।। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন।।
তারপর নীলকণ্ঠ পাখী কৈলাশে উড়ে গিয়ে শিবঠাকুরকে খবর দেয়, ওগো তোমার বউ এবার তোমার বাসায় ফিরবে, তুমি আর নেশাভাঙ কোরো না, করলে খবর আছে৷ তারপর গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা-যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে ভেসে কীভাবে যে উমা মা তাঁর বরের কাছে ফিরে যান, কে জানে! সতী, পার্বতী, গৌরী, উমা- বিভিন্ন নামের এই একজনই দেবী, ইনি তো আসলে সেই আদিতন্ত্রের শক্তির রূপপ্রকাশ। যে তন্ত্র তখনও ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতে বিকৃত জাদুবিদ্যা আর দেহতত্ত্বনাম্নী দেহকে উপায় করে তোলার বিদ্যায় পর্যবসিত হয় নাই… বরং বাংলার তন্ত্র বেদের সমান্তরাল এবং তা জ্ঞান বা বিদ্যার বিমূর্তায়নের বিরোধী। বরং এই তন্ত্র হলো বস্ত, দেহ, প্রকৃতি, ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কিত এবং নিত্য অভ্যাস, যোগ ও সাধনা নির্ভর।
শুভ শারদীয়া। শারদোরৎসব বৃহৎ বঙ্গের উৎসবগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। এই উৎসবের আজকের চেহারার ইতিহাসের মধ্যে ঔপনিবেশিক ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও উমার ঘরে ফেরার পুরাকথার সেলিব্রেশন উপলক্ষে বঙ্গের কৃষিজীবী জনতার আহ্লাদ বহু পুরানো। ঔপনিবেশিক সময়কাল বৈদিক দুর্গাকে উমার সঙ্গে একত্ব করে একটি বাবু সংস্কৃতির জন্ম দিতে চেয়েছে বটে, কিন্তু আদতে সেই দুর্গোৎসবও গণমানুষের উৎসবই হয়ে উঠেছে ক্রমশ। উমা ও দুর্গার প্রসঙ্গে পরে আসি। তার আগে জানিয়ে রাখা দরকার এ বছর গোটা বাংলাদেশে প্রায় ৩২ হাজার সর্বজনীন দুর্গাপূজার আয়োজন হয়েছে। বহু বছর বাদে বাংলাদেশে দুর্গাপূজার ছুটি বেড়েছে। দুর্গাপূজাকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় অনুদানও রয়েছে। ঢাকার পাশপাশি বাংলাদেশের সবকটি মেট্রো শহরে এবং অন্যান্য জেলার সর্বত্র বারোয়ারি দুর্গাপূজা এবং বাড়ি ও মন্দিরের পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ঢাকার থেকেও চট্টগ্রামে দুর্গাপূজা ঘিরে উন্মাদনা বেশি। থিমের পূজায় ঢাকাকে বহু আগেই ছাড়িয়ে গিয়েছে চট্টগ্রাম। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ সংখ্যাগুরু হলেও শারোদৎসব বরাবরাই এ দেশের উৎসবগুলির মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে। উৎসবে সব মানুষের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। যদিও একদল জাতিবাদী মূর্খ অথবা বাংলাদেশকে কালিমালিপ্ত করার আকাঙ্খায় চালিত হওয়া ক্ষুদ্র অংশের নাগরিক মূর্তি ভাঙার মতো অপকর্ম করার পাশাপাশি নানাবিধ সহিংসতা প্রকাশের চেষ্টা চালায়, তারা নিশ্চয়ই উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিওয়ালাদের বলয়েরই কেউ, তারা নিশ্চয়ই ইসলামের চাদর গায়ে জড়ায়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সম্প্রসারণের সুযোগ করে দিতেই এমনটা করে। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক জনতা যেন এই অপরাজনীতির কারবারিদের বিষয়ে সজাগ থাকেন। আমাদের মনে রাখা উচিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশের মুসল্লিদের বড় অংশ রাত জেগে মন্দির পাহারা দিয়েছেন, যাতে করে এ দেশের জনগণকে হীন প্রমাণ করার ফ্যাসিস্ট চক্রান্ত কার্যকর না হয়। গণঅভ্যুত্থান যে অভিপ্রায়ে সংগঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম, একটি সমন্বয়বাদী বা ইনক্লুসিভ সমাজ কাঠামো গঠন যেখানে কোনও বৈষম্য থাকবে না, সংখ্যা, সংখ্যালঘু থাকবে না। সকলেই নাগরিক। সকল নাগরিকের নাগরিক তথা মানবাধিকার ও প্রাণ-প্রকৃতির সমন্বয় যে সমাজ গঠনের মূলগত বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারে। এমন বাংলাদেশ গঠনের অভিপ্রায় মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেও ছিল, আর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সেই অভিপ্রায় আরও বড় আকারে হাজির হয়েছে। এবং সেই প্রক্রিয়া আজও জারি আছে। আমরা দেখতে পেলাম দুর্গাপূজায় সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে একদল দুর্গাপূজা মণ্ডপে হাজির হলেন, সেখানে ইসলামি গান গাইলেন। কিন্তু তার অর্থ নেতিবাচকভাবে এটা দাঁড়ালো যে সনাতনী সংস্কৃতির ওপর মুসলমানরা বোধহয় সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব কায়েম করতে চেয়েছে! যদিও যারা ইসলামি গান গাইলেন, তাঁদেরও মাথায় রাখা উচিত ছিল কোন্ গান কোথায় তাঁরা গাইবেন, কোন কথা কী পরিপ্রেক্ষিতে সামনে আনা উচিত। সেই হুঁশ তাঁদের কতটা ছিল না জানা নাই। চট্টগ্রামের যে মণ্ডপে এই ঘটনা, সেই পূজা কমিটির কর্তারাই বা কেন ওই গ্রুপকে মঞ্চে উঠতে দিলেন, সে প্রশ্নও উঠে আসছে সঙ্গত কারণেই৷
এখন আসি পশ্চিমবঙ্গের কথায়।
পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজার সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা বেশি। সেটাই স্বাভাবিক কারণ, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুর বসবাস বাংলাদেশের চেয়ে ঢেড় বেশি। আবার পশ্চিমবঙ্গে ঈদ বা শবে-বরাতের মতো মুসলিম পরবগুলির বহর ও জাঁকজমক বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। বরং সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মাঝে মুসলিম অনুষ্ঠানগুলির সাংস্কৃতিক প্রভাব নগণ্য। বাংলাদেশে কিন্তু দুর্গাপূজাকে উৎসব আকারে ধরে নিয়ে তার সাংস্কৃতিক প্রভাব সব অংসের মানুষের মাঝেই দৃশ্যমান। তারপরেও পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রচার চালানো হয়, বাংলাদেশে হিন্দুরা সেইফ নয়, দুর্গাপূজায় বাধা দেওয়া হয় প্রভৃতি। এদিকে বিহার বা উত্তরপ্রদেশে হিন্দিভাষী হিন্দুরা যখন দুর্গাপূজায় নানা বাধা দেওয়ার পাশাপাশি যেসব জুলুম চালায়, যার খবর মাঝে মাঝেই মাসমিডিয়ার বদৌলতে গণচক্ষুর প্রকাশ্যে চলে আসে, সেই বিষয়ে কোনও কথাবার্তা নাই পশ্চিমবঙ্গে, হায়! পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান কেউ শারোদৎসবে প্রাণবন্তভাবে শামিল হলে কলকাতার বাবু বাঙালিরা যতটা আহ্লাদিত হন, তার সিকিভাগ উদ্যোগও তাঁদের মাধে দেখা যায় না ঈদের সামাজিকতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। হায়! এদিকে কলকাতায় আরজিকর হাসপাতালে চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারীদের অনেকে শারদোৎসব বয়কট করছেন, সেটা করতেই পারেন, কিন্তু আন্দোলনের নামে কাউকে উৎসবে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া অনুচিত। বিশেষত এই উৎসবের সঙ্গে বিকেন্দ্রীভূত গণঅর্থনীতি জড়িত, হকার, কারিগর, কুমোর, মণ্ডপশিল্পী, মরশুমি ব্যবসায়ীরা জড়িত, তাঁদের পেটে লাথি মারার দরকার ছিল না। দরকার ছিল না গরিব মানুষকে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত করার।
এই বাবুদের অনেকেই, যাঁরা মূলত জাতিবাদী, তাঁদের প্রচার, ঈদ তো বাইরের সংস্কৃত, উপমহাদেশের নয়। তাঁদের অবগত করি, হরগৌরীকেন্দ্রিক, পুরুষ প্রকৃতির দ্বৈতাদ্বৈত সত্তার ভজনা বঙ্গে প্রাচীন হলেও মহিষাসুরমর্দিনী তো গৌরী বা উমা নন, বরং এই মিথ বৈদিক। বৈদিক কালচার বঙ্গের নয়। এই বৈদিক সংস্কৃতি তো বঙ্গের উমার অভিসন্দর্ভকে দখল করেছে। আদিতন্ত্রের দেশ বঙ্গে তো বেদ বহিরাগতেরই বয়ান। যদিও বৈদিক সংস্কৃতিও বাংলায় মিশেছে। কিন্তু ইসলাম বাংলায় যে কাজটা করেছে তা হল, অবৈদিক যে অংশের মানুষেক বর্ণাশ্রমবাদীরা শূদ্র চিহ্নিত করে নীচুতলায় ফেলে রেখেছিল, তাদেরকে জাতপাতহীন জীবনবিধি ও এবাদত তরিকায় নিয়ে এসেছে। ফলে বাংলার ভূমিসন্তানরাই ইসালমের ছত্রছায়ায় গিয়েছে। ইসলামও নদীমাতৃত দেশের ফুল-ফল-সুর ও আদবের সঙ্গে নিজের রূপসম্প্রসারণ করেছে। এবার আসি বঙ্গের উমার কথায়।
উমা ও দুর্গা
বাংলায় শারদোৎসব উমার আপন ঘরে ফিরে আসা কিংবা বাবা গিরিরাজ ও মা মেনকার ঘরে মেয়ে উমার ভ্রমণে আসার উৎসব। উমার মাতৃভূমি হল বড় বাংলা৷ শিব কৈলাশ থেকে ব-দ্বীপ বঙ্গে নেমে এসেছিলেন গৌরীপ্রেমে। পশুপালন থেকে ক্রমে শিখেছিলেন কৃষিকাজ। বড় বাংলা তাই হরগৌরীর ভজনা করে, দ্বৈতাদ্বৈতে। পুরুষ ও প্রকৃতির রূপদ্বৈত যখন প্রেমের ভিতর দিয়ে এক হয়ে অদ্বৈত হয়ে যায়, তখন তাঁর কোনো লিঙ্গপরিচয় থাকে না, থাকে না রূপের প্রকাশ, তখন তা অরূপ। এই দার্শনিক প্রজ্ঞার মিথিক্যাল প্রকাশ হরগৌরী৷ বঙ্গে সতীর জন্মান্তরের কয়েকটি রূপপ্রকাশের ভজনা হয়, কখনো পার্বতী নামে, কখনো গৌরী নামে, কখনো উমা নামে। গৌরী বা উমা ঘরে ফেরেন শরৎকালে, যে শরৎ ও হেমন্ত আসে গ্রীষ্ম ও বর্ষার পরে শীত ও বসন্তে যাওয়ার ঋতুসন্ধিপর্ব। এই সন্ধিপর্বে শারদোৎসব বঙ্গে সুপ্রাচীন। এই ভাবকে কেন্দ্র করে বাংলায় বিখ্যাত ভক্তিগান রয়েছে, ‘যাও যাও গিরি, আনিতে গৌরী’।
যাও যাও গিরি,আনিতে গৌরী,
উমা নাকি বড় কেঁদেছে
দেখেছি স্বপন, নারদ বচন
উমা ‘মা’ ‘মা’ বলে কেঁদেছে
সোনার বরণী গৌরী আমার,
ভাঙ্গড় ভিখারী জামাই তোমার
মায়ের বসন ভূষণ সব আভরণ,
তাও বেচে নাকি ভাঙ্গ খেয়েছে
ভাঙ্গেতে ভোলার প্রবৃত্তি বড়
ত্রিভুভনের ভাঙ্গ করেছে জড়
ধুতুরার ফল ভাঙ্গেরই গুঁড়ো
আমার উমার বদনে দিতেছে।
যাও যাও গিরি,আনিতে গৌরী,
উমা নাকি বড় কেঁদেছে
কিন্তু উমাভজনা আর অসুরদলনী বৈদিক দুর্গার এবাদত এক নয়। হুদুর দুর্গা আসলে মহিষাসুরের নাম। এ নিয়ে বহু আলোচনা আমরা করেছি৷ তাই নতুন করে বলার কিছু নেই৷ আসলে আমরা বৈদিক মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি মণ্ডপে স্থাপন করে বৈদিক মন্ত্র আউড়াই বটে, কিন্তু বুর্জোয়া দেবতার প্রতিনিধি এক দেবী যেভাবে অপরাজেয় কালোমানুষের প্রতিনিধি, অনার্য ভূমিপুত্র, সাবঅল্টার্ন অসুরকে ছলেবলে কৌশলে ফাঁদে ফেলে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছিলেন, সেই প্রতিহিংসাকে সেলিব্রেট করার ভাব শরৎকালে জাগ্রত হয় না, বর্ণহিন্দু বাবুদের তা হতে পারে, কিন্তু বড় বাংলার গণমানুষের তা হয় না। বরং বড় বাংলা তার মেয়ে উমাকে পাঁচদিন ধরে সেবাযত্ন করে, আদর করে। মা মেনকা উমাকে বলেন- আয় গো উমা কোলে লই
তারপর নীলকণ্ঠ পাখী কৈলাশে উড়ে গিয়ে শিবঠাকুরকে খবর দেয়, ওগো তোমার বউ এবার তোমার বাসায় ফিরবে, তুমি আর নেশাভাঙ কোরো না, করলে খবর আছে৷ তারপর গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা-যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে ভেসে কীভাবে যে উমা মা তাঁর বরের কাছে ফিরে যান, কে জানে! সতী, পার্বতী, গৌরী, উমা- বিভিন্ন নামের এই একজনই দেবী, ইনি তো আসলে সেই আদিতন্ত্রের শক্তির রূপপ্রকাশ। যে তন্ত্র তখনও ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতে বিকৃত জাদুবিদ্যা আর দেহতত্ত্বনাম্নী দেহকে উপায় করে তোলার বিদ্যায় পর্যবসিত হয় নাই… বরং বাংলার তন্ত্র বেদের সমান্তরাল এবং তা জ্ঞান বা বিদ্যার বিমূর্তায়নের বিরোধী। বরং এই তন্ত্র হলো বস্ত, দেহ, প্রকৃতি, ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কিত এবং নিত্য অভ্যাস, যোগ ও সাধনা নির্ভর।
পুরুষ ও প্রকৃতির সম্মিলনই তন্ত্রের আদি ভাবনা। জগতকে যখন আমরা স্রেফ জ্ঞানের বিষয় ভাবি, জগৎ তখন আমাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে হাজির হয়। জ্ঞানের এই বিভ্রমের বিরোধিতা করতে গিয়েই বলা হয়, ভাণ্ড এবং ব্রহ্মাণ্ড আসলে একই। আমার মধ্য দিয়ে ব্রহ্মাণ্ড কিম্বা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্য দিয়ে ‘আমি’ই প্রকাশিত ও মূর্ত হয়ে চলেছি। নিরাকার সত্তা, দার্শনিকভাবে গায়েব, কিন্তু বস্তু ও প্রকৃতি জগতে নিত্য প্রকাশিতও। তাই সকল অস্তিত্বের মধ্যেই তিনি আছেন, তিনি প্রকাশমান। এই প্রকাশিত সত্তা প্রকৃতিস্বরূপা, আর তিনি কর্তাসত্তায় মিলে অচিন্ত্য, বাগরহিত, অকল্পনীয়, অদৃশ্য, পরম। পৌত্তলিকতার আগে দেবীশক্তি প্রকাশিত হতেন যন্ত্রে (যন্ত্র মানে এক্ষেত্রে মেশিন নয়, বরং জ্যামিতিক আকার। কালীযন্ত্র, শ্রীযন্ত্র- এরকম বেশ কিছু জ্যামিতিক আকার রয়েছে) এবং ভাবে। সেই দশটি ভাববিদ্যার দশ প্রকার তত্ত্বই দশমহাবিদ্যা৷ আসলে তা প্রাকৃতিক ও মহাজাগতিক জ্ঞানের দশ রকমের ডিসকোর্স৷ দশটি সিস্টেমও বটে। সমাজতন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি যেমন আধুনিক রাজনীতি ও অর্থনীতির একেকটি তন্ত্র বা সিস্টেম– তেমনই দশমহাবিদ্যাকেন্দ্রিক তন্ত্র হলো ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্ককে ঘিরে আবিস্কৃত দেহ, মন, প্রকৃতি ও মহাবিশ্ব সম্পর্কিত বিদ্যা ও তার প্রয়োগের একেকটি সিস্টেম৷ এই সিস্টেম সমূহে ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজ, প্রকৃতি, বিশ্ব, মহাবিশ্ব কোনোটা কোনোটার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং ইউনিভার্স তথা সুপারভার্সের সঙ্গে একটি আণুবীক্ষণিক প্রাণকণাও যে সম্পর্কিত, সেই সম্পর্ককে চিহ্নিত করে তার দার্শনিক ক্রিয়ার চর্চা বা সাধন হয় তন্ত্রে।
কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। তন্ত্রে দেহ, প্রকৃতি ও মহাজগতের সম্বন্ধসূত্র নির্মাণ ও প্রয়োগের যে দশটি মহাবিদ্যা রয়েছে, সেই দশ প্রকার ডিসকোর্সের যে ভাবসমূহ সেগুলির রূপকল্পনায় যেসকল প্রকৃতিশক্তি বা নারীশক্তি মূর্ত হয় উল্লেখিত দেবীরা হলেন সেইসকল শক্তিই।
এ প্রসঙ্গে পৌরাণিক আখ্যানকে স্মরণ করা যাক। প্রজাপতি ব্রহ্মার নিয়োজিত প্রশাসক (সতীর পিতা) রাজা দক্ষের গৃহে আয়োজিত যজ্ঞে শিব ও সতী কাউকেই আমন্ত্রণ জানানো হয় নি। কেননা মেয়ের জামাই শিব ফকিন্নি, নেশাখোর, চালচুলা নাই, প্রলেতারিয়েত। কিন্তু মা মেনকা অস্থির হয়ে পড়লেন তাঁর মেয়ের জন্যে। তলব করলেন মেয়েকে। মায়ের ডাকে মেয়ে তো ঘরে ফিরবেই৷ তো সতী জেদ ধরলেন দক্ষযজ্ঞ উৎসব উপলক্ষে বাপের বাডি যাওয়ার। কিন্তু ত্রিকালজ্ঞ শিব বুঝতে পারছেন যে তাঁর স্ত্রীকে অনুমতি দেওয়াটা সমীচীন নয়, কারণ কোনো না কোনো অঘটন ঘটবেই! কিন্তু স্বাবলম্বী সতী তাঁর স্বামীর এই আপত্তিকে তোয়াক্কা করতে চান, শিব বেশি করে বাধ সাধলে তখন তিনি নিজের দশরকমের স্বরূপ প্রকাশ করলেন, তাঁর এই দশটি স্বরূপই তন্ত্রের দশমহাবিদ্যা। এই দশটি রূপপ্রকাশে স্ত্রীর কাছে জব্দ হলেন বেচারা স্ত্রৈণ শিব, অগত্যা আর কিছুই বললেন না। সতী বাপের বাড়ি গেলেন৷ কিন্তু সেখানে তাঁর স্বামীকে নিয়ে শুরু হলো বড়লোক আত্মীয়স্বজন ও অভ্যাগতদের কটুক্তি। প্রাণপ্রিয় স্বামীর অপমানে দিশেহারা সতী যজ্ঞের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। খবর গেল শিবের কাছে, শিব তাঁর শ্বশুরবাড়ি পৌঁছলেন, উপস্থিত দেবতাদের পিটিয়ে ছাতু বানালেন মহাদেব, শ্বশুরের মুণ্ডছেদন করে তার জায়গায় ছাগমুণ্ড বসালেন। বিষ্ণুকে অবধি ধাওয়া করলেন। অতঃপর স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে শুরু হলো তাঁর প্রলয়নাচন। শেষমেশ সুদর্শন চক্রে দেবীর দেহকে একান্নটি খণ্ডে বিভক্ত করে সেগুলোকে উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিক্ষেপ করলেন বিষ্ণু, ক্রমে সতীর দেহচিহ্ন গায়েব হলে শিব ক্ষান্ত হলেন।
উল্লেখিত এই গল্লটা সবারই কম বেশি জানা। তারপরেও এটি উল্লেখ করা হলো দশমহাবিদ্যা-সহ আরও কয়েকটি প্রসঙ্গে। এই যে দক্ষরাজের সঙ্গে শিবের দ্বন্দ্ব– এই দ্বন্দ্ব একদিকে যেমন শ্রেণীর দ্বন্দ্ব, তেমনই তা সংস্কৃতিরও দ্বন্দ্ব। বেদের অগ্রগতিতে যে চতুর্বর্ণ ও চতুরাশ্রম তৈরি হয়েছিল বহিরাগত কাস্টিস্ট এলিটদের দ্বারা, যারা ভুমিসন্তান তথা কর্মীজনতাকে ‘শূদ্র’ জ্ঞান করে, উৎপাদন ও ভূমির হক থেকে তাদের বিযুক্ত করে একপ্রকার জাতিবাদী উপনিবেশ তৈরি করতে চাইলো, নারীকে তার ক্ষমতায়নের পরিকাঠামো থেকে উৎখাত করে পিতৃতান্ত্রিক শাসনকাঠামো কায়েমের উদ্যোগ নিলো– প্রজাপতি ব্রহ্মা সেই বৈদিক সিস্টেমেরই তো হোতা এবং দক্ষরাজ তাঁর নিয়োজিত একজন প্রধান আমলা বা প্রশাসক। আর শিব হলেন কালো ও বাদামি চামড়ার অনার্য ভূমিসন্তানের নেতা। এইসব কালো-বাদামি চামড়ার ভূমিমানুষকেই তো ভূতপ্রেত-রাক্ষসখোক্কস বানিয়েছে বৈদান্তিক সমাজ। এছাড়াও, শিব কোনো কর্তৃত্ববাদী শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজ, বর্ণগত এবং অর্থনৈতিক শ্রেণীবিন্যাস মানেন না এবং তিনি প্রকৃতিনিবিড়। প্রকৃতিবিহনে শিব শব মাত্র৷ প্রকৃতিশক্তিই শিবের চালিকাশক্তি, তিনি রথ আর তাঁর ‘তুমি’ হলেন রথি, সেই ‘তুমি’ যেমনভাবে তাঁকে চালান, তিনি সেভাবেই চলেন৷ অর্থাৎ শিব তন্ত্রনিবিড়৷ শৈবতন্ত্র আর শক্তিতন্ত্র/ শাক্ততন্ত্রের মধ্যে তো আন্তর্যোগও প্রবল।
তো যাইহোক, দক্ষ ও শিবের এই দ্বন্দ্ব বেদ ও তন্ত্রের দ্বন্দ্বও বটে। খেয়াল করলে দেখা যায় যে ৫১টি জায়গায় দেবীর অঙ্গ খসে পড়েছিল, সেই ৫১টি পীঠ আসলে তন্ত্রচর্চার ক্ষেত্র একেকটি৷ যোগসাধনা ও তন্ত্রমীমাংসার একেকটি আখড়া এইসব পীঠ, তার মধ্যে কামাক্ষার কথাই ভাবুন, গোরক্ষনাথের গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ সেখানে সাধনা করেছেন সেখানে৷ গুরুর মুখনিঃসৃত বাণী ও তার সাহায্যে ক্রিয়াকার্য নির্ভর যে দেশীয় শিক্ষাপদ্ধতি যা চতুর্বর্ণকে তোয়াক্কা না করে গণমানুষের মধ্যে লৌকিক (বস্তুগুত) ও আধ্যাত্মিক (অতিন্দ্রিয়) জ্ঞানচর্চার বিস্তার করেছিল, সেই অবৈদিক ওর্যাল ট্র্যাডিশনের একেকটি ক্ষেত্র হিসাবেও গড়ে উঠেছিল এই সকল পীঠ। এবং নারীশক্তিই ছিল এইসব পীঠের কেন্দ্র।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে বৈদান্তিক মেটাফিজিক্যাল থিওলজির সমান্তরালে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরমের মধ্যে সম্বন্ধকে চিহ্নিত করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ মানব সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তন্ত্রবিদ্যা সমূহ বিকশিত হয়েছে৷ এই তন্ত্রে প্রকৃতিশক্তি বা নারীশক্তির ভূমিকা অসীম। কিন্তু পাল যুগের শেষ থেকে শুরু করে সেন যুগে বৃহৎ বঙ্গে বহিরাগত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা তন্ত্রকে বিকৃত করে জাদুবিদ্যা ও নারীদেহকে ব্যবহারের মাধ্যমে তুরীয়ানন্দে পৌছনোর উপায় করে তোলার চেষ্টা শুরু হয় প্রবলভাবে৷ এই বিকৃত নব্যতন্ত্রকে তাই খারিজ করে অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্বের মাধ্যমে ভক্তি ও প্রেমকে কেন্দ্র করেই দ্বৈতাদ্বৈতের নয়া-বৈপ্লবিক প্রস্তাবনা পেশ করলেন শ্রীচৈতন্য। সেই আলোচনা অন্য পরিসরে করা শ্রেয়৷ কিন্তু এটা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন, বৈদান্তিক চেতনার সমান্তরালে যে তন্ত্র গণভুবনে মুক্তির এক হদিশ হয়ে হাজির ছিল সমাজে, ক্রমশ সেটির একটা বড় অংশও বৈদান্তিক ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা বিকৃত হয়ে গেছে৷
সহজ একটি উদাহরণ কালীপূজা। কালী তন্ত্রের দেবী। দশমহাবিদ্যার এক বিদ্যা৷ অথচ কালীকে যন্ত্র থেকে ক্রমে মূর্তিতে প্রকাশ করে তারপর একদিন তাঁর পূজায় বৈদিক মন্ত্র জুড়ে দেওয়া হলো উপাচারে। কালী কৈবল্যদায়িনী, অথচ তাঁর মূর্তিকে সামনে রেখে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা তাদের দ্বারা বিকৃত তন্ত্রের দোহাই দিয়ে নিম্নবর্গের মানুষদের অকাতরে বলিও তো দিয়েছে৷ অর্থাৎ কখনও তন্ত্রকে নিকেষ করে অথবা তন্ত্রকে বিকৃত করে বৈদান্তিকদের সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়া জারি থেকেছে।
তলিয়ে দেখলে সহজেই বোঝা যাবে যে ইওরোপিয় জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থা যে উপনিবেশবাদের দ্বারা গোটা বিশ্বকে গিলে খেতে চেয়েছে, সেই উপনিবেশবাদের সঙ্গে বৈদান্তিক জাতিবাদের সাংস্কৃতিক রাজনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে।
কীভাবে?
দেখুন, এই যে হরগৌরীর লীলারূপ, এই মাতৃময়ী পার্বতী বা উমা- এঁদের ভাব-ডিসকোর্সকে খারিজ করতে চেয়ে মহিষাসুরমর্দিনীর রূপকে বঙ্গের মাতৃরূপ হিসাবে চালিয়ে দেওয়ার যে প্রয়াস ও প্রচার- তার সর্বজনীনতার সূচনা তো ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের গোড়া পত্তনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে৷ ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদৌল্লার বিপক্ষে ব্রিটিশদের সাহচর্য দেওয়া নবকৃষ্ণ দেবের শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার পত্তন হলো সিরাজের পরাজয় তথা ব্রিটিশ কর্তৃক বাংলা দখলকে সেলিব্রেট করতে। কৃষ্ণচন্দ্র রায়, জগৎ শেঠ- এরা সকলেই তো হঠাৎ করে নারীশক্তির ভক্ত হয়ে উঠলেন৷ কোন নারীশক্তি? তিনি অসুরদলনী, তিনি বৈদিক পিতৃতন্ত্রের তৈরি করা সমরবিদ নারী যিনি পিতৃতন্ত্রকে রক্ষা করতে চান এবং আর্য উপনিবেশ কায়েম করতে চান। ফিলোজফি ও মিথের সঙ্গে এভাবেই মিশে গেছে আধুনিক রাজনীতির উপনিবেশবাদ৷ খেয়াল করলে দেখা যায়, ব্রিটিশ বিরোধী বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদ অনেকগুলো নষ্টামি করে জাতিবাদী ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের অগ্রসরতায় সহায়তা করলেও তারা কিন্তু তাদের উপনিবেশবাদ বিরোধী এক্টিভিজমে কালীকে আইকন বানিয়েছিল। অন্যদিকে মহিষাসুরমর্দিনী কিন্তু হয়ে উঠলেন উপনিবেশবাদীদের দেশীয় মিত্রগোষ্ঠীর আইকন। তারা শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গামূর্তির সামনে মদের ফোয়ারা তুলে আর বাইজী নাচিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে উদযাপন করেছিল পলাশীতে সিরাজের পতন তথা বড় বাংলার সূর্যাস্ত যাওয়ার ঘটনার।
ধর্ম ইতিহাসের বাইরের কিছু না। ইতিহাস ধর্মচর্চারই ইতিহাস।