।। অতনু সিংহ ।।
রাষ্ট্রনৈতিক ও জাতিবাদী বিভাজনের যুগে, ইসলামোফোবিয়ার যুগে, এই হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি আধিপত্যের যুগে, ইসলামের নাম ভাঙানো মুসলিম জাতিবাদীদের উত্থানের যুগে কাজী নজরুল ইসলাম আজ বড়ই প্রাসঙ্গিক এই বড় বাংলায়। বাংলার ভাব-বস্তুর লীলাজগতে, ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ডের সম্বন্ধ স্থাপনের দার্শনিকতায়, মুক্তির ইস্তেহার নির্মাণে বঙ্গের ভূমিজনতার কাছে নজরুল চিরপ্রাসঙ্গিক এক কবি।
বড় বাংলার কাজী নজরুল, ভাব-বস্তু এবং শ্রেণির বয়ান
বঙ্গাব্দ দিনপঞ্জি অনুযায়ী কাজী নজরুলের জন্মদিন ১১ জ্যৈষ্ঠ। কিন্তু রবীন্দ্রজয়ন্তী বাংলা তারিখে পালিত হলেও নজরুলজয়ন্তীর ক্ষেত্রে এটা হয় না। কেন হয় না? ইওরোপমন্য বাঙালি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ২৪ কিংবা ২৫ মে কবির জন্মদিন পালন করে থাকে।
অন্যদিকে, আজ ২৫ মে। দিনটি ছিল নকশালবাড়ি দিবস। তরাই অঞ্চল থেকে একদা আজ শোনা গেছিল মুক্তির ডাক। ভূমিহীন কৃষকের মুক্তি, জমিসম্পৃক্ত মানুষের মুক্তি, নিপীড়িত জাতিসত্তাসমূহের মুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি… এমনিতে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সাথে নজরুলের কোনো সম্পর্ক নাই। এমনটাও নয় যে নকশালরা নজরুলের যথার্থ কোনো মূল্যায়ণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বড় বাংলার শ্রেণির বয়ানে, শ্রেণি রাজনীতির সাংস্কৃতিক মূলায়ণে নজরুলের ছায়া স্পষ্টভাবেই রয়ে গেছে। যদিও এখানকার শ্রেণি-বয়ান পাঠে ইওরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি আজও প্রবল কর্তৃত্বময়। অথচ বড় বাংলার আছে ভাব-বস্তুর যুগল লীলার নিজস্ব এক শ্রেণিভাষ্য। যার হদিশ ঔপনিবেশিক সময়কালে এসেও কাজী নজরুলের সৃজনসম্ভারে খুঁজে পাওয়া যায়। বড় বাংলার ভাব-বস্তুর যুগল লীলার অন্দরে বেজে চলা মুক্তির সেই সুর, মুক্তির সেই ভাষ্য কাজী নজরুলকে সামনে রেখে খোঁজার চেষ্টা করতে পারি। চেষ্টা করতে পারি, নকশালবাড়ি দিবসে আমাদের নিজস্ব শ্রেণির বয়ানের মুখরাটুকু স্মরণ করতে, উচ্চারণ করতে।
মুক্তির (লিবারেশনের) সুর বাংলার জীবিতের জীবনচর্যায় আবহমান বেজে চলেছে বাঁশির মতো, তার প্রকাশ বাংলার গীতিসম্ভারে, কাব্যে, গীতিকাব্যে, বড় বাংলার ভাবান্দোলনের প্রতিটি ছত্রে। পার্থিব জগতের অর্থবাহুল্যের মধ্যে থেকে প্রেম কিংবা কবিতার মতো কোনো কিছু জীবনের পরমার্থিক অর্থ মূর্ত করে। মূর্ত হয় মানুষ ও মানুষের ভাষা জগত। তাকে কেন্দ্র করে এই বড় বাংলার ভাব ও বস্তুর লীলাখেলার রঙ্গিলা ইতিহাস জুড়ে, প্রেম, দ্রোহ ও জীবিতের পরমার্থিক প্রকাশ পরস্পরাবিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং তা এক। মানুষের ভাষা, মানুষ নির্ণীত সুর, মানুষের চিহ্নজগত, মানুষ দ্বারা চিহ্নের অবলুপ্তি,.. বাংলার সাধু, গুরু, সাঁই, দরবেশ আর সাধক কবিদের পদ, গীতি, কাব্য এসবেরই দলিল। পশ্চিমের সমান্তরালে এ-সকল সিলসিলাতেই বাঁধা হয়েছে গান, বাঁধা হয়েছে কাব্য, পটচিত্রে ও ম্যুরালে ভরেছে গৃহস্থের ঘরের দেওয়াল। এবং এ পথেই কবিতা ও গান ঠোঁটের আগায় নিয়ে শ্রীচৈতন্য আর প্রভু নিত্যানন্দের ছায়া অনুসরণ করে পথে পথে নেমেছে কালো-বাদামি ছোটলোকের ঢল। তারাই দরগায়, আখড়ায়, তারাই মুর্শিদের আশ্রয়ে কৃষিতে ভরিয়েছে অঞ্চল, তারাই মাধুকরী, তারাই জমিদার ঠাকুর পরিবারের বিরুদ্ধে রনপায়ে গর্জে ওঠা ছেউড়িয়ার ফকিরের দল। এবং তারাই ব্রিটিশ বিরোধী ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের জাদুবাস্তবতা। আর এইসব ছোটলোকেরাই হেঁটে হেঁটে ইতিহাসের পর ইতিহাস পার করল, ওরা এলো ১৯৬৭ অবধি, নকশালবাড়িতে, ওরা বোকাবুড়োর দল, ওরা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ আর ঔপনিবেশিকতার পাহাড় ভেঙে কুলকুল নদী বইয়ে দেয় ইতিহাসের শিরা-উপশিরায়। তারপর ওরা ঘুমায়ে পড়ে এই বড় বাংলায়। নির্বাক হওয়ার আগে অবধি ওই রাস্তাতেই খাড়ায়ে ছিলেন কাজী নজরুল, সেই রাস্তাতেই প্রেমে ও জেহাদে ছিল তাঁর কাব্যসাধনা। তাঁর সুরসম্ভার।
কেননা বাংলা কাব্যের মধ্যে ঔপনিবেশকিতা সূত্রে অনুপ্রবেশ করা আধুনিকতার দ্বারপ্রান্তে নজরুল আবির্ভূত হয়েছিলেন ভাবান্দোলন পরম্পরার একজন কবি হিসাবে। কাজী নজরুল ইসলাম ভাবান্দোলন পরম্পরার একজন কবি। তাঁর কালী-কৃষ্ণ গীতি কিম্বা আল্লাহ-নবীর আশিকানায় বাঁধা গান- সবটাই বঙ্গের ভূমিমানুষের ভাব-বস্তুর যুগল দ্বৈতাদ্বৈত সম্পর্কের অভিসন্দর্ভ থেকে। আধুনিকতাবাদীরা নজরুলকে আধুনিক করে তুলতে চেয়েছেন বটে, কিন্তু নজরুল কখনোই বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের কবি নয়, তিনি বড় বাংলার। যে বঙ্গে ভাব ও বস্তু মিশে থাকে একে অপরের সাথে, আর তৈরি হয় লীলা। নজরুল সেই লীলার অন্তর্জগতে মিশে যেতে পেরেছিলেন। আর তাই নজরুলের ইসলামিক গজল ও শ্যামাগীতিগুলো আজ আমাদের ফের নতুন করে ভাবায়।
বাংলার ইতিহাস ও ইতিহাসের গতিপথ ইওরোপের সমাজ বিবর্তনের অনুসারী নয়। বরং ইওরোপের সমান্তরালে চলেছে উপমহাদেশের ইতিহাস, বিশেষত উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তের বা বৃহৎ বঙ্গের ইতিহাস। ধর্ম সম্পর্কে মার্ক্সের আলাপের অপব্যাখ্যা করে এঙ্গেলসীয় ইওরোপমন্য ইতিহাস পর্যালোচনার ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিরীখে ইউরোপের ইতিহাস ব্যাখ্যাকে যতই তথাকথিত মার্ক্সবাদীরা বাংলায় লাগু করতে চান না কেন, সেটা কোনো কাজে যে আসে নাই, তাহা প্রমাণিত। ধর্ম আর রিলিজিয়ন যে এক বস্তু নয়, তাও বোঝানো যায়নি তথাকথিত প্রগতীমন্যদের, কারণ, তাঁরা ভিতরে ও বাহিরে আদতে বর্ণের ভজনা করে গেছেন, করে গেছেন বিত্তের ভজনা, বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় শুরুয়াতে অধিকাংশ কমিউনিষ্ট উচ্চবর্ণের আর উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি তাই তারা ধর্মবিদ্বেষের কথা বলে আদতে বাংলার ছোটলোকের জীবনচর্যার প্রতি বিদ্বেষপোষণ করে গেছেন, কেননা ছোটলোকের জীবনদর্শনের মধ্যে রয়েছে পরমার্থিক অনুসন্ধান, তা মানুষ ভজনার ভিতর দিয়েই, কিন্তু জীবিতের সঙ্গে পরমের সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ সেখানে গভীর। আর প্রগতীবাদীরা ধর্মবিদ্বেষের নাম করে একদিকে ঔপনিবেশিকতার পদলেহন করেছেন অন্যদিকে উত্তর ভারতীয় বর্ণবাদকে লালন-পালন করে গেছেন হয় অবচেতনে কিংবা কোথাও কোথাও সচেতনভাবেই। এই এলিট বামপন্থার চর্চায় কুঠারাঘাত করেছিল নকশালবাড়ি, তারা তিরিশের দশকের বাবু-কমিউনিষ্টদের মতো তেভাগার ডাক দিয়ে জমিদারিকে ভিতরে ভিতরে টিকিয়ে রাখার ধান্দাবাজীতে যায় নাই, তারা জোতদার-জমিদারের বিরুদ্ধে মরণপন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জমিদারি প্রথার নির্মূল করার ডাকই ছিল নকশালবাড়ির র্যাডিক্যাল কমিউনিষ্টদের বিদ্রোহের প্রাথমিক বিষয়।
কংগ্রেস ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দোসর সিপিএম একটা কথা রটিয়েছিল বলে সজোনা যায়। কী সেই কথা? তা হলো, চারু মজুমদার নাকি কালী পূজা করতেন।! এই তথ্যের সত্য-মিথ্যা নিয়ে কিছু জানা যায় না। নকশালপন্থী সিপিআইএমএল-এর উচ্চশিক্ষিত নাস্তিক নেতা সরোজ দত্ত এই তথ্যকে খারিজ করে ছিলেন যদিও, কিন্তু চরম পরীক্ষা-নিরীক্ষাপন্থী সিপিআইএমএল নেতা চারু মজুমদার কালী পূজা যদি করেও থাকেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। কেননা, কালী আদিতে বাংলার ছোটলোকের দেবী এবং কালীভাব বাংলার প্রকৃতিনিবিড় মহাবিদ্যা ও কসমোলজি সম্পর্কিত এক বিষয়, এছাড়া কালী তো সাব-অল্টার্ন সুতরাং কালীর সঙ্গে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের বিরোধ কোথায়? সে যাইহোক, মোদ্দা কথা নকশালবাড়ি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এমন নানা বিষয় সামনে এসেছে যা ট্র্যাডিশনাল লেফট মুভমেন্টের ঘটনার ব্যতিক্রম এবং যা একই সঙ্গে বড় বাংলার মাটির মানুষের জীবনচর্যার ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। দ্যাখেন ইওরোপের কেতাবি আলোকায়ন আর তার জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যের পরিকাঠামোর সমান্তরালে বঙ্গের তথা উপমহাদেশের মৌখিক পরম্পরা ও জ্ঞানতত্ত্ব বিরোধী অভদ্রবিত্ত সো-কল্ড সাব-অল্টার্ন ঐতিহ্যকে কীভাবে আমলে নিচ্ছেন কাজী নজরুল, যা কিনা একইসাথে পশ্চিমা আলোকায়নের পাশাপাশি বৈদিক জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যবাদী পরিকাঠামোর বিরুদ্ধাচার। কী বলছেন নজরুল?
আমার হাতে কালি মুখে কালি, মা
আমার কালিমাখা মুখ দেখে মা
পাড়ার লোকে হাসে খালি।।
মোর লেখাপড়া হ’ল না মা,
আমি ‘ম’ দেখিতেই দেখি শ্যামা,
আমি ‘ক’ দেখতেই কালী ব’লে
নাচি দিয়ে করতালি।।
কালো আঁক দেখে মা ধারাপাতের
ধারা নামে আঁখিপাতে,
আমার বর্ণ পরিচয় হ’লো না মা
তোর বর্ণ বিনা কালী।
যা লিখিস মা বনের পাতায়
সাগরজলে আকাশ খাতায়,
আমি সে লেখা তো পড়তে পারি
মূর্খ বলে দিক্ না গালি মা,
লোকে মূর্খ ব’লে দিক্ না গালি।।
বঙ্গের শাস্ত্রবিরোধিতা, জ্ঞানতাত্ত্বিক শোষণ-পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে জেহাদ ও প্রাণ-প্রকৃতি-পরমের সহাবস্থানের যে ভূমিনিবিড় চেতনা, যা বঙ্গের ভাবান্দোলনের মধ্যে মূর্ত হয়েছিল নজরুল তা লালন করে গেছেন তাঁর চিন্তায়, জীবনচর্যায়। আধুনিকতার সকল চিহ্ন-প্রকরণের অন্দরের মধ্যে বসবাস করেও ঔপনিবেশিক চিন্তা, ঔপনিবেশিক জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিকাঠামো ও আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন। বরং বাংলার ভাবান্দোলন পরম্পরাকে আধুনিক পরিসরে ছড়ায়ে দিয়ে গেছেন অবলীলায়। তিনি বহন করেছেন সৈয়দ সুলতান, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, রামপ্রসাদ, লালন সাঁই প্রমুখ মহাজনের পরম্পরা। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নানা সময় নান্দনিক ক্ষেত্রে প্রভাবিত করেছে কিন্তু ভাব ও ভাবনায় তিনি রাবিন্দ্রীক হয়ে যাননি, যদিও রবীন্দ্রনাথ বাংলার মানুষের জীবন সহিত সম্পর্কিত কথা ও কাব্যকেই সাহিত্য বলেছেন তাই তাঁকেও আমরা আধুনিকতার পঙ্কিল আবর্তে ছুঁড়ে ফেলি না। আধুনিকতার যে রণ-রক্তপূর্ণ, ক্রূরতার ক্লান্ত-ভারাক্রান্ত , আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠে আধুনিকতার লাশকাটাঘর চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ ( যা তাঁর সমসাময়িক কেউই পারেননি, না তো সুধীন্দ্রনাথ, না তো বিষ্ণু দে, না তো বুদ্ধদেব বসু) এবং বের হয়ে যেতে চেয়েছিলেন কলকাতাময় ঘিনঘিনে আধুনিকতা থেকে, রূপসী বাংলার প্রান্তরে নাটোরে ফিরে গিয়ে মুখোমুখি বসতে চেয়েছিলেন বনলতা সেনের… অন্যদিকে নজরুল এই আধুনিকতার ভাবসংঘ থেকে নিজেকে পৃথক রেখে গেছেন, বরং তিনি মুজফফর আহমেদের সঙ্গে দিনবদলের আলাপ করেছেন, সক্রিয় হয়েছেন নিজেও দিনবদলের দ্রোহ-অধ্যায়ে। এবং তাঁকে ভাষা জুগিয়েছে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, কোরআন, ত্রিপিটক, আবেস্তা, বেদ। আর তাই তিনি ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, হয়ে উঠেছিলেন চির-বিস্ময় তিনি বিশ্ববিধাতৃর… উপনিবেশবাদী আধুনিক কবিরা আধুনিকতার নামে যখন অবলীলায় বাংলা ভাষা থেকে বাদ দিয়ে গেছেন আরবী, ফার্সী শব্দ আর চাপিয়ে দিয়েছেন তৎসম, তদ্ভব শব্দ রাশি রাশি, তখন তার সমান্তরালে আরবী-ফার্সি অক্ষুণ্ণ রেখে রেফারেন্সে নজরুল কোরআন, পুরাণ- সব কিছুকে পেশ করে গেছেন চির উন্নতশিরে। অন্যদিকে বাংলার ধর্মবিবেচনার দার্শনিক পর্যবেক্ষণ, আল্লাহ থাকেন বান্দার মনের অন্দরে বা সাঁই আছেন আপন অন্তঃপুরে… যা কি না মানুষ ভজনার নিগূঢ় ভাব, তা নজরুলের কাব্যে, গীতিতে চিরকাল প্রতিফলিত হয়েছে।
বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্ এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহাগীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছে বাংলার বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের যুগল থেকে এক হয়ে ওঠার অচিন্ত্যভেদাভেদ ও দ্বৈতাদ্বৈতভাব, প্রেরণা জুগিয়েছে পুরুষ ও প্রকৃতির একাত্বভাবের রূপপ্রকাশ রাধাকৃষ্ণ, তিনি বাংলার ভাবের অন্দরের বসে নারী ও পুরুষের লৈঙ্গিক সাম্যের গানও গেয়েছেন। তিনি তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ। একদিকে কৃষ্ণ অন্যদিকে মোহাম্মদ। যেভাবে বঙ্গের ভাষা, ভাব ও ইতিহাসের বিস্তার-অগ্রসরতায় ইসলাম অবদান রেখেছে ইতিবাচক, যেভাবে জাতপাত,-বর্ণবিভাজনের বিরুদ্ধে ও ইনসাফ-সমানাধিকারেরে পক্ষে ইসলামের ঝাণ্ডা পতপত করে উড়েছে এই বৃহৎ বঙ্গে আর বাংলার কালীকৃষ্ণের মাথায় ছাতা ধরে থেকেছে পরম মাবুদের নাম… বাংলার মানুষ ভজনা ও মানুষের রূপভজনার সিলসিলায় তাই বারবার প্রেরণা হয়েছে ইসলাম, প্রেরণা হয়েছেন নবী মোহাম্মদ (সা.), আর তাই বড় বাংলার কবি কাজী নজরুলেরও প্রেরণা ইসলাম। তিনিও নবীজীর আশিকানায় পরিপূর্ণ।
তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম
ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি, খোদায়ী-কালাম
ঐ নামের দামন ধ’রে আছি- আমার কিসের ভয়
ঐ নামের গুণে পাবো আমি খোদার পরিচয়
তাঁর কদম মোবারক যে আমার বেহেশতী তান্জাম
মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম।।
আল্লাহকে পেতে হলে রসূলের অছিলা চাইতে হবে। কবি বলেন-
আল্লাকে যে পাইতে চায় হযরতকে ভালবেসে
আরশ কুরসি লওহ কালাম না চাইতেই পেয়েছে সে।।
রাসূল নামের রশি ধরে
যেতে হবে খোদার ঘরে।।
কিংবা
আমি বুঝি না কো কোন ইজম
কোন রূপ রাজনীতি
আমি শুধু জানি আমি শুধু মানি
এক আল্লাহর প্রীতি।
তার শক্তিতে জয়ী, হবে লয়ে আল্লার নাম, জাগো
ঘুমায়ো না আর, যতটুকু পার শুধু তার কাজে লাগো।
ভেদ বিভেদের কথা বলে যারা তারা শয়তানী ঢেলা
আর বেশি দিন নাই, শেষ হয়ে এসেছে ওদের খেলা।
ভেদ-বিভাজনের বিরুদ্ধে ইসলাম যুগে যুগে যুগে যে জেহাদ চালিয়েছে আর প্রেমের দাওয়াত দিয়ে গেছে মানুষের মাঝে, কাজী নজরুল সেই দাওয়াত গ্রহণ করেছেন প্রাণ ভরে, তিনিও পাঠকের মাঝে রেখেছেন সেই দাওয়াত কাব্যে, গীতিতে। তিনিও মানুষ ভজনার ভাবের মধ্যেই উচ্চারণ করেছেন ইসলামি সেইসকল শিক্ষা।
সাম্যের কবি কবি কাজী নজরুল, প্রেমের কবি কাজী নজরুল, জেহাদের কবি কাজী নজরুল কমিউনিষ্ট পার্টি গড়ে ওঠা কিংবা তার আগে-পরে কমিউনিষ্টদের সঙ্গে সখ্যের সম্পর্ক রেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন কিন্তু পার্টির মেম্বার হন নাই কখনও। কারণ, একদিকে হয়তো বা বোহেমিয়ান কাজী নজরলের পক্ষে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার রেজিমেন্টশনে থাকা সম্ভব ছিল না, এমনটা হতে পারে। কিন্তু তার থেকেও অনেক বড় কারণ, কমিউনিষ্ট পার্টি শুরু থেকে বহুদিন যাবত এই বৃহৎ বঙ্গের পার্টি হতে পারেনি, উপমহাদেশের পার্টি হয়ে উঠতে পারেনি, জার্মান ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের উত্তর-মার্ক্সবাদী এরিক ফ্রমরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কে সমালোচনার ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে দেশ-কাল নিরপেক্ষ একবগগা পর্যালোচনা ও বস্তুবাদের নামে অতিবস্তুমুখীনতার অভিযোগ এনেছিল, সেই ভাবনাটা বোধহয় অনেকের মধ্যেই ছিল এই অখণ্ড বাংলায়। যাঁরা কমিউনিষ্টদের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেও পার্টি মেম্বার হয়ে উঠতে পারেননি, কারণ কমিউনিষ্ট পার্টিও বাংলার হয়ে উঠতে পারেনি অন্তত ষাটের দশকের শুরু অবধি। বাংলা ভাগের বিশ বছরের মাথায় পশ্চিমবঙ্গের তরাই অঞ্চল নকশালবাড়িতে সামন্ততন্ত্র আর ঔপনিবেশিক পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে ছোটলোকেরা যে বিদ্রোহের সূচনা করেছিল, সেটাই ছিল কমিউনিষ্ট পার্টির ইতিহাসের সফল অর্জন এবং বাংলার ভূমিমানুষের নিজস্ব দল হয়ে ওঠা, যদিও ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি বড় অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছিল নকশালপন্থীদের এর পরেই। বাংলার ছোটলোকের বিদ্রোহকে ধারণ করার জন্যে নকশালপন্থীদের সঙ্গে একযোগে থাকতে পারেননি সংসদীয় এলিট কমিউনিষ্টরা, যাদের অধিকাংশ এখন বিজেপির সাফল্য কামনা করেন মনে-মনে… নজরুলের মতো কবি বঙ্গীয় সাম্যবাদী হয়েও কমিউনিষ্ট তকমা পান নাই, কেননা তিনি বাউন-কায়েত ও উচ্চমধ্যবিত্ত নন, বিলাত-ফেরত নন। নজরুল কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশনালের বঙ্গীয় ভাবানুবাদ রচনা করেছেন কিন্তু হুবহু তর্জমা করেন নাই, কারণ বাংলার দল বাংলার কাব্য বাংলার স্লোগান, বাংলার সাম্যবাদী অ্যান্থাম বাংলার মতো হবে। প্রথমে বঙ্গীয় হতে না পারলে বিশ্বজনীন হওয়ার উপায় নাই, বুঝেছিলেন নজরুল। হুবহু অনুবাদ না হওয়ায় নজরুলের ভাবানুবাদ গ্রহণ করেনি কমিউনিষ্ট পার্টি। তাই আমরা যারা বড় বাংলার মানুষ ভজনার ভাবে ও তার বস্তুগিত চর্চায় বিশ্বাসী, আমরা যারা নকশালবাড়িকে বাংলার মজলুমের, বাংলার নিপীড়িতের বাংলার ইতরের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জেহাদ হিসাবে দেখি, তাঁরা স্মরণ করি নজরুলকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শহুরে নকশাল নেতারা নাস্তিক্য-আস্তিক্য, সেক্যুলার-সাম্প্রদায়িকতা, বস্তুবাদ-ভাববাদ ইত্যাদি বাইনারিতেই ভেসে গেছেন তাঁদের পূর্বেকার সো-কল্ড বাবু কমিউনিস্টদের মতো করে, ইওরোপমন্যতায়। তাই নজরুলের গান, কবিতা ব্যক্তিগত স্তরে কোনো নকশালপন্থীকে প্রেরণা জোগালেও, নজরুলকে ওই আন্দোলনে আরাধ্য করে তোলা হয় নি। বঙ্গের ভূমিমানুষের জাতীয়-গণতান্ত্রিক মুক্তির আন্দোলনের চেহারায় নকশালবাড়ি আন্দোলনের শ্রেণীর বয়ানকে বিকশিত করার সুযীগ থাকলেও সেটা যেমন হয়ে ওঠে নাই, তেমন নজরুলকে তাঁরাও চিনতে পারেন নাই। অথচ এই আন্দোলনেই নজরুলকে সাংস্কৃতিক বাতিঘর হিসাবে ধার্য করা ছিল সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত। তা হয় নাই। নজরুল ব্রাত্য থেকে গেছেন ব্রাত্যজনের মুক্তি আন্দোলন নকশালবাড়ির সংগ্রামেও। যেভাবে তিরিশের দশকের কমিউনিস্টরা ব্রাত্য করেছিল নজরুলকে। আজ দরকার বাংলার নিজস্ব শ্রেণীর বয়ানকে পুনরুদ্ধার ও বৈশ্বিক শ্রেণী রাজনীতির সঙ্গে তার সম্বন্ধ স্থাপন করা, স্থানিকতাকে আমলে নিয়ে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার প্রত্যয়ে। এই কারণে নজরুল আজও আমাদের কাছে দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক তাঁর সৃষ্টিসুখসম্ভারের ভিতর থেকেই।
রাষ্ট্রনৈতিক ও জাতিবাদী বিভাজনের যুগে, ইসলামোফোবিয়ার যুগে, এই হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি আধিপত্যের যুগে, ইসলামের নাম ভাঙানো মুসলিম জাতিবাদীদের উত্থানের যুগে কাজী নজরুল ইসলাম আজ বড়ই প্রাসঙ্গিক এই বড় বাংলায়। বাংলার ভাব-বস্তুর লীলাজগতে, ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ডের সম্বন্ধ স্থাপনের দার্শনিকতায়, মুক্তির ইস্তেহার নির্মাণে বঙ্গের ভূমিজনতার কাছে নজরুল চিরপ্রাসঙ্গিক এক কবি।
জাগো অনশন-বন্দী, ওঠরে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত।
যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি
হাঁকে নিপীড়িত জন-মন-মথিত বাণী,
নব জনম লাভ অভিনব ধরণী,
ওরে ঐ আগত॥
আদি শৃঙ্খল সনাতন শাস্ত্র আচার
মূল সর্বনাশের এরে ভাঙিব এবার!
ভেদি দৈত্য-কারা
আয় সর্ব্বহারা!
কেহ রহিবে না আর পর-পদ আনত
নব ভিত্তি’ পরে
নব নবীন জগৎ হবে উত্থিত রে!
শোন্ অত্যাচারী! শোন্ রে সঞ্চয়ী।
ছিনু সর্বহারা, এই সংগ্রাম-মাঝ
ওয়ে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ
নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ!
এই ‘অন্তর-ন্যাশানাল সংহতি’ রে
হবে নিখিল-মানব-জাতি সমুদ্ধত॥
অতনু সিংহ
বড় বাংলার কবি। ‘প্রতিপক্ষ’র নির্বাহী সম্পাদক। নিবাস, হাওড়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ।