নীল রঙের নূর

অনুগল্প

।। বৈশালী ।।

এমনই এক অসুখের সন্ধ্যায় সুমু খালা এলো আবার। জানলা থেকে হাঁকলো, “তোর বাপজান খবর দিছে, ফিরে আইবে দিন বিশেকের মাঝেই।” ঘন নীলে নূর চিকমিকায়, সমুদ্দুরের বুক জুড়ে জোয়ার আসে।

একবার আরো অনেক ছোটো বয়সে কে বেশ চিবুক ধরে বলেছিল, ভারী সুন্দর নাম! তারপর থেকে আব্বুকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ক্ষণে ক্ষণে একটাই প্রশ্ন, “আব্বু, মরিয়াম মানে কী?” কিন্তু একবারও তার আব্বুজানের উত্তর তার মনে ধরেনি।

এক সন্ধ্যায় কাজ সেরে আব্বু গেছে মাগরিবের নামাজ পড়তে, ছোট্ট মেয়ে মরিয়মের আপা বলল, “এখান থেকে সোজা হেঁটে গেলে এক এত্ত বড় সমুদ্দুর, তার ঘন নীল জল আর নীল জলে আছে এক নূর। মরিয়ম হলো সেই নূর, বুঝলি?”

ম রি য় ম  হ লো  সে ই  নূ র

এই প্রথম বোধ হলো মরিয়ম তার উত্তর পেয়েছে! আপার ফেলে রাখা ভাঙা আয়নায় সে তার দীঘল চোখে অপলকে চেয়েই রইলো, দেখলো, সত্যিই চোখের মণি গাঢ় ঘন নীল আর সে নীলে নূর ভাসছে চিকমিক করে!

কখন সমুদ্দুরের পানিতে জোয়ার এলো আর সব আবছা হয়ে এলো
দূর থেকে মাগরিবের সুরও ফিকে হয়ে হাওয়ায় মিশে গেল রোজের মতো।

একদিন মরিয়মের ছোটো ঘরে মেঘ ঢুকে এলো, ছায়া বিছোলো ঘর জুড়ে। ছোট্ট মরিয়ম অবাক চোখে চেয়ে রইলো, এই বুঝি বুড়ির চুলের মতো খানিক মেঘ খসে পড়বে আর সে চেটেপুটে খাবে। এসব ভেবে ভেবে ঘন নীলে নূর উঠলো চিকমিকিয়ে!

হঠাৎ টের পেলো আব্বু চলেছে মেঘেদের সঙ্গে দূর দেশে।

আব্বু বললো, “না গেলে যে মেঘ কাটবে না।” আপা চুপ করে দাঁড়ালো কোনায়। আব্বু মেঘেদের সাথে মিলিয়ে যেতে যেতে মরিয়ম পিছনে ডাক দিলো, ‘আব্বু, মরিয়ম মানে সত্যিই সমুদ্দুরের নূর তো?’

মেঘেদের শব্দে আব্বুর উত্তর মরিয়ম অবধি পৌঁছালো না।

এরপর দিন কাটে, মাস যায়, আপার নামে খাম আসে। এক টুকরো নীল পানি খসে মেঘ থেকে, কিন্তু মেঘ খসে পড়ে না। মরিয়ম আশায় আশায় থাকে আর দেখে আপা কেমনে চুপ করে থাকে। কখনো দুই মাসে কখনো তিন মাসে খাম আসে আর এক এক টুকরো নীল পানি খসে, কিন্তু মেঘ খসে পড়ে না। এখন কেমন মেঘের সাথেই প্রশ্ন প্রশ্ন খেলে ছোট্ট মারিয়ম।

এভাবেই রাত কাটে, বছর যায়, আব্বু পালকের দেশে মেঘ কেটে ঘর বানায় –

সাদা পালকের ঘর একতলা, দুই তলা, তিনতলা, দশতলা, বিশতলা হয়।
মরিয়মের ছোট্ট ঘরের মেঘেরা আর কাটেনা।
আপা কেবল চুপ করে থাকে।
আর আপা কেবল চুপ করেই থাকে।

এরই মধ্যে কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘ ঠেলাঠেলি করে ঢুকে যায় মরিয়মের ছোট্ট ঘরে। অবাক হয়ে চায় মরিয়ম! ঘন নীলের নূর ফুটে উঠবে ঠিক সে সময়ে সুমু খালা জানলায় এসে বলে যায়, “অসুখ, অসুখ!”

অসুখ অসুখ অসুখ
অসুখ অসুখ অসুখ

গোটা তল্লাটে এদেশে-ওদেশে অসুখ করেছে নাকি! মেঘে মেঘে ছুঁয়ে দিলেই অসুখ! মেঘে জল ছুঁয়ে দিলেও অসুখ! মরিয়ম তার ছোট্ট জীবনে এমনতর দেখেনি কক্ষনো! আপাও কেমন মেঘের মতন জমে গেছে!

দিন কাটে, রাত কাটে, অসুখ আর কাটে না।
আপার নামে খামও আর আসেনা।
মেঘেরা জমে জমে আঁধার হয়।

এমনই এক অসুখের সন্ধ্যায় সুমু খালা এলো আবার। জানলা থেকে হাঁকলো, “তোর বাপজান খবর দিছে, ফিরে আইবে দিন বিশেকের মাঝেই।” ঘন নীলে নূর চিকমিকায়, সমুদ্দুরের বুক জুড়ে জোয়ার আসে।

মরিয়ম এখন গুনতে শিখে গেছে। একের পরে দুই, দুইয়ের পরে তিন, তিনের পরে চার… একটা একটা মেঘকে একটা একটা দিন সাজিয়েছে মরিয়ম। ওদের গুনে গুনে আব্বুর জন্য সাজিয়ে রাখে সে।

এভাবেই বিশের পর একুশ আর একুশের পর তিরিশ আর তিরিশের পর পঞ্চাশ আসে… মরিয়মের মেঘও শেষ হয় না, গোনাও শেষ হয় না, কেবল, আপা চুপ করে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকে।

মেঘে মেঘে ঠাসাঠাসি বাড়ে, মরিয়মের ছোট্ট ঘরে জায়গা কম পড়ে।
ঘন নীলে অকালে অকালে মেঘেদের ছাই এসে মেশে, পানি ফিকা হয়ে আসে।

আপার ভাঙা আয়নার কাচও ক্যামনে মেঘেদের ঘষা লেগে আবছা হয়ে গেছে! মরিয়ম মেঘেদের ভিড় ঠেলে চৌকাঠে আপার গা ঘেঁষে বসে। সন্ধ্যে নামে, দূর থেকে মাগরিবের ক্লান্ত সুর ভেসে আসে। বাতাস লেগে মরিয়ামের চোখ জুড়ে আসে…

হঠাৎ দ্যাখে, দূরে দূরে আরো দূরে একটা ফালির মতো ফিকা নীল সমুদ্দুরের জলে একটা বাতি জ্বলছে টিমটিম করে! আর সেই আলোয় দেখে, আব্বু!

হ্যাঁ, ওই তো আব্বু হেঁটে আসছে!
গোটা সমুদ্দুর হেঁটে হেঁটে হেঁটে হেঁটে আসছে আব্বু, ছোট্ট মরিয়মের আব্বুজান….

মেঘেদের ঝাঁকুনিতে ঘোর কাটে
-আপা, তুমি দেখলে আব্বুকে?”
-আপা?
-আপা?

আপা অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন!

ছোট্ট মরিয়ম মুখ ফিরিয়ে আবার তাকায় সেই দূরে, দূরে দূরে অনেক দূরে! এক ফালি রুটির মতো ঝলসানো চাঁদের ছায়া পড়া সরু সুতোর মতো ফিকা নীল পানির সমুদ্দুর বয়ে যায়…

সমুদ্দুরের ওপারে রেলের ট্র্যাকের ফাঁকে ফাঁকে আটকে থাকা নূর, ক্রমে নিভে আসছে…
মরিয়মের ক্লান্ত চোখ জ্বালা করে চেয়ে থেকে থেকে, বাতাস লেগে জড়িয়ে আসে গলা!

সে অস্ফুটে বলে ওঠে,

“আব্বু, মরিয়ম মানে সত্যিই সমুদ্দুরের নূর বলো?“

অলঙ্করণ: লেখক স্বয়ং

বৈশালী

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতকোত্তর এবং ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ নিয়ে এমফিল করার পর বিগত ৬ বছর বিভিন্ন এনজিও’র সঙ্গে যুক্ত। WLCI, কলকাতা কলেজ থেকে ফ্যাশান টেকনোলোজি নিয়ে ডিপ্লোমা করেছেন। বৈশালী একজন স্বশিক্ষিত অঙ্কনশিল্পী এবং বিগত বেশ কিছু বছর ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। থিয়েটার চর্চার সাথে সঙ্গে বিগত ৭ বছর; অভিনয়ের পাশাপাশি শিল্প নির্দেশনা, সেট ও পোশাক ডিজাইনিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার অলঙ্করণ বিভাগের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন।

Share