আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আকবর যুগের দক্ষিণ এশিয়া নির্ভর বিশ্বরাজনীতি

।। বিশ্বেন্দু নন্দ ।।

আধুনিককালে তাকালে যেমন দেখতে হয়, একবিংশ শতকে এশিয়াকে ইওরোপ আমেরিকার ‘আশির্বাদ’ প্রার্থনা করতে হচ্ছে, আকবরের আমলে ঠিক উল্টোটাই ঘটত, ইংলন্ড থেকে উজিয়ে এসে বেসরকারি ব্রিটিশ প্রতিনিধি আকবরের দরবারে সম্রাটের সঙ্গে প্রথম এলিজাবেথের বন্ধুত্ব চাইলেন। এই উদাহরণ থেকে আজ থেকে ৪০০ বছর আগে বিশ্বকেন্দ্র দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব আন্দাজ করা যায়।

আকবর যখন আকস্মিকভাবে ক্ষমতায় আসছেন, তখনকার বিশ্ব রাজনীতি বুঝতে যেমন সম্রাট জালালুদ্দিন আকবরের সময় বুঝতে হবে তেমনই সম্রাট আকবরকে বুঝতে সে যুগের বিশ্বরাজনীতিও বোঝা দরকার। বোঝা দরকার তখনকার বিশ্ব বলতে আমরা কী বুঝি। এইটুকু পড়েই  যারা অসীম অবজ্ঞায় ভ্রু কোঁচকাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলা যাক, আকবরের ক্ষমতা আরোহনের সময়ে এশিয়া ছিল বিশ্বকেন্দ্র, মুঘল আমল ছিল বিশ্বকেন্দ্র। উপনিবেশপূর্ব অর্থনীতি আলোচনায় এঙ্গাস ম্যাডিসন ‘কনটুর অব ওয়ার্ল্ড ইকনমি’ বইতে বলছেন আকবরের সময় দক্ষিণ এশিয়া ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতি, ১৫ কোটি মানুষের ভূখণ্ড। তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতি অর্থনীতি বুঝতে তাই বিশ্বকেন্দ্র, দক্ষিণ এশিয়ায় আকবরের সময় বোঝাত, বা চিন বোঝাত, কোনও মতেই বিশ্বলুঠেরা পশ্চিম  ইওরোপ বোঝাত না, পশ্চিম ইওরোপের আজকের কলোনি উত্তর আমেরিকাও বোঝাত না। বিশ্ব অর্থনীতি রাজনীতির চলনে এশিয়া, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাব ছিল অভূতপূর্ব। ভারতবর্ষ (চিন আর পারস্য) তখন বিশ্বের কারখানা— সে সব কারখানা নিয়ন্ত্রণ করে সেই দেশেরই জনমানুষ। আজকেও চিন দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের কারখানা, কিন্তু বাস্তবতা হল সেদিনের মতো এশিয় কারখানা, প্রযুক্তি, বাজার কোনওটারই নিয়ন্ত্রণ এই অঞ্চলের মানুষের হাতে নেই। কারখানা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে ইওরোপিয় কর্পোরেটজোট।  এশিয় কর্পোরেটেরা তাদের ফড়ে, পুঁজি খাটানোর যন্তর, শোকেসে সাজানো বিখ্যাত কর্পোরেট পুতুল।

মাথায় রাখতে হবে, আকবরের প্রয়াণের সময় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি থেকে যাত্রা শুরু করে মাত্র ১০০ বছরে, তাঁর উত্তরপ্রজন্ম আওরঙ্গজেবের প্রয়াণের সময়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতি হয়ে ওঠে মুঘল দক্ষিণ এশিয়া। সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিম ইওরোপিয়দের পক্ষে এশিয়দের নিয়ন্ত্রণে থাকা এশিয়, বলা ভাল দক্ষিণ এশিয় অর্থনীতি উপেক্ষা করা আত্মহত্যার সামিল ছিল। তাই আকবরের প্রয়াণের দশক থেকে আওরঙ্গজেবের ক্ষমতা আরোহনের দশক পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিজ উপসর্গে বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতিতে প্রান্তিক ইওরোপে অন্তত ৫টা কর্পোরেট সনদি কোম্পানি তৈরি হবে। এদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য শুধু এশিয়া বা দক্ষিণ এশিয়াও নয় ইস্ট ইন্ডিজ অঞ্চলে ব্যবসা করা। 

বালক শাহজাদা আকবর যে সময়ে বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে সিংহাসনে উঠছেন, বিশ্বরাজনীতি তখন এক অদ্ভুত মোড়ে দাঁড়িয়ে। সম্রাট আকবর ক্ষমতায় আসার ১০০ বছর আগে এশিয়ার সেরা বাণিজ্য আড়ং, শহর কন্সট্যান্টিনোপলের নিয়ন্ত্রণ ইওরোপিয়দের হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে এশিয় হাতে— যার প্রতিক্রিয়ায় এশিয়, এশিয় পণ্য কেনার কাজে, বিকল্প পথ, জলপথ খুঁজছে ইওরোপ। আকবর ক্ষমতায় আসার ৫০ বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ায় পা দিয়ে গোয়ায় গণহত্যা চাপিয়ে ছোট্ট একটা উপনিবেশ তৈরি করেছে পর্তুগিজ হার্মাদ, এস্তাও দা ইন্ডিয়া। আকবরের জীবনকালেই ইওরোপে তৈরি হবে একচেটিয়া সনদওয়ালা ডাচ আর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি; সিংহাসন আরোহনের ২০০ বছরের মাথায় তাদেরই সক্রিয়তায় ঘটবে পলাশী চক্রান্ত— টালমাটাল এই সময়কে উপনিবেশিক আমলা পরিবারের সন্তান উইলিয়াম ডালরিম্পল নাম দেবেন এনার্কি, মাৎস্যন্যায়ের যুগ। সেই উপনিবেশিক এনার্কিক কেওস ভিত্তি করে পলাশী উত্তর সময়ের লুঠ, খুন, গণহত্যাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সম্পদ লুঠে বিশ্ব ভাগ্যবিধাতা হয়ে উঠবে পশ্চিম ইওরোপের প্রান্তিক দেশ ইংলন্ড।

এই রকমই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, যখন বিশ্ব অর্থনীতি অক্ষদণ্ড ছিল দক্ষিণ এশিয়া, বিশ্বের গন্তব্যস্থল ছিল দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়ার ইস্ট ইন্ডিজ অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল, সেই ভূখণ্ডকে কীভাবে দিশা দেখাচ্ছেন সম্রাট আকবর, কীভাবে মুঘল রাষ্ট্র গঠনকর্ম দক্ষিণ এশিয় অর্থনীতি সবল করার জন্যে উদ্দিষ্ট হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করার জন্যে বইটির অবতারণা।

আকবর ক্ষমতায় আসার কয়েক হাজার বছর আগে ইওরোপিয় জনমানসের বেঁচে থাকা নির্ভর করত বিশ্বের কারখানা এশিয়ার তিনটে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতি চিন, দক্ষিণ এশিয়া আর পারস্যের কারিগর-চাষী-হকারদের উৎপাদিত পণ্য ইওরোপের দেশগুলোয় পৌঁছনোর উপর। ইওরোপের কোনও দেশই এশিয় বাজারে তার নিজস্ব উতপাদন বিক্রি করতে পারত না। এশিয়াজুড়ে ইওরোপিয় দেশগুলোর বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি ছিল খ্রিষ্টজন্মের আগের সময়ের রোমক অর্থনীতি থেকেই। যেহেতু এশিয়, আফ্রিকিয়, আমেরিকিয় দেশগুলোয় সে সব দেশের স্থানীয় অর্থনীতি থেকে উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারে না, তাকে সেই সব অর্থনীতিতে ব্যবসা করতে হয়েছে সোনা, রুপো আর দামি ধাতু মুদ্রা আর বড়লোকি পণ্যের বিনিময়ে। বিশ্ব লুঠে সে সব দামি ধাতু জোগাড় করতে হয়েছে। সেই মাথাব্যথার বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে ইওরোপ হাজার বছর ধরে চেষ্টা করেছে আফ্রিকা আমেরিকা আর এশিয়াকে পদানত করার।

আকবরের ক্ষমতায় আসার ১৮০০ বছর আগের আলেকজান্ডারের আধা ব্যর্থ এশিয়া দখল উদ্যম, ৪৫০ বছর আগে পোপ দ্বিতীয় আরবানের ডাকে এশিয়ায় উপনিবেশ তৈরির জন্যে চার শতাব্দ ব্যাপী ব্যর্থ ক্রুসেডের ফল এশিয়ায় সার্বিকভাবে উপনিবেশ চাপানোর ব্যর্থতা এবং ইওরোপিয়দের হাত থেকে কন্সট্যান্টিনোপলের নিয়ন্ত্রণ এশিয়দের হাতে যাওয়া। হাজার হাজার বছর ধরে এশিয় বাণিজ্য রাজপথ, যাকে পাঠকদল রেশমপথ বলতে অভ্যস্ত, বাহিত হয়ে চিন, পারস্য (আজকের ইরান) আর দক্ষিণ এশিয়া অর্থনীতিজাত পণ্যের মাত্র ১০ শতাংশ উৎপাদন পৌঁছাত পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সট্যান্টিনোপল শহরে। বসফরাস প্রণালী পেরিয়ে ইওরোপের ইতালির বণিক শহরগুলোর উদ্যমী আর ফ্রান্সের গণরাজ্যের বণিকেরা এই জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং ধনীদের ভোগ্য পণ্য জোগাড়ের জন্যে আসত বিশ্বের অন্যতম বড় আড়ং তুর্কির, সে সময়ের উসমানিয় সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সট্যান্টিনোপলে। ১০০০ শতাব্দেও কন্সট্যান্টিনোপল ছিল রোমক খ্রিষ্টদের নিয়ন্ত্রণে। ৪৫০ বছর পর ১৪৫৩য় উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ কন্সট্যান্টিনোপলের দখল নিলেন। ইওরোপিয় বণিকদের এশিয় পণ্য কেনায় বাধা পড়ল। তারা তখন থেকেই এশিয়ায় আসার সমুদ্র পথ খুঁজছে। মাথায় রাখতে হবে কন্সট্যান্টিনোপলের পতনের ৫০ বছরের মধ্যে ইওরোপিয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গোয়ায় পৌঁছেছে এবং তারা দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছে মুঘলদেরও দু’দশক আগে – কিন্তু তারা মুঘলদের মত দক্ষিণ এশিয় সমাজে মিশে যেতে পারে নি। পশ্চিম ইওরোপিয়রা নিজেদের হাতে লুঠ প্রশাসন চালিয়ে, আধুনিক বিশ্বে লুঠের কোলাবরেটর বসিয়ে দেশে ফিরে গেছে উপনিবেশকে তথাকথিত স্বাধীনতা দিয়ে। পর্তুগিজেরা গোয়ায় উপনিবেশ তৈরি করার অর্ধশতাব্দ পর আকবর যখন ক্ষমতায় আসছেন, সে সময় কন্সট্যান্টিনোপলের ক্ষমতা উসমানিয়দের হাতে। এই বইতে আমরা দেখব ইওরোপের সীমান্ত, উসমানিয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে মুঘলদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

আকবর যখন ক্ষমতায় আসছেন, ঠিক তার কয়েক বছর আগে লন্ডনে ১৫৫১তে তৈরি হচ্ছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পূর্বজ Mystery and Company of Merchant Adventurers for the Discovery of Regions, Dominions, Islands, and Places unknown। আজকের কর্পোরেট কোম্পানির কাঠামোর পূর্বসূরী কোম্পানির একচেটিয়া নমুনা কাঠামো তৈরি করছেন রিচার্ড চ্যানসেলর, সেবাস্টিয়ান ক্যাবট এবং হিউ উইলাউবি, উদ্দেশ্য কন্সট্যান্টিনোপল এড়িয়ে চিনে যাওয়ার রাস্তা খোঁজা। সে সময় চিন বিশ্বের সব থেকে বড় অর্থনীতি। এই কোম্পানিই ১৫৫৫তে নাম বদল হয়ে মস্কোভি কোম্পানি হিসেবে আবির্ভূত হবে। ১৫৫৮-এ শুরু হবে এলিজাবেথিয় যুগ। ব্রিটানিকার আকার মূর্ত হবে এই সময়। গোলাপ যুদ্ধের সময় পেরিয়ে ইংলন্ডের সাম্রাজ্যেচ্ছার সময়ের শুরুয়াত। ইতালি, ফ্রান্স নিজস্ব দ্বন্দ্বে দীর্ণ— অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। কিছুদিনের জন্যে ব্রিটিশ-ফরাসি যুদ্ধ মুলতুবি হল। ইওরোপে তখন ব্রিটেনের বড় শত্রু স্পেনের হ্যাপসবার্গ রাজত্ব।

আধুনিককা তাকালে যেমন দেখতে হয়, একবিংশ শতকে এশিয়াকে ইওরোপ আমেরিকার ‘আশির্বাদ’ প্রার্থনা করতে হচ্ছে, আকবরের আমলে ঠিক উল্টোটাই ঘটত, ইংলন্ড থেকে উজিয়ে এসে বেসরকারি ব্রিটিশ প্রতিনিধি আকবরের দরবারে সম্রাটের সঙ্গে প্রথম এলিজাবেথের বন্ধুত্ব চাইলেন। এই উদাহরণ থেকে আজ থেকে ৪০০ বছর আগে বিশ্বকেন্দ্র দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব আন্দাজ করা যায়। এই গল্প Charles Beem সম্পাদিত The Foreign Relations of Elizabeth I (Queenship and Power) বইতে নন্দিনী দাস লিখছেন Elizabeth And India শীর্ষক অধ্যায়। নন্দিনী বলছেন জন মিনডেনহল নামে এক ব্যবসায়ী মুসাফিরের কথা, যনি হেক্টর জাহাজে চেপে কন্সট্যান্টিনোপলে এসে রাণীর দেওয়া বাদ্যযন্ত্র অরগান ১৫৯৯তে উসমানিয় সুলতান তৃতীয় মহম্মদকে উপহার দিয়ে বাণিজ্য সড়ক পথে আলেপ্পো, ইরান হয়ে লাহোর থেকে ১৬০৩এ আগরা পৌঁছলেন। আকবরের দরবারে এসে বার্তা দিলেন রাণী সম্রাটের বন্ধুত্বের। মিনডেনহল লিখছেন—

The third day after, having made before a great man my friend, [Akbar] called me into his Councell: and comming into his presence, He demanded of me, what I would have, and what my businesse was. I made him answere, That his greatnesse and renowmed kindnesse unto Christians was so much blased through the World, that it was come into the furthermost parts of the Westerne Ocean, and arrived in the Court of our Queene of Englands most excellent Maiestie; who desired to have friendship with him, and as the Portugals and other Christians had trade with his Majestie, so her Subjects also might have the same, with the like favours; and farther, because there have beene long Warres betweene her Majestie and the King of Portugall, that if any of their ships or Portes were taken by our Nation, that he would not take it in evill part, but suffer us to enjoy them to the use of our Queenes Majestie.

এই ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব।

একই সঙ্গে মাথায় রাখবেন পাঠক, আকবর ক্ষমতায় আসার ২০০ বছর পরে ইওরোপ বিশ্বজুড়ে যে উপনিবেশ যুগ তৈরি করবে, সেই সম্ভাব্য উপনিবেশিক কাঠামো প্রথমে পশ্চিম ইওরোপের দেশে দেশে চাষী কারিগর হকারদের ওপর চাপিয়ে, বিদেশে তৈরি উপনিবেশে লুঠ, খুন অত্যাচার আর গণহত্যা কীভাবে চালাতে হয়, সে বিষয়ে হাত পাকাবে তারা। আকবর যখন ক্ষমতায় আসছেন, প্রথম এলিজাবেথও তখন ক্ষমতায় বসছেন। সে সময় কর্পোরেট কোম্পানি তৈরি করে ইংলন্ডের কৃষক, কারিগর, হকার, পশুচারকদের ক্রমশ বিছিন্ন করে ফেলার উদ্যম নেওয়া হল। পলাশীর ২৩ বছর পর, আমেরিকার দাস শ্রমের উদ্বৃত্ত আর বাংলার পলাশীর পরের লুঠ মিলিয়ে ইংলন্ডে নিজের দেশের উপনিবেশে একঘরে হওয়া হওয়া চাষী কারিগর হকার পশুচারকদের শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করবে ১৭৮০তে চালু হওয়া কাপড়ের মিলগুলোয় প্রায় বিনামূল্যের শ্রমিক হিসেবে দাস ব্যবসার ব্যবস্থাপনা কাঠামো নকল করে।

অথচ সেসময় মুঘল আমল কৃষকদের সঙ্গে কী ব্যবহার করত? সতীশ চন্দ্র, ‘মধ্যযুগের ভারত’, দ্বিতীয় খণ্ড, আকবরের আমলে রাষ্ট্র ও প্রশাসন অধ্যায়ে বলছেন, ‘বস্তুত কৃষির উন্নতি ও বিস্তার ঘটিয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করাই ছিল মুঘল প্রশাসনের প্রধান লক্ষ্য। আমরা আগে দেখেছি কীভাবে বঞ্জর বা পতিত জমিকে কৃষিকর আওতায় এলে তা থেকে প্রথম দিকে ছাড় দিয়ে চার বছর ছাড়া রাজস্ব আদায় করা হত। আইন অনুসারে, আমলগুজার বা রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের ‘পতিত জমিগুলিকে কৃষির আওতায় আনা ও কৃষিজ জমি যাতে কোনোভাবেই পতিত জমিতে পরিণত না হয় সে ব্যাপারে যত্নবান’ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এদেরকে আরও বলা হয়েছিল যে ‘কোনো গ্রামে যেন পতিত জমি পড়ে না থাকে আর যে কৃষক তার কৃষির সম্প্রসারণ করতে সক্ষম তাকে ভিন গ্রামে হলেও যেন পর্যাপ্ত জমির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।’ আমলগুজারদের এই নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল যে খরা বা পতিত জমিকে কৃষির আওতায় আনার ক্ষেত্রে কৃষকদের বীজ ও কৃষিজ অন্যান্য সরঞ্জাম ক্রয় করার জন্য পর্যাপ্ত ঋণ বা তাকাভি দেওয়ার ব্যবস্থা যেন করা হয়। এই ধরনের রাষ্ট্রীয় সহায়তা সেচের জন্য কূপ খনন ও মেরামতির ক্ষেত্রেও দেওয়ার কথা বলা হয়। মুখ্য শস্য বা অর্থকরী ফসলের চাষ বাড়ানোর জন্যেও নানা ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হয়েছিল’।

এখানেই শেষ নয়, সতীশ চন্দ্র বলছেন মুঘল আমল সময়ে সময়ে রাজস্বের দাবি কমিয়েও দিয়েছে, ‘এই ভাবে রাষ্ট্র কৃষির উন্নতিসাধন ও সম্প্রসারণ ঘটিয়ে নিজ রাজস্ব আয় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। এর একটা প্রভাব ফসলের বাজারদরের ওপরেও পড়েছিল। আকবর নামাতে বলা হয়েছিল যে আকবরের রাজত্বের ৪৩তম বর্ষে (১৫৯৮) সম্রাটের দীর্ঘদিন লাহোরে অধিষ্ঠান ও স্থানীয় বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলের রাজস্ব দাবি ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল আর সেখান থেকে তার চলে যাবার পরে মূল্যমান কমে গেলে রাজস্ব দাবিও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আকবরের শাসনের ৩০ ও ৩১তম বর্ষে (১৫৮৫, ১৫৮৬) যখন দারুণ ফলন হওয়ায় বাজারদর অনেকটাই কমে গিয়েছিল তখন দিল্লি, এলাহাবাদ ও অযোধ্যায় দাম কমার অনুপাতে রাজস্ব দাবিও কম করা হয়েছিল। খরার ফলে ক্ষতিপূরণ হিসাবে অনেক সময়ে কৃষি জমির একটা বিশেষ অংশকে ‘চাষ হয়নি’ (নাবুদ) বলে ঘোষণা করে তা থেকে রাজস্ব নির্ধারণে ছাড় দেওয়া হত’। সেই জন্যেই আমাদের আকবরের সময় বুঝতে হবে, বিশ্বরাজনীতি বুঝতে হবে।

আন্তর্জাতিকতার চরিত্র নিয়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণার আলোচনা সেরে নিই এই ফাঁকে। গত ২৬৬ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর চেপে বসা উপনিবেশের জগদ্দল পাথর সূত্রে আন্তর্জাতিক অর্থে প্রাক্তন কলোনির ইংরেজি শিক্ষিত প্রজারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বুঝত পশ্চিম ইওরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কর্মকাণ্ড এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম ইওরোপের সঙ্গে জুড়ল আমেরিকা, ইওরোপের চলতি উপনিবেশ, উত্তর আমেরিকার বিশাল ভূখণ্ড, যেখানে তারা প্রথম সেটলার কলোনি তৈরি করে লুঠ খুন অত্যাচারের মডেল তৈরি করবে। দক্ষিণ এশিয়ায় ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রবিত্তের জীবনে আন্তর্জাতিক শব্দের সঙ্গে অনপনেয়ভাবে জুড়ে ছিল উপনিবেশজাত ইওরোপমন্যতা।

মুঘল আমলের শুরুর সময়ে, বিশেষ করে আকবরের ৫০ বছরের রাজত্বকাল আলোচনায় বিশ্ব রাজনীতি বুঝতে গিয়ে, আমাদের, এই ইংরেজি শিক্ষিত ইওপরোপমন্য ভদ্রবিত্তকে বুঝতে হবে, উপনিবেশপূর্ব সময়ের বাস্তবতায় এশিয়া, শুধু এশিয়া বললে ভুল হবে, দক্ষিণ এশিয়ার সিন্ধু উপত্যকা থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছুঁয়ে দক্ষিণের নর্মদা গোদাবরী উপত্যকা উত্তরে হিমালয় দিয়ে ঘেরা অঞ্চল হয়ে উঠেছিল বিশ্বআকর্ষণকেন্দ্র, যে ভূখণ্ডের সঙ্গে গোদাবরীর নিচের এলাকা থেকে কেরল আর তামিলদেশজোড়া অঞ্চলজুড়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আন্দ্রে উইঙ্ক আল-হিন্দ আখ্যা দিচ্ছেন। আজও এই ভূখণ্ড তার অসীম উর্বরতা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে জনবহুল ভূমিক্ষেত্র – সেদিনও একই বাস্তবতা ছিল— গত ২৬৬ বছরে এই ভূমিখণ্ডে জুড়েছে পশ্চিম ইওরোপিয় কর্পোরেট জাতিরাষ্ট্রীয় ইওরোপিয় লুঠ প্রক্রিয়া— যে সম্পদে ইওরোপ আজ স্বচ্ছল, সেই স্বচ্ছলতা তখন দক্ষিণ এশিয়ার আমাদের সকলের ছিল – ছিল না শুধু অপচয়ী ইওরোপিয় জীবনযাত্রার মানের মত অবশ্য অনুসরণকারী লুঠেরা শব্দবন্ধজাত জীবনযাত্রা।

আকবরের সময় ছাড়িয়ে, আওরঙ্গজেবের প্রয়াণের পর দক্ষিণ এশিয়ায় মুঘল সাম্রাজ্যের সেই দবদবা না থাকলেও, মুঘল পরবর্তী সময় এবং উপনিবেশের আগের সময়ের মধ্যেকার যুগে এই অঞ্চলে গড়ে উঠবে আরও অর্থনৈতিকভাবে সবল, সক্রিয় ছোট ছোট রাষ্ট্র বাংলা, হায়দারাবাদ, পাঞ্জাব, অবধ আরও অনেক বর্ধিষ্ণু জনপদ – যার মুখড়া তৈরি করে দিয়ে যান সম্রাট আকবর। আকবরের প্রয়াণের পরে আরও ১৫০ বছর, তার অসীম উৎপাদকতা নিয়ে এই আল-হিন্দ অঞ্চল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গন্তব্যস্থল হিসেবে গণ্য হবে কারন এশিয়ার সব থেকে বেশি রাজস্ব আদায় হত এই অঞ্চলেই। সব থেকে বেশি জীববৈচিত্রের অঞ্চল এই ভূমিখণ্ড। সব থেকে বড় অর্থনীতি অভাগা বাংলারই।   তাই আমরা এই বইতে আকবরের আমলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বলতে ইওরোপ বুঝব না, ইওরোপিয় জীবনযাত্রা বুঝব না, ইওরোপিয় অর্থনীতি বুঝব না, অবশ্য অনুসারী ইওরোপিয় কৃষ্টিও বুঝব না। সে সময় আলোচনায় আমরা বিশ্বকেন্দ্র বলতে বুঝব চিন থেকে উসমানিয় সাম্রাজ্যপর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড। আশাকরি পাঠকের নিশ্চই মনে হবে না, আকবরের সময় কেন আমরা বিশ্বব্যবস্থা আলোচনায় লন্ডন, প্যারিস, আমস্টারডাম, লিসবনের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করলাম না। আজ যেমন ইওরোপ মহা উন্নাসিকতায় বিশ্ব রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, কৃষ্টি আলোচনায় দক্ষিণ এশিয়াকে স্বচ্ছন্দে নজর আন্দাজ করে যায়, ঠিক সেদিনের আকবরের সময় বোঝার আলোচনায় আমরা পশ্চিম ইওরোপকে ধর্তব্যের মধ্যে আনব না।

বিশ্বেন্দু নন্দ
বিশ্বেন্দু নন্দ

লেখক, গবেষক, সংগঠক, প্রকাশক। উপনিবেশপূর্ব সময়ের সমাজ অর্থনীতিতে  কারিগরদের ইতিহাসের খোঁজে সর্বক্ষণের কর্মী। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন বিক্রেতাদের বিষয়ে লিখেছেন নিরন্তর। বাংলার উপনিবেশপূর্ব সময়ের পরম্পরার চাষী-হকার-কারিগর-ব্যবস্থা বিষয়ে খোঁজ করছেন। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। ‘পরম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব, ম্যান এন্ড দ্য মিথ, স্বেন বেকার্ট এম্পায়ার অব কটন, যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেসন, আহকমই আলমগিরি অনুবাদ করেছেন। পলাশীপূর্বের বাংলার ৫০ বছর, পলাশীপূর্বের বাংলার বাণিজ্য দুটি মৌলিক পুস্তকের রচয়িতা। 

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top