদের ( যারা ধর্মে মূলত হিন্দু) সংখ্যালঘু কুকিদের ( যারা ধর্মে মূলত খ্রিস্টান ও মুসলিম) দাঙ্গা তৈরিতে বিজেপির রাজনৈতিক হাত রয়েছে বলেও সামাজিক মাধ্যমে লেখালিখি হয়েছে। গোটা উত্তর পূর্বেই এই ঘটনা কেন্দ্র করে মেরুকরণ ঘটানোর বিজেপির একটা কৌশল বলেও সামাজিক মাধ্যমে উঠে এসেছে। আসল ঘটনাকে গোপন করাটাও সংবাদমাধ্যমের এক ধরনের প্রোপাগান্ডা।

হ্যাঁ এটা ঠিক, প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলো যে হারে সরকার ও কর্পোরেটের হয়ে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার কাজটা খুবই কঠিন। পাল্টা প্রচার যে একদম হচ্ছে না তা নয়। দ্য হিন্দু সংবাদপত্র ফন্টলাইন ম্যাগাজিন এখনো তাদের প্রগতিশীল সাংবাদিকতাটা ধরে রেখেছে। অন্যদিকে অল্ড নিউজ এবং বুমের মতো বেশ কিছু সংবাদ পোর্টাল কোনটা পোপাগান্ডা নিউজ এবং কোনটা ফেক নিউজ সেটা মানুষকে জানানোর কাজটা নিরন্তর ভাবেই করে চলেছে। অন্যদিকে ‘দ্য ওয়ার ‘এর মত বেশ কিছু নিউজ পোর্টাল ও প্রগতিশীল সাংবাদিকতা করছে। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর পাল্টা হিসাবে তথ্যচিত্র নির্মাতা সন্দীপ রবীন্দ্রনাথ ৯ মিনিটের ‘অ্যানথেম ফর কাশ্মীর’ নামে একটি শর্টফিল্ম তৈরি করেছিলেন। যদিও সেটা বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের চাপে ইউটিউব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে গ্রামসির কাউন্টার হেজিমনির উল্লেখ করতে হয়। ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হলে, শাসক এবং কর্পোরেট যেভাবে মিডিয়া প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করছে তার বিরুদ্ধে থাকা গণতান্ত্রিক মানুষদের পাল্টা আধিপত্য তৈরি করতে হবে। সেই আধিপত্য বিস্তারের কাজ দুই প্রকারে হতে পারে । প্রয়োজনে এই অল্টারনেটিভ মিডিয়ার মাধ্যমে পাল্টা প্রোপাগান্ডা চালাতে হবে। সেই প্রোপাগান্ডাটা প্রাচ-প্রকৃতির ভারসাম্য, সহাবস্থান ও বৈচিত্রের পক্ষে। কমিউনিকেশনের ভাষায় যেটাকে বলা হয় ‘হোয়াইট পোপাগান্ডা’। অন্যদিকে বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ করে করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রের পক্ষে থাকা অধ্যাপক ও শিল্পী সাহিত্যিকদের মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব নিতে হবে। এদেরকেই গ্রামসি বলেছেন ,”অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল”। যেভাবে মুক্তচিন্তার পক্ষে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তার বিরুদ্ধে শিক্ষক শ্রেণিকে প্রবলভাবেই রুখে দাঁড়াতে হবে। এই পাল্টা আধিপত্যের কাজ ভারতের বাম দলগুলি সেইভাবে করে উঠতে পারেনি। এটা যে তাদের ব্যর্থতা সেটা স্বীকার করতেই হবে। শুধুই দলীয় মুখপত্রের মাধ্যমে মানুষকে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে সচেতন করা যাবে না। জেলায় জেলায় ছোট ছোট অল্টারনেটিভ মিডিয়া তৈরি করে মানুষকে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে সচেতন করতে হবে। তাতে যেমন কিছু বেকার ছেলের কর্মসংস্থান হবে পাশাপাশি বাম প্রগতিশীল ইডিওলজিটাও মানুষের কাছে ছড়ানো যাবে। বাংলার প্রেক্ষিতে বলতে গেলে অবশ্যই যারা ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী আইকন তাদের এতদিন কোনভাবেই ব্যবহার করেনি বাম দলগুলি। বিশেষ করে চৈতন্য, নিত্যানন্দ, লালন শাহ, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর, এমনকী যোগেন মণ্ডল ও মওলানা ভাসানী যারা সরাসরি ব্রাহ্মণ্যবাদ-সহ সকলপ্রকার কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন নিম্নবর্গের মানুষের স্বার্থে, তাঁদের মুল্যায়ণ না করাটা বাম দলগুলির ঐতিহাসিক ভুল বলেই মনে করি। চৈতন্যদেব যে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন সেটা নিয়ে কটা তথ্যচিত্র হয়েছে এই বাংলায়? এই কাজ না হওয়াই চৈতন্যদেবকে হাইজ্যাক করে নিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। কিংবা লালনের যে মানুষ ভজনার পথ– তা নিয়েও কাজ খুব কম হয়েছে। আর যোগেন মণ্ডল আর হরিচাঁদ ঠাকুরকে নিয়ে তো কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজই হয়নি। মওলানা ভাসানী ও তাঁর রবুবিয়াত বা প্রতিপালনের তত্ত্ব, পশ্চিমবঙ্গে ক’জন জানেন? অথচ প্রাণ-প্রকৃতির সহাবস্থান এবং জগতের সকল প্রাণিক সত্তার হকের পক্ষে তিনি যে দার্শনিক জগত এবং রাজনীতিকে ঈশানবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গ হয়ে বড় বাংলার মানুষের কাছে রেখে গিয়েছিলেন তা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে নয়া সবুজ সাম্যের নব্য কমিউনিজমের চর্চাকে উস্কে দেন এবং ধর্ম যে জাতিবাদ বা পরিচয়বাদী আস্ফালনের বিষয় নয়, তা তিনি স্পষ্ট করে দেন। তাই এখন সময় এসেছে এইসব বাতিঘরদের নিয়ে কাজ করার। বাংলার প্রেক্ষিতে বলতে গেলে, ব্রাহ্মণ্যবাদ-সহ সকল প্রকার কর্তৃত্ববাদ বিরোধী আমাদের ঐতিহাসিক স্ট্রাগলকে মানুষের সামনে তুলে ধরাটাও এক প্রকারের কাউন্টার-হেজিমনিক কাজ।

নজরুল আহমেদ জমাদার

গণজ্ঞাপন বিষয়ক গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাংবাদিক।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top