আজ বুধবার, ২রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

একাত্তর, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী ও বড় বাংলা

পেরিয়ে এলাম ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বর। এই ১৬ ডিসেম্বর শুধুই কি বাংলাদেশের বিজয় দিবস? গণমানুষের সার্বিক আকাঙ্খার দিক থেকে বিবেচনা করলে এই তারিখটি যেমন বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের ও বহমানতার দিকচিহ্ন, ঠিক তেমনই এ্ই দিনটি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরবঙ্গ, ঈশানবঙ্গ, মানভূম ও ধলভূম-সহ বড় বাংলার কাছে গর্বের দিন। বৃহৎ ইতিহাস-চেতনার দিক থেকে দেখলে এই দিনটি বাংলাভূমির সকল ভুমিসন্তানের বিজয় দিবস। কারণ বাংলাদেশের বিজয় দিবসে আত্মিক ও মানবিক অবদান ছিল পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার৷ কিছুটা অসমেরও৷ দিল্লির অবদানটা আসলে অবদান নয়, কেননা উহা ছিল ভূরাজনৈতিক স্ট্র‍্যাটেজির জায়গা থেকে ফায়দা তোলার আকাঙ্খা৷ বাংলাদেশের বিজয় দিবস তাই দিল্লির নয়৷ তার আরও কারণ দিল্লি বিজয় দিবসকে ভারত-পাক বাইনারির ভিতর দিয়েই দেখেছে ও সেই অনুযায়ী কাজ করেছে৷ দিল্লি বিজয় দিবসকে জনযুদ্ধের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের জনতার বিজয় হিসাবে দেখেনি, দেখেছে স্রেফ ইসলামাবাদের পরাজয় ও নিজেদের (দিল্লির) বিজয় হিসাবে৷ দিল্লির এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয় একাত্তর নিয়ে তৈরি হওয়া বিভিন্ন বলিউডি সিনেমা থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় চেতনার সাংস্কৃতিক বয়ানে। তাছাড়া এবারেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক্স হ্যান্ডেলে দেওয়া পোস্টের বয়ান দেখলেই বোঝা যায় একাত্তর ও ১৬ ডিসেম্বরের বিষয়ে দিল্লির দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু এই একাত্তরকে পশ্চিমবঙ্গের ও ত্রিপুরার জনতা বৃহৎ বঙ্গের বাঙালি-সহ বঙ্গের সকল ভূমিসন্তানের গণজাগরণ হিসাবেই দেখেছিল একাত্তরে৷ তাই একদা পূবের বাংলার পূবের পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ওঠার স্ট্রাগেলকে সেখানকার জনতার বিজয় হিসাবেই চিহ্নিত করেছিল পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরা৷ বৃহৎ বঙ্গের জাতীয় গণতান্ত্রিক উন্মেষ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্যে যে প্রকট হয়েছিল তা আলোড়িত করেছিল ভারতীয় ভুখণ্ডের বঙ্গীয় পরিসরকে৷ তাই বিজয় দিবস বড় বাংলার প্রতিটি বঙ্গীয় পরিসরের সত্তার গর্ব৷ বিজয় দিবস দিল্লির নয় তাই৷ বিজয় দিবস বাংলাদেশের এবং বড় বাংলার৷ বঙ্গীয় সুলতান রাজত্ত্বের সময়কালে যে বড় বাংলার রাজনৈতিক বীজ বপন করেছিলেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নিজিকে সমগ্র বঙ্গ ভূমির অধিপতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে। কেননা তিনিই প্রথম ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ভূখণ্ডকে নিয়ে একটা ইউনিফায়েড বাংলার ধারণা দেন। কিন্তু তারও বহু বহু আগে থেকে, বৈদিক সভ্যতা গড়ে ওঠার বহু আগে থেকেই প্রকৃতিনিবিড় বাদামি-কালো চামড়ার ভূমিসন্তানে্র এই বঙ্গভূমির উজ্জ্বল উপস্থিতি উপমহাদেশের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বঙ্গের ইতিহাসকে মুছে দিয়ে, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে, সম্পদ লুঠ করে বৈদিক মনুবাদী সাম্রাজ‌্য কায়েম করার ব‌্যাপারে আর্য বলয়ের বাসনা বহু পুরাতন।

মনে রাখতে হবে ওই বৈদিক আর্য বলয়েরই অংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। তাদের চিন্তাচেতনা জুড়েও বিরাজমান বর্ণবাদী জাতিঘৃণা। এক্ষেত্রে উত্তর ও পশ্চিম ভারত আর একদা পশ্চিম পাকিস্তান তথা আজকের খণ্ডিত পাকিস্তানের মূলভাগের তেমন কোনও ফারাক নেই। আর সেকারণেই বাঙালির রক্তের বিনিময়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিবাসীরা ব্রিটিশদের তাড়াতে সক্ষম হলেও সাতচল্লিশের পর থেকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরকার বঙ্গীয় পরিসরগুলির ওপর অর্থনৈতিক নিপীড়ন যত দিন গিয়েছে ততই বেড়েছ। উল্টোদিকে পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতার চাকায় নিষ্পেষিত হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। ক্রমে তা বাংলা ও বাঙালিবিদ্বেষের জাতিবাদী রাজনীতি চেহারা নিয়ে পূবের বাঙালি-সহ সকল অধিবাসীর ওপর বর্ণবাদী নিপীড়ন চালিয়ে গিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান। সেই নিপীড়ন থেকে মুক্তি মিলতে উনসত্তরের গণপ্রতিরোধের পর একাত্তরের ৩০ লক্ষ বাঙালিকে আত্মবিসর্জন দিতে হয়েছে। মুক্তিসংগ্রামের এই লড়াইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের পলিসিগত কারণে সংহতি জানালেও দিল্লির সহযোগিতা ছিল ভূরাজনৈতিক স্বার্থজনিত। আর সে কারণেই বিজয় দিবসকে দিল্লি কখনোই বাংলাদেশের জনগণের বিজয় হিসাবে মর্যাদা দেয়নি।

যদি দিল্লি বিজয় দিবসকে এভাবে মর্যাদা দিত তাহলে বাংলাদেশকে কলোনি বানাতে চাইত না, বাংলাবিদ্বেষ কায়েম করত না, আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠায় সাহায্য করত না, পতিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারীদের অনৈতিক আশ্রয় দিত না, পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের বাংলাদেশি ট্যাগ দিয়ে, অনুপ্রবেশকারী ট্যাগ দিয়ে পুশব্যাক করত না৷ কিন্তু এসবই দিল্লি করেছে এবং একাত্তরকে ভিতর থেকে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা নিয়েছে৷ দিল্লি আসলে কখনোই কোনো বাংলার ভালো চায়নি৷ কারণ দিল্লি বর্ণবাদী৷ বাংলা যেহেতু শূদ্রের সম্পদশালী ভুবন তাই দিল্লির ব্রাহ্মণ্যবাদী চেতনা বাংলাকে জাতিঘৃণার জায়গা থেকে দেখে৷ শূদ্রের জল-জমি-জঙ্গল লুঠ করতে চায়৷ এসআইআর-এনআরসির মাধ্যমে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থাকা বঙ্গীয় পরিসর দখল করতে চায়।

‘বিজয় দিবসের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে ওঠার ক্ষমতা অর্জনের ভিতর দিয়ে যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর সমস্ত শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল, তেমনই গোটা পৃথিবীতে প্রথম ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পূর্ববঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের মানুষ যে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে, সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বঙ্গীয় পরিসরের মানুষ কি স্বাধীন একটি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে? উত্তর না। এদিকে ভারত রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে একান্ত ভাবেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দিল্লির জয় বলে যেভাবে কৃতিত্ব জাহির করেছে, সেভাবেই পশ্চিমবঙ্গের আজকের ইতিহাসবিবর্জিত মোদি-শাহের মগজ ধোলাইয়ের শিকার হওয়া মিডলক্লাস বাঙালির বড় একটা অংশও এমন একটা ধারণা পোষণ করেন যে একাত্তরের বিজয় বুঝি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একান্তভাবে ভারত রাষ্ট্রের জয়। আর পশ্চিমবঙ্গের বাবু বাঙালির এহেন চিন্তাপ্রক্রিয়ার জেরে তাদের রাজনৈতিক উত্তরণের পথ সঙ্কুচিত হয়। ক্রমেই রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবাসী হয়ে ওঠার সম্ভবনার মৃত্যু ঘটে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা সংস্কৃতিকভাবে বাঙালি হলেও এখনও রাজনৈতিকভাবে বাঙালি ও বঙ্গবাসী হয়ে উঠতে পারেননি। যেটা পূর্ববঙ্গের তথা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ পেরেছে। তাঁরা যেমন সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালি বা চাকমা মার্মা, তেমনই তাঁরা রাজনৈতিকভাবে সার্বভৌম বাংলাদেশি।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিরা রক্ত ঝড়ালেও স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র গঠনে বাঙালিদের সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিতান্তই ক্ষীণ। যতদিন গিয়েছে দিল্লির ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ততই দূরে সরে গেছে বাঙালি-সব ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বঙ্গীয় জাতিসত্তাগুলি। দিল্লির ক্ষমতার স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিতই থেকেছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ভূমি সন্তানদের অবস্থা আরও খারাপ। এনআরসির মাধ্যমে অসমে ১৯ লক্ষ বাঙালিকে ‘ডি ভোটার’ করা হয়েছে। বর্তমানে এসআইআর -এর মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের ভূমি সন্তানদের একটা বিরাট অংশকে ‘ডি ভোটার’ করার নীল নকশা তৈরি করেছে বিজেপি আরএসএস পরিচালিত দিল্লির ইউনিয়ন সরকার। প্রতিনিয়ত দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান বিভিন্ন রাজ্যে যাওয়া বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে শুধু বাংলায় কথা বলার জন্য। বাংলায় কথা বললে যেমন তাদের বাংলাদেশী তকমা দেওয়া হচ্ছে, পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশী’ ভাষা বলা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে যেমন সার্বিকভাবে বাংলা ভাষাকে অপমান করা হচ্ছে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনে একটা চাষ করা হচ্ছে বাংলাদেশ ঘৃণা। দুঃখের বিষয় হল, বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা বিরাট অংশ আরএসএস বিজেপির এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে স্রেফ নীরব দর্শক। পশ্চিমবঙ্গের জমিনে যে প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার ছিল তা হয়নি। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রবলভাবে মননে বাংলাদেশ ঘৃণা পোষণ করছে। বিশেষ করে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ কে একটা দানব রাষ্ট্র হিসেবে দেখছে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত বাঙালিদের একটা বিরাট অংশ। যেটা একান্ত ভাবেই কাম্য নয়। পশ্চিমবঙ্গের একটি বাংলাবাদী সংগঠন এমনও দাবি তুলেছে, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ‘সভ্য বাঙালি, আর বাংলাদেশের বাঙালি ‘অসভ্য বাঙালি। কিন্তু বাংলাদেশিরা অর্থাৎ বাংলাদেশের বাঙালি, চাকমা, মার্মা, পাহাড়ি-সহ সকল অধিবাস কোনভাবেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের তাদের শত্রু মনে করে না। হ্যাঁ তারা প্রবল ভাবেই দিল্লির আধিপত্যবাদের বিরোধী। সেটা তো হাওয়াই স্বাভাবিক। রক্ত ঝরিয়ে, শাহাদতবরণের মধ্য দিয়ে তার একটা স্বাধীন দেশ কায়েম করেছে কারোর গোলামিকরার জন্য নয়। ভারত তার ভুরাজনৈতিক স্বার্থেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল, তার মানে এই নয় যে একটা ছোট দেশকে চিরকাল গোলাম হয়ে থাকতে হবে। স্বাধীন হওয়ার জন্যই তো তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পরেও হাসিনার জামানায় দিল্লি বাংলাদেশকে নিজেদের কলোনি বলেই মনে করত। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনাকে সরিয়ে বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা লাভ করেছে। হ্যাঁ বাংলাদেশে ইসলামিক জাতিবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে। এমনকী দিল্লি হেজিমনির বিরোধিতা করতে গিয়ে ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির পুনরুত্থান হয়েছে। এগুলি কোনোটাই সার্বিকভাবে সুখকর নয়। বরং আত্মঘাতী প্রবণতা। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশকে নতুন করে গঠন করার যে শর্ত তৈরি করে দিয়েছে, সেই শর্তটা কে কীভাবে কাজে লাগাতে পারবে সেটা বাংলাদেশের মানুষের উপর নির্ভর করবে, সেটা নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা সমাজে বিদ্যমান আছে।

কিন্তু যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি-সহ সকল অধিবাসীরা এখনও রাজনৈতিকভাবে জনগোষ্ঠী হিসাবে নিজেদের রাজনৈতিক আত্মনির্মাণ করতে পারেনি, তাদের তরফ থেকে বাংলাদেশিদের ‘অসভ্য ’বলাটা একান্তই হাস্যকর এবং নিজেদের অক্ষমতাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার প্রতিফলন। পশ্চিমবঙ্গবাসী আজও বাঙালি, সাঁওতালি, কুড়মালি-সহ সকল বঙ্গীয় জাতিসত্তাগুলিকে একত্রিত করে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হয়ে উঠতে পারেনি। তারা সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালি হলেও রাজনৈতিকভাবে এখনও তারা পরাধীন। কেননা সাংস্কৃতিক পরিচয় থাকলেই মুক্তি আসে না। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের যে বাবু বাঙালি নিজেদেরকে সাংস্কৃতিক পরিচয়ে বাঙালি হিসাবে দেখতে চায়, তাদের সেই সাংস্কৃতিক বাঙালি সত্তাটাও ‘ভূমি বাঙালি’ সত্তা নয় বরং উপনিবেশবাদ ও বৈদিক বর্ণবাদের মিশেলে নবজাগরণের নাম করে যে সিন্থেটিক বাবু বাঙালি সত্তা তৈরি হয়েছিল, তারই লিগাসি বহন করছেন এই বাবুরা, যা বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে কতটা সম্পৃক্ত অথবা কতটা পরিপন্থী।

আসলে জাতীয় গণতান্ত্রিক অধিকার কায়েম করা ছাড়া শেষ পর্যন্ত শাসিত হয়। যেটা ভারতে দেখা যাচ্ছে। হিন্দির আধিপত্য গেঁড়ে বসেছে বাংলার জমিনেও। এটা বুঝতে হবে যে রাজনৈতিকভাবে জাতি হয়ে উঠতে হয়। বেনেডিক্ট আন্ডারসন বলছেন, ‘A nation is a historically produced political community’। এটা ঠিক ভাষা, সাহিত্য, লোকাচার, খাদ্য, স্মৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে বাঙালি একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেনেডিক্ট আন্ডারসন একেই বলেছেন ‘Imagined Community’। যেখানে মানুষ একে অপরকে না চিনলেও একই ভাষা ও স্মৃতির ভেতর নিজেদের কল্পনা করে। এই অর্থে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ দুটিই সাংস্কৃতিকভাবে বঙ্গীয়। এখানে অবশ্যই রাজনৈতিক সীমান্ত গৌণ। কিছু বাংলাদেশি পরিচয় প্রবলভাবেই রাজনৈতিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাবু বাঙালির ভিতর এই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গঠনের প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার আকাঙ্খা কখনও সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি। বরং উনিশ শতকীয় তথাকথিত নবজাগরণের হাত ধরে যে কলকাতাকেন্দ্রিক ঔপনিবেশি বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল সেটাকেই আনন্দবাজারের মতো সংবাদমাধ্যমগোষ্ঠী ‘বাঙালি’ সংস্কৃতি বলে চালিয়ে এসেছে। যে সংস্কৃতির বাইরে অবস্থান করছে ৭০ শতাংশের বেশি বাংলার ভূমিসন্তানরা। শুধু তাই নয় এই সংস্কৃতিকেই যুগ যুগ ধরে তারা মননে ধারণ করে এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বাঙালি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যেও দেখা যায়নি। বরং তারা অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে ভারতীয়। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে তারা অনেক দূরে। তাই এখানে বাঙালি সংস্কৃতি একটা ‘Sub National identity’ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ সংস্কৃতি আছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। এটাকেই ফ্রান্জ ফাননের ভাষাই বলতে হয়, ‘Cultural expression without political power’। সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ হিন্দুত্ববাদেরই সফট ভার্সান হলেও এখন বিজেপি আরএসএস-র হাতে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ’ হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছে। এটি একটি ‘Hegemonic Project’ । বর্তমান ইউনিয়ন সরকার আঞ্চলিক জাতিসত্তাগুলোকে কিছু বানোয়াট সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে রাখছে। যেমন বাংলাকে সংস্কৃতজাত প্রমাণ করতে সুকৌশলে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে, কিন্তু সমানে চলছে বাঙালিবিদ্বেষ। বাংলা ভাষায় কথা বলে বাংলাদেশী তকমা দিয়ে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করছে। তাই বাংলাদেশের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করে, ঘৃণা না ছড়িয়ে, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি-সহ সকল ভূ-অধিবাসীদের রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবাসী বা বড় বাংলার অধিবাসী হয়ে উঠতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করেছে, ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান করেছে, ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নতুন দেশ অর্জন করেছে। আবার ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে সরিয়ে নতুন ভাবে নিজেদের গঠন করতে চাইছে। সেই জায়গায় তারা যেমন সংস্কৃতিক ভাবে বাঙালি, পাহাড়ি প্রভৃতি, তেমনই তারা রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবাসী হয়ে উঠতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top