
।। অনুবাদ শামসুর রাহমান অমিতাভ দাশগুপ্ত ও প্রতুল মুখোপাধ্যায় ।।
মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে এশিয় ও চৈনিক প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক করে তুলে তা চিনের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন বলে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চিন বিপ্লব কার্যকরী হয়েছিল৷ চিনের বাস্তবতায় মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ফলিত রূপকে মাও কার্যকরী করে তুলতে চিনা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, উপকথা ও কাব্যের দ্বারস্থও হয়েছিলেন৷ চিনা পারম্পরিক সংস্কৃতির বিনির্মাণ ও বৈপ্লবিক নবনির্মাণ ছিল তাঁর অন্যতম অবদান৷ যা বিশ্বের বিপ্লবী কমিউনিস্ট ধারার রাজনীতির তত্ত্বায়নের প্রেরণাও বটে৷ মাওয়ের রেড বুক যার নিশানা হাজির রেখেছে আমাদের কাছে৷ এসবই সম্ভব হয়েছে মাওয়ের বিপ্লবীসত্তার পাশাপাশি কবি সত্তার জন্যে৷ দুনিয়ায় যেকজন কমিউনিস্ট বিপ্লবীর কবিতা কাব্যের নিরিখে নান্দনিক শর্তপূরণ করেছিল, মাও তাঁদের মধ্যে অন্যতম৷ তাই বড় বাংলার বেশ কিছু কবিকে আকৃষ্ট করেছিল বিপ্লবী চেয়ারম্যান কমরেড মাও সে তুংয়ের কবিতা৷ শামসুর রাহমান ও অমিতাভ দাশগুপ্ত তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ মাওয়ের বেশ কিছু কবিতা গত শতকের পঞ্চাশের দশকের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের এই দুই কবি অনুবাদ করেছিলেন৷ মাওয়ের জন্মদিনে সেগুলির বেশ কয়েকটি পাঠকের দরবারে হাজির করা হল৷ পাশাপাশি সঙ্গীতশিল্পী ও গীতিকার প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটি তর্জমাও রাখা হল বাকি কবিতাগুলির সঙ্গে৷

শামসুর রাহমান অনূদিত কবিতা
পরির গুহা
গোধূলির গাঢ় দীর্ঘ ছায়ায়
দাঁড়ানো কী দৃঢ় পাইনের শ্রেণি।
বর্ণিল মেঘ উড়ে যায় দূরে, প্রশান্ত, দ্রুত।
অপরূপ রূপে প্রকৃতি নিজেকে
ছাড়িয়ে গিয়েছে পরির গুহায়।
বিপজ্জনক পাহাড় চূড়ায় সুন্দরীতমা
অনন্ত তার বৈচিত্র্যে করে বসবাস।
কমরেড কুও মোজোকে জবাব
চরাচরে ফেটে পড়ল দুরন্ত বৃষ্টি ঝড়,
তাই শাদা হাড়ের স্তূপ থেকে উঠে এল এক শয়তান।
বিভ্রান্ত সন্ন্যাসী ছিলেন না আলোর পরপারে,
কিন্তু বিদ্বেষপরায়ণ অপদেবরা ধ্বংসলীলায় মেতে উঠবেই।
সোনালি বানর দারুণ রোষে
ঘোরালো তার অতিশয় ভারী লাঠি
আর ফিরোজা পাথরের মতো আকাশ থেকে মুছে গেল ধুলো।
আজ, যখন আবার দূষিত কুয়াশা উঠে আসছে,
আমরা অভিবাদন জানাই সেই বিস্ময়কর্মা সুউচ্চ কুংকে।
লিউপান পাহাড়ে
আকাশ অনেক উঁচু, মেঘমালা কেমন বিবর্ণ,
আমরা দেখছি বুনো রাজহংসীগুলি হচ্ছে অদৃশ্য দক্ষিণে।
যদি ব্যর্থ হই ওই মহাপ্রাচীরে
পৌঁছাতে তাহলে আমরা পুরুষ নামের যোগ্য নই,
আমরা যারা ইতিমধ্যে শত শত মাইল করেছি অতিক্রম।
লিউপান পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়ায়
লাল পতাকারা
পশ্চিমা হাওয়ায় তরঙ্গিত, কী স্বাধীন।
আমরা ধরেছি হাত আছে দীর্ঘ দড়ি
আমরা কখন কক্ষে বাঁধব ধূসর ড্রাগনকে?
শাওশানে ফেরা
মনে পড়ে যাওয়া কোনো আবছা স্বপ্নের মতো
অনেক আগেকার পলাতক অতীতকে আমি অভিশাপ দিই—
আমার দেশের মাটি, কেটে গেছে বত্রিশটি বছর।
যখন স্বেচ্ছাচারী শাসকের কালো নখগুলি
ওপরে তুলে ধরছিল ওর চাবুক,
লাল পতাকা জাগ্রত করেছিল ভূমিদাসকে, হাতে যার টাঙ্গি,
তিক্ত বলিদান দৃঢ় অঙ্গীকারকে করে শক্তিশালী,
যা নতুন আকাশে চাঁদ আর সূর্যকে জ্বালিয়ে রাখার সাহস জোগায়
কী সুখী! আমি দেখছি ধান আর মটরশুঁটির তরঙ্গিত খেত,
আর দেখছি চতুর্দিকে সন্ধ্যার কুয়াশায় বীরদের ঘরে ফেরা।
অমিতাভ দাশগুপ্ত অনূদিত কবিতা
তোমাকে
পুরোপুরি পাওয়ার জন্যই
কয়েকটা বছর ভুলে থাকতে চাই তোমাকে।
এই ঝোরো দিনগুলিতে
আমরা কিছু পাহাড়ের মাথা গুঁড়িয়ে দেব,
নিকেশ করব নেকড়ে-সমেত জঙ্গল,
কাঁটা ঝোপ নিড়িয়ে শুরু করব ফুলের আবাদ,
সালতির পর সালতি সাজিয়ে
নদীর ওপর গড়ব সেতুবন্ধ,
যার উপর দিয়ে দুনিয়ার সমস্ত ভালোবাসা
একদিন তোমার কাছে পৌঁছে যেতে পারে।
নারী বাহিনী
কুচকাওয়াজের মাঠে প্রথম সূর্যের আলোয়
পাঁচফুট-রাইফেল কাঁধে
কি উজ্জ্বল আর সাহসী দেখাচ্ছে তাদের।
রোখা মেজাজে ভরপুর চীনের মেয়েরা
তারা হাতিয়ারগুলির প্রেমিকা,
সিল্ক আর শাটিনের নয়।
হুঁশিয়ার
এই সময় কোনো কথা বলতে নেই।
এই সময় কারো ডাকে সাড়া দিতে নেই।
তাহলেই তোমার ভাইবেরাদরদের ভেতর থেকে
তোমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে সেই কালো হাত
যা মানুষজনকে গুনতি করতে চায়
একটার পর একটা মাথার খুলি দিয়ে।
গান
এভাবে কি গাইতে আছে,
তাও এমন সময়।
আমাকে দুর্বল করে দিও না, গান,
আমার শুকনো চোখ থেকে নিঙড়ে নিও না অশ্রু,
তাহলে পাথুড়ে পথ এত পিছল হয়ে যাবে যে
আমরা এককাট্টা পাড়ি দিতে পারব না কুয়াংচু-র দিকে,
দোহাই, চুপ করো,
গান গাইবারও তো
একটা সময়-অসময় আছে।
সন্ধ্যা
পাইনের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল
শেষ সূর্যের আলো।
আমরা পাহাড়ের বুকে কাঠকুটো গাদা করে
জ্বালছি আগুন।
টিনে বন্দী জমাট মাংসের সুরুয়াগুলো
একটু একটু করে গলে যাচ্ছে।
কাঁধ থেকে রাইফেল নামিয়ে
ছড়িয়ে বসেছি আমরা।
এই সময় শুধু এটুকু সময়
আচমকা তোমার মুখ মনে পড়ে যাওয়াটা
কি খুব একটা অন্যায় হয়ে যাবে?
সঙ্গত
সাগরের গানে সঙ্গত করে নদী ।
পাহাড়ের গানে আলো।
কোনটা মন্দ, কোনটা সঠিক, ভালো
জানি না, জানি না, জানি না-
মানুষের চেয়ে বিশাল কিছুকে
আমরা কখনো মানি না।
নিহত কমরেডের জন্য
চোখের পাতাজোড়া বন্ধ করে
অশ্রুকে শাসন করতে চাইছিলাম।
সে আমাদের বারণ মানেনি।
এখন সামনে শুয়ে আছে কমরেড লিং-এর লাশ।
বেশ কয়েকটি দুশমনের বুকে বুলেট বিঁধে যাওয়ার আগে
কিছুতেই মরতে চায়নি সে।
তার শরীরের ওপর ঝরে পড়ছিল
তাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ানো আমাদের চোখের জল।
‘সাড়ে তিন হাত জমির উপরে আমাকে শুয়েই দাও
আর এগিয়ে যাও তোমরা
থেমে গেলেই জঙ্গলের ফাঁক-ফোকর থেকে
লাফিয়ে নামবে মৃত্যু’-
বারবার বুঝি এ কথাই বলতে চাইছিল
আমাদের নিহত কমরেডের ঠোঁট।
মূক বিউগলের শোকগীতি বাজাতে বাজাতে
আমরা একবারও পিছন না ফিরে সারারাত
সামনের গিরিখাতের দিকে এগিয়ে যাবো।
ততক্ষণ রাশ রাশ জোনাকির ফুলে
কমরেড লিং-এর শরীর আলো হয়ে থা
প্রতুল মুখোপাধ্যায় অনূদিত কবিতা
টাপোটি
লাল সাদা আর হলদে সবুজ আসমানি নীল-বেগুনী
সাত রঙা আঁচল উড়িয়ে আকাশে
নাচেরে কোন নাচনী, আহা!
একদিন ভীষণ লড়াই হয়েছিল এই গাঁয়ে
গুলির দাগে বীরের গাথা লেখা
দেওয়ালেরই গায়ে গায়ে
দেওয়ালের সেই ক্ষত,
যেন লাগছে ফুলের মতো
সে আকাশ পাহাড়ি পথে আঁকা
শোভা দ্বিগুণ বাড়ে তখনই,
লাল সাদা আর হলদে সবুজ আসমানি নীল-বেগুনী

