।। বিশ্বেন্দু নন্দ ।।
দুই লুঠেরা খুনির অভিযাত্রাকে ইওরোপিয় ইতিহাস আধুনিকতার শুরুয়াৎ হিসেবে গণ্য করে, বহু ভদ্রবিত্তও তাই মনে করে , ইতিহাস অধ্যাপকের সাংবাদিক পুত্র কয়েক বছর আগে কলম্বাস দিবস উপলক্ষ্যে ভাস্কোর গুণগান করেছিলেন। বিশ্বজুড়ে প্রথম সমুদ্র সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল ইওরোপিয় শক্তিরা, এই চরম অনৃত তথ্য বার বার তারস্বরে উল্লিখিত হতে হতে ঐতিহাসিক তথ্যে পরিণত হয়ে পড়ুয়াদের মাথা খেয়েছে। পাঠ্যক্রমে কলম্বাস, ভাস্কো দা গামাদের মধ্যযুগীয় হত্যালীলা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রগতিশীল ইওরোপের অভিযাত্রীরা এই প্রথম বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপথে বেরিয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ তৈরি করে ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়ে ‘প্রিমিটিভ’দের তৈরি সামন্ততন্ত্রের গোড়া চ্ছিন্ন করে আধুনিকতা বয়ে নিয়ে গেলেন ইওরোপের বাইরে। যে কোনও গোষ্ঠী, মানব সমাজকে ‘প্রিমিটিভ’ দাগিয়ে আধুনিক উপনিবেশিকদের প্রত্যেকটি হত্যালীলা জায়েজ করা হয়েছে এতকাল। যদিও আস্তে আস্তে ইতিহাসচর্চা ইওরোপমন্যতার বাইরে বেরিয়ে ইউরেশিয় ইতিহাসের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু আজও আধুনিক উপনিবেশিক ইওরোপকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার বাইরে আমরা অনেকেই বেরোতে যে পারি নি, সেটাও সমান সত্য।
১৪৯৭-এর স্কেমা, ইওরোপিয় সাম্রাজ্য বিস্তার এবং এশিয় সমুদ্র
Before the arrival of the Portuguese in . . . 1498 there had been no organized attempt by any political power to control the sea-lanes and the long distance trade of Asia. ! e Iberians and their north European followers imported a Mediterranean style of warfare by land and sea into an area that had hitherto had quite a diff erent tradition.” Kitri N Chaudhuri, Trade and Civilisation in the Indian Ocean
১] সপ্তদশ শতের প্রথম দশকগুলোয় পর্তুগিজ শক্তিকে দমিয়ে ভারত মহাসাগর ক্ষেত্রে উঠে এল নতুন এক নৌ শক্তি। লক্ষ্য পর্তুগিজ নৌ বাহিনীর প্রতাপ ধ্বংস করে তাদের দখল নেওয়া সমুদ্র পরিসর পুনর্দখল। কামান সাজানো বিশাল জাহাজ নিয়ে প্রায় একতরফা আক্রমন শানিয়ে পর্তুগিজ বন্দর ঘাঁটি, সওদাগরি জাহাজ (ক্যারাক্স) বহর গুঁড়িয়ে দীর্ঘকালের অভেদ্য মোম্বাসা, মাসকটের মত সুদৃঢ় কেল্লা উপনিবেশ দখল নিল তারা। ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যপথ দখল নেওয়া পর্তুগিজ শক্তির উপনিবেশিক ক্ষমতা হ্রাসের যুগ শুরু হল।
২] দ্বিতীয় যে সামুদ্রিক শক্তির কথা বলব, তারা নিয়ন্ত্রণ করত ইওরোকেন্দ্রিকেরা যে অঞ্চলকে দূর প্রাচ্য বলে, চিন-জাপান কোরিয়ার সমুদ্রক্ষেত্র। ১৬৩৯ সালে জাপান থেকে পর্তুগিজদের বের করে দেওয়ার পর তারাই দ্বীপরাষ্ট্রে বিদেশি পণ্য আর বিশ্ব সংবাদ সরবরাহকারী শক্তি। সপ্তদশ শতকে তাইওয়ানে বিশাল উপনিবেশ তৈরি করে পূর্ব সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করেছে। এরা স্পেনিয় এবং ফিলিপিনোদের অন্যতম প্রধান শত্রু।
৩] তৃতীয় শক্তি অষ্টাদশ শতকে ভারত মহাসাগরে বিপুল প্রতাপ তৈরি করেছে নিজেদেওই বলে। সমুদ্র যাত্রায় পর্তুগিজদের কার্তেজের মতই এরাও বাণিজ্য জাহাজগুলোকে ছাড়পত্র বিক্রি করত। না থাকলে অব্যর্থভাবে জাহাজ দখল হত; এরাই ভারত মহাসাগরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূল শত্রু হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ কোম্পানিকেও তাদের ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে হত। এরা পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রিত কেল্লা দখল করে, এমন কী এক সময় গোয়া দখল করার মতো অবস্থায় চলে এসেছিল।
ধরেই নিচ্ছি আপনি ইতিহাসচর্চা করেন। উপনিবেশ, উপনিবেশের আগের সময়ের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ সম্বন্ধে আপ্নার কিছু না কিছু ধারণা আছে। এবং সেই সুবাদে নিশ্চই ধরে নিয়েছেন, ওপরে তিন বুলেটপয়েন্টে আলোচনা করা নতুন সমুদ্রশক্তি অবশ্যম্ভাবীভাবে হবে হয় ডাচ, নয়তো ফরাসি না হলে তো আবশ্যিকভাবে ব্রিটিশ। এর বাইরে আর কিই বা থাকতে পারে।
এমরি ইউনিভার্সিটির টোনিও আন্দ্রাদে ‘বিয়ন্ড গানস জার্মস অ্যান্ড স্টিক ইওরোপিয়ান এক্সপান্সান অ্যান্ড মেরিটাইম এশিয়া ১৪০০-১৭৫০’ প্রবন্ধে আপনাদের সমস্ত অনুমান নস্যাৎ করে বলছেন ওপরে উল্লিখিত প্রথম সমুদ্রশক্তির নাম ওমানের ইয়ারুবি সাম্রাজ্যের সমুদ্র বাহিনী। মাথায় রাখতে হবে ওমান রাষ্ট্র, সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের বড় সময় জুড়ে পারস্য উপসাগর ছাড়িয়ে বিস্তৃত সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। অথচ ইতিহাসে শুধুই ইওরোপিয় শক্তিগুলোর সমুদ্র সাম্রাজ্য দখলদারির বয়ানেরই আধিপত্য আজও ক্রিয়াশীল; ওমানিদের কাজকর্ম সম্বন্ধে প্রায় কিছু লেখা হয় না, যেমন ভাস্কো ডা গামার আগেই চৈনিক সেনাপতি জেং হির বিশ্ব সমুদ্র যাত্রার কথা প্রায় অনুল্লেখিত থেকে যায় অথবা ভারত মহাসাগরে কোঙ্কণ উপকূল অঞ্চলে মারাঠি সেনানায়ক কানহাজী আংরে পরিবারের অর্ধশতাব্দ ব্যাপী সমুদ্র বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস হয় চেপে যাওয়া হয়, না হয় তাদের জলদস্যু দাগিয়ে দিয়ে তাদের কৃতিকে আলোচনার বাইরে ঠেলে ফেলা হয়।
বিশ্ব ইতিহাসে ইওরোপিয় কৃতি নির্মাণে ইওরোপিয়দের অন্য বহু অইওরোপিয় কৃতি আলোচনায় সিলেক্টিভ আমনেসিয়া আজ উপনিবেশবিরোধী চর্চা করা আমআদমির কাছে অতি পরিচিত ইস্যু; সাম্রাজ্য সৃষ্টির মার্কেন্টাইল এবং নবজাগরণী কালের অধিকাংশ জ্ঞান, প্রযুক্তি, হাতিয়ার, খেলাধুলো ইওরোপিয়রা এশিয়া আফ্রিকা আমেরিকা থেকে আত্মস্যাৎ করেও এমন একটা ধারণা তৈরি করেছে যাতে মনে হয় এগুলোর অধিকাংশ ইওরোপিয়দের তৈরি, আবিষ্কার, নির্মাণ। ফুটবল-বাস্কেটবল-লুডো থেকে কফি থেকে বেকিং থেকে বারুদ থেকে ম্যাপিং থেকে সমুদ্র জ্ঞান থেকে জাহাজ তৈরি থেকে স্থাপত্য থেকে জ্যোতির্বিদ্যা থেকে কলনবিদ্যা থেকে যুদ্ধাস্ত্র থেকে ধাতু জ্ঞান এবং এরকম হাজারো জ্ঞান/প্রযুক্তি/জীবনশৈলী ইওরোপিয় সাম্রাজ্য গিলে খেয়েছে। সে সবের অইওরোপিয় চেহারা বদল করতে ব্যাপক প্লাস্টিক সার্জারি করে ইওরোপিয় কাঠামোয় ঢেলে সাজিয়েছে যাতে তার উদ্ভবের সমস্ত রূপ রস গন্ধ মুছে শুধু নব্য ইওরোপিয় দখলদারির রঙচঙে লেবাস জেগে থাকে। এশিয় সমুদ্র জগতে মারাঠি, চিনা এবং ওমানি প্রতাপের ইতিহাস ঠিক এমনিভাবেই সযত্নে উপনিবেশিক ইতিহাস থেকে মুছে দিয়েছে ইওরোপিয় জ্ঞানচর্চা।
প্রাক্তন উপনিবেশিক দেশগুলোর ইতিহাসের পাঠ্যক্রম এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে ওপরে আলোচ্য দ্বিতীয় শক্তিকে অনেকেই ভাববেন ডাচ নৌ উদ্যম; অবশ্যই এই অঞ্চলে ডাচ কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু ডাচেদের থেকেও বড় শক্তি ছিল চিনাদের জেং রাষ্ট্র। ডাচেরা কিন্তু তাইওয়ানে উপনিবেশ তৈরি করেছে। সে সময় সব থেকে বড় এবং সব থেকে লাভের উপনিবেশ ছিল তাইওয়ান। তাদের খেদিয়েছিল চিনা শক্তি। পর্তুগিজরা জাপান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে ডাচেরা সেখানে প্রবেশ করে ঠিকই কিন্তু চিনারা কিন্তু সেখানে ছিল সব থেকে বড় শক্তি – পণ্য এবং বিশ্বতথ্য সরবরাহ করার ক্ষেত্রেও।
তৃতীয়টা অবশ্যই মারাঠা কানহাজী আংরের তৈরি নৌ সাম্রাজ্য। নিজেদের তৈরি বিশাল জাহাজ আর সমুদ্র কেল্লায় থানা গেড়ে তারা বেশ কয়েক দশক সাম্রাজ্য ছড়ানোর আশায় থাকা ব্রিটিশ শক্তির মাথা ব্যথার কারন হয়ে উঠেছিল। আঠেরো শতকের শুরুতে মারাঠা নৌশক্তি, সমুদ্রের উপকূলজোড়া দুর্ভেদ্য কেল্লা, শক্তিশালী নৌবহর ভারত মহাসাগরে টহল দেওয়া ব্রিটিশ নৌ বাহিনী আর পর্তুগিজ হার্মাদদের চক্ষুশূল ছিল। মাঝ সমুদ্রে হালকা নৌবহর নিয়ে অতর্কিত মারাঠা আক্রমণের ধাক্কা থেকে বাঁচতে ব্রিটিশ আর পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা মারাঠাদের বাধ্য হয়ে সমুদ্র কর দিতে হয়েছে – যে ধরণের সমুদ্র নিরাপত্তা ট্যাক্স ‘কার্তেজ’ তার আগের সময় নিত পর্তুগিজ শক্তি।
ভারত মহাসাগরের তিন ব্যতিক্রমী শক্তি ইয়ুরাবি, চিনা আর মারাঠি সমুদ্র বাহিনী এবং তাদের কাজকর্ম নিয়ে আমি আমার পুরোনো ফেবু আইডিতে ধাঁধা প্রতিযোগিতা করেছিলাম। একজন দিদিমনিই ইয়ুরাবি শক্তির নাম বলতে পেরেছিলেন; তিনি ছাড়া আর কেউই ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেননি। প্রত্যেকেরই আন্দাজ ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসিদের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। অর্থাৎ এই তথ্য ইন্টারনেটেও অলভ্য ছিল ২০২০ সালের আশেপাশের সময়ে। আমার উত্তর শুনে অধিকাংশই অবাক হয়েছেন। এই ধাঁধা-খেলা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট কীভাবে পশ্চিমি ইতিহাসের বয়ান আজও অ-ইওরোপিয় ইতিহাসের ঘাড়ে সিন্দাবাদের নাবিকের মত জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে আছে।
এই প্রবণতাকে আন্দ্রাদে বলছেন, ১৪৯২ স্কেমা– আমরা দক্ষিণ এশিয়ার উপনিবেশ বিরোধী মানুষজন বলব ১৪৯৭-এর ভাস্কো কেস। দুই লুঠেরা খুনির অভিযাত্রাকে ইওরোপিয় ইতিহাস আধুনিকতার শুরুয়াৎ হিসেবে গণ্য করে, বহু ভদ্রবিত্তও তাই মনে করে , ইতিহাস অধ্যাপকের সাংবাদিক পুত্র কয়েক বছর আগে কলম্বাস দিবস উপলক্ষ্যে ভাস্কোর গুণগান করেছিলেন। বিশ্বজুড়ে প্রথম সমুদ্র সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল ইওরোপিয় শক্তিরা, এই চরম অনৃত তথ্য বার বার তারস্বরে উল্লিখিত হতে হতে ঐতিহাসিক তথ্যে পরিণত হয়ে পড়ুয়াদের মাথা খেয়েছে। পাঠ্যক্রমে কলম্বাস, ভাস্কো দা গামাদের মধ্যযুগীয় হত্যালীলা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রগতিশীল ইওরোপের অভিযাত্রীরা এই প্রথম বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপথে বেরিয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ তৈরি করে ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়ে ‘প্রিমিটিভ’দের তৈরি সামন্ততন্ত্রের গোড়া চ্ছিন্ন করে আধুনিকতা বয়ে নিয়ে গেলেন ইওরোপের বাইরে। যে কোনও গোষ্ঠী, মানব সমাজকে ‘প্রিমিটিভ’ দাগিয়ে আধুনিক উপনিবেশিকদের প্রত্যেকটি হত্যালীলা জায়েজ করা হয়েছে এতকাল। যদিও আস্তে আস্তে ইতিহাসচর্চা ইওরোপমন্যতার বাইরে বেরিয়ে ইউরেশিয় ইতিহাসের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু আজও আধুনিক উপনিবেশিক ইওরোপকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার বাইরে আমরা অনেকেই বেরোতে যে পারি নি, সেটাও সমান সত্য।
ইওরেশিয় মডেলকে চারভাগে ভাগ করা করি। প্রথমটি আলফ্রেড ক্রসবির ‘ইকলজিক্যাল ইম্পিরিয়ালিজম’, জারেড ডায়ামন্ডের ‘গানস, ডায়মন্ড এন্ড স্টিল’। এই দুটো অসামান্য বই আমাদের পুরোনো এবং নতুন সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাস তুলে ধরেছে। দ্বিতীয়টি ১৪৯২ থেকে ১৬৫০ পর্যন্ত ইওরোপিয় সাম্রাজ্য বিস্তার যাকে ধ্রুপদী অভিযাত্রীদের যুগ বা বাণিজ্যের যুগ বলা হয়েছে। এটাই আদতে ইওরোপিয়দের সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথমধাপ। তৃতীয়টি বহু গবেষক দেখেছেন, নতুন সময়ে ইওরোপ থেকে চিন পর্যন্ত ভূখণ্ডের পুরোনো কাঠামো তখনও দাঁড়িয়ে ছিল এবং ১৪০০র মাঝখান থেকে তথাকথিত অষ্টাদশ শতকের সঙ্কটের সময়েও দূরবাণিজ্যের (‘এজ অব কমার্স’এর ধারণা তৈরি করেন এন্থনি রিড আর অষ্টাদশ শতকের সঙ্কট নিয়ে প্রথম কাজ করেছেন জিওফ্রে পার্কার আর লেজলি স্মিথ) বৃদ্ধির সঙ্গে তালমিলিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। কেউ কেউ বলছেন এই বাণিজ্য এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিশ্বের সব অঞ্চলে সমানভাবে ঘটে নি। এই বিকাশের কাজে স্থানীয়তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কোথাও কোথাও অবৃদ্ধির মন্দাও দেখা গিয়েছে। তা সত্ত্বেও পণ্ডিতরা মনে করছেন এই সময় বিশ্বজুড়ে মোটামুটি উন্নয়নের ধারা বয়ে গেছে, বিশেষ করে দূর বাণিজ্যে। চতুর্থত মাথায় রাখা দরকার ইওরোপিয়রা যাকে তথাকথিত ওল্ড ওয়ার্ল্ড দাগিয়ে দিচ্ছে –প্রাচীন ইতিহাস সমাজ সমৃদ্ধ দেশগুলো, সেখানে সওদাগরি বাণিজ্য বিস্তারে উপনিবেশ তৈরি আর লুঠ চালানো সম্ভব হয়েছে ওল্ড ওয়ার্ল্ডের মানুষজনের সহায়তাতেই। ইওরোপিয় সমুদ্রবাহিত দুর্বল সাম্রাজ্য এবং বাণিজ্য কাঠামো তৈরি হয়েছিল শত শত বছর ধরে এশিয় আফ্রিকিয় আমেরিকিয়দের তৈরি বাণিজ্য পথের ওপরে। ১৪০০ থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত সময়ে এশিয় বণিকেরা বিশ্ব ব্যবসায় খুব বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাদের কেন্দ্র করেই বিশ্ব ব্যবস্থা আবর্তিত হত। ঠিক যে জন্য আকবর যখন ক্ষমতায় আসছেন ১৫৫০এর দশকে চিন বিশ্বের একনম্বর আর দক্ষিণ এশিয়া দুনম্বর অর্থনীতি আর আওরঙ্গজেব যখন মারা যাচ্ছেন অষ্টাদশ শতকের প্রথম দশকে ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটছে দক্ষিণ এশিয়া হচ্ছে একনম্বর অর্থনীতি আর চিন হল দুনম্বর অর্থনীতি। অষ্টাদশ শতকের এই তালিকায় উনবিংশ শতকে বিশ্বকেন্দ্র হিসেবে গণ্য হওয়া ইওরোপিয়দের প্রথম দশনম্বরে দেখি না। মাথায় রাখুন ইওরোপিয় সনদী কোম্পানিগুলি অর্থাৎ সেনাবাহিনী নিয়ে ‘বাণিজ্য’ করতে আসা কর্পোরেটরা যখন এশিয়ায় ব্যবসা করতে আসছে, তখন মালয় বণিকেরা পর্তুগিজদের ফিনান্স করে, চিনারা ডাচ আর স্পেনিয়দের ফান্ড যোগায়, দক্ষিণ এশিয়ার শেঠ-ব্যবসায়ীরা ডাচ আর ব্রিটিশদের ব্যবসায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে। জন উইলিস, ‘মেরিটাইম এশিয়া – দ্য ইমারজেন্স অব ইওরোপিয়ান ডমিনেশন ১৫০০-১৮০০ কালপর্বে একে বলছেন ইওরোপিয় আধিপত্যের ইন্টার্যাক্টিভ উত্থান। এই ভাবেই ইওরোপিয় মিরাক্যালের ধারণাটা ঘুরে ফিরে এসে লুঠ, খুন, অত্যাচারের তথ্যগুলো সরে যায় পর্দার পিছনে।
ভদ্রবিত্তের মাথায় ১৪৯৭-এর ভাস্কো কেস আজও বহাল তবিয়তে ইওরোপিয়দের মনোজগতে তো বটেই, এশিয় আফ্রিকিয় আমেরিকিয় কোলাবরেটর ভদ্রবিত্তদের মাথায়অ বরকরার। ইওরোসেন্ট্রিজমকে প্রশ্ন করা জ্যাক গুডি ‘দ্য থেফট অব হিস্ট্রি’তে বলছেন, ষোড়শ শতাব্দ থেকে রেনেসাঁ ঘটিয়ে ইওরোপ বিশ্ব দখলদারি নিশ্চিত করে। নিউ ইয়র্ক রিভিউএর এক বই সমালোচনায় (জুলিয়ান বেল, ‘দ্য গোল্ডেন এজ এট ইটস বেস্ট’) দাবি করা হয় ১৬০০ সালেই আমস্টারডাম বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। এশিয় বন্ধুরা প্রায়শই বলে থাকেন পুঁজিবাদ আর ইওরোপিয় দখলদারি ষোড়শ শত থেকে শুরু হয়। এর হাতে গরম আমরা দেখি শুরুর তিনটে প্রশ্নের চলতি ভদ্রবিত্তের ইন্সট্যান্ট উত্তরে। এইভাবেই
আমাদের মানসিক ইতিহাসের চলন নির্দিষ্ট ইওরপিয় প্রাধান্যের রাস্তায় চালান করার কাঠামো শুরু হয়ে যায়। ইওরোপিয় ঐতিহাসিকেরাই কিন্তু ইওরোপমন্যতাকে নানাভাবে কাউন্টার করেছেন। তাহলে আজও কেন ১৪৯২/১৪৯৭এর স্কেমা বা ইওরোপিয় মিরাকলের ধারণা ইতিহাস চর্চায় কাজ করে – প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন টোনিও আন্দ্রাদে। তার দাবি আধুনিক এশিয় মনষ্ক ইওরোপিয় ঐতিহাসিকেরা বিশ্ব ইতিহাসে এশিয়ার অবদান স্বীকার করেও, ষোড়শ শতক থেকে ইওরোপিয়দের বিশ্ব ডমিন্যান্সের যে ইতিহাস নির্মাণ হয়েছে, সে ধারণা থেকে বেরোতে পারেন না। তাই সপ্তদশ শতকের ওমানি, চিনা, মারাঠি সমুদ্র শক্তি ইতিহাসের আলোচনা তো দূরস্থান, পাদটিকাতেও ঠাঁই হয় না।
এই ঘটনা আরও সত্য হয়ে দেখা দেয় নিওলিবারেল এবং বামপন্থী আলোচনাতেও। ‘পশ্চিমের উত্থান’এর ধারণাটা তৈরি হয় ইওরোপিয় ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকার, নবজাগরিত মানবিকতাবাদ, ধর্ম/চার্চ এবং রাষ্ট্রের বিভাজন এবং এধরণের হাজারো সামাজিক-অর্থনৈতিক চলক নির্ভর করে, অধিকাংশ অইওরোপিয় সমাজ/রাষ্ট্র সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারণা বুঝ না তৈরি করেই। ডেভিড ল্যান্ডেস ‘ওয়েলথ এন্ড পোভার্টি অব নেশনস’ বইতে একই ধারণার শিকার হয়েছেন। অইওরোপবাদী বিশ্লেষক যেমন বিন্ ওয়ংএর (R. Bin Wong) ‘চায়না ট্রান্সফর্মড, হিস্টোরিক্যাল চেঞ্জ এন্ড দ্য লিমিটস অব ইওরোপিয়ান এক্সপেরিয়েন্স’ অথবা কেনেথ পমেরানজের ‘দ্য গ্রেট ডাইভারজেন্স, চায়না ইওরোপ এন্ড দি মেকিং অব দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড ইকনমি’ পড়তে গিয়ে আমরা একই সমস্যার মুখোমুখি হই। অন্যদিকে ‘দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড সিস্টেম১ ক্যাপিট্যালিস্ট এগ্রিকালচার এন্ড দ্য অরিজিন অব দ্য ইওরোপিয়ান ওয়ার্ল্ড ইকনমি ইন দ্য ১৬ সেঞ্চুরি’তে ইমানুয়েল ওয়ালারস্টেইন এবং তার ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের অনুগামী নব্য মার্ক্সবাদীরা ওয়ালারস্টেইনের তত্ত্বকে নতুনভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ষোড়শ শতকের পুঁজির বিশ্বজয়ের ইওরোপিয় বিশ্ব দখলদারির প্রমান উপস্থাপন করেন – যে ধারণার খুব একটা ভিত্তি নেই।
সমস্যা হল কেনেথ পমেরানজ, বিন ওয়ং বা আন্দ্রে গুরুনার ফ্রাঙ্কের মত ঐতিহাসিক এবং বিশ্লেষকেরা ইওরোপিয় সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে নবজাগরণকে যতটা সম্পৃক্ত করেন, শিল্পায়ন বা শিল্পবিপ্লব আকস্মিক ঘটনা মাত্র এর আর্থ-সামাজিক ভিত্তি ছিল না, এই তথ্য মানেন না। পলাশী এবং তার পরে বাংলা এবং দক্ষিণ এশিয়া লুঠ না হলে হয়ত সবই ফক্কা হত। অথচ ইওরোপিয় শিল্পায়নের আগে ইওরোপে বেশ কিছু পরিবর্তন আসছিল, সে তথ্যেও ভুল দেখি না। ইওরোপিয় সামুদ্রিক শক্তির পাশাপাশি আমরা অইওরোপিয় ওমানি জেং বা মারাঠি নৌবহরের উদাহরণ পাচ্ছি – কিন্তু এরা কেউই ধারে ভারে এবং সাম্রাজ্য তৈরির শক্তিতে ইওরোপিয় নৌ সাম্রাজ্য সমতুল হয়ে উঠছে না। কেন?
আন্দ্রাদে ইওরোপিয় সাফল্যের তিনটে যুক্তি দিচ্ছেন। প্রথমত ইওরোপিয়রা যে বিশ্ব সাম্রাজ্য তৈরি করছে তাতে প্রযুক্তি কিছুটা সহায়ক হয়েছে, বিশ্ব রাজনীতিও কিছুটা সহায়ক হয়েছে, সব থেকে বেশি সাহায়ক হয়েছিল পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের সামরিক ভূমিকা – মার্কেন্টিলিজম [এটা অবশ্য আন্দ্রাদে বলেন নি]। পশ্চিম ইওরোপের রাজনীতিই ছিল সমুদ্রশক্তি নির্ভর করে দুঃসাহসিক কর্পোরেটদের সামরিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে রাষ্ট্রের সহায়তা দেওয়া। দ্বিতীয়ত সামরিক প্রযুক্তি – যদিও তারা এশিয়দের তুলনায় খুব বেশি এগিয়েছিল না – তারা বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তি, শিল্প কাঠামো ধ্বংস আর লুঠ করেছিল এবং এই ধ্বংস-লুঠের ইতিহাসও মুছে দিয়েছে আধুনিক ভদ্রবিত্তের স্মৃতি থেকে। তৃতীয়ত ইওরোপিয় শক্তিগুলো সমুদ্রে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে এগিয়েছে ফলে সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে মূলত পশ্চিম ইওরোপিয় শক্তিগুলো।
১]
১৪০০র শেষের দিকে পর্তুগিজেরা ভারত মহাসাগরে বৃহৎ নৌশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। আক্রমণাত্মক সমুদ্র শক্তি থেকে নিজেদের সমুদ্র শক্তিকে রক্ষা করা এই অঞ্চলের রাজনীতি এবং সমুদ্র শহরগুলোর প্রশাসকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল না। ফলে সমুদ্রে হার্মাদি করে পর্তুগিজেরা ভারতবর্ষ এবং পূর্ব আফ্রিকার একের পর এক সমুদ্র বন্দর দখল নিয়েছে। সামরিক প্রযুক্তির দিক দিয়ে পর্তুগিজেরা কিছুটা এগিয়ে থাকলেও তাদের সার্বিক প্রযুক্তির ধার এমন কিছু আহামরি ধারালো ছিল না যে তারা শুধু প্রযুক্তি অবলম্বন করে উপনিবেশ তৈরির খেলায় জিততে পারবে। এমন কোনও ক্ষমতাধর নৌসামরিক শক্তি তাদের ছিল না যা দিয়ে দক্ষিণাঞ্চল থেকে আবির্ভূত হওয়া পর্তুগিজদের হাল্কা সামরিক শক্তির সঙ্গে টক্কর নিতে পারে। তাছাড়া পর্তুগিজেরা পৌঁছবার আগে এই এলাকার সমুদ্র রাজনীতির ধরণধারণও ছিল সম্পূর্ণ আলাদা রকমের। ফলে নতুন বিশ্ব রাজনীতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার আগেই পর্তুগিজেরা জাঁকিয়ে বসে (এই সময়টা জানতে কীর্তি নারায়ণ চৌধুরীর ‘ট্রেড এন্ড সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়ান ওসান – অ্যান ইকনমিক হিস্ট্রি ফ্রম রাইজ অব ইসলাম টু ১৭৫০’ বা ডেভিড রিংরোজের ‘এক্সপানসান অ্যান্ড গ্লোবাল ইন্টার্যাকশান’ বই দুটো দেখতে পারেন)।
পারস্য উপসাগরের মাস্কট (১৫০৮এ) এবং হরমুজ (১৫১৫ সালে) দখল নেয় পর্তুগিজ শক্তি। শুধু এই অঞ্চলেই নয়, এশিয়ার অন্য অঞ্চলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্তুগিজ শক্তি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় নি। কিন্তু হঠাতই তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই অঞ্চলের স্বাধীন শহর রাষ্ট্র হরমুজের প্রধানেরা [মালিক]। পর্তুগিজদের সামরিক শক্তি খুব কিছু আহামরি ছিল না, স্থানীয়রা পর্তুগিজদের সহায়তায় শাসন চালাত ঠিকই কিন্তু স্থানীয় শক্তিরা উদ্যমী হয়ে উঠলে পর্তুগিজেরা সমস্যায় পড়ত। আমরা জানি অধিকাংশ ঐতিহাসিক, অনৈতিহাসিকভাবে বলেছেন এশিয়ায় পর্তুগিজ শক্তি দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল। একমাত্র সঞ্জয় সুব্রহ্মণিয়ম [নোটস অন সিক্সটিন্থ সেনচুরি বেঙ্গল] এবং সপ্তগ্রাম-হুগলী বন্দর আলোচনায় সুশীল চৌধুরী এই সিদ্ধান্তে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন; এবং এর থেকে বড় সত্য আর কিছুই নেই।
এই অঞ্চলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল ছিল, কারন কোনও শক্তিশালী সমুদ্রশক্তি পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় নি। সঞ্জয় সুব্রহ্মণিয়ম ‘অন ইমারত এন্ড তিজারত’ প্রবন্ধে (এবং মামলুকদের নৌবাহিনীর সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান বুঝতে জন গিলমার্টিনের ‘গানপাউডার এবং গ্যালিজ, চেঞ্জিং টেকনোলজি এন্ড মেডিটেরেনিয়ান ওয়ারফেয়ার এট সি ইন দ্য ১৬থ সেঞ্চুরি’ দেখতে পারেন) মিশরিয় মামলুক শক্তিকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূমধ্যসাগরীয় আঙ্গিকের সমুদ্রশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করলেও তারা ভারত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে পর্তুগিজদের সামরিক শক্তির বাড়বাড়ন্ত রুখতে ব্যর্থ হয়। মাথায় রাখতে হবে মামলুকেরা পর্তুগিজদের মোকাবিলা করার অল্পদিনের মধ্যেই উসমানিয় সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। ঐতিহাসিক গিয়ানকার্লো ক্যাসল ‘দ্য অটোমান এজ অব এক্সপানসান’এ দেখিয়েছেন পর্তুগিজদের রোখার উসমানিয় চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মাঝে মধ্যে কিছু সামরিক শক্তি পর্তুগিজদের বিরুদ্ধাচারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু এই অঞ্চলে আবির্ভাবের ১০০ বছর অবদি পর্তুগিজরা প্রায় আনচ্যালেঞ্জড থেকেছে বললেও অত্যুক্তি হয় না।
কিন্তু সপ্তদশ শতকে নতুন ইওরোপিয় সামুদ্রিক শক্তি তৈরি হল। আমরা ডাচ আর ব্রিটিশ সমুদ্র শক্তিদের সম্বন্ধে জানি, কিন্তু ভারত মহাসাগরে ইয়ারোবি সাম্রাজ্য সম্বন্ধে প্রায় কিছু জানি না বললেই চলে। মুঘল হিন্দুস্তানে যখন জাহাঙ্গিরের রাজত্ব শেষ পর্যায়ে, সে সময় ওমানি সমুদ্র লিটারোলে নাসির বিন মুর্শিদ তার সম্প্রদায়ের ইমাম নির্বাচিত হলেন। ক্ষমতা হাতে পেয়ে নিজের সম্প্রদায়ের থেকে সম্পদ জোগাড় করে অঞ্চলে রাষ্ট্রের কাঠামো বৃদ্ধির কাজ শুরু করলেন এবং ক্রমশ ইমামের উদ্যমে ক্রমশ শক্তিশালী ওমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠল। জিহাদের ডাক দিয়ে তিনি পর্তুগিজ শক্তির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন, পশ্চিম উপকূলে জুলফার (রাস এল কাইমা) সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শহর কারিয়াত দখল নিলেন। ১৬৪৯এ ভারতবর্ষে তখন শাহজাহানের রাজত্ব। তিনি মারা যাওয়ার সময় আমরা দেখি ওমানিরা শুধু গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-শহর ম্যাসকট ছাড়া প্রায় সব কটা অঞ্চল পর্তুগিজ শক্তিমুক্ত। উত্তরাধিকারী ভাইপো সুলতান বিন সেইফ পরের বছর তাঁর অনারব্ধ কাজ শেষ করলেন খুবই শক্তিশালী সুরক্ষিত কেল্লা ম্যাসকট থেকে পর্তুগিজদের উচ্ছেদ করলেন।
ম্যাসকট দখল নিয়ে ওমানি রাষ্ট্র ইওরোপিয় সমুদ্রশক্তির সঙ্গে টক্কর নিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দিল। কিন্তু তারা কীভাবে নৌবহর বৃদ্ধি করল সে বিষয়ে আমরা আজও অন্ধকারে। কিছু হয়ত পর্তুগিজদের থেকে দখল নেওয়া বহর আর কিছু হয়ত ব্রিটিশদের থেকে কেনা। মনে হয় তারা সমুদ্রপোত তৈরির কাঠামোও তৈরি করতে পেরেছিল। তাদের কোনও জাহাজে ৮টা কামানও বসানো থাকত। সুলতান বিন সইফ বা তার উত্তরাধিকারী নৌবাহিনীকে ব্যবহার করে সমুদ্রে ক্ষমতা বিস্তারে মন দিল। সইফ বিন সুলতান (১৬৯২-১৭১১) ২৪টা ইওরোপিয় আঙ্গিকের বড় জাহাজ এবং ২৮টা ছোট যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে টহল দিতেন। সময়ের তুলনায় বেশ বড় নৌবাহিনী বানিয়ে ফেলেছিল ওমানিরা; ক্রমশ ভারতীয় নৌ এলাকায় পর্তুগিজ বন্দরগুলো দখল নিতে শুরু করে – সব থেকে বড় আক্রমন নামিয়ে এনেছিল পর্তুগিজ বাণিজ্য কেন্দ্র দিউ শহরে ১৬৬৮তে, আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে। এই আক্রমনে পর্তুগিজদের প্রচুর ক্ষতি হয় এবং তাদের এশিয় বাণিজ্য বহুকাল বন্ধ থাকে।
শুরু হল ভারত মহাসাগরে ওমানি পর্তুগিজ নৌ বহর আধিপত্যের যুগ। এই সময় ওমানিরা পর্তুগিজদের থেকে অনেক বেশি শক্তিধর ছিল। ওমানি-পর্তুগিজ নৌযুদ্ধের যুগ, আদতে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ যুদ্ধই। নৌবাহিনীকে সম্বল করে সইফ পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জিবার, পেম্বা, কিলওয়া এবং মোম্বাসার মত বিপুল বিশাল কামান-কেল্লায় সুসজ্জিত সুরক্ষিত পর্তুগিজ ঘাঁটি দখলে নেন। অষ্টাদশ শতকে ওমানিরা বিপুল নৌবহর নিয়ে ভারত মহাসাগরে রাজত্ব করার সুবাদে লাভজনক বাণিজ্য পথ দখল এবং উপনিবেশ তৈরি করল।
ওমানিদের সাফল্য থেকে আমরা কী শিক্ষা নিলাম? পর্তুগিজেরা প্রথম ভারত মহাসাগর সমুদ্রপথ দখল করেছিল স্রেফ গায়ের জোরে হিংসা চাপিয়ে। দুর্বল মামলুক মিশর সাম্রাজ্যের পক্ষে পর্তুগিজদের আটকানো সম্ভব না হলেও ওমানিরা পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে সবল সফল চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বহুকাল সাফল্য ধরে রেখেছিল। পর্তুগিজেরা ভারত মহাসাগরে যে সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল, সেটা খুব জোরালোও ছিল না কিম্বা কার্যকরও ছিল না। মামলুক মিশর শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ায় মহাসাগরে যে শূন্যতা তৈরি হয় সেই শূন্যতা পর্তুগিজেরা পূরণ করেছিলমাত্র। স্পষ্টভাবে বলা যাক এই অঞ্চলে পর্তুগিজ নৌবহরের উত্থান ‘রাইজ অব ওয়েস্ট’ তত্ত্বে ঘটে নি, কারন তারা খুব একটা নতুন প্রযুক্তি বা ব্যবস্থাপনার ধারণা আনে নি বরং ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় নতুন ধরণের হিংসা ছড়িয়ে সাম্রাজ্য কায়েম করছিল। ওমানিদের উত্থান ঘটে পর্তুগিজদের সমুদ্র হিংসার পাল্টা হিংসা পর্তুগিজদের ওপরে সফলভাবে চাপিয়ে দিতে পারার কারণে। হিংসা, পালটা হিংসার রাজত্ব যে কায়েম হয়েছিল তার প্রমান পর্তুগিজেরা কয়েকটা জায়গায় ওমানিদের সফলভাবে আটকাতে পেরেছিল। সব মিলিয়ে ওমানিরা পর্তুগিজদের সমান্তরাল ক্ষমতার কাঠামো তৈরি করতে সফল হয়েছে। কিন্তু পর্তুগিজ-ওমানি দ্বন্দ্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে রাষ্ট্রব্যবস্থা। মাইকেল পিয়ার্সন ‘মার্চেন্ট এন্ড স্টেটস’, কীর্তি চৌধুরীর ‘ট্রেড এন্ড সিভিলাইজেশন’ বা সঞ্জয় সুব্রাহ্মণিয়ম ‘অফ ইমারত এন্ড তিজারত’ স্পষ্ট বলছেন ইওরোপিয় সাম্রাজ্য বিস্তার সম্ভব হচ্ছে রাষ্ট্র, তার বাহিনী নিয়ে বাণিজ্য কর্পোরেটদের সাম্রাজ্য বিস্তারের পাশে দাঁড়িয়ে বাজার দখল করে দেওয়ার ফলে – অর্থাৎ মার্কেন্টিলিজমের জন্য, যেটা এশিয় উদ্যমে সম্ভব হচ্ছে না। মাথায় রাখবেন, শুধু সমুদ্র রাজপথ দখল হলেই হবে না, উপনিবেশ তৈরি করে, ইওরোপিয় শিল্প কাঠামোর পণ্য না বিক্রি করে উদ্বৃত্ত তৈরি করতে না পারলে এই খরুচে ভর্তুকির কেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থা নির্ভর উপনিবেশ রক্ষা সম্ভব না। ওমানি উদাহরণ থেকে আমরা দেখলাম, রাষ্ট্র ব্যবস্থা উদ্যমী হলে ইওরোপিয় সাম্রাজ্য বিস্তারের বিরুদ্ধপক্ষ হয়েও এশিয় সাম্রাজ্য বিস্তার সফল করা যায়।
তবে ইওরোপিয়রা সামরিক প্রযুক্তিতে এশিয়দের তুলনায় কিছুটা এগিয়ে ছিল এটাও বলা দরকার। পর্তুগিজ কামানবাহী জাহাজের হঠাৎ আক্রমন শত্রুদের বহু সময় বিস্মিত করেই জিত হাসিল করত। ১৫০০এর মাঝখানে ইওরোপিয় কেল্লা প্রযুক্তিও সাম্রাজ্য বিস্তারে কাজে এসেছে। উপনিবেশে একের পর এক কামান সজ্জিত সুরক্ষিত কেল্লাকে ইওরোপিয়রা সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ওমানিরা পর্তুগিজদের মতই একই কায়দায় সাম্রাজ্য বিস্তার করে পর্তুগিজদের বিজিত অঞ্চল দখল করতে থাকে। অর্থাৎ ইওরোপিয়রা যুদ্ধ প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকলেও তারা যুদ্ধ প্রযুক্তি, বা রণনীতিতে এত বেশি এগিয়েছিল না যে ওমানিদের তারা প্রযুক্তি বা রণনীতি দিয়ে দমন করতে পারে। ফলে পর্তুগিজ যুদ্ধ প্রযুক্তি খুব সহজেই ওমানিরা আত্মস্থ করে পর্তুগিজ আক্রমনে যোগ্য জবাব দিয়েছে। সমুদ্রে সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে ওমানি রাষ্ট্র সক্রিয় ছিল। ওমানিদের নিজস্ব সমুদ্র প্রযুক্তির সাথে সাথে ইওরোপিয় প্রযুক্তির মেলবন্ধন করাল। মুঘল, তুর্কি আর পারসিক সাম্রাজ্যের মত ওমানিরা ইওরোপিয় যুদ্ধ প্রযুক্তিবিদদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করেছে।
২]
আমরা দেখলাম ইওরোপিয় শক্তির সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সমান্তরালভাবে পাল্লা দিয়ে ওমানিরাও সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটিয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে মাথায় রাখা দরকার সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজ এস্তাও দা ইন্ডিয়া ছিল ভারত মহাসাগরের পড়ন্ত শক্তি। তবুও কোনওভাবেই ওমানিদের সাফল্যকে ছোট করে দেখা যাবে না। আমরা ইওরোপমন্যতার বাইরে গিয়ে বলতে পারি এই ঘটনাক্রমকে ইওরোপিয় দৃষ্টিভঙ্গীতে ইওরোপিয় ক্ষয়িষ্ণু শক্তির পতন হিসেবে না দেখে একে এশিয় সামুদ্রিক শক্তির উত্থান হিসেবে দেখা দরকার।
এবারে আমরা দেখব কীভাবে চিনা ঝেং রাষ্ট্র ১৬৬২ সালে ক্ষমতাশালী ডাচেদের হাত থেকে তাইওয়ান উপনিবেশ দখল নিল। ওমানিদের ক্ষেত্রে পর্তুগিজেরা ক্ষয়িষ্ণু শক্তি ছিল ঠিকই কিন্তু চিনাদের ক্ষেত্রে ডাচেরা এশিয়াজুড়ে জবরদস্ত শক্তিতে ক্ষমতা এবং উপনিবেশ বিস্তার করছিল। সেই ক্রমবর্ধমান ইওরোপিয় উপনিবেশিক শক্তি, চিনা জলদস্যুর পুত্রের কাছে সব থেকে বড় উপনিবেশটি হারিয়ে বসল।
কোরিয়াও একই পথে চলছিল; দীর্ঘ উপকূল, বহুকালের সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা, খুবই প্রভাবশালী নৌকো বহর – শুধু মাছ ধরার নৌকো নয়, লোহায় তৈরি মোটা কচ্ছপাকার যুদ্ধ জাহাজ এবং তার সঙ্গী অখ্যাত প্যানোকিসন নিয়ে কোরিয়দের সমুদ্র সাম্রাজ্য তৈরির পক্ষে উপযুক্ত শক্তি হয়ে ওঠার সমস্ত প্রতিশ্রুতি ছিল। জাহাজগুলো দ্রুত চলত, শক্তিশালী ছিল এবং বড় কামানে সজ্জিত ছিল। ৫৭ খ্রিপূ থেকে ৬৬৮ খ্রিপূ পর্যন্ত তিন রাজার রাজত্বে কোরিরার সমুদ্র শক্তি হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। নবম শতে কোরিয় ব্যবসায়ীরা চিন এবং জাপান ব্যবসায় খুব বড় ভূমিকা পালন করেছে। এই সময় কোরিয় জলদস্যুরা কোরিয় উপসাগরে জাপানের মাথা ব্যথার কারন হয়ে ওঠে। তারপরে কোরিয়া তার বৈদেশিক যোগাযোগ, ব্যবসা বাণিজ্য হঠাতই রুদ্ধ করে দেয়। ১৩৯২-১৯১০ পর্যন্ত রাজত্ব করা চোসন রাজপরিবার Choson Dynasty মিং চিনের অনুসরণে বৈদেশিক বাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
অন্যদিকে জাপান সরকার সমুদ্র নির্ভর সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেয়, ১৫৯২-১৫৯৮ পর্যন্ত জাপান রাষ্ট্র কোরিয়ায় উপনিবেশ তৈরি করে। জাপান কোরিয়া ছেড়ে চলে গেলেও সে ১৬০৯এ রায়ুকু দ্বীপ এবং ১৬০৯-১৬১৬ পর্যন্ত তাইওয়ান দখলে রাখে। ১৬০০-এর দশকের গোড়ার দিকে, টোকুগাওয়া শোগুনেট তার জনগণকে বিদেশে বাণিজ্য করার অনুমতি দেয় এবং এমনকি তাদের শোগুনাল সার্টিফিকেটের আকারে রাষ্ট্রীয় সমর্থন দিয়েছে, সুরক্ষাও দিয়েছে। আশ্চর্যের কথা এর পরের সময়ে জাপান সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জাপানের সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধকরণের রাজনীতি ১৬৩৯-এ এই অঞ্চলে ইবারিয়দের নিষিদ্ধ করণের থেকেও বেশি প্রভাব ফেলল। কারন এই সময় পূর্ব এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় জাপানি বণিকেরা একচ্ছত্র বাণিজ্যযাত্রা করত। ভূসামরিক ক্ষেত্রে এই নিষিদ্ধকরণের সুযোগ নিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
১৬২০তে চিন সমুদ্রে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিযোগী ছিল না; হতোদ্যম পর্তুগিজদের এই অঞ্চল থেকে তাড়িয়ে দিতে তাদের সময়ও লাগল না। ডাচেদের প্রতিযোগী ছিল তাইওয়ানের জলদস্যুরা। চিনা আমলারা ডাচেদের ফরমোসায় ঘাঁটি তৈরি করতে আহ্বান জানাল। ১৬২৪তে তারা ফরমোসাকে উপনিবেশ বানায়। জাপানি বণিকেরা ডাচেদের সামনে কিছুটা প্রতিরোধ খাড়া করলেও ১৬৩৫ সালে শগুন বণিকদের বৈদেশিক বাণিজ্যযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করায় ডাচেদের সমস্যা মিটে যায়।
ডাচেরা একদা তাদের চিনা দোভাষী এবং জলদস্যু ঝেং ঝিলংএর সঙ্গে মিলে এই অঞ্চল টহল দিত এবং ঝেংএর সহায়তায় স্পেনিয় এবং পর্তুগিজদের জাহাজ লুণ্ঠন করত। ঝেং প্রভাবশালী এবং কার্যকর জলদস্যু হিসেবে চিনা সমুদ্রবিশ্বে নিজেকে ক্রমশঃ প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। চিন সরকার প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযান করলেও ক্রমশ তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করে। চিনারা ১৬২৮এ ঝেংকে তাদের আমলাতন্ত্রে যোগ দিয়ে ডাচেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-অভিযানে আহ্বান জানায়। এলাকার ভূসামরিক ক্রমেই চিত্র পাল্টে যেতে থাকে।
ঝেং নৌবাহিনীতে অসম্ভব শক্তিশালী জাঙ্ক জাহাজে ইওরোপিয় ব্রডসাইড পদ্ধতিতে বড় কামান দাগার প্রযুক্তি বানিয়েছিল। এক চিনা আমলা লিখছেন, ‘তার জাহাজগুলো বিদেশি বর্বরদের জাহাজের মত উঁচু, চওড়া আর শক্তিশালী… কামানগুলো যথেষ্ট কার্যকর, দশ লি দূর থেকে নির্দিষ্ট টার্গেটে আঘাত করতে সক্ষম his ships are built like those of foreign barbarians, tall and sturdy. . . . His cannons are very eff ective, shooting from a distance of ten li and smashing their targets’। একই বয়ান আমরা ডাচেদের সমীক্ষাতেও পাচ্ছি। ঝেংএর বাহিনীতে ২৫টা বড় জাঙ্ক ছিল, কোনও কোনও জাঙ্কে ৩৬টা কামান থাকত। ‘সুন্দর, বড়, সুসজ্জিত অস্ত্র সুসজ্জিত জাঙ্ক… চীন সমুদ্রে আগে দেখা যায়নি Such an armada of beautiful, big, well-armed junks . . . has never been seen before in China’। আজ আর ঝেংএর জাহাজের আকার বোঝা অসম্ভব না কিন্তু খুব সম্প্রতি পিটার স্যাপিনসকির (লর্ডস অব দ্য সি পাইরেটস ভায়োলেন্স এন্ড কমার্স ইন দ্য লেট মেডিভ্যাল জাপান) জাপানি জাহাজের আকার আলোচনায় কিছুটা আন্দাজ করতে পারি।
প্রাথমিকভাবে ঝেং ডাচেদের সঙ্গে সমঝোতা করে চিনা বাণিজ্যে সহায়তার প্রস্তাব দিলেও ডাচেরা সে প্রস্তাবে খুশি হয়নি। ডাচেরা ঝেংএর নোঙর করা শক্তিশালী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। ঝেং আরও একটা জাহাজ বানায় এবং ১৬৩৩এ শয়ে শয়ে চিনা জলদস্যুর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ডাচেদের পরাজিত করলে তারা মাথা নামিয়ে ঝেংএর দেওয়া শর্ত মানতে বাধ্য হয়; এরপর তার জাঙ্ক চিন অবাধে চিন-তাইওয়ান বাণিজ্য করেছে। একেরপর এক জাঙ্ক বিপুল বাণিজ্য পণ্য নিয়ে তাইওয়ানের বন্দরগুলোয় ক্রমশ নোঙর ফেলছে। তারা শুধু জাপান থেকে রেশম আর পোর্সেলিনের মত ধনী ভোগ্য দ্রব্যই আনছে না, চিনা উপনিবেশ তাইওয়ানের অধিবাসীদের কাছে বিক্রিযোগ্য পণ্য যেমন নুন, কাপড়, লোহার মত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যও আমদানি করত। তাইওয়ানের আর্থিক বাড়বাড়ন্তের ফলে ঝেং ঝিলং ধনী হতে শুরু করেন। ১৬৪০এর প্রথম দিকে ফুজিয়ান প্রদেশের প্রায় সমস্ত জাহাজ ঝেংএর পতাকা বহন করত। ঝেংএর হাত ধরে এই সময় চিনা বৈদেশিক বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটে।
১৬৪৬এ চিনে কুইং রাজত্ব শুরু হতেই কৌশলে ঝেংকে বন্দী করা হয়। ১৬৪৪ সালে চিনের রাজধানী দখল নিয়ে কুইং পরিবার চিন জুড়ে তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ খুঁজছিল। ঝেং যেহেতু পুরোনো রাজপরিবারকে সমর্থন দিয়েছিলেন তাই নতুন রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে তার উপস্থিতি ভীতপ্রদ হয়ে ওঠে। কিন্তু ঝেংকে গ্রেফতার করেও তাদের লক্ষ্য পুরণ হল না, ঝেংপুত্র, ঝেং চেংগং বাবার থেকেও আরও প্রভাবশালী, আরও ভীতিপ্রদ আরও দূরগামী হয়ে উঠল।
পুত্র ঝেং এর সময়ে ঝেং পরিবার আর শুধু বাণিজ্যে সন্তুষ্ট রইল না সে নতুন রাষ্ট্র মিং মেমোরিয়াল প্রিফ্যাকচার প্রতিষ্ঠা করে, আমলাতন্ত্র তৈরি করে, রাজস্ব বৃদ্ধি করে, বৈদেশিক বাণিজ্যে যোগদান করে। তার শক্তিশালী সেনাবাহিনী দক্ষিণ চিন সাগরে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বেশ কিছু যুদ্ধ জয়লাভ করে। নতুন রাষ্ট্রের দুইতৃতীয়াংশ রাজস্ব আসত সমুদ্র বাণিজ্য সূত্রে। নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভবে ডাচেরা সিঁদুরে মেঘ দেখে। ডাচেরা তার জাহাজ দখল আর ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। ডাচ আর ঝেং পরিবারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, সেটি অচিরেই ভেঙে পড়ে।
১৬৬১তে কুইং বাহিনী তার রাষ্ট্র দখলের উদ্যম নিলে সে তাইওয়ানে রাষ্ট্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই বছরের এপ্রিলে বিশাল বাহিনী নিয়ে সে তাইওয়ানে পা রাখে; ২০০০০ চিনা তাইওয়ানে নেমে তাইওয়ানকে চিনের উপনিবেশে রূপান্তরিত করে ডাচেদের অধিকাংশ ঘাঁটি ধ্বংস করে তাদের মূল সুরক্ষিত ঘাঁটি ফোর্ট জিল্যান্ডিয়া অবরোধ করে। ৯ মাসের দীর্ঘ লড়াইএর পরে ঝেং বাহিনী জিল্যান্ডিয়া দখল নেয়। ১৬৬২তে ডাচেরা তাদের এশিয়ার সব থেকে বড় উপনিবেশটি এক চিনা জলদস্যুর পুত্রের হাতে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
৩]
আমাদের শেষ উদাহরণ মুঘল আমলের প্রথম ছয় সম্রাটের শেষ সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষের দিকে ইওরোপিয়দের কাছে সমুদ্র ত্রাস হয়ে ওঠা মারাঠা সমরনায়ক কানহজী আংরে এবং তার উত্তরাধিকারীদের তৈরি করা সমুদ্র শক্তি। মারাঠি আংরে পরিবার দক্ষিণ এশিয় রাজনীতিতে ৫০ বছর ধরে সিদ্ধি, পর্তুগিজ, ডাচ এবং ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা বিস্তারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে এবং এক সময় পর্তুগিজ ঘাঁটি গোয়া দখলের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। অথচ দক্ষিণ এশিয় ইতিহাসচর্চায় আজও কানহজী আংরে শুধুই জলদস্যু। ডেভিড এবারান্থির (David Abernathy) ‘দ্য ডায়নামিক্স অব গ্লোবাল ডমিন্যান্স- ইওরোপিয়ান ওভারসিজ এম্পায়ার’ সূত্রে বলতে পারি সাম্রাজ্য এবং উপনিবেশ নিয়ে পশ্চিমি ইতিহাসচর্চার বয়ান হল ‘উপনিবেশিত জনগণের ভাগ্য উপনিবেশিক শাসকদের ক্রীড়ানক হিসেবে ব্যবহার হওয়া; উপনিবেশিক শাসকদের উদ্যমে প্রতিক্রিয়ায় ক্রিয়ান্বিত হওয়া’। এইভাবেই আংরে পরিবারকে দেখা হয়েছে ইওরোপিয় ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়ার শক্তি হিসেবে। অথচ দক্ষিণ এশিয় ইতিহাসে আমরা জানি ৫০ বছর ধরে মারাঠা নৌসেনাধ্যক্ষ্য আংরে পরিবার কোঙ্কনি সমুদ্র অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল; তাদের চাপে ইওরোপিয়রা পালটা সামরিক রণনীতি তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে।
ইওরোপিয় সাম্রাজ্যবাদ যেমন ইওরোপিয় সাম্রাজ্যের ব্যক্তি/গোষ্ঠীর লুঠেরা প্রবৃত্তি, খুন বা গণহত্যার ইতিহাস, দাস ব্যবসার বাখান বা সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রবৃত্তি/কর্ম লুকোতে যেমন তাদের অভিযাত্রিক, দার্শনিক, অর্থশাস্ত্রী, আবিষ্কারক, গবেষক, ইতিহাস বা প্রকৃতিচর্চক, সভ্যতা বিস্তারের দূত ইত্যাদি ভাল ভাল নামে অভিহিত করেছে তেমনি ইওরোপিয় সাম্রাজ্য বিস্তারের সামনে আড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অইওরোপিয় মানুষ/গোষ্ঠীকে ডাকাত, খুনি, বর্বর, আক্রমনকারী দেগেছে। এই ঘটনা তারা ঘটিয়েছে মারাঠা সমুদ্র সেনাপতি কানহজী আংরের ইতিহাস বর্ণনায়। নবজাগরণী দার্শনিক ডেভিড হিউম আংরের চরিত্র বাখানে যে উপনিবেশিক কাঠামো তৈরি করে দিয়ে যান, আজও ইতিহাসচর্চকেরা সেই নির্মাণ থেকে বার হতে চান না – বরং প্রায় প্রত্যেকেই সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানির বয়ানেই আংরেকে চিত্রিত করেছেন। ১৯০৭এ জন বিডুলফের ‘দ্য পাইরেটস অব মালাবার এন্ড এন ইংলিশওম্যান ইন ইন্ডিয়া’য় আংরে জলদস্যু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। ১৯২০র দশকে ফিলিপ গোসি আংরেকে অভিহিত করলেন Brother of a famous pirate, Angora, Sultan of Timor হিসেবে; এই দাবি শুধু অনৈতিহাসিকই নয়, চরম মিথ্যাচারও বটে। অথচ অষ্টাদশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বয়ান অনুসরণ করে আংরে পরিবারের ইতিহাস রচনা হতে থাকে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জেরে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন আসে; ক্রমশ স্বীকার করে নেওয়া হয় কানহজী আংরের মারাঠা নৌবাহিনীর অন্যতম প্রধান নৌসেনাপতি বা সরইখেইল। ১৯৫১য় তার নামে একটি নৌঘাঁটির নামকরণ করা হয়। ততদিনে সক্রিয় মারাঠা হিন্দু জাতীয়তাবাদ কানহজী আংরেকে প্রথম হিন্দু সাম্রাজ্যের নৌসেনাপতি এবং তার উদ্ভবের শ্রেয় দেয় মুসলমান সাম্রাজ্যের পতনের সূত্রে।
বাংলার হিন্দু নবজাগরণের প্রভাবে মারাঠা হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ ঘটলেও জাতীয়তাবাদী এবং মারাঠি ইতিহাসে কানহজী আংরের অবদান ছোট্ট পাদটিকা হিসেবে গণ্য হয়েছে। এমনকী বম্বে এবং ভারত মহাসাগরকে নতুন দৃষ্টিতে দেখা ঐতিহাসিক লক্ষ্মী সুব্রহ্মণিয়মও (অন পাইরেটস এন্ড পোটেনটেটস, ম্যারিটাইম জুরিসডিক্সন এন্ড দ্য কন্সট্রাকশন অব পাইরেসি ইন দ্য ইন্ডিয়ান ওসান) তাঁকে জলদস্যুর বেশি সম্মান দিতে অস্বীকার করেছেন। তিনি মূলত কানহজী বিষয়ে ব্রিটিশ বয়ানকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। জাতীয়তাবাদের চক্করে পড়ে কানহজীর যে ঐতিহাসিক পুনর্বাসনের আশা জেগেছিল, সে আশা সুদূরপরাহত হল। তবে সম্প্রতি গবেষক ডেরেক এলিয়ট ‘পাইরেটস পলিটিক্স এন্ড কম্পানিজ – গ্লোবাল পলিটিক্স অন কোঙ্কনি লিটোরাল ১৬৯০-১৭৫৬’ গবেষণা পত্রে কানহজী আংরের অবদানকে নতুন দৃষ্টিতে তৌল করার উদ্যম নিয়েছেন। আমার এই রচনা তাঁর প্রবন্ধ এবং আরও কিছু বই অবলম্বন তৈরি হয়েছে।
মনোহর মালগাঁওকরের ‘কানহজী আংরে, মারাঠা এডমিরাল’ এবং সুরেন্দ্র নাথ সেনের ‘আর্লি কেরিয়ার অব কানহজী আংরে’ জানাচ্ছে ১৬৮৮তে মারাঠা শাসক শম্ভাজীর নির্দেশক্রমে কানহজী সুবর্ণদুর্গ কেল্লার প্রশাসনিক প্রধান মনোনীত হন। দশ বছর পর মারাঠা সম্রাট রাজারাম, তাঁকে মারাঠা নৌবাহিনীর উত্তর ডিভিশনের সুবাদার নিযুক্ত করেন। মনে হয় তখনও আংরে পরিবার মারাঠা নৌবাহিনীর একচ্ছত্র সেনাপতিত্ব অর্জন করেন নি। ক্রমশ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মারাঠা নৌবহরের মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ ঘটতে থাকে, প্রথম দিকে মাঝেমধ্যে তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে সমঝোতা-দ্বন্দ্বের কূটনৈতিক চাল চেলে নিজের অবস্থান জোরদার করছেন। কালক্রমে সমুদ্রে কানহজী আংরের দক্ষতায় তার নেতৃত্বে নৌবহর পরাক্রমশালী হয়ে উঠল। তিনি দস্তক এবং কার্তেজ উভয়ই জারি করতেন। ১৫০০ থেকে কার্তেজ পর্তুগিজেরা জারি করত সমুদ্রে ছাড়পত্র হিসেবে। তার একশ বছর পরে ব্রিটিশ আর ডাচেরাও সমুদ্র ছাড়পত্র জারি করেছে। পর্তুগিজেরা ক্রমশ শক্তিহীন হলে ডাচ আর ব্রিটিশেরা সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অষ্টাদশ শতকে বুদ্ধিমান ব্যবসায়ীরা দুটো ছাড়পত্রই সংগ্রহ করতেন, যদিও সঞ্জয় সুব্রহ্মনিয়ম এবং সুশীল চৌধুরী বলছেন, ইওরোপিয় ইতিহাসে এশিয় সমুদ্রে পর্তুগিজদের যতটা সর্বব্যাপী দেখানো হয়েছে, সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণে তাদের ততটা ক্ষমতা ছিল কিনা সন্দেহ। পর্তুগিজদের ১০০ বছর পর এবং তারপরেরও ১০০ বছর ধরে ব্রিটিশেরা প্রায় বাধাহীনভাবে মালাবার এবং কোঙ্কণ উপকূলে দখলদারি কায়েম করেছে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোনও রকম কার্তেজ বা দস্তককে পরওয়া করত না। কানহজীর সবল আবির্ভাব সূত্রে বম্বে থেকে আরব বাণিজ্যপথ এবং পারস্য সমুদ্র রাস্তার দখলদারি নিয়ে কানহজী-ব্রিটিশ সংঘাত লাগল। ব্রিটিশ কোম্পানির ইতিহাসকার এবং আমলা ক্লেমেন্ট ডাউনিংএর জাহাজকে ১৭১৬র সেপ্টেম্বরে কানহজীর বাহিনী চ্যালেঞ্জ জানায় এবং ছাড়পত্র দেখতে চায়। ক্যাপ্টেন ছাড়পত্র দেখিয়ে ছাড়া পায়। ততদিনে কানহজী ইওরোপিয় পদ্ধতিতে সমুদ্র দখলদারির ব্যবস্থা তৈরি করেছেন।
১৭১৫ সালে বোম্বের প্রশাসক চার্লস বুনি কানহজীর বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর নৌবহর তৈরি করতে ৫১৭০০ পাউন্ড ব্যয় করে ২৫টা ৫ থেকে ৩২টা কামানের নতুন ধরণের যুদ্ধ জাহাজ এবং সমুদ্রের তীরে কুঠীতে সুরক্ষা প্রাচীর তৈরির কাজ করান। মাথায় রাখতে হবে কোঙ্কণ উপকূলে এর আগে ব্রিটিশেরা খুব একটা দাদাগিরি ফলাতে পারে নি। ১৬৮৫ সালে হুগলিতে মুঘলদের বিরুদ্ধে হারের পরে ব্রিটিশ কোম্পানির লন্ডনের কর্তারা বম্বেতে মারাঠাদের বিরুদ্ধে আক্রমনে যেতে রাজি ছিল না। তারা বারবার বম্বের কর্তাদের স্থানীয় রাজনীতিতে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে। বম্বে ছিল মুঘল নৌবাহিনী সিদ্দিদের ঘাঁটি। সেখানে নতুন করে সুরক্ষা প্রাচীর তৈরি করা সমস্যার ছিল।
১৭০০/০১এ সিদ্দিরা আংরের বাহিনীকে আক্রমন করে মারাঠদের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি কোলাবা আর খাণ্ডেরি ঘেরাও করে। সিদ্দিরা এই লড়াই জিততে পারে নি; এর পর থেকে তীব্র উৎসাহে কানহজী সমুদ্রপথ দখল নিতে থাকেন দেশিয় বণিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিনিময়ে। মালগাঁওকর বলছেন ১৭০২তে ব্রিটিশেরা প্রথম কানহজীর সঙ্গে অনাক্রমন চুক্তি ভেঙে আংরের দস্তকওয়ালা জাহাজ দখল নেয়। দু’দলের মধ্যে বিফল আলাপ আলোচনা চলতে চলতেই ১৭০৩এ কানহজী সাতটা জাহাজ নিয়ে বম্বে হারবার অবরোধ করেন। ব্রিটিশেরা নিচু গলায় আলাপ আলোচনা শুরু করতেই আংরে উচ্চৈস্বরে জানান মারাঠারা ৪০ বছর ধরে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, মালাবার উপকূলে কানহজীর ছাড়পত্র নিয়ে ব্রিটিশেরা যেখানে খুশি যেতে পারে। তিনি ব্রিটিশদের অঞ্চলের ওপর দখলদারির দাবি নস্যাৎ করে বলেন ব্রিটিশেরা মারাঠা অঞ্চলে ব্যবসা করছে, মারাঠারা ব্রিটিশ অঞ্চলে নেই।
পরের আট বছর কানহজী তার দস্তক ছাড়া সমুদ্র যাত্রা করা প্রত্যেকটি দেশিয় এবং ইওরোপিয় জাহাজ দখল নিলেন। ভূমি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে বরাবরের মত ইওরোপিয়রা সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করলেও মারাঠাদের দ্রুতগতি হালকা ঘুরাব জাহাজের দৌড়ের কাছে পেরে উঠছিল না। ১৭৩৬ পর্যন্ত আংরের কোনও জাহাজ ধরা পড়ার খবর নেই। মালগাঁওকর বলছেন এর ফলে আংরের বাহিনী এতই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠল যে মারাঠা নৌ বাহিনীকে ধ্বংস করতে ইয়োরোপীয় শক্তি পাল্টা আঘাত নামিয়ে আনতে পারল না, কারন মারাঠা সাম্রাজ্য সমুদ্র ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল নয়। ফলে আংরের বাহিনীকে যেহেতু মারাঠা বাণিজ্য জাহাজকে নিরাপত্তা দিতে হচ্ছিল না, তাই আংরের নৌবহর খুল্লমখুল্লা দস্তক ছাড়া ইওরোপিয় বিশেষ করে ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে আক্রমন করতে থাকে। বি কে শ্রীবাস্তব ‘দ্য আংরে’জ অব কোলাবা ইন ব্রিটিশ রেকর্ডস’এ বলছেন ১৭২৪ সালে ব্রিটিশ প্রশাসক ফিপসের চিঠি প্রমান, তারা আংরেকে স্থানীয় সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল।
১৭০০-র প্রথম দশকের দীর্ঘস্থায়ী মারাঠা গৃহযুদ্ধেও আংরের বাহিনী কোঙ্কণী উপকূলে টহলদারি করেছে। ১৭১০এ বেশ কয়েকটা ডাচ স্লুপ আর গ্যালিস দখল নেয় আংরের বাহিনী। ১৭১২য় কারওয়ার কুঠিয়াল রবার্ট চাউন আর তার স্ত্রীকে বহন করা জাহাজ এনি দখল নেওয়ার যুদ্ধে চাউন মারা যান আর তার বিধবাকে ৩০০০০ টাকার মুক্তিপণ চেয়ে বন্ধক করা হয়। এই সময়ে উপকূল অঞ্চলে দখলদারি বাড়াতে ক্রমাগত উপকূলের পর্তুগিজ কেল্লাগুলির ওপর নিয়মিত আক্রমন শানাতে থাকে কানহজী বাহিনী। ইতিমধ্যে পর্তুগিজেরা সিদ্দিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মারাঠা নৌবাহিনীর ওপর আক্রমন শানাতে শুরু করে। মারাঠা গৃহযুদ্ধর শেষের দিকে আংরে সিদ্দিদের বিরুদ্ধে কামান দাগতে শুরু করেন। মারাঠা আর মুঘলদের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে কানহজীর সঙ্গে সিদ্দিদের বৈরিতা শেষ হয় কিন্তু ইওরোপিয়দের সঙ্গে কার্তেজ/দস্তক নিয়ে নতুন করে যুদ্ধপরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। বৈরিতার পরিবেশে ব্রিটিশরা ১৭১৭য় নতুন ১৭টি যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করেও আংরে বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠল না। অথচ ব্রিটিশরা চাইত মারাঠারা তাদের স্বতন্ত্র রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দিক। মারাঠারা ব্রিটিশদের দাবিকে ফুতকারে উড়িয়ে দিয়ে ক্রমান্বেয়ে কার্তেজ/দস্তকহীন একের পর এক জাহাজে আক্রমন শানাতে থাকে। গভর্নর বুনি নতুন জাহাজ নিয়ে এবং নতুন সুরক্ষা জাল তৈরি করে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে মারাঠা বাহিনী/কেল্লার ওপর আক্রমন শানালেও সফল হলেন না। কিন্তু বুনি হাল ছাড়লেন না। তিনি সিদ্দি, সুরাটি মুঘল ব্যবসায়ী, পারসিক ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের সঙ্গে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যৌথ আক্রমণের কথাবার্তা চালালেন। কোনওটাই সফল হল না। ইতিমধ্যে ইংলন্ড থেকে নতুন এক উন্নতমানের যুদ্ধ জাহাজ পৌঁছল, বাহিনী আক্রমণে গেলে প্রযুক্তিগত ত্রুটির জন্যে সেটি ব্যবহার করা গেল না উলটে কামান ফেটে পাঁচ সৈন্য প্রাণ হারাল। আক্রমন ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ বাহিনী বম্বে ফিরে আসে।
১৭২১ সালে কোলাবা দখল নিতে ব্রিটিশদের সঙ্গে পর্তুগিজেরা হাত মেলায়। স্থল আর নৌবাহিনী নিয়ে আক্রমন শানায় যৌথ ইওরোপিয় বাহিনী। আক্রমনে ছিলেন গোয়ার ভাইসরয় ডন এন্টোনিও ডি কাস্ত্রো। আগে থেকে খবর থাকায় সাহুর বিশাল ২৫০০০ সেনা আংরের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। দুই ইওরোপিয় বাহিনীর মধ্যে তালমিল না গড়ে ওঠায় এই আক্রমন চরম ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ বুনি অবসর নিয়ে দেশে ফিরে যান।
পর্তুগিজদের সঙ্গে আংরের চুক্তি ছিল ব্রিটিশ বাহিনী মারাঠাদের আক্রমন করতে এলে তাদের গোয়ায় আশ্রয় দিতে হবে এবং মারাঠাদের বিরুদ্ধে পর্তুগিজেরা ব্রিটিশদের সাহায্য করবে না। বুনির ব্যর্থ হয়ে চলে যাওয়ার পরে ফিপস বম্বের প্রধান হয়ে এসে নতুন কয়েকটা জাহাজ বানানো হয়। লন্ডনের কর্তারা আংরের বিরুদ্ধে অসফল যুদ্ধ অভিযানের খরচ চালাতে অস্বীকার করে। বম্বে এলাকার বাইরে ব্রিটিশেরা কানহজীর সার্বভৌমত্ব কার্যত মেনে নেয়।
১৭২৯-এর ৭ অক্টোবর ব্রিটিশেরা কানহজী আংরের মৃত্যুর এবং কানহর পুত্র, উত্তরাধিকারী সুখজী দায়িত্ব নেওয়ার সংবাদ পেল। সুখজী, বাবা কানহর তুলনায় এতই চটপটে ছিল যে তার সামনে আসা যে কোনও ব্রিটিশ পর্তুগিজ সিদ্দি জাহাজই ধ্বংস করে দিত। ১৭৩৩এ সুখোজীর মৃত্যুর পর নেতৃত্ব নেওয়ার ভার পড়ল সম্ভাজীর ওপর। ১৭৩৫ সালে পেশওয়া বালাজী বাজিরাও উত্তর কোঙ্কনের দায়িত্ব দিলেন সম্ভাজীর সৎ ভাই মানাজীকে। ১৭৪৯এ সাহুজীর মৃত্যুর সময় ক্রমশ আংরে পরিবারের সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ কমতে শুরু করে; মানাজী ছাড়া আর কোনও পুত্রই কোঙ্কণ উপকূলে আংরে পরিবারের যথাযোগ্য নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারেন নি। ভায়েদের মধ্যে কলহ আর যুদ্ধে আংরেদের ক্ষমতা হ্রাস হল। ১৭৩৭এ শম্ভাজী মোকা কফি ভর্তি ব্রিটিশ জাহাজ দখল নেয়। ১৭৪৩সালে তুলাজী শম্ভাজীর উত্তরসূরী সরইখেইল নিযুক্ত হন। ১৭৫৫ পর্যন্ত তুলাজী উপকূলে টহল চালিয়ে যান। ১৭৫৫তে পেশওয়া তুলাজীর সমুদ্র নেতৃত্ব অস্বীকার করলে একটি যুদ্ধে তুলাজী ব্রিটিশদের হাতে আত্মসমর্পণ করলে আংরেদের শেষ শক্তিও নিশ্চিহ্ন হয় এবং ব্রিটিশদের সার্বভৌম ক্ষমতা নিশ্চিত হয়।
সূত্র: Tonio Andrade, Beyond Guns, Germs, and Steel: European Expansion and Maritime Asia, 1400-17501; Derek L. Elliot, Pirates, Polities and Companies: Global Politics on the Konkan Littoral, c.1690-1756 এবং লেখার মধ্যে উল্লিখিত বইগুলি।
বিশ্বেন্দু নন্দ
লেখক, গবেষক, সংগঠক, প্রকাশক। উপনিবেশপূর্ব সময়ের সমাজ অর্থনীতিতে কারিগরদের ইতিহাসের খোঁজে সর্বক্ষণের কর্মী। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন বিক্রেতাদের বিষয়ে লিখেছেন নিরন্তর। বাংলার উপনিবেশপূর্ব সময়ের পরম্পরার চাষী-হকার-কারিগর-ব্যবস্থা বিষয়ে খোঁজ করছেন। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। ‘পরম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব, ম্যান এন্ড দ্য মিথ, স্বেন বেকার্ট এম্পায়ার অব কটন, যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেসন, আহকমই আলমগিরি অনুবাদ করেছেন। পলাশীপূর্বের বাংলার ৫০ বছর, পলাশীপূর্বের বাংলার বাণিজ্য দুটি মৌলিক পুস্তকের রচয়িতা।
Post Views: 780