।। অতনু সিংহ।।
একটা কথা সাফ বুঝে নেওয়া দরকার, এই বড় বাংলায় বাংলা ভাষার বহমানতায় যেসব শব্দ অবলীলায় ঢুকে বেগবান করেছে ভাষাকে, সেইসব শব্দ যে ভাষারই হোক, বাংলা ভাষাকে সেই সকল শব্দ প্রাণবন্ত করেছে। রবীন্দ্রনাথ তাই দাবি করেছেন তর্কটা মোটেও শব্দ অন্তর্গত বা অন্তর্ভূক্ত করে না-নেওয়ার তর্ক না। সেটা বাংলা ভাষার ‘নিত্য প্রকৃতি’র তর্ক। অর্থাৎ বাংলা ভাষা সেটা কতটা নিতে পেরেছে এবং জীবন্ত সাধারণ মানুষের ভাষার কতটা কাছাকাছি যেতে পারছে তার ওপর নির্ভর করে। রবীন্দ্রনাথ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী , দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ সংস্কৃত, তৎসম ও তদ্ভব শব্দের নির্বিচার ব্যবহারকে মান্যতা দেন নি। সেটাও বাংলা ভাষার নিত্য প্রকৃতির জায়গা থেকে। খাটে না, তবুও জোড় করে সংস্কৃত শব্দ চাপানোর বিরোধিতা করেছেন তাঁরাও…
বাবু-বাঙালির শুচিবায়ুগ্রস্থ ‘বাংলা’ ভাষা
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির অনুষ্ঠানে চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন যা বলেছেন সেটাই কলকাতার আশিভাগ বর্ণবাদী সুশীল বাঙালির (বর্ণহিন্দু) ভাবনা! গোটা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এমনটা বলা যায় না অবশ্যই। কিন্তু এটা ফ্যাক্ট যে কলকাতার বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক ভাইরাস পশ্চিমবঙ্গে বাংলার বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যকে ক্রমশই ধ্বংস করছে! অথচ দ্যাখেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উত্তরসূরী প্রমিতওয়ালারা তো বাঙলা ভাষাতেই কথা বলেন। যে ভাষা থেকে আরবি-ফার্সি শব্দ অকাতরে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেও পুরোপুরিভাবে সে কাজে কামিয়াব হয় নাই নবজাগরণওয়ালারা। আর তাই বাবু সমাজ আজও তাদের জবানে এবং লিখনমাধ্যমের বাংলা ভাষায় প্রতিনিয়ত আরবি-ফার্সি-তুর্কি শব্দ ব্যবহার করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা জানে না শব্দগুলো কোথা থেকে এলো। আর কী কী জানে না? জানে না, তাদের নিজেরই ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস এবং ব্যপ্তি।
তৎসম-তদ্ভব শব্দের তল্পিবাহকরা জানেই না যে বাংলা ভাষা আগায়ে যাওয়ার পিছনে প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছিল সংস্কৃত। পশ্চিম পাকিস্তান শাসকের থেকেও বাংলা ভাষাকে অনেক আগেই কোতল করতে চেয়েছেন লক্ষণ সেন, বল্লাল সেনেরা। অন্যদিকে বাংলা ভাষার সবথেকে বেশি উৎকর্ষতা তৈরি হয়েছে সুলতানি আমলে — আলাউদ্দিন হুসেইন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) ও শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২ – ১৪১৫)-দের সময়েই। প্রথমে সংস্কৃত আর আর তারপর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে তৈরি হওয়া হিন্দি ভাষার তল্পিবাহক হয়ে ওঠা ক্যালকেশিয়ান বুদ্ধিজীবী ও ক্ষমতার চাকর-বাকররা। তারা জানেই না তাদের তৎসম-তদ্ভবপ্রীতির বৈদিক বর্ণবাদী প্রীতির কোনো বেইল নাই আজ বিশ্বে। বাংলাভাষা বলতে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক বাংলার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, মূর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, বীরভূম ইত্যাদি জেলাগুলোর বাংলা ভাষাবৈচিত্র্যকে সম্মান করা হলেও আজ আর কলকাতাকে কেউ গুনতির মধ্যেই আনে না।
বৈশ্বিক বাংলা গণমাধ্যম থেকে শুরু করে গ্লোবাল বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবকাঠামোয় কলকাতা এখন একটা গঞ্জমাত্র। এইট-বি থেকে কলেজ স্কোয়ার এই হচ্ছে ক্যালকেশিয়ানদের গণ্ডি। উহাদের ভাণ্ড ফুঁটা হইয়া গেছে দিল্লি, হিন্দি আর বৈদিক হিন্দুত্বের মোসাহেবি করিতে করিতে। তাই বিশ্ব ও ব্রহ্মাণ্ডের কোনো আলোই আর ওই ভাণ্ডে এসে পড়ে না। কূয়ার ব্যাঙেরা এতই অন্ধ যে জানেই না, আরবি-ফার্সি কী প্রকারে ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, লালন থেকে মাইকেলদের কাব্যসাহিত্যের উত্তরণ ঘটিয়েছে৷ এমনকী রামমোহন রায় কিংবা ভাই গিরীশচন্দ্র সেনেদের গদ্যসাহিত্যের বড় জায়গায় ঠাঁই পেয়েছে আরবি-ফার্সি। পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র সেনের মতো কয়েকজন বড় মনের মানুষ বড় বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারে আরবি-ফার্সির গুরুত্বকে খাঁটি ঐতিহাসিক গবেষকের মতো স্বীকার করেছেন, যথার্থই তাঁরা তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ফলে ‘বৃহৎ বঙ্গ’ নামক ধারণাও তারা আমাদের ভাবনা ও আগামী রাজনীতির জন্য রেখে গিয়েছেন। এমনকি ঔপনিবেশিক আধুনিকতার কালপর্বে বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাস-সহ গদ্যভাণ্ডারের হাজারও জায়গায় আরবি-ফার্সি শব্দকে বাদ দিতে পারেননি।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের দ্বারা আমদানি করা কলোনিয়াল মর্ডানিজম যাকে ‘মধ্যযুগ’ বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছে সেই যুগটাই কিন্তু বাংলা কাব্যের স্বর্ণযুগ। অথচ দীনেশচন্দ্র সেন পরবর্তী সময়ে কলকাতার আকাদেমিয়া জগত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসচর্চায় আব্দুল হাকিম, সৈয়দ সুলতানের মতো বিরাট বিরাট কবিদের কথা এক হিসাবে আড়ালই করে গিয়েছে। কলকাতার কয়জন কবি, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক প্রমুখরা সৈয়দ সুলতান ও তাঁর ‘জ্ঞানচৌতিশা”র মতো দার্শনিক কাব্যমঞ্জুষার কথা মনে রাখেননি বা রাখতে চাননি! এমনকী পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজের কেউ কেউ সৈয়দ সুলতানের ‘নবীবংশ’-এর কথা বললেও তাঁর ‘জ্ঞানচৌতিষা’র কথা আদৌ উচ্চারণ করেন কি না সন্দেহ! বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ভাষা, সাহিত্য ও দর্শন বা ভাববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে সৈয়দ সুলতানের কাব্য চর্চার বিষয় হলেও কলকাতা, যাদবপুর-এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্চায় সৈয়দ সুলতান ব্রাত্য!
খণ্ডিলে খণ্ডন নাহি সেই অখণ্ডন
খণ্ড খণ্ড হয়ে আছে তেঁই সে কারণ
জ্ঞানচৌতিষা’য় ‘মধ্যযুগ’-এর এই কবি লিখলেন এমনটাই। অর্থাৎ যিনি পরমসত্তা, তাঁকে কেউ খণ্ডন করতে পারে না। তিনি অখণ্ড। আর যেহেতু তিনি অখণ্ড, তাই তিনি নিজেই খণ্ডে-খণ্ডে প্রকাশিত হয়ে সামগ্রিক অখণ্ড কারণ হিসেবে নিত্যসত্য হয়ে আছেন। খণ্ড খণ্ড হয়ে থাকা মানবসত্তার স্থান-কালের প্রেক্ষিত অনুযায়ী তিনি খণ্ড খণ্ড উপলব্ধির মধ্যে হাজির বলেই গোটা মানবসত্তার পরমার্থিক সম্বন্ধের ক্ষেত্রে তিনি অখণ্ড। বাংলা কাব্যে বঙ্গের মৌলিক দর্শন ও তার কাব্যিক স্ফূরণ নিয়ে যিনি বড়মাপের কাণ্ড ঘটিয়ে গিয়েছেন তাঁকে বাদ দিয়ে কীভাবে কলকাতার আকাদেমিয়ায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসচর্চা সাধিত হয়, এ এক বড় প্রশ্ন।
আলাওল ও দৌলত কাজীর নামমাত্র উচ্চারণ কলকাতার আকাদেমিয়া জগতে কালে ভদ্রে শোনা যায়। শুনতে পাওয়া গেলেও তাঁদের নিয়ে বিশদে কি কোনো কাজ হয়েছে? অথচ আলাওলের সাহিত্যসম্ভারে পুরা উপমহাদেশই হাজির থাকত। হিন্দুস্তানি, অওধি, ফার্সি সাহিত্য অনুবাদ করতেন আপন ভাষা বাংলায়। শুধুই তর্জমা নয়, পাশাপাশি সাহিত্যে তাঁর মৌলিক অবদান হেতু অপরূপ কাব্যরসেরও সাক্ষ্য তিনি রাখলেন। আর এ পরম্পরাতেই দৌলত কাজী আরাকানের রাজসভার কবি হয়েও বাংলা ভাষাতেই কাব্য রচনা করে গেছেন। যাকে অন্ধকার যুগ ও মধ্যযুগ বলে চিহ্নিত করেছে ফোর্ট উইলিয়া কলেজে ও ‘নবজাগরণ’মুখী ইওরোসেন্ট্রিক বাবু বাঙালি, সেই সোকল্ড ‘অন্ধকার’-এ যে আলো জ্বলেছিল ভাষায়, ভাষার অলঙ্কারে, কথনে, প্রতীক ও উপমা সৃজনে, সেই আলো ছিল এ ভূমির নিজস্ব। কৃষি ও কারিগরী অর্থনীতিতে এ ভূমি তখনও আলোকিত। বৃহৎ বঙ্গের ইতিহাস আমাদের সেই সত্যের সাক্ষ্য দেয়। যেখানে দেখা যায় ইওরোপ তখনও প্রাচ্যের কাছে অপাংক্তেয়। আর প্রাচ্যের বঙ্গদেশের গরিমা তখন গোটা বিশ্ব দরবারে সুপরিচিত। এই সেই তথাকথিত মধ্যযুগ, যখন আব্দুল হাকিমের মতো কবি তাঁর ‘নূরনামা’ কাব্যগ্রন্থে ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় লিখলেন,
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।
বঙ্গদেশে জন্মে যারা বঙ্গের মর্মবাণী ও ভাষাকে হিংসে করে, তাদের জন্মটা ঠিক কেমন? এই প্রশ্ন তুলেছেন আব্দুল হাকিম।
একটা কথা সাফ বুঝে নেওয়া দরকার, এই বড় বাংলায় বাংলা ভাষার বহমানতায় যেসব শব্দ অবলীলায় ঢুকে বেগবান করেছে ভাষাকে, সেইসব শব্দ যে ভাষারই হোক, বাংলা ভাষাকে সেই সকল শব্দ প্রাণবন্ত করেছে। রবীন্দ্রনাথ তাই দাবি করেছেন তর্কটা মোটেও শব্দ অন্তর্গত বা অন্তর্ভূক্ত করে না-নেওয়ার তর্ক না। সেটা বাংলা ভাষার ‘নিত্য প্রকৃতি’র তর্ক। অর্থাৎ বাংলা ভাষা সেটা কতটা নিতে পেরেছে এবং জীবন্ত সাধারণ মানুষের ভাষার কতোটা কাছাকাছি যেতে পারছে তার ওপর নির্ভর করে। রবীন্দ্রনাথ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী , দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ সংস্কৃত, তৎসম ও তদ্ভব শব্দের নির্বিচার ব্যবহারকে মান্যতা দেন নি। সেটাও বাংলা ভাষার নিত্য প্রকৃতির জায়গা থেকে। খাটে না, তবুও জোড় করে সংস্কৃত শব্দ চাপানোর বিরোধিতা করেছেন তাঁরাও। একই যুক্তিতে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের ‘খুন’ শব্দ ব্যবহারে আপত্তি করেছেন, কিন্তু নজরুল দেখিছে সৃষ্টিশীলতার তর্ক আলাদা। তাকে দড়ি দিয়ে ধরে-বেঁধে রাখা যায় না। কমলকুমার মজুমদারের ভাষা নিয়ে এই সূত্রে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে।
মোদ্দা কথা হলো, যে ভাষা বেগবান বাংলার গতিপথকে সঙ্কীর্ণ করতে চায়, পবিত্রতার অছিলায় ভাষাকে গণদরবার থেকে লুঠ করে সামন্তের, ব্রাহ্মণের, আশরাফের আর বুর্জোয়ার ক্ষমতার ভাষা-রাজনীতি — অর্থাৎ নিজেদের বর্ণ আর শ্রেণীর আধিপত্য চাপিয়ে রাখতে চাইয়, তাকে লাত্থি মেরে তাড়ানো এখন আমাদের নান্দনিক ও রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে উঠেছে । বাংলা ভাষার প্রবাহপথ থেকে অকাতরে আরবি-ফার্সিকে বিচ্ছিন্ন করে সংস্কৃত ঢোকানো হয়েছে। অথচ এই সংস্কৃত বড় বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদের অনুপ্রবেশের পর থেকে অনার্য গণমানুষের বিরুদ্ধে গণসমাজের বিরুদ্ধেই নির্লজ্জ অবস্থান। যার জেরে শ্রীচৈতন্য বৈদান্তিক শঙ্করাচার্যীয় বিভ্রম-দর্শনের পাশাপাশি সংস্কৃত জ্ঞানচর্চাকে নাকচ করলেন, ‘জ্ঞানপুস্তিকা’ ভাসিয়ে দিলেন গঙ্গার পানিতে। সময়টা সেই সুলতান আমল।
সংস্কৃতের মাধ্যমে জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখার ব্যাপারে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের যে ঐতিহ্য সেটাই বঙ্গদেশে কায়েম করতে চেয়েছিল বৈদান্তিক আর্যীয় সমাজ, চেয়েছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার মাধ্যমে বিকেন্দ্রিক সমাজ-অর্থনীতির বিনির্মাণ এবং ক্ষমতার ব্রাহ্মণ্যবাদের পাওয়ার সেন্টার তৈরি করতে। চৈতন্য-নিত্যানন্দদের ভাবান্দোলন সেই অপচেষ্টাকে রুখে দিতে পেরেছিল। পৈতের পাশাপাশি সংস্কৃত পুঁথি জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। পালি-প্রাকৃত-মৈথিলী-ব্রজবুলি-সহ অবৈদিক ভাষাসমূহের মৌলিক উপাদানে কালো-বাদামি চামড়ার কৃষ্ণের বঙ্গে বাঙালি’ নামক মিশ্র জনগোষ্ঠির যে নিজস্ব ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ‘বাঙ্গালা’ ভাষাকে জনজীবনে নয়া-উদ্যোগে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন শ্রী চৈতন্য। বাউনদের বর্ণবাদী ইতিহাসনাম্নী গুজবচর্চায় আপ্রাণ প্রমাণ করার চেষ্টা হয়, হুসেইন শাহের সঙ্গে বুঝি দ্বন্দ্বে মেতেছিলেন নিমাই। একেবারেই ভুল। আসলে চৈতন্য তাত্ত্বিকভাবে এবং গণআন্দোলনের সংগঠক ও নেতৃত্বের জায়গা থেকে যে কাজটি করছিলেন সেই একইকাজ শাসনতান্ত্রিক জায়গা থেকে করতে চেয়েছিলেন সুলতান শাসকরা। কী সেই কাজ? সেটা হলো, বর্ণব্যবস্থা বা জাতপাত বৈষম্য নির্মুল ও বাংলা ভাষার প্রসার। সুলতানদের পৃষ্টপোষকতায় তখন বাংলা কাব্যের প্রসার ও অন্যান্য ভাষা থেকে বাংলায় তরজমা করার কাজ তুঙ্গে উঠেছিল। সেন আমলে ‘ছোটলোক’-এর ভাষা হিসেবে বাংলার গলা টিপে শ্বাসরোধ করে সংস্কৃত চাপানো হয়েছিল কিন্তু সুলতানি পর্বে হল ঠিক উল্টোটা, মানুষের মুখের ভাষাকে তার পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করা হল। চৈতন্য-নিত্যানন্দের দ্বারা বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে দ্রোহ এবং সংস্কৃত মাতব্বরির বিরুদ্ধে জেহাদে সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল হুসেইন শাহের। তাঁর কাজ ও কাজের লক্ষ্য পর্যালোচনা করলে খুব সহহজে যে কেউ-ই সেটা বুঝতে পারবেন।
বঙ্গ ও বাঙ্গালা ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেও বাউন-কায়েতপনার বাইরে কি বের হতে পেরেছে কলকাতা? তাদের মনের মধ্যে থেকে কি বর্ণব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটেছে? তা যে ঘটেনি, সেটা বুঝতে হলে কলকাতার বেশিরভাগ সুশীলদের সঙ্গে আলাপ করলেই পরিষ্কার টের পাওয়া যায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও এইটবি কফি হাউজ থেকে তাদের আজকের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার গণ্ডি সেই কলেজস্ট্রিট ও কলেজস্ট্রিটের আদি কফি হাউজেই সীমাবদ্ধ। এই গণ্ডির মধ্যে ঘোরাফেরা করেই তারা মনে করে জগত সংসারের সবকিছুই তারা বুঝে ফেলেছে। আসলে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও দেশীয় পরিসর সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন দুরূহ কাজ। সেটা না থাকলে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের ‘ব’টুকুও জানা যায় না। বাংলার স্থান নির্ণয়ও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। নিজের ঘরের খবর নাই তাই কলকাতায় পশ্চিমা জ্ঞানচর্চার বুলি আউড়ানো বর্ণবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের দাপট চরম হাস্যরস ছাড়া এখন আর অন্য কোন বিনোদন দানে এখন অক্ষম। কিছুদিন পরপরই আরবি-ফার্সি বা বিদেশি ভাষার বিরুদ্ধে সে ঝাণ্ডা ওড়ায়। বড় বাংলা হাসে!
এদের আবভাব এমনই যে বাংলা ভাষাটা বোধহয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, সংস্কৃত কলেজ আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সময় থেকেই বিকশিত। বাংলা ভাষাটা এদের কাছে ভারতীয় জাতিবাদের চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই ঔপনিবেশিক সময়কাল থেকে শুরু করে সমসাময়িক কালপর্বটা এবং কলকাতাকেন্দ্রিক ভাঙা বঙ্গটাই ইহাদের কাছে বাংলা ভাষার কালিক ও স্থানিক চেতনা । বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে যেকোনো আলাপে এরা তাই কলোনিয়াল কৃত্রিম ক্যালকেশিয়ান বাংলাটাকেই বাংলা বলে ধরতে চান। সাতচল্লিশে অখণ্ড বাংলা-দেশ ভাগ হয়েছিল, কিন্তু এই ভাষাকে খণ্ডিতভাবে দেখার ও আমলে নেওয়ার চেষ্টা ও অভ্যাস তো সেই ‘নবজাগরণ’-এর সময় থেকেই। সমসাময়িক কলকাতাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দেখুন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকেন্দ্রিক গবেষণাতে ‘সুবে বাংলা’ আলোচনায় আসছে না, বাংলাদেশের দুয়েকটা মুখস্থ নাম বাদে তেমন কেউই ঠাঁই পাচ্ছেন না। আর কী হচ্ছে?
সেক্যুলারিজমের নামে ‘ওয়ার অন টেরর’ প্রোজেক্টের লিগ্যাসি বহন করে বাংলা ভাষার শত্রু হিসেবে বারবার দাঁড় করানো হচ্ছে ‘আরবী’, ‘ফার্সি’-সহ সেমেটিক ভাষাগুলিকে। অত্থচ এই ভাষাগুলির উপাদান বাংলা ভাষাকে বৈচিত্র ও পূর্ণতা দিয়েছে। তাছাড়া গোটা বিশ্বের বাঙালিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির বিশ্বাস ও ঈমান ইসলামকেন্দ্রিক। খুব স্বাভাবিকভাবে ইসলামিক টেক্সটগুলি যে ভাষায় নাযেল ও নথিবদ্ধ হয়েছে, সেই ভাষাগুলো থেকে উপাদান ও অলঙ্কার বাংলায় সংযোজিত হয়েছে। এছাড়াও মনে রাখা দরকার বাংলা ভাষার জন্যে সবার আগে এবং সবচেয়ে রক্ত ঝরিয়েছে বাঙালি মুসলমান। বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি নমঃশূদ্র বাংলার নিম্নবর্গের মানুষের জবান, সংস্কৃতি, পরিচয়, আত্মসম্মান ও আত্মপরিচিতর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে একবার পাকিস্তান প্রস্তাবের সমর্থনে কথা বলে, তারপরেই তারা কিন্তু বেঙ্গল প্যাক্টের পক্ষেই কথা বলেছিলেন। সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম, কিরণশঙ্কর রায় ও শরত বোসরা চেয়েছিলেন ভারত-পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাক কিন্তু বাংলা নিজের সত্তা নিয়ে গঠিত হোক। না, ‘অখণ্ড’ বাংলা তাঁরা চান নি — অর্থাৎ আমরা যেমন ‘অখণ্ড’ ভারত বুঝি, কিন্তু আসলে তা বহু রাজ্যের ফেডারেল ব্যবস্থা। সেই ক্ষেত্রে ‘যুক্তবাংলা’ সম্ভাব্য মীমাংসা হতে পারত। বর্ণবাদী ও হিন্দু বাবুরা উত্তর ভারতের অধীনে ভারত-পাকিস্তানের সমান্তরালে যুক্ত-বাংলা তৈরি হোক বা রাষ্ট্র গঠিত হোক চায় নি। কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা-সহ যতেক বাবু বাঙালি বা বর্ণহিন্দু বাঙালি তারা তার বিরোধিতা করেছে। কিন্তু বাঙালি মুসলিম ও বাঙলি নমঃশূদ্ররা ছিলেন এই প্রস্তাবের পক্ষ। তারপরেও এই প্রস্তাব খারিজ হয়ে গেলে বাঙালি নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলিম একত্রিতভাবে পাকিস্তান আন্দোলনেরর পক্ষে চলে যায়। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যেও সচল থাকে বাংলার স্বাধিকারের স্ট্রাগল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রথমে ছয় দফা দাবির আন্দোলন ও পরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে সামনে রেখে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে পূবের বাঙালিরা।
এখন আমরা কি দেখছি? কলকাতার মেরুদণ্ডহীন বাবুদের বদৌলতে পশ্চিমবঙ্গ দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে মাড়োয়ারি-গুজরাতি পুঁজি আর হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি আধিপত্যবাদী রাজনীতির কাছে। যেভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে অসমের অন্তর্গত ঈশানবঙ্গ। একদিকে অহমিয়া জাতিবাদী অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদীদের সাঁড়াশি আক্রমণে পিষ্ট হয়ে এনআরসি’র ছোবলে সেখানকার লাখো বাঙালি ডিটেইনশন ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছে। অসমেও বাংলা ভাষার মধ্যে থেকে আরবি-ফার্সিকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়ার আওয়াজ উঠেছিল বাবু বাঙালিদের দ্বারা। যার জেরে সেখানকার বাঙালি মুসলিম আর বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে চিরতরে পয়দা হয়েছে অবিশ্বাস ও দূরত্ব। যার সুযোগে অহমিয়া জাতবাদীরা হিন্দি ঔপনিবেশিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালিয়ে আসছে ক্রমান্বয়ে। পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসির মাধ্যমে বাংলার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করতে মরিয়া মোদি-অমিত শাহ ও লুঠেরা আদানিরা।
তাহলে কি ধরে নেবো, এটার পথ সুগম করার জন্যেই শুভাপ্রসন্ন কালচারাল স্পেসে এমন একটি বর্ণবাদী কথা বললেন? ধরে নেবো কি? হয়তো তেমনটা হতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু এটা তো সত্যি এইটবি থেকে কলেজস্কোয়ার- গণ্ডিতে আটকে থাকা কলকাতার সঙ্কীর্ণ বাঙালিরা নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসচর্চার প্রায় কিছুই জানে না বলেই অন্ধকূপে পড়ে থেকে বারবার তাদের হীনমন্য বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে আনে।
তাই না?
অতনু সিংহ
কবি, গদ্যকার। ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। ১৯৮২ সালে জন্ম। বসবাস পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। প্রকাশিত পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ ও একটি ছোটগল্প সংকলন রয়েছে।