জিরার্দের ‘মিমেটিক তত্ত্বকথন’-এর সাদৃশ্যতায় বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’

।। নাসরিন জে রানি ।।

বেকেটের নতুন নাট্যরীতি এবং ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ থেকে যে মেসেজ পাওয়া যায়, তা তুলনামুলক দৃষ্টিকোণ থেকে আরেক ফরাসি সাহিত্য সমালোচক, মনস্তত্ত্ববিদ রেনে জিরার্দের বিখ্যাত তত্ত্ব ‘মিমেটিক থিয়োরি’-এর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে প্রায় সমতলধর্মী বলা যায়। আর তাই জিরার্দের মিমেটিক তত্ত্বকথনের আলোকে ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ নিয়ে সংক্ষেপে আলাপ করা যেতে পারে।

জিরার্দের ‘মিমেটিক তত্ত্বকথন’-এর সাদৃশ্যতায় বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’

রেনে নোয়েল থিওফিল জিরার্দ একজন ফরাসি ইতিহাসবিদ, সাহিত্য সমালোচক এবং সমাজবিজ্ঞানের দার্শনিক ছিলেন। তাঁর কাজগুলো নৃতাত্ত্বিক দর্শন ঐতিহ্যের অন্তর্গত। জিরার্দ প্রায় ত্রিশটির অধিক বই লিখেছেন। যার সিংহভাগ একাডেমিক পাঠ্যক্রমের রেফারেন্স বই হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়। জিরার্দের মৌলিক ধারণাগুলো সহিংসতার ফলে মানুষের বিভিন্ন সমাজগুলোর উপর দীর্ঘস্থায়ী কী ধরনের প্রভাব ও সমস্যার সৃষ্টি হয় তা বোঝার জন্য ব্যাখ্যা, এবং তত্ত্ব বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে রচিত। জিরার্দ বলেন, যদিও আমরা অনুমান করতে পারি যে- অনুকরণ, অতঃপর তাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভূত হয়, যার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। জিরার্দের গবেষণার মুল প্রতিপাদ্য ছিল মানবসমাজের সহিংসতা, যা প্রকৃতপক্ষে অনুরূপতার থেকে বৃদ্ধি পায়।তার ব্যাখ্যায় একটি শব্দ বা কী-ওয়ার্ড বলা যায় তা হলো ‘অনুকরণ’।এই অনুকরণের প্রবণতার দৃষ্টিকোণ থেকে রেনে জিরার্দ সাহিত্য এবং ধর্ম, নৃতত্ত্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এমন কী সমাজবিজ্ঞানকে বোঝার জন্য একটি তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন,নাম দিয়েছেন ‘মিমেটিক থিয়োরি’।

জিরার্দ বলেন, “পুরো বিশ্বকে এককভাবে বিশ্বায়িত করা সম্ভব হলে, সে মুহূর্তে আপনি চাইলে একটিমাত্র দিয়াশলাই কাঠি জ্বেলে তাতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারবেন” (Girard said, “when the whole world is globalized, you will able to fire the whole thing through a single match-stick” – From the ‘Things Hidden Since the Foundation of the World ‘ book)

রেনে জিরার্দের মিমেটিক তত্ত্বের চারটি পর্যায় রয়েছে।

১। মিমেটিক ডেজায়ার বা মিমেটিক ইচ্ছা। ২। মিমেটিক রাইভালরি বা মিমেটিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা বিরোধিতা। ৩। বলির পাঁঠা/স্কেইপগোট। ৪। শান্তিপূর্ণ অবস্থা। আজকের আলোচনা তাঁর ‘থিংস হিডেন সিন্স দি ফাউন্ডেশন অব দি আর্থ’ বই থেকে সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে আলোচিত হলো।

মিমেটিক ডেজায়ার / মিমেটিক ইচ্ছা:

মানুষের নিজস্ব ইচ্ছা বলে কিছু নেই।মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অন্য মানুষের ইচ্ছা অনুকরণ করে। প্রতিটি মানুষ দৈনন্দিন প্রায় সবকিছুই অন্য আরেকজনকে অনুকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। একথা সত্যি যে আপনি এবং আমি মিমেটিক প্রাণী। আমরা একে অন্যের স্বভাবগুলোকে অনুকরণ করি। রেনে জিরার্দের তত্ত্বে দেখা যায়, একজন মানুষ বা আইডল, তার একজন ইমিটেটর বা অনুকরণকারী আছে, দুইজনের মধ্যে সাধারণ যেকোনো একটি বস্তু বা অবজেক্টের উপস্থিতি আছে এবং যার থেকে মডেলকে অনুকরণ করছে তার ইমিটেটর বা অনুকরণকারী তাৎক্ষনিক ইচ্ছাশক্তির প্রকাশে বা ডেজায়ারে আক্রান্ত হয়ে। এই সবগুলোই মডেল বা প্রথম মানুষটিকে দেখে দ্বিতীয় ব্যক্তির মনে (বা অন্যান্য ক্ষেত্রে তার অধিক লোকের মনে) মিমেটিক ডেজায়ারের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। সহজভাবে বলতে গেলে মানুষের নিজস্ব কোনো ডেজায়ার নেই, অন্যের ডেজায়ার বা একই রকম বিষয়ে আগ্রহ দেখে তার নিজের মাঝে সেইরকম ডেজায়ারের জন্ম লাভ করে, তা যেকোনো কিছু হতে পারে যা তারপক্ষে পূরণ করা সম্ভব হউক বা অসম্ভবই হউক না কেন! এখানে মিমেটিক ডেজায়ারের কিছু উদাহরণ জানার মাধ্যমে সহজে ব্যাপারটি বুঝে নেয়া যায়।

— কোনো একটি রেস্তোরাঁতে বসে পাশের টেবিলে কাউকে কিছু খেতে দেখে নিজের জন্যও সেই একইরকম খাবার অর্ডার করা।
— জুতার দোকানের সামনে দিয়ে যেতে যেতে দোকানে সাজানো জুতা দেখে বা এমনি কোথাও কোনো আকর্ষণীয় জুতার ছবি দেখে, অথবা কারো পায়ের জুতা, বা কাউকে দৌড়াতে বা হেঁটে যেতে দেখে,মনে মনে সেই জুতা কেনার আকাঙ্খা করা। এর বাইরে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখে,শপিংমলে বিভিন্ন জুতার দোকানে ঢু মেরেও এমন ডেজায়ারে আক্রান্ত হতে পারে কেউ কেউ।
— কোনো মডেল বা ব্যক্তির হেয়ারস্টাইল দেখে (যেমন- নায়ক/ নায়িকা/ গায়ক/ বড়ভাই/ বন্ধু/ বাবা/ অন্যকেউ) নিজে সেইরকম হেয়ারস্টাইল অনুকরণ করতে চাওয়া; এই দৃশ্য শহুরে সেলুন বা বিউটিপার্লারগুলোর বিভিন্ন হেয়ার স্টাইলের বিজ্ঞাপনের বইগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে সহজেই অনুমেয় হয়।
— দেশীয় বিবিধ জাতীয়-উৎসবগুলোতে বিশেষধরনের সাজপোষাক পরিধান করা, যা অত্যাবশ্যকীয় নয় কিন্ত শখের কারণে সবাই পরিধান করে থাকে। বসন্ত উৎসব বা ফাল্গুনের প্রথমদিন উদযাপনে মাথায় ফুলের মালার মুকুট, একুশে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় পতাকার ব্যাজ পরিধান ইত্যাদি, যা আমরা উৎসব উদযাপনের জন্য নির্দিষ্টস্থানে সমবেত হওয়া অন্যদেরকে দেখে নিজেরাও সেইরকমভাবে অংশগ্রহণ করে থাকি, বা উৎসাহী হয়ে উঠি।
— সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘন ঘন প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন করা, নিজেকে অন্যের মতো সুন্দর করে উপস্থাপনের চেষ্টা, বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমনের ছবি দেয়া, বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বসে যে খাবার খাচ্ছি তার ছবি দেয়া, পরিবারের সাথে বিভিন্ন দিবস উদযাপনের ছবি দেয়া, ঘন ঘন বিভিন্ন বিষয়ের আপডেট দেয়া, একাধিক স্টেটাস দেয়া ইত্যাদি এই সবই মিমেটিক ডেজায়ারের সহজ বহিঃপ্রকাশ।

মিমেটিক ডেজায়ার স্বল্পস্থায়ী থেকে দীর্ঘস্থায়ী বা টেকসই কিছুকে অনুসরণ করেও হতে পারে। যেমন, একটি নির্দিষ্ট কর্মজীবন বা চাকুরীর জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং প্রস্তুতি (বিসিএস ক্যাডার,বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা,যা সামাজিক মর্যাদা ও স্থির অর্থনৈতিক আয়ের সুন্দর মাধ্যম হিসেবে আমাদের সোসাইটিতে এর জনপ্রিয়তা রয়েছে। পূর্বের অনেকেই এই রকমের সফল জীবনধারণ করেছেন, তাই পরবর্তী প্রজন্মগুলোও এইপথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী ও উদ্যমী হয়েছে বা হতে পারে)।

আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে,একটি মনোরম স্থান ও পরিবেশে বসবাস করার আকাঙ্ক্ষা এবং মধ্যবয়সে এসে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ছোট একটি বাড়ি গড়ে তোলা,পরিবার নিয়ে সেই বাড়িতে সুখীজীবনের স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা লালন করা।

অন্যরকম মিমেটিক ডেজায়ারের মধ্যে আছে বিভিন্ন জ্ঞানী ব্যক্তিদের জীবনী অনুসরণ করে নিজেকে তাদের মতো গড়ে তোলার চেষ্টা করা।

আমরা একে অন্যের স্বভাবগুলোকে অনুকরণ করি। রেনে জিরার্দের তত্ত্বে দেখা যায়, একজন মানুষ বা আইডল, তার একজন ইমিটেটর বা অনুকরণকারী আছে, দুইজনের মধ্যে সাধারণ যেকোনো একটি বস্তু বা অবজেক্টের উপস্থিতি আছে এবং যার থেকে মডেলকে অনুকরণ করছে তার ইমিটেটর বা অনুকরণকারী তাৎক্ষনিক ইচ্ছাশক্তির প্রকাশে বা ডেজায়ারে আক্রান্ত হয়ে। এই সবগুলোই মডেল বা প্রথম মানুষটিকে দেখে দ্বিতীয় ব্যক্তির মনে (বা অন্যান্য ক্ষেত্রে তার অধিক লোকের মনে) মিমেটিক ডেজায়ারের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। সহজভাবে বলতে গেলে মানুষের নিজস্ব কোনো ডেজায়ার নেই, অন্যের ডেজায়ার বা একই রকম বিষয়ে আগ্রহ দেখে তার নিজের মাঝে সেইরকম ডেজায়ারের জন্ম লাভ করে, তা যেকোনো কিছু হতে পারে যা তারপক্ষে পূরণ করা সম্ভব হউক বা অসম্ভবই হউক না কেন! এখানে মিমেটিক ডেজায়ারের কিছু উদাহরণ জানার মাধ্যমে সহজে ব্যাপারটি বুঝে নেয়া যায়।

মিমিটিক রাইভালরি / মিমিটিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা:

মানুষ যেমন অনুকরণপ্রিয় জীব, কেউ কেউ নির্দিষ্ট জিনিসটিকে পেতে মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করে, তাই সে যখন বস্তুটি অর্জনের জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে, অতঃপর বস্তুটি লাভ করে,তা দেখে তখন অন্য আরেকজনের তার নিজের মাঝে মিমিটিক ইচ্ছা জাগ্রত হতে পারে,এখানে দ্বিতীয়ব্যক্তির ইচ্ছাটি প্রথমব্যক্তিকে অনুকরণের মাধ্যমে এলো। এই অনুকরণের কারণে দুই ব্যক্তির মাঝে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি নাও হতে পারে যদি দুইজন ভিন্ন-সময় বাস্তবতাতে অবস্থান করে থাকেন।  কিন্ত অন্যদিকে এই অনুকরণের ফলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টিও হতে পারে,যা কখনো কখনো ক্ষতিকর রূপ নিয়ে সংঘাতের পথকে সুগম করে দেয়।যখন একটি অবজেক্টকে ঘিরে, একজন আইডল বা মডেল এবং তার অনুকরণকারী বা ইমিটেটরের লক্ষ্য কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় তখন ক্ষতিকর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে একপ্রকারের কলহ বা যুদ্ধের মাধ্যমে যে কোন একপক্ষের জয়লাভ হয়ে থাকে।

উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এমন-
দুটি শিশু একসঙ্গে অনেক খেলনা নিয়ে খেলার সময় যেকোনো একটি খেলনার দখলকে কেন্দ্র করে নিজেদের মাঝে মারামারিতে জড়িয়ে যেতে পারে। কেননা প্রথম শিশুর হাতে সেই বিশেষ খেলনা দেখে অন্য শিশুটি বাকি খেলনাগুলোকে ভুলে গিয়ে প্রথম শিশুর হাত থেকে তা কেড়ে নিতে উদ্যত হতে পারে, তখন যার হাতে খেলনাটি রয়েছে সেই শিশুটি তা দিয়ে দিতে সম্মত না হলে পারস্পরিক কান্না শুরু করে দিতে পারে; ঘটনাটি যেন এমন,
“এটা আমার!!”
“না, এটা প্রথমে আমার ছিল !!”

মানবসভ্যতার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায়,প্রাচীন মানব সমাজগুলোতে মূলসমস্যা বা দ্বন্দ্বগুলো এই ধরনের অনুকরণ বা মিমিটিক রাইভালরির মাধ্যমেই উদ্ভুত হয়েছিল। একটি বস্তু(বা বিষয়)অন্যের ভাল লেগেছে,তাই সেই জিনিসটি আমারও ভাল লাগছে,আমার তা চাই।তাই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল,আর এই প্রতিযোগিতা সংকটের প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে কাজ করে।

এই অনুকরণের কারণে দুই ব্যক্তির মাঝে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি নাও হতে পারে যদি দুইজন ভিন্ন-সময় বাস্তবতাতে অবস্থান করে থাকেন।  কিন্ত অন্যদিকে এই অনুকরণের ফলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টিও হতে পারে,যা কখনো কখনো ক্ষতিকর রূপ নিয়ে সংঘাতের পথকে সুগম করে দেয়।যখন একটি অবজেক্টকে ঘিরে, একজন আইডল বা মডেল এবং তার অনুকরণকারী বা ইমিটেটরের লক্ষ্য কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় তখন ক্ষতিকর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে একপ্রকারের কলহ বা যুদ্ধের মাধ্যমে যে কোন একপক্ষের জয়লাভ হয়ে থাকে।

বলির পাঁঠা বা স্কেইপগোট:

সংকট ও সংঘাত যেমন মিমিটিক সংক্রামণের সাথে শুরু হয়ে যায়, তেমনই খুব মিষ্টিভাবে তা শেষ হওয়া উচিত; কিন্তু সমজাতীয় মিমেসিসের কারনে সমাজে বিভিন্নপ্রকার সমস্যা দেখা দেয়।সেই সমস্যাগুলোর মধ্য থেকে যেকোনো একটি অভিযোগ আকারে সামাজিকক্ষেত্র জুড়ে মিমিটিক সংক্রামণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে- এটি একটি বিশেষ ব্যক্তিকে( বলির পাঁঠা) ঘিরে, বা এই রকমের কিছু ইস্যুকে নিয়ে, অথবা একক একটি শিকারকে (স্কেইপগোট) কেন্দ্র করে একীভূত হয়ে ওঠে।
স্কেইপগোটিং’এর শুরুতে দেখা যায়-

ক) সকলের বিরুদ্ধে সবাই
( সকলপ্রকারের পক্ষ দল < মুখোমুখী> সকল ধরণের বিপক্ষ দল )।
খ) এর পরবর্তী সহিংস প্রতিরূপ আসে এমন-
একের পর এক শিকার (পক্ষ < মুখোমুখী>বিপক্ষ< মুখোমুখী> অন্যান্য)।
) অবশেষে তা এমন দাঁড়ায়- অনেকের পক্ষে এক (সকলে মিলে একদল হয়ে যাওয়া ও শিকার করা, বা স্কেইপগোটিং করা), তখন সামাজিক ভেক্টরগুলো সব একত্রিত হয়ে যায়; সাধারণত দেখা যায় তা একক শিকারের (স্কেইপগোট) উপর মনোযোগ নিবদ্ধ করে এবং পক্ষ-বিপক্ষ সবাই মিলে তাকে নির্মূল করার জন্য সক্রিয় হয়।

শান্তিপূর্ণ অবস্থা বা সামাজিক সংহতি:

সেই স্কেইপগোটিংয়ের শেষে এমন হলো যেন বলির পাঁঠা চড়িয়ে সকলের একমাত্র সমস্যাটি দূর করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হলো; বা, একটি সমস্যা ছিল তাকে সবাই মিলে নির্মূল করা হয়েছে।
এই সামাজিক সংহতি সেই শিকারের (স্কেইপগোট) মৃত্যুর সাথে বেঁচে থাকে এবং ব্যাপক বৈষম্যের অভিজ্ঞতাটি হঠাৎ একটি আপত শান্তির সাথে জড়িত আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে পক্ষ/বিপক্ষ সকল দলসমূহের প্রত্যেকের উপর একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলে; যেন অভিযোগটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে, সমাজের শান্তি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে পরবর্তী অভিযোগ বিবেচনা করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত। এই ঘটনা একটি চলমান প্রক্রিয়া, যার শুরু হয়েছে সেই প্রাচীনকাল থেকে, বাইবেল,প্যাগান দেব-দেবীর কাহিনী সর্বত্র এর বহু প্রমানাদি ছড়িয়ে আছে। তাই জিরার্দ দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, মানুষ তাদের মিমিটিক প্রকৃতি থেকে পালাতে পারে না ।

বেকেট ও ওয়েটিং ফর গোডো

আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের স্বনামধন্য নাট্যকার স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট। বেকেট ১৯০৬ সালের ১৩ এপ্রিল আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বেকেটের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকর্ম ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ একটি অ্যাবসারডিস্ট ঘরানার নাটক। এই নাটকের পাঁচটি চরিত্র- ভ্লদিমির,এস্ত্রাগন,পিৎজো,লাকি আর সংবাদ-বাহক বালক। নাটকের চরিত্রগুলো অনবরত, ক্লান্তিহীনভাবে কথা বলে চলে।দুই প্রধান চরিত্র ভ্লাদিমির এবং এস্ট্রাগন বিরমহীনভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকে।তাদের এই কথা বলা আর একটি নির্দিষ্টস্থানে বার বার ফিরে আসার পেছনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘গোডো’ নামের একজনের সাথে সাক্ষাৎ লাভের অভিপ্রায়। তাদের আলাপে গোডোকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কেউ বলে মনে হয় । গোডো হয়তো-বা একজন ব্যক্তি কিংবা স্বয়ং ঈশ্বর। যেন গোডো তাদের সাথে সাক্ষাৎ করলে তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান লাভ হতে পারে।

বেকেটের সৃষ্টিকর্মের সংখ্যা খুব বেশী নয়, কিন্ত আমাদেরকে চিন্তাশীল করে তুলতে, চেতনাকে জাগিয়ে দিতে তিনি ছিলেন এক সুদক্ষ কারিগর। আসলে যে যাই বলুক না কেন (তারা সকলে যারা যারা বলেছেন) তারা তো মানুষই, সকলেরই রয়েছে বিচিত্র মন। একটি উদাহরণ দিয়ে এই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণটি করা যায়, ধরা যাক,সবাই না হলেও সিংহভাগ লোক,তাদের আগামীদিনগুলোকে নিয়ে মনে মনে পরিকল্পনা তৈরি করে থাকেন, ভবিষ্যত জীবনের সুরক্ষার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেন বা এক ধরনের প্রচেষ্টা চালান, যাকে আমরা ‘কল্পনা’ হিসেবে ধরে নিতে পারি,এটাকে ‘anticipation of future orientation’ বললে সহজে বোঝা যায়।

স্যামুয়েল বেকেট সেই নাট্যকারদের একজন যিনি একটি নতুন নাট্যরীতির জন্ম দিয়েছেন বিংশ শতকের বিশ্বনাট্য অঙ্গনে।আপতদৃষ্টিতে,’ওয়েটিং ফর গোডো’কে একটি উদ্ভট নাটক মনে হওয়ার সমূহ কারণ রয়েছে, কেননা নাট্যকার তাঁর বেখেয়ালি চরিত্রগুলোর অস্বাভাবিক আচরণ, তাদের হাস্যকর সংলাপ আর অর্থহীন একটি ঘটনাকে বিভ্রান্তিপূর্ণ ভঙ্গিতে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। অ্যাবসার্ড নাটকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জীবনকে তুচ্ছ,উদ্দেশ্যহীনভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে কোনো বহিঃশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অযাচিত কৌতুককর নির্মোহ বেদনার মিশ্রণে এক গ্লানিময় সংজ্ঞা হিসেবে উপস্থাপন করা।

‘ওয়েটিং গোডো’এর একঘেঁয়ে কথোপকথন এবং হাস্যকর সংলাপগুলো মানুষের মানসিক ভারসাম্যের অস্থিরতা, মানব অস্তিত্বের ভঙ্গুরতাকে নিয়ে উপহাসের ছলে আমাদের সম্মূখে বিচিত্র অর্থের দুয়ার খুলে দিয়েছে। বেকেটের সমালোচক ও গবেষকদের জন্য তাঁর নাটকের সংলাপগুলোর অর্থহীনতার মাঝে বেকেট ইঙ্গিত দিয়েছেন গভীর পর্যালোচনার দিকে এগিয়ে যেতে।

অ্যাবসার্ড ঘরানার নাটকের আরেকটি দিক হলো- এটি জীবনের নৈরাজ্যকে নিদারুণভাবে তুলে ধরে যেন নাটকের বিবিধ চরিত্রগুলো অসংলগ্নভাবে কথা বলে যায়, এক কথা বার বার ফিরে আসে নিরর্থকভাবে;  কিছু একটার অপেক্ষা, আর সেই কিছু একটা না পাবার হতাশায় চরিত্রগুলো নিরাশায় আক্রান্ত। নাটকের দুই প্রধান চরিত্র- ভ্লাদিমির আর এস্টাগনের কার্যকলাপ জোকারের মতো, তাদের কথাগুলো শুনতে একঘেঁয়ে আর আজব লাগে। তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে তাদেরকে মনে হয় যেন তারা কোন এক অদৃশ্য জালে আটকা পরে আছে যেখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই, বরং আছে শুধু দীর্ঘায়িত অপেক্ষা।

এই নাটকের চরিত্রগুলো কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করে না। বেকেটের প্রায় সব নাটকের প্রধান চরিত্রগুলো জীবনের দুঃর্বিষহ ভারবহনে ক্লান্ত,তারা প্রায় নিঃসঙ্গ,বিপন্ন,যন্ত্রনাদগ্ধ, ব্যর্থ, ভীতু ও পরাজিত, যেমন- হ্যাপি ডেইজ নাটকের প্রধান চরিত্র-উইনি নামে এক নিঃসঙ্গ নারীকে দেখা যাবে,যার স্বপ্নময় জীবনের দৈনন্দিন সব ছেলেখেলার মধ্য দিয়ে মানুষের অভিনব মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পুরো নাটকটিতে ইউনি তার স্বামীর উইলির সাথে অনর্গল কথা বলে যায়,যেখানে উইলির অস্তিত্ব বাস্তবিক কি না তা বোঝা যায় না।

স্যামুয়েল বেকেটকে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। তাঁর নতুন নাট্যরীতি এবং ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ থেকে আমরা যে ম্যাসেজ পাই,তা তুলনামুলক দৃষ্টিকোণ থেকে আরেক ফরাসি সাহিত্য সমালোচক,মনস্তত্ত্ববিদ রেনে জিরার্দের বিখ্যাত তত্ত্ব ‘মিমেটিক থিয়োরি’-এর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে প্রায় সমতলধর্মী বলা যায়।

জিরার্দ ও তার মিমেটিক তত্ত্বকথনের সাথে তুলনামূলক আলোচনায় ফিরে যাওয়ার আগে বেকেটের ব্যক্তিত্ব এবং চিন্তাশক্তি নিয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক। বেকেট এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর আছে জীবনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ক্লান্তিহীনভাবে উলটে-পালটে দেখার চোখ, মানুষের স্বভাব ও মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার অসাধারণ দক্ষতা। আজকের আলোচ্য নাটকটিকে বহু সমালোচক বহুভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, তুলনা করেছেন গোডোকে ঈশ্বরের সঙ্গে,তাদের মাঝে এমন অনেকেই বলেছেন, গোডো হচ্ছে মানুষের বিচিত্র আকাঙ্ক্ষা,যার কোনো অন্ত নেই; সেই সব অভিলাষ যার কোনো সমাপ্তি নেই, গোডো মানুষের প্রতিনিয়ত আশার সূচক নির্দেশক।

মঞ্চে ওয়েটিং ফর গোডোর দৃশ্য

‘ওয়েটিং ফর গোডো’র ক্রিটিকরা এইভাবেও বলে থাকেন যে, গোডো হচ্ছে বর্তমানের আধুনিক পৃথিবীতে সত্যিকার প্রভুর অনুপস্থিতি বা অস্তিত্বহীনতা নিয়ে একটি প্রলাপ। সমালোচকদের কেউ কেউ অন্য কথাও বলেন, গোডো কো্নো ঈশ্বর নয়,’ওয়েটিং ফর গোডো’ হচ্ছে এমন একটি নাটক, যা আমাদের জীবনের সিংহভাগ অপূরণীয় ইচ্ছেগুলোর একটি বিরামহীন অবস্থা। আসলে এরচেয়ে সহজ করে এই কথাগুলো বলা যায় না। একটি জীবন,কিংবা আমাদের সবার জীবন কখনো কোনো একমুহূর্তে শুরু হয়েছিল, এখনো বয়ে চলেছে, কখনো হয়তো-বা শেষ হয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হলো বেকেট নিজে একবার বলেছিলেন, আমার নাটকের কী-ওয়ার্ড হলো-‘হয়তোবা /সম্ভবত (Perhaps)’, যেটা আমি এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাতে অতটা সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলাম না বোধকরি। যাই হউক, বিশিষ্ট সমালোচকদের কাছে আবার দৃষ্টি ফেরাই- এই গ্রহে মানুষের জীবনকে স্যামুয়েল বেকেট এক অসহায় বাস্তবতার রূপ হিসেবে চিত্রিত করে দেখিয়েছেন। তাঁর নাটক,প্রবন্ধ আর কবিতাগুলোতেও তিনি ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে সারাজীবন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।

বেকেটের সৃষ্টিকর্মের সংখ্যা খুব বেশী নয়, কিন্ত আমাদেরকে চিন্তাশীল করে তুলতে, চেতনাকে জাগিয়ে দিতে তিনি ছিলেন এক সুদক্ষ কারিগর। আসলে যে যাই বলুক না কেন (তারা সকলে যারা যারা বলেছেন) তারা তো মানুষই, সকলেরই রয়েছে বিচিত্র মন। একটি উদাহরণ দিয়ে এই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণটি করা যায়, ধরা যাক,সবাই না হলেও সিংহভাগ লোক,তাদের আগামীদিনগুলোকে নিয়ে মনে মনে পরিকল্পনা তৈরি করে থাকেন, ভবিষ্যত জীবনের সুরক্ষার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেন বা এক ধরনের প্রচেষ্টা চালান, যাকে আমরা ‘কল্পনা’ হিসেবে ধরে নিতে পারি,এটাকে ‘anticipation of future orientation’ বললে সহজে বোঝা যায়। উদাহরণ দিলে, বাংলাদেশি একজন শিক্ষিত বেকার তরুণ, সদ্য পাশ করে বের হয়ে প্রতিনিয়ত যখন চাকুরীর ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছেন, এবং একের পর এক ব্যর্থতার পরেও মনের মাঝে একটি আশা নিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে সামনে এগিয়ে চলেছেন-

” যখন আমি সেই কাঙ্খিত চাকুরীটি পাব!
এরপর কিছু বছর পর একটি প্রোমোশন হবে,
একটি বিয়ে করবো,
ছোট্ট বাড়ি বানাবো,
ছেলেমেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করে,যখন আমি রিটারমেন্টে যাবো,
সবশেষে ঐ জীবনে আমি তখন একজন সত্যিকারের সুখী মানুষ,
সফল স্বামী, আর গর্বিত একজন পিতা হবো।”

কিন্ত এইখানেই কি শেষ হয়ে যায়, তার ইচ্ছে?

যখন সমস্ত ইচ্ছেগুলো তিনি কল্পনাতে এনেছেন সময়ের আবর্তনে সেসব পূরণ হলো। দেখা গেল যে, যখন তার সুখী হওয়ার কথা তখন তিনি আরো বেশি অন্যান্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন এবং এই চুড়ান্ত সুখ-সস্তুষ্টি কখনো স্থির নয়, এইখানে রেনে জিরার্দের মিমেটিক তত্ত্বকথন আবার তুলনামূলভাবে সমতল আলাপে চলে এলো, বেকেটের ওয়েটিং ফর গোডো’র দুই প্রধান চরিত্র- ভ্লাদিমির এবং এস্টাগন যেভাবে ভাবতে থাকে, গোডোর সাথে সাক্ষাৎ হলে তাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে জীবন সুখের হয়ে যাবে, যা আদৌ কখনো ঘটবে না, জীবনের সমস্যার কোন অন্ত নেই, তেমনিভাবে দেখা যায় উল্লেখিত বাংলাদেশি যুবক যে ভেবেছে, একটা সময়ে পৌছে তার সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়ে সে চরম সুখী একজন মানুষে পরিণত হবে।

কিন্ত চুড়ান্ত সুখ বলে কিছু নেই যা সব সময় স্থির থাকবে, কেননা চুড়ান্ত সুখ প্রাপ্তির কিছু পরেই মানুষ আবার নতুন কিছুর জন্য আকাঙ্ক্ষা বা নতুন কোনো সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে পারে, যা প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। এই সবকিছুই মানুষের মিমেটিক ডেজায়ারের সহজ এবং স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ।

বেকেটের কাজগুলোকে formal এবং artistic achievement হিসেবে যদি ধরে নিই, তাহলে দেখতে পাব, বেকেট তাঁর রচনাগুলো দিয়ে এমন একটি ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে যেন আমরা সবাই ব্যক্তিগতভাবে কোনকিছুর বা কারো জন্য প্রতীক্ষায় আছি, কিন্ত সেই ব্যক্তি বা ব্যাপারটি কখনোই আমাদের কাছে পৌছায় না। বেকেট খুব চমৎকারভাবে এই নিশ্চয়তার মাঝের অনিশ্চয়তা, সেই অনিশ্চয়তার অন্ধকার দিকগুলোকে দক্ষতার সাথে উন্মোচন করেছেন- ‘Waiting for Godot presents a dog vision of human life’, চারপাশ থেকে জীবনকে না দেখে, পক্ষপাতিত্ব ও একপেশেভাবে বয়ে নিয়ে চলার মতো।

নাসরিন জে রানি

গল্পকার, ছোট ও বড় গল্প লেখেন। বাংলাদেশের সমসাম্যিক গদ্যকার ও গল্প লেখকদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৮৩-১৯৯৯ মফস্বলে থেকেছেন, ২০০০- ২০১০ বিবিধ শহরে বেড়িয়েছেন, ২০১১- বর্তমানে বিশ্বের আনাচে কানাচে ঘুরছেন; বই পড়ছেন, নিজস্ব আঙ্গিকে চরিত্র-নির্ভর, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস লেখার জন্য খুব ধীরে তৈরি হচ্ছেন।

Share