আজ শনিবার, ১৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৩১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এথনোসেন্ট্রিজম: ফুলপাখিলতাসাপরাক্ষস এবং মানুষের রাজনীতি

গ্রীষ্মের রাত।

বন্ধুপুত্র নোয়াকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম। নোয়ার বয়স চার, তার বাবা-মা আমার কাছে বাচ্চা পালতে দিয়ে ডিনারে গেছেন বাইরে। নোয়া বললেন তাকে ভূতের গল্প পড়ে শোনাতে হবে।

আমি ভাবলাম, এ তো মহা মুসিবত।

কিন্ডেলে একটাই মাত্র বাচ্চাদের বই আছে, সেটা হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের আগলি ডাকলিং। এছাড়াও রাশান উপকথা বলে আরেকটা ‘ছোটোদের’ জিনিস পড়ছিলাম কিন্ডেলে। তবে রাশানদের উপকথা, বিশেষত শাশুড়ির সাথে মেয়ের জামাইয়ের যৌন সম্পর্কওয়ালা নাভির ভেতর থেকে সুতা টেনে বের করতে করতে সেটা চার রাস্তার মোড়ে বেঁধে সেখান থেকে জন্ম নেওয়া ফুলের পাপড়ি থেকে জন্ম নেওয়া হাঁড়ির ভেতর ঢুকে বসে থাকা শয়তানের গল্প ছোটোদের জন্য কতখানি উপযুক্ত সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না বলে সেটাও বাদ দিতে হল। তো কিন্ডেল বাদ দিলে ভূত বলতে গুটেনবার্গের কল্যাণে বাসায় আছে অবনীন্দ্রনাথ সমগ্র। নোয়াকে জিজ্ঞেস করলাম তার অবন ঠাকুরে সমস্যা আছে কি না।

বললাম, এই বস্তু কিন্তু বাংলায় লেখা।

নোয়া জানালেন সমস্যা নাই। বাচ্চাদের অবশ্য বড়োদের মতো সব কিছুতে সমস্যা থাকে না। একবার দেশে দিনাজপুরে চালের আড়তে কাজ করেন যে ছোটো ছোটো বাচ্চারা, তাদের ইংরেজিতে ‘স্নো-হোয়াইট’ গল্প শুনিয়েছিলাম, তারা খুব মনোযোগ দিয়ে সেই গল্প শুনেছিলেন। স্নো-হোয়াইটের সৎ মার ইংরেজি শয়তানিতে বাংলায় খুব আহতও হয়েছিলেন। নোয়াও তাই, তিনি বাংলা জানেন না, কিন্তু বাংলা গল্পে তার সমস্যা নাই। তো আমি তার মাথার কাছে বসে পড়তে শুরু করলাম রাক্ষসের গল্প। দণ্ডক অরণ্যের একপাশে মুনি ঋষিদের আশ্রম, আর তার উলটা পাশে বাতাপি লেবুর বন। সেই বনে দুই রাক্ষস থাকেন। একজনের নাম ইল্বল। আরেকজনের নাম আপনার মনে হতে পারে বিল্বল। কিন্তু তার নাম বাতাপি। বর্ষার শেষে যখন সেই বনে নতুন পাতা জন্মায়, শিশু লেবুতে, লেবু ফুলে যখন গাছের ডাল ভারী হয়ে ওঠে, তখন আশ্রম থেকে ঋষিকুমাররা দল বেঁধে আসেন গাছ থেকে সেই লেবু পাড়তে। তারপর একদিন গাছের সব লেবু শেষ হয়ে যান, শীতের বাতাসে সবুজ পাতারা ঝরে যান মাটিতে, মাটি ঢেকে যান রাতের শিশিরে— আর তখনই ইল্বল রাক্ষসের ঘরের দুয়ারে মায়াবী লেবুর গাছ ভরে ওঠেন মায়াবী লেবুতে। ঋষিকুমাররা তখনও অবশ্য আসছেন লেবুর বনে। কিন্তু বনের গাছে তো লেবু নাই। তখন ইল্বল রাক্ষস তাদের হাত ধরে সেই মায়াবী লেবু তুলে দেন। ঋষিকুমাররা জানেন না এসব মায়াফল। তারা লেবুটেবু খেয়েদেয়ে তপস্বী সেজে থাকা ইল্বলের ঘরে শুয়েবসে আছেন। আর এদিকে রাত নেমে এসেছে। তখন ভণ্ড তপস্বী চাপাস্বরে ভাই বাতাপিকে ডাকতে শুরু করেন, “আয় রে বাতাপি বাইরে আয়”। আর তখনই ঋষিকুমারদের পেট চিরে বাতাপি রাক্ষস বেরিয়ে আসতেন। এরপর রক্তটক্ত খেয়ে তাদের পুঁতে রাখতেন মাটিতে। আর তারপর এক একজন ঋষিকুমার একেকজন লেবু গাছ হয়ে জন্মাতেন মাটি ফুঁড়ে।

অ্যাদ্দুর পড়তে পড়তে দেখলাম বড় বড় শ্বাস ফেলে নোয়া ঘুমিয়ে পড়েছেন। এদিকে আমি আটকে গেছি সব ঋষিপুত্রদের খেয়ে সাবাড় করা সব ঋষিদের খেয়ে সাবাড় করা বনের সব হাতি ঘোড়া বাঘ ভালুক হরিণ খেয়ে সাবাড় করা কাঁটায় ভরে যাওয়া নিঝুম তপোবনের মাথার ওপর মেঘের কড়মড় আর বৃষ্টির ঝরঝর আর ঝড়ের হুহু শব্দে আটকে পড়া ইল্বল বাতাপি দুই রাক্ষসের গল্পে। রাক্ষস-খোক্কসের গল্প, আমার ধারণা ছোটোবেলায় ঠাকুমার ঝুলি-তে লালকমল নীলকমলের রূপকথায় আমরা সবাই পড়েছি। আমাদের অঞ্চলের উপকথা আর মানুষের মুখে মুখে চলা লোকসাহিত্যে ছড়া ব্রতকথা রূপকথা ধাঁধায় কৃষ্ণকায় কুৎসিত বেঁটে মোটা, বড়ো বড়ো দাঁত নখওয়ালা রাক্ষস-খোক্কসের ছড়াছড়ি। তারা মানুষের রক্তমাংস খান। পৌরাণিক গল্পে ব্রহ্মাস্ত্র বা দৈবশক্তি প্রয়োগে এবং লোককথায় রাক্ষস নিধনের জন্য ভ্রমর ভ্রমরীকে মাটিতে না ফেলে হাতে পিষে মারতে হয়। রাক্ষসদের জন্ম বিষয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। বলা হয়ে থাকে রাক্ষসদের জন্ম ঋগ্‌বেদে। অথচ বেদের কোথাও, বৈদিক যুগের কোনো সাহিত্যে রাক্ষসদের উপস্থিতি নাই। রাক্ষসদের প্রথম লিখিত উপস্থিতি আমরা দেখি রামায়ণে। পরবর্তীতে মহাভারতে। রাক্ষসরাজা রাবণ, তার ভাই বিভীষণ এবং কুম্ভকর্ণ ছাড়াও কবন্ধ, শূর্পণখা, হিড়িম্বা, মারীচ, বকাসুর, জটাসুর এবং সবশেষে বাংলার মঙ্গলকাব্যে রাক্ষসদের দেখি আমরা। তবে রামায়ণের তুলনায় মহাভারত বা মঙ্গলকাব্যে রাক্ষসদের উপস্থিতি তেমন প্রকট নয়। রামায়ণে ঋষিদের এক কথায় রামচন্দ্র প্রায় চোদ্দো হাজার রাক্ষস বধ করে ফেলেন। এই নিয়ে দণ্ডকারণ্যে সীতা রামকে প্রশ্ন করেন, কী এমন করেছেন রাক্ষসরা যে তাদের বিনা কারণে মেরে ফেলতে হবে? রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে বলা হয় সত্যযুগের শেষে ঘুমন্ত ব্রহ্মার নিশ্বাস থেকে জন্ম নেন রাক্ষসরা। জন্ম নেওয়ার সাথে সাথে রক্তপিপাসায় তারা ব্রহ্মাকে খেয়ে ফেলতে চাইলে বিষ্ণু এসে রক্ষা করেন ব্রহ্মাকে। পৃথিবী থেকে বিতাড়িত হন রাক্ষসরা। আবার এদিকে এ-ও বলা হয় যে রাক্ষসরা ঋষি কশ্যপের বংশধর। কশ্যপের ১৩ স্ত্রীর একজন প্রজাপতি দক্ষ-কন্যা সুরস। সুরসের পুত্র ইয়াতুধান, যার পুত্ররা রাক্ষস। সেই তুলনায় মহাভারতে তেমন রাক্ষস নাই। এর আরও অনেক পরে বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলিতে আবার রাক্ষসের খানিক দেখা পাওয়া যায়। মঙ্গলকাব্যের লেখকরা সম্ভবত বেদের থিয়োরির ফিল-ইন-দ্য-গ্যাপ করতে প্রিকুয়েল স্টাইলে রাক্ষসদের জন্মরহস্যে সৃষ্টির শুরুতে চলে গেলেন। চণ্ডীমঙ্গলে পৃথিবী সৃষ্টির গল্পে আছে, “না আছিলো রবীশশী সন্ন্যাসী তপস্বী ঋষি, না আছিলো এ মেরু মন্দার/না আছিলো সুরাসুর রাক্ষস কিন্নর নর, সকলি আছিলো শূন্যাকার।” মনসামঙ্গলে রাক্ষসের পাশাপাশি আমরা আরও কিছু দেওদৈত্য এবং চণ্ডীমঙ্গল ও অন্যান্য পুরাণে ভূতপ্রেতের উপস্থিতি দেখতে পাই। প্রশ্ন হচ্ছে, রাক্ষসদের শারীরিক বর্ণনাতে কালো কুৎসিত নরমাংসভোজী বিশেষণ আসা শুরু হল কীভাবে? উপমহাদেশ অঞ্চলে যেখানে আমাদের পূর্বসূরীদের গায়ের রং মূলত কালোই, সেখানে সাদা-কালোর রাজনীতিকে এমনি এমনি “ছিল বেড়াল হয়ে গেল রুমাল” স্টাইলে উড়িয়ে দেবার ‘নাইভ’ সুযোগ আছে কি? বরং খেয়াল করলেই কি দেখতে পাওয়া যায় না যে এই সাদা-কালোর রাজনীতি কোনো এমনি এমনির রাজনীতি না, বরং এর সাথে শ্রেণির রাজনীতি, ব্রহ্মজ্ঞান লাভের রাজনীতি, সম্পত্তি এবং রাজত্ব দখলের, কর্তৃত্ববাদের এবং এমনকী লৈঙ্গিক আধিপত্যবাদেরও রাজনীতি জড়িত?

সমাজ বিবর্তনের নিয়মে আমাদের প্রাক্‌-পুঁজিবাদী এবং অতি অবশ্যই প্রাক্‌-সামন্তবাদী সময়ে শোষণভিত্তিক যে সমাজ গড়ে উঠেছিল সেখানে আমরা স্পষ্ট দুই বিপরীত শক্তিকে দেখতে পাই, যার একদিকে ছিলেন শোষিত ব্রাত্য নিরক্ষর খেটে খাওয়া অনুন্নত দরিদ্র আদিম কৃষিজীবি কালো ‘অনার্য’ ভূমিপুত্র-কন্যারা, অন্যদিকে ছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্গের শাসক এবং শোষক গোষ্ঠী। রামায়ণে দেখা যায় চতুর্বর্ণে বিভক্ত সমাজে শূদ্ররা ছিলেন সবার নীচে। মনুসংহিতাতেও তাই। বিজয়ী আর্যরা এই নমঃশূদ্রের সাথে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতেন না, এই শূদ্রদের তারা দাস, বানর, পক্ষী ইত্যাদি নামে সম্বোধন করতেন, এই আর্যেতর জনগোষ্ঠীই, এই গন্ধর্বরাই পরিণত হয়েছিলেন রাক্ষসে, আমাদের সাহিত্যে, আমাদের শিশুসাহিত্যে, আমাদের জনমানসে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে রামায়ণ স্টাইলে মহাভারতে আবার রাক্ষসদের দেখা হয়নি। মহাভারতের লেখক মূলত অনেকে। উগ্রশ্রবা, বৈশম্পায়ন, সঞ্জয়ের মৌখিক বয়ান সংকলন এবং পরবর্তীতে অনার্যদের লিপি ধার করে লিপিবদ্ধ করেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। কৃষ্ণদ্বৈপায়নের মা সত্যবতী বা সত্যকালী নিজে ছিলেন অনার্য নারী (হরপ্রসাদ মুখোপধ্যায়, কৃষ্ণকাহিনী মহাভারত, ২০০০)। ফলত মহাভারতে এসে আমরা দেখি ভীমসেন বিয়ে করছেন রাক্ষসী হিড়িম্বাকে। অর্থাৎ ততদিনে খুব স্বল্প পরিসরে হলেও আর্য-অনার্যের দেবতা-রাক্ষসের বিয়ে হচ্ছে, ততদিনে খানিক হলেও বিআর্যীকরণ শুরু হয়েছে এ অঞ্চলে। আমরা জানি প্রাচীন বাংলা শাসন হয়েছে সনাতনী শাসকদের দিয়ে। এরপর ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত মুসলমান শাসনের সময়কালের ইতিহাস। এই সাহিত্যিক ইতিহাসে আমরা এসব শূদ্র চরিত্র বা অদ্ভুত আরবি ফারসি তুরকি বা তথাকথিত মুসলমান নামের মানুষদের খল চরিত্র হিসাবে, প্রতারক হিসাবে দেখি। অষ্টাদশ থেকে ঊনবিংশ শতকে লেখা ধর্মমঙ্গল কাব্যে দেখি বীর লাউসেনের মামা মহামদ, লাউসেনের অনুপস্থিতিতে ময়নায় এসে লখাকে রানি বানাতে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছেন, আর তার উত্তরে লখা তাকে “লখ্যা বলে তোর মুখে তুল্যা মারি লাথি” বলে অপমান করলেও মহামদের হেলদোল হচ্ছে না। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল গৌড়রাজ তার সামন্ত কর্ণসেনের সাথে নিজের শ্যালিকা— মহামদের বোন— রঞ্জাবতীর বিয়ে ঠিক করার মাধ্যমে। মহামদ এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। তাই রঞ্জাবতীর পুত্র লাউসেনের জন্ম থেকেই মহামদ তাকে মেরে ফেলার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। গল্পটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ গল্পের চরিত্রের নামকরণ। রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ করে খল চরিত্রগুলির নাম মুসলমান বা মুসলমান জাতীয় হয়ে গেল কেন, বা সব খল চরিত্র দেখতে কুৎসিত কালো বেঁটে মোটা অসুরাকৃতি হয়ে গেলেন কেন? এগুলিকে কি কাকতালীয় ঘটনা বলে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যাবে?

না।

এসব অতি অবশ্যই কাকতালীয় ঘটনা না। এসব মূলত আর্যবিজয় বা এই অঞ্চলের আর্যীকরণের ইতিহাস। আর্যদের ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশের মাধ্যমে মহেঞ্জেদারো হরপ্পাবাসীকে অনার্য বানানোর এবং মুসলমানদেরও বহিরাগত বানানোর ইতিহাস। ইসলাম ধর্মের আগমন এ অঞ্চলে বহিরাগত আরব বণিক আর সুফি সাধকদের মাধ্যমেই, অবশ্যই। এবং এ অঞ্চলে বহিরাগত আর্যরাও। ফলত এক বহিরাগত অন্য বহিরাগতকে বহিরাগত বলে খারিজ করে ফেলে দিলে বিষয়টা বেশ হাস্যকর একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

আর এ কারণেই সম্ভবত নিজেদের হাস্যাস্পদ না করতে চাওয়ার প্রক্রিয়াতে কটা চোখের সাদা চামড়া আর্যদের এই অঞ্চলের কালো বেঁটে মোটা ভূমিপুত্র-কন্যাদের, রাবণদের নরমাংসভোজী অসভ্য বর্বর দাস বলে সম্বোধন করতে হয়েছে।

অথচ রামায়ণ ঘাঁটলেও রাবণ কোনোদিন মানুষের রক্তমাংস খেয়েছেন, তার পরিবারের কেউ রক্তমাংস খেয়েছেন তার প্রমাণ পাওয়া যাবে না। তবে হ্যাঁ, নরমাংসভোজী বা কাঁচামাংসভোজী সারা পৃথিবীতেই সে সময় ছিলেন, এখনও আছেন প্রচুর অঞ্চলে। হয়তো আমাদের ভূমিপুত্র-কন্যারা, আমাদের আদি পিতা-মাতারা কাঁচামাংস খেয়েছেন। কিন্তু আর্যরা কাঁচামাংস না খেলেই কি তারা খুব সভ্য আর বাকিরা অসভ্য হয়ে যাবেন? সভ্য অসভ্যের এই সংজ্ঞা নির্ধারণ করছেন কে? আমি মনে করি সভ্যতা শব্দটা পৃথিবীর অসভ্য শব্দগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান অসভ্য শব্দ। অন্যকে সভ্য করার প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে জাতিগত আধিপত্যবাদ বিস্তার করা হয়েছে। নিজেকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ করে তোলার আর্যীয় বাসনায় অন্য সবাইকে রাক্ষস বানানো হয়েছে, পৃথিবীর পশুপাখিগাছপালামাছদের মানুষের চাইতে নিচু শ্রেণির প্রাণীতে পরিণত করা হয়েছে। আর্যদের ভারত আগমনের সময় ‘নাগ’— আর্যেতর এবং আর্যবিরোধী জাতির কাছে বাধা পেয়েই নাগকে অসুর বলে, এবং অথর্ববেদে রাক্ষসরূপে পরিণত করা গেছে। অথচ প্রকৃতিনির্ভর বা মাতৃশক্তিকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে শক্তিবাদের উদ্ভব, শস্য উৎপাদনী সেই পৃথিবীতে কেউ কারও চাইতে বড়ো ছিলেন না, ছোটোও ছিলেন না। এই পৃথিবীতে সাপকে শুধুমাত্র বিষধর প্রাণীরূপে দেখা হত না, বাংলায় তাকে সর্পদেবী মনসা বলে পূজা করা হত। ঋগ্‌বেদে ইন্দ্রের প্রধান শত্রু, অসুরদের প্রতিনিধি বৃত্র বা অহি— অহি অর্থ যে সাপ, সেই সাপকে বাংলায় শ্রদ্ধা করা হত। ভাবা হত এই বাস্তু সাপেরা আমাদের ঘরবাড়ি পাহারা দিচ্ছেন। তারা ছিলেন প্রজননশক্তির প্রতীক। যেই গাছে সাপ থাকতেন, সেই গাছকেও পূজা করা হত। আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন গাছের সাথে সাপের সম্পর্ক অত্যন্ত প্রাচীন। এর “কারণ উভয়ই উর্বরাশক্তির প্রতীক। দাক্ষিণাত্যে অশ্বত্থ বৃক্ষের সঙ্গে সর্পের সম্পর্ক আছে বলিয়া মনে করা হয়। সেইজন্য অশ্বত্থ বৃক্ষের নীচে মৃৎ কিংবা প্রস্তর নির্মিত নাগমূর্তি উপহার দেওয়া হয়—অপুত্রক বা বন্ধ্যা নারীগণ সন্তান কামনা করিয়া অশ্বত্থতলে নাগমূর্তি উপহার দেয়। কিংবা নাগপূজা করিয়া ১০৮ বার সেই বৃক্ষ প্রদক্ষিণ করিয়া থাকে। ইহাতে বৃক্ষ ও সর্পের সঙ্গে উর্বরতাবাদ বা fertility cult-এর সম্পর্কটি অত্যন্ত স্পষ্ট হইয়া চোখে পড়ে। মনে হয়, জীবিত সর্পের পূজক কোনও জাতির সংস্কৃতির সঙ্গে কালক্রমে বৃক্ষমধ্যে সর্পোপাসক বা বৃক্ষোপাসক কোনো জাতির সংস্কৃতি একত্র মিশিয়া গিয়াছিল। সেইজন্য একসময়ে বৃক্ষমধ্যে সর্পপূজার ব্যাপক প্রচলন ভারতের সর্বত্রই দেখা গিয়াছিল। মনে হয়, সেই সময়ই বাংলাদেশে উক্ত বৃক্ষোপাসক জাতির প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রভাবে এদেশেও বিশেষ এক শ্রেণীর বৃক্ষের মধ্যেই সর্পের পূজা করিবার রীতি প্রথম প্রবর্তিত হয়। এই বৃক্ষের নাম মনসা বৃক্ষ। ইহাকে সংস্কৃতে স্নুহী বৃক্ষ বলা হইয়াছে।” (আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, বাংলা ১৩৪৬)

পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর স্বর্গযাত্রা, সঙ্গে কুকুর। (মহাভারত)

শুধু গাছ বা সাপই না, এবং শুধুমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশেই না, পৃথিবীর সকল সভ্যতায় প্রাণীজগতের প্রতিটা প্রাণীর গুরুত্ব ছিল মানুষের সমান। মাছকে প্রায় প্রতি সংস্কৃতিতেই মানুষের পরিত্রাতা হিসাবে, মানুষের পাপের উদ্ধারকর্তা হিসাবে ধরা হত। বিষ্ণুর যে দশ অবতার, তার মধ্যে প্রথম অবতার মাছ। যিশুখ্রিস্ট, দেবী আইসিস এবং ক্যালডীয় ত্রাণকর্তা ওনেস— সকলের প্রতীকই ছিলেন মাছ। প্রাক্‌-ইসলামিক ইতিহাসেও আমরা দেখি, নবি ইউনুসকে যখন পাপী বলে জাহাজ থেকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, সমুদ্রের তিমি মাছ তখন তাকে রক্ষা করছেন। যদিও এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ইউনুসের এই তিমি সম্ভবত আমাদের পৃথিবীর সমুদ্রের তিমি মাছ না, তিনি সম্ভবত পৌরাণিক প্রাণী— হিপ্পোক্যাম্পাস ছিলেন, যাকে আংশিক ঘোড়া এবং আংশিক ডলফিনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল— প্রাথমিক খ্রিস্টীয় মূর্তি এবং প্রাচীন মন্দিরের খোদাইগুলিতে আমাদের সুকুমার রায় ধরনের তিমি আকৃতির বিভিন্ন যৌগিক প্রাণীর চিত্র সেই যুক্তির পক্ষে প্রমাণ দেয়।

এবং শুধুমাত্র পশুপাখিসাপমাছই নন, আমাদের সকল প্রাচীন সভ্যতায় এমনকী পোকামাকড়েরও বিশেষ স্থান ছিল। মিশরীয় সভ্যতায় মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা সূর্য দেবতা রা-এর প্রতীক ছিল স্কারাব জাতীয় এক ধরনের ডানাওয়ালা পোকা। প্লুটার্ক বলেন এই স্কারাবরা যে পদ্ধতিতে কাজ করেন বা হাঁটেন তার সাথে সূর্যের গতিপথের মিল আছে। প্রাচীন মিশরীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুযায়ী সূর্যের কক্ষপথ পশ্চিম থেকে পূর্বে দেখা হত। তারা মনে করতেন স্কারাবরা তাদের ডানা মেলে দেওয়ার কারণে সকালে সূর্যোদয় হয় আর যখন সূর্যাস্তে তারা তাদের ডানা ভাঁজ করে ফ্যালেন, তখন রাত নেমে আসে। একই সভ্যতায় বিছাকে জ্ঞানের প্রতীক হিসাবে দেখা হত। দ্য বুক অব দ্য ডেড-এ অনির প্যাপিরাসে বলা হচ্ছে, “আমিই সোয়ালো (এক ধরনের চড়ুই জাতীয় পাখি), আমিই বিছা, আমিই রা-এর কন্যা!” এলিজাবেথ গোল্ডস্মিথ বলেছেন, বিছারা ছিলেন মিশরীয় দেবী সেল্কের প্রতীক। এছাড়াও ব্যাবিলনীয় এবং অ্যাসিরীয় সভ্যতায় সূর্য দেবতার মন্দিরের প্রবেশদ্বারের রক্ষক হিসাবে বিছাকে রাখা হত (Elizabeth E. Goldsmith, Life symbols as related to sex symbolism, 1924)। বিছা ছাড়াও টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিসের তীরে এই প্রাচীন পৃথিবীতে সাইকি নামের প্রজাপতি আর মাকড়সা থেকে শুরু করে এমনকী মাছিকেও গুরুত্বের সাথে দেখা হত, যেহেতু মাছি নোংরা পচনশীলকে পরিষ্কারে সাহায্য করতেন, তাই মনে করা হত মাছি ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক। জেবুব বা জেবাব শব্দের অর্থ মাছি বা গুঞ্জন করেন যে। ক্যালডীয় অঞ্চলের দেবতা ছিলেন বালজেবাব। টমাস ইনমান মনে করেন বালজেবাবকে রসিকতা করে মাছিদের দেবতা বলে ডাকা হলেও বালজেবাবের মূল অনুবাদ হবে হামিং বা গুঞ্জনের দেবতা। মাছি তার পাখার সাহায্যে যেই শব্দ তৈরি করেন তা গ্রিক এবং মিশরীয় দুই সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি বলছেন মিশরীয় মরুভূমির কলোসি অব মেমনন নামের দুই মূর্তির কথা, যারা আল-কলোসাত বা আল-সালামাত নামেও পরিচিত। মরুভূমির বালিতে জোরে বাতাস বইলে গ্রিক মেমনন গুনগুন করে দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো করে গান গাইতেন। ইহুদিরা বালজেবাবকে পরিণত করেন রাক্ষসে, তাকে শয়তানের রাজপুত্র আখ্যা দিয়ে বানিয়ে ফেলেন দানবে। ভার্জিলকে জাদুবিদ্যা, বিশেষত কালো জাদুর অভিযোগ থেকে রক্ষার জন্য নওডিয়াস ভার্জিলের ঘটানো অলৌকিক সব অতিপ্রাকৃত ঘটনাকে গায়ের জোরে ফেলে দিয়ে মেমননকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। ভার্জিল তখন পিতল দিয়ে একটা মাছির মূর্তি বানিয়ে নেপলসের দরজার ওপর বসিয়ে দেন। পরে আট বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই শহরে কোনো মাছি প্রবেশ করেননি (Thomas Inman, Ancient faiths embodied in ancient names, 1868-69; Manly P. Hall, The secret teachings of all ages, 1928)

মনসা

উইলিয়াম সামনার ১৯০৬ সালে প্রথম এথনোসেন্ট্রিজমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি এই জাতিকেন্দ্রিকতাকে বলেছেন, “the technical name for the view of things in which one’s own group is the center of everything, and all others are scaled and rated with reference to it.” (William Graham Sumner, Folkways: a study of the sociological importance of usages, manners, customs, mores, and morals, 1906)। নিজেকে দিয়ে অন্যকে বিচারের এই পদ্ধতিতে শুধুমাত্র কোনো বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর, কোনো বিশেষ ধর্মের মানুষকে ছোটো করা হয় না, আমরা মানুষের মাধ্যমে পশুপাখিকেও মানুষের চাইতে নিচু চোখে দেখার, তাদের খর্ব করার রাজনীতির সাথে পরিচিত হই। তবে মানুষের জীবনকে মশামাছির চাইতে গোরুছাগলের চাইতে ল্যাবের বানর ইঁদুর গিনিপিগের চাইতে সমুদ্রের সব মাছ পৃথিবীর সব ভোঁদর বিড়াল বাঘ সিংহ হাতি ঘোড়ার চাইতে, বাতাসে ঘুরে বেড়ানো বরফযুগে মাটির নীচে আটকা পড়া ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসের চাইতে মূল্যবান মনে করার প্রান্তিকীকরণ এবং শোষণের রাজনীতির মূল নাম স্পিশিসিজম বা প্রজাতিবাদ হলেও অনেক সময়েই এই প্রজাতিবাদ জাতিকেন্দ্রিকতারই এক রূপ হিসাবে আমরা দেখি। আর্যীকৃত উদ্বৃত্ত সম্পদনির্ভর অর্থনীতির পৃথিবীতে আমরা মানুষের মাধ্যমে কোনো বিশেষ মনুষ্য জাতিগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্যবাদই শুধু দেখি না, একইসাথে সেই জাতিগোষ্ঠীর সাথের ফুলপাখিমাছেদের ওপর আধিপত্যবাদের প্রতিষ্ঠা দেখি পুঁজিবাদী পশুপালন শিল্পে, বাছুরকে মায়ের দুধ বঞ্চিত করে মা গরুকে স্টেরয়েড ইনজেকশনের মাধ্যমে বালতি বালতি দুধ উৎপাদনে বাধ্য করা, ভেড়াকে ছাগলকে শুয়োরকে হরমোন ইনজেকশন দিয়ে কেজি কেজি মাংস উৎপাদনে বাধ্য করা, মুরগিকে সারা জীবন খাঁচায় আটকে রেখে তাকে কেএফসি-র ফ্রায়েড চিকেনে পরিণত করার কুৎসিত ভোগবাদের সংস্কৃতিতে। নিজেদের বাদে বাকি প্রাণীদের জীবনকে মূল্যহীন করে ফেলতে মানুষ প্রকৃতির নিয়ম মাংসাশী প্রাণীর দাঁতের হজমের পাকস্থলীর অ্যাসিডের বিবর্তনের কুযুক্তি ব্যবহার করে থাকেন। মানুষ এক্ষেত্রে যা বলতে ভুলে যান তা হচ্ছে এই যে আমাদের মাংসাশী পূর্বসূরীরা এই ভোগবাদের খাইখাইয়ের দিনে তিনবেলার বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের অধিবর্ষে তিনশো ছেষট্টি দিনের কবজি ডুবিয়ে কনুই ডুবিয়ে হাঁটু ডুবিয়ে মাংস খাবার মোচ্ছবে যুক্ত ছিলেন না। আমাদের শিকারি সংগ্রাহক পূর্বসূরীরা খুব ভাগ্যবান হলে বছরে একবার দু’বার মাংস খাবার সুযোগ পেতেন। তাদের বাকি জীবন কাটত সবুজ শাকপাতা ফলমূল শস্যবীজ খেয়েই।

না, মানুষের মাংস খাওয়া নিয়ে আমার অনুযোগ নাই। নিজে ব্যক্তিজীবনে ভিগান হলেও, নিজে মাছ মাংস ডিম দুধ মধু কিছু না খেলেও, উল রেশম চামড়া-সহ কোনো প্রকার প্রাণীজ উৎপাদন ব্যবহার না করলেও আমি পৃথিবীর সকল মানুষকে ভিগান হবার আমন্ত্রণ জানাই না কোনোভাবে। আমি শুধু মনে করি ভোগবাদিতার লোভের পুঁজিবাদের কার্বন ফুট প্রিন্ট বাড়ানোর অমানবিক অ্যানিমেল এগ্রিকালচার ইন্ডাস্ট্রির মারফতে নিজেকে, নিজের জীবনকে, নিজের মনুষ্য পরিবারকে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মনে করে পৃথিবীর সব গরুছাগলহাঁসমুরগিকে পৃথিবীর সব ম্যালেরিয়ার মশাকে এপস্টিন-বার ভাইরাসকে অগুরুত্বপূর্ণ ভাবার এথনোসেন্ট্রিক চিন্তাকাঠামো থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত।

বলুন, একজন গোরুর সাথে মানুষের বাসায় বাস করা একজন ‘পোষ্য’ বিড়াল বা খরগোশ বা পাখির পার্থক্য কোথায়? পোষা প্রাণীকে রান্না করে খেতে আপত্তি থাকলেও গোরু ছাগল বা শুয়োর রান্না করে খেতে আমাদের সমস্যা হয় না কেন? একজন বিড়ালের চাইতে, একজন পাখির চাইতে একজন শুয়োর একজন ভেড়া কোথায় আলাদা?

একজন বিড়ালকে জবাই করে চামড়া ছাড়িয়ে তার মাংস দিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি শামি কাবাব বিড়ালের মালাইকারি রান্না করে খাবার কথা আমরা চিন্তা করতে পারি না কেন? বিড়ালরা কি গোরুদের চাইতে অধিক অনুভূতিসম্পন্ন প্রাণী? ছাগলদের কি ব্যথা অনুভবের ক্ষমতা কম? যাদের আমরা রান্না করে মোরগমোসল্লম বানিয়ে কোপ্তা কাবাব কালিয়া বানিয়ে পাতুরির ভেতর পুর ভরে ভাপে সেদ্ধ করে আগুনে ঝলসে সেঁকা তেলে ভেজে রুটি পরোটা ভাত মটর পোলাওয়ে মাখিয়ে খাই, তারা কি শুধুমাত্র আমাদের পেটে ঢোকার জন্য, আমাদের রসনা পরিতৃপ্ত করার জন্য পৃথিবীতে জন্মেছেন? এইসব প্রাণীরা কি শুধুমাত্র আমাদের মতো আত্মকেন্দ্রিকদের কেন্দ্র করে গোলগোল হয়ে ঘুরতে পৃথিবীতে এসেছেন? আমরা কোথায় গুরুত্বপূর্ণ? আমরা কী এমন বুদ্ধিমান প্রাণী, বলুন। পৃথিবীকে আমরা, মানুষরা কিসে পরিণত করেছি বলুন। বলুন— আমাদের নির্বুদ্ধিতার যুদ্ধের ধ্বংসের ভোগবাদের লালসার বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের নামে অন্যকে নিপীড়ন করার প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংসের পশুপাখিকে অন্য জাতকে দাস বানানোর— অন্যকে নির্যাতনের কাল্পনিক কাগজের টাকা আর বিটকয়েনের গল্পের সুবিধাবাদের ইলন মাস্কের জাকারবার্গের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে এই পৃথিবীকে নোংরা আস্তাকুঁড়ে পরিণত করে মেটার কাল্পনিক জগতে নিজের প্যারালাল চরিত্রের অ্যাভাটার তৈরির মাধ্যমে মঙ্গল গ্রহে গিয়ে মঙ্গলকেও অমঙ্গল বানানোর একটা অর্থহীন বুদ্ধিহীন আয়ুক্ষয়কারী মিথ্যা কর্মযজ্ঞ ছাড়া আমাদের জীবন আর কী? কীভাবে মানুষ বুদ্ধিমান? কীভাবে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব? কে বলেন সেই কথা? কোনো গরু বা শুয়োর বা সাপ বা মশা এসে মানুষকে কি সেই কথা বলেছেন?

না।

মানুষই সেই কথা বলেছেন। মানুষ নিজেকেই নিজে সৃষ্টির সেরা জীব বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বলুন— কীভাবে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব? যেই প্রাণী জাতীয়তাবাদের ধর্মের কাল্পনিক কাগজের গল্প তৈরি করে ইরাকে সিরিয়ায় প্যালেস্টাইনে রোয়ান্ডায় মণিপুরে চট্টগ্রামে শাপলা চত্বরে আয়নাঘরে নিজের প্রজাতির অন্যদের মেরে ফেলতে পারমাণবিক অস্ত্র জৈবিক অস্ত্র আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করেন, যেই প্রাণী সম্পত্তির জন্য নিজের প্রজাতির নিজের পরিবারের মানুষকে খুন করে ফেলতে এক বিন্দু ভাবেন না, যেই প্রাণী অন্য লিঙ্গের মানুষকে, তার জন্ম দেওয়া সন্তানকে সম্পত্তিকে মনে করে সম্পত্তি কুক্ষিগত করে আফ্রিকায় চায়নার চা-বাগানে কফি বাগানে শ্রমের অবমূল্যায়নে মানবিকতার অবমূল্যায়নে শিশুদের লাশ ভেসে আসা ভূমধ্যসাগরে মেক্সিকোয় ঘৃণার দেওয়াল তুলে দেন, সেই প্রাণী কিসের সেরা জীব? ব্রিজ বানানো স্কাইস্ক্র্যাপার বানানো কিসের বুদ্ধির পরিচয়? পৃথিবী জুড়ে মানুষের তাবৎ এঞ্জিনিয়ারিংয়ের বুদ্ধি তো এসেছে প্রাণীজগতের ব্যাকটেরিয়াকে, প্রজাপতির পাখাকে, পাখির ম্যাগনেটিক ফিল্ড ধরে রাস্তা চিনে নেওয়ার ক্রিপ্টোক্রোম আর হামিংবার্ডের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার হভার আর ম্যানুভার করার এয়ারোডিনামিক্স নকল করে। আমরা জুতায় যে ভেলক্রো ব্যবহার করি তা আঁকড়া-সহ বীজের শুঁটি থেকে অনুপ্রাণিত, আমরা ক্যামোফ্লেজের বুদ্ধি পেয়েছি সেফালোপড জাতীয় অক্টোপাস আর কাটলফিশ নামের সামুদ্রিক প্রাণী থেকে, আমরা বুলেট ট্রেনের ধারণা পেয়েছি মাছরাঙা পাখির ঠোঁট থেকে, ন্যূনতম পানি ছিটিয়ে নদীর ভেতর দিয়ে ছুটে চলা সেই ঠোঁটের কারিগরি থেকে, ফ্লিপারওয়ালা রোবোটের ধারণা পেয়েছি সামুদ্রিক কচ্ছপ আর পেঙ্গুইন থেকে, নিজে নিজে পরিষ্কার হয় এমন রং তৈরি করেছি নিজে নিজে পরিষ্কার হওয়া পদ্মপাতা দেখে! তো আমাদের কী এমন বিশেষ বুদ্ধি যা একমাত্র আমাদের আছে, অন্য আর কারও নাই?

অন্যকে নকল করে নিজেদের ধ্বংস করা ছাড়া, আজগুবি গল্প তৈরি করা ছাড়া, লোভ আর আলস্য দিয়ে তাড়িত হওয়া ছাড়া আমাদের আর বিশেষত্ব কোথায়, বলুন।

বোরাক

আমরা এখন, ঠিক এই মুহূর্তে, এই ২০২৫ সালে একটা পোস্ট-পোস্ট-মডার্নিস্ট বা মেটামডার্নিস্ট সমাজের এমন একটা বিকেন্দ্রীভূত স্থানীয় অর্থনীতির সম্ভাবনার দরজায় দাঁড়িয়ে আছি যেখানে আরেকটু সামনে আগালেই পোস্ট-ক্যাপিটালিজমের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগমেন্টেড রিয়ালিটির কগনিটিভ কম্পিউটিংয়ের সংরক্ষণশীল প্রযুক্তির কোয়ান্টাম যুগের নিশ্বাস ঘাড়ের ওপর টের পাওয়া যাবে। এবং এ কথাও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে যে এই যুগে অন্য পশুর মাংস খাওয়া আগের যুগের মানুষের মাংস খাওয়ার মতোই ‘বর্বর’ কাজ বলে বিবেচিত হবে।

আমরা— মানুষরা, সময়কে ভাবি এক ঘটনা থেকে অন্য ঘটনার দূরত্ব মাপার ভবিষ্যৎমুখী একগামী সরলরৈখিক রাস্তা হিসাবে। কিন্তু সময় তা নয়। সময় একটা নির্দিষ্ট স্থানে ঘূর্ণায়মান ক্রমশ ছোটো হতে থাকা সুবর্ণ অনুপাতের মতো সর্পিল একটা গতিপথ। এবং আমাদের বুঝতে হবে যে স্থাননির্ভর এইকাল্পনিক গতিপথে মানুষের সময়কালই একমাত্র সময়কাল নয়। অর্থাৎ প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, লৌহ যুগ, মধ্যযুগ, পুনর্জাগরণ, বাণিজ্যিক বিপ্লব যুগ, শিল্পায়নের যুগ— এই সবই মানুষের অগ্রগতির সময়কাল বলে ভাবা হলেও মাথায় রাখতে হবে যে আমাদের সহযাত্রী অন্যান্য প্রজাতির পশুপাখিদের ক্ষেত্রে এই একই সময়কাল প্রযোজ্য নয়। এ-ও মাথায় রাখা প্রয়োজন যে বিবর্তন কোনো ঘটে যাওয়া অতীতের ঘটনা নয়, বরং বিবর্তন নিরন্তর পরিবর্তনশীল একটা সত্য মাত্র। এবং সত্য সকলের ক্ষেত্রে একই বিষয় নয়, ফলত বিবর্তন সবার ক্ষেত্রে একই হারে ঘটে না। সুতরাং বুঝতে হবে যে আমাদের যে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের যুগ তা আমাদের সাথে একই পৃথিবীতে বাস করা পশুদের জন্য আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের যুগ নয়। বরং এই যুগ পশুপাখিদের জন্য এখনও প্রস্তর যুগ; যেখানে তারা যন্ত্রের ব্যবহার শিখছেন বা যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করছেন মাত্র। বিষয়টা পরীক্ষার জন্য আমাদের আশেপাশের প্রাণীদের খেয়াল করা যাক। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কাকদের দেখবেন গাড়ির সামনে বিশ ফিট উঁচু থেকে আখরোট ছুড়ে ফেলছেন, যেন আপনার গাড়ির চাকায় তাদের আখরোটের খোসা খুলতে সুবিধা হয়। এই বুদ্ধি, কাকদের পঞ্চাশ বছর আগেও ছিল না সংগত কারণেই। বিড়ালদের দেখবেন, তারা মানুষদের সাথে মিউমিউ করে কথা বলছেন। আমরা জানি যে এই ভাষায় তারা নিজেরা নিজেদের সাথে কথা বলেন না। এই মিউমিউ তাদের মানুষের জন্য তৈরি করা ভাষা। ক’দিন আগে ইউটিউবে আমি একজন বিড়াল দেখলাম, যিনি তার মূক-বধির মানুষ সঙ্গী মিউমিউ শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না উপলব্ধি করার পরে পা ব্যবহার করে সাংকেতিক ভাষায় তার সাথে যোগাযোগ করছেন। সুতরাং এই থেকে আশা করা অস্বাভাবিক হবে না যে আগামী একশো বছরের মধ্যে আমরা, মানুষরা অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীদের সাথে এবং তারাও আমাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম এবং ভাষা আবিষ্কার করতে সক্ষম হব।

আমরা, মানুষরা অভিযোজনযোগ্য প্রাণী, অবশ্যই। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে আমাদের আশেপাশে বাস করা অন্যান্য প্রাণীরাও আমাদের মতোই অভিযোজনযোগ্য। শুধুমাত্র তারা আমাদের সাথে একই যুগে বাস করছেন না। তাদের সময় এবং আমাদের সময় ভিন্ন।

সুতরাং এই নতুন যুগে শুধুমাত্র খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক দিয়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর সম্পর্ক নির্ধারণের সরলীকৃত এথনোসেন্ট্রিক চিন্তা থেকে আমাদের বের হয়ে আসার কথা বিবেচনা করতে হবে।

তবে তা বিবেচনা করলে এই প্রশ্ন আসা এক্ষেত্রে স্বাভাবিক যে মানুষের খাদ্যের জোগাড় তাহলে কোথা থেকে হবে? প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে আমরা কি তাহলে ল্যাবে তৈরি করা কালচার্ড বা কালটিভেটেড— অর্থাৎ কৃত্রিম মাংস উৎপাদনের ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি? এবং তা-ই যদি যাই তাহলে জেনেটিক এবং পরিবেশগত স্তরে কয়েক প্রজন্ম পরে তার পরিণাম কী হবে? এই পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদনে কি পৃথিবীর খাদ্য সমস্যার সমাধান হবে? অবশ্য অপ্রাসঙ্গিক হলেও এক্ষেত্রে অতি অবশ্যই উল্লেখ্য যে পৃথিবীর খাদ্য সমস্যা খাদ্যের বা অর্থের অভাব থেকে তৈরি সমস্যা না, বরং আমরা জানি যে এই সমস্যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কারণে সৃষ্টি। ১৯৪৩-এর বাংলার বা ১৯৮০ সালে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষে আমরা তার প্রমাণ দেখি। অমর্ত্য সেনও তাঁর Poverty and famines: an essay on entitlement and deprivation (1981) লেখায় বণ্টন ব্যবস্থার বা অপব্যবস্থার রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন। সুতরাং ল্যাবে কৃত্রিম উপায়ে কোষ বিভাজন করে কোনো প্রাণীকে নিপীড়ন না করেও যদি মাংস বা দুধ উৎপাদিত হয়— যা ইতোমধ্যে হচ্ছেই, তাতে পৃথিবীতে খাদ্য সংকটের সমাধান হয়ে যাবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। তবে বৈষম্যমূলক রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ না হলেও পৃথিবী যে হারে মানুষে মানুষে জাতিগত লৈঙ্গিক ধর্মীয় ইত্যাদি বৈষম্যমূলক নিপীড়নের আধিপত্যমূলক অপরায়নের রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসছেন, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বাধ্যতামূলকভাবে প্রজাতিগত বৈষম্যও কমবে বলে আমার ধারণা।

বিজ্ঞান যে আমাদের সবসময় সামনে নিয়ে যায়, বিষয়টা তা নয়। বিজ্ঞান অনেক সময় আমাদের পেছনেও নিয়ে যায়। এবং এই পেছনে যাওয়াটা খারাপ কোনো বিষয় না। আমি বিশ্বাস করি, আমরা এই নতুন যুগে পেছনে ফেরত যাচ্ছি। এই পেছনে যাওয়ার পরিক্রমায় ল্যাবে তৈরি কৃত্রিম খাদ্যের সায়েন্স ফিকশনের ডিসটোপিয়ায় আবদ্ধ না হতে চাইলে পেছনের যুগের মতো ব্যক্তি বা স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী হওয়াই সম্ভবত আমাদের জন্য সবচাইতে সহজ এবং টেকসই পদ্ধতি হবে বলে আমি ধারণা করি। সময় বিষয়টাকে আমি এবং আমার মতো অনেকেই ঘূর্ণায়নমান একটা গোল্ডেন রেশিওর পথ হিসাবে দেখি আগেই বলেছি। সুতরাং একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ঘটনার বিচারে আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার আবার পুনরাবৃত্তি ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না। ফলত দু’হাজার বছর আগের রাজা সলোমনের পশুপাখিদের ভাষায় কথা বলার যে মিথ আছে, আমি বিশ্বাস করি আমরা একশো বছরের মধ্যে আবার সেই পেছনের মিথোলজিক্যাল যুগে ফেরত যাচ্ছি। জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিং এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় আমাদের আয়ুষ্কাল যেভাবে আবার পেছনের আদম নূহ সেথ ইনোখ্ব লামেকের মতো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়ার রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতেও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না যে ধানগম চাষ করা বাড়ির পেছনে

আঙিনায় সবজি ফলানো বন থেকে ফল কুড়িয়ে আনা পিরামিড আর স্টোনহেঞ্জ আর ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান তৈরি করা আমাদের ডাইনি পূর্বসূরীরাই আমাদের ভবিষ্যতের মানুষ হবেন এবং আমরাই বরং আমাদের পূর্বসূরীদের চাইতে পেছনের মানুষ হিসাবে বিবেচিত হব। গত একশো বছরের পুঁজিবাদ এবং বিজ্ঞানবাদের অহংকারে জ্ঞানহীন আমরা যে আমাদের পৃথিবীর প্রতি, আমাদের আশেপাশের প্রতিটা জীবন্ত এবং অজীবন্ত প্রাণী আর অপ্রাণীর ওপর, নিজেদের শরীর আর মন আর আত্মার ওপরও নিরন্তর অত্যাচার করেছি, ভোগবাদের সংস্কৃতিতে ঘরবাড়িবাসা নিজেদের আলমারি আর ব্যাগ অপ্রয়োজনীয় আবর্জনায় আর নিজেদের ফ্রিজ আর রান্নাঘরের তাক তিন মাসের তিন বছরের তিন যুগের খাবারে ভরিয়ে নিজেদের স্থূল থেকে স্থূলতর করার প্রক্রিয়ায় শরীর আর মাথাকে অসুস্থ করে প্রতিনিয়ত অসুধ নামক ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির বিষ গেলার প্রক্রিয়ায় প্রকৃতিচ্যুত হয়েছি, নিজেদের খাবারের দায়িত্ব ম্যাকডোনাল্ডস আর পিৎজা হাট আর কেএফসি-র মতো বিষ উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীর হাতে দিয়ে মাংস আর দুধ উৎপাদনের অমানবিক কারখানায় গুটেনবার্গের প্রিন্টিং প্রেসের লিখিত যুগে জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে জ্ঞানকে অক্ষরকে প্রজ্ঞাকে শ্রেণি দিয়ে লিঙ্গ দিয়ে বাক্সবন্দি করে এক ঘোর অন্ধকারে সাঁতার কেটে ধ্বংসযজ্ঞের প্ল্যাটোতে পৌঁছেছি, তাতে আমরা নিজেদের বুদ্ধিমান প্রাণী বলে দাবি করার অধিকার হারিয়েছি বলে আমি মনে করি। সুতরাং পেছনে ফেরত যাওয়া ছাড়া, মঙ্গল গ্রহের ডিসটোপিয়ান লাল মাটি ছাড়া এই ধূলির ধরায় আমাদের সামনে কি দ্বিতীয় কোনো উপায় অবশিষ্ট আছে? এখন ডিজিটাইজড মিডিয়া পার হয়ে টিকটকের দুই মিনিটের অকারণ ডোপামিন নিঃসরণের এডিএইচডি পার হয়ে অডিবল নামক কানে শোনা গল্পের জগৎ পার হয়ে আগুনের পাশে বসে চর্চা করা মৌখিক সংস্কৃতির পেছনের পৃথিবীতে ফেরত যাওয়া ছাড়া আমাদের কি রামায়ণ আর মহাভারত আর ইলিয়াড আর ওডিসিদের রক্ষা করার, নতুন করে রামায়ণ আর মহাভারত আর ইলিয়াড আর ওডিসিদের জন্ম দেবার দ্বিতীয় কোনো উপায় খোলা আছে?

আমি মনে করি আমাদের দ্বিতীয় আর উপায় নাই।

আমি বিশ্বাস করি মানুষের অনন্যতা তার গল্প বলার ক্ষমতায়। আমি বিশ্বাস করি আমরা আবার মুখে মুখে মহাকাব্যদের জন্ম দিতে যাচ্ছি। আমরা পেছনে ফিরছি। আমরা জাত্যাভিমানে আক্রান্ত হওয়া নিজের ভূমিপুত্র-কন্যাদের রাক্ষস-খোক্কস বানানোর, নিজেদের আশরাফুল মাখলুকাত বানানোর ন্যারেটিভ পালটাচ্ছি। আমরা ঘাসের পাশে আগুনের পাশে ফেরত যাচ্ছি।

আমরা রূপকথার গল্প শোনাচ্ছি নোয়াদের।

গল্প শুনতে শুনতে নোয়ারা ঝিমাবেন।

সাথে ঝিমাবেন চালের আড়তের আমাদের ফুল পাখি সাপ ব্যাঙ রাক্ষস খোক্কস শিশুরাও।

লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top