।। পায়েল দেব ।।
ওঠো ওঠো তটরেখা, বৃদ্ধ ঘনশ্যাম
সাজসজ্জা, মোহন বাঁশি, যত পুরাতন
ফুঁ দিতে দিতে
তুমি পার হও আমারে, আমিও তোমারে
যেন বৃন্দাবন
আমাদের রাখালনৃত্য, তিলতত্ত্ব
মনে নেই, থাকবেও না
এভাবেই আমাদের সুর পারাবার
যেন যমুনার জল
প্রভাত পরিক্রমা
১
যে জলে একসাথে ঘর করে শাপলা আর শামুক
অসহায়, একদিন নামতে হবে
দল বেঁধে, আমাদের বেঁধে নিয়ে
সেখানে জলসা শেষে
কুয়াশার গ্রাম হাতে করে দাঁড়ায় এক উন্মাদ নারী
হাজার হাজার হাত
হাতে হাতে বাহারি গ্রাম– গায়ে আত্মহত্যার দাগ
বেগুনি রঙের দড়ি, বাদামি কাচের শিশি, ময়লা চিঠি, ছেঁড়া নোটখাতা, এলজোলাম ১.৫
তখন রাত দুটো
খুব ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমাকে
২
একজন বিরহী কথা বলে
পুনরায় বলা হয় না কিছুই
অনেকদিন স্নান করলে
যেকরে সরে যায় কচুরিপানার দল
আমাদেরও সরে যেতে হয়
তারাদের নিচে, যেখানে ছড়িয়ে থাকে শিউলি
আর ক্রন্দনরত পদ্মের বিলাপ
পাশ ফিরি
এক বুদ্ধসন্তান কী করে এল ঘরে
কুয়াশার জানালা-কাচ
আঙুল দিয়ে উপরের লাইনগুলো লিখে রেখে গেছে কেউ
কোণঠাসা করে এঁকেছে, বলো বলো…
পুনরায় বলা হয় না কিছুই
বোবা
মনখারাপ, কেউ ডেকে নিয়ে গিয়ে ভুলে গেছে
বসিয়ে গেছিলো ফুল আনতে যাচ্ছে বলে
দাঁড়িয়ে রাস্তায়
এমন রাস্তা জীবনে মাঝেমাঝে আসে
আসা ভালো
ভালোবাসা ভালো
মনখারাপ,মৃতদেহের
যত সাপ আছে, শাপিত, জন্মমাস শ্রাবণ বলে
তাদের আহ্লাদী আমি নই
সপ্তডিঙা ভাসে, ভাসে আমার লখিন্দর
জলে নয়, বাতাসে, শ্বাসে
নগ্ন গাছেদের দেখো
লাজ নাই, পাতা খুলে ফেলে যখনতখন
যে পাহাড়ে জুম হয়, প্রায় ছ’মাস পুড়ে মাটির অন্তর
নিলাম হয় কালো ছাই বসতির উঠোনে
আমি তার গানও শুনি,শুনি রাতভর
পাহারা ছাড়িয়ে যতদূর পৌঁছয় লোকালয়ে
শতক শতক আগে কলেরার কবল ছিল
কেউ তা বিশ্বাস করে না, মনে রাখা মানুষগুলো মরে গেছে কবেই
তাদের দাওয়াও গিয়ে বসি, মৃত্যু শিখি, শিখি পদাবলী, হরিনাম সংকীর্তন
চুপ থাকি, শব্দ শুনতে হলে চুপ থাকতে হয়
কথা বলো না, আমাদের আর কোনও কথা বাকি নেই
শব্দ ছাড়া
কীর্তন
এক শ্রীময়ী, যতবার জপ করে, যতবার যায় যমুনায়
সর্বনাশ, অধরা, অমৃতা
শত শত সারস, সুহাসিনী জল ফেলে উড়ে যায়
কবে ছিল প্রেম, তার ঠিক নেই, কদম্ব নামটুকু
লতিকার মতো শেকড়, দাঁড়াবে দুজনে, একহাতে কষ্ট
আরেকহাতে বাদ্য, বিছিয়ে আসন
শেষবার গাইবে রাধানাম, হরে হরে,
ওঠো ওঠো তটরেখা, বৃদ্ধ ঘনশ্যাম
সাজসজ্জা, মোহন বাঁশি, যত পুরাতন
ফুঁ দিতে দিতে
তুমি পার হও আমারে, আমিও তোমারে
যেন বৃন্দাবন
আমাদের রাখালনৃত্য, তিলতত্ত্ব
মনে নেই, থাকবেও না
এভাবেই আমাদের সুর পারাবার
যেন যমুনার জল
কথা
এক নিরন্ন বাতাসের দিকে গেছে ঘর
ধ্বনিময় সরস্বতী
পুতুল মাস, ঝরে পড়ে অজস্র বকুল
অজানা বসন্তে লাগে দাগ বিষাদী কৃষ্ণচূড়ার
অসহায় আমাদের উদর, ধরে থাকা বিধিমালা
একজোড়া গেজেট, প্রকাশিত কোনও রোববার
তবু নিরন্ন বাতাসের দিকেই যায়
পশমিনা কাজ, উনুনের আঁচ
জানালার জাদু কাছে
দিনে দিনে পাল্টে ফেলে রঙ, যত যাতায়াত
নূপুরের শব লেগে থাকে
দরজায়
নিরন্ন বাতাসের দিকে তাকিয়ে ভাবুন যারা নিজেদের গ্রন্থের অনুবাদ নিজেরাই করে
তাদের সুখ ও অসুখের হিসেব মিলাতে গিয়ে যারা আত্মঘাতী হয়েছে
তাদের সংসার থেকে বেরিয়ে কেউ কোনওদিন কবিতা লেখার সাহস পাবে?
তবু নিরন্ন বাতাসের দিকেই যায় ঘর, স্মৃতি, ছোটো ছোটো শহরের নৌকো, ঘাট, আর বুনিয়াদ
সত্য
এক অদ্ভুত বিরহে তোমারে স্থাপন করব ভাবছি
অথবা তোমাতে স্থাপন করব এক অদ্ভুত বিরহ
বিরহ কৃষ্ণ হবে, তুমি ভাঙা বাঁশরী
আমি তব পরিধান, মনোরম ফুৎকার
এর থেকে যেথা আছে বড় নির্বাণ, যাব না
বিপ্রতীপ
আমাদের সুখের উপর বন্যদের নজর পড়ল
লোভ, ভয়ানক লোভ
সিংহ এল, রাজা, খেয়ে বাকিটা ফেলে চলে গেল
বাঘিনী এল, খেল
একে একে আরও অনেকেই
শেয়াল, বনবেড়াল, যারা যারা সুখ চায় সবাই
ফুরিয়ে গেল সব
শেষে এল দুই অভাগা, নেউল আর সাপ
পেলো না কিছুই
রাগে অপমানে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিলোঅভিশাপ
সেই থেকে তুমি সাপ আমি নেউল
পায়েল দেব
ত্রিপুরার কবি। জন্ম-১৯৮৭ সালের ২৭ শে জুলাই। পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও শিক্ষাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশা- ত্রিপুরা সরকারের অধীনে বিজ্ঞান শিক্ষিকা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ – কুয়াশার সানস্ক্রিন (২০১৭)। অন্য কাব্যগ্রন্থগুলো হল – গাছের গোপন অসুখ( ২০১৯), স্কেচবুক( একফর্মা, ২০১৯), নিমফুল(২০২০), জমান্ধ পংক্তিমালা (একফর্মা,২০২১),সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘শূইন্য দেহের বাউল’।