।। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন ।।
কার বা খাঁচায় কে-বা পাখি,
কার জন্য মোর ঝরে আঁখি।
আমার এই আঙিনায় থাকি
আমারে মজাইতে চায়।।
– লালন সাঁই
(ফরিদা পারভীন: ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫৪–১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫)
খাঁচার ভিতর কোথা থেকে পাখি আসে, আর কোথায় যে উড়ে চলে যায়, তা আজও আমাদের জানা-বোঝার বাইরেই থেকে গিয়েছে। কিন্তু সেই প্রাণপাখি যতক্ষণ ক্ষণিকের বাসায় থাকে, ততক্ষণই তার সুর আর তালের তরঙ্গে ভরে ওঠে দুনিয়ার ঘর-গেরস্থালি। তারপর সব পাখিই একদিন তার আপন ঘরে ফিরে যায়। সে ঘরের হদিস আমাদের কারও জানা নাই। জানা-বোঝার বাইরের যেটুকু, সেই অপার রহস্যের সামনে আমরা নত হয়ে জীবনের গেহ কীভাবে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেই সন্ধান চালাই। প্রতিদিন এই নিয়ত আসা-যাওয়ার রুটিনমাফিক খেলার মাঝেও কারও কারও আগমণে আর দিনকয়েক তাঁদের যাপন দুনিয়ায় দাগ কেটে রেখে যায়। তাঁদের কাজে অর্থবহ হয়ে ওঠে জাগতিক লীলা। প্রাণে প্রাণে মায়া ঢেলে দেন তাঁরা। তাই তাঁদের বিদায়ও হয়ে ওঠে বিষাদঘন। যেন-বা আসরে থেমে গেছে গান। মণ্ডপে জ্বলতে থাকা রূপের বাতিটিও নিভে গেছে বদহাওয়ায়। তিনি উড়ে গেছেন তাঁর নিজস্ব অচিন গৃহে। পড়ে রয়েছে অপার শূ্ন্যতা।
সঙ্গীতশিল্পী, লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীনের বিদায়ের পর ‘প্রতিপক্ষ’-র সম্পাদকীয় দপ্তরের অনুভূতিটা ঠিক এমনই। বাংলাদেশ-সহ বড় বাংলার রসিকজনেদের কাছে, শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে প্রাণের মানুষ ছিলেন ফরিদা পারভিন। তাঁর মায়াভরা কন্ঠ আর গায়কীতে শান্তির খোঁজ পেতেন লালনভক্ত-সহ আপামর শ্রোতাজনেরা। সাঁইজীর পদ যখন সুরের মূর্চ্ছনায় ফরিদার কণ্ঠ হতে ধ্বনিত হত চারপাশে, তখন যেন আমরা প্রবেশ করতাম এক ধরনের মায়াবাস্তবতায়। যেন-বা প্রাণ-প্রকৃতি-পরমের মেলবন্ধনের ভাবের ভিতর দিয়ে মানুষভজনার আকাঙ্খা তীব্র হত ভক্তদের মনে, যেন-বা ভিতরঘরে বসে থাকা নিগূঢ়ের সাইঁয়ের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যেত গানে গানে।
ফরিদা পারভীন আমাদের ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার আপনজন ছিলেন। অনলাইনে নবকলেবরে ২০২০ সালে ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকা আত্মপ্রকাশের দিন ভার্চুয়ালি আমাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ফরিদা। ব্যক্তিগতস্তরে ‘প্রতিপক্ষ’র প্রধান সম্পাদক-সহ অনেকের সঙ্গেই ছিল তাঁর নিবিড় সখ্য। আমাদের পত্রিকার ব্যপ্তি বৃহৎ বঙ্গব্যাপী হলেও যদি তার কেন্দ্র বলে কিছু থাকে, তবে তা ভাবের জায়গা থেকে অবশ্যই কুষ্টিয়া। কেননা আমরা মনে করি শুধু বৃহৎ বঙ্গের নয় বরং গোটা উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে লালন সাঁই ও তাঁর অনুসারীদের ভূমি কুষ্টিয়ার। সেই কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায়, কুমারখালী গ্রামে লালনধামের পাশেই আমাদের পত্রিকার ভাবকেন্দ্র ‘নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি’, যা মহাপ্রাণ লবান সাঁইজীর স্মৃতিবিজড়িত, তো সেই আখড়বাড়ির সঙ্গেও প্রাণবন্ত যোগাযোগ ছিল ফরিদা পারভীনের। তাঁর চলে যাওয়া তাই বাংলা সঙ্গীতজগত ও ভাবজগতের পাশাপাশি ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকা ও ‘নবপ্রাণ আখড়বাড়ি’র জন্যেও অপূরণীয় ক্ষতি।
১৯৫৪ সালে ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন। গানে গানে কাটিয়েছেন ৫৫ বছর। ১৪ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে ফরিদা পারভীনের পেশাদার সঙ্গীত জীবন শুরু হয়। এরপর পার হতে হয় অনেক চড়াই-উতরাই। পারিবারিক সূত্রেই গানের ভুবনে আসা তাঁর। গানের প্রতি বাবার টান ছিল বেশি। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে তাঁকে। শৈশবে যখন মাগুরায় ছিলেন, তখন উস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয়। এরপর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তালিম থেকে দূরে থাকেননি। নজরুল গীতি-সহ বহু ধরনের গানে ফরিদা তাঁর সাক্ষর রেখে গেলেন। নানা ধরনের গান করলেও শিল্পীজীবনে পরিচিতি, জনপ্রিয়তা, অগণিত মানুষের ভালোবাসা মূলত লালনের গান গেয়ে। যখন থেকে লালনের গান গাওয়া শুরু হয়েছিল, তারপর আর থেমে থাকেননি। সেই লালন সাঁইয়ের সঙ্গীত সঙ্গে নিয়েই জীবনকে বিদায় জানালেন ফরিদা পারভীন।
সামনের কার্তিক মাসের পয়লা তারিখটি লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবস উপলক্ষে জাতীয়স্তরে বাংলাদেশে উদযাপিত হবে। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুলের পাশাপাশি মহাপ্রাণ লালন সাঁইজির তিরোধান দিবসটি জাতীয়স্তরে উদযাপনের উদ্যোগ বাংলাদেশে এই প্রথম। এমনকী বড় বাংলাতেও। কিন্তু এহেন উৎসবে ফরিদা পারভীন আমাদের মধ্যে সশরীরে হাজির থাকবেন না। এই বেদনার ভার আমাদের বইতে হবে। যদিও তাঁর স্মৃতি ও রেখে যাওয়া সঙ্গীতভাণ্ডার আমাদের জন্যে অমূল্যরতন। বিদায় ফরিদা পারভীন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ভালোবাসা চিরন্তন। শ্রদ্ধা।