আজ বৃহস্পতিবার, ১০ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বিশমাত্রার ভূমিকম্প


ওর নাম আরিফ। আমার ক্লাসমেট। স্টুডেন্ট লাইফে দেখেছি, কারো সাতেও ছিল না পাঁচেও না। এমনই সাধারণ। নব্বইয়ের উত্তাল মুহূর্তে আমরা যখন হল থেকে বেরিয়ে স্বৈরাচারের গদি থেকে একটি একটি করে ইট খসে নিতাম, ও তখন পড়ার টেবিলে খুব নিমগ্ন আর একের পর এক রেজাল্ট করে তাক লাগিয়ে দিত।
আজ সে সচিব। আর আমি যে , তা এখনও স্পষ্ট করে বলতে পারি না। এ-পত্রিকা থেকে ও-পত্রিকা তাঁতের চাকার মতো ঘুরতে ঘুরতে কোনোরকম টিকে আছি। এরইমধ্যে টুকটাক লেখালেখি করি। তবে ডরে-ভয়ে সব লেখা প্রকাশও করি না। যেসব লেখাকে বিপজ্জনক মনে হয়, সেগুলো রেখে দিই সময়ের জন্যে। অবস্থা গুণে যদিও বুঝতে পারছি, সে সময়, ‘দিল্লি বহুদূর’।

২.
আরিফ বিসিএস করে প্রশাসনিক পোস্টে ঢুকে যাওয়ার পর আর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। এমনকী ফোন-টোনেও না। বলতে গেলে ভুলেই গিয়েছিলাম। হয়তো আরিফও ভুলে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল একদিন আমরা একরুমে দীর্ঘ পাঁচ বছর ছিলাম। আর্থিক টানাপড়েনে একে অপরকে ধার দিতাম। বান্ধবীর সাথে দেখা করার সময় একে অপরকে শার্ট-পাঞ্জাবি ধার দেওয়াদেওয়ি করতাম। বিরহের কাসুন্দি একে অপরকে শুনিয়ে আত্মাকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করতাম।
আমি নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে, হয়তো এই ভুলে যাওয়ার মধ্যে ওর কোনো দোষও নেই। যদ্দূর শুনেছি প্রশাসনিক পোস্টে যারা ঢোকে, তাদেরকে নাকি ট্রেনিং দিয়ে অন্যরকম করে নেওয়া হয়। তাদের চোখ-মুখ-ভাষা নাকি আর আমাদের মতো থাকে না। আমাদের আচার-সংস্কৃতিও তাদের কাছে ঘেঁষতে পারে না। বোধহয় এসবের কারণেই দূরে সরে গিয়েছিল। তবে এ ক্ষেত্রে আমিও কম দায়ী নই। সারাজীবন শুনে এসেছি, ক্লাসমেট বন্ধুত্বের মাঝখানে কোনো পর্দা থাকে না, এটা ভুলে গেলাম কেন? ইচ্ছে করলে তো নিজ থেকেও একবার দেখা করতে পারতাম। তখন যদি তার আচরণের মধ্যে তেমন কিছু একটা পরিলক্ষিত হতো, তখন না হয় ফিরে আসতাম। যাকে এধরনের কোনো পরীক্ষাতেই ফেলিনি, তাকে এখন দোষারোপ করি কী করে?

.
একদিন হঠাৎ আরিফই ফোন দিয়ে বসল। যদিও ফোনের এপার থেকে দেখার সুযোগ নেই, তবে শব্দচয়ন এবং কণ্ঠের টোন ধরেই বুঝতে পারলাম, তার মধ্যে আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। আমিও এতদিন খোঁজ না নেওয়ার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলাম। পরে এল আসল কথায়। বলল, সেও নাকি কীসব লিখেছে, বই প্রকাশ করবে। তার আগে আমাকে একবার দেখিয়ে নিতে চায়। মনে মনে বললাম, এই সারছে। তার মানে আরও একজন আমলা লেখক বাড়ল। আমি সাধারণত আমলাদের সাহিত্য পড়ি না।  তাদের লেখার মধ্যে শিল্প চেয়ে ডুগডুগির আওয়াজ বেশি। বইয়ের প্রচ্ছদ-শিরোনাম দেখলেই গা ঘিন ঘিন করে। তাই বলে সবাই ফালতু, তাও নয়। দুএককে তো খুব কাছ থেকেই জানি, আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক ভালো লেখে।  কিন্তু তাদের হয় আরেক সমস্যা। সেই ভালো লেখাটা  ঢাকা পড়ে যায় পদের জৌলুশের ছায়ায়। সমালোচকরা সমালোচনা করতে গিয়ে তেল মশলা বেহিসাবি ঢেলে ফেলে। ফলে মূল আনাজের গুণাগুণ অনেকাংশেই হারিয়ে যায়। এইসব ফালতু বাড়াবাড়ি সহ্য হয় না বলে বরাবরই আমলা, ক্ষমতা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকার করেছি। এখন মনে হচ্ছে আর উপায় নেই

৪.
আরিফের পাণ্ডুলিপিটা আজই শেষ করলাম। মনে হচ্ছে, ডিটেকটিভ সদস্যদের মতো আরিফও একটা অদৃশ্য চোখ অর্জন করেছে, এবং সে ইতোমধ্যে সমাজের উপর-নীচের অনেককিছুই দেখে ফেলেছে। যদিও হাতে গোনা বিরল প্রজাতির কজন বাদে দেশি বলি আর বিদেশিই বলি বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র বলে কোনোকালেই কিছু ছিলো না। এজন্যে তাঁরা দেশ-বিদেশে খিস্তিখেউড়ও কম শুনেনি। বিদেশে তো পুরো বুদ্ধিজীবী সমাজটাকেই ট্রলের চোখে দেখে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যারা ট্রল করেছে তারাও বুদ্ধিজীবী। ফরাসি লেখক রমা রলাঁ বুদ্ধিজীবীদেরকে ‘সরকারের শিকলবাঁধা কুকুর’ বলে অভিহিত করেছেন। নাৎসিরা বুদ্ধিজীবীদের বলতো, ‘মেধাবিপশু’। আমাদের দেশেও কোনো বুদ্ধিজীবীকে যখনই কোনো নাটক-সিনামার চরিত্র করা হয়েছে, তাদের চরিত্র বলতে কিছু রাখেনি। এমনকী গল্প-উপন্যাসেও। হুমায়ুন আজাদের ‘কবি ও দণ্ডিত পুরুষ’। সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’। আহমদ ছফার ‘গাভী বৃত্তান্ত’ কিংবা ‘অর্ধেক মানবী অর্ধেক ঈশ্বরী’। তসলিমা নাসরিনের ‘ক’। এসব পড়ার পরও বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এতটুকু টলেনি।  আমরা ধরে নিয়েছি, এসবই বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্প। ফলে ওগুলোকে শিল্পের চরিত্র ধরেই সবকিছু সামলে নিই।
কিন্তু আরিফের লেখাগুলো কোনো শিল্প নয়। তার সব লেখা নাতিদীর্ঘ মুক্তগদ্য। প্রতিটা গদ্য অন্ধকারাচ্ছন্ন মঞ্চে উপর থেকে টর্চ মারার মতো। এর একটাও যদি কোথাও ছাপা হয় কিংবা প্রকাশ পায়, দেশ জুড়ে বিশ মাত্রার ভূমিকম্প বয়ে যাবে।
সব টাচ করার দরকার নেই। কেবল একটা ইঙ্গিত দিই। তার একটা গদ্যে আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় স্যার, যিনি বাগ্মিতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী, আবার বয়সও আশির কোটায়।তাঁর মতো ব্যক্তিকে বলতে দেখা যায়, “আরিফ, বাবা এই বয়সে  এসে বেঁচে থাকতে হলে শুধু সুরা দিয়ে হয় না, একজন সাকিও লাগে যে।” বাক্যটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কেজের ‘আমার কতিপয় দুঃখীনী মেয়েরা’ উপন্যাসের বুড়ো সাংবাদিকের চেহারাটা মনে ভেসে ওঠে। যার আশিতম জন্মদিনে মনে খায়েশ জাগে একদম অল্প বয়স্কা কুমারীর সঙ্গে রাত কাটানো। এবং সে তার চাহিদা মতো পেয়েও যায়। সমস্যা হলো সেদিন তার মন জাগলেও দেহ জাগেনি। অনেকদিন চেষ্টা করেও দেহটাকে এক লহমার জন্য জাগাতে পারেনি। আরিফ লিখেছে আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার নাকি অনেক চেষ্টা করেছেন। শেষে না পেরে মেয়েটাকে খামচে-কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে।


বললাম, এসব লেখা কখনোই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাহলে শ্রদ্ধা-ভক্তি বলতে যে একটা কিছু আছে তা দেশ-সমাজ থেকে হারিয়ে যাবে। সে-সঙ্গে তোরও বিপদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠবে। বিশেষ করে চাকরিটা…।
ওপাশ থেকে ফোনে সে বলে, যা ইচ্ছে হোক। তুমি ওটা প্রকাশের ব্যবস্থা করে দাও।
মাথা খারাপ নাকি? চাকরির এই পর্যায়ে এসে কেউ এমন ঝুঁকি নেয়? কেউ না নিক। আমি নেব। মানুষকে বুঝতে দিতে হবে, এসব পদে লাত্থি মারার হিম্মত বাঙালি সন্তানের হয়েছে।


বুঝলাম, আমার দ্বারা হবে না। ওর স্ত্রীকে ফোন দিতে হবে। সংসার জীবনে ওটাও একটা পক্ষ। পাগলা ঘোড়াকে লাইনে রাখার মতো অনেক কায়দাকানুনও তাদের রপ্ত। নাম্বার যোগাড় করে ওর বউকে ফোন দিলাম। কিন্তু ফল হলো উল্টো। তার বউ আরও ডিটারমাইন্ড। তার মানে কিছু একটা এখান থেকেই শুরু। লোকমুখে বহুত শুনেছি, প্রমোশনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকতার মন যোগাতে নিম্নপদস্থকে অনেককিছুই করতে হয়। আমি আর উপায় পেলাম না। পাণ্ডুলিপিটার বানান ইত্যাদি দেখে ফিরিয়ে দিলাম এবং সে-সঙ্গে একজন প্রকাশকের ফোন নাম্বার দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কখন আসে সেই ক্ষণ! যাকে আমি বলি,  বিশ মাত্রার ভূমিকম্প।

শাদমান শাহিদ

জন্ম কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ। প্রকাশিত গ্রন্থ: ছোটগল্প: যমকুলি (২০১৪) , শিকড়, ঢাকা। উপন্যাস: পোস্টার চোখ (২০১৯) , চৈতন্য, সিলেট।সম্পাদনা: সম্পাদক, ত্রিকাল ( ছোটগল্প বিষয়ক লিটলম্যাগ, নরসিংদী)

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top