আত্মপরিচয় ও বাঙালিত্বের যুদ্ধ-খায়েশ
১.
জাকির তালুকদার রচিত ‘মুসলমানমঙ্গল’র প্রচার পত্রে লেখক সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি ‘বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সবচেয়ে অগ্রগামী চিন্তার কথাসাহিত্যিক’। একইসাথে দাবি করা হয়েছে ‘এই ধরনের উপন্যাস বাংলাভাষায় এটাই প্রথম।
প্রথমে আসা যাক, উপন্যাস প্রসঙ্গে। সমকালীন বাঙালি মুসলমান সমাজ ও মননকে ‘ইসলামের ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত’ করে এ রচনা প্রয়াসের সাহিত্যমূল্য বা সাহিত্য হিশাবে এর সফলতা ব্যর্থতা বিচারের মানদণ্ড নিয়ে বাগবিস্তারের ইচ্ছা আমার নাই। মোটাদাগে বলা যায়; একটা গল্প বা উপন্যাসের কাঠামোয় কতগুলো চরিত্র, ঘটনা ও পরিপ্রেক্ষিত তার অন্তর্গত সাযুজ্যের সংযোগে ক্রমে যেভাবে রক্ত-মাংশে পুষ্ট হয়ে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে, নিত্যদিনের নানা দ্বন্দ্ব-বিরহের মুখে মানুষ নিজে নির্মিত হয়–আপন স্বভাবে আর যুগপৎ বাহিরের দোলাচল-তাপ-ঝাপটায় যেভাবে অনিবার্য বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য হয়–ফলে তার রূপায়নে উঠে আসে সমকাল ও সমাজ–সেরকম উৎরে যাওয়া কাহিনীকথকতার সাফল্য এই প্রচেষ্ঠায় মেলে নাই। ছকেবাধা কয়েকজন মানুষের মুখে পূর্ব নির্ধারিত কিছু সিদ্ধান্তকথন অনর্গল বলিয়ে যাওয়ার মধ্যেই মুসলমানমঙ্গল’র বুনোট স্থিরকৃত। গল্পের নিজস্ব চলনে কোন চরিত্রেই বিকাশ বা উপলব্ধির পূর্ণতা আসে নাই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আড়ষ্ট ও নিরস বর্ণনা যান্ত্রিকভাবে অনুমেয় পরিণতিতে সমাপ্তি টানা হয়েছে। প্রচলিত মধ্যবৃত্তীয় মনোভঙ্গি, আবেগ ও ইতিহাস বোধের বাইরে এই উপন্যাসে কোনো চরিত্রের জায়গা মেলেনি। ফলে ভিন্নস্বরও আসে নাই। বরং অশিক্ষিত, প্রতারক, নোংরা, দুশ্চরিত্র ইত্যাদি প্রথাগত প্রকরণে চিহ্নিত করে শ্লেষ ও তাচ্ছিল্যের শেলে ‘মোল্লা-মুসলমান’র অবয়ব বার আনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ঔপনিবেশিক কালপর্ব থেকে জারিকৃত প্রগতিশীলতা এবং আলোজ্বালাতন প্রকল্পের হাল কেতায় জোরদার সব দাপুটে বয়ানের অধীনস্ত থেকে ও রেখে লেখক এইকালে বাঙালি মুসলমানের আত্মসমালোচনাপর্বে করুণারও অযোগ্য এক কৌতুককর চরিত-মানস খাড়া করেছেন–বিপরীতে; মোকাবিলাপর্বে শান্তিবাদী ‘ইসলাম’র আরামদায়ক আলখাল্লায় আবৃত আত্মনিবেদনই মুক্তির মন্দির সোপানজ্ঞানে মাথাপেতে নেওয়া সাব্যস্ত করেছেন। এতে প্রতীকী অর্থে হলেও নায়ক ইউসুফের আমেরিকান প্রেমিকার প্রেমের আনন্দের মাঝে প্রতিক্রিয়ায় বশবর্তী নর্দমার গন্ধমাখা শামসুলদের মধ্যদিয়ে অনাকাঙ্খিত ‘ইসলাম’ এসে বাধ সাধলে পরে ঘুষিতে তাদের মুখমণ্ডল থেতলে দেওয়ার বীরত্বও সূচিত হয়। সাম্রাজ্যিক যুদ্ধ খায়েশের কোলে বসে বীরত্ব দেখানোর দুর্নিবার শক্তিমত্তা প্রতিনিয়ত প্রদর্শিত হচ্ছে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ও দখলদারির সূচনালগ্ন থেকে–হাল আমলে ইরাক, আফগানিস্তানে। এবার বাংলাদেশে ‘মোল্লা’দের হাত থেকে ইসলাম উদ্ধারে আমেরিকান স্টেট-ডিপার্টমেন্টের অভিলাষ পূরণে স্থানীয় সর্বসাম্প্রতিক প্রতিনিধি ইউসুফের ইসলাম বাঁচানোর শ্লোগানই আমাদের আলোচ্য কথক জাকির তালুকদারের রাজনীতি। (এ বিষয়ে আগ্রহীরা যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারফোর্স ইন্টিলিজেন্সের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘RAND CORPORATION’ এর ওয়েবসাইটে National Security Research Division’s Civil Democratic Islam: Partners, Resources, and Strategies শীর্ষক দলিলটি পড়তে পারেন।) ‘মোল্লা’ এবং ‘ইসলাম’ই বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের জন্য সমস্যা হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। তবে কোরআনের আয়াত আউড়িয়ে, হাদিস ঘেঁটে নিজেকে ‘মুসলমান’ পরিচয় দিয়ে ইসলামের মহান উদ্ধারকর্তা বানানোর এই নতুন আদা-জল প্রচেষ্টার খবর নিলে জাহাজ ও যাত্রীর গন্তব্য স্পষ্ট হবে। রুকু ও কেবলা বোঝা যাবে।
আমেরিকা ও সোভিয়েত নেতৃত্বে দুই শক্তি শিবিরের স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠান্ডা লড়াইয়ের সমাপ্তির আগে ও পরের বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপট এবং কাঠামোর মধ্যে গুণগতভাবে মৌলিক কিছু বদল ঘটেছে। সেই পরিবর্তনের মধ্যে অন্যতম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং ইসলামি ধারার রাজনীতির সাথে সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস। এই ঘটনাটা উভয় পক্ষের দিক থেকেই হয়েছে। বাংলাদেশে নব্বই দশকের পর সোভিয়েত প্রভাবাধীনে থাকা বামপন্থার শক্তিক্ষয় হলেও এখানকার ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সাথে ইসলাম এবং মুসলমানদের সম্পর্ককে ঔপনিবেশিকতার ঔরশে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক বয়ানের বাইরে তারা বিচার করে না। স্থানীয়ভাবে এই ধারাটা আগেও যেমন এখনো তেমনই মর্মের দিক থেকে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। বামপন্থার মোড়কে প্রগতিশীল বাঙালি হওয়ার দাওয়াই ছিল যা কিছু ইসলামের সাথে যুক্ত তার বিরোধিতা করা। ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটা ক্ষেত্র থেকেই উচ্ছেদ সাধনের উৎকট প্রবণতা। ইসলাম ও পাকিস্তানকে সমার্থক করে তার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধকে মুসলমানিত্বের বিরুদ্ধে বিজয় আখ্যা দিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ খাড়া করা। যদিও মনে হবে এই প্রচেষ্টায় আপাত ভাটা পড়েছে। অন্তত রণধ্বনির দিক থেকে। কিন্তু বাস্তব ঘটনা ঠিক তার উল্টা। আসলে বিদ্যমান যুদ্ধে আন্তর্জাতিক মিত্রপক্ষের কৌশলের চাহিদা মাফিকই বয়ান সাজানোয় নতুনত্ব এসেছে। প্রথম নজরে প্রচলিত ইসলাম বিরোধিতার সাথে মুসলমানমঙ্গল’র যা কিছু ফারাক নজরে আসবে, তার লক্ষ্য ও উপায়ের নেকাব তুলে দেখলেই ভেতরের মিল খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না। বরং অভিন্ন লক্ষ্যকে সামনে রেখে বয়ানের প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সূচনা হিশাবে এই উপন্যাস নিঃসন্দহে উল্লেখযোগ্য। আর সে চাহিদা মেটানোর জন্যই ইউসুফ নামের চরিত্রের আবির্ভাব। আরবের ইতিহাস, খেলাফত নিয়ে মুসলমানদের ঝগড়া–আসলে কুরাইশ গোত্রের মধ্যে কলহ–তার পরিপ্রেক্ষিতে হাদিসশাস্ত্র ও আইনশাস্ত্রের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতার প্রতিফলনের ছাপ থাকায় তার গ্রহণযোগ্যতা ও প্রামাণ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পুরানা প্রবণতার আনাগোনায় সরগরম এ উপন্যাস। ধরে নেওয়া হয়েছে মুসলমানরা এসব না জেনেই খালি ইসলাম ইসলাম করে কিম্বা কাল্পনিক প্রবিত্রতায় বুঁদ হয়ে আছে। লেখক ‘ইসলাম’ আবিষ্কারের এই রোমাঞ্চ মুসলমানের অজ্ঞতার বিপরীতে যেভাবে হাজির করেছেন তার বেশিরভাগই মনগড়া। খেলাফত কিংবা ইসলামের মতাদর্শিক ধারার যতগুলো প্রতিনিধি আছে তার প্রত্যেকটারই পুরা এই ঘটনাপরম্পরা নিয়ে নিজস্ব মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা আছে। কেউই না জেনে বা গদগদ হওয়ার জন্য খোলাফায়ে রাশেদার কথা বলে না। এগুলো নিয়ে সবসময়ই বাহাস-বিতর্ক চলমান ছিল, আছে। কিন্তু নায়ক ইউসুফের মারফতে এই উপন্যাসে ইতিহাস উদ্ধারের যে তোড়জোড় দেখা গেল তার অভিমুখ মোটেই ইসলামের ইতিহাস ও সভ্যতার ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও বিকাশের চরিত্র বিচার করে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়বার রাজনৈতিক এবং দার্শনিক শক্তি অনুসন্ধান নয়। মোটেই ইসলামের সর্বজনীন ও বিশ্বঐতিহাসিক ভূমিকার তাৎপর্যকে বিপ্লবী রাজনৈতিক আদর্শের পুনর্গঠনে কাজে লাগানো নয়। বরং লড়াকু ও প্রতিরোধের উৎসমুখগুলোকে ‘চরমপন্থী’ ‘জঙ্গি’ ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী প্রকরণে সংজ্ঞায়িত করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঢাক-ঢোল পেটানো।
এই তরিকার আসল প্রকরণ হল, দেখানো যে ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের মধ্যে যুক্তি বিরোধী পশ্চাৎপদ ও আধুনিকতার সাথে সাংঘর্ষিক মোল্লাতান্ত্রিক ধারার সাথে মুতাজিলাপন্থীদের বিরোধ। এই তরল ও ক্লিশে ব্যাখা নিয়ে বিস্তারিত বলার জায়গা এটা নয়। তো সেখান থেকে নাম চলে আসবে ইমাম তাইমিয়া অতঃপর আবদুল ওহাব। সরল অংকের মত মিলিয়ে দিয়ে প্রমাণ করা হবে এই ধারারই সাম্প্রতিক উত্তরাধিকার হল এখন যারা আত্মঘাতী বোমারু, যাদের তালেবান-তালেবান লাগে ‘জায়নিস্ট-ক্রুসেডার এলায়েন্স’র বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ‘সভ্যতা ও গণতন্ত্রের’ ক্ষতিসাধন করছে যারা। মহান মানবতার একনম্বর এই ভয়ঙ্কর শত্রুদের সমূলে বিনাশ করতে হলে অবশ্য আর আগের মতো প্রগতিশীলতার বুলি কপচিয়ে কাজ হচ্ছে না। ঈশ্বর প্রদত্ত উপহার গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা খাওয়াতে হলে তো আবদুল খালেকের মতো মওলানা পয়দা করতে হবে। তা নাহলে ভবিষ্যতে ইরাক ও আফগানিস্তানের মত ‘নির্বাচিত’ সরকারের সমর্থনে ফতোয়া কে দেবে? কোরান হাদিসের সাম্রাজ্যিক ব্যবহারের কলাকৌশল নিয়ে মার্কিন মুলুকে অনেক আগ থেকেই গবেষণা ও চর্চা চালু হয়েছে। সেখানে ইসলামের অনেক প্রকাণ্ড পণ্ডিতই আছেন যাদের জ্ঞানকাণ্ড ইউসুফের মত মুসলমান নামি বরকন্দাজ বানানোর কাজেই নিয়োজিত। লরেন্স অব আরাবিয়া থেকে নেটিভ ইউসুফ পর্যন্ত আসতে যে হয়েছে সেটা বেশ পরিষ্কার। পরিহাসের বিষয়, আমেরিকান ইসলাম বাংলাদেশে আমদানির জন্য মসজিদ মিশন ও মধ্যবিত্ত একসাথে উঠেপড়ে লেগেছে। এই হল সেই মোক্ষম রসায়ন যার কুদরতে আপাত ইসলাম মাত্রই বিরোধিতার অভ্যাস ত্যাগ করে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ শরিক হওয়ার জন্য ‘মুসলমানিত্ব’ ধারণের ব্রত শুরু হয়েছে। যে কারণে নায়কের মুখ দিয়ে আল্লা-খোদা নবী-রাসুলে বিশ্বাসের স্বীকারোক্তিই শুধু নয়, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। যেন নামাজ রোজায় পয়বন্দ দেখালেই জুলুমের বিরুদ্ধে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মূলগত ইসলামি তাগিদের অনুসারী বনে যাবে। দ্বীন ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সাথে কিভাবে ইবাদতের সম্পর্ক রাখতে হয় এসব বিষয়ে প্রচুর দার্শনিক ও রাজনৈতিক বোঝাপড়া আছে। সেইসব দিকে লেখকের দার্শনিক প্রক্ষেপ যাওয়া তো দূরের কথা ইঙ্গিত বা ইশারা পর্যন্ত নাই। বরং জামায়াতে ইসলামির বিরোধিতা করতে গিয়ে মওদুদীর কোরআনের তাফসির ও ইজতিহাদের পক্ষাবলম্বনের মধ্যেই তথাকথিত ধর্মের নামে রাজনীতির ফন্দিসর্বস্বতা নির্দেশ করতে চাইলেন। যেন ইজতিহাদের কথা বলাটাই অপরাধ হয়েছে, সেটা করেই বিপথে চালিত করেছেন। অথচ ইসলামের মৌলিক বিষয়ে তার চিন্তার একটা নৈর্ব্যক্তিক পর্যালোচনা হতে পারত। কিন্তু সেসব দিকে যাওয়ার দরকার নাই, লাফ মেরে চলে আসতে হবে জিহাদ প্রসঙ্গে। যত নষ্টের গোড়া তো এখানেই। জিহাদ নিয়ে কোন ইজতিহাদ করা যাবে না। এবং অদ্ভূতভাবে আমেরিকানদের পছন্দের ইসলামের যোগানদার জামায়াতে ইসলামির এখন প্রধান ভরসা হয়ে উঠছে যে ইউসুফ আল কারযাভি তার কাছ থেকে মুসলমানমঙ্গল’র নায়ক–সেও ইউসুফ–যুক্তি আমদানি করে। জাকির তালুকদারের প্রচেষ্টায় শহুরে মধ্যবিত্তের কাছাকাছি আসতে জামায়াতের আর খুব একটা দেরি নাই। তারা উভয়েই মিলে গাইবে ‘শান্তিবাদী’ ইসলামি সঙ্গীত।
২.
লেখক বইয়ের ব্যাক-কভারে পাঠকের কাছে একটা আহ্বান রেখেছেন বিজ্ঞাপন আকারে। কষ্ট উপশমের জন্য এই উপাখ্যান পড়ে বেদনা ভাগাভাগি করতে। বলেছেন, আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের মুসলমান এবং বাঙালি এই দুই পরিচয় নিয়ে রক্তাক্ত হই। কেন হই, কারা করে? তিনি উল্লেখ করছেন, সেটা হই আমরা আবার দুইদিক থেকে। বাইরের দিক থেকে উন্নত বিশ্বের মানুষ আর ভেতরের দিক থেকে ‘আমাদের পাহাড়সম জাতীয় অজ্ঞতা, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিশাবে গড়ে উঠতে মানুষের অনীহা, ধর্মের নামে প্রতারিত হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা’ই কারণ-পদার্থের অন্যতম। দুঃখের মধ্যে আরো কি আছে সেটা দেখতেই প্রলুব্ধ হয়েছিলাম বইমেলা থেকে বইটি কিনতে। সাথে সবিস্তারে কাহিনীকল্পনার রসায়নে কি উত্তর তিনি তৈরি করেছেন সেটা পরখ করে দেখারও ইরাদা ছিল বৈকি। ‘ইতিহাস’, ‘ধর্মতত্ত্ব’ আর ‘দর্শনের’ উপাদান মিশিয়ে বর্তমনকালের হাড়িতে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের যে খিচুড়ি পরিবেশিত হয়েছে তাতে এই জনগোষ্ঠীর দেহে সত্যিকার আঘাতের ক্ষতবিক্ষত রক্তচিহ্ন, আত্মমর্যাদা ও অধিকার আদায়ের লড়াইগুলো উধাও হয়ে গেছে। সমস্ত আয়োজন ঘিরে রেখেছে ‘অজ্ঞতার পাহাড়’ প্রদর্শনের কাফেলা আর ‘ধর্মের নামে প্রতারিত হওয়ার জন্য উন্মুখ’ থাকা মুসলমানদের আমেরিকান ইসলামের নির্বিচার ভোক্তা বানানোর উপদেশ। প্রকল্পের দিক থেকে এটা সাম্রাজ্যিক খায়েশেরই উত্তম বহিঃপ্রকাশ।
অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থাকা প্রাচ্যবাসী কিংবা মুসলমানদের ‘মানুষ’ (civilize) করার বর্ণবাদী চেষ্টার ধারাবাহিকতায় নতুনত্ব না থাকলেও পাহাড় প্রদর্শনের উদ্যমে যথেষ্ট নতুনত্ব যুক্ত হয়েছে। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস, ধর্মবোধ–নানান লড়াই-সংগ্রাম ও চড়াই-উৎরাই মূর্তবাস্তবতায় সুনির্দিষ্ট রূপ ও পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এখানকার মানুষ নিজের লড়াইয়ের প্রয়োজনে সামনে যাকে অনিবার্য, আপন ও অগ্রসর পথনির্দেশকের ভূমিকায় পেয়েছে তাকেই গ্রহণ করেছে। সেখানে ব্যতিক্রমহীনভাবে ধর্মের ভূমিকা ছিল প্রধান। তথাপি বাঙালি মুসলমানের মানুষ হিশাবে গণ্য হওয়ার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং পরিচয় নির্মাণের ঐতিহাসিক সংগ্রামের সাথে বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্ম সরাসরি যুক্ত। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নিজের আত্মপরিচয়ের প্রয়োজনেই তার সামনে হাজির তথাকথিত ঐতিহ্যের বন্ধন ছিন্ন করে ভিন্নভূমি ও সাংস্কৃতিক উৎস থেকে আগত একটি ধর্মকে মুক্তির অবলম্বন করেছিল। কি তার তাৎপর্য? সেই অন্বেষণের গভীরতায় গিয়ে ইতিহাসের গতিপ্রক্রিয়া থেকে বাঙালি মুসলমানের স্বরূপ সন্ধানের কোন প্রচেষ্টা নাই। নাকি নিছকই আচার-আচরণ নাম-ধামে কিছু পোশাকি পরিবর্তনের বৈচিত্র্য সর্বস্বতা নিয়ে কার্ল মার্কসের ‘হিন্দু ভূত’ বনে যাওয়া উচিত ছিল এদের? সেটা না হওয়াই কি তাদের উন্মুখ প্রতারণার শিকার হওয়ার প্রথম পর্ব? ইসলাম ধর্মের মুক্তিকামী দায়িত্ব ও বিপ্লবী চরিত্র সম্পর্কে সুদৃঢ় অবস্থান ঘোষণার কারণেই কি শেখ আহমদ সেরহিন্দ ‘পুনরুত্থানপন্থী কট্টর’ মুসলমান?
উপনিবেশিক কালপর্ব থেকেই সাম্রাজ্যিক ধ্যানধারণা ও কলকাতার বাবুশ্রেণীর সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে কিভাবে লেখক আত্মসমালোচনা বলে চালিয়ে দেন তার উৎকৃষ্ট নজির, পূর্ববাংলার কৃষকশ্রেণীর ইংরেজ ও জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে যুগপৎ লড়াইয়ের ধারাটিকে যখন জঙ্গি ওহাবি বলে চিহ্নিত করেন। চলনবিলের কোন গৃহবধূর লুকিয়ে মনসা পূজার চাঁদা দেওয়ার ঘটনার সাথে যখন উল্লেখ করেন ওহাবি-ফরায়েজিদের এই ‘সংস্কৃতি’ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের কথা তখন লেখকের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার আবেগের মধ্যে নিরেট সাম্প্রদায়িকতাই আমদানি হয়। কারণ ভুলে গেলে চলবে না, তিতুমির বা শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিঞার জমিদারি শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা অবধারিত অংশ ছিল জমিদারের প্রজা হিশাবে মুসলমান কৃষকদের নানান পূজাপার্বণের খরচ জোগাতে বাধ্য হওয়ার নির্মমতার উচ্ছেদ সাধন। শিরক বা বেদাতের নামে এই ধরনের বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তাকে মৌলবাদ বলে সম্প্রীতির মায়া-কান্না প্রতিক্রিয়াশীলতারই নামান্তর হতে বাধ্য। বৈষয়িক সম্পর্কের মধ্যে সংঘাত ও লড়াইয়ের যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় সেটা কোন ধর্মের আত্মিক ও জাগতিক ইনসাফ বোধের জায়গা থেকে পরিচালিত হলে তা অন্যায্য হয়ে যায় না। শিরক-বেদাত বিরোধী লড়াইও তৎকালে কৃষকের ইহজাগতিক সমস্যার ভেতরে বাস্তব ভিত্তি ও আকার পেয়েছিল। তাছাড়া তারা নিজেদেরকে ওহাবিও বলত না, তাদের পরিচয় ছিল তরিকায়ে মোহাম্মদি। ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ কৃষকের পক্ষে এই বৈপ্লবিক ঘোষণাটি প্রথমে শরীয়তুল্লার কাছ থেকেই এসেছিল। শ্রম, সম্পদ ও মালিকানায় অধিকার লাভের ঘোষিত নীতিটিও ছিল দুর্দান্ত বিপ্লবী। সেইসব ইতিহাস ভালভাবে জানা দরকার। সেসব দিকে না গিয়ে এদেরকে বাঙালির সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য উৎপাত বানানোতেই যত প্রগতিশীল তৎপরতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবন ও জগত সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসের সাথে মানুষের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিও বিনির্মিত হয়। নৃতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার কিম্বা আবহমান ঐতিহ্যের যুক্তির জোরে সাংস্কৃতিক আদর্শ ও চর্চার রূপান্তর বন্ধ থাকে না।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে গোস্বা হওয়ার কারণ এবং এখন সৈয়দ আহমদ বেরেলভিসহ তার অনুসারিদেরকে জঙ্গি ও ওহাবি বলে অবলীলায় বিদ্যমান সাম্রাজ্যবাদী ভাষায় শত্রু চিহ্নিত করার দারকার পড়ল কেন? ইতিহাসের এই প্রক্ষেপের প্রয়োজন ও বয়ানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য উপন্যাসে নায়কের মোকাবিলাপর্বের কর্মকাণ্ড থেকেই পরিষ্কার। বাংলাদেশী মুসলমানদের কালচার বিষয়ে সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা (প্রাচ্যতাত্ত্বিক প্রকল্প) করতে আসা একজন আমেরিকান তরুণী লিসবেথকে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি বুঝানোর মাধ্যমে তার মুগ্ধ বিস্ময়ে প্রেম নিবেদনের সাফল্য অর্জিত হয়। প্রেমের এতবড় জয়গানে বলার কিছু নাই। কিন্তু বিষয়টা তামাশায় পর্যবসিত হয় যখন নিজ দেশের পররাষ্ট্রনীতির উন্মোচনে (সামরিক খরচপাতির খতিয়ান, পাতি-মধ্যবিত্ত অবশ্য পররাষ্ট্রনীতি বলতে এরচে’ অধিক কিছু ধারণা করতে অক্ষম) একজনের রোমান্টিক আবেগ প্রেম নিবেদনে প্রতীকায়িত হয়। ফলে বিকল্প হিশাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ–সেই ‘উগ্রবাদী চরমপন্থা’র চেয়ে কত সহজে সামরিক বাজেটের হিসাব দেখিয়ে প্রেম তৈরি করা যায়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জমানায় শান্তিবাদী ইসলাম নিয়ে প্রেম জাগ্রত করার প্রস্তুতিই তো মোকাবিলাপর্ব! অতঃপর মিলন ও বিবাহ পরবর্তী সেকুলার শিহরণ, আহা বাঙালীত্ব! আহা!
mustain.zahir@yahoo.com